যাকারিয়া আবুল কালাম মোহাম্মদ

সুফি মোসত্মাফিজুর রহমান

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, পুঁথিসাহিত্য-বিশারদ ও অনুবাদক। এ ছাড়া তিনি ছিলেন একজন ক্রীড়া-সংগঠক ও প্রশাসক। ১৯১৮ সালের ১ জানুয়ারি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের দড়িকান্দি গ্রামে জন্ম নেওয়া  আ. ক. ম. যাকারিয়া অবিভক্ত বাংলার শেষ বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ডেপুটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ১৯৪৮ সালে চাকরি শুরু করেন এবং সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ থেকে ১৯৭৬ সালে অবসর নেন।

তৎকালীন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে মহসিন বৃত্তিলাভ করেন। ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন; আইএ পাশ করেন মেধাতালিকায় দশম স্থান অধিকার করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স নিয়ে সণাতক এবং সণাতকোত্তর সমাপ্ত করেন ১৯৪৫ সালে। এরপর দুবছর বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক ছিলেন। বিকেলবেলা এবং ছুটির দিনে তিনি বগুড়া শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন পু-্রনগরে প্রায়ই বেড়াতে যেতেন। আলাপচারিতায় জানা যায় মহাস্থান তথা প্রাচীন পু-্রনগরেই প্রত্নতত্ত্বে তাঁর আগ্রহ  জন্মে। ভাস্কর্য, মূর্তি, স্থাপত্যিক কীর্তিগুলো তাঁকে খুবই আকর্ষণ করত। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রত্নবস্ত্ত-বিষয়ে তিনি অনুসন্ধানী হয়ে ওঠেন। সংগ্রহ করতে থাকেন অমূল্য ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত। সরকারি চাকরিতে যোগদানের সুবাদে তাঁর এই সুযোগ আরো বেড়ে যায়। দিনাজপুর জেলায় যুগ্ম-সহকারী কমিশনার পদে যোগদানের পর তিনি পুরোদস্ত্তর প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খনন শুরু করেন। একজন আমলা হয়ে যান স্বশিক্ষেত প্রত্নতাত্ত্বিক! প্রত্নতত্ত্বের এই ব্যয়বহুল ও শ্রমসাধ্য কাজে তিনি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। নতুন-নতুন জেলায় বদলি হন, আর একের পর এক জেলাভিত্তিক জরিপ সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ গ্রন্থে শেকড়-সন্ধানী স্বশিক্ষেত প্রত্নতাত্ত্বিক আ. ক. ম. যাকারিয়ার গবেষণালব্ধ ফসল উঠে এসেছে। এ দেশের সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ গ্রন্থটি এককথায় একটি অমূল্য প্রকাশনা। আমরা যাঁরা প্রত্নতত্ত্বের ছাত্রছাত্রী এবং গবেষক তাঁদের জন্য এটি একটি দিকনির্দেশনামূলক গ্রন্থ। সারা দেশের (দু-একটি জেলা ছাড়া) প্রত্নসম্পদের একটি ডাইরেকটরি এই গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি হাতে থাকলে আপনি দেশের যে-কোনো জেলার প্রত্নসম্পদ সম্পর্কে জানতে পারবেন। ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য জানা এবং গবেষণার জন্য এই বই ব্যবহার করছেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বা এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল এটি কিন্তু যাকারিয়া ব্যক্তিপর্যায়ে তা সম্পন্ন করেছেন!  কত সাহস, অধ্যবসায়, জ্ঞান, কষ্টসহিষ্ণু মানসিকতা, দেশপ্রেম থাকলে এ-ধরনের কাজে হাত দেওয়া যায় তা ভাবতেও অবাক লাগে। তথ্য-উপাত্ত-বিশেস্নষণে তাঁর দক্ষতার ছাপ পরিলক্ষেত হয় গ্রন্থের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যে। সাধারণত আমাদের দেশের প–তরা বলেন, বাঙালির সংস্কৃতি হাজার বছরের প্রাচীন। যাকারিয়া লেখেন ‘প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আরম্ভ করে বর্তমান কাল পর্যন্ত হাজার-হাজার বছর ধরে বাংলায় মানববসতি ছিল।’ আমরা যখন কাবর্ন-১৪ তারিখের ভিত্তিতে আড়াই হাজার বছর আগে উয়ারি-বটেশ্বরের নগরায়ণের কথা বলি; তখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ-কেউ তা মানতে রাজি হননি। অপরপক্ষে যাকারিয়া বলেন, উয়ারি-বটেশ্বর আড়াই হাজার নয়, ১০ হাজার বছর প্রাচীন। আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় বেরিয়ে আসছে যে, উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাক-নগরায়ণের ইতিহাস আড়াই হাজার বছরের আগের।

তিনি লেখেন – ‘বাঙালি জাতির সামরিক শক্তিও ছিল অতি উঁচুমানের। আর্যরা বাঙালি জাতির প্রতি যত ঠাট্টা-মশকরাই করে থাকুন না কেন, তার মূলে ছিল খুব সম্ভব এদেশ অধিকারে আর্যদের ব্যর্থতার অভিব্যক্তি। কারণ গ্রিক ও ল্যাটিন ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় চারশো বছর আগেকার বাংলার যে-চিত্রটি পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, বাঙালির (গঙ্গাঋদ্ধি) সামরিক শক্তি ও সত্যতা ছিল অতি উন্নত ধরনের। কিন্তু এসব মানুষের কাহিনি, প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাদের ক্রমাগত অগ্রগতি, সেই অগ্রগতির ধারাকে বিভিন্ন যুগে ধাপে-ধাপে এগিয়ে নিয়ে এক সুসভ্য ও সুবিন্যস্ত জাতিতে পরিণত হওয়ার পেছনে যে বিরাট ইতিহাস লুক্কায়িত আছে, তা বর্তমান পৃথিবীর কাছে প্রায় অজানা।

বাঙালির এই গৌরবময় ঐতিহ্যকে জানার জন্য আজ পর্যন্ত তেমন কোনো সার্থক প্রচেষ্টা হয়নি। তাই বাংলা ও বাঙালির প্রাচীন ইতিহাস লুক্কায়িতই রয়ে গেছে। লুক্কায়িত রয়ে গেছে গভীর পলিমাটি, নতুন গড়ে ওঠা বসতি এবং পরিত্যক্ত জঙ্গলময় ভূমির নিচে বহু প্রাচীন জনপদের চিহ্ন সে-যুগের মানুষের ব্যবহৃত উপকরণসমূহ। সেগুলির সবকিছু উদ্ধার করা আজো সম্ভব হয়নি।’ তাঁর বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ গ্রন্থে আরো অসংখ্য ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তির মৌলিক গ্রন্থটি ছাড়াও আগামী দিনের ভবিষ্যৎ শিশুদের জন্য তাঁর প্রশ্নোত্তরে বাংলাদেশের প্রত্নকীর্তি প্রকাশনা শিশুসাহিত্যে একটি অসাধারণ সংযোজন। এর বাইরে তাঁর অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ, খনন ও প্রকাশনার বাইরে তিনি আরেকটি কাজের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন – তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দিনাজপুর জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৮ সালে। তিনি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি, জাদুঘরে প্রদর্শিত ও সংরক্ষেত প্রত্নবস্ত্তর বিসত্মারিত পরিচিতিসহ একটি গবেষণা গ্রন্থও প্রকাশ করেন।

আ. ক. ম. যাকারিয়ার অনেক পা–ত্যের বিসত্মারিত বিবরণে না গেলেও দু-একটি না বললে নয় – তিনি দুষ্প্রাপ্য পুঁথি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন একাধিক। গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস, সত্যপীরের পুঁথি, গাজী কালু চম্পাবতী সম্পাদনার কাজ উল্লেখযোগ্য।

যাকারিয়া বাংলা, ইংরেজির বাইরে জানতেন ফারসি, ফরাসি, উর্দু ও আরবি। তিনি মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের আকর গ্রন্থ তবকাত-ই-নাসিরি, তারিখ-ই-বাঙালা-ই-মহাবত জঙ্গী, মোজাফফরনামা, নওবাহার-ই-মুরশিদ কুলি খান অনুবাদ করেন।

ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে প্রত্নতত্ত্বের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা উল্লেখ না করে পারছি না – ঐতিহ্যকে জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্য সচেতনতা সৃষ্টি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমরা উয়ারী-বটেশ্বরে বার্ষিক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু এবং দু-তিন মাস কাজ শেষে দুটি অনুষ্ঠান করি। ২০০৯ সালের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন আ. ক. ম. যাকারিয়া এবং প্রয়াত অধ্যাপক জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী। দুপুরের খাবার পর দুই বিজ্ঞজনের সঙ্গে আড্ডা জমাই আমরা। মে মাসের গরমে ৯০ বছর বয়সী যাকারিয়া স্যার হঠাৎ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। আমরা সবাই দুশ্চিমত্মাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি স্বাভাবিক হন। আমার ছাত্র সৌরভকে সঙ্গে দিয়ে ঢাকা পাঠাই। পথিমধ্যে তিনি সৌরভকে বলেন, উয়ারী-বটেশ্বরে সংজ্ঞাহীন হওয়ার দুর্ঘটনা যেন সে তার বাসায় ছেলেমেয়েদের না বলে; বললে আর ফিল্ডে যাওয়া হবে না। ৯০ বছর বয়সে তাঁর ফিল্ডে যাওয়ার ইচ্ছা অনুকরণীয় এবং আমাকে তা বারবার অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের অধীনে আমি যাকারিয়ার ভিডিও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ৯২ বছর বয়সে ভিডিও ক্যামেরার সামনে প্রায় দুই ঘণ্টা সাক্ষাৎকার রেকর্ড করি। ৯২ বছর বয়সে সারাজীবনের কর্ম, আনন্দ, সৃষ্টি ধারাবাহিকভাবে বলে যান! তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল ঈর্ষণীয়। প্রথম আলো তাঁর পরিবারের বরাত দিয়ে জানায়, জ্ঞান থাকা পর্যন্ত তিনি বাংলার পুঁথিসাহিত্য, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে করা অসমাপ্ত গবেষণাগুলো নিয়ে চিমত্মা করেছেন। দেশবরেণ্য স্বশিক্ষেত প্রত্নতাত্ত্বিক, বর্ণাঢ্য-জীবনের অধিকারী, আ. ক. ম. যাকারিয়া ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের সভাপতির পদও অলংকৃত করেন।

আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই; বাংলাদেশের অনেক প্রত্নস্থানও একদিন থাকবে না। কিন্তু টিকে থাকবে আ. ক. ম. যাকারিয়ার অমর সৃষ্টি বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ গ্রন্থ এবং নানাবিধ কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রত্নস্থানের জীবন্ত বর্ণনা। পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন স্বশিক্ষেত প্রত্নতাত্ত্বিক, বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্বের জনক আ. ক. ম. যাকারিয়া।