রফিক আজাদের কবিতার প্রশ্নে

শহীদ ইকবাল

কেন কবি রফিক আজাদের (জন্ম ১৯৪৩-মৃত্যু ২০১৬) কবিতার পাঠে অনেক রকম তত্ত্ব আছে, তত্ত্বে ফেলে কবিতার পাঠ রচনা করলে, কবিতাকে তত্ত্বের ফ্রেমে এঁটে, তত্ত্বের আয়নায় দেখে সমস্ত রস শুষে-শুঁকে বিচার করলে কবি ও কবিতার উপভোগটুকু কতটুকু ভোক্তার মনকে বা ভোক্তাকে আন্দোলিত করে তা বোঝা দায়। পাঠ হয়তো  চিরকালের কিন্তু আন্দোলিত শতদল মর্ম ছুঁয়ে পৌঁছয় বহুদূর, হয়ে ওঠে অনেককালের, চিরকালের, চিরসবার। পাশ্চাত্য তত্ত্বগুলো এখন তো আর শুধু পাশ্চাত্যের নয়, তারাই তো শাসন করছে, কর্তৃত্ব করছে, তাদের নীতি-আদর্শ নিয়ে নিজের জীবনের ব্যাখ্যা তৈরি করছে, তাও মেনে নিয়েছে অনেকেই। সংস্কৃত তাত্ত্বিক ভবভূতির তত্ত্ব অচল না হলেও তার প্রসার এখন ন্যুব্জ। ধরে নিই মডার্নিজম, পোস্ট-মডার্নিজম, ফেমিনিজম, ডি-কলোনিয়ালিজম, স্ট্রাকচারালিজম, ন্যারেটিজম ইত্যাদি নানা পাশ্চাত্যতত্ত্বে কিংবা বিপরীতে পুরনো প্রাচ্যরীতিকে নবায়ন করে পুনর্গঠিত প্রণালিতে কবিতার ব্যাখ্যা করা হলো। তাতে কি কবি ও কবিতার পূর্ণাঙ্গ পাঠ হয়? নাকি এক ভোক্তার পূর্ণায়ত উপলব্ধির পরিবেশ তৈরি হয়! কোনোটাই ঠিক সুবিধামতো হয় না, বরং তার চেয়ে নিছক উলটো করে যদি চিমত্মা করি – পাঠক বোধের কাঁটাতারগুলো কীভাবে পেরোবে, কীভাবে সে-সময়ের অঙ্গুরীকে চিহ্নিত করবে, কীভাবে সে নতুন মানুষ হয়ে উঠবে ইত্যাদি বিষয় কবিতার পাঠে ও আলোচনায় কি গৃহীত হতে পারে না! সেখানে তত্ত্ব নির্বিরোধে যদি প্রবেশ করে ক্ষতি নেই, আবার যদি নাইবা কোনো তত্ত্বের মুখোমুখি হই, তাতেই বা দোষ কী? পাঠক কীভাবে পেরয়, সেভাবে কবিকে বিচার করলে কেমন হয়? তাতে ভেবে নিই কবির কবিতার গঠন-পুনর্গঠন, নির্ধারিত ইমেজ-শব্দ, আনন্দলোকের অভিসারের জন্য রোমান্সকাতর প্রেতলোক উপলব্ধি প্রভৃতি ধারণা। আবেগের সূক্ষ্ম তীর, শাণিত লক্ষ্যভেদ, অভিপ্রায়িত স্বপ্নডানা ও চিরপ্রতিম প্রেম কোত্থেকে আসে, কীভাবে ধরা দেয় প্রভৃতি নিয়ে ভাবি – তাহলে কেমন হয়! শব্দের সিন্ধুতে, শব্দের প্রতিমায়, প্রতীকবন্ধে ও যুগলপ্রবাহের আশ্বাসে ভেবে নিই যদি কবিকে, তাতে ক্ষতি-বৃদ্ধি কী। আশ্চর্য রূপটি চিনে নিতেও স্বর, ধ্বনিময়তার তীব্র তীর নিয়ে রূপের খেলা, মায়ার মুগ্ধতা বুঝে নিই – কেবল প্রজন্মান্তরের চলার শক্তিসঞ্চয়ের জন্য – তাতেও কার কী। আর এবারে যদি এই প্রসত্মাবনায় বলি, রক্তমাংসরম্য কবিতা কি এর বাইরে আর কিছু? তার উত্তর কী! আমাদের কবি রফিক আজাদের রক্তমাংসের আক্রমণ কী রকমে আসে – আমাদের ভেতরে। সুন্দরের রক্তপ্রতিমা কী ছোঁয় অন্তরকে – মহামান্য কি করে, শ্রদ্ধাশীল, অদম্য প্রেমপ্রবণ, স্তননের বুননিতে আক্রান্ত করা – সবই কী ঘটে না? এর বাইরে কবিতার আর কীইবা করার আছে! কিছু লাইন তুলে নিই :

অন্ধত্ব বরণ করে নিয়েছিলাম –

চক্ষুষ্মানের পক্ষে চোখ বুজে থাকার মতো

আনন্দময় আর কী-ইবা হতে পারে?

হয়তো এভাবেই আমার বাকি জীবন

চ’লে যেতো –

কিন্তু হঠাৎ ক’রে তোমাকে দেখে ফেলে

আনন্দে বিহবল এই আমি কী যে বিপদে পড়লাম,

তুমি তো কোনোদিনই বুঝবে না।

[‘আটত্রিশ বছর বয়সে’]

আবার দশ বছর সময় পেরোনো কবির ভিন্ন আঙ্গিকজমা কয়েকটি লাইন :

তো, বালকের উথালপাতাল বুকে নানা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে – কোনো-এক কিশোরীর চঞ্চল চোখের চাউনি, কারু পিঠছেয়ে নেমে আসা ঘনকৃষ্ণ কুন্তলদাম, কারু হাসির ঝরনাধারা, কারুবা দেহসৌষ্ঠব, গালের তিল, ওষ্ঠপ্রান্ত! একক একাকী নির্দিষ্ট কেউ নয়, বালক সবার কাছে থেকে তিল-তিল সৌন্দর্য আহরণ ক’রে গড়ে তোলে এক মানসিক ‘তিলোত্তমা’ কিশোরী – সেই কিশোরীই ধীরে ধীরে বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে এখনো – মৃত্যুর আগে হয়তো এক পরিপূর্ণ ‘নারী’ এসে আসন পাতবে তার কবিতায়। সেই প্রতীক্ষায় সুদূরের পিয়াসী এক বিহবল বালক এখনো নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছে। [‘নারী’]

আরো কিছু পরে লেখা কবির কবিতা :

আমরা আগুনমুখো নদীর তলদেশ থেকে

সাঁতরে উঠে এসেছিলাম –

আমাদের এই উত্থান তখন অবশ্য অনিবার্য ছিলো;

দুঃসময়ে উঠে এসে আমাদের ঐ

পায়ের নিচের মাটি খুব ভালোবেসেছিলাম –

…             …     …

কিন্তু বন্যা, ঝঞ্ঝাবাতে, বিক্ষুব্ধ গর্কিতে, জলোচ্ছ্বাসে,

মারী ও মড়কে, অগ্নিঝড়ে, মঙ্গায় পীড়িতজন

দৃঢ়পায়ে দাঁড়ানোর কোনো ঠাঁই-ই তো পেলাম না!

 

তা-হলে কি জন্মাবধি প্রাণান্তকর দুঃখজয়ী

ঐ প্রচেষ্টাটি আমাদের প্রিয় স্মৃতিভা-ারেই

জমা থাকলো?

[‘তখন স্বপ্ন ছিলো দু’চোখে অনেক’]

কবি নিমজ্জিত তাঁর অনুরণিত চেতনায়, বিসত্মার সে-চেতনার অনেকদূর, বৈরীপ্রবাহ পেরিয়ে যায় সে। প্রকৃত কবি, সচেতন-অচেতন-অর্ধচেতন বোঝেন না; কিন্তু গড়ে নেন এসবের ভেতরেই তাঁর ধ্বনিচিহ্নসমূহ। সেটি ‘মিউজে’র আদেশ। অনিবার্যও তা তাঁর জন্যে। কিছুতেই এ-আদেশের লঙ্ঘন ঘটে না। গেঁথে ওঠে চরণগুচ্ছে। পাঠক বলেন, ‘বোধের ঘনায়িত রূপ’। সে-ঘনত্ব কতটুকু, ‘স্তনন’ কতটুকু, ছেয়ে নেওয়া বিসত্মৃতি কতটুকু কবি তা বোঝেন না। কিন্তু করে ফেলেন কাজটুকু। নিঃশঙ্ক তীব্রতায়। কঠিন প্রতিজ্ঞায়। এ-প্রতিজ্ঞায় দলিত হয় ধর্ম-সমাজ-আচার-আনুষ্ঠানিকতা। সে বেচে না কিছু। কোনো দামেই না। ঊর্ধ্বে তুলে ধরে মানুষ ও মানুষের ভেতর গড়ে-ওঠা নিষ্পাপ স্বপ্নমুহূর্তকে। ব্যবসা বা বেসাতিতে আটকিয়ে ফেলে না মানুষকে। কথাগুলো ‘সাধারণ’ হয়ে গেল। সাধারণ এই অর্থে, কবি এসব ভাবনাকে পেরিয়ে যান প্রথম পদক্ষেপেই। মানে উঁকি দেওয়া সভ্যতার আলোর প্রথম মুগ্ধতার ছটাতে। টুকরো আলোর বিম্বটি তাকে ধরে ফেলে, এবং তিনি সদম্ভে তা গ্রহণ করেন। এই গ্রহণটি সবার নয়, কেউ-কেউ বা কারো-কারো – ‘ঘটে’ ঘটে। সেজন্যে কিছু বোঝার প্রয়োজন নেই তাঁর, তিনি বুঝে নেন, অতঃপর ক্রমাগত বিবেচ্য সমাজের ভেতর দাঁড়িয়ে নিঃশঙ্কভাবে, নিরতিশয়রূপে, পরোক্ষ ‘সজ্ঞানতায়’ তিনি বুনে চলেন তাঁর পদক্ষেপসমূহ। এই পদক্ষেপ পাঠকের কাছে অত্যুঙ্গ হয়ে পড়ে। তাঁকে করে তোলে বিচিত্র মহার্ঘের অভিষেক। সূক্ষ্মতার অনুভবে তাঁর চলতি কাঁটাতার অতিক্রম করে, দ্রম্নততা পায়। কবি রফিক আজাদের ‘অসম্ভব পায়ে’ বের হয় ১৯৭৩-এ। এ কবিতাগুলো লেখা আরো আগে। ‘হে দরোজা’ কবিতাটি দিয়ে শুরু। ‘দরোজা’র চিরচিহ্নিত স্বর উদযাপিত। সাধারণ চোখে দেখা নয়, সাধারণ পাঠক পৌঁছে যাবেন কবির চোখে। ‘নতুন চোখ’ পাবে দেখার দৃষ্টি। গড়ে উঠবে ‘দরোজা’র কড়ানাড়ার শব্দ। উপরিউক্ত উদ্ধৃতিতে তিন সময়ের অভিযাত্রার অনুরণন বিবেচনায় এনেছি। এখানে কবির শুরু ও প্রতিশ্রম্নত পদক্ষেপটুকু বিশেস্নষণে আনতে চাই। কী আছে এতে? দরোজাকে কারুকার্যময় করে প্রকাশ করেন, বোধের আঙিনায় তা কারুখচিত। পরে তার স্বরূপটি জানাচ্ছেন বিশেষণে ‘গভীর’, ‘কনকনে’; যে-বাস্তব স্বপ্নের গুণে চিহ্নিত, বিহবল রাত্রির মতো উষ্ণতায় দাপটে রচিত। প্রশ্নের অভিসারে, পেয়ে যাই প্রেমিকা। কোনো উজাড় করা নারী। তার সৌন্দর্য এক প্রক্ষেপণে চিহ্নিত। ‘দরোজা’ কিছু নয়, সে অপূর্ব প্রতীকায়িত দরোজার ইমেজ, যেখান দিয়ে আলো আসে, যা প্রবেশচিহ্ন, যে গ্রহণ করে, সাহস আর স্বপ্নমাখা স্বরে যে আহবান করে। প্রথম স্তবকেই সে সংজ্ঞার্থ ও উদ্দিষ্ট বিবেচনা চিহ্নিত। এর পরের স্তবকে তার অবস্থান ও অভীপ্সা সে ব্যক্ত করে। পরিপ্রেক্ষেত রচিত। অতিশয় প্রামিত্মক, ‘অপর’ পরিগণিত এ-প্রেমিক যুবক। সে ‘পেরিফেরাল’। ব্রাত্য। আবার বিপরীতে প্রাণস্ফূর্তি জাগানো যুবক সে, নির্জলা প্রেমিক, বুকে আছে পুণ্যময় বিরহ। তার প্রার্থিত দরোজা, প্রার্থিত আকাঙক্ষা কিন্তু খুব সামন্ত মানসিকতায় সে বলে ‘প্রবেশ নিষেধ’। ইঙ্গিতে সে ‘রক্তচক্ষু-বাল্ব’। এরকম বিপরীত স্বরে পরের স্তবকে লোকজ এ-যুবক তার নিখাদ নিবিষ্টতায় নত হয়ে প্রিয় দরোজাকে বোঝায়, দয়াও চায়। সবকিছু বিসর্জন দিয়েই তাকে পেতে চায়। কী আছে তার? ‘শৈশবের পরিত্যক্ত ভো-ভো মাঠ’, ‘ধুলো পা’, ‘কুড়িয়ে আনা হারানো বেলুন’ – এইসব। এত উপাদেয় স্মৃতি, যত্নের উপভোগ, অমূল্য দান সবকিছু কী ফিরিয়ে নিয়ে যাবে? সবই কি মূল্যহীন, কোনোই কি দাম নেই! বিফল হবে সব? হ্যাঁ, শেষ স্তবকে এসে অনেক প্রশ্ন, প্রশ্নের নিরুত্তরে সে বলে বসে, ‘উন্মাদের অহঙ্কারে তবু তোমার সমগ্র সত্তা অনুভবে ধরি!’ সে নীরবেই ফেরে। প্রবেশদ্বার খোলে না, কারণ সে ‘বাহ্যজ্ঞানশূন্য’। অত্যন্ত সংযমে পরিবেশিত হয় প্রামেত্মর প্রেমিকার ব্যর্থ ও বিফল মনোরথের ছবি। এমনটি অবশ্যই সীমিত অর্থ। কিন্তু কবিতা তো ছড়িয়ে যায় অনেকদূর। শুধু কোনো নির্দিষ্টতা তার থাকে না। এই দরোজা আজকের সময়ের পুঁজিবাদী কোনো করপোরেট বণিকের কাছে প্রার্থনা মনে করলে কিংবা এদেশেরই পুঁজির প্রপাতে ভুঁইফোঁড় ফেঁপে ওঠা কোনো কর্তৃত্বের কাছে শরাণাপন্ন মাথানত আটপৌরে কোনো মানুষের কথা ভাবলে – সেটি কী বাতিল হয়ে যায়! অর্থ অনেকমুখী, কবি অর্থের ভার কাঁধে চাপিয়ে কবিতা লেখেন না। তাহলে কবিতা হয় না, রসাতলে যায় সবকিছু। ‘দরোজা’র চারটি স্তবকে, শোষিতের খ- ইতিহাস থাকতে পারে,

থাকতে পারে এদেশীয় ঐতিহ্যের করুণ কাহিনি, ঘটে যেতে পারে তাতে অনেক মানুষের স্বপ্নমাখা দিনে প্রতিচ্ছবির বয়ান, নির্মিত হয়ে উঠতে পরে দ্বন্দ্বস্বরূপের অভিমুখ – ইত্যাকার নানাবিধ ঝরণাতলা যেন ওই ‘দরোজা’। ঠিক এর বিপরীতে উপভোগ্যতার মাত্রাটুকু অন্যরকম করে পেতে চাইলে পাঠক নিমজ্জিত হতে পারেন ‘কুড়িয়ে আনা হারানো বেলুনের’ স্মৃতিতে। এটি তো অমোঘ ও দুরন্ত এক আলেখ্য। কমতি নেই কিছু। নিছক প্রেমিক হয়ে প্রেমিকার সমর্পণটুকু কম হয় কীসে? তাতে সে কি ব্যক্তিত্বহীন হয়ে যায়!

বিষয়ের বাইরে এর শব্দ-উপমার দৃষ্টিকোণ-বাক্যচয়ন কেমন? তার ভিন্নতা কোথায়? রফিক আজাদ যে-কবিতার আদেশটুকু তৈরি করলেন তাঁর মনোভূমে তার চমৎকারিত্ব কীসে? ‘শব্দই ব্রহ্ম’ কিংবা সর্বোচ্চ ‘ওয়ার্ড’ ও ‘অর্ডার’ কীরূপে নির্ণীত? উপভোগের আলিঙ্গন তো তাতেও নির্ণীত! ধরি ‘শীত’ এবং ‘রাত্রি’র ইমেজার্থ। পাশ্চাত্য কবিদের ভেতরেও এ-দুটি সময়খ- তুমুলভাবে কবিকরোটিতে আন্দোলিত। বিশেষ করে ইমেজিস্ট কবিদের ভেতরে। রফিক আজাদের কবিতায় যে-সত্যটি এমন শব্দবন্ধে লয়প্রাপ্ত হয়েছে – তা বিশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকের দিকে ধারণ করেছেন পাশ্চাত্যের কবিরা। যেটি পরবর্তীকালে কলেস্নালের ভেতর দিয়ে বিভাগোত্তর ষাটে এস পৌঁছয় – এই বাংলাদেশে। অভাবনীয় প্রস্ত্ততি এ-পর্যায়ে তাঁদের। স্বদেশ-জাতীয়তা ছাড়াও অবক্ষয়ের ক্লামিত্ম, ক্লেদ, কর্দমাক্ত জীবন নিরত হয় কবিদের ওপর। কালখ-টি বুদ্ধির প্রভাবে করোটিবান্দ হয়। ইমেজিস্ট বা প্রতীকবাদী চিন্তন কবিদের মধ্যে আসে – এদেশীয় প্রকৃতির স্বরাঘাত উপজীব্য হয়ে। আবেগ বা ‘ইমোটিভ’ স্টেটমেন্টের

চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে বুদ্ধিপ্রদ নৈর্ব্যক্তিক প্রতীক সমাহার। সেখানে মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ও গভীর ধারণাস্তর থেকে উঠে আসা ঐতিহ্য ও মিথ সংশয় ও ভীতি নিয়ে প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। রাত্রি [শীত ও বিহবল], মাঠ [পরিত্যক্ত/ ভো-ভো], অন্ধকার [ঠা-ঠা/ হাসি], ঠিক এর বিপরীতে ঠোঁটে [ঝলমলে উৎসবের আলো], গ্রাস [অগ্যসেত্মর মতো], চক্ষু রক্ত/ রক্তচক্ষুবাল্ব], অহঙ্কার [উন্মাদ] এভাবে শব্দকে বিষয়ীর বিষয় করলে রফিক আজাদ হয়ে ওঠেন ‘অবক্ষয়ী’ চেতনাদর্শের কবি – যা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এ-অবক্ষয়তাকে আমরা আরো অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারি, কেননা পরে আমাদের কবি পার করে এসেছেন আরো কয়েক দশক। সেখানে তাঁর কবিতায় ঘটে গেছে উল্লেখনীয় বিবর্তন, যেটি এখানে আগেই উল্লেখ করেছি বিভিন্ন সময়খ–র কয়েকটি কবিতা উদ্ধৃত করে। সে-পরিবর্তনটি কী? কীভাবে তা ঘটেছে? এখানে ‘রাত্রি’, ‘মাঠ’, ‘ঠোঁট’, ‘গ্রাস’, ‘চক্ষু’ প্রভৃতি শব্দকে নিয়ে যে-সংজ্ঞার্থটি নিরূপিত তা ক্রমশ চাকচিক্য পায় আবেগোদ্দীপকতাকে ছাড়িয়ে যখন সেটি পায় তুমুল খররৌদ্রতাপিত বুদ্ধির সংশ্রব। বুদ্ধির শাসনটি আবেগের ওপর বর্তায়। করতলে আবেগ অনিচ্ছুক নয় কিন্তু শাসনে নেয় করাল বৃদ্ধি – যে-উদাহরণটি এখানে আগে গৃহীত হয়েছে, নাম যার ‘নারী’। বিন্যাসটিও অনিন্দ্য-আনন্দের। যেখানে এক একটি পর্যায় বা স্তর অতিক্রম করছে, গড়ে তুলছে ‘মানসিক তিলোত্তমা’কে। সঞ্চারণ ঘটে কাম ও কামের ভেতরে লুক্কায়িত-প্রস্ত্ততকৃত ‘ঘ্রাণ’। এই ঘ্রাণ প্রলাপে তৈরি, ‘সিডৌ স্টেটমেন্ট’ – কল্পোময় ধারণা। ঠিক বিপরীতে তা নিচেরই মুখশ্রী, জ্যাকুয়েস ল্যাঁকাঁ-কথিত ‘আয়নামহল’। অভিভূত, মন্দ্রিত, আত্ম-‘দর্শনে’। অবসেশনে আক্রান্ত। সে নিজেই মূর্তিমান এক বিপরীত প্রতীকী সেঙকে আবিষ্কার করে, ক্রমশ। মায়ের প্রতিস্থাপিত সে মুখটি হয়ে ওঠে ‘তিলোত্তমা’। সে বিহবল বালক। এই বালকের বয়ঃস্তর ধারাটি প্রতীকী ভাষায় চিহ্নিত হয়, অনুভূতির স্তরকাঠামোটি ধরা পড়ে তাতে। বুদ্ধির সংক্রমণে নির্ধারিত হয় ব্যক্তিত্বও। একে কল্পোময় করে যেমন আবেগোদ্দীপক (বসড়ঃরাব) আখ্যায় নেওয়া সম্ভব, তেমনি বিপরীতে করা চলে ‘অবজেকটিভ কোরিলেটিভ’ সন্নিপাতেও। কিন্তু আগেই বলেছি, নিছক উপভোগের মাত্রায় দাঁড়ালে ‘নারী’ কবিতাটির অপরূপ মুগ্ধতার সুখদ স্বরটি কি চেনা যায় না! ‘বিহবল বালকের’ নদীতীরের স্বর আমাদের চিরবালকের অন্তরেই প্রেথিত। সে কিশোরী বালিকাকে ঘনগন্ধে যৌনতার আচরণে নিজেকেই তৈরি করতে চায়। প্রলম্বিত কুন্তল, তিল-টিপ-আঁখি আর শেমিজের নিচে বেড়ে ওঠা নম্র শরীর ও তার স্বেদসৌধ বালকটির উপভোগ্য শান্ত নদীতীরের মতোই তো দানময়। নারীর আতপ্ত সৃষ্টির ভেতরেই তার নিজস্বতা ক্রম-নির্মিত। এ-বালকের দশ বছর আগের ‘আটত্রিশের জ্বালা’র অবক্ষয় পেরোনো। সে চক্ষুষ্মান। কিন্তু কেউ কি চক্ষুষ্মান? কবি চক্ষুষ্মান নন। তিনি দেখেন অন্তশ্চক্ষুতে। সাধারণ দৃষ্টিতে নয়। যে অন্তশ্চক্ষু সর্বদা জাগরূক। এই অন্তশ্চক্ষুর দ্যোতনাই ভিন্ন পরিবেষ্টনে ধরা দিয়েছে কবির কাছে। সেখানে সশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে অনেক কিছু। ভীষণতার মুগ্ধ অভিসার কবি যখন প্রেমপিয়াসী কাউকে দেখেন। স্থূল নয়, সূক্ষ্ম সুকুমার অনুরাগে – সে-প্রেম পরিবেদনা হয়ে ওঠে অনেক বড়, মহান। কবির পঙ্ক্তিমালায় এক-একটি দৃষ্টিকোণে গঠন হয় বড় সৌধ, ক্রমাগত তাতে দার্শনিক মুগ্ধতার যোজনা তৈরি হয়, সংস্রব থাকে তীক্ষন রসবোধের। তাই তো চক্ষুষ্মান চোখে যখন ঝিলিক দিয়ে ওঠে কোনো বস্ত্ত – সেটি মহার্ঘ্য, অনিঃশেষ। তাই তো সে হয়ে পড়ে বিহবল, লজ্জাকাতর [‘বিপদে পড়লাম’]। ‘আমি’কে সংশ্লিষ্ট করে কবি পেরোন বৃহত্তর পথ। অনেকদূর এবং দিগন্তস্পর্শী তার সীমারেখা। সে-সীমায় জীবন ও জনপদ হয়ে ওঠে প্রাচুর্যময়। জীবন হয়ে ওঠে স্ফূর্তিময়। রফিক আজাদ আটত্রিশ বছর আগের ভেতরে সীমানা পেরোনোর উত্তাপকে নিবিড় করে ছেনে তোলেন। সেখানকার সমস্ত স্মৃতিকাতর আনন্দই তৈরি করে এক বিশেষ মুহূর্ত। তাই চক্ষুষ্মান হয়ে ওঠে আরো বেশি দৃষ্টিপ্রবণ। অকাতরে দৃষ্টিকে মেলে দেন সম্মুখে ‘অন্ধকারে চোখে দেখার মতো’। কবির এ-শতকের প্রথম দিকের লেখা আর একটি প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা দিয়ে এ-অংশের আলোচনা শেষ করব। কবিতাটির নাম ‘তখন স্বপ্ন ছিল দু’চোখে’। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত – এ-সময়ের ভেতরে আমাদের প্রতিসরিত চেতনা। কী ছিল আমাদের! যুদ্ধের স্বপ্ন আর স্বাধীনতার স্বাদ এখন কোথায়! সবকিছু কি ফুরিয়ে গেল। ‘আমরা আগুনমুখো নদীর তলদেশ থেকে/ সাঁতরে উঠে এসেছিলাম -/ আমাদের এই উত্থান তখন অবশ্য অনিবার্য ছিলো;/ দুঃসময়ে উঠে এসে আমাদের ঐ/ পায়ের নিচের মাটি খুব ভালোবেসেছিলাম -’ তাই তো সত্য। সক্কলে তাই জানে। একটু ফিরে রফিক আজাদকে এ-পর্বে চিনে নিই। এসব শব্দবন্ধে একাত্ম দেশ-মাটি-মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল। কবিতাটি সরাসরি সে-সময়ে বশীভূত না হলেও একালে এসে তার গুরুত্বই বেশি অনুভব করি। এখানে স্পষ্টভাবে পরিষ্কার সময়গ্রন্থি ‘কিন্তু বন্যা, ঝঞ্ঝাবাতে, বিক্ষুব্ধ গর্কিতে, জলোচ্ছ্বাসে,/ মারী ও মড়কে, অগ্নিঝড়ে, মঙ্গায় পীড়িতজন/ দৃঢ়পায়ে দাঁড়ানোর কোনো ঠাঁই-ই তো পেলাম না!’ – এভাবে গড়ে ওঠে স্বাধীনতা-পরবর্তী ত্রিশ বছরের নদীপাড়ের শিকস্তি-পয়স্তির করুণ বিবরণ। মেলে ধরেন তা অতুল্য সংযমে। কবিতার ভেতরে গড়ে তুলতে চান বিপন্ন সময়ের ফিরিস্তি। এ-বিবরণ কী কবিতা? প্রশ্ন মেলে ধরলে তার উত্তর পাওয়া যায়। একটি শব্দে গড়ে ওঠে উত্তপ্ত উপমা। বন্যা, মারি-মড়ক, অগ্নিঝড় কোনো আক্ষরিক অর্থ কী? সমাজে ও জীবনে এসব কীভাবে ঘটে গেছে? জনপ্রবাহের ওপর দিয়ে কত অমাবস্যা আর পূর্ণিমার ভোগ কি শুধুই নামমাত্র! বা দৈবদুর্যোগ! কবি দৈব মানেন না। সৃষ্ট জীবনের দায় কাঁধে নিয়ে বলেন, ‘দৃঢ়পায়ে দাঁড়ানোর’ কথা। আমরা তা পেরেছি কী? তাই তো প্রাণান্তকর দুঃখজয়ী হওয়ার চেষ্টা। উক্তিতে কবি প্রাচুর্যময়, ভাষায় অবক্ষয়ের ক্লেদ, কণ্ঠে ঋজু মায়া, প্রকাশে স্বতন্ত্র অভিব্যক্তিপ্রবণ, চিমত্মায় আধুনিক, গড়নে পুণ্যময়ী, নির্মাণে সত্যভাষী – প্রলাপমথিত নন, সর্বার্থে বহুমূল্য প্রজ্ঞাসক্ত; এমন কবির পঙ্ক্তিবিন্যাস। লেখমালার স্মরণে চলে সময়ের নবায়ন, মানুষের মৃত্যু হলেও মানব থাকার অর্থ যেন বিন্যস্ত। কবিতার ঐতিহ্য মেলে কিন্তু পুরনোর নিঃশঙ্ক নবায়ন নিরন্তর। প্রচুর শব্দ তাই, এ-কালের। অর্থ ও ইমেজও তাই। এ-পরিপ্রেক্ষেতে একটি উদ্ধৃতি দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি :

সার্বভৌম পাঁচটি আঙুলে

আমরা, বড়রা, আজকাল তুলে দিই

বাজার-চলতি কিছু মূল্যবান পণ্যের সম্ভার,

আমাদের এই ক্রয়-তালিকায় অবলীলাক্রমে চ’লে আসে

জলপাই-রঙ চিপ, কোমরে পিস্তল-গোঁজা নিঃসঙ্গ সৈনিক,

রাইফেল, ট্যাংক, জঙ্গি বিমান-বহর,

ব্যাটারিচালিত দূর-পাল্লার কামান,

কুচকাওয়াজরত সেনাদল, বার্বড-ওয়্যারঘেরা ময়দান আর

মাইল-মাইলব্যাপী অন্ধকার আর আর্তনাদ,

অতল গহবর আর আর্তনাদ…

এভাবে তীক্ষন ব্যঙ্গ কবিতার ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে। এসব শব্দের ছন্দোৎসব কেমন? আকাশের চাঁদ, ধবল জ্যোৎস্না কিংবা শ্যামা, প্রজাপতির বদলে আমাদের কীসে ব্যবহার সার্বভৌম সব আঙুল। এখানে ভঙ্গির স্বরে কী আটকানো? উত্তর কবিতার ভেতরেই নির্মিত। তবে বিবরণের এমন প্রকোষ্ঠে কবিতা সর্বদা প্রসারিত হয় – তা বলা যায় না। কঠিন কর্মের ভেতরে কবিতা নেয় পুণ্যবান দ্রোহের প্রলাপ। সেটি চিরসময়ের রক্তমাংসের অভিপ্রায়ে মগ্ন। রফিক আজাদে সে-উপলভ্য রূপ ভিন্ন অঙ্গীকার পায়, কিন্তু সর্বদা তা নয়, কোনো পঙ্ক্তি প্রাত্যহিক শব্দের বিবরণে স্থির-নিশ্চল। মুঠোবন্দি কবিতা তো এমনই। সর্বদা কেউ পায় না তাকে।

 

দুই. সমালোচকের পাঠ-পদ্ধতির নিরিখে

ষাটের অবক্ষয়চেতনা মর্মে অবগাহন করে বিষাদ-নৈরাশ্য-ক্ষোভ-ক্রোধ নিয়ে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সময়ের [স্যাড জেনারেশনে, ‘স্যাড জেনারেশন’ বেরিয়েছিল ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারির দিকে। যাকে কেন্দ্র করে স্যাড জেনারেশন আবর্তিত হয়েছিল সে রফিক আজাদ। সে-সময়কার নতুন অবক্ষয়ী চেতনার মূল চেতনাটিকে ও-যে কেবল এই বুলেটিনে তুলে ধরেছিল তা নয়, এই বুলেটিনের অধিকাংশ লেখার মূল বিষয়বস্ত্তও ছিল ও-ই] সবুজপ্রত্নরসিক [‘সবুজ শস্যের মাঠ’, ‘সবুজের ধারাবাহিকতা’, ‘সবুজ সংসার’, ‘সীমিত সবুজে’, ‘সবুজের ভেতর সবুজ’, ‘পাখিদের মতো সবুজ সাম্রাজ্য’, ‘চুনিয়া সবুজ খুব’, ‘কী ক’রে সবুজ হ’ব বলো’, ‘দীর্ঘ সবুজ বিকেল’, ‘সবুজ চারা কেন আমি করিনি রোপণ’] কবিকৃতিতে বিরাজমান এক ধরনের সাহস, দৃঢ়তা ও অঙ্গীকার, অন্যদিকে ব্যক্তির ব্যথাবেদনার উগ্র-আকুতি। উদ্ধত ভঙ্গি এবং প্রবণতায় জীবনবাদী। না-পাওয়ায়, বেদনাহত। চিৎকার তার অনিবার্য ক্ষোভ ও অধিকারে। ‘ভাত দে হারামজাদা, তা-না হ’লে মানচিত্র খাবো’ – এক দানব-দুঃস্বাপ্নিকের হাহাকার। এ প্রবণতাটি ‘স্যাড’-উত্থিত। সেভাবেই কবির নৈর্ব্যক্তিক প্রকল্প-নির্মাণ। কোনো তুলনায় নয়, ষাটের অবক্ষয়-দুর্বিনীত লক্ষ্যভ্রষ্ট-কালধারায় পাশ্চাত্যরীতির প্রভাব বা প্রচ্ছন্নতা অবসিত নয়। সেটি স্বকালবিদ্ধ। লক্ষণীয় উপর্যুক্ত কাব্যটির ‘নগর ধ্বংসের আগে’ কবিতাটি :

নগর বিধ্বস্ত হলে ভেঙে গেলে শেষতম ঘড়ি

উলঙ্গ ও মৃতদের সুখে শুধু ঈর্ষা করা চলে।

‘জাহাজ, জাহাজ’ – ব’লে আর্তনাদ সকলেই করি –

তবুও জাহাজ কোনো ভাসবে না এই পচা জলে।

 

সমুদ্র অনেক দূর, নগরের ধারে কাছে নেই :

চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন জলরাশি।

রক্ত-পুঁজে মাখামখি আমাদের ভালোবাসাবাসি;

এখন পাবো না আর সুস্থতার আকাঙক্ষার খেই।

দৃষ্টান্তটি দুর্মর। ঐতিহ্যপ্রেরিত। ‘পচা জলে’ নঞর্থক। নেতিচেতনা বাংলাদেশের কবিতায় ওই কালপটে খুব কঠিন করে তোলেননি তেমন কেউ। কিন্তু এখানে নিশ্চিন্ততায়-নির্ভয়ে গ্রথিত। এতে মনে পড়ে : ‘The poetry is never solely with the presentation of a picture of Ôthe turning world’ : the spiritual undertones are always present. But what most distinguishes the early from the later poetry is that in the former the streets, the houses, the music, the routine affairs of the people overlay the spiritual considerations and are essential to their communication’। ‘শেষতম ঘড়ি’ ঐতিহ্যিক আর ‘রক্ত-পুঁজে মাখামাখি’ বর্তমান কিন্তু পঙ্ক্তিগুচ্ছে বিদ্যমান কালখ- অধ্যাত্ম-ইঙ্গিতে জারিত। ‘ধ্বংসের আগে সাইরেন কেউ বাজাবে না’ চিরন্তনতার-আনুকূল্য পেলে ‘প্রোথিত বৃক্ষ’-এ বদ্ধমূল সমস্ত সৎ-সদর্থক চিমত্মা আর ‘জিরাফের গ্রীবা’ বিকৃত প্রতীক-বিদ্রূপে অনিঃশেষ। এরকম ‘স্মৃতি, চাঁদের মতো ঘড়ি’, ‘চোর’, ‘ক্ষুধা ও শিল্প’ একই প্রবণতার। কবিপ্রসিদ্ধিটি ধরা পড়ে, ধারাবাহিক এ-চেতনাটি ক্রমশ সম্মুখপানে এগিয়ে গেলে। সমস্তরকম শব্দে (চলতিশব্দ, ধ্বনিব্যঞ্জকশব্দ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য শব্দ) বোধ আক্রান্ত হলে সেখানে পুনর্গঠিত চিত্রকল্প নিজের মতো গড়ে ওঠে। বস্ত্তত তাতে ‘placing his picture of the turning world in the perspective of history and traditional faiths.’ এতে রফিক আজাদ ওই মাপে প্রতিষ্ঠা না পেলেও তার উপলব্ধিতেই বলা যায় :

আমার ক্ষমতা কম – পঙ্গু আমি – ঊর্ধ্বারোহণের

শক্তি ও সাহস নেই; মৃত্তিকায়, পাথুরে শয্যায়,

শোকের তাঁবুর নিচে শুয়ে আছি, – ত্বকের প্রচ্ছদে।

তবে কবিতার এ-কাঠামোটি প্রায়শ বজায় থাকে না। মাঝে মাঝে প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় উৎকীর্ণ হয়ে পড়েন কবি। পিছিয়ে যায় তার ‘ঊর্ধ্বারোহণ’। আবার ঝলসে ওঠে ‘মধ্যরাতের শোকগাথা’। বিস্তর ভেসে ওঠে দীপাবলি। চরিত্র গড়ে ওঠে। আশাবাদ প্রতিশ্রম্নত হয়। ভালোবাসার আশায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি। তাতেই তাঁর সমর্পণ, প্রতিষ্ঠা। এর ব্যত্যয়ে কারণ খোঁজেন, বিদ্রূপ আওড়ান, নস্টালজিক হয়ে ওঠেন, সভ্যতার গস্নানি নিয়ে বোঝাপড়ায় লিপ্ত হন। তাতে তাঁর কবিতা Ôchief interestÕ -এ আটকে যায়। উপর্যুক্ত ‘framework of myth’ দূরপরাহত থাকে।

‘শব্দের ব্যাপ্তি, ধ্বনিগুণ ও কবিতার প্রকৌশলগত দিক বিবেচনায় রফিক আজাদের কবিতা ধ্রম্নপদী লক্ষণাক্রান্ত। কাব্যভাষায় গদ্যাত্মক ঋজুতা আছে, সেই সঙ্গে রোমান্টিক আর্তিও দুর্লক্ষ নয়।’ দীর্ঘ কবিতা অনুশীলনে রচিত হয়েছে সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে (১৯৭৪), নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫), চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া (১৯৭৭), প্রেমের কবিতা (১৯৮১), সশস্ত্র সুন্দর (১৯৮২), একজীবনে (১৯৮৩), ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৩), অঙ্গীকারের কবিতা (১৯৮৩), প্রিয় শাড়িগুলি (১৯৮৩), হাতুড়ির নিচে জীবন (১৯৮৪), পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ (১৯৮৫), রফিক আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৭), গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি এক দিগ্ভ্রান্ত পথিক (১৯৮৭), অপর অরণ্যে (১৯৮৭), খুব বেশি দূরে নয় (১৯৮৯), ক্ষমা কর বহমান হে উদার অমেয় বাতাস (১৯৯২), করো অশ্রম্নপাত (১৯৯৪), পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি (১৯৯৫), প্রেম ও বিরহের কবিতা (১৯৯৪), কবিতাসমগ্র (১৯৯৬), কণ্ঠে তুলে আনতে চাই (১৯৯৬), প্রেমের কবিতাসমগ্র (১৯৯৭), হৃদয়ে কী বা দোষ (১৯৯৭), বিরিশিরি পর্ব (১৯৯৭), বর্ষণ আনন্দে যাও মানুষের কাছে (২০০৫) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। কবির সম্পাদনাগ্রন্থ দুই বাংলার কবিতায় মা। এসব কৃতিকে পুনরুক্তি করে বলা যায়, রফিক আজাদ প্রেমিক, অভীপ্সা-আকুল প্রেমিক। কবির নির্বাচিত কবিতায় উক্তি ‘খ-, বিচ্ছিন্ন, স্বাধীন কিছু পদ্য-প্রবন্ধের একত্রিত সমাবেশ ঘটিয়ে এই সামান্য পুঁথির বিনীত প্রকাশ’, আবার বলেন, ‘পাঠকের জন্য আমার কোনো গদ্য-সংবাদ নেই বলেই অগত্যা, পদ্য-প্রবন্ধকে আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছি’ – নৈরাশ্যবাদ, ‘মাছি’, মানুষের প্রতীকায়ন কবিউপমায় দিব্যদৃষ্টি। সময়, ব্যবস্থা, সামরিক শাসনের মধ্যে কবির মর্মপীড়ন, আত্তীকরণ – অবক্ষেণ্ণ ও বিকারতাড়িত। তখন ‘পদ্য-প্রবন্ধ’ই ছন্দের মাত্রা পেয়ে যায়। কবি শ্যেনদৃষ্টি সেখানে শিল্পকৃতি অর্জন করে। কবিতাচর্চায় শিল্পের কারুকার্যময় দরোজা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অন্বেষণ করেছেন। এজন্য প্রকরণ কখনো প্রম্নফকসুলভ, কখনো স্যামসনীয়, কখনো কনফেশনাল।  হ্রস্ব কবিতা পেরিয়ে দীর্ঘ কবিতার পরিকীর্ণ পানশালায়। তবে এক সময় উঠে আসে ‘চুনিয়া’র নিষ্পাপ ইতিহাস। কবির কাছে ষাটের ‘স্যাড’ হয়ে ওঠে দর্শন। প্রেম পৌরুষস্পন্দিত, ব্রীড়াহীন, লাম্পট্য লীলালাস্যে ভরপুর। আর সময় অবসেশনপ্রিয়। তবে প্রামিত্মকে কবি স্থিত, মৃত্যুচেতনাকাতর, স্নেহধারাজলসিক্ত। ক্ষমা করো হে বহমান উদার অমেয় বাতাস-এ প্রকৃতি প্রচ- দায়িত্বশীল। পলস্নীর পললভূমে সজ্জিত। পাখি, কীট, পতঙ্গ, লতার শোভামগ্ন আত্মার অবমুক্তি। রফিক আজাদ প্রকৃত কবি কিন্তু ‘গভীর আর স্বপ্নে বাস্তবে’র রথে তিনি ত্রম্নটিমুক্ত নন। শব্দের বাগাড়ম্বর, তাৎক্ষণিক স্থূল আবেগ, রাজনৈতিক দার্ঢ্য, প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা অনেক সময় তাঁর কবিতায় যেন জনপ্রিয়তার চাপ সৃষ্টি করেছে।

প্রধানত আক্রমণাত্মক, আত্মবিশেস্নষণ, অবক্ষয়ী, বিবরবাসী; নিও-রোমান্টিসিজম লক্ষণাক্রান্ত, বলা চলে, ‘ষাটের গোড়ার দিকে, একনায়কতান্ত্রিক শাসন-নিগড়ে রুষ্ট- ক্ষুব্ধ-হতাশ তরুণ কবিবৃন্দ প্রচ-ভাবে মানসিক নিম্নচাপে ভুগেছিলেন, তা ফলিতরূপে অর্জন করে বাস্তব ও ঘটমান জীবন-বিমুখতায়। স্বস্তিহীন অবরুদ্ধ দেশকালের প্রতিক্রিয়ায় তরুণ কবিকুল বিচিত্রধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েন। প্রত্যাশিত সুন্দরের অর্চনায় আবদুল মান্নান সৈয়দ পরাবাস্তব পরিম-লের সদস্যে পরিণত হন; স্বপ্নের নির্মোকে ঘটমান বাস্তবের সমালোচনা করার অন্যবিধ কোনো উপায় ছিলো না।’ অসম্ভব পায়ে এবং পরে চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া পর্যন্ত রফিক আজাদ রিরংসা-মগ্ন,

নৈরাজ্যিক, স্খলিত :

খণ্ডিত ব্রিজের মতো নতমুখে তোমার প্রতিই

নীরবে দাঁড়িয়ে আছি : আমার অন্ধতা ছাড়া আর

কিছুই পারিনি দিতে ভীষণ তোমার প্রয়োজনে;

উপেক্ষা কোরো না তবু নারী

এবং,

উভয়ের দেহ জাগে দেহের অতীত কোনো এক

ঐশ্বর্যের লোভে,

আমাদের উভয়ের

শরীর মনের ঐক্যে, অশ্রম্ন আর ঘামে

মধ্যরাতে তৈরী হয় সুন্দরের সম্পন্ন প্রতিমা \

পরে তা আলাদা হয়েছে, সমাজ-ইতিহাসের রূপান্তরে। এসেছে মিত-সংযম, স্মিতবাক, পরিমিতি। পরে রাজনৈতিক কবিতাও লিখেছেন। এরূপ পরিপ্রেক্ষেতে তাঁর গড়ন, তবে ক্রমশ বেরিয়ে আসেন অনেক অবলম্বনে, মুক্তিযুদ্ধের পরে, মৃত্তিকাকে পায়ে দলে। ‘রফিক আজাদ যতোই থাকুন ষাটের দশকের উন্মাদনার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, তিনি যে শেষ পর্যন্ত মাটিতে পা রাখেন, তিনি যে কৃষক হয়ে যান, তার ঘন-ঘন সর্দির ধাত কেটে যায় খালি-মাথায় রোদবৃষ্টিসাঁতলা বাতাসে বাংলার বুকের ভিতরে ঢুকে পড়ার আকুতিতে।’ (হাসান আজিজুল হক) উদ্ধৃতি :

এই তো সময় হ’লো, এসো তুমি বেরিয়ে এবার –

হে ব্যাঘ্র, বিবর থেকে উজ্জ্বল ভাঁটার মতো চোখে,

খাটো চুলে, বস্ত্রের বাহুল্যহীন গ্রীজ-মাখা দেহে,

শাবল-গাঁইতি হাতে বিড়ালের মতো মৃদু-পায়ে –

সন্তর্পণে, এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ো : এই তো সময়।

পরে আরো লেখেন :

মাতৃরূপিণী হে, তুমিও দেখছি বেশ মর্ষকামী,

উপভোগ ক’রে যাচ্ছো, দীর্ঘদিন, আনন্দ-ধর্ষণ –

বিশটি বছর ধ’রে পরিতৃপ্ত তুমি পড়ে আছো

দুষ্ট প্রকৃতির সব পুরুষের শরীরের নিচে!

আরব্য-রজনীর হে মর্ষকামী কুরুৎকামিনী,

তোমাকে জননী বলে ডাকতে আজ ঘৃণা বোধ করি।

রফিক আজাদের আধুনিক বৈশিষ্ট্যটি মনোলগের ব্যবহারে, স্বীকারোক্তি-রীতি বা ‘আনুভূমিক প্রাত্যহিকতা’য় নির্ধারিত। পুরুষপ্রবণতায় তিনি বেপরোয়া আক্রমণাত্মক, দুর্দমনীয় আবেগী, নিটোল আর স্পন্দ্যমান। নৈরাশ্য ও বেদনাকাতর ‘বাষ্পাতুর নেত্র সম্মুখে তাকিয়ে দেখি’ কিংবা ‘ভুলে ভর্তি লগবুক যেন কোন ক্লান্ত কেরাণীর’ – এমন পঙ্ক্তিতে। আর সে-রূপেই তিনি সহজবোধ্য এবং জনপ্রিয়, সেক্ষেত্রে কবির মনোলগের ব্যবহার বিস্তৃতি ঘটে, আটের দশকের কিছু কবিতায় (‘পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ’, ‘নারী’, ‘পয়ারেই করো ধারাস্নান’)। টিপিক্যাল মধ্যবিত্তের দৈনন্দিনতার ভেতর দিয়ে রফিক আজাদ নিজেকে প্রকাশ করেন, অতিক্রম করেন। ‘উত্তর তিরিশ’ কথন, অতীত-শৈশব, সময়গ্রাহী বাস্তবতা, আত্মবিশেস্নষণ,

ক্ষয়িষ্ণু-নারীর শরীরগম্য যৌনতা, প্রেম, দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, ক্ষুর প্রাকার ইত্যাকার স্বতন্ত্র স্ফূর্তি নিয়ে তার কবিতা। কোনো শব্দে রফিক আজাদ অগভীর হতে চাননি, পূর্ণতরো ক্যাজুয়ালে সংহত পরিস্ফুট-প্রকাশ (‘যেন গর্ভগৃহ থেকে নেমে ডিনামাইটের মতো/ অসম্ভব তোলপাড় জুড়ে দিলো একটি শৈশব’, ‘ঠোঁটে-ঠোঁটে, বুকে-বুকে/ কামে-ঘামে উষ্ণ শরীর চাই’) তার অভীষ্ট।

শুভপ্রদ, শ্রেয়োচেতনায় রফিক আজাদ হঠকারী নন, পরিপূর্ণ ‘ধার্মিক’, স্বদেশ-স্মৃতি-ঐতিহ্য-পুরাণের রসায়নে তা তপ্তময়। সমাজের যাবতীয় বিষয় বিশেষ করে মধ্যবিত্তের-স্বরূপ নির্ণয় করলেও তার কবিতার মুখ্য প্রতিপাদ্য শুভপ্রদ চেতনা। যেটি নববইয়ের পরে এক উচ্চরেখ আস্থায় পৌঁছেছে। দক্ষতাও যুক্ত হয় তাতে। ‘নারী’-কৈশোর-জননী-গ্রাম-নিসর্গ এক ভিন্ন প্রকরণে স্থিরতা পায়। বিষয়-সংকেতে ধরা দেয়। এতে হয়তো মধ্যবিত্তীয় সমাজস্তর বা করপোরাল পুঁজির কাঠামোয় বন্দি-ব্যক্তির নাভিশ্বাস, উত্তেজনা ও ক্ষেদ আছে – ‘নানারকম হাতুড়ির নিচে এই জীবন।’ কিন্তু উপলব্ধিটুকু কবিতায় রূপান্তরে ‘most original and most reminiscent’ :

অবশেষে একদিন দেখি : আমাদের ছোট নদী লৌহজঙ্ঘার

ওপারে দাঁড়ানো এক

কিশোরী – উধাও চোখে পড়ন্ত বিকেলে স্রোতস্বিনীর তীরে

দাঁড়িয়ে-থাকা সেই

বিষাদপ্রতিমা নগণ্য এক বালককে কল্পলোকে উড়তে

শিখিয়েছিলো। আমার অর্ধেকেরও

বেশি কবিতায় নদীর ওপারে দাঁড়ানো অস্পষ্ট রহস্যময় এই

নারী বা কিশোরীর

উপস্থিতি। কবিতাগুলির বাস্তবতার ভিত্তি ওপরের ঐ বর্ণনা,

বাকিটা কল্পনা। নারী

চিরকালই আমার কাছে নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে-থাকা এক

বাস্তবতা।

‘বিরিশিরি পর্বে’র পরে কবির মৃত্তিকাগন্ধী, লোকপ্রত্নপুরাণ সত্তাসান্নিধ্য স্পষ্টতায় বিকিরিত। ধর্মীয়-ঐতিহ্যও পুনর্গঠিত। আকর্ষণীয় কোলাজধর্ম কখনো আশায় প্রতীক্ষায় স্বীকারোক্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এখানে বিসত্মৃতিময় ও সৃজনশীল নিরীক্ষায় ব্যঞ্জিত বিষয়সমূহ। কবির অদৃষ্টময়তা, আত্মশস্নাঘা, জীবননিষ্ঠা এতে প্রকাশিত। এ-পর্বের পরে কবির কবিতার রং ও বিভা পালটেছে। মৃত্যু-মানুষ-ধর্ম অলৌকিক বা লৌকিক আখ্যান মননে উৎকীর্ণ :

বর্ষা বড় ঋদ্ধ ঋতু, দ্রবীভূত করে, এমনকি,

জল্লাদেরও মন; মাঙ্গলিক এই ঋতু বিশুষ্কতা

প্রত্যাখ্যান ক’রে আর্দ্র করে হৃদয়-মনন-মেধা।

 

তিন. ‘সবুজ’ সংসারের চিরবাঞ্ছা

রফিক আজাদ ‘পয়ারেই করো ধারাস্নান’ নামে একটি কবিতায় লিখেছেন। এটিই হতে পারে এ-লেখাটির উপসংহার অংশ। ‘পঞ্চাশ বছর ধ’রে নির্দ্বিধায় এই অর্বাচীন/ যে-ছন্দে করেছে চাষ নিদারুণ মানবজমিন -/ সন্দেহের চোখে তাকে তাকিয়েছে বাজার-জহুরী!’ বাস্তবে ঘটেছে যা, তা-ই হয়েছে। কে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে তা ছেড়ে দিলে – ‘মানবজমিন চাষের’ আলেখ্যটুকু কী? কবির চোখে তা কেমন – বিশেষ করে এই এতোকাল পরে এসে? খুব শক্ত ছন্দে তুলে নেন তিনি কলমের বাট। পয়ারকে নিয়ে খেলেন। তাতেই দেন বিবরণ। ভরে দেন অবক্ষয়ের রাগ-ক্রোধসমূহ। গভীর যন্ত্রণাও। উপনিবেশ নয়, পরাধীনতা নয়, কর্তৃত্ব নয়, বাণিজ্য লালসা নয়, প্রচার নয়, স্বার্থপরতার সম্মুখে বিলানো নয় – বলেন পঙ্ক্তিতে, বলাটাই বা কেন? কবি তো প্রথমেই তার মীমাংসা করে নিয়েছেন। শুরুতেই তার দায় নেন ‘গাঙ্গেয় বদ্বীপে, রাঢ়ে, সমতটে, বরেন্দ্রভূমি’র। সেটিই তো তাঁর জমিন। কার্যত কবি, এই প্রাচ্যের নামাঙ্কন ও লোকায়ত প্রকৃতির প্রতিনিধি – বিশ্বায়নের প্রকোপে তাই তাঁর উন্নত শিরে বৈঠা চালানোর দাম্ভিক উক্তি। ‘দ্যাখো গিয়ে দারিদ্রে্যর নিচে/ কী ক’রে রয়েছে বেঁচে তোমার স্বজন’ বলে নিতে নিরাপত্তি নেই। এই একালের আরো ইতিহাস ‘গাভীর ওলানে দাও ঠোনা, রোদচশমা খুলে ফেল’ – এই অভিজ্ঞান শুধু ‘সবুজ’ জীবনের জন্য।

এ ‘সবুজ’ আসলে কী? দ্রোহ ও দ্বিধা কাটানোর স্বর। সেটি অনেক ভাবে এবং বহুরকমে তাঁর কবিতায় পরিবেশিত। চিরচলমান তাঁর এ-সংজ্ঞার্থ। জীবনানন্দটুকু পাওয়ার জন্যে, পেরোনোর পথ নির্ণয়ে সবুজ-প্রতিশ্রম্নতিটুকু তো তার এই! তা নিয়েই তিনি চলমান। এখনো। আজীবনও তাই। সম্মুখে কবিতার ফেরানো বাঁক, তাতে তাঁর অর্থও আরো প্রকাশ-উপমা মর্জিমাফিক লভ্য হবে; কিন্তু মূলটুকু ওই সবুজেই বর্তাবে। সবুজেই থাকবে সমাসীন। কবিতাজুড়ে তাই-ই চিরচিহ্নিত মনে হয়।