রফিক আজাদ : চুনিয়া থেকে বিরিশিরি

আহমেদ মাওলা

কবি রফিক আজাদ (১৯৪৩-২০১৬), তাঁর পেছনে রয়েছে বিশাল ব্যাপক এক কৃষি-পটভূমি। ধারাবাহিক এক স্মৃতি-পরম্পরা সমগ্র বাঙালি সত্তার। ছায়াঘন সেই প্রেক্ষাপট ছায়া ফেলে গেছে তাঁর মননে ও কবিতায়। সর্বাংশে আধুনিক হয়েও আবহমান বাংলার মাটির গভীরে প্রোথিত তাঁর আবেগ। সামাজিক অসংগতি দেখে, আহত, ক্ষুব্ধ হয়ে কখনো রূঢ় উচ্চারণ করেছেন বটে – ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব’; কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল শিশুর মতো সরল। এই যুদ্ধ, দ্বন্দ্বময় পৃথিবীতে বাস করেও তিনি বুকে লালন করতেন এক নির্বিরোধ পৃথিবী ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ – ‘চুনিয়া বিশ্বাস করে/ শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে/ পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে।’ জলের গভীরে জ্যোৎস্না, লাঙলের ফলপ্রসূ ফলা, নিধুয়া পাথার, শামিত্মছায়াঘন এক আদিম অরণ্য। বহিরঙ্গে নাগরিক হয়েও রফিক আজাদ অন্তরঙ্গে ছিলেন এক অতৃপ্ত কৃষক। প্রায় ৫৮ দিন কোমায় থেকে, নীরবে, নিভৃতে চলে গেলেন ষাটের দশকের দুর্দান্ত, দুর্বিনীত, আত্মদর্পিত স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর কবি রফিক আজাদ। ‘চুনিয়া’ ছিল রফিক আজাদের ‘ইউটোপিয়া’। এক সাক্ষাৎকারে (১০ মে ২০১৩, প্রথম আলো) তিনি বলেছেন, ‘১৯৭৫ সালের আগে যাওয়া হয়নি চুনিয়া গ্রামে। পরিবারসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলেন, সেই সময় আমাদের মন খুব বিষণ্ণ। এক পূর্ণিমায় প্রথম যাওয়া হয় চুনিয়াতে, আমি শামসুজ্জামান খান, রাহাত খান, রশীদ হায়দার, রইছউদ্দিন ভূঁঞা। সেই সময় আমাদের একটি দল ছিল। নানা উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় হুটহাট করে চলে যেতাম আমরা। তেমনিভাবেই চুনিয়া যাওয়া, সেই যাত্রায় গারোদের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। চুনিয়ার প্রাকৃতিক লীলাভূমি আবেশিত করেছিল। ফিরে এসেই লিখলাম ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’। এই গারোদের সঙ্গে আমার পরবর্তী জীবন যে, অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে যাবে, আমিও যে তাদের একজন হয়ে উঠব, জীবন উপলব্ধিতে যে বাঁকবদল ঘটবে এটা সেদিন ভাবিনি। ১৯৯৭ সালে পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে বিরিশিরি যাওয়ার পর কেবলই মনে হতো, আমি ফিরে এসেছি আমার শিকড়ের কাছে পূর্বপুরম্নষদের ঠিকানায়।’ ‘বিরিশিরি’ কবিতায় লিখেছেন – ‘ঠিকানা আমার/ পূর্ব পুরম্নষদের ছিল গারোপাহাড়েই/ আমি তো এসেছি ফিরে/ শিকড়ের টানে – শিকড়ের সন্ধানে এই/ গারোপাহাড়ের সানুদেশে/ বিরিশিরি গ্রামে।’ নদী সোমেশ্বরী স্বচ্ছতোয়া জলে ধুয়ে নিয়েছেন তিনি বিষয়বাষ্পের ছিল যত পাপ ও গস্নানি। রফিক আজাদ কবি, সম্পাদক এবং পরিচালক হিসেবে নানা জায়গায় নানা সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলে কলকাতার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। স্বভাবে, আচরণে, কাব্যচিমত্মার দিক থেকে রফিক আজাদ ষাটের দশকে অন্যতম প্রধান কবি হয়ে ওঠেন। রফিক আজাদের কবিমানস গড়ে উঠেছে মূলত সময়তাড়িত শৈল্পিক যন্ত্রণায়। অভিজ্ঞতা এই কবির পরম পুঁজি। সমকালীনতা ও প্রাত্যহিকতা তাঁর কাব্যমানসের অন্যতম অবলম্বন। স্বীকারোক্তি ও আত্মকথন তাঁর কবিতার অন্যতম ভঙ্গি। প্রেমে যেমন তিনি দুর্ধর্ষ ও আক্রমণাত্মক, তেমনি তাঁর হাতাশাও বটবৃক্ষের মতো ছড়ানো। তাঁর কবিমানসের বৈশিষ্ট্য ও গুরম্নত্ব এখানেই।

 

দুই

প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জীবনদ্রষ্টা কবিকে কখনো-কখনো আপন চরিত্রের অধিক মহিমায় উত্তীর্ণ করে। আপন সৃষ্টির ভুবনে নিজেই হয়ে ওঠেন অমর, অজর, অক্ষয়। বাংলাদেশের কবিতায় রফিক আজাদ তেমন একজন কবি, যিনি পূর্বাপর আপন চারিত্র্যখচিত এবং স্বভাবের অবিকল অনুসারী। তিনি বরাবরই নিজেকে দেখেন সমাজ-সময়ের নির্দিষ্ট বাসত্মবতায়, যেখানে ব্যক্তিমানুষটি প্রায়শ যেন খাপ না-খাওয়া, অসহায়, করম্নণ, পর্যুদসত্ম, আত্মমর্ম। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে রফিক আজাদ সরকারি দায়িত্ব নিয়ে ‘বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল অ্যাকাডেমি’র প্রধান হিসেবে যোগ দেন নেত্রকোনা জেলায়।
প্রথমদিকে এই নিয়োগকে তিনি ‘নির্বাসনদ-’ বলে অভিহিত করলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন গারো, হাজং, হদি, ডালু, বানাই, মান্দাই, রাজবংশী প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্বজন একজন হিসেবে। তিনি লিখেন – ‘এখনও, এই মুহূর্তে, একবছর চারমাস পরে, আমি এদের একজন। এখন আমার কোনো খেদ নেই। আমার পূর্বপুরম্নষের রক্ত-সম্পর্কিত গারো নৃগোষ্ঠীর মধ্যে বাস করছি আমি অত্যধিক স্বসিত্মদায়ক পরিবেশে।… এই মুহূর্তে আমি আমার এই অবস্থানকে আর নির্বাসন বলি না; এই আমার ঘরে ফেরা একান্ত আপন শিকড়ে ফেরা মনে করি।’ (‘যৎকিঞ্চিৎ’, বিরিশিরি পর্ব, রফিক আজাদ, অনন্যা, ঢাকা, ১৯৯৯)

বিরিশিরিতে রফিক আজাদ প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে অবস্থান করেন। যদিও এটি ছিল তাঁর কার্যোপলক্ষে সেখানে অবস্থান করা, কিন্তু ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-অধ্যুষিত আদিবাসীদের বিলীয়মান সংস্কৃতির লালন, উন্নয়ন সাধনে কাজ করতে গিয়ে বড়বেশি ভালোবেসে ফেলেন তাদের। নিজের চেহারা দৈহিক অবয়ব গাত্রবর্ণের অবিকল মিল দেখে রফিক আজাদ নিজেকে আবিষ্কার করেন গারো নৃগোষ্ঠীর উত্তর-পুরম্নষ হিসেবে। পূর্বপুরম্নষের রক্ত-সম্পর্কিত গারো নৃগোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করতে গিয়ে রফিক আজাদের কবিমানসের অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে। গারোদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ধর্ম ও ঐতিহ্যগত জীবন প্রত্যক্ষ করে তিনি আত্মশস্নাঘাবোধে উজ্জীবিত হন। তিনি উদ্যাপন করেন সৃষ্টিশীল এক উৎসবমুখর সময়। সেই সঞ্চিত অভিজ্ঞতারই প্রতিমূর্তি বিরিশিরি পর্ব

এ-পর্বে রচিত কবিতাগুলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। রফিক আজাদের পূর্বাপর কাব্যধারা থেকে বিরিশিরি পর্বের কবিতাগুলো ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কবিমানসের অন্য এক উপলব্ধির কবিতা ‘বিরিশিরি পর্ব’। নিয়তি যেন অদৃশ হাতে টেনে নিয়ে গেছে সোমেশ্বরী নদীর তীরে। গারোদের আ’ছিক দেবতাশ্রেষ্ঠ তাতারারাবুগার অলীক ইচ্ছায়, পূর্বপুরম্নষের রক্তের ঋণ শোধ করার জন্যেই যেন তাঁর এখানে আসা, এই বিরিশিরি অনিন্দ্যসুন্দর এক নাম –

নিয়তি এনেছে টেনে এইখানে

সোমেশ্বরী তীরে, শুষ্ক বালিয়াড়ি আর কাশবন

ছাড়া কিচ্ছু নেই। সীমামেত্মর ওই পারে

সাজানো মেঘের সারি নয়, সত্মরে সত্মরে

গারো পাহাড়ের শ্রেণী, এই শুষ্ক বিশীর্ণ প্রান্তরে –

আমার গোঁফের মতো – বিরিশিরি নামটি সুন্দর

না-দেখা না-জানা এতোটুকু নামের মোহে

এসে তো পড়েছি এইখানে – হয়তো বা –

তাতারারাবুগা ইচ্ছে করেছিলো, তাই

পূর্বপুরম্নষের শোধ ছিলো কপালে আমার

তাই এই নির্বাসন –

(‘সন্ন্যাসী’, অন্তরে-বাহিরে)

 

যে-বয়সে মানুষ ঘরে ফেরে, সে-বয়সে তৎকালীন সরকার তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন স্বজন-পরিজন থেকে দূরে, নির্বাচনদ–র মতো কিংবা মহাভারতের পা-বৃন্দ অথবা রামায়ণের রামের নির্বাসনদ- – পুরাণের এসব ঐতিহ্যের সঙ্গে রফিক আজাদ যখন নিজেকেই সংশিস্নষ্ট করে লিখেন এমন পঙ্ক্তি, তখন মহিমান্বিত হয়ে ওঠে কবিতা –

আমার এ নির্বাসন-নির্বাসনই, বটে,

তবে জন্ম মুহূর্ত থেকে নির্বাসিত-জন

ডরাবে কি নতুন এ নির্বাসনে?

পা-বেরা আমাকে কি শেখাননি

নির্বাসন কী করে সহনীয় হয়?

রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণ কি শেখাননি

নির্বাসন কাকে বলে?

(‘অপার অরণ্যে’)

বাল্যকালের দিনগুলো ছাড়া রফিক আজাদের প্রায় পুরো জীবনই ঢাকায় কেটেছে। ষাটের দশকের শুরম্নতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-কবি রফিক আজাদ নিজের চোখে দেখেছেন ঢাকার নগরায়ণ, প্রাদেশিক শহর থেকে রাজধানী হয়ে ওঠা ঢাকা শহর, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা-উত্তর কর্মক্ষেত্র, বন্ধুবান্ধব, পরিবার নিয়ে আবর্তিত, অভ্যসত্ম নাগরিকতা নিয়েই তাঁর জীবন। মুক্তিযোদ্ধা অথচ কর্মহীন কবি রফিক আজাদকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ দল দীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় এসে পাঠিয়ে দিলেন রাজধানী থেকে দূরে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্বাভাবিকভাবে তিনি অভিমানী হয়ে ওঠেন। সেজন্যেই তাঁর আবেগময়, অভিমানী উচ্চারণ –

জানি মিত্র আছে বহুজনে – দূর থেকে

তারা নিরীক্ষা করে নব এই মীর তকী মীর,

যাদের ভেতরে আছি – তাদের নিমিত্তে নিত্যদিন

উদয়ামেত্ম লড়ে যাচ্ছি – তাদেরই কতক করে

ষড়যন্ত্র, অবিরাম – বাংলার গালিব তারা

তাড়াতে মনস্থ করে – গোপনে নিপুণভাবে

আমি কি নির্বোধ এতো, বুঝবো না বলে,

কাকে নির্বাসন, কাকে সুখী গৃহকোণ? (ওই)

 

অভিমানী, আত্মমর্ম রফিক আজাদ একসময় নির্বাসনদ-কে সহনীয় করে তোলেন আপন ঔদার্যে। গারো আদিবাসী, যাদের পূর্বপুরম্নষ নৃমু-শিকারি ছিল, সেই সাংমা ও মারাক, যাদের দেবতা তাতারারাবুগা, সিনকিয়াং থেকে দীর্ঘ পাথুরে পথ পেরিয়ে অবশেষে গারো পাহাড়ে এসে স্থিত হয়েছিল। যাদের সজারম্নর মতো খাড়া চুল, চ্যাপ্টা নাক, কঠিন শিলার মতো মর্মভেদী আধফোটা চোখ, গায়ের মঙ্গোলীয় টগবগে রক্ত – এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে রফিক আজাদ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন। নিজের গাত্রবর্ণ, চ্যাপ্টা নাক, আধফোটা চোখ, দৈহিক আকৃতির সঙ্গে হুবহু মিল খুঁজে পেয়ে যেন আত্ম-সাক্ষাৎ লাভ করেন। ভাবলেন, নিয়তির অমোঘ নিয়মে তিনি আপন শেকড়ে ফিরে এসেছেন। পূর্বপুরম্নষের ঋণ শোধ করার জন্যেই যেন তাঁর আপন শেকড়ে ফেরা। এই বোধ ও অভিজ্ঞতা রফিক আজাদের কবিমানসকে আমূল পালটে দেয়।

খুব কাছাকাছি পূর্ব পুরম্নষটি এসেছিলো নেমে –

গারো পাহাড়ের সানুদেশ বেয়ে নিচে

মধুপুর গড়ে চুনিয়া নামক গ্রামে

নাম তার তুং হো মারাক

সজারম্নর মতো ছিলো খাড়া চুল, অতিশয় চ্যাপ্টা ছিলো নাক

সর্বদাই রক্তচক্ষু, কঠিন শিলার মতো মর্মভেদী চোখ নৃমু-শিকারী

ছিল আমাদের তুং হো মারাক।

বহিরাগত তো বটে রক্তচিহ্নে, তবে

ভুসুকুর মতো ‘আজি বাঙালী ভইল’, রফিক মারাক।

(‘তাতারারাবুগা ইচ্ছে করেছিল, তাই…’)

 

গারো নৃগোষ্ঠীর জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যগত বোধ রফিক আজাদকে ‘রফিক মারাক’ করে তোলে। গারোপাহাড়ের সানুদেশেই মধুপুর গড়, চুনিয়া, পাশে গুণি গ্রাম – রফিক আজাদের জন্মও এখানেই। রফিক আজাদের সেই সময়কার আবেগময় অভিব্যক্তি –

আমি তো এসেছি ফিরে

শিকড়ের টানে – শিকড়-সন্ধানে এই

বিরিশিরি গ্রাম।

(‘বিরিশিরি’)

‘বিরিশিরি’ নামটি মধুর। শুনলেই রক্তের ভেতর সাড়া পাওয়া যায়। যদিও অনেকে মনে করেন ‘নামে কী আসে-যায়’; কিন্তু রফিক আজাদ উলটোটিই বলেন, ‘নাম খুবই দরকারি। নামের অনেক মহিমা আছে। নামহীন, গোত্রহীন মানুষের প্রকৃতপক্ষে কোনো ঠিকানা নেই। অর্থাৎ আত্মপরিচয়ই তাকে অসিত্মত্ববান করে তোলে। সেইসঙ্গে বিরিশিরি নামটি মাহাত্ম্য লাভ করে; মর্যাদাকর আসনে অভিষিক্ত হয় ‘বিরিশিরি’। কথায় বলে – নাম মানুষকে জাঁকিয়ে তোলে না, মানুষই নামকে জাঁকিয়ে তোলে।’ রফিক আজাদ ‘বিরিশিরি’ নামটিকে মহিমান্বিত করে তুলেছেন তাঁর কবি-প্রতিভার নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে। ‘বিরিশিরি’ হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার নান্দনিক বিভূতির তাৎপর্যময় আধার।

এ-পর্বে রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে অভিমান, ক্ষোভ, দুঃখ ছাড়াও কবিমানসের নৈঃসঙ্গ্যচেতনা, মৃত্যুচিমত্মা, হতাশা এবং ব্যক্তিগত বেদনার অশ্রম্নসজল রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। রফিক আজাদ বাংলাদেশের খ্যাতিমান ক্ল্যাসিক কবি, আজ তাঁর কবি-ব্যক্তিত্বের যে বিশাল মহীরম্নহ, তা একদিনে দাঁড়ায়নি। অনেক খরতাপ, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ দিন, গস্নানি, অপবাদ-অপমান সহ্য করে এগোতে হয়েছে। শুধু কবিতার জন্যে, কাব্যশিল্পের জন্যে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি। কবিতায় এতটা নিমগ্ন, নিবেদিত ছিলেন যে, জাগতিক জীবনের সমৃদ্ধির কথা ভাববার অবকাশ তাঁর হয়নি। এ-পর্বে তিনি ফিরে তাকিয়েছেন আত্মজীবনের দিকে। অকপটে স্বীকার করেছেন, আপন স্বভাবের কথা –

সম্ভবত রক্তের ভেতরে ছিলো অস্থিরতা কিংবা এক অস্বসিত্মর বোধ

সারাটি জীবন ধরে

অস্থির ও আত্মধ্বংসপরায়ণ আমি

যা-কিছু করেছি অনুকূল ভেবে

কী যে এক ঝড়ো হাওয়া

কোথায় থেকে এসে

সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে!

দোষটি আমার বটে, এ যুগে

নিয়তি বা নেমেসিস-এর

দোহাই পেড়েও কোন লাভ নেই

কেউ শুনবে না; অধিকন্তু

দোষের মাত্রাটি আরো জোরদার হবে

সমাজের আদালতে

রায় হবে বিরম্নদ্ধে আমার।

(‘আমার শিকড়’)

এই স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা, আত্মজবানবন্দি, এতে কেবল কবির ব্যক্তিগত জীবন প্রতিফলিত হয়েছে তা নয়, সমকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রের বাসত্মবতাও ফুটে উঠেছে। হয়তো কিছু দোষ রয়েই গেছে স্বভাবের গভীরে। জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছেন – ‘নিজেরই মুদ্রাদোষে নিজেই আমি হতেছি আলাদা’। রফিক আজাদ হয়তো তাই হয়েছেন। তিনি মেনে নিতে পারেন না সমাজের কালো টাকার মালিক, অধুনা গড়ে-ওঠা ঋণখেলাপি সংস্কৃতি। তাই রচনা করেন বিদ্রূপাত্মক বা স্যাটায়ারধর্মী কবিতা ‘রফিক উবাচ’, ‘নয়া উদ্যোগ’, ‘আগাছা কাহিনী’ অথবা ‘ঋণখেলাপির মনস্তাপে’র মতো কবিতা :

 

ক. আমিও খেলাপী এক, প্রকৃত ঋণের খেলাপী;

কোনো অর্থপ্রতিষ্ঠানের নয় – খেলাপ করেছি ঋণ

মাটি ও মায়ের কাছে, ছোট্ট প্রজাপতিটির কাছে

… … …

ঋণের খেলাপ করে মনস্তাপে জর্জরিত আজ

ক্ষমাপ্রার্থী আমি – ক্ষমা চাই ঋণদাতাদের কাছে।

(‘ঋণখেলাপীর মনোস্তাপ’)

 

খ. স্যার, আমরা, শেষ-বিদায়ের ব্যবসায়ী

নিম্ন, মধ্য উচ্চমধ্যবিত্ত কিংবা ঐ অতি উচ্চ

ঋণখেলাপীর বাবা-মার সৎকার করে থাকি।

… … …

সফল বণিক, স্যার, রাজাকার পিতার সমত্মান

নিশ্চিমেত্ম থাকুন নেত্রকোণে শুধু

অশ্রম্নর সামান্য অংশ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সমত্মান

নয়া ব্যবসায়ী সবকিছু, স্যার, দ্রম্নত

সুনিপুণভাবে সুসম্পন্ন করে দোবো \

(‘নয়া উদ্যোগ’)

আর্থসামাজিক বাসত্মবতা নিয়ে এমন তির্যক বিদ্রূপাত্মক, তীক্ষন তীর কেবল রফিক আজাদই মারতে পারেন। কারণ তিনি কেবল কবি নন, মুক্তিযোদ্ধাও। নিজ হাতে যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছেন যে-দেশ, সে-দেশের রাষ্ট্রীয় বাসত্মবতা যখন রাজাকারদের মন্ত্রী বানায়, ঋণখেলাপিরা সমাজসেবক হয়ে গলায় ফুলের মালা নেয়, দেশের সব ব্যবসা যখন ঋণখেলাপিদের দখলে, তখন মুক্তিযোদ্ধার সমত্মানদের করতে হয় ‘শেষ-বিদায়ের ব্যবসা’, মৃতের সৎকার। রাজাকার পিতার সমত্মান সফল ব্যবসায় মৃত বাবার সৎকারের জন্য ‘নয়া ব্যবসায়ী’দের ভাড়া করে। এই তো বাসত্মবতা।

বিরিশিরি পর্বে রফিক আজাদের নৈঃসঙ্গ্যচেতনা তীব্র আকার ধারণ করে। এর প্রধান কারণ সম্ভবত ঢাকা থেকে দূরে, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন তথা আত্মীয়-বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা তাঁকে সত্তা-বিচ্ছিন্নতায় নিয়ে যায় এবং তিনি যেন নিঃসঙ্গতার নীরব গুহায় নিক্ষেপ্ত হন। কবি চৈতন্যের এই নিঃসঙ্গতার ভয়াবহ প্রকাশ দেখা যায় এ-পর্বের কবিতায়। নিঃসঙ্গতা মৃত্যুচিন্তাকে তীব্রতর করে, প্রকারান্তরে নৈঃসঙ্গ্যের সঙ্গে মৃত্যুচিমত্মাও তাঁকে ঘিরে ধরে।

ক. এটাই নিয়ম, জানি –

মেনে নিতে কষ্ট হয় –

মধ্যরাতে নিরাত্মীয়, স্বজনবিহীন

একাকী রম্নগ্ন কবি

প্রিয়তমা স্ত্রী নেই, সমত্মানেরা

ঘুমিয়ে নেই যে ঐ পাশের কামরায়

একাকী, নিঃসঙ্গ ন্যুব্জ, ব্যর্থ

বিষণ্ণ প্রবীণ কবি

দুঃখচিমিত্মত ঘুমায় একাকী।

(‘জীবন থেকে না থেমে’)

 

খ. মরে যাবো, ঝরে যাবো, কেউ নেই

বাধাটি দেয়ার

পত্নী নেই, সমত্মানেরা নেই

প্রেমিকা তো থাকার কথাও

নয় এ-কুৎসিত, কদাকার মানুষের

(‘মরে যাবো, ঝরে যাবো’)

 

গ. আমি মনোযোগহীন এক তুচ্ছ বনফুল

নীরবেই ঝরে যাবো সোমেশ্বরী তীরে \

(‘নীরবেই ঝরে যাবো বনফুল’)

এই নৈঃসঙ্গ্যচেতনা, মৃত্যুচিমত্মার মধ্যে কোনো ভয় বা দ্বিধা নেই, নেই কোনো পিছুটান কিংবা অলৌকিক আধ্যাত্মিকতা। কারণ, মৃত্যু-উত্তর জীবন সম্পর্কে তিনি সংশয়হীন। কাব্যযাত্রার শুরম্ন থেকেই তিনি সেক্যুলার, ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁর কবিতায় ধর্মীয় চেতনার কোনো প্রকাশ লক্ষ করা যায় না, এমনকি ‘পাপ’ শব্দটির বদলে ‘দোষ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথাগত ধর্মের প্রতি তাঁর কোনো আস্থা নেই, তবে কিঞ্চিৎ পক্ষপাত আছে গৌতম বুদ্ধের প্রতি –

ধর্ম আমি বুঝিনি কখনো

ধর্ম ভালো – ধর্ম তো বুঝি না

ধর্মদ্রোহী নই – আমি ধর্মনিরপেক্ষ

কোনোদিন পালন করিনি

যদি করতেই হয় তবে

সামান্য যে পক্ষপাত আছে যার প্রতি

তিনি যে গৌতম বুদ্ধ;

আমার বিশ্বাস নেই ধর্মে

ধর্ম ভালো – সব ভালো আমার দরকার নেই।

চিনি, নুন, চিকনাই ভালো

আমার জন্যে তা বিষ,

পরিত্যাজ্য ঐ তিন বস্ত্তর মতন

নিপাট বাঙালি কবি

আমি একবিংশ শতাব্দীর \

(‘মরে যাবো, ঝরে যাবো’)

 

রফিক আজাদের কাব্যবিশ্বাস এই ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিচেতনার ওপর ভিত্তি করেই বিকশিত হয়েছে। কোনো ভান বা ভ-ামি নয়, কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাসের কাছেও তিনি দায়বদ্ধ নন; আত্মগত সততা এবং দৃঢ়তায় সমসত্ম উচ্চতা অতিক্রম করে তাঁর কবিব্যক্তিত্ব ঊর্ধ্বে উঠে যায়, যে-উচ্চতার দিকে তাকালে সবার মাথা নিচু হয়ে যায়। প্রতিদিনের জীবনযাপনে যতোই সরল, সাধারণ মনে হোক না কেন, রফিক আজাদ কবি ‘একবিংশ শতাব্দীর’। তিনি অনেক বেশি ত্যাগ করে, বর্জন করে অর্জন করেছেন আকর্ষণীয় এক কবিসত্তা।