ম্যান্ডেলা, গান্ধীবাদ ও জনমুক্তির আকাঙ্ক্ষা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

২০১৩ সালের ডিসেম্বর প্রথম সপ্তাহে পৃথিবীজুড়ে যে একটি বিশেষ ঘটনা গভীর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল সেটি হলো নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু। তাঁর বয়স হয়েছিল, তিনি অসুস্থ ছিলেন, সেই অসুখের খবর বিশ্ববাসী জানতো, এবং তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। ৬ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুতে সারাবিশ্ব শোক প্রকাশ করেছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য প্রায় সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রনায়কেরা দক্ষিণ আফ্রিকায় সমবেত হয়েছেন। একজন কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুতে শোকের এমন সর্বজনীন প্রকাশ আগে কখনো ঘটে নি। প্রয়াণের কালে তাঁর মতো আন্তর্জাতিক সম্মান কম রাষ্ট্রনায়কই পেয়েছেন। এর কারণ মোটেই অস্পষ্ট নয়। ব্যক্তি হিসাবে তিনি ছিলেন অসামান্য এবং তাঁর রাজনৈতিক অর্জন ও সাফল্য ছিল অনন্যসাধারণ। সেই সঙ্গে আরো একটি ঘটনা ছিল, সেটি হলো সমকালীন বিশ্বের জন্য তাঁর প্রয়োজনীয়তা।

গণমাধ্যমে বলা হয়েছে তিনি গান্ধীবাদী ছিলেন; আবার রাজনৈতিক জীবনে যখন তিনি সক্রিয় ছিলেন তখন বলা হতো তিনি আসলে একজন ছদ্মবেশী কমিউনিস্ট। ব্যাপারটা মোটেই রহস্যমন্ডিত নয়। গান্ধীবাদের সঙ্গে তাঁর নৈকট্য ছিল, আবার দূরত্বও ছিল; এই দূরত্বটা এতটাই যে সেখানে তিনি প্রায় কমিউনিস্ট। এই দুই বিপরীতের মাঝখানে ম্যান্ডেলা নিজের জন্য এমন একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন যেটা ছিল বিশিষ্ট এবং বিশ্বজনমতের কাছে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য। বলা যায় একালের বিশ্ববাসী এমন একটি ভাবমূর্তির জন্য অপেক্ষা করছিল।

পুঁজিবাদের এখন দুরন্ত একাধিপত্য; কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আবার সঙ্কটের ভেতরও আছে। সঙ্কটটি বাইরের নয়, ভেতরেরই। এই সঙ্কটে এমন একজন মানুষের উপস্থিতি ব্যবস্থাটিকে আশ্বস্ত করে যিনি উদারনৈতিক, যিনি বঞ্চিত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করেছেন, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল ও গৌরবজনক একটি ভূমিকা রেখেছেন, অথচ যিনি উগ্রপন্থী নন, সমঝোতায় বিশ্বাসী। দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন, সশস্ত্র সংগ্রাম করেছেন, সংগ্রামের ভেতর দিয়েই বর্ণবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকে ভেঙে ফেলেছেন; কিন্তু কাজটা রক্তাক্ত বিপ্লবের পথে করেন নি, যেমনটা কমিউনিস্টরা করে থাকে, করেছেন গণতান্ত্রিক উপায়ে, অর্থাৎ সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যাধিক্য ছিল বিপুল, প্রায় আশি শতাংশ মানুষ তারাই, তাই সর্বজনীন ভোটের অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া মাত্রই সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গরা রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হলো, ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রপতি হলেন, যেটা এক সময়ে অসম্ভব মনে হতো।

কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ শাসন শ্বেতাঙ্গদের জন্য কোনো বিপর্যয় ডেকে আনলো না, তাদেরকে ধাওয়া করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হলো না, বরঞ্চ তাদের সঙ্গে সমঝোতা করা হলো। উদারনীতির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন বৈকি। যে আমেরিকানরা কমিউনিস্টভীতি ও কমিউনিস্টবিদ্বেষের জন্য জগৎবিখ্যাত ম্যান্ডেলাকে তারা কমিউনিজমপন্থী হিসাবেই জানতো, এবং জেনে নিশ্চিন্ত ছিল; ২০০৮ সালেও ম্যান্ডেলা ও তাঁর দল আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসকে সন্ত্রাসীদের কালো তালিকাভুক্ত করে রাখতে কোনো অসুবিধাই হয় নি, তাঁর মৃত্যুতে সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সব কাজ ফেলে স্বয়ং চলে এসেছিলেন প্রয়াত এই নেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে। ম্যান্ডেলা তখন রাষ্ট্রপতি নন, একজন সাধারণ নাগরিক বৈকি। এই শ্রদ্ধা কেবল যে একজন ব্যক্তির প্রতি তা নয়, ওই ব্যক্তিটি সহনশীল উদারতা ও সমঝোতার যে অতিমহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তার প্রতিও বটে। এমন একটি দৃষ্টান্তের প্রয়োজন ছিল, দৃষ্টান্তের সে-চাহিদা ম্যান্ডেলা সুন্দরভাবে মিটিয়েছেন।

ওবামা নিজেও চাহিদা মেটানোর দৃষ্টান্ত বটেন। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা অবহেলিত ও বঞ্চিত। সংখ্যায় তারা অনেক, তাদের মধ্যে বিভেদ ও অসন্তোষ ফুঁসে উঠছে। ওদিকে জর্জ বুশের প্রকাশ্যে রক্ষণশীল এবং অপ্রকাশ্যে বর্ণবাদী নেতৃত্বে রিপাবলিকানরা অর্থনীতিতে দুর্দশা ঘটিয়েছে, যুদ্ধবাজ বলে বিশ্বে নাম করেছে, অথচ দৃশ্যমান বিজয় অর্জন করতে পারে নি। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকার জন্য এমন একজন ডেমোক্রাটকে প্রয়োজন ছিল যিনি তরুণ, উদ্দীপক বক্তা, তিনি স্বপ্নের কথা যদি শোনাতে পারেন তা হলে ভালো হয়, আর যদি কৃষ্ণাঙ্গ বংশোদ্ভূত হন তবে তো সোনায় সোহাগা। ওবামার মধ্যে আমেরিকানরা তেমন একজন নেতাকেই খুঁজে পেয়েছেন, এবং তাঁকে একবার নয় দু’বার প্রেসিডেন্ট করেছেন। গরজ কোনো নিষেধ মানে না, এক্ষেত্রে ও মানে নি। সেই ওবামাই যখন ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে যান তখন ব্যাপারটা ব্যক্তিগত থাকে না, উদারনৈতিক সমঝোতার ভেতর দিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার একটি নজিরকে উচ্চমূল্য দানের ঘটনা ঘটে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এটি একজন কৃষ্ণাঙ্গ নেতার প্রতি অন্য একজন কৃষ্ণাঙ্গের প্রণতি বলে মনে হলেও ভেতরের তাৎপর্য হলো ব্যবস্থা সংরক্ষণে সহায়তাদানকারী একজন নেতার প্রতি সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার অভিনন্দন। সর্বজনীন ভোটে ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ১৯৯৪ সালে, তার আগের বছর তিনি শান্তির নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সেটিও তাঁর ওই সমঝোতা স্থাপনের মনোভাবকে উৎসাহ দানের অভিপ্রায় দ্বারা অনুপ্রাণিত বলেই মনে করবার কারণ আছে। পুরস্কারটি একলা তাঁকে নয়, তাঁর এককালীন অমসৃণ শত্রু ও দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পি ডব্লু ক্লার্ককেও দেওয়া হয়, এবং উদার সমঝোতার মনোভাব নিয়ে ম্যান্ডেলা তাঁর সঙ্গে একত্রে পুরস্কারটি নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন নি। হরিণ মিলেছে বাঘের সঙ্গে। নিশ্চিত ও আশ্বস্ত হয়েছে পুঁজিবাদী দুনিয়া।

অপর পক্ষে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কাছেও ম্যান্ডেলা ছিলেন একজন শ্রদ্ধেয় নেতা। দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের হয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন, কষ্ট ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, পরোয়া করেন নি বাঁচা না-বাঁচার। নত হন নি কোনো বিপদের কাছে, হতাশ হন নি এক মুহূর্তের জন্যও। তাঁর এই কাজে বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানুষের কাছে আশার বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ওই মানুষদের জন্য এই আশার খুবই প্রয়োজন ছিল। ম্যান্ডেলা এই প্রত্যাশাটিও মিটিয়েছেন।

ওদিকে জনমাধ্যমের জন্যও তাঁর মতো একজন নেতার প্রয়োজন ছিল। এটি মিডিয়ার যুগ, আর মিডিয়া খুবই ক্ষুধার্ত। সর্বক্ষণ খাদ্য খুঁজতে থাকে, এবং প্রচারের জন্য উপযুক্ত ভাবমূর্তি পেলে তারা খুবই খুশি হয়। ম্যান্ডেলার অসুখ থেকে শুরু করে, মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সবকিছুর বর্ণনার কাজটি মিডিয়া অত্যন্ত সন্তোষ ও নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। খুঁটিনাটি পর্যন্ত বাদ দেয় নি। শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে ওবামার বক্তৃতা প্রচারের ইশারা-অনুবাদে একটা ত্রুটি ঘটেছিল, এই অনুবাদটি অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে করা হয়, বধির দর্শক-শ্রোতাদের জন্য। মিডিয়া সেটা নিয়েও কম হৈচৈ করে নি। মিডিয়ার কারণে ম্যান্ডেলা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের গৃহাভ্যন্তরে পৌঁছে গেছেন।

ইতিহাস সফল মানুষদেরকেই বীর হিসাবে গণ্য করে, কারণ সফল মানুষদের হাতেই ইতিহাস রচিত হয়। ম্যান্ডেলার লক্ষ্য ছিল বর্ণবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকে ভাঙবেন। সেটা তিনি ভেঙেছেন। এই সাফল্যই তাঁর অন্যান্য গুণের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি মর্যাদা পেয়েছেন বীরের। কেন এবং কোন পথে ও কি ধরনের পদক্ষেপের কারণে তিনি সাফল্য অর্জন করলেন       সে-বিষয়ে আমরা অবহিত হয়েছি।

দুই

প্রথম কথা, ব্যক্তি হিসাবে তিনি ছিলেন বিস্ময়কর। তাঁর ছিল নেতৃত্বদানের জন্মগত মেধা। মানুষকে তিনি আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। সহযোদ্ধারা তো অবশ্যই, তাঁর শত্রুপক্ষও তাঁর ব্যক্তিগত আচরণের প্রশংসা করেছেন। সহযোদ্ধারা দেখেছেন তিনি কেমন অকুতোভয়, প্রজ্ঞাবান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে তিনি নেতৃত্ব দেবেন। সর্বস্তরেই তিনি নেতা ছিলেন। বারবার কারারুদ্ধ হয়েছেন, জনসমক্ষে তাঁর উপস্থিতি সরকারি আদেশে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, আন্দোলনের প্রয়োজনে তিনি আত্মগোপনে বাধ্য হয়েছেন, নাম বদলেছেন, ছদ্মবেশের কারণে চেহারাতেও পরিবর্তন এনেছেন, চলাফেরার সুবিধার জন্য ট্যাক্সি-ড্রাইভারের কাজ নিয়েছেন, বিনা পাসপোর্টে বিদেশে গেছেন, উদ্দেশ্য জনসমর্থন ও বস্ত্তগত সাহায্য সংগ্রহ। গোপনে ইংল্যান্ডে চলে গেছেন, দেখা করেছেন লেবার ও লিবারেল পার্টির সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের সঙ্গে। একটানা সাতাশ বছর বন্দি থেকেছেন, যার মধ্যে আঠারো বছর ছিলেন দ্বীপান্তরে। কিন্তু যখন যেখানে যে-অবস্থাতেই থাকুন না কেন, ছিলেন জনগণের আন্দোলনের সঙ্গে। জেগে থাকার সময়ে তো বটেই, স্বপ্নেও তিনি দেশবাসীর মুক্তির জন্য সংগ্রামের কথা ভাবতেন। এটা জানতেন তাঁর সহযোদ্ধারা, টের পেতেন দেশের মানুষ। জীবনভর তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক যোদ্ধা, আর সে যুদ্ধটা ব্যক্তিগত ছিল না, ছিল সমষ্টিগত। তাঁকে বিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টা হয়েছে। বন্দি অবস্থায় যখন রবেন দ্বীপে নির্বাসিত, তখন কর্তৃপক্ষ তাঁকে স্বতন্ত্র খাবার দিতে চেয়েছে। কারসাজিটা বুঝতে তাঁর কষ্ট হয় নি। কর্তারা তাঁকে বন্দি করে সন্তুষ্ট হয় নি, ওরা চেয়েছিল তাঁকে আলাদা করে ফেলবে, এবং বুঝতে দেবে যে তিনি সকলের মতো নন; বড়মাপের মানুষ, তৈরি করবে অহমিকা। এসব চালে ম্যান্ডেলার সাড়া দেবার কথা নয়, তিনি দেনও নি। অন্য বন্দিদের মতোই অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার খেয়েছেন, কায়িক শ্রম করেছেন, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এমনকি ক্ষয় রোগে আক্রান্ত পর্যন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কখনোই নিজেকে বিশিষ্ট অথবা বিচ্ছিন্ন ভাবেন নি। বন্দিদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে নালিশ করতে হতো, তিনিই লিখতেন অভিযোগপত্র, লিখতেন সকলের পক্ষ হয়ে, সকলের অসুবিধার কথা জানিয়ে। কর্তারা বলতো, তুমি একজন বন্দি, তুমি তোমার নিজের অভিযোগ থাকলে তার কথা বলো। ম্যান্ডেলা বলতেন, অন্য বন্দিদের কথা ও তাঁর কথা অভিন্ন, আলাদা করে তাঁর নিজস্ব কোনো অভিযোগ নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সকল কাজেই প্রতিফলিত হয়েছে। ব্যক্তিগত আচরণে ছিলেন পরিপূর্ণরূপে সাম্যবাদী।

কোন সিদ্ধান্তটি সঠিক অনেক সময়ে সেটা জানতেন, কিন্তু কখনোই তা চাপিয়ে দিতেন না। সকল সিদ্ধান্তই ছিল সম্মিলিত। পদ্ধতি ছিল গণতান্ত্রিক। অপরের কথা শোনার ব্যাপারে ম্যান্ডেলার ধৈর্য দেখে সহকর্মীরা বিস্মিত হয়েছেন। নিজের মত দলের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে কখনো পাওয়া যাবে না। এবং সম্মিলিত সিদ্ধান্তের বাইরে যেতেন না। পার্টির নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। অথচ তিনিই ছিলেন নেতা। প্রায় সর্বেসর্বা। এটা জানতো তাঁর কর্মীরা, জানতো দেশবাসী। জানতো তিনি সঙ্গে আছেন। বন্দি অবস্থাতে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কঠিন ছিল, তার মধ্যেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে দেন নি। খবর রেখেছেন। অভিনন্দন জানিয়েছেন। স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা কেউ কেউ বন্দি ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, তাঁকে বুঝতে ও আপোসের পথে নেয়া যায় কি-না বাজিয়ে দেখতে; তাঁরা দেখেছেন তিনি অনড়, তাঁদেরকে বলে দিয়েছেন তাঁর দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) যে ‘মুক্তির ঘোষণাপত্র’ (ফ্রিডম চার্টার) দিয়েছে তিনি তার বাইরে যেতে পারেন না; তাছাড়া বন্দি অবস্থায় তাঁর পক্ষে কোনো কিছুই বলা সম্ভব নয়, তাঁকে আলাপ করতে হবে দলের সঙ্গে পরামর্শ করে। দল তাঁকে সর্বাধিনায়ক মনে করতো, কিন্তু নিজেকে তিনি কখনো সে-ভাবে দেখেন নি। সংগঠনে বহু মানুষ আছেন, বহু ধরনের মানুষ, কেবল যে একালের তা নয়, পূর্বকালেও, তাঁদের সকলের আত্মত্যাগ ও প্রজ্ঞাতেই দলটি গড়ে উঠেছে, এটা শুধু প্রকাশ্যে বলেন নি, অন্তরেও বিশ্বাস করতেন। জাতীয়তাবাদী নেতাদের ভেতর এমন দৃষ্টান্ত দেখতে পেলে চমকে উঠতে হয় বৈকি।

হতাশা এবং সময়ের অপচয় এ দু’টির কোনোটিই ম্যান্ডেলার চরিত্রে ছিল না। বছরের পর বছর বন্দি থেকেছেন, সেই সময়ে যত পারেন পড়েছেন এবং লিখেছেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘লঙ ওয়াক টু ফ্রিডম’  তিনি রবেন দ্বীপে বন্দি অবস্থাতে লিখেছেন। সে-বইয়ের পান্ডুলিপি বাইরে পাঠানো যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ ছিল; সহবন্দিরা তাই অনুলিপি তৈরি করে দিয়েছেন, এবং মূল পান্ডুলিপিটি তাঁরা লুকিয়ে রেখেছিলেন মাটির নিচে। এমনি ছিল যৌথ কার্যক্রম। ম্যান্ডেলা শিক্ষায় বিশ্বাস করতেন, নিজের শিক্ষায় এবং অপরের শিক্ষায়। রবেন দ্বীপে বন্দিদের নিয়ে তিনি ক্লাস করতেন, যে জন্য দ্বীপটির নামই হয়ে গিয়েছিল ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়। কর্তৃপক্ষ দেখেছে মানুষগুলো সচেতন হয়ে উঠছে, সে জন্য আঠারো বছর পরে ওই দ্বীপ থেকে তাঁকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

অবস্থাপন্ন পরিবারে জন্মেছিলেন। প্রথম জীবনে স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হবেন। নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশোনা করতে পারেন নি। ছাত্র-আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য বহিষ্কৃত হয়েছেন। তবু ছাত্রত্ব ছাড়েন নি, স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে বি.এ. ডিগ্রি নিয়েছেন। তারপরে তো সার্বক্ষণিকভাবে রাজনীতিতে যোগদান। এর মধ্যেই একবার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে জোহানেসবার্গে আইনজীবী হিসাবে কাজ করতে। বেশি দিন সে কাজ চালানো সম্ভব হয় নি। বর্ণবাদী পৃথকীকরণ আইনে কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের জন্য শ্বেতাঙ্গদের শহরে অফিস খোলা নিষিদ্ধ ছিল। ওরা দুই বন্ধু সে আইন অমান্য করেই অফিস চালিয়েছেন, এবং তখন আদালতে মামলা করতে গিয়ে বর্ণবাদের হাতে মানুষ কীভাবে নির্যাতিত হচ্ছে সে বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেছেন, যা ওই প্রথা অবসানের ব্যাপারে তাঁর অঙ্গীকারকে আরো দৃঢ় করেছে।

১৯৬২ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ম্যান্ডেলা নিজের মামলা নিজেই পরিচালনা করেন, এবং সাক্ষীদের যে-ভাবে জেরা করেন তা অন্যকোনো আইনজীবী করতে পারতেন কি না সন্দেহ। আদালতের বিচারক, বাদীপক্ষ, সাক্ষী, পুলিশের কর্মকর্তা, এমন কি চাপরাসিটি পর্যন্ত ছিল শ্বেতাঙ্গ, তিনি একাই কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ আদালতে তিনি এক কৃষ্ণাঙ্গ আসামি। জানতেন তাঁর শাস্তি হবে, পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ডাদেশ হয়েছিল বৈকি, কিন্তু ছিলেন তিনি অকুতোভয়। আদালতকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কারাভোগ যখন শেষ হবে তখন আবার আমাকে এই সংগ্রামে যেভাবে সম্ভব যতটা সম্ভব যোগ দিতে হবে, এবং সে কাজ চলবে যত দিন না রাষ্ট্রীয় অন্যায় চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হচ্ছে।’

কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থাতেই পরের বছর আরো বড় একটি মামলায় অভিযুক্ত করে তাঁকে আদালতে এনে হাজির করা হয়েছিল। বন্দিত্বের ওই এক বছরে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, কিন্তু মনোবল এতটুকু হ্রাস পায় নি। তাঁর পক্ষের আইনজীবী বিস্মিত হয়েছেন এটা দেখে যে, ম্যান্ডেলা আগের মতোই সহজ, বন্ধুবৎসল, সাহসী; তিনি কথা বলছেন স্বাভাবিকভাবে, হাসছেন যেমন সবসময়েই হাসতেন।

তাঁর সঙ্গে আরো নয়জন অভিযুক্ত হয়েছিলেন। আশঙ্কা ছিল চরম শাস্তি দেওয়া হবে – হয়তো মৃত্যুদন্ড নয়তো যাবজ্জীবন কারাদন্ড। অভিযুক্তরা কেউই বিচলিত হন নি। ক্ষমা চাইবার প্রশ্নই ওঠে নি। সকলেই ছিলেন অচঞ্চল। এক্ষেত্রেও নেতা ছিলেন ম্যান্ডেলা। তাঁরা একটা বিষয় নিয়েই শুধু আলোচনা করছিলেন, সেটা হলো আদালতে যখন মৃত্যুদন্ডাদেশ উচ্চারণ করা হবে তখন তাঁরা কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। তাঁদের আইনজীবীরা বলেছেন, বিচারক ম্যান্ডেলাকেই প্রথম সম্বোধন করবেন, যেহেতু তিনি পয়েলা নম্বরের আসামি। তাঁকে বলা হবে, ‘আপনি কি এমন কোনো যুক্তি দিতে পারবেন কেন আপনার মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হবে না?’ ম্যান্ডেলা ঠিক করলেন একটি নয়, বেশ কিছু কথা বলবেন। তিনি বলবেন যে, মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়ে সরকার যদি ভেবে থাকে যে, মুক্তির আন্দোলনকে শেষ করে দিতে পারবে, তাহলে তারা ভুল করবে। কেননা তিনি মরতে প্রস্ত্তত আছেন, কারণ তিনি জানেন তাঁর মৃত্যু তাঁর দেশবাসীকে তাদের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

আদালতে তিনি যে লিখিত বিবৃতিটি দেন সেটি একটি অসাধারণ দলিল। তখন সেটা সাড়া ফেলেছিল, এখনো পড়লে বোঝা যায় কেমন অসামান্য ছিল তাঁর লেখার ক্ষমতা ও যুক্তিবাদিতা। বক্তা হিসেবে তাঁর সঙ্গে তুলনা করার মতো মানুষ তাঁর আশেপাশে দ্বিতীয়টি ছিল না। বক্তৃতাতে যেমন লেখাতেও তেমনি, আবেগ ছিল, কিন্তু ভাবালুতা ছিল না, বাগাড়ম্বর তো নয়ই। সরল, স্বচ্ছ বাক্যে বক্তব্য উপস্থিত করেছেন। ক্রোধ ও ঘৃণাকে সম্বরণ করেছেন ভাষার সাহায্যে, কিন্তু যেটুকু প্রকাশ পেয়েছে তা যে কোনো পাঠককে নাড়িয়ে দেবে। শ্বেতাঙ্গ শাসকদের কারো পক্ষেই এ-ধরনের কোনো রচনা প্রস্ত্তত করা সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না, এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বুর্জোয়াদের চাইতেও বুর্জোয়া। অভিযোগ খন্ডন করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, চেয়েছিলেন আদালতকে ব্যবহার করে নিজেদের বক্তব্য প্রচার করবেন। ওই প্রচার তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল; পত্রিকাতে খবর আসতো না, কোনো ছাপাখানা তাঁদের ইস্তেহার পর্যন্ত ছাপতে সাহস পেত না। তাঁরা কী চান, কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছেন, কেন লড়ছেন, কিভাবে লড়ছেন সব কিছু পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। প্রমাণ করে ছেড়েছেন যে, অপরাধী তাঁরা নন, অপরাধী আসলে যাঁরা তাঁদের বিচার করছে তাঁরাই। সন্ত্রাসের কারণ হচ্ছে বর্ণবাদ, তার শিকার হচ্ছে জনসাধারণ। অথচ ওই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ করছেন বর্ণবাদী সরকার তাঁদেরকেই আসামি করেছে।

আদালতে প্রদত্ত ওই জবানবন্দিটি প্রচার পেয়েছে। বিশ্বের নানা স্থানে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল জাতিসংঘে এই মর্মে একটি অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব গ্রহণ যে ওই মামলার অভিযুক্তসহ দক্ষিণ আফ্রিকার সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। ম্যান্ডেলা নিজেও একটি অসম্ভব ব্যক্তিগত কাজ করেছিলেন। মামলার রায় বের হবার কথা ছিল বৃহস্পতিবারে, সোম ও মঙ্গলবারে কারাগারে বসেই তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ডিগ্রির জন্য যে উত্তরপত্রগুলো লেখা বাকি ছিল সেগুলো লেখা শেষ করে ফেলেছিলেন। যথাসময়ে তিনি ওই ডিগ্রি লাভ করেন।

বিচারে দশজনের মধ্যে ম্যান্ডেলাসহ আটজনেরই যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ হয়েছিল। সবাইকে পাঠানো হয়েছে এ্যাটলান্টিকের একটি দ্বীপে, নাম যার রবেন আয়ল্যান্ড। সেখানে বিপজ্জনক অপরাধীদের রাখা হতো। ম্যান্ডেলার সঙ্গীদের মধ্যে একজন ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, তাঁকে কিন্তু দ্বীপের নির্বাসনে পাঠানো হয় নি, মূল ভূখন্ডের কারাগারে রাখা হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বর্ণবাদী নীতি এক্ষেত্রেও অকার্যকর থাকে নি। নীতির স্বভাবটি ছিল এমনই অনৈতিক।

বর্ণবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদের ব্যাপারে ম্যান্ডেলা কৈশোর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অনড় ছিলেন, এবং তিনি সাফল্য অর্জন করেছেন। এই সাফল্য তাঁর নেতৃত্বে ঘটেছে, কিন্তু তিনি নিজে কখনোই মনে করতেন না যে, এটি তাঁর একার কাজ। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী দল অত্যন্ত কার্যকর ছিল, সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টিও একই লক্ষ্যে সংগ্রাম করেছে, শেতাঙ্গদের মধ্যে যাঁরা উদারচেতনাসম্পন্ন তাঁরাও কম-বেশি চেয়েছেন এই অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং সম্পূর্ণ অমানবিক ও অস্বাভাবিক ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে। বিশ্বজনমতও পরিবর্তনের পক্ষে গড়ে উঠেছিল এবং প্রকাশ পাওয়া শুরু করেছিল। কমনওয়েলথ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বহিষ্কার, অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিয়নে সদস্য পদ না-দেওয়া, জাতিসংঘে আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ, সব কিছুই প্রভাব ফেলেছে। আফ্রিকার বহুদেশই ততদিনে স্বাধীন হয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেও স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, কিন্তু সেটা ছিল শ্বেতাঙ্গদের স্বাধীনতা। দেশের সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের মতামত নেওয়া হয় নি। বরঞ্চ তাদেরকে ক্রমাগত নিপীড়নমূলক আইনের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদেরকে আটক করে রাখা হয়েছে বিশেষ এলাকায়। খনিতে ও কারখানায় তারা মজুরি পায় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অনেক কম। সবচেয়ে বড় অন্যায় ছিল এটা যে, কৃষ্ণাঙ্গ মেহনতি মানুষেরা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারত না, তাদের পরিবার আটক থাকতো কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ এলাকাতে। সেখান থেকে কেউ যদি শহরে আসতে চায়, যে শহরগুলো শ্বেতাঙ্গদের, তাহলে প্রবেশপত্র লাগে। যেন ভিন্ন রাষ্ট্রে যাচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের খামারে কাজ করে, কিন্তু সেখানেও পরিবারের সঙ্গে তাদের থাকার অনুমতি নেই, পরিবার থাকে চিহ্নিত বিশেষ বিশেষ এলাকায়। উল্লেখ্য যে, ভূমি প্রশ্ন ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সামাজিক বৈষম্যের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি, ভূমির সাতাশি শতাংশ ছিল শ্বেতাঙ্গদের মালিকানায়, যে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার পনের শতাংশেরও কম। কয়লা, স্বর্ণ, হীরক সম্পদ ছিল দেশটির সমৃদ্ধির মূল কারণ, সেগুলোর মালিকানা পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গদের দখলেই থেকেছে, কৃষ্ণাঙ্গদেরকে কাজে লাগানো হতো বিপজ্জনক খনন শ্রমিক হিসাবে।

কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের গৃহেও কাজ করতো, তাদের ছাড়া আর কে করবে, শ্বেতাঙ্গরা কী শ্বেতাঙ্গদের চাকরবাকর হবে? কিন্তু ওইসব কর্মীকে নিজেদের পরিবার নিয়ে থাকতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না, পরিবার থাকতো গ্রামের বাড়িতে; এখন যেমন আমাদের দেশের অনেক মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় গৃহদাসত্ব করে, অনেকটা সেই রকমের ব্যাপার। এই ধরনের কৃত্রিম একটা ব্যবস্থা যে চিরস্থায়ী হতে পারে না সেটা তো পরিষ্কার। ভেতরে ভেতরে তা দুর্বল হয়ে পড়ছিল।

কৃষ্ণাঙ্গরা বিক্ষুব্ধ হচ্ছে। তারা সংগঠিত হচ্ছে। আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেস ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। প্যান আফ্রিকান কংগ্রেস নামে অন্য একটি রাজনৈতিক দলও এগিয়ে এসেছে। এই দল বরঞ্চ ছিল আরো দৃঢ়। এএনসি’র ডাকে ১৯৫০ সালে মে দিবসের এক শ্রমিক সমাবেশ হয়। পুলিশ সেখানে গুলি ছোড়ে, এবং তাতে ১৮ জন নিহত হন। এএনসি এর প্রতিবাদে ২৬ জুন সাধারণ ধর্মঘট ডাকে। ধর্মঘট সফল হয়েছিল। দু’বছর পরে ১৯৫২-তে এএনসি ও তার সহযোগীরা মিলে নির্দিষ্ট কয়েকটি আইনের বিরুদ্ধে অমান্য আন্দোলনের ডাক দেয়। এতে কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় যোগ দেন। সাড়ে আট হাজার মানুষকে আটক করা হয়।

নেতা ও কর্মীদের ধরপাকড় ও জেল-জুলুম অব্যাহত ছিল। এরি মধ্যে ১৯৫৫ সালে মূলত এএনসি’র উদ্যোগে কংগ্রেস অব দি পিওপল নামে একটি সর্বদলীয় সম্মেলন আহবান করা হয়। বিভিন্ন ভাষায় দেশের সর্বত্র প্রচারপত্রের মাধ্যমে আহবানের খবরটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সরকারি ন্যাশনালিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গ দলকেও যোগদানের আহবান জানানো হয়েছিল; তারা কেউই সাড়া দেয় নি। না-দেওয়াটা ছিল প্রত্যাশিত, কিন্তু যা ছিল অপ্রত্যাশিত তা হলো সরকার ওই সমাবেশকে নিষিদ্ধ করে দেয় নি। তবে সরকার ‘শান্তিপূর্ণ’ উপায় অবলম্বন করেছে সম্মেলনকে বানচাল করে দিতে, যেমনটা আমাদের দেশে করা হয়ে থাকে। প্রথমত, শ্বেতাঙ্গ পত্রিকায় সম্মেলন ডাকার কোনো খবর প্রকাশ পায় নি। দ্বিতীয়ত, শ্বেতাঙ্গ এলাকা জোহানেসবার্গে সম্মেলন করার অনুমতি দেওয়া হয় নি, যার দরুন আয়োজনটি করতে হয়েছে শহরের বাইরে গ্রামের পরিত্যক্ত একটি খোলা মাঠে। তৃতীয়ত, দূরবর্তী এলাকা থেকে প্রতিনিধিরা যাতে আসতে না পারেন সে জন্য কিছুসংখ্যক বাসকে পথিমধ্যে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও কোথাও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে, ড্রাইভারদের যে আটক করা হয় নি এমনও নয়। এসব প্রতিবন্ধক অতিক্রম করে প্রায় তিন হাজার প্রতিনিধি এসে সম্মেলনস্থলে পৌঁছান; এঁদের মধ্যে দুই হাজারের বেশি ছিলেন আফ্রিকান, দুইশত করে শ্বেতাঙ্গ, ভারতীয় ও মিশ্রবর্ণের মানুষ। ক্ষুদ্র পরিসরে যেন সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকারই প্রতিবিম্ব। পুলিশকে দেখা গেল আলস্য ভরে ঘুরছে, কমলালেবু খাচ্ছে, সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে এবং রাইফেল ঘোরাচ্ছে। শনিবারে সম্মেলন শুরু হয়, রবিবার বিকেলে পুলিশ সম্মেলন এলাকায় সদর্পে প্রবেশ করে, বিশেষ বাহিনীর লোকেরা কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু তারা সফল হয় নি। সম্মেলন ঠিকমতোই শেষ হয়েছে। এই সম্মেলনেই জরুরি সেই ‘মুক্তির ঘোষণাপত্র’টি গৃহীত হয়, যেটি এএনসি’র মূল রাজনৈতিক দলিল হিসাবে কাজ করেছে, এবং যার ভিত্তিতে পরবর্তী আন্দোলন অগ্রসর হয়েছে।

ওদিকে জনজীবনে বিক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছিল। জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত ছিল। বাড়ি ভাড়া ও যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে একাংশ শিক্ষিত হয়ে উঠেছে, কারো কারো ধনবৃদ্ধিও ঘটছে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে এরাও অপমানজনক বর্ণপৃথকীকরণ ব্যবস্থার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে। ট্রেনে, পোস্ট অফিসে, স্কুলে, অফিসে, কারখানায়, পথচলার রাস্তায় সর্বত্র কালোদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ক্রমশ সহ্যের সীমাটাকে ভেঙে ফেলতে চাইছিল। এরি মধ্যে ঘটে গেল একটি রক্তাক্ত ঘটনা। ১৯৬০ সালে প্যান আফ্রিকান কংগ্রেস সার্পোভিল নামক জায়গায় একটি প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছিল। পুলিশ নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে, এবং তাতে ৬৯ জন নিহত ও ১৭৬ জন আহত হন। খবরটা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা কেঁপে ওঠে। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য এই ঘটনা ছিল একটি ক্রান্তিবিন্দু। সরকার প্যান আফ্রিকান কংগ্রেস ও এএনসি উভয়কেই নিষিদ্ধ করে দিল। জারি করলো জরুরি অবস্থা। গ্রেফতার করলো বিশ হাজার মানুষকে। প্রতিবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে গেল এএনসি’র হাতে। এবং তার চরিত্রও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বদলে গেল। ১৯৬১ সালে এএনসি’র একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হলো। যার নেতৃত্বে থাকলেন নেলসন ম্যান্ডেলা।

ম্যান্ডেলা এএনসি’তে যোগ দেন ১৯৪৪; সংগঠনের অগ্রগতির প্রত্যেকটি ধাপের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই এএনসি’র একটি যুব শাখা গঠিত হয়েছিল। এর ঘোষণাপত্রও তিনিই রচনা করেন। নবগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর নাম দেওয়া হলো ‘জাতির বল্লম’। এর নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ম্যান্ডেলা স্বাভাবিকভাবেই আত্মগোপনে চলে গেলেন। এবং আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকল। ম্যান্ডেলাকে ধরার জন্য পুলিশের জাল ছিল নিশ্ছিদ্র, কিন্তু তিনি সহজে ধরা পড়েন নি। তাই বলে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি যে নিষ্ক্রিয় ছিলেন তা মোটেই নয়। সশস্ত্র গোপন বাহিনীটিকে সংগঠিত করতেন এবং যাতায়াতের অসুবিধা সত্ত্বেও দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে যেতেন। তিনি আছেন জেনে বিশেষ করে তরুণরা উদ্বুদ্ধ হতেন। এরি মধ্যে তিনি ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবাতে আফ্রিকানদের এক সম্মেলনে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে বর্ণবাদের প্রকোপে দক্ষিণ আফ্রিকা কী ভাবে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত তীব্র বর্ণবাদী সংঘর্ষ ও বিবাদে খাড়াখাড়ি বিভক্ত হয়ে গেছে, এবং দেশপ্রেমিকদের রক্ত অবিরাম বইছে তার এক মর্মস্পর্শী চিত্র সমবেত প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরেন। এক সময়ে তিনি দেশের বাইরে চলে যান। এসব খবর কল্পকাহিনী হিসেবে ছড়িয়ে যেতো; এবং সংগ্রামে নিযুক্ত মানুষদের জন্য অনুপ্রেরণার কারণ হয়ে দাঁড়াত।

এর আগে ১৯৬১ সালেই একটি খোলা চিঠিতে কেন আত্মগোপনে গেলেন তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছেন, সশস্ত্র পথ গ্রহণ ছাড়া উপায় ছিল না, কেননা প্রকাশ্য আন্দোলনের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রশ্নটা দাঁড়িয়েছিল হয় আত্মসমর্পণ, নয় মুক্তি। বলেছেন, ‘আমি মুক্তির কঠিন পথ বেছে নিয়েছি।’ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এএনসি’র জাতীয় নির্বাহী কাউন্সিলের নির্দেশেই তিনি আত্মগোপনে গেছেন।

আত্মগোপনে যাবার আগে তিনি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। একটি অ-বর্ণবাদী ও গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের জন্য এএনসি’র পক্ষ থেকে একটি জাতীয় সম্মেলন আহবান করেছিলেন। এতে বর্ণবাদী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী এবং শ্বেতাঙ্গ পার্লামেন্টের বিরোধী দলের নেতাকে যোগ দিতে আহবান জানান। তাদেরকে তিনি সতর্ক করে দেন যে, অতিশয় ঘৃণ্য বর্ণবাদী নীতি থেকে সরে না এলে একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ১৯৬১ সালের ৩১শে মে। বলা হয়েছিল, ওই দিনের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না-পাওয়া গেলে দেশব্যাপী এক ধর্মঘট শুরু করা হবে। এই ধর্মঘটে মানুষ কলকারখানায় রাস্তাঘাটে জমায়েত হয়ে পুলিশের জন্য হামলা করার সুযোগ করে দেবে না, তারা ওভাবে মরবে না, তারা নিজেদের ঘরে বসে থেকে জানিয়ে দেবে যে, বর্ণবাদকে তারা মান্য করে না। এ ছিল এক অভিনব ধর্মঘট। ধর্মঘট সফল হয়েছে। একদিকে সশস্ত্র গোপন আন্দোলন অন্যদিকে সাধারণ ধর্মঘট, দুইয়ে মিলে দক্ষিণ আফ্রিকায় এক নবজাগরণের সূচনা হয়েছে। ম্যান্ডেলা পরিণত হয়েছেন রূপকথার নায়কে। প্রতিটি কৃষ্ণাঙ্গ গৃহে তাঁর নাম জানা, লোকে তাঁকে নিয়ে গান বাঁধছে, সে গান গাওয়া হচ্ছে। পথেঘাটে, দোকানে,      খেতে-খামারে-কারখানায় তাঁকে নিয়ে আলোচনা। তাঁকে সামনে রেখে কালো মানুষেরা সাহসী হয়ে উঠেছে।

এএনসি’র সশস্ত্র শাখা গঠনকে যুব শাখা গঠনের ধারাবাহিকতা বলা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই নেতৃত্বে ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁর বয়স যত বেড়েছে তত বৃদ্ধি পেয়েছে দৃষ্টির স্বচ্ছতা ও অঙ্গীকারের দৃঢ়তা। মানুষ কী চায় তিনি বুঝেছেন। সার্পোভিলের পরে প্রতিরোধী অস্ত্র হাতে তুলে নেবার প্রবণতা যুবকদের ভেতর দেখা দিয়েছিল। আফ্রিকা মহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে মানুষ অস্ত্র হাতে লড়াই করছে, সে দৃষ্টান্তও তাদের সামনে ছিল; তাছাড়া অবরুদ্ধ অবস্থায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতির মধ্যেও সশস্ত্র বিরোধ দেখা দিচ্ছিল। ম্যান্ডেলা বুঝেছেন সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি ছিল সশস্ত্র তৎপরতা যাতে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিকল্পিত থাকে সেদিকে। আদালতে সে কথা তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, তাঁর জবানবন্দিতে। নবগঠিত ‘জাতির বল্লম’ সন্ত্রাসী সরকারের মতো মানুষ হত্যার নেশায় উন্মাদ হয়ে কাজে নামে নি। এক্ষেত্রে ভারতের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীদের থেকে তাদের কর্মসূচির ভিন্নতাটা লক্ষ্য করবার মতো। ভারতবর্ষীয় যোদ্ধারা (সরকার যাঁদেরকে সন্ত্রাসবাদী বলতো) বিচ্ছিন্নভাবে তৎপরতা চালিয়েছেন, ‘জাতির বল্লম’ ছিল সুগঠিত ও সুশৃঙ্খল। দ্বিতীয়ত, তারা ব্যক্তির ওপর আক্রমণ চালায় নি; ব্যক্তিহত্যা পরিহার করাই ছিল তাদের নীতি। আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত্ত ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সেই ধরনের দালানকোঠা ও স্থাপনা যেগুলো বর্ণবাদের কারণে কলঙ্কিত। তারা আক্রমণ করেছে রেললাইন, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও টেলিফোন যোগাযোগের ওপর, যাতে করে সরকার আঘাত পায়। অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত হয়। উদ্দেশ্য ছিল সরকারের নিপীড়ন ক্ষমতাকে বিধ্বস্ত করা। তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। অন্তর্ঘাত, গেরিলা আক্রমণ, সশস্ত্র উত্থান, এভাবে স্তরগুলোকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। সহিংসতা পরিণত হয়েছিল সংগঠিত রাজনৈতিক অস্ত্রে।

সরকার বসে থাকে নি। তারা গ্রেফতার করেছে। নিপীড়নের মাত্রাও বৃদ্ধি করেছে। আত্মগোপনের সতের মাস পরে ১৯৬২-তে ম্যান্ডেলা নিজেই গ্রেফতার হন। সন্দেহ করা হয় পুলিশের চর তাঁর গোপন অবস্থানের খবর পৌঁছে দিয়েছিল। পরাধীন ভারতবর্ষে যেমন বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকান রিপাবলিকেও তেমনি গুপ্তচর, অনুপ্রবেশকারী, উস্কানিদাতা ও দুর্বলচিত্তের মানুষের অভাব ছিল না। কিন্তু সরল কৃষ্ণাঙ্গরা যেভাবে মুক্তি আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ থেকেছে অগ্রসর ভারতবর্ষে তেমন ঐক্য ও সংঘবদ্ধতা যে দেখা যায় নি সেটা মানতেই হবে।

ম্যান্ডেলা গ্রেফতার হলেন। অভিযোগ ছিল ধর্মঘটে উস্কানিদান ও বিনা পাসপোর্টে বিদেশ ভ্রমণের। তাঁকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হলো। যেমনটা আগেই উল্লেখ করেছি। পরের বছর কারাবন্দি অবস্থায় তাঁকে আদালতে হাজির করা হলো। এবারের অভিযোগ আরো গুরুতর। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র। বিচারে শাস্তি হলো যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড। তাঁর অপসারণে আন্দোলন স্তিমিত হবে কী, উলটো আরো জোরদার হতে থাকলো। নিপীড়ন, জরুরি অবস্থা জারি, কিছুতেই সরকার সুবিধা করে উঠতে পারলো না। অর্থনৈতিকভাবেও সে দুর্বল হয়ে পড়ছিল।

সারাজীবন তিনি রাজনীতিতেই ছিলেন। প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ ছিল সীমিত। জীবনের বড় একটা সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। বেশ কিছুদিন ছিলেন আত্মগোপন করে। প্রকাশ্য রাজনীতির তুলনায় আত্মগোপনে থাকা ছিল অনেক বেশি কষ্টের। থাকা, চলাচল করা, যোগাযোগ রাখা সব কিছুই ছিল অনিশ্চিত ও বিঘ্নসংকুল। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারেন নি। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পলাতকের জীবনযাপন করেছেন। অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ধরা পড়লে যে মৃত্যুদন্ডাদেশের আশঙ্কা তা জানতেন। কিন্তু কোনো ক্ষোভ ছিল না। অস্ত্র হাতে নিয়ে ও অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেই জীবনে প্রথমবারের মতো নিজেকে মনে হয়েছে স্বাধীন। তাঁর সমস্ত অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। সকলের মুক্তির ভেতরে নিজের মুক্তির সম্ভাবনা দেখতেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির খবর পরিষ্কারভাবে রাখতেন। প্রতিটি সাফল্য অর্জিত হয়েছে অত্যন্ত কঠিন মূল্যে।

তাঁর সাফল্যের পেছনে বিশ্ব পরিস্থিতিরও একটা বড় ভূমিকা ছিল। বর্ণবাদের মতো একটি কুৎসিত ব্যবস্থা আধুনিক বিশ্বে মোটেই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছিল না। ধিক্কারও আসছিল নানা মহল থেকে। বিশ্বপরিসরে ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস গৃহীত হয়েছে। ১৮৮৫ সালে কৃষ্ণাঙ্গ খ্রিস্টান ধর্মযাজক ডেসমন্ড টুটোকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে ইউরোপ জানিয়েছিল যে, তারা বর্ণবাদের পক্ষে নেই।

দক্ষিণ আমেরিকার সরকারের জন্য বড় মিত্র ছিল আমেরিকা। আফ্রিকায় আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশ ও কার্যকলাপ সম্পর্কে ম্যান্ডেলা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এই নতুন শক্তি ইউরোপীয়দের মতো জবরদখলের রাস্তা ধরে এগোয় নি, পুঁজিবাদের যুগে সাম্রাজ্যবাদ যেমনটা করে তেমন কৌশলে কাজ করেছে। পুঁজি বিনিয়োগ করেছে, সম্পদের ওপর মালিকানা বিস্তার করেছে, স্থানীয় সুবিধাভোগীদের আনুগত্য আদায় করে নিয়েছে। এই অনুগতদের মধ্যে কেবল যে সাদারা ছিল তা নয়, কালোরাও ছিল। অন্যত্র যেমন দক্ষিণ আফ্রিকাতেও তেমনি আমেরিকার জন্য প্রধান শত্রু ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু স্ট্যালিনের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছিল; আশির দশকে তার অবস্থান দাঁড়িয়েছিল সহাবস্থানের নীতিকে মেনে নেওয়ার, এবং তার পতন যে আসন্ন তার লক্ষণও দেখা দিয়েছিল। এর ফলে আমেরিকার জন্য সোভিয়েতের চ্যালেঞ্জটা আর আগের মতো ছিল না। নববইয়ের শুরুতে সোভিয়েতের পতন ঘটে গেছে। প্রতিপক্ষ অনুপস্থিত, তাই আমেরিকা আর আগের মতো বর্ণবাদী সরকারের নীতিকে সমর্থন করা আবশ্যক মনে করে নি। উলটো আমেরিকা দেখেছে যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় যদি শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ মিলে সংঘাতবিহীন একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলে তবে তার পক্ষে পুঁজি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিনিয়োগ করা পুঁজির নিরাপত্তা বিধান এবং দুর্বল হয়ে-যাওয়া ইউরোপীয়দের জায়গায় সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা সাধনের কাজটা সহজ হবারই কথা। ব্যাপারটাকে আমেরিকা সেভাবেই বিবেচনা করেছে। সে জন্য বর্ণবাদী ব্যবস্থার প্রতি তার পূর্ব সমর্থন আর অক্ষুণ্ণ থাকে নি; বরঞ্চ ব্যবস্থাটায় পরিবর্তন আসুক, এবং গোটা দেশে তাদের শান্তিপূর্ণ আধিপত্য  বিস্তার সহজ হোক এটাই ছিল কাম্য। বস্ত্তগত এই পরিবর্তন ম্যান্ডেলার মুক্তি এবং তাঁর মূল দাবি, এক মানুষ এক ভোট ব্যবস্থার পক্ষে গেছে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সত্য হলো যে, সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভেতর এক ধরনের রাজনৈতিক শক্তি আছে। একাত্তর সালে  পাকিস্তানি শাসকচক্র বাংলাদেশকে নিয়ে যে বিপাকে পড়েছিল তার একটা বড় কারণ ছিল ওই এক মানুষ এক ভোট নীতির স্বীকৃতি, যার দরুন নির্বাচনে রায় বের হয়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। যে-রায়কে কামান বন্দুক দেগে, এমন কি গণহত্যা চালিয়েও নাকচ করে দেওয়া সম্ভব হয় নি। উল্লেখ্য যে, ওবামার মতো অশ্বেতাঙ্গ একজন মানুষ যে হোয়াইট হাউসে বসবাসের অধিকার পেয়েছেন সেটাও সম্ভব হতো না আমেরিকানদের সর্বজনীন ভোটাধিকার না থাকলে।

ওই অধিকারটি অর্জনের ক্ষেত্রে ম্যান্ডেলার নিজের ভূমিকা কম কার্যকর ছিল না। বস্ত্তগত পরিস্থিতি এবং আত্মগত সংগ্রাম, এ-দুইয়ের যোগফলই হচ্ছে বর্ণবাদী ব্যবস্থার রাজনৈতিক পতন। ১৯৭৬ সালে ম্যান্ডেলা যখন দূরদ্বীপে নির্বাসনে তখন সোয়াতো নামক একটি শহরে বর্ণবাদী শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল স্কুলশিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ অকারণে গুলি চালায়। তাতে নিহত হয় ৬১৮ জন, আহতের সংখ্যা দেড় হাজার। এটি সরকারি হিসাব। কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে পিছু হটবার কোনো জায়গা থাকে নি। তারা সামনে এগিয়ে গেছে। এক সময়ে শ্বেতাঙ্গরা ভাব করতো যে, কৃষ্ণাঙ্গদের তারা অভিভাবক, কোন শিক্ষাটা তাদের জন্য ভালো সেটা তারাই জানে। সংগ্রামের পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা যে রাজনৈতিক শিক্ষা পেয়েছে তার সম্মুখে নৈতিক প্রতারণার আর কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকে নি। তাই তারা বলপ্রয়োগ ভিন্ন অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করতে পারে নি। মুক্তির ওই সর্বাত্মক সংগ্রামে ম্যান্ডেলা যে কেবল অবিচলচিত্তে দুর্ভোগই সহ্য করেছেন তা নয়, নীরবে আত্মত্যাগও করেছেন। স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন যাপন তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি, ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার ধার ধারেন নি। পুত্রের ও মাতার মৃত্যুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে পারেন নি। পলাতক নয়, তখন তিনি বন্দি। ক্রোধকে ঘৃণায় পরিণত করেছেন। ঘৃণা ছিল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ১৯৯৪-তে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, অনায়াসে দ্বিতীয়বার ওই পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন, কিন্তু    সে-প্রস্তাবে সম্মত হন নি। এটা আত্মত্যাগ তো অবশ্যই। বিশ্বের কম জাতীয়তাবাদী নেতাই এমন লোভ সম্বরণ করতে পেরেছেন, নিজে চাইলেও আপনজন এবং সুবিধাভোগী ও চাটুকারদের কারণে তাঁরা অসমর্থ হন। ম্যান্ডেলা দেশের জন্য সুখ ত্যাগ করেছিলেন, দেশের জন্য সুযোগও ত্যাগ করলেন। তাঁর স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলা শুধু তাঁর দু’সন্তানের জননী ছিলেন না, ছিলেন অবিচল সহযোদ্ধা। ম্যান্ডেলার অনুপস্থিতিতে কঠিন দুঃসময়ে, নিদারুণ বিপদে তিনি ম্যান্ডেলার পক্ষে কাজ করেছেন, বিবৃতি দিয়েছেন, কারাবরণসহ বহুধরনের নির্যাতন সহ্য করেছেন, মুক্ত হয়ে ম্যান্ডেলা সেই অতি আপনজনকেও ত্যাগ করেছেন। কারণ উইনি নানা রকমের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যেগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।

 

তিন

জনমাধ্যমে বেশ জোর দিয়েই বলা হয়েছে যে, ম্যান্ডেলা গান্ধীবাদী ছিলেন। কথাটা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। গান্ধীর সঙ্গে ম্যান্ডেলার বিস্তর সাদৃশ্য ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে দূরত্বও ছিল অনেক। উভয় দিকের বিবেচনাই তাঁকে জানবার ও বুঝবার জন্য জরুরি।

গান্ধী যেমন ম্যান্ডেলাও তেমনি অবস্থাপন্ন গৃহের সন্তান। অল্পবয়সেই গান্ধী বিলেতে চলে গেছেন উচ্চ শিক্ষার জন্য, সেখানে গিয়ে কেবল ব্যারিস্টারই হন নি, অনেক বিষয়েই জ্ঞান লাভ করেছেন। ম্যান্ডেলার বিলেত যাওয়া হয় নি, যেতে পারতেন যদি বর্ণবাদী সরকার তাঁকে ছাড় দিত। রাজনীতি তার সঙ্গ ছাড়ে নি, রাজনৈতিক কারণে তিনি বারম্বার কারারুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেও আনুষ্ঠানিক পড়াশোনায় তিনি ক্ষান্ত হন নি, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন, পরে বন্দি অবস্থাতেই ডাকযোগে পরীক্ষা দিয়ে বিলেত থেকে আইনেই আরেকটি ডিগ্রি লাভ করেন। কৈশোরে তাঁর স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হবেন। সেখানেও তিনি গান্ধীর মতোই। এবং গান্ধীর মতোই তিনি আইনের জ্ঞানকে রাজনীতিতে প্রয়োগ করেছেন। গান্ধী এবং ম্যান্ডেলা উভয়েই শেষ পর্যন্ত রাজনীতিকেই সার্বক্ষণিক কাজ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

গান্ধীর প্রভাব দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে স্পষ্টভাবেই পড়েছিল। তাঁর আইনজীবী ও রাজনৈতিক উভয় জীবনের সূচনা দক্ষিণ আফ্রিকাতে, ভারতবর্ষ থেকে আসা বসবাসকারী ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও শ্রমিকদের নিয়ে। ১৮৯২ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত বাইশ বছর তিনি সেখানে কাটিয়েছেন। ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের রাজনৈতিক কৌশল সেখানেই উদ্ভাবিত। দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের রাজনৈতিক সংগঠনের প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯১২ সালে, নেটিভ ন্যাশনাল কংগ্রেস নাম নিয়ে। এই নামকরণে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে প্রভাব লক্ষ্য করবার মতো। এগার বছর পরে ১৯২৩ সালে যখন সংগঠনটির নাম দেওয়া হয় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস তখন না বোঝার কারণ ছিল না যে, প্রতিষ্ঠানটি ভারতবর্ষীয় কংগ্রেসের রাজনীতিকে স্মরণে রেখেছে।

গান্ধী ও ম্যান্ডেলা উভয়েই ঔপনিবেশিক শাসনের ভেতর থেকেই বেড়ে উঠেছেন, এবং সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। নেলসন ম্যান্ডেলার নামের নেলসন অংশটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলের শিক্ষকের দেওয়া। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই তিনি শিক্ষার্জন করেছেন, ওই ভাষাতেই লিখতেন এবং বক্তৃতা করতেন। ওদিকে গান্ধীর নামের মোহনদাস করমচাঁদ অংশ যে এম কে হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে তাতেও ইংরেজি কেতার ছাপ রয়েছে, এবং তাঁর লিখবার ও বলবার ভাষাও মূলত ইংরেজিই ছিল। গান্ধীর প্রতি ম্যান্ডেলার যে গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল তার একটি প্রকাশ দেখি ১৯৯০তে দেওয়া তাঁর একটি বক্তৃতায়। সেখানে তিনি বলেছেন যে, আফ্রিকায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জুলুরা যখন যুদ্ধ করতে বাধ্য হয় তখন গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় অভিবাসীরা জুলুদের পক্ষে ছিল। আসল ঘটনা কিন্তু অন্য রকম। ম্যান্ডেলা হয়তো জানবার সুযোগ পান নি, আর জানতে পারলেও হয়তো তাঁর জন্য সেটা বিশ্বাস করা কঠিন হতো যে, গান্ধী মোটেই জুলুদের পক্ষ নেন নি, বরঞ্চ ব্রিটিশের পক্ষেই ছিলেন। কেবল পক্ষে থাকা নয়, ভারতীয়দেরকে তিনি যুদ্ধরত ব্রিটিশের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। এর আগে ব্রিটিশের সঙ্গে বূয়রদের যে-যুদ্ধ হয় তাতেও তিনি আহত ব্রিটিশ সেনাদের শুশ্রূষার কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেন। সেটা অবশ্য ছিল সাদায় সাদায় লড়াই, তবু তাঁর আনুগত্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশের প্রতিই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ভারতবর্ষে ফিরে এসেছেন, এবং ব্রিটিশের জন্য সেনা সংগ্রহের কাজে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে যোগ দিয়েছিলেন, যার জন্য তাঁকে সেবাকার্যের সর্বোচ্চ সম্মান কাইজার-এ-হিন্দ-এ ভূষিত করা হয়।

ম্যান্ডেলার পক্ষে শাসকদের প্রতি এ ধরনের আনুগত্য প্রকাশ ছিল অকল্পনীয়। শুরুতে তিনি গান্ধী-প্রদর্শিত এবং এএনসি অনুসৃত শান্তিপূর্ণ অসহযোগিতার রাজনীতির অধীনেই ছিলেন, কিন্তু আমরা দেখেছি যে অচিরেই তিনি যুবকদের সংগঠিত করতে শুরু করেছেন, এবং তারপর অহিংস পথে কাজ হবে না দেখে সহিংস পথে চলে গেছেন। আত্মগোপনে থাকা, দেশের বাইরে গিয়ে অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষণ নেয়া, সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদান, মৃত্যুদন্ডের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা, দশকের পর দশক ধরে বন্দি অবস্থায় থাকা – এসবের কোনোটাই গান্ধী-প্রদর্শিত পথের অন্তর্গত নয়। এটা বলা অসঙ্গত হবে না যে, ম্যান্ডেলা যদি যথার্থ গান্ধীবাদী হতেন তাহলে বর্ণবাদী ব্যবস্থাটা ভাঙতে আরো বিলম্ব ঘটত; কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য অনেক বেশি দুর্ভোগ নেমে আসতো।

গান্ধীর প্রজ্ঞার কোনো অভাব ছিল না। তিনি নতুন নতুন রাজনৈতিক কৌশল উদ্ভাবনে অত্যন্ত সফল ছিলেন। ম্যান্ডেলাও ছিলেন ওই গুণে গুণান্বিত। কিন্তু পদ্ধতি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তিনি   অন্তরের বাণী, কিংবা দৈব নির্দেশের ওপর নির্ভর করতেন না। বাস্তব পরিস্থিতি দেখতেন, এবং সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন। দলের ভেতর গান্ধীর মতোই তাঁর স্থান ছিল সর্বোচ্চ; কিন্তু নেতৃত্বকে তিনি ব্যক্তিনির্ভর করে রাখেন নি; যে জন্য তাঁর অনুপস্থিতিতেও আন্দোলন এগিয়ে গেছে। গান্ধীর কংগ্রেসে মেহনতি মানুষের স্থান ছিল না, ম্যান্ডেলা মেহনতিদের ওপরই বিশেষভাবে নির্ভর করছেন। একথা সত্য যে, গান্ধী কংগ্রেসকে বর্ষশেষের তিন দিনের তামাশার প্রতিষ্ঠানের সীমা থেকে বের করে জনগণের কাছে নিয়ে গেছেন; তাকে সজীব, সক্রিয় ও সংগ্রামী করে তুলেছেন; কিন্তু তবুও কংগ্রেস জনগণের সংগঠনে পরিণত হয় নি, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের ভেতরেই আটকে থেকেছে। ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে এএনসিতে ছাত্র, যুবক, নারী সবাই এসেছে, এসেছে মেহনতি মানুষ। তাঁর লড়াইটা ছিল সর্বজনীন ভোটাধিকারের, গান্ধীর কংগ্রেস ওই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেয় নি।

গান্ধী কর্মসূচি দিতেন, আবার তা গুটিয়ে দিতেন, এমনও সময় গেছে অনেক সময়ে কোনো কর্মসূচিই থাকতো না। ম্যান্ডেলার পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি কর্মসূচিকে ধারাবাহিকভাবে কঠোর থেকে কঠোরতর করেছেন, কখনোই বিরতি দেন নি, গুটিয়ে ফেলেন নি নিজেকে। বিশের দশকে গান্ধী অসহযোগ-খেলাফতের ডাক দিলেন, আন্দোলন এগিয়ে গেল, চৌরিচৌরাতে কৃষকরা এসে যোগ দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণকারী পুলিশের ফাঁড়ি পুড়িয়ে দিল, প্রতিক্রিয়ায় মহাভ্রম ঘটে গেছে বলে ঘোষণা দিয়ে গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন। এমন ব্যাপার ম্যান্ডেলার ক্ষেত্রে ঘটার সুযোগ ছিল না। তিনি প্রস্ত্ততি নিয়েই কর্মসূচি নিতেন, নিজে সামনে থাকতেন, এবং নেতৃত্বকে ব্যক্তির হাতে ধরে রাখতেন না, ছড়িয়ে দিতেন গ্রামে-গঞ্জে, হাটবাজারে, খনিতে-কারখানায়। নেতৃত্বের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের এমন দৃষ্টান্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে বিরল বৈকি।

জাতীয়তাবাদীদের প্রবণতা থাকে একনায়কত্বের দিকে, ম্যান্ডেলা ছিলেন গণতান্ত্রিক। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক দেশে দুই বাদশাহর অবস্থান অসম্ভব, যে জন্য দেখা যায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে জিন্নাহর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হয় নি, সুভাষ বসু বিতাড়িত হয়েছেন, জওহরলাল নেহেরু যে রয়ে গেছেন সেটা গান্ধীর আনুগত্য স্বীকার করে তবেই। ম্যান্ডেলার আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে নি। সেখানে কখনোই স্থানের অভাব হয় নি। লড়াইটা ছিল প্রত্যক্ষ; জেল-জুলুমের তো বটেই, ছিল মৃত্যুদন্ডের আশঙ্কাও, এবং নিখোঁজ হবারও। ধরনটা ছিল সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে এমন সুযোগ দেখা দেয় নি।

অথচ ম্যান্ডেলাও একজন জাতীয়তাবাদীই ছিলেন, সমাজবিপ্লবী ছিলেন না। গান্ধী বিশের দশকে একবার, তারপরে দশ বছরের বিরতিতে ত্রিশের দশকে লবণ আইন অমান্যর নামে আরেকবার, এবং চল্লিশের দশকে এসে ভারতছাড় ডাকের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বার আন্দোলনের সৃষ্টি করলেন, এবং হয়তো আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতেন পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার জন্য, যদি না ব্রিটিশ শাসকেরা ভারত ত্যাগে সম্মত হতো। অপরদিকে ম্যান্ডেলার সংগ্রাম ছিল অব্যাহত, সেখানে বিরতির কোনো সুযোগ ছিল না, কেননা বিষয়টা ছিল জীবনমরণের। ম্যান্ডেলা বলেছেন, আমার জীবন হচ্ছে একটা নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, এ বক্তব্যে কোনো অত্যুক্তি দেখি না। মৃত্যুকে গান্ধী ভয় করতেন না, অনশন করে তিনি একবার মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন, ম্যান্ডেলাও মৃত্যুপণ করে লড়েছেন, কখনো আপোস করেন নি। মৃত্যুদন্ডাদেশ হতে পারে জেনেও আদালতে ম্যান্ডেলা স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, তিনি যা করেছেন    জেনে-বুঝে করেছেন, এবং সে জন্য তিনি অনুতপ্ত বা ক্ষমাপ্রার্থী নন। বক্তব্যে কোনো লুকাছাপা ছিল না, আইনি মারপ্যাঁচের আশ্রয় নেন নি। নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন। আন্দোলনের ডাক দিয়ে কখনোই তিনি আত্মসমর্পণ করেন নি, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে থেকেছেন। তাঁর সংগ্রামের জনভিত্তিটা অত্যন্ত প্রসারিত ও শক্ত ছিল, গান্ধীর আন্দোলনে যার অভাব দেখা গেছে।

এটা স্বীকৃত সত্য যে, গান্ধী ছিলেন ভাববাদী; অপরদিকে ম্যান্ডেলা হচ্ছেন নির্মোহ বস্ত্তবাদী। রাজনীতিতে তিনি ধর্মকে ডেকে নিয়ে আসেন নি, রাজনীতিকে সমাজসেবাতে রূপান্তরিত করতেও সম্মত হন নি। তাঁর জন্য রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ ও ইহজাগতিক। গান্ধী রামরাজ্যের কথা বলেছেন, তিনি পুঁজিবাদবিরোধী ছিলেন না, কিন্তু আধুনিক সভ্যতার প্রতি তাঁর বিমুখতা ছিল। ম্যান্ডেলাও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধ্বংস চান নি, তবে পুঁজিবাদকে যে সামন্তবাদী আচ্ছাদন দেবেন এমন চিন্তা তাঁর ছিল না; বরঞ্চ তিনি চেয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা একটি আধুনিক শিল্পসমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়ে জীবনযাত্রার মানে উন্নতি ঘটাক। চরকার কথা ভাবেন নি, শিল্প পুঁজির বিকাশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল আন্তর্জাতিকতা। শাসকদের হৃদয় পরিবর্তনের ওপর তাঁর বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না। সে জন্য মুক্তির পথটা দাঁড়িয়েছিল সশস্ত্র প্রতিরোধের। এদিক থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর মিল আছে; কিন্তু সুভাষ যেমন ভেবেছিলেন বাইরের শক্তির সাহায্যে দেশকে মুক্ত করবেন, ম্যান্ডেলা তেমনটা ভাবেন নি, তাঁর নির্ভরশীলতা ছিল জনগণের সংগ্রামী শক্তির বিকাশের ওপর। জাতীয়তাবাদীরা সাধারণত কমিউনিজমবিরোধী হন, গান্ধীও তা-ই ছিলেন, ম্যান্ডেলা কিন্তু তেমনটা ছিলেন না; নিজের দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তিনি একত্রে সংগ্রাম করেছেন, শ্রেণীহীন সমাজের সম্ভাবনা তাঁকে ভীত করতো না।

গান্ধীর অসাধারণত্ব ও মহত্ত্ব স্মরণে রেখেই বলা যায় যে, এএনসি’র পক্ষে এটা ছিল সৌভাগ্যের বিষয় যে গান্ধীবাদী আপোসকামিতা ও শাসকশ্রেণীর হৃদয়পরিবর্তনের ভদ্রলোকী বলয় থেকে সংগঠনটি বের হয়ে আসতে পেরেছিল এবং সংগঠনের ভেতর কোনো গান্ধী ছিলেন না। নইলে বিপদ ঘটতো। যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল তা হতো না। গান্ধী ঐক্য গড়তে চেয়েছেন, কিন্তু কংগ্রেসের আন্দোলন যত এগিয়েছে ততই দেখা গেছে যে, ভারতবাসী হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। ম্যান্ডেলার আন্দোলনে তেমনটা ঘটে নি। সেখানে দেখি সংগ্রাম যত তীব্র হচ্ছে ঐক্য তত দৃঢ়তা পাচ্ছে। গান্ধী বারবার হতাশ হয়েছেন, এবং শেষ লড়াইয়ে বিজয়ী হতে পারেন নি। বিদেশী শাসকদের হাতে নয়, স্বধর্মাবলম্বীদের হাতেই তাঁর প্রাণহানি ঘটেছে। অপরদিকে ম্যান্ডেলা তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছেছেন, বর্ণবাদের রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিক অবসান তিনি দেখে গেছেন। তিনি নন, শাসকেরাই পরাজিত হয়েছে।

তাই বলে গান্ধীর কাছ থেকে তিনি যে অনতিক্রম্য দূরত্বে ছিলেন তাও কিন্তু নয়। তাঁরা উভয়েই ছিলেন জাতীয়তাবাদী। তাঁরা রাজনৈতিক পরাধীনতার অবসান চেয়েছেন অবশ্যই, কিন্তু সামাজিক বিপ্লব চান নি। ম্যান্ডেলা গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। তিনি ন্যায়বিচার ব্যবস্থাসম্পন্ন বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু যে গণতন্ত্র তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন সেটা অর্থনৈতিক নয়। সেটি ওপরের কাঠামোর, ভেতরের আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে ভাঙা হয় নি। তাতে করে মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি, কেবল ভোটের ব্যাপারে সাম্য এসেছে।

যতই যা হোক শেষ বিচারে ভোটের গণতন্ত্র যে প্রকৃত গণতন্ত্র নয় সেটা তো বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত সত্য। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে তিনি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড় একটা পরিবর্তন আনলেন ঠিকই, কিন্তু ভূমি, পুঁজি, ব্যবসা-বাণিজ্য এসবের মালিকানা মোটামুটি আগের মতো শ্বেতাঙ্গদের হাতেই রয়ে গেলে, শুধু অল্পসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ তাতে অল্পস্বল্প প্রবেশাধিকার লাভ করলো। ম্যান্ডেলা মুক্তির জন্য লড়ছিলেন, মুক্তির প্রয়োজনে সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার অবসান অত্যাবশ্যক ছিল। সেটা ঘটলো। শ্বেতাঙ্গরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল, কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ক্ষমতার ভাগ দিতে তারা কিছুতেই রাজি ছিল না। আন্দোলনের পরিণতিতে তারা ছাড় দিল, সংখ্যাগরিষ্ঠদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, এএনসি রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় চলে এলো। কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্র বদলালো কি? মোটেই না। সবকিছুই আগের মতো রয়ে গেলো, কেবল শাসকদের গায়ের রংটা গেল বদলে। সেই যে সংখ্যালঘু শাসন ভিন্ন নামে সেটাই তো কায়েম রইলো। এই সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ নয়, কৃষ্ণাঙ্গ – ভোটের জোরে। শ্বেতাঙ্গ সুবিধাভোগীদের হটিয়ে দিয়ে তাদের গদিগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গ সুবিধাপ্রাপ্তরা বসে পড়ল। সেটা একটা পরিবর্তন তো অবশ্যই; কিন্তু ওই পর্যন্তই, তার অধিক নয়। কেননা কৃষ্ণাঙ্গরা ঠিক সেই শোষণই অব্যাহত রাখলো এতদিন শ্বেতাঙ্গরা যা চালাতো। যেমন ধরা যাক কয়লা শ্রমিকদের ধর্মঘট। এ ধরনের ধর্মঘট দমনে আগে যেমন গুলি চালানো হতো মুক্ত দেশেও তেমনি করা হলো। মুখগুলো আলাদা, মুখের অভিব্যক্তি অভিন্ন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে। সাধে কী পুঁজিবাদী বিশ্ব অমন সপ্রশংস।

ম্যান্ডেলা বলতেন, শত্রু অভিন্ন, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই চাই। অভিন্ন শত্রু ছিল একচেটিয়া শ্বেতাঙ্গ শাসন; কিন্তু তার পেছনে যে অদৃশ্য কিন্তু ভয়ঙ্কর শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও দর্শন কাজ করছিল সেটা তো পুঁজিবাদ। সেই শত্রুটি অক্ষতই রয়ে গেছে। বরঞ্চ বলা যায়   সে-ই পেয়েছে আসল স্বাধীনতা, যেমন পেয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশে, পেয়েছে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত অন্য বহুদেশে। গান্ধীর সঙ্গে ম্যান্ডেলার পার্থক্য কম নয়, কিন্তু সেটাকে আলো এবং অাঁধারের ব্যবধান বলা যাবে না, কেননা আলো-অাঁধারিতেই তাঁদের উভয়কে থাকতে হয়েছে। কী পরিমাণ আলো, কতটা অাঁধার    সে-পরিমাপ কষ্টসাধ্য বৈকি। সত্য থাকে এটাই যে, ভারতবর্ষের মতোই দক্ষিণ আফ্রিকাতেও জাতীয়তাবাদের পক্ষে গান্ধীবাদকে অতিক্রম করে যাওয়া সহজ ছিল না। বাদ দেওয়া তো ছিল একেবারেই অসম্ভব।

দুর্নীতির বিষয়টাই ধরা যাক। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত এমন কোনো দেশ নেই যেখানে দুর্নীতি পাওয়া যাবে না। কম আর বেশি। আমাদের নিজের দেশের অভিজ্ঞতা তো একেবারে প্রত্যক্ষ। ম্যান্ডেলার দেশেও সেটা ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে তিনি টের পেয়েছিলেন যে, মুক্তির লড়াইয়ে নিবেদিতপ্রাণ তাঁর স্ত্রী স্বয়ং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছেন। উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকার বিপদ সম্পর্কে সজাগ থাকার বিষয়ে লিখতে গিয়ে আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে ফ্রান্সিস বেকন লিখেছিলেন যে, ঘুষ গ্রহণে নিবৃত্ত থাকার প্রয়োজনে কেবল নিজের হাত দু’টিকে বেঁধে রাখাই যথেষ্ট নয়, ভৃত্যদের হাত বাঁধা আছে কি-না তাও দেখা চাই, কারণ ওই পথেও ঘুষ আসতে পারে। পত্নীর কথা বেকন বলেন নি, এ ব্যাপারে পত্নীরা সেকালে এখনকার মতো যোগ্যতা অর্জন করেন নি। আর ঘুষের প্রলোভন যে কতটা দুর্মর হতে পারে সেটা তো উইনির মতো মুক্তিযোদ্ধার দুর্নীতি সংলগ্নতার ভেতর দিয়েই ম্যান্ডেলা দেখতে পেয়েছেন।

দুর্নীতি বেড়েছে। ওদিকে এএনসি নিজেও এখন আর আগের মতো ঐক্যবদ্ধ নেই, সেখানে ঘোরতর অন্তর্বিরোধ দেখা দিয়েছে। জানা গেল যে, ম্যান্ডেলার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তাঁর সহযোদ্ধা ডেসমন্ড টুটো আমন্ত্রিত হন নি। ম্যান্ডেলার উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে পরিবারের ভেতরেই বিভিন্ন কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। দেশে বেকারত্ব ও সহিংসতা একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হু-হু করে বাড়ছে। ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এইডস রোগীর সংখ্যা ভয়াবহ। যে বাস্তববুদ্ধি মুক্তিসংগ্রামের সময় ম্যান্ডেলার জন্য বড় রকমের সহায়ক ছিল সেই বাস্তববুদ্ধিই তাঁকে নির্দেশ দিয়েছে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রক্ষমতায় না যেতে। তিনি বুঝে নিয়েছেন যে, একজন জাতীয়তাবাদী নেতার পক্ষে যতটা করা সম্ভব তা তিনি করেছেন, বাকিটা সামলাতে গেলে তিনি ব্যর্থ হবেন। প্রত্যক্ষ ক্ষমতার লোভ তাঁর ছিল না, যেমন ছিল না গান্ধীর; ত্যাগের সেই মানসিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বিচক্ষণতা। সরে না দাঁড়ালে সম্মান হারাতেন। কে জানে হয়তো বা প্রাণই হারাতেন, অনেক জাতীয়তাবাদীর বেলায় যেমনটা ঘটেছে।

পুঁজিবাদী বিশ্বের পক্ষে তাঁর ব্যাপারে সন্তুষ্ট হবার জন্য আরেকটি কাজ তিনি করে গেছেন। সেটি হলো, দক্ষিণ আফ্রিকাকে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে যুক্ত করে দেওয়া। পরোক্ষে গান্ধীও এ-কাজটি করে দিয়ে গেছেন। ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে না পারার ক্ষেত্রে গান্ধীর ব্যর্থতা দেশবাসীর জন্য মর্মান্তিক দুঃখের কারণ হয়েছে বৈকি, কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্ব সন্তোষের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে যে, নবোদ্ভিন্ন উভয় রাষ্ট্রই সোৎসাহে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্লগ্ন হয়ে গেছে, এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পুঁজিবাদকে আরো সুসংহত ও বিকশিত হবার জন্য পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে। পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ তিনটি রাষ্ট্রই এখন সংকটের মধ্যে রয়েছে, এই সংকট সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর জন্য যে সুখকর তাতে সন্দেহ কী? সনাতন সমাজবিন্যাসে আস্থাশীল গান্ধী এবং আধুনিক রাষ্ট্রগঠনে অভিলাষী ম্যান্ডেলাকে পরস্পর থেকে পৃথক বলে মনে করলে তাঁদের কারো প্রতি সুবিচার করা হবে বলে মনে হয় না।

 

চার

রটনা ছিল যে ম্যান্ডেলা একজন কমিউনিস্ট। হ্যাঁ, ম্যান্ডেলার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টির সংযোগ ছিল বৈকি, মুক্তির সংগ্রামে এএনসি কমিউনিস্ট পার্টিকে সহযোদ্ধা হিসাবে পেয়েছে। শুরুতে ম্যান্ডেলা বর্ণবাদবিরোধী একরকমের পালটা বর্ণবাদীই ছিলেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু পরে কমিউনিস্ট পার্টির সান্নিধ্যে এসে, মার্কসবাদী সাহিত্য অধ্যয়ন করে এবং বিশ্বপরিস্থিতির দিকে চোখ রেখে তিনি মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন, এক সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পর্যন্ত হয়েছেন, কিন্তু তাঁকে কমিউনিস্ট বলবার কোনো উপায় নেই। ব্যাপারটা তিনি নিজেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। নিজেকে তিনি একজন বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী হিসাবেই দেখেছেন, কমিউনিস্ট হিসাবে নয়। তাঁর সংগ্রামটা জাতীয়তাবাদী চরিত্রের; লড়ছিলেন জাতির মুক্তির জন্য, শ্রেণীর মুক্তির জন্য লড়বেন অতটা অগ্রসর হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, সে চেষ্টা তিনি করেনও নি। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মুক্তির জন্য বর্ণবাদী ব্যবস্থাটা ভেঙে ফেলা অত্যাবশ্যক ছিল, সে-কাজেই নিজেকে তিনি নিয়োজিত রেখেছিলেন। উল্লেখ্য যে, শ্বেতাঙ্গরাও নিজেদেরকে জাতীয়তাবাদী বলেই বিবেচনা করতো। নিজেদের সরকারের তারা নাম দিয়েছিল জাতীয়তাবাদী সরকার। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, এই শ্রেণীর ভেতর সবচেয়ে অগ্রসর যে অংশ তিনি ছিলেন তারই অন্তর্ভুক্ত। অগ্রসর এই অংশের মধ্যে আপোসকামিতা ছিল না, যে আপোসকামিতা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভেতর আমরা দেখি। ম্যান্ডেলা ওই আপোসহীনতারই অতিউজ্জ্বল প্রতিনিধি। ব্রিটেনে প্রচলিত সংসদীয় গণতন্ত্রই তাঁর কাম্য ছিল, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা তিনি ভাবেন নি। যুদ্ধ করেছেন ভোটাধিকারের মাধ্যমে ক্ষমতার অংশ লাভের জন্য, রাষ্ট্র ও সমাজকে ভেঙে ফেলে রাজনৈতিক সমানাধিকার লাভের স্তর পার হয়ে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে এগুবেন – এমন আকাঙ্ক্ষাকে তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করেন নি।

বলা বাহুল্য সে পথের যাত্রী হলে তিনি এএনসি’র নেতা হতে পারতেন না, তাঁকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে হতো, এবং যে জাতীয়তাবাদী সাফল্যটি তিনি অর্জন করেছেন সেটি অর্জনেও ব্যর্থ হতেন। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির মতোই দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টিও চলছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দেশেই, এবং এ দলের নেতা ও কর্মীরা যদিও প্রচুর নির্যাতন সহ্য করেছেন, প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন তবুও দলটির পক্ষে বর্ণবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটানো সম্ভব হতো না। কমিউনিস্ট পার্টিতে কৃষ্ণাঙ্গরাও ছিলেন, কিন্তু পার্টি গঠিত হয়েছিল শ্বেতাঙ্গদের উদ্যোগেই, নেতৃত্বেও তারাই ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গদের মর্মবেদনা তারা বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে বুঝতে পারতেন, সে-বেদনার সঙ্গে থাকতেন, বর্ণবাদকে প্রচন্ডরূপে ঘৃণা করতেন; সংগ্রামে অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু ছিলেন; কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়াটা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি।

জাতীয়তাবাদীরা যাতে সমাজতন্ত্রীদের দিকে যেতে না পারেন তার জন্য সরকারের দিক থেকে তৎপরতার অভাব ছিল না। অন্যদিকে আবার এএনসি’র ভেতরেই এমন একটি প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ছিল যারা কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী, এবং যারা চেষ্টা করেছে এএনসি’তে মার্কসবাদী যাঁরা ছিলেন তাঁদেরকে বহিষ্কার করতে, যেমনটা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বেলাতেও ঘটতে দেখা গেছে। ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেসীরা ওই কাজে সফল হয়েছে, এএনসি’র প্রতিক্রিয়াশীলরা হয় নি, কারণ সেখানে নেতৃত্বে ছিলেন ম্যান্ডেলার মতো প্রগতিশীলরা।

আদালতের জবানবন্দি এবং অন্যান্য ঘোষণাপত্রে তিনি কমিউনিস্ট নন, এ-কথাটা জোর দিয়ে বলা সত্ত্বেও তাঁকে যে কমিউনিস্ট বলা হতো তার একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত, বর্ণবাদী সরকার কৃষ্ণাঙ্গদেরকে এতটাই পশ্চাৎপদ মনে করতো যে, তাদের পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন ছিল যে, শ্বেতাঙ্গ কমিউনিস্টদের    সাহায্য-সহযোগিতা ব্যতিরেকে কৃষ্ণাঙ্গদের নিজেদের পক্ষে নিজস্ব বুদ্ধিবিবেচনায় অত বড় একটা আন্দোলন গড়ে তোলা এবং দলীয় বক্তব্যকে অমনভাবে গুছিয়ে প্রকাশ করা সম্ভবপর। তারা ধরেই নিয়েছিল যে, কমিউনিস্টরা রয়েছে পেছনে। তাদের ধারণা ছিল যে, মুক্তিসংগ্রামী মাত্রেই হয় কমিউনিস্ট, নয়তো কমিউনিস্টদের দ্বারা প্ররোচিত।

অতিনিম্নমানের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের ওই দৃষ্টিতে সবচেয়ে মারাত্মক প্রাণী ছিল কমিউনিস্টরা। কারণ রাষ্ট্র জানতো যে, কমিউনিস্টরা আপোস করবে না, এবং কেবল যে বর্ণবাদের অবসান ঘটাবে তাই নয়, সমাজতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইবে। প্রলোভন বা ভীতিতে তারা কাবু হবে না। তাদের আদর্শবাদ ভঙ্গুর নয়। এবং তারা অগ্রসর, সুশিক্ষিত ও সুসংগঠিত। তদুপরি কমিউনিস্টদের রয়েছে আন্তর্জাতিক সমর্থন, আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুকূল্য। ওই আনুকূল্য প্রত্যক্ষভাবেই লক্ষণীয় ছিল এ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিকের মতো দেশগুলোতে, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত আফ্রিকানরা কমিউনিজমের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন এবং সোভিয়েত সাহায্য-সহায়তা লাভ করছিলেন। কমিউনিস্ট-আতঙ্কের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ‘সাপ্রেশন অব কমিউনিজম অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন চালু করেছিল। এএনসি’কে দমন-পীড়ন করার সময়ে তারা ওই আইনটির সাহায্য নিত। ম্যান্ডেলাও ওই আইনেই গ্রেফতার হয়েছেন এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ড লাভ করেছিলেন।

এএনসি’কে কমিউনিস্ট-প্রভাবিত বলে চিহ্নিত করার চেষ্টার পেছনে অন্য একটি অভিসন্ধি কাজ করছিল। সেটা হলো, ওই পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে একদিকে আন্দোলনকে আফ্রিকাবাসীর কাছে হত্যা ও ধ্বংসে বিশ্বাসীদের তৎপরতা হিসাবে কালিমামন্ডিত করা এবং অপরদিকে পুঁজিবাদী বিশ্বকে আন্দোলনের প্রতি বিমুখ করে তোলা। ওই সুযোগে এএনসি’র মূল যে দাবি – সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতাতে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের ভেতর ক্ষমতার অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা – সেটিকেও আড়াল করা যাবে এমন আশাও তারা করেছিল।

ম্যান্ডেলা বলেছেন, তাঁদের আন্দোলনের ভিত্তি হচ্ছে ‘মুক্তির ঘোষণাপত্র’, যেখানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য নেই। যে দাবিগুলো আছে সেগুলো সর্বজনীন মানবাধিকারসম্মত। ভূমির মালিকানাই ছিল মূল সমস্যা। ভূমি জাতীয়করণের দাবি সেখানে তোলা হয় নি, বলা হয়েছে ভূমি যারা ব্যবহার করে তাদের মধ্যে পুনর্বিভাজন করে দেওয়া হবে। খনি ও কৃষি সম্পদের জাতীয়করণের কথা বলা হয়েছে বটে, তবে সেটা করা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নয়, ক্ষমতায় শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের একাধিপত্য নষ্ট করার জন্য। শ্বেতাঙ্গরা অবশ্যই ওই ঘোষণাপত্র পড়ে দেখা আবশ্যক মনে করে নি। সরকারের একজন আইনমন্ত্রী ম্যান্ডেলার সঙ্গে রবেন দ্বীপে গিয়ে দেখা করেন, ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে তিনি নিজের পুরোপুরি অজ্ঞতার কথা জানান। তবে তদ্সত্ত্বেও দলিলটি যে কমিউনিজমদোষে দুষ্ট এই মত প্রকাশে তিনি কার্পণ্য করেন নি। সরকারের কাছে প্রদত্ত প্রতিবেদনে মন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, ম্যান্ডেলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

আদালতে ম্যান্ডেলাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি কমিউনিস্ট কি না। জবাবে তিনি বলেছিলেন যে, কমিউনিস্ট হওয়ার অর্থ যদি হয় পার্টির সদস্য হওয়া এবং পার্টির শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলা তবে আমি বলবো আমি কমিউনিস্ট নই। অর্থাৎ ব্যক্তিগত প্রবণতা যা-ই হোক দলগত পরিচয়ে তিনি কমিউনিস্ট নন। পরবর্তী প্রশ্নটি ছিল শ্রেণীহীন সমাজের ধারণা তাঁকে আকর্ষণ করে কি না। উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যাঁ, খুবই করে। কেননা সমাজের শ্রেণীবিভাজন অনেক ধরনের অনিষ্টের কারণ। ওই ব্যবস্থায় এক শ্রেণী অপর শ্রেণীর ওপর শোষণ চালায়। তবে তিনি এটা উল্লেখ করতে ভোলেন নি যে, এ ব্যাপারে এএনসি’র কোনো ঘোষিত নীতি নেই।

নীতি না থাকুক, বিরোধিতা কিন্তু ঠিকই ছিল। ১৯৪৪ সালে গৃহীত এএনসি’র যুবলীগ শাখার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘আমরা শ্রেণী হিসাবে নয়, জাতি হিসাবে নির্যাতিত।’ কাজেই আমরা কোনো বিদেশী পদ্ধতির দ্বারা পরিচালিত হবো না। স্পষ্টতই বিদেশী পদ্ধতি বলতে কমিউনিস্টদের প্রচারিত শ্রেণী সংগ্রামের বৈপ্লবিক পদ্ধতিকেই বোঝানো হয়েছে। অন্যত্র ম্যান্ডেলা বলেছেন যে, কমিউনিস্টরা বিশ্বাস করেন শ্রেণী সংগ্রামে; তাঁরা চান পুঁজিবাদী শাসন হটিয়ে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর শাসন প্রতিষ্ঠা করতে, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য হলো শ্রেণী সমন্বয় প্রতিষ্ঠা। দক্ষিণ আফ্রিকা হচ্ছে         সাদা-কালো ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের মাতৃভূমি, এই ‘সত্যে’ তিনি আস্থাশীল ছিলেন।

যে শ্রেণীহীন সমাজের ধারণার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন প্রদর্শিত নয়; শ্রেণীহীন সমাজের দৃষ্টান্ত তিনি দেখতে পেয়েছেন তাঁদের নিজেদের প্রাচীন দেশীয় সমাজে, যেখানে রাজা শাসন করতেন ঠিকই কিন্তু সাধারণ মানুষ ছিল স্বাধীন, তাদের চলাফেরা জীবনযাপনের ওপর কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। সে সময়ে ভূমি ছিল উৎপাদনের প্রধান উপায়, এবং ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানা ছিল না, মালিকানা ছিল গোত্রের হাতে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ছিল অনুপস্থিত, অস্তিত্ব ছিল না শোষণের। স্পষ্টতই তিনি সেই ব্যবস্থার সঙ্গে সমসাময়িক বর্ণবাদী বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থার তুলনা করছিলেন। তবে ওই প্রাচীন সমাজ যে সমাজতান্ত্রিক ছিল না সে-বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ থাকবার কারণ নেই।

তাঁর চিন্তাধারায় এক ধরনের সারল্য ছিল। যে জন্য তিনি নেহেরু, নক্রুমা, নাসের – এঁদেরকে সমাজতন্ত্রী মনে করতেন। নেহেরুর প্রতি তাঁর যে একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল সেটি বোঝা যায় ১৯৫২ সালে প্রদত্ত একটি বক্তৃতা পড়লে। যেখানে তিনি নেহেরুকে উদ্ধৃত করেছেন। নেহেরু বলছেন যে, মুক্তির সংগ্রামের জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক শক্তি। শক্ত সংগঠনে ম্যান্ডেলাও বিশ্বাস করতেন, এক্ষেত্রে তিনি গান্ধীপন্থী নন, অনেকটা লেনিনপন্থী; কিন্তু লেনিনের সাংগঠনিক প্রস্ত্ততির সামনে যে সমাজবিপ্লবী লক্ষ্যটি ছিল ম্যান্ডেলার ক্ষেত্রে তা উপস্থিত ছিল না।

ম্যান্ডেলা মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, তাঁর বক্তৃতা ও লেখাতে বস্ত্তবাদিতার স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান। তিনি রাজনৈতিক শক্তির সামাজিক ভিত্তির ওপর জোর দেন, শাসকদের ভেতরকার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করার কথা বলেন, অর্থনীতিকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব দেন, এক ধরনের সমাজতন্ত্রেও তাঁর আস্থা আছে, শ্রেণীবিভাজনকে ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করেন; কিন্তু লেনিনকে যে পথের দিশারী হিসাবে গ্রহণ করবেন সেটা পারেন না। জাতীয়তাবাদীই রয়ে যান।

সরকারের পক্ষে যখন তাঁকে আর আটক করে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না তখন মুক্তিদানের জন্য তাঁকে যে তিনটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল তাদের প্রথমটি ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম বাদ দেওয়ার এবং দ্বিতীয়টি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার। জাতিগত মুক্তির লক্ষ্যে অনড় ম্যান্ডেলার পক্ষে ওই দুই শর্তের কোনোটাই মান্য করা সম্ভব ছিল না। তিনি বলেছিলেন, সশস্ত্র পথ বর্জন তখনই করা যাবে যখন তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। অর্থাৎ তৃতীয় যে শর্তটি দেওয়া হয়েছিল, যেটি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে সরকার গঠনের দাবি ত্যাগ করার, সেই সরকারকে দাবিটি মেনে নিতে হবে। বর্ণবাদকে ভাঙার জন্য তিনি এক মানুষ এক ভোটের যে দাবি জানিয়ে আসছিলেন সেটি প্রতিষ্ঠিত হলে কৃষ্ণাঙ্গরা সরকার গঠন করবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। সেই দাবি ছাড়ার প্রশ্ন তো অবান্তরই ছিল।

সশস্ত্র পন্থা বহাল রাখা ও সর্বজনীন ভোটাধিকার আদায় করা এই দুইটি বিষয় ছিল অঙ্গাঙ্গীরূপে জড়িত, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেটা তো এএনসি’র জন্য কোনো মৌলিক অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হতো না, কারণ দলটি মোটেই কমিউনিজমপন্থী নয়, সুনির্দিষ্টরূপেই জাতীয়তাবাদী। এরকম ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদীরা কী করতেন আমরা নিশ্চিত নই, অত্যাসন্ন বিজয়কে দ্রুতগতিতে  হস্তগত করার স্বার্থে তাঁরা হয়তো পুরাতন সহযোদ্ধাকে ত্যাগ করে ভারমুক্ত হতেন। কিন্তু ম্যান্ডেলা তা করেন নি। তিনটি প্রস্তাবই তিনি একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এতে তাঁর মুক্তি ছয় মাস বিলম্বিত হয়েছিল, কিন্তু সরকারকে তাদের আরোপিত তিনটি শর্তই প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল।

ম্যান্ডেলা বলেছেন, কমিউনিস্টদের সঙ্গ ত্যাগ করার প্রস্তাব তাঁর কাছে বিবেচনার অযোগ্য। একাধিক কারণে। প্রথমত তাঁদের সঙ্গে এএনসি’র সম্পর্ক দীর্ঘ সত্তর বছরের, শুরু সেই বিশের দশকে। সরকারের কাছে ম্যান্ডেলার পালটা প্রশ্ন ছিল : ‘কোথাও কি এমন একজনও সম্মানিত লোকের সন্ধান পাওয়া যাবে যিনি শত্রুর নির্দেশে সারা জীবনের বন্ধুকে ত্যাগ করেছেন, অথচ আশা রেখেছেন যে তাঁর নিজের অনুসারীরা তাঁর ওপর আস্থা রাখবেন? এমন বিশ্বাসঘাতক মুক্তিসংগ্রামীকে কোন শত্রুই বা বিশ্বাস করবে? অথচ ঠিক এই কাজটিই সরকার আমাদেরকে করতে বলছে, আশা করছে আমরা আমাদের বিশ্বস্ত মিত্রদেরকে ত্যাগ করবো। না, শাসকদের পাতা ওই ফাঁদে আমরা পা দিচ্ছি না।’

ম্যান্ডেলা বলেছেন যে, কমিউনিস্টবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের সংকীর্ণ মনোজগতে এই উপলব্ধিটা অগম্য যে কমিউনিস্টরা ছিলেন সংগ্রামী কৃষ্ণাঙ্গদের অকৃত্রিম সুহৃদ। তারা মনে করেছে যে, তাত্ত্বিক পার্থক্যের বিলাসিতার অপচয়ে জাতীয়তাবাদীদেরকে প্ররোচিত করাটা কঠিন হবে না। তারা জানে না যে, দক্ষিণ আফ্রিকাতে বহুকাল ধরে কমিউনিস্টরাই ছিলেন একমাত্র রাজনৈতিক দল যাঁরা কৃষ্ণাঙ্গদেরকে মানুষ বলে মনে করতেন, মানুষ হিসাবে তাঁদেরকে মর্যাদা দিতেন এবং একসঙ্গে ওঠাবসা চলাফেরা আলাপ-আলোচনা খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রকার সঙ্কোচ করতেন না। তাঁরাই একমাত্র দল যাঁরা আফ্রিকানদের রাজনৈতিক অধিকার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের সংগ্রামে সহযোগিতা দানে সর্বদা প্রস্ত্তত ছিলেন।

তিনি জানিয়েছেন যে, কেবল স্থানীয়ভাবে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এএনসি কমিউনিস্টদের সমর্থন ও সাহায্য লাভ করেছে। আফ্রো-এশীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি পশ্চিমের অনেক দেশই নৈতিক সহানুভূতি প্রকাশ করেছে; কিন্তু ম্যান্ডেলা বলছেন, কমিউনিস্টদের সমর্থন ছিল পরিষ্কার ও সর্বাত্মক। বর্ণবাদের নিন্দা যে শোনা যায় নি এমনও নয়, শোনা গেছে; কিন্তু এক্ষেত্রে সর্বাধিক উচ্চকণ্ঠ ছিলেন কমিউনিস্টরাই। নিজের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় থেকে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সংগ্রামের কালে তিনি পশ্চিমের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু অস্ত্র সাহায্যে পেয়েছেন কেবলমাত্র কমিউনিস্ট দেশগুলোর কাছ থেকেই। আদালতে জানিয়েছেন এমন তথ্য। সরল ও স্পষ্ট ভাষায়। অকৃতজ্ঞতা ও অসত্যভাষণ তাঁর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ছিল না।

সরকারের দিক থেকে অপপ্রচার ছিল যে, এএনসি কমিউনিস্ট পার্টির গোপন নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। ম্যান্ডেলা জানিয়েছেন যে, এর চেয়ে বড় মিথ্যা কথা আর হয় না। নেতৃত্ব সর্বদাই ছিল এএনসি’র হাতে, সেই নেতৃত্ব মেনে নিয়েই কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে আন্দোলন করেছেন, বছরের পর বছর ধরে সব রকমের নির্যাতন সহ্য করেছেন, তাঁদের ভেতর কোনো প্রকার দ্বিধার প্রকাশ দেখা যায় নি। এই যে প্রশংসা দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টির কাজের এর ভেতরে কিন্তু অনূক্ত একটি বক্রাঘাতও রয়েছে। সেটা হলো, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দানে কমিউনিস্ট পার্টির ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার কালিমা ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির ললাটেও অঙ্কিত। প্রায় একইভাবে তাঁরাও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে কখনো যুক্ত হয়ে কখনো-বা পাশাপাশি থেকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাঁদের ওপর দিয়ে নির্যাতন কম যায় নি, অনেকটা সময়েই দল নিষিদ্ধ থেকেছে, কিন্তু নেতৃত্ব রয়ে গেছে জাতীয় কংগ্রেসের হাতেই। আর বেশির ভাগ সময়েই এই নেতৃত্ব ছিল কমিউনিস্ট-বিরোধী। দক্ষিণ আফ্রিকাতে যেমন ভারতেও তেমনি, কমিউনিস্ট পার্টি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে নি। রাজনৈতিক সংগ্রামে পথের নির্দেশ এসেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে। ফলে চীন, ভিয়েতনাম ও কিউবাতে কমিউনিস্ট পার্টি যেভাবে জনগণের মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার ও ভারতের পার্টি সেভাবে সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে নি। একই ঘটনা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। এসব দেশে বিপ্লব সম্ভব হয় নি, স্বাধীনতার সুফল ক্ষমতা হস্তান্তরের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।

 

পাঁচ

অনেক দিক দিয়েই ম্যান্ডেলার সাফল্য অসামান্য এবং অবশ্যই বিরল। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে বর্ণবাদ ছিল সেটিকে তিনি ভেঙে ফেলেছেন। দেশটি ছিল বিভক্ত, তাকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছেন, রাজনৈতিক মুক্তির পর সেখানে রক্তপাতের উৎসব শুরু হবার আশঙ্কা ছিল, তেমন কিছু ঘটতে দেন নি। ক্ষমতা অাঁকড়ে ধরে রাখেন নি, দলের এবং অনুরাগীদের প্রবল চাপে থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা তো দূরের কথা, ধরে রাখতেও সম্মত হন নি। ত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রীয় বিবেচনাকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপরে স্থান দিয়েছেন। একজন জাতীয়তাবাদী নেতার পক্ষে এর চেয়ে অধিক অর্জন সম্ভব বলে মনে হয় না।

তবে তিনি জাতীয়তাবাদীই ছিলেন, সমাজতন্ত্রী নন। সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর আকর্ষণ যে ছিল না তা নয়। এমনও নয় যে, মার্কসবাদের প্রভাব তাঁর ওপরে পড়ে নি। বিলক্ষণ পড়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর নিজের সীমাটা জানতেন, তার বাইরে গিয়ে ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে সম্মত হন নি। গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মিল ও দূরত্ব দুই-ই ছিল, যেমনটা ছিল লেনিনের সঙ্গেও। ওই দুই পথপ্রদর্শকের মাঝখানের স্থানটিতে ছিল তাঁর অবস্থান। জাতীয়তাবাদী, কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী; রাজনীতিতে বিপ্লবী, কিন্তু তাই বলে সমাজবিপ্লবী যে তা নন। বর্ণবাদ শ্রেণীবিভাজনকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল। শ্রেণীপ্রশ্নের মীমাংসার জন্য বর্ণপ্রশ্নের মীমাংসার প্রয়োজন ছিল। তাঁর নেতৃত্বে বর্ণপ্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধান হলো, কিন্তু শ্রেণীপ্রশ্নের মীমাংসা হলো না। ধনী-দরিদ্রের বিভাজনটা রয়েই গেল।
ম্যান্ডেলা লড়ছিলেন গণতন্ত্রের জন্য। এই গণতন্ত্রকে তিনি বলতেন বৈপ্লবিক গণতন্ত্র। সর্বজনীন ভোটাধিকার সীমিত পরিসরে একটি বৈপ্লবিক অর্জন বটে, কিন্তু ভোটের স্বীকৃতির দ্বারা গণতন্ত্রের যেটি মৌলিক শর্ত, অধিকার ও সুযোগের সাম্য, সেটি প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ভোটের সাম্য এসেছে, তাতে আর্থিক বৈষম্য ঘোচার কথা নয়, ঘোচেও নি। শ্বেতাঙ্গদের অধীনে রাষ্ট্র ছিল এককেন্দ্রিক, বর্ণবাদের অবসানের পরে রাষ্ট্রক্ষমতার যে বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে তা মোটেই নয়; আগের মতোই সব ক্ষমতা রয়ে গেছে কেন্দ্রের হাতে। আর উন্নতি যা ঘটেছে তা পুঁজিবাদী ধরনের। পুঁজিবাদী রোগবালাই সমানে ছড়িয়েছে। জাতীয়তাবাদী বিজয়টিকে সমাজতন্ত্র অভিমুখে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্বটা ছিল সমাজতন্ত্রীদের। সে-কাজটি করতে তাঁরা অসমর্থ হয়েছেন। যেমন তাঁরা হয়েছেন আমাদের দেশেও।
আমরা দেখলাম যে, একাধিক কারণে ম্যান্ডেলা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, কেবল তাঁর নিজের দেশের ইতিহাসেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও। একটি নেতিবাচক কারণও আছে। সেটি এরকমের। রাষ্ট্রকে জনগণতান্ত্রিক করবেন বলে ম্যান্ডেলার ভরসা ছিল, রাষ্ট্র যে শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদীই রয়ে গেলো তাতে আবারো প্রমাণিত হয়েছে যে, রাষ্ট্রের ওপরকাঠামোতে পরিবর্তন আনাটা যথেষ্ট নয়, অবকাঠামোতেও পরিবর্তন চাই, এবং তার জন্য অত্যাবশ্যক হচ্ছে সমাজবিপ্লব। সমাজবিপ্লব ঘটে নি বলেই ভারতের মানুষ উন্নতি দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের খোঁজ পাচ্ছে না। একই দশা বাংলাদেশের মানুষেরও।