যখন অসময়

ফা রু ক  ম ই ন উ দ্দী ন

কুসুমবাগ প্রাইমারি স্কুলের একচিলতে মাঠের মাঝ বরাবর টানানো নকশাদার প্যান্ডেলের ছাদের পেট থেকে ঝালরের মতো ঝুলে আছে রংবেরঙের পাকানো সুতো। কুয়াশা আর মেঘে-ঢাকা সকালের ম্লান আলোর ওপর প্যান্ডেলের নিচের ছায়া আরেক পরত ছাই মেখে দিয়েছিল। এখন কুয়াশা উবে গেলে মেঘের পাতলা আবরণের নিচ থেকে সূর্যটা তেড়ে ওঠার পর প্যান্ডেলের নিচের ছায়াটুকুতেই বরং আরাম বোধ হয়। মাঘ যাই যাই করছে, কিছুক্ষণ আগে যারা বাইরে রোদের মধ্যে বসেছিল, তারা একজন-দুজন করে ছায়ার নিচে চলে আসে। প্যান্ডেলের এক মাথায় এপাশ-ওপাশ জুড়ে লম্বা করে টেবিল ফেলা, তার ওপর ময়লাটে সাদা চাদর বিছিয়ে পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছে স্থানীয় ডেকোরেটরের লোকেরা, টেবিলের সামনেও ঝোলানো হয়েছে একই কাপড়ের পর্দা। পেছনের বিবর্ণ পর্দার ওপর সাঁটানো ‘দুস্থ শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠান’ লেখা ঝাঁ-চকচকে ডিজিটাল ব্যানার বেমানান আভিজাত্যের জেল্লা ছড়ায়। নিচে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিদের নাম-পদবিসহ শিলালিপির কায়দায় উৎকীর্ণ। দানগ্রহীতা এবং উপস্থিত মানুষের মগজে গেঁথে দেওয়ার জন্য ব্যানারের একদম চাঁদির কাছে ব্যাংকের বিশাল লোগো জ্বলজ্বল করে। রোদ চড়লে মাথার ওপরে টিয়া রঙের কাপড়ের ছাদ পেরিয়ে আসা সূর্যের আলোর সবুজাভ আভায় প্যান্ডেলের নিচের সবকিছু অপরিচিত মনে হয়।

আজ সকালবেলায় নাতি বিল্লালের সঙ্গে স্কুলের মাঠে চলে এসেছিল সফুরা বিবি। রাতের বেলায় শীতের কামড়ে ঘুম ভেঙে যায় বলে সকালবেলায় শীতটা কমে এলে আরামের ঘুম নেমে আসে, তাই কিছুটা বেলা করে ওঠে বুড়ি। তা, খুব বেলা অবধি যে শুয়ে থাকতে পারে তাও নয়। এ-সময় বিল্লালের মাকে ছুটতে হয় কাজে। ভোরে বেরিয়ে তিন বাড়িতে কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায়। তখন সারাদিন সফুরা প্রায় একাই থাকে ঘরে। দুর্বল হাতে এটা-সেটা করার চেষ্টা করে, যাতে বউটা ফিরে এলে কিছু কাজ পড়ে না থাকে। বিল্লালের বাপ ঢাকা যাওয়ার কথা বলে বছরদুয়েক আগে সেই যে গেল, আর কোনো খবর নেই। পাড়ার একজন ঢাকায় ওকে রিকশা চালাতে দেখেছে। আরেকটা বিয়ে করে কোন বস্তিতে নাকি থাকে। বউটা কিছুই বলে না মুখে। গত বছর ওদের বস্তির সোলেমান যখন ঢাকায় গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে ফেলে, ওর বউ যেভাবে চিৎকার-কান্নাকাটি করে গালাগাল করে পাড়া মাথায় তুলেছিল, সেরকম কিছুই করে না বিল্লালের মা। ওর চুপচাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে মায়া হয় সফুরার। মাঝে মাঝে বলে, কী শত্তুর প্যাটে ধরিছিলাম আমি। ঢাকায় যায়ে কোন মাগির খপ্পরে পড়িছে কিডা কবে?

একথার পিঠেও কিছুই বলে না মেয়েটা। কিছু বললে যে-বুকটা হালকা হয়, এ-কথা কীভাবে বোঝাবে ওকে? স্বামীর বিয়ে করার খবরটা প্রথম শোনার পর কিছুদিন রাতের বেলায় নিঃশব্দে কাঁদত ও। ঘুম ছুটে গেলে সফুরা ঘুমের ভান করে কান খাড়া করে শুনত ফোঁপানির শব্দ। কখনো অন্ধকারের ভেতর ঘুমজড়িত গলায় বলত, এ-বউ, কাঁদিসনে। দুদিন পর পিরিত ছুইটে গেলে ঘরের ছাওয়াল ঘরে ফিরে আসবে, দেহিস ক্যানে। কোনো জবাব দেয় না বউ। ঘুমজাগা ভাঙা গলায় সফুরা যেন আপন মনে বলতে থাকে, যে গেছে, তার জন্যি কাঁইদে কী লাভ? ছাওয়ালডারে মানুষ করতি অবে। সে বড় অয়ে গেলি নিচ্চিন্দি। আমি আর কদিন বাঁচপো? বিড়বিড় করতে করতে কখন যে ঘুম নেমে আসত চোখে বুঝতেই পারত না। সকালে উঠে বউয়ের থমথমে মুখ দেখে সফুরা বুঝতে পারত, রাতে অনেক কেঁদেছে মেয়েটা। নিজের ছেলের কারণে ওর নিজেকেই অপরাধী মনে হয়।

বাপ নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার পর প্রথম প্রথম বিল্লাল কখনো জিজ্ঞেস করত, মা, বাবা কহন আসবি?

– সোমায় হলিই আসবি। আসলি তো নিজ চক্ষে দেখতি পাবি।

– আমার জন্যি কিছু কিনি আনবি না বাবা?

ওর মা আদর করে বলত, আনবি না আবার? না আনলি ওরে ঘরে থাকতি দেবো?

তারপর যত দিন গেছে, তত চাপা হয়ে গেছে মেয়েটা। বিল্লাল বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে মুখ ঝামটে বলত, কিডা কবে কহন আসবি! আর কুনোদিন যদি আমারে জিগাস করিছিস তো!

সফুরা এগিয়ে আসে, বাচ্চা মানুষ, ওরে ধমক দিচ্ছিস ক্যান ক-দি? ও কি অতকিছু বোঝে? শেষ পর্যন্ত যখন বিয়ে করার খবরটা আসে, তারপরও এটা নিয়ে কখনো কোনো কথা বলেনি মেয়েটা।

মা সকালে কাজে বের হয়ে গেলে বিল্লালের আর পাত্তা নেই। কোথায় কোথায় টইটই করে ঘুরে, কে জানে। বেলা বাড়ার পর এক ছুটে ঘরে ঢুকে বলে, দাদি, খাতি দে, জববর খিদা লাগিসে। সফুরা নাতিকে আগের রাতের বাসি ভাত বেড়ে দেয়। যেদিন রাতের ভাত থাকে না, বাটিতে মুড়ি দিয়ে জংধরা টিনের ভেতর থেকে এক ডেলা গুড় বের করে দেয়। মুড়ি দেখে বিল্লালের মেজাজ চড়ে যায়, এ-বুড়ি, ভাত নেই? মুড়ি খালি প্যাট ভরবে? সফুরা নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ভাত নেই রে ভাইডি। গুড়-মুড়ি খায়ে বেশি কইরে পানি খায়ে নিলি প্যাট ভইরে যাবেনে।

বিল্লাল চোটপাট করলেও মুড়ি চিবায়, তারপর এক কামড় গুড় মুখে নিয়ে বলে, মা ভাত নিয়ি আসতি আসতি আবার খিদে পায়ে যাবে কলাম।

সফুরা বলে, ইশকুলি যায়ে দোস্তগের সঙ্গে খেলতি খেলতি খিদার কথা মনেই থাকবে না, দেহিস ক্যানে।

বিল্লালকে ওদের বস্তির কাছে একটা এনজিও স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে ওর মা; কিন্তু ওর পড়াশোনায় মন নেই। সকালবেলায় বই-খাতা নিয়ে যায়, কখনো যায় না, সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় কে জানে। ওর মা কাজের বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এলে  সে-খাবার তিনজনে মিলে ভাগ করে খায়। কখনো মা না খেয়ে ছেলে আর শাশুড়িকে সব খাইয়ে দেয়। বলে, আজ এক বাসায় খাওয়ায়ে দিলো, ওগের বাসায় কাল রাতির বেলা মেহমান খায়ে গেছে। অনেক খাবার বাঁইচে গিইলো, আমারে দিয়ে কলো খায়ে নে।

বিল্লাল না বুঝলেও সফুরা বোঝে, কখনো খাবার কম হলে মেয়েটা না খেয়ে ওদের খেতে দেয়। সে-খাবার ওর গলা দিয়ে নামতে চায় না। তখন নিজের পাত থেকে অর্ধেক তুলে রেখে বউকে বলে, সব খাতি পাল্লাম না রে মা, তুই খায়ে নে। মেয়েটার জন্য বুকের ভেতর কষ্ট হয় ওর। ছেলে ঘর ছাড়ার পর যত দিন যায়, সফুরার ভেতর এক ধরনের ভয়ও দানা বাঁধতে শুরু করে। বউটা যদি নিকে করে অন্য কারো সঙ্গে চলে যায়, তখন ওর নিজের কী অবস্থা হবে ভেবে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চায়। তাই আজকাল বউয়ের প্রতি মায়ার সঙ্গে এক ধরনের তোয়াজও মিশে থাকে যেন।

সন্ধ্যার পর বস্তির ঘরে ঘরে লোকজন ফিরতে শুরু করে। ততক্ষণে মেয়েদের উকুন বাছা, চুল আঁচড়ানোর কাজ শেষ। তখন সারাদিনের প্রাণহীন ঘরগুলোতে ব্যস্ততা জেগে ওঠে। ঘরে ঘরে রান্নার আয়োজন, দীনহীন হলেও জাগতিক স্পন্দন শোনা যায় বস্তি জুড়ে। ধোঁয়া আর রান্নার নিজস্ব গন্ধ ঘরগুলোর ওপর থম ধরে ঝুলে থাকে। কর্মক্লান্ত পুরুষেরা কলতলায় ভিড় করে গায়ে পানি ঢালে। তারপর ভেজা লুঙ্গিতে গা মুছে গায়ে চাদর জড়িয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়ায়। কেউ বস্তির মুখে দোকানের বেঞ্চে বসে চায়ের লিকারে চুমুক দিয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরায়।

বেলা বাড়তে থাকলে সফুরার পেটের ভেতর খিদের আঁচড় শুরু হয়। সকালে কিছু মুখে দিয়ে আসেনি ও, মনে করেছে বেলা বাড়ার আগেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। সকাল থেকে বিল্লাল তাড়া দিচ্ছিল, এই দাদি, যাবিনে? কোম্বল শেষ অয়ে যাবেনে কলাম। টিউবওয়েল থেকে পস্নাস্টিকের বোতলে আনা পানি দিয়ে কোনোরকমে হাত-মুখ ধুয়ে নেয় সফুরা। বিল্লাল এবার মাকে নিয়ে পড়ে। মা, তোমারেও যাতি অবে। দ্যাহ, ওগের ঘরের বেবাক যাতিসে। ওর মা কাজ কামাই দিতে রাজি হয় না, বলে, নারে বাজান, তুই দাদিরে নে যা। অই ছাতার একখান কোম্বলের জন্যি কাজ কামাই দেওয়া ঠিক অবেনানে। বিল্লাল বলে, আমারে দেবে নানে। ওর মা কাজে যাওয়ার আগে ঘরের এটা-সেটা ঠিক করে রাখতে রাখতে বলে, না দিলি দেবে না। শীত চইলে যাতিসে, অ্যাহন কোম্বল দে করবানে কী? তারপর আঁচলের খুঁট থেকে কাগজের দুটো টুকরো সাবধানে ওর হাতে দিয়ে বলে, একডা তোর দাদির, আরেকডা তোর। হারায়ে ফেলিসনে য্যান।

গতকাল ব্যাংকের লোকেরা ওয়ার্ড কমিশনারের সই আর সিল-ছাপ্পর দেওয়া কাগজের টুকরো দিয়ে গেছে। ওদের সঙ্গে কমিশনারের লোক ছিল একজন। ঘরপ্রতি একটা সিস্নপ। ঘরে বুড়ো মানুষ থাকলে আর একটা বাড়তি। সফুরার কারণে বিল্লালদের ভাগে পড়েছে দুটো। ওরা বলে গেছে, কম্বল নেওয়ার সময় এই সিস্নপ জমা দিতে হবে, তা না হলে কম্বল মিলবে না।

বিল্লাল একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পেয়ে যত্ন করে প্যান্টের পকেটে কাগজের টুকরোদুটো রাখে। তারপর রাতের বাসি ভাত থেকে অল্প উঠিয়ে নিয়ে নাকেমুখে গুঁজে দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। হাত ধুতে ধুতে দাদিকে বলে, এ বুড়ি, তোর খাতি তো ম্যালা টাইম লাগবে, আমার মোত চট কইরে খায়ে নিতি পারবি?

সফুরা নাতির অস্থিরতা দেখে বলে, নারে ভাইডি, আইসে খাবানে। আমি অত জলদি খাতি পারি না। – তাহলি চল, লাইনের আগে থাকতি পারলি জলদি জলদি ফিরে আইসে খাতি পারবি।

দাদি-নাতির এসবের হুড়োহুড়ির মধ্যে তালাটা বের করে রেখে বিল্লালের মা বেরিয়ে গেছে। উৎসাহে টগবগ করতে করতে বিল্লাল ঘরের নড়বড়ে কড়ার সঙ্গে তালা লাগিয়ে চাবিটা দাদির শাড়ির আঁচলে গিঁট দিয়ে লাগিয়ে দেয়। তারপর মুরবিবর মতো বলে, চাবিডা হারায়ে ফেলিসনে য্যান।

রাস্তায় নেমে প্রায় ছুট লাগায় বিল্লাল, ওর সঙ্গে পেরে ওঠে না সফুরা। বিল্লাল কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আবার দাদির জন্য অপেক্ষা করে। বলে, অমন মরার মতো কইরে হাঁটলি দিন কাবার অয়ে যাবেনে। কোম্বল শেষ অয়ে গেলি বইসে বইসে আঁটি চোষা লাগবি কলাম।

সফুরা কিশোর নাতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। বলে, তুই এগো ভাইডি, আমি আস্তে আস্তে হাঁইটে আসতিসি। অত জোরে হাঁটতি পারি আমি?

বিল্লাল দ্রুত হেঁটে অনেকদূর এগিয়ে যায়, তারপর দাদির জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে।

হাঁপাতে হাঁপাতে যখন স্কুলের মাঠে পৌঁছয় ওরা, ততক্ষণে প্যান্ডেলের নিচে বহু নারী-পুরুষ জড়ো হয়ে গেছে। কোট-টাই পরা ব্যাংকের লোকজন ওদের সারবেঁধে বসানোর চেষ্টা করে।  আয়োজন দেখে বিল্লাল দাদিকে বলে, দেহিছিস, বহুত দেরি কইরে ফেলাইছিস। অ্যাহন এগের পিছে লাইন দিতি অবে। সফুরা কিছু বলে না, এতদূর রাস্তা হেঁটে এসে ওর পাদুটো ভেঙে পড়তে চায়। বিল্লাল ওকে ধরে লাইনের পেছনে বসিয়ে দিলে কাপড়ের পুঁটলির মতো পড়ে থাকে সফুরা।

কিছুক্ষণ দাদির পাশে বসে থেকে একসময় উসখুস করে উঠে পড়ে বিল্লাল। বলে, দাদি, তুই বইসে থাক, আমি ইকটু দেইখে আসি। ওঠার সময় সামনের মহিলাকে বলে, খালা আমার দাদিরে রাইখে গেলাম, আমি যাবো আর আসবো।

তারপর সামনের সাজানো টেবিলের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ও। টেবিলের পেছনে কয়েকটা কম্বলের গাঁইট ফেলে রাখা, ওখান থেকে বের করে কিছু সাজিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলের ওপর। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করে ও, এগুলো সবাইকে দিয়ে কুলোবে কিনা। তারপর একপাশে দাঁড়িয়ে কোট-টাই পরা লোকগুলোর ব্যস্ত ছোটাছুটি দেখতে থাকে। চারপাশে একটা উৎসবের আবহ। ছোটাছুটির সময় ওদের গলায় ঝোলানো টাই উড়ন্ত ঘুড়ির লেজের মতো নাচানাচি করে। কম্বল কখন দেওয়া শুরু হবে কথাটা কাউকে জিজ্ঞাসা করার সাহস হয় না ওর। ওদের কয়েকজন ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে নানান ভঙ্গিমায় খটাখট সেলফি তোলে ওদের ফোনে। ওদের চলাফেরায় অস্থিরতা। ঘনঘন ঘড়ি দেখে, ‘বস এখনো আইল না, এতোগুলা মানুষ সক্কালবেলা থেইকা বইসা আছে। এরা ক্ষেইপা গেলে সামলান যাইব?’

– শীতকাল চইলা গেল, অ্যাহন পাঠাইসে কম্বল। কী কাজে লাগবে এগুলা ওদের?

– আগামী বছরের জন্য তুলে রাখবে, তা না হলে বিক্রি করে দেবে। সামনের শীতে কেউ না কেউ তো আবার কম্বল বিলাবে।

– আরে, প্রত্যেক বছর সারা দেশে সবাই মিলে যে-পরিমাণ কম্বল দেয়, দেখ গিয়া সবার ঘরে কয়েকখান করে কম্বল জমে গেছে এতোদিনে। কম্বল না দিয়ে নগদ টাকা দিয়ে দিলে ওরা দরকারি জিনিস কিনে নিতে পারত।

– নগদ টাকা দিলে সব উড়ায়া দেবে, নেশা করবে, সিনেমা দেখবে। কম্বল তো আর উড়ায়া দেওয়া যাইব না।

– সবাই কি আর উড়াবে? বেছে বেছে কেবল মহিলাদের হাতে নগদ টাকা দিলে ওরা বরং সেই টাকা সংসারের কাজে লাগাবে। পুরুষদের হাতে না দিলেই হলো।

একজন ফোড়ন কাটে, আরে জববর কথা তো। খাড়াও তোমারে টেলিভিশনের টক শোতে পাঠাইতে অইব।

হো হো করে হেসে ওঠে সবাই। এই সমবেত হাসির প্রতিধ্বনির মতো লাইনে বসে থাকা নারী-পুরুষের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, সেই গুঞ্জন স্বস্তিদায়ক নয়। ব্যাংকের একজন মাইকে প্রবল ফুঁ দিয়ে বলে, উপস্থিত ভাই ও বোনেরা, ধৈর্য ধরে বসে থাকার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আমরা খবর পেয়েছি, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের আজকের প্রধান অতিথি কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে এসে পৌঁছাবেন। বিশেষ অতিথি আপনাদের নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার সাহেবও এসে যাবেন। দয়া করে আপনারা শৃঙ্খলা বজায় রেখে আমাদের সহযোগিতা করবেন, যাতে আপনাদের সবার হাতে আমরা কম্বল তুলে দিতে পারি।

সফুরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিল্লালকে খোঁজে। একটানা বসে থাকতে থাকতে ওর পায়ে খিল ধরে যায়, উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পায় না। খিদের জন্য, নাকি খোঁয়ারির ঘোরে কিংবা প্যান্ডেলের নিচের সবুজাভ আলোতে ওর কাছে সবকিছুই অচেনা ঠেকে। অপরিচিত মানুষগুলো ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় এদিক-ওদিক। প্রতীক্ষার ক্লাস্তিতে মাথা বারবার ঢলে পড়তে চায় ওর, বহুবারের চেষ্টায় বিল্লালকে একঝলক দেখা যায় দূরে, ওকে ডাকার শক্তি পায় না গলায়। ডাকলেও অতদূর থেকে ওর কানে পৌঁছাবে না। তবু নাতিকে একবার দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বোজে সফুরা। আধো ঘুমের ঘোরে ওর চোখে আবছা ভেসে ওঠে ছোটবেলার ছবি। ধোঁয়া ওঠা ভাতের হাঁড়ির চারপাশে ওরা ভাইবোনরা খেতে বসেছে, ওর মা সবার পাতে ভাত বেড়ে দেয়। গরম ফেনা ভাতের গন্ধ নাকে এসে লাগে। এবার মায়ের জায়গায় নিজেকে দেখতে পায়, ভাত বেড়ে দিচ্ছে বিল্লালের বাবাকে, পাশে বিল্লালের দাদা থালা নিয়ে বসে আছে।

মাইকের শব্দে খোঁয়ারি ভেঙে বাস্তবে ফিরে আসে ও। বিল্লাল কোথা থেকে ছুটে এসে ঠেলাঠেলি করে দাদির পাশে বসে পড়ে। উত্তেজিত গলায় বলে, এ দাদি, ওগের বড় সায়েব আইসে পড়িসে। অ্যাহন শুরু অবে। সারিতে বসা নারী-পুরুষেরা হুড়োহুড়ি করে উঠে লাইনে দাঁড়িয়ে যায়, পেছনের ধাক্কায় গায়ে গা লাগানো মানব-সারিটা বেঁকে গিয়ে অস্থির সাপের মতো নড়াচড়া করতে থাকে। মাইকে একজন বলে, আপনারা সবাই যে-যার জায়গায় বসে থাকেন। আমাদের সভার কাজ এখনই শুরু হবে। লোকজনের গুঞ্জন স্তিমিত হয়ে আসে, নিশ্ছিদ্র সারিটা শিথিল হয়ে ভেঙে পড়ে ঘাসের ওপর।

মাইকে তখন একজন বলে যাচ্ছে, আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন আমাদের আঞ্চলিকপ্রধান। তিনি তাঁর শত ব্যস্ততার মাঝেও আপনাদের মধ্যে কম্বল বিতরণ করার জন্য উপস্থিত হয়েছেন। আরো উপস্থিত আছেন আপনাদের অতিপরিচিত আপনজন নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার। তিনি আমাদের সাহায্য না করলে সুন্দরভাবে এই বিতরণকাজ আমরা চালাতে পারতাম না। এখন আপনাদের উদ্দেশে কিছু কথা বলবেন অত্র এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার।

বক্তৃতার আভাস পেয়ে সারিতে বসা নারী-পুরুষের মধ্যে আবার গুঞ্জন শুরু হয়। ওয়ার্ড কমিশনার ‘বিসমিল্লাহির রাহমানুর রহিম, আমার প্রিয় কুসুমবাগ মহল্লার ভাইবোনেরা’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন। লোকজন চুপচাপ হয়ে গেলেও তাদের কানে কমিশনারের কোনো বক্তব্য ঢোকে কি ঢোকে না, তারা এদিক-সেদিক তাকায়, ঘাড় উঁচিয়ে পেছনে বসা লোকজনের সংখ্যা দেখে কম্বলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা যাচাই করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শরীর চুলকাতে মনোযোগ দেয়। কোলের বাচ্চা কেঁদে উঠলে মায়েরা বক্তৃতা শোনার চেষ্টা বাদ দিয়ে সামান্য ঘুরে বসে বাচ্চার মাথাটা গুঁজে দেয় ময়লা আঁচলের নিচে। এসবের মধ্যে কমিশনার বলতে থাকেন, আপনাদের শীতের কষ্ট দেখে আমি ব্যাংকের ম্যানেজার সায়েবরে অনুরোধ করলাম, কিছু কম্বল বরাদ্দ করার জন্য। তিনি আমার কথা শুনিছেন, শুধু শোনেন-ই নাই, তার বড় সায়েবরে দাওয়াত দিয়ে হাজির করেছেন আপনাদের কাছে। কমিশনার এযাবত তাঁর এলাকায় কী কী উপহার দিয়েছেন মহল্লাবাসীকে, ন্যায্যমূলে চাল, রিলিফের কম্বল এসব ফিরিস্তি দেওয়া শুরু করলে প্রধান অতিথি উসখুস করে ঘড়ি দেখেন, পাশে বসা ম্যানেজারের কানে কানে কথা বলেন। তাঁর ভয়, লোকজন দীর্ঘ প্রতীক্ষায় হট্টগোল শুরু করলে সব ভেস্তে যাবে, বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগও মিলবে না। খোঁয়ারির ভেতর ‘চাউল’, ‘কম্বল’ এসব শব্দ সফুরার কানের ভেতর ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়লে ও ধড়মড় করে উঠে পড়ে। বিল্লাল ওর দিকে তাকিয়ে নিরুপায় হাসে, সকালবেলায় কিছু খেতে না দিয়ে জোর করে নিয়ে আসার জন্য বুড়ির জন্য মায়া হয়।

ততক্ষণে শেষ মাঘের রোদ প্যান্ডেলের ছাদের পুরো দখল নিলে ভেতরে নেমে আসে ফাগুন শেষের গুমোট। প্রধান অতিথি গলার টাই আলগা করে দিয়ে সামনে পড়ে থাকা স্থানীয় দৈনিকের শীর্ণ পাতাগুলো ভাঁজ করে হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করেন। ম্যানেজার তার গায়ের ভারী কোট খুলে চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলেন। এ সময় ব্যাংকের লোকজন ছোটাছুটি করে কোথা থেকে একটা বড় পাখা এনে মাটিতে বসিয়ে চালিয়ে দিলে সেটি এপাশ-ওপাশ মাথা ঘুরিয়ে ‘না না’ করার ভঙ্গিতে হাওয়া দিতে থাকে অতিথিদের। সে-হাওয়ায় প্রধান অতিথির টাই ওড়ে, খসে পড়তে চায় কমিশনারের গায়ের দামি শাল। শীতের কম্বল বিলোতে এসে আচমকা পাখার বাতাসের বিপরীত হাওয়ায় কমিশনার কিছুটা থতমত খেয়েই যেন তার কথা শেষ করেন।

সামনের সারিতে বসা লোকজন আবার উঠে দাঁড়ানোর উপক্রম করলে মাইকে সবাইকে শান্ত হয়ে বসার জন্য অনুরোধ করা হলেও কেউ কেউ অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাজ কামাইয়ের ক্ষতি আর একখানা কম্বলের দামের পার্থক্য বের করতে না পেরে রোজগেরে লোকজন ধন্দে পড়ে যায়। মাইকে বলে, এবার আপনাদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেবেন আমাদের আজকের প্রধান অতিথি…। উপস্থিত সবার মধ্যে একটা হতাশ গুঞ্জন বক্তার প্রারম্ভিক ফুঁয়েরসঙ্গে উড়ে চলে যায়। এই বক্তা কমিশনারের মতো জনপ্রতিনিধি নয় বলে তাঁর বক্তব্য আসে ধিকিয়ে ধিকিয়ে, শব্দের পিঠে শব্দ খুঁজতে খুঁজতে তিনি রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মোছেন, কাঁপা-হাতে সামনের মাইক্রোফোনের মু-ু মচকে দিয়ে মুখের সামনের সঠিক অবস্থানে বসানোর চেষ্টা করেন। তাঁর অনভ্যস্ত শব্দ ও বাক্যের মধ্যকার ফাঁক আবহসংগীতের মতো ভরাট করে দেয় বাচ্চাদের হট্টগোল আর মানুষের অধৈর্য গুঞ্জন। সেই গুঞ্জন বাড়তে থাকলে প্রধান অতিথি শব্দ হাতড়াতে হাতড়াতে প্রায় অসমাপ্ত বাক্যে তাঁর কথা শেষ করেন।

সঙ্গে সঙ্গে কোনো ঘোষণা ছাড়াই লোকজন অস্থির ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো লাইনের ফাঁকে গুঁজে দিতে থাকে নিজেদের শরীর। ফলে নানা বয়সী নারী-পুরুষের সারিটি পরিণত হয় আঁকাবাঁকা এক নিরেট মানবপ্রাচীরে। মাইকের ‘সবাই ধৈর্যসহকারে লাইনে থাকেন, সবার জন্য যথেষ্ট কম্বল আছে, কেউ তাড়াহুড়া করবেন না’ –  এসব কানফাটানো চিৎকার প্রবল হট্টগোলে চাপা পড়ে যায়। এ সময় ওয়ার্ড কমিশনার মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে সবাইকে ধমকের সুরে বলেন, লাইন ভাঙলি, হুডোপুডি করলি কোম্বল দেওয়া অবে না কলাম।

এই ধমকে কাজ হয়, হইচই কিছুটা থেমে আসে। মনুষ্য-সারিটা টানটান স্প্রিংয়ের মতো প্রবল শক্তি নিয়ে এপাশ-ওপাশ দুলতে থাকে। এই চাপের মাঝামাঝি জায়গায় সফুরাকে হাত দিয়ে বেড় দিয়ে ধরে রাখে বিল্লালের অশক্ত হাত। দাঁতে দাঁত চেপে পেছনের চাপ সহ্য করার চেষ্টা করে। মাইকে বলা হয়, কাগজের সিস্নপ হাতে নিয়ে একজন একজন করে আসতে থাকেন, কোনো বিশৃঙ্খলা করবেন না। সবার জন্য পর্যাপ্ত কম্বল রয়েছে। সারি থেকে একজন একজন করে সিস্নপ উঁচিয়ে টেবিলের সামনে গেলে কাগজের টুকরোটা রেখে দিয়ে হাতে তুলে দেওয়া হয় কম্বল। বিতরণের গতি বাড়ানোর জন্য মঞ্চ থেকে হাত-ইশারায় পা চালিয়ে যেতে বলা হয় ওদের। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাম্যান বলে, এই যে এদিকে তাকান, স্যার আপনিও তাকান। ফ্ল্যাশ না জ্বলা পর্যন্ত টেবিলের ওপাশে প্রধান অতিথির প্রাণহীন হাসিমুখ আর টেবিলের এপাশে হাত বাড়িয়ে কম্বলের প্রান্ত ধরে ক্যামেরার দিকে চেয়ে থাকা কারো ভাবলেশহীন, কারো বিস্ফারিত দৃষ্টি তৈরি করে সিনেমার একেকটি ফ্রিজ শট। প্রথমদিকে কম্বল হাতে পাওয়া ছেলের দল কম্বলের দুকোণ ধরে মাথার ওপর হাত উঁচিয়ে মাঠের মধ্য দিয়ে দৌড়ে বাড়ির পথ ধরলে হালকা হাওয়ায় ঢেউ খেলিয়ে ভেসে থাকে বিশাল ঘুড়ির মতো। সামনের দিক থেকে লোকজন দ্রুত বেরিয়ে যেতে থাকলে পেছনের চাপ আরো বাড়তে থাকে। কম্বল শেষ হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে সামনে ছুটে যাওয়ার তাগিদে পেছন থেকে নিজের অজান্তেই ধাক্কা দিতে থাকলে সামনের জন খেঁকিয়ে ওঠে, কিন্তু সারিচ্যুত হয়ে পড়ার ভয়ে কার্যকর সংঘাতে যায় না।

এতক্ষণ সামনের মানুষ আর পেছনে নাতির কারণে সোজা হয়ে থাকতে পারছিল সফুরা, সামনের মানুষটি বিতরণমঞ্চের দিকে ছুটে গেলে ওর ঠেকনা সরে যায়, উপুড় হয়ে পড়ে যেতে চাইলে পেছন থেকে দুর্বল হাতে টেনে রাখে বিল্লাল। তবু ওর পা চলতে চায় না। টেবিলের পেছনে দাঁড়ানো লোকজন, ‘জলদি আসো, জলদি আসো’ বলতে থাকলে বিল্লাল দাদিকে প্রায় হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় টেবিলের সামনে। চোখে অন্ধকার নেমে আসতে চায় ওর, বিল্লাল পকেট হাতড়ে কাগজের সিস্নপদুটোর একটা বের করে দিলে ওরা একটা কম্বল তুলে ধরে। কাঁপা কাঁপা হাতে ওটার দিকে হাত বাড়াতেই বিভিন্ন দিক থেকে ‘নানি অইদিকে চান’, ‘এই যে, আমার দিকে দেখেন’ – এরকম নানান নির্দেশ কানে আসতে থাকলে দিশেহারা লাগে ওর। কোনদিকে তাকাবে বুঝতে না পেরে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকায় ও। কমিশনার এবার অসহিষ্ণু হয়ে বলে, ‘এই বুড়ি ক্যামেরা-বর চাইতে কয় তোমারে।’ ক্যামেরা কোনদিকে বুঝতে না পেরে সফুরা কমিশনারের দিকে অসহায়ভাবে তাকায়। এ-সময় পেছন থেকে বিল্লাল দাদির মুখটা ধরে ক্যামেরার দিকে ঘুরিয়ে দিলে ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, এই দিকে দেখেন’ শুনে ও হাত বাড়িয়ে ধরে থাকা কম্বলের কোনাটা ছেড়ে দেয়। ‘আরে ধরেন, হাত দিয়া ধরেন’, শুনে সফুরার মাথার মধ্যে সব ঘোঁট পাকিয়ে যায়। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ঠেকানোর জন্য দুর্বল হাতে কম্বলের প্রান্ত ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গেলে চোখের সামনে বিদ্যুৎ খেলে যায়, আষাঢ়ের মেঘের আওয়াজের সঙ্গে আকাশ চিড়ে নেমে আসা আলোর মতো তীব্র সাদা রোশনাইয়ে ওর বলিরেখাভরা মুখ ঝলসে ওঠে মুহূর্তের জন্য। r