যতীন সরকার কী লেখেন, কেন লেখেন?

সরোজ মোস্তফা

একটা কথা যতীন সরকার প্রায়ই প্রচার করেন যে, ‘তিনি কষ্ট লেখক’। এই কথার ভিত্তি ও ওজন রক্ষার্থে তিনি একটা যৌক্তিক পরিবেশ তৈরি করে কণ্ঠস্বরে আবেগ মাখিয়ে বলতে থাকেন, ‘বাংলা সাহিত্য এত দীন না যে আমার মতো অধম লেখকের অনুপস্থিতিতে বাংলা ভাষা হাহাকার করবে। আমি শুধু মাস্টার হতে চেয়েছি। সারাজীবন মাস্টারি করেছি। ক্লাসে আমি সিলেবাস পড়িয়েছি। কর্তৃপক্ষ বিরাগ হতে পারেন – এই বিবেচনায় ক্লাসে সিলেবাসের বাইরে এক তুলা কথাও প্রকাশ করিনি। কিন্তু সময়, সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি নিয়ে আমারও বলার কিছু আছে। যে-সময়ের ভেতরে বসবাস করি সে-সময়কে মানা-না-মানার আমার নিজস্ব দৃষ্টি ও অভিজ্ঞান আছে। সেই কথাই আমি লিখি। আমার লেখালেখিই আমার মাস্টারি।’ প্রাচীন ভারতীয় সমাজে মাস্টার নামের কোনো পেশাজীবী শ্রেণি হয়তো ছিল না। মাস্টার ছিলেন সমাজ ও সংস্কৃতির অভিভাবক। সে-সমাজে মাস্টার কখনো জীবিকা নিয়ে চিমত্মা করতেন না কিংবা সমাজ মাস্টারকে জীবিকা নিয়ে ভাবতে দিত না। সময়, সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচর্যার কাজটি মাস্টার সযত্নে সম্পন্ন করতেন। দশজনের মন ও মনন তৈরির কাজটাকে তাঁরা দায়িত্ব ভাবতেন। সমাজের পোষ্য হয়ে মাস্টার সময় ও প্রজন্মকে বিনির্মাণ কিংবা চিন্তকের কাজটাই করে যেতেন।

সমাজ এখনো ‘মাস্টার’ শ্রেণিটির প্রতি একটু দরদ বরাদ্দ রেখেছে। এই দরদের রেশ ধরেই হয়তো একটু আদর করে ‘মাস্টার’ শব্দের উচ্চারণে একটা নিজস্ব স্বর ঢুকিয়ে ‘মাস্টর’ নামে ডাকে। মুক্তবাজার অর্থনীতির ভেতরে ঢুকে মাস্টারও বদলে গেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেউ কাউকে আর তেমন পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। প্রায় সবার একটাই স্বপ্ন ‘টাকা কামাতে হবে’। উঁচু দালানের উঁচুতে দাঁড়িয়ে উঁচুতে তাকাতে হবে। সমাজ কিংবা ছাত্রের সঙ্গে মাস্টারের আর শ্রদ্ধার সম্পর্ক নেই। টাকাই যখন সম্পর্ক তৈরি করে দেয় তখন কে আর কাকে পাত্তা দেবে। নীতি-নৈতিকতার শেষ ধাপে পৌঁছুনো এই সমাজে মাস্টার হয়ে তিনি কী করতে চেয়েছেন। এই ‘মাস্টর’ হয়ে যতীন সরকার ক্লাসে কিংবা ক্লাসরুমের বাইরে শপিংমলের ভেতরে ঢুকে যাওয়া নাগরিক মনকে কী শেখাতে চেয়েছেন। পকেটে কিংবা হাতে ‘লালকলম’ নিয়ে প্রাচীন ভারতীয় স্কুলিংয়ের একটা ধ্যান-জ্ঞান নিয়ে তিনি সমাজকে কী শেখাতে চাইছেন। আসলে, মাস্টারি আর লেখালেখিকে তিনি একটা সাধনাই ভাবেন।  আলাপে-আড্ডায় বিবৃতির সুরে তিনি বলেছেন,

ক্লাসে আমি ব্যাকরণ পড়িয়েছি, সিলেবাস পড়িয়েছি। সিলেবাসের বাইরে অতিরিক্ত ফর্মায় কথা বলে কর্তৃপক্ষের বিরাগ-ভাজন হইনি। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাসে আমার আত্মগত অনুভবগুলোকে আমি বলতে পারিনি। আমার অনুভবগুলোকে নিংড়ে দেওয়ার জন্য আমি ‘মুক্ত বাতায়ন’ খুলেছি। লেখালেখি করেছি। বক্তৃতার বিপুল পরিসরে কিংবা ক্লাসরুমে বলতে না পারা কথাগুলো কিংবা লিখতে না পারা কথাগুলোই বলেছি। আমার জাগ্রত জীবনের সমগ্র কর্মটিই ‘আমার মাস্টারি’।

আসলে সমাজ মাস্টার ও মাস্টারিকে কিংবা লেখক ও লেখালেখিকে আলাদা শ্রেণি হিসেবেই জানে ও মানে। এখন কেউ একজন যদি বলেন, ‘আমার লেখালেখিই আমার মাস্টারি’ – তখন বাক্যটা ব্যক্তির যাপিত জীবনের প্রজ্ঞা ও মননের প্রতিবেশ নিয়েই হাজির হয়। তিনি কী লিখছেন, কেন লিখছেন, কী তাঁর দৃষ্টি ও দার্শনিক প্রতিজ্ঞা – এ-প্রশ্নগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়।

দুই

বাংলা ভাষায় যতীন সরকার একজন খাঁটি ও পূর্ণাঙ্গ লেখক। কেন? শুধু ভাষা ও সৌন্দর্য সৃষ্টিই লেখকের কাজ হতে পারে না। বরং লেখার বিষয় ও প্রাসঙ্গিকতাই চলমান ভাষা, স্টাইল ও সৌন্দর্যকে নবায়ন করে। বরং একটা সমাজের ভেতরে, একটা দায়ের ভেতরে একজন লেখকের জন্ম হয়। সচেতন অভিপ্রায়ে লেখক সে-দায়টাকেই লিখে যান। সময়ের নির্মম ও অনিবার্য সংকট মোকাবিলায় লেখক একটা দার্শনিক ডিসকোর্স তৈরি করেন। লেখালেখি কিংবা বক্তৃতার উন্মুক্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর চিন্তন ও দার্শনিক ডিসকোর্সকেই হাজির করেন। লৌকিক বাঙালির জীবনাচারের ভিত্তি ও দার্শনিক প্রত্যয়কে হৃদয়ে ধারণ করে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষে একজন পূর্ণাঙ্গ লেখকের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। একবিংশ শতাব্দীতে প্রত্যেকটি মানুষই হয়তো রাজনৈতিক বোধ ও বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত। যতীন সরকারও রাজনীতি করেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একজন অগ্রজ তিনি। পার্টির সাংগঠনিক কর্মকা- থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তরুণদের কাছে পার্টির দার্শনিক ও রাজনৈতিক আদর্শের মর্মার্থ পৌঁছে দেওয়ার কাজটি নিরন্তর করে যাচ্ছেন। সময় ও সমাজের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি রাজনীতি করেছেন। পার্টির খুঁত ও ভুলগুলোকে তিনি অকপটে বলেছেন। আপন আত্মার নিজস্ব সত্যের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে কখনো কখনো পার্টির ভেতরেও একা হয়ে গেছেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে গেল। সত্তর বছর বয়সী একটা রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ভাঙনে এ-দেশের কমিউনিস্ট পার্টিও বিভক্ত হয়ে গেল। হতাশ নেতৃবৃন্দ পার্টির সম্পত্তি ভাগ করতে বসে গেলেন। কেউ কেউ থেকে গেলেন, কেউ কেউ নতুন দলে ভিড়ে গেলেন। নেতৃবৃন্দের চিমত্মার এই দীনতায় তিনি হতবাক হয়েছেন। প্রকাশ্যেই বলেছেন,

আমি ভাবতাম, কমিউনিস্ট পার্টির মতো এত বড় আর ধীমান সদস্যদের পার্টিতে সদস্য হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। এত বড় পার্টিতে দীন আমি একজন সদস্য। কিন্তু আজকে আমি বুঝতে পারছি – কতগুলো মূর্খের নেতৃত্বে আমি পার্টি করে গেছি। তাই পার্টি ভাঙনের দিন সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছি। হতাশা কিংবা দুঃখ প্রকাশ নয়, মাটিবর্তী হয়ে পার্টি ও সময় সম্পর্কে আমার একটি নিজস্ব দলিল লিখেছি। যার মর্মার্থ, ‘এই পার্টি আমাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়, এই পার্টি ভাঙার অধিকার আমরা রাখি না। পার্টির তৃণমূল কংগ্রেস না ডেকে আমরা পার্টি ভাগ করতে পারি না।’

কিন্তু পার্টির প্রদীপ হয়ে তিনি পার্টির প্রচার সম্পাদক হয়ে যাননি। বরং সমাজের প্রত্ন-ইতিহাসের ভেতরে ঢুকে খুঁজে এনেছেন বাঙালির সমাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকার। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘আদর্শবাদের প্রতি পক্ষপাত ছাড়া অন্য কোনো পক্ষপাতে তিনি দুষ্ট নন।’ তাঁর এই আদর্শবাদের নাম ‘দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ’। বাঙালির কৃষক-সমাজের ভেতরেই তিনি পেয়েছিলেন এই আদর্শবাদের বীজ। পরবর্তীকালে এই আদর্শবাদের শেকড়কে কিংবা দৃষ্টি ও প্রজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন গোপাল হালদার, রণেশ দাশগুপ্ত, সরদার ফজলুল করিমসহ সময়ের সমৃদ্ধ যুগপুরুষগণ। লৌকিক বাঙালিই যতীন সরকারের লেখালেখির মূলসূত্র। ‘বাঙালির লৌকিক ধর্মের মর্মান্বেষণ’ খুঁজতে খুঁজতে তিনি লিখেছেন প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন। ইতালির মার্কসবাদী মনীষী আমেত্মানীয় গ্রামসি যাঁদের ‘অর্গ্যানিক বুদ্ধিজীবী’ বলেন – যতীন সরকার ঠিক তাই। তিনি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ, বাংলার কৃষকের প্রতি দায়বদ্ধ – তিনি প্রাকৃতজনের দার্শনিক। ‘মুক্তবুদ্ধিচর্চা ও বাঙালির লৌকিক ঐতিহ্য’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘বাঙালির লৌকিক ঐতিহ্যের অভ্যন্তরে সন্ধানী দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাব : পাশ্চাত্য তথা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিছুসংখ্যক  মানুষের মধ্যেই যে মুক্তবুদ্ধিচর্চা সীমিত হয়ে থেকেছে – এমন কথা মোটেই সত্য নয়; বরং প্রকৃত সত্য হচ্ছে : প্রাক্-আধুনিককাল থেকেই বাংলার লোকসাধারণ মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে এসেছে এবং নানা ধরনের প্রতিকূলতার চাপে কখনো কখনো সে চর্চার ধারাস্রোত ক্ষীণ হয়েছে, কখনো-বা উন্মার্গগামীও হয়েছে; কিন্তু কখনোই সে স্রোত একবারে শুষ্ক, রুদ্ধ বা স্তব্ধ হয়ে যায়নি।’ যুগ যুগ ধরে জনসংস্কৃতিতে প্রবাহিত বাংলার প্রাকৃত জীবনবোধকেই চিন্তক যতীন সরকার তুলে ধরেছেন। প্রজ্ঞায়, মননে, কাব্যে-সুরে এরাই বাংলার মূলধারার লোক। চর্যাপদের নির্জন সিদ্ধাচার্য থেকে শুরু করে আমাদের উচ্চারিত তথাকথিত মধ্যযুগের ধারা বেয়ে ভারতচন্দ্র রামপ্রসাদ হয়ে শাহ আবদুল করিমের সুরে ভাসতে ভাসতে হাল আমলের কেন্দুয়ার সালাম বাউল যে-গান ধরেন কিংবা সুর স্থাপন করেন – সেই গান ও প্রাসঙ্গিক রচনাকেই যতীন সরকার বলছেন বাংলা কবিতার মূলধারা। রবীন্দ্রনাথের মতকে ধারণ করে তিনিও বলেন, ‘এখানে কোরানে-পুরাণে ঝগড়া বাধে না।… এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি।’ মাটির সহজ সুর ও জীবনবোধ থেকে উঠে আসা এই গান বাঙালির মিলনের গান। এখানেই তিনি অনুসন্ধান করেন বাঙালির ইতিহাস, বাঙালির শেকড় ও দার্শনিকতা। বাঙালি সংস্কৃতির এই শুদ্ধ শেকড়কে ছড়িয়ে দিতেই তিনি লিখে যাচ্ছেন।

পোস্টমডার্ন দুনিয়ার এই পণ্যসংস্কৃতির যুগে তিনি মূলধারার লৌকিক গণসংস্কৃতিরই বিকাশ চান। তিনি নাগরিক নিরক্ত মধ্যবিত্তের মননে ঢুকিয়ে দিতে চান তাজা রক্তের মূলধারার                                সংস্কৃতি। লুকাচের মতো তিনিও মনে করেন, রাজনীতি হচ্ছে পথ কিংবা উপলক্ষ; সংস্কৃতি হচ্ছে লক্ষ্য। সংস্কৃতিবিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপস্নব অসম্ভব। তিনি তাই একটা সচেতন লড়াই করতে চান। এই লড়াইয়ে তিনি সবাইকে সংঘের ভেতরে চান। তিনি মনে করেন, লড়াইটা একা করা যায় না। তিনি বলেন, ‘আমি দারিদ্রে্যর মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি জানি, ব্যক্তিগতভাবে দারিদ্র্য দূর করা যায় না। এই বিষয়ে আমি শুরু থেকেই সচেতন ছিলাম। তাই পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য নির্মূলের যে-দর্শন সেটাকেই আমি জীবনদর্শনরূপে গ্রহণ করেছি। কথায় ও কাজে এই দর্শনেরই প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি এবং করছি। আমি মনে করি, সমাজতন্ত্র ছাড়া মানুষের মুক্তি অসম্ভব। সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি ছাড়া পৃথিবীতে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে না। তবে আগামীর সময় ও সমাজ নির্ধারণ করে দেবে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের রূপ ও প্রকৃতি।’

 

তিন

পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় বাংলাদেশে তিনিই পথিকৃৎ। আধুনিক সমাজবীক্ষায় পাভলভ যে-বিজ্ঞানকে হাজির করেছেন – ইতিহাস ব্যাখ্যায়, রাজনীতি ও সমাজ বিশেস্নষণে, চিন্তনে ও সাহিত্য সমালোচনায় ‘দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদী’ হিসেবে তাঁর প্রধান আস্থা পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান। এই ধারায় কলকাতার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর গুরু। ধনবাদী সমাজের তৈরি করা ভাববাদী, অবক্ষয়ী, অবৈজ্ঞানিক দার্শনিকতার বিরুদ্ধে পাভলভ এক অনিবার্য আশ্রয়। যদিও ব্যক্তিকে কোনো ঘরানাই আটকে রাখতে পারে না। কেননা, ব্যক্তিমাত্রই প্রত্যেকে এক-একটি ঘরানা। কিন্তু যতীন সরকার এই ঘরানার একজন হতে পেরে খুব গর্ব অনুভব করেন। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়-সম্পাদিত মানবমন পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হওয়ায় তাঁর চিমত্মার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে – এই কথা তিনি অনেকবার বলেছেন। পাভলভীয় ঘরানায় আস্থা রেখে শোষক ও শোষিতের মনোচরিত্র কিংবা শ্রেণিবিভাজিত সমাজের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করেছেন।

মানুষের মনের বাইরে কিছু নেই। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের মন। সময় ও পৃথিবীর ভেতরে যেমন মানুষের অবস্থান, তেমনি মানুষের মনের ভেতরে সময় ও পৃথিবীর অবস্থান। সময় ও পৃথিবীর অবশ্যই গুরুত্ব আছে কিন্তু মনকে বিবেচনা না করে সময় ও পৃথিবীকে বোঝা যায় না। সময় ও পৃথিবীও মানুষের মনকে প্রভাবিত করে। কীভাবে করে পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান, সেই কারণ অনুসন্ধান করেছেন। যতীন সরকার বলেন,

বিপস্নবের বিজ্ঞান মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কিন্তু মনোবিজ্ঞানকে উপেক্ষা করতে শেখায় না। প্রাক্-মার্কসীয় যান্ত্রিক বস্ত্তবাদ বস্ত্তকেই একমাত্র নির্ধারক শক্তি বলে প্রচার করত, মানুষের মনকে বস্ত্তর উপজ বা নিতান্ত প্রতিচ্ছায়া বলে ভাবত, মন বা চেতনার কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকাই স্বীকার করত না। মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ তেমন নয়। দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদও অবশ্যই বস্ত্তকে মূল সত্তা বলে নির্দেশ করে, এবং বলে : বস্ত্তই বিবর্তিত হতে হতে একসময় তার মধ্যে চেতনার উদ্ভব ঘটে, – অর্থাৎ বস্ত্তই চেতনাকে নির্ধারণ করে, চেতনা বস্ত্তকে নয়। কিন্তু দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ সেই সঙ্গে আরো বলে : চেতনাও বস্ত্তর ওপর প্রভাব ফেলে বস্ত্তকে নানাভাবে রূপান্তরিত করে। বস্ত্তর বিবর্তনের সর্বশেষ ধাপে আছে মানুষ। সেই মানুষেরই আছে মন, মানুষরই আছে চেতনা। মানুষ তার মন বা চেতনালোকে যে-ছক তৈরি করে, তা দিয়েই সে তার বহির্বাস্তবকে প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত করতে থাকে। সমাজ-রূপান্তর তথা সামাজিক বিপস্নবের অবজেকটিভ নিয়ম অবশ্যই আছে, তাই বলে তার সাবজেকটিভ দিকটিও উপেক্ষণীয় হতে পারে না। দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ বরং এর গুরুত্বকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে উচ্চে তুলে ধরে। মানুষের মনেরও অবজেকটিভ নিয়ম তার অনুসন্ধেয় হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদের দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই মানবমনের অবজেকটিভ নিয়মগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

কাজেই, মানবধর্মের স্বর ও স্বভাবকে বুঝতে হবে। মানুষের মন ও প্রকৃতিকে বুঝতে হবে। সময় ও সমাজের নানা অবজেকটিভের ভেতর প্রতিনিয়ত মানুষের মন কীভাবে রূপান্তরিত হয় পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান সেই ধারায় এগিয়েছে। মানবমন ও মানবধর্মের বৈশিষ্ট্য না বুঝে কেবল উৎপাদননীতি আর উৎপাদনপদ্ধতি দিয়ে মানবসমাজকে বোঝা যাবে না। ‘মানবমনের অবজেকটিভ নিয়মগুলোকে সঠিকভাবে জানা ও মানার গুরুত্বকে উপেক্ষা করা’ই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন যতীন সরকার। তিনি বলেন,

সমাজতান্ত্রিক বিপস্নবের কার্যকর দর্শন লেনিনবাদের উদ্ভবের আগেই মানুষের মনের বাস্তব ভিত্তিটি আবিষ্কার করেছিলেন রুশ বিজ্ঞানী সেচেনভ। উনিশ শতকে ষাটের দশকের গোড়ার দিকে সেচেনভ-লিখিত ‘মসিত্মষ্কের পরাবর্ত’ নামক নিরীহ একটি শরীরবিদ্যার বইয়ে যে বৈপস্নবিক চিমত্মার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিহিত ছিল, সে কথা অত্যাচারী জারপ্রশাসন ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাই, তারা বইটিকে বাজেয়াপ্ত করে। লেনিনই সেচেনভের বইটির যথাযথ তাৎপর্য অনুধাবন করেছিলেন। সেচেনভের উত্তরসাধক ইভান পেত্রভিচ পাভলভ মনোবিদ্যাকে দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ-সমর্থিত যথার্থ বিজ্ঞানে পরিণত করলেন বিশ শতকের প্রথম পর্বেই। লেনিন পাভলভের অবদানেরও স্বরূপ অবহিত হয়েছিলেন। পাভলভের সুহৃদ ও শিষ্য-প্রশিষ্যদের হাতে নানান চড়াই-উতরাই বেয়ে, এবং পাভলভীয় তত্ত্বের অনেক অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতা সংশোধিত ও দূরীভূত হয়ে – দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদভিত্তিক মনোবিজ্ঞান ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। কিন্তু অসমাজতন্ত্রী দেশগুলোতে পাভলভের আবিষ্কারের তাৎপর্য মোটেই উপলব্ধ হলো না।… বুর্জোয়া শিক্ষাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা পাভলভীয় তত্ত্বকে আমেরিকায় উদ্ভূত বিহেভিয়ারিজম (আচরণবাদ বা ব্যবহারবাদ) নামক একটি ভয়াবহ যান্ত্রিক মতবাদের সঙ্গে একীভূত করে ফেলেন। … পাভলভীয় তত্ত্বভিত্তিক মনোবিজ্ঞান ফ্রয়েডীয় আত্মমুখী তথা ভাববাদী মনস্তত্ত্বকে যেমন ফুটো করে দিয়েছে, তেমনি যান্ত্রিক বস্ত্তবাদী বিহেভিয়ারিজমেরও বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করেছে। এ মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ ইতিহাস-ব্যাখ্যায় নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে, বিপস্নবকে আরো বেশি তাৎপর্যম–ত করে তুলতে পারে, মানুষের সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণে একান্ত সহায়ক হতে পারে।

যতীন সরকার পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানকে বাংলা ভাষায় পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, জনসমাজকে বুঝতে গেলে জনসমাজের মনস্তত্ত্বকে বুঝতে হবে। না-জানার সীমা মানুষকে অসমর্থ করে। অন্ধ করে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের মূলে আছে সমাজমানসকে না বোঝার অসমর্থতা। পাভলভীয় জ্ঞানচর্চায় তিনি ডাক্তার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ঋণী। ধীরেন্দ্রনাথের বক্তব্যের প্রতি আস্থা রেখে তিনিও বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’ তিনি মনে করেন,

প্রত্যেকটি ভাবাদর্শের পেছনেই থাকে একটি সামাজিক ভিত্তিভূমি। আবার, এই সামাজিক ভিত্তিভূমিটিও কেবল উৎপাদন-শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে যান্ত্রিক নিয়মে তৈরি হয়ে যায় না, কিংবা শ্রেণিসংগ্রামের কতকগুলো বস্ত্তগত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়েও এর উৎপত্তি ব্যাখ্যা দেওয়া চলে না। বহুকাল আগে রুশ দেশের মার্কসবাদী বিপস্নবী পেস্নখানভ অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন, – ‘সমস্তভাবধারাই উৎপন্ন হয় সমকালীন মনস্তত্ত্বের এক অভিন্ন উৎস থেকে’। মনস্তত্ত্বের এই অভিন্ন উৎসটিকে উপেক্ষা করার ফলেই কোনো ভাবাদর্শেও সামাজিক ভিত্তিটিকে যেমন বোঝা যায় না, ভাবাদর্শেও গুরুত্ব ও তাৎপর্যও তেমনি অনুপলব্ধ থাকে; এবং ভাবাদর্শেও স্বাভাবিক বিকাশ ও রূপান্তর কোনটি, আর কোনটিই-বা এর বিকার ও মায়ারূপ, তা-ও স্পষ্ট হয় না। এই অস্পষ্টতা থেকেই ভাবাদর্শ-সম্পর্কে অতি সংবেদনার জন্য কেউ অতি কঠোর ও রক্ষণশীল, আর কেউ-বা তার বিপরীত। সব যুগে সব ভাবাদর্শ নিয়ে যেমন এমনটি ঘটেছে, আজো ঘটছে।… মনে রাখা দরকার : রিলিজিয়ানই হোক কিংবা অন্য যে কোনো ভাবাদর্শই হোক, সবকিছুরই স্রষ্টা সামাজিক মানুষ।

 

চার

লেখালেখিতে তিনি কাউকে অনুসরণ করতে চাননি। ইনফেক্ট, গদ্য লেখায় তিনি কাউকে আদর্শ হিসেবে নেননি। বলা যায়, স্বাতন্ত্রিক গদ্যরীতি তৈরিতে তাঁর কোনো ঝোঁক ছিল বলে মনে হয় না। নিজের ভাবনাকে যথাসম্ভব সহজ ভাষায় পরিবেশন করাই হচ্ছে যতীন সরকারের গদ্যরীতি। জনমানসের লোকজ্ঞানের ধারণাকেই তিনি লিখে গেছেন। এক্ষেত্রে ভাষারীতির চেয়ে গদ্যের বিষয়টাই বড় হয়ে উঠেছে। একটা সংহত রচনাশৈলীতেই তিনি তাঁর কথাগুলো বলেছেন। আলাপে-আড্ডায় এই প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্ট বলেছেন,

লেখালেখির ক্ষেত্রে আমি কাউকেই অনুসরণ করিনি। গোপাল হালদার, রণেশ দাশগুপ্ত কিংবা সর্দার ফজলুল করিম আমার মানস-চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছেন কিংবা এদের লেখালেখিও আমাকে প্রাণিত করেছে। কিন্তু লেখালেখির ক্ষেত্রে কাউকেই মডেল করিনি। জেলখানায় থাকাকালীন সময়ে একটা প্রত্যয় ঢুকেছিল যে আমাকে লিখতে হবে। প্রতিদিন লিখতে হবে। সেই প্রেরণাতেই ডুবে আছি। প্রতিদিন এই নিয়ে আছি। কিন্তু কারো ভাবনার কিংবা লেখার কার্বনকপি আমি হতে চাইনি। আসলে কোনো ডু মার্কা লেখাই আমি লিখতে চাইনি। এমনও হয়েছে আমি একটা লেখা লিখতে শুরু করেছি কেউ এসে বললেন এই বিষয়ে তো উনি লিখেছেন। সাথে সাথে আমি লেখা থামিয়ে দিয়েছি। ওই লেখকের বইটা পড়ার পর আমি যদি মনে করি আমার বলার নূতন কথা আছে তবেই আমি সেই বিষয়টা নিয়ে লিখেছি।

তিনি খুব গতানুগতিক কিংবা সমকালীন হয়ে থাকতে চাননি। এই কথাটা স্পষ্টই বলা যায়, তিনি নবীনের ভেতরে, আগামীর ভেতরে নিজের ভাবনার একটা সচেতন অনুশীলন প্রত্যাশা করেন। নবীনের মধ্যে এই সম্ভাবনা পেলে তিনি খুশি হন। তারুণ্যের জন্য নবীনের জন্য তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রাখেন। আমি কখনোই তারুণ্যের সঙ্গে কথা বলতে যতীন সরকারকে বিরক্ত হতে দেখিনি। তারুণ্যের ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞানের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আছে। তবে যুগে যুগে বর্তমান যে-জ্ঞান সে-জ্ঞানের প্রতি আস্থাবান তরুণকে তিনি চিৎকার করে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানান।

 

পাঁচ

যতীন স্যার রক্তিম চা খান। স্যারের বাসায় গিয়ে আপনি চা না খেয়ে আসতে পারবেন না। গৃহকর্ত্রী মাসিমা আপনাকে চা তো খাওয়াবেনই, তার সঙ্গে ম-া, মিষ্টি, পায়েস কিংবা কমপক্ষে বিস্কুট হলেও আপনাকে খেতে হবে। স্যার গরম চাকে ঠান্ডা করে বডি টেম্পারেচার করে পান করেন। জার্মানি ভ্রমণে এ-ফর্মুলা তিনি শিখে এসেছেন। পৃথিবীর এক আশ্চর্য মানুষ তিনি। তাঁর ঘরে পৌঁছুনোর জন্য আপনার কোনো পারমিশন লাগবে না। তিনি লিখছেন কি পড়ছেন – সেটা থামিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলাটাই জরুরি হয়ে উঠবে তখন। আসলে এই কথা বলাটাকে তিনি দায়িত্ব মনে করেন। তাঁর যে নিজস্ব স্কুলিং আছে সেটা বলতে থাকেন। পুরো জীবনে অধীত অনুভবগুলোকে তিনি নব-নবীনের মধ্যে খুঁজে দেখতে চান। তিনি হয়তো জানেন, কাউকে জোর করে শেখানো যায় না। যিনি শেখেন তিনি দূরে দাঁড়িয়ে একলব্যের মতোও শেখেন কিংবা শিখতে জানেন। তবু তিনি বলতে থাকেন। নবীন আগন্তুকদেরই পছন্দ করেন তিনি। এই বডি টেম্পারেচার চা পান করতে করতে আড্ডার মুডেই অনেক আত্মপ্রত্যয়ে স্যার সেদিন বলেছিলেন, ‘শোনো, লেখক হিসেবে আমি হয়তো খুবই নগণ্য। তবে যা লিখেছি, সেগুলো আমার নিজস্ব চিমত্মা ও চিন্তনের ইতিহাস। আমি তো বক্তৃতা করি, বক্তা হিসেবে আমি হয়তো সামান্য সফলও হয়েছি। তবে, এই কথাটা আমি গর্ব করেই বলতে পারি, ‘I am one of the best teachers in the world।’ এই কথা বলার পর স্যার অনেকক্ষণ চুপ থাকেন। আমিও চুপ থাকি। তাঁর চোখের মণির দিকে তাকিয়ে তাঁর শিক্ষকতার নির্জন আদর্শটা দেখতে থাকি। চোখের দিকে তাকালে হয়তো কখনো কখনো মানুষের আদর্শকে সত্যি সত্যি দেখা যায়।