যাপিত জীবনের বিচিত্রতা

ইব্রাহিম ফাত্তাহ্

শৈল্পিক দক্ষতা প্রকাশের হাত ধরে ক্ষুদ্রকায় শিল্পসৃজনের সূত্রপাত সভ্যতার আদিকাল থেকে। চিত্রশিল্পীর দক্ষতার উৎকর্ষ-নিদর্শন হিসেবে সারাবিশ্বেই ক্ষুদ্রকায় শিল্পসৃজনের গুরম্নত্ব যেমন আগেও ছিল, এখনো আছে। বাংলাদেশের শিল্পীরাও ক্ষুদ্রকায় চিত্রপটে ছবি আঁকেন, ভাস্কর্য গড়েন। বেশ কিছুকাল ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে – নানাবিধ কারণে সারাবিশ্বেই শিল্প-সংগ্রাহকদের কাছে ক্ষুদ্রকায় শিল্পকর্মের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে গত শতকের নববইয়ের দশকে নানা উদ্যোগ নিয়ে গ্যালারি টোন মিনিয়েচার আর্ট খুদে শিল্পসৃজনের আন্দোলনকে আমাদের শিল্পীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। এক্ষেত্রে চারম্নশিল্পীদের অনুপ্রাণিত করতে তারা প্রতিযোগিতার আয়োজন ও পুরস্কারের ব্যবস্থাও করেছিল। এমনসব ধারাবাহিক উদ্যোগের ফলে দেখা যাচ্ছে অনেক শিল্পীই আজকাল খুদে ছবি অাঁকছেন।

তরম্নণ শিল্পী আমিনুল ইসলাম আকন নিজের শিল্পানুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ৫ গুণিতক ৬ ইঞ্চি আকৃতির খুদে চিত্রপট। কালি-কলম, জলরং আর অ্যাক্রিলিক রঙে এঁকেছেন যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ, ভালোবাসা, বিরহ, আনন্দ-বেদনা, কত কি! নিসর্গ রূপের নানা দিকও উঠে এসেছে তাঁর চিত্রপটে। অনুভূতিপ্রবণ এই চিত্রকরের অাঁকাঅাঁকির সঙ্গে লেখালেখিরও সংযোগ আছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, আকন পদ্যও লিখেন। যে-কথা লেখায় আর অাঁকায় প্রকাশ করা যায় না, তাকে তিনি তুলে ধরেন চিত্রপটের পরিসরে। এভাবেই চিত্র আর চিত্রকল্প মিলে গড়ে উঠেছে আকনের আপন ভুবন।

‘আলোয় অাঁধারে’ শীর্ষক শিল্পী আমিনুল ইসলাম আকনের একক ক্ষুদ্র চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে চারম্নকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে গত ১১ থেকে ১৬ অক্টোবর, ২০১৫ পর্যমত্ম। এটি তাঁর প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী। ছোট-ছোট কাজ বলে পাশাপাশি অনেক ছবি দিয়ে গ্যালারির দেয়াল সাজিয়েছেন শিল্পী। এক ছবি দেখতে-দেখতেই আরেক ছবির দিকে চলে যায় চোখ। রং-রেখা-গঠন আর আলো-অাঁধারি মিলিয়ে একটি ছবি যেন আরেকটির জোড়া হয়ে উঠেছে।

শিল্পী আকনের জন্ম ১৯৭৮ সালে ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারম্নকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন থেকে সণাতকোত্তর করেছেন ২০০১ সালে। এখন ডিজাইনার হিসেবে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছেন। কর্মজীবনের ব্যসত্মতার পর যেটুকু অবসর পান, তাকে কাজে লাগান কাগজে-কলমে-জলরঙে ছোট-ছোট ছবি অাঁকায়।  ফলে দেখা যাচ্ছে, তাঁর অনেক ছবির ভেতর কলম দিয়ে লাল নীল হলুদ সবুজ রঙের অাঁকিবুঁকি আছে। মনের ভাব প্রকাশের তাড়নায় হাতের কাছে থাকা সহজ উপাদান তুলে নিয়েছেন শিল্পী। এভাবে কাজ করতে-করতে ক্ষুদ্রচিত্রের সঙ্গে ভাব জন্মেছে তাঁর। টানা সাড়ে তিন বছরের শিল্পিত প্রয়াস শিল্পী হাজির করেছেন দর্শক-সমক্ষে।

সৃজনশিল্পীর মানসলোকের অনুভব বিচিত্র কায়দায় নানা ধরনে পলস্নবিত হয় তাঁর সৃজন-পসরায়। দর্শক-বোদ্ধাদের কাছে শিল্পীর পরিচয় তাঁর কাজের ধরনে-গড়নে। আকনের চিত্রকর্মে শিল্পীর যে-স্বভাবের সুলুক-সন্ধান আমরা পেয়ে যাই, তাতে তাঁকে স্বপ্নচারী বলে মনে হয়। চোখের ভেতর স্বপ্নঘোর নিয়ে স্বপ্নের পথে পা বাড়িয়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে যখন স্পর্শ করেছেন, সে-যন্ত্রণাও যেন প্রতিফলিত হয়েছে তরম্নণ এই চিত্রকরের পটে, রেখা ও রঙের আলিম্পনে। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখকে শিল্পী মেলে ধরেছেন দশজনের আনন্দ-বেদনার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার আকাঙক্ষায়।

তাঁর চিত্র গঠনে একদিকে যেমন পরাবাসত্মব ও পাশ্চাত্য অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে অমত্মর্নিহিত মিল খুঁজে পাওয়া যায়, অন্যদিকে প্রাচ্যের রেখা ও অলংকরণধর্মী শৈলীর সন্নিবেশও দেখা যায়। তাঁর কাজ মানুষকে নিয়ে। বলা ভালো, মানুষের মনের ভেতরের ভাবনা যেন উঠে আসে এই চিত্রকরের ছোট-ছোট ছবিতে। সেই ভাবনা প্রকাশের অনুষঙ্গ হয়ে চিত্রপটে জায়গা নেয় নিসর্গের নানা ফর্ম ও মোটিফ। তাঁর বেশিরভাগ চিত্রকর্মে আলোছায়ার প্রয়োগ দেখে মনে হয়, শিল্পীর উপস্থাপিত সময় গোধূলি-সন্ধ্যা থেকে চন্দ্রালোকিত রাতের আবহময়। যেমন – ‘গোধূলির মিলন’, ‘ছায়াবীথি’, ‘আলোয় অাঁধারে’, ‘তৃতীয় পক্ষ’, ‘নীরব উলস্নাস’, ‘নক্ষত্রের পতন’, ‘পূর্ণিমা রাত’ – এসব চিত্রকর্মে আসন্ন সন্ধ্যা থেকে রাত গভীরের সময় উপলব্ধি করা যায়। সময় ব্যবস্থাপনার পেছনের কারণ বিষয়বস্ত্ত নির্বাচন ছাড়াও বোধকরি রাতের বেলা শিল্পীর ছবি অাঁকার সময়ের সঙ্গে ছবির ভেতরের সময় মিলে গেছে।

এবার ছবির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করা যাক। ‘নস্টালজিয়া’ শিরোনামের চিত্রটির মধ্যে ভাবুক এক নারীর অবয়ব। তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখি। এর বিপরীত দিকে জলাধারে বড়শি ফেলে মাছ শিকারের অপেক্ষায় আছেন কেউ একজন। যেন     ফেলে-আসা দিনের আনন্দস্মৃতি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস এখানে। ‘বর্ণচোরা’ শিরোনামে আরেকটি চিত্রে দেখা যাচ্ছে বহুরঙা এক নারীর অবয়ব, তার প্রায় নিরাভরণ দেহ ঘিরে আছে নবীন লতানো এক গাছ ও ফুল। এই নারী নিজের জীবনের অন্ধকার বাইরের রঙের আলোয় ভরিয়ে তুলছে বলেই কি তিনি বর্ণচোরা!

আমিনুল ইসলাম আকনের আরেকটি চিত্রের শিরোনাম – ‘অন্যগ্রহ’। পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহের প্রাণী ও প্রকৃতি শিল্পীর কল্পনা হয়ে চিত্রপটে জায়গা নিয়েছে। ‘আলোর সন্ধানে’ শিরোনামের চিত্রটিতে দেখা গেল এর ভেতরে থাকা মানুষ যেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আসতে চাইছেন। ‘নক্ষত্রের পতন’ শীর্ষক চিত্রে নক্ষত্ররা যেন নেমে এসেছে মাটিতে আর আলো যেন পড়ছে গলে-গলে। আরেকটি চিত্র ‘পূর্ণিমার রাত’; তাতে শিল্পী তুলে ধরেছেন ভরা চন্দ্রালোকে দুজন মানব-মানবীর ভ্রমণ, নিচেই নতমুখ এক নারী যেন সেই সুখস্মৃতিচারণ করছেন। ‘গোধূলির মিলন’ নামে আরেক চিত্রে দুটি গো-শাবকের অপত্য ঘনিষ্ঠ প্রতীকের পাশেই দুজন প্রেমাস্পদের ছায়ামূর্তি দেখে মনে হয়, তরম্নণ এই শিল্পী যেন প্রাকৃতিক নিয়মে মিলনের মানবিক বার্তাই তুলে ধরেছেন।

আমাদের ভেতর যেমন মাঝে-মাঝে হতাশা ভর করে, তেমনি একজন সৃজনশিল্পীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমিনুলের সেই মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে কয়েকটি খুদে চিত্রে। যেমন – ‘বৃষ্টির বিষণ্ণতা’, ‘স্খলন’, ‘ঝরে পড়ার অপেক্ষা’, ‘আলোয় অাঁধারে’, ‘ঘৃণা’ প্রভৃতি শিরোনামের চিত্রগুলোয় তারম্নণ্যের বিষণ্ণতা ভর করেছে। প্রযুক্তির এই যুগে তরম্নণদের রাত জেগে ফেসবুকে নানা আপডেট দেখার চিত্র উঠে এসেছে ‘বিভোর’ শিরোনামের  ছবিতে। একটা দ্বন্দ্বের আভাসও মেলে এতে। মুঠোফোন-হাতে রাতজাগা তরম্নণী স্ত্রীর পাশেই বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন তার স্বামী। তারম্নণ্যের এরকম আরো নানা ব্যক্তিক ও পারিবারিক সমস্যার খ–খ- চিত্র পেয়ে যাই আমরা আকনের এসব ছবিতে। আকারে ছোট হলেও এসব ছবিতে ইঙ্গিত আছে অনেক বড় কিছুর। আর এখানেই এ-তরম্নণের কাজের সার্থকতা।

ক্রমাগত চর্চা আর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে শিল্পীর এই নিরীক্ষা কতটুকু সিদ্ধিলাভ করল তার কিছুটা ফল হয়তো পাওয়া যাবে তাঁর এই প্রদর্শনীলব্ধ মতামত ও অভিজ্ঞতা থেকে।