মোহাম্মদ রফিকের একগুচ্ছ কবিতা

পাওয়া না-পাওয়া

বহুকিছু ছেড়েছি জীবনে

এমনকি তোমাকেও,

অথচ তুমিই করে গেলে দান

অন্ধকূপে প্রায় অন্ধ যাত্রা

তুমি শুধু রয়ে গেলে আলোর বর্তিকা

দিগ্বিদিক শূন্য পথে-পথে

কখন ছড়িয়ে গেলে মণিমুক্তাসম

মাঝে মাঝে মুমূর্ষু শ্বাসের মতো

নুড়িবালুপাথরের শব্দ চিত্রকল্প পঙ্ক্তির সংঘাত

দ্বিখন্ডিত মস্তকে দিকভ্রান্ত আশীর্বাদ

পারাপারহীন ওপারের আদিগন্ত রেখা

হাতছানি কোনো এক অক্ষয় ছায়ায়

তুমি তবু দিনরাত্রি অতলের তল

গহীন অাঁধারে সদ্য ফুটে ওঠা পুষ্পের সুঘ্রাণ;

তোমাকে ছেড়েছি বলে,

বয়ে চলি স্তবকে স্তবকে কবিতার অভিশাপ,

মিটে যাক ইহজনমের দায়ভার!

 

 

 

মন্ত্র চাই

 

কিছুকাল স্বপ্নে বেঁচে থাকি

অতঃপর দুঃস্বপ্নের কালো রাত

 

জেগেও জাগিনি তবু অসাড় নিঃসাড়

মনে-মনে ভাবি কবে হবে ভোর

 

এমন দুঃসহ কালে, কালান্তরে

অনাবৃষ্টি খরা ঘামে ভিজে যাওয়া দেহের যন্ত্রণা

 

চৈত্রের দুপুর থেকে যায় যদি যায় দিন

তখনো অনেক দূরে ভাদরের মুখর প্রভাত

 

মাথার ভিতরে গুঞ্জরণ করে দগ্ধ ক্ষুধা

দহনের তাড়নায় নেই বুঝি অবশেষ

 

তবে যাক যা-কিছু যাওয়ার ছিল

থাক শুধু গুরুভার আত্মতৃপ্ত সময়ের

 

স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের ভার বয়ে খিন্ন দেহ;

ধু-ধু শূন্যতার বুকে অবগাহনের মন্ত্র চাই!

 

 

 

শাপমুক্ত হলে

 

পুড়িয়েছি ঘরবাড়ি

উৎপাটন অকাতরে গৃহস্থ সংসার

একে-ওকে হত্যা করে নির্বিচারে

চালিয়েছি নরমেধযজ্ঞ চতুর্দিকে

রাস্তার ধুলোয় লাশ ফেলে রেখে

দেখে, অসহায় রক্তস্রোত

হেসেছি নৃশংস নারকীয় অট্টহসে,

কেউ তো চিনি না কাউকে চিনতেও চাইনি

তবু একে-ওকে শত্রু ভেবে

চালিয়েছি ছুরি-কাঁচি গ্রেনেড চাপাতি

আত্মতৃপ্ত বিকৃত ক্ষুধার অহংকারে দুরভিসন্ধির

গড়ে তোলে ধ্বংসস্তূপ পাহাড় সমান

হয়তো-বা এর থেকে মুক্তি মিলবে

পাঁচশত বছরের পরপারে,

অতিক্রান্তকালে!

 

 

শাহীনা

 

শাহীনা, তোমার সঙ্গে যেতে চাই,

কবিতার শব্দ ছন্দ লয় পঙ্ক্তির বিন্যাস

তোমার মৃত্যুর চেয়ে কোনো কিছু অধিক যন্ত্রণা নয়;

 

শেষ মুহূর্তের আর্তকণ্ঠ, ভাই ছেড়ে যেও না আমাকে

ঢাকা পড়ে আগুনের লেলিহান জ্বলন্ত শিখায়,

তখনো বা বুঝি বেঁচে ছিল চোখে জীবনের ঘোর;

 

নেমে এলো অন্ধকার তুমি পড়ে রইলে অসহায়

অতঃপর মৃত্যু এসে কোলে তুলে নিল ধীরে ধীরে

সেই মুহূর্তের ক্ষণ ধরা পড়বে না কল্পনায়

 

কোথায় নিবাস ছিল বাড়িঘর সন্তানের মুখ

কাফনের ধবধবে সাদা থানে আবৃত অনড়

এখন তোমার যাত্রা স্মৃতিহীন অনন্ত আকাশে,

 

পড়ে রইল পাপবিদ্ধ আত্ম অনুশোচনায় ছিন্নভিন্ন

এই অপরাধবোধ হয়তো-বা কোনো এক দুর্জনের

তবু, ক্ষমা করে দিও বোন এই অক্ষম আবেগ

 

শাহীনা, তোমার সঙ্গী হতে চাই, কিন্তু সেই পথ

রুদ্ধ আজ; কাল নিয়তির অভিশাপ বুকে

পাথরের চাঁই বেঁধে পড়ে থাকি কবিতায়

 

চুন-কালি ইট-সুরকি ধ্বংসযজ্ঞ ভবনের

অন্তহীন নির্বিবেক বিকারের ঘোরে;

জানি, তুমি জেগে উঠবে বারবার কবরের মাটি ফুঁড়ে!

 

 

স্বাদ

 

রসগন্ধে ভরপুর জীবনের স্বাদ

শীত-বিকেলের রোদ মধুর মধুর

স্মৃতি-বিস্মৃতির মৌ-মাছিদের ভিড়

অতিক্ষুদ্র জ্বালাতন মদির নিদ্রায়,

 

কতশত জনমের অভিশাপ বয়ে

আমি একা মুহ্যমান নিমগ্ন চিন্তায়

ঘোর ভাঙে চতুর্দিকে উড়ন্ত পাখার

ভ্রাম্যমাণ পোকা-মাকড়ের ভিড় ছুঁয়ে,

 

কালের যাত্রায় মহাক্ষণ গুনে-গুনে

ন্যুব্জ দেহ টেনে তুলি ঘরের দাওয়ায়!

Published :