রবিজিজ্ঞাসা খেলো কেন অমন খেলা তুমি সবার সনে

রণজিৎ বিশ্বাস

যখন শুনি ‘কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে,/ তখন তুমি ছিলে না মোর সনে\’ অথবা, ‘মনে রবে কি না রবে আমারে  সে আমার মনে নাই। ক্ষণে ক্ষণে আমি আসি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই।’ কিংবা, ‘তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ/ ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া।/ বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক ওগো দুখজাগনিয়া\’, তখন বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না যে এগুলো প্রেমের গান।

যাকে ভালোবাসি, রবীন্দ্রপক্ষপুটে আশ্রয় নিয়ে তার উদ্দেশে বলছি – মনে যখন গান ছিল, তখন তুমি যদি পাশে থাকতে বড় ভালো হতো। অথবা, আমি বলতে চাচ্ছি, হে তুমি, যাকে আমি ভালোবাসি, তুমি শোন। আমাকে তুমি মনে রাখবে কি রাখবে না, তা নিয়ে আমার ভাবনা নেই, আমি তোমার দুয়ারে আসবো এবং বিনিকারণে গান গেয়ে যাবো। কিংবা, যাকে আমি ভালোবাসায় বেঁধেছি, যাকে অধিকার দিয়েছি আমাকে ভালোবাসায় বাঁচানোর জন্য তাকে তো আমি ‘ঘুম ভাঙানিয়া’ কিংবা ‘দুখজাগানিয়া’ বলতেই পারি। ভালোবাসার মানুষই তো আমাকে ঘুম থেকে জাগাবে। ভালোবাসার সঙ্গে দুঃখের সম্পর্কের নিবিড়তার জন্যই তো ভালো যে বাসে, দুঃখে পোড়াবার কিংবা রোদনে ডোবাবার অধিকার সে ভোগ করে। এগুলো ভালোবাসার সহজ সমীকরণ।

কিংবা, একাকী বসে যখন আমার গাইতে ইচ্ছে করে ‘কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে।/ সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে’ অথবা ‘অনেক কথা বলেছিলাম কবে তোমার কানে কানে/ কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে \’ গাইতে গাইতে তখন অবাক হই, আর ভাবি – ‘মানবিক প্রেমের এমন’ প্রকাশ, এর চেয়ে সুন্দর আর কেমন করে হবে! বয়স যে প্রেমের বিষয়ে বড় তুচ্ছ এক সংখ্যা, তখন ভালো করে বুঝি, যখন হৃদমন্দিরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কেউ শুনিয়ে যায় ‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান -, তুমি জান নাই, তুমি জান নাই,/ তুমি জান নাই তার মূল্যের পরিমাণ\’ অথবা ‘ভালোবেসে/ সখী, নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো – তোমার  মনের মন্দিরে। আমার পরাণে যে গান বাজিছে/ তাহারি/ তালটি শিখো – তোমার/ চরণমঞ্জীরে \’

সিন্ধু থেকে বিন্দু কিছু চয়ন করে যে কটা গানের কথা বলা হলো, সেগুলো কোনো দ্বন্দ্বে তো ফেলেই না, ফেলে না গীতবিতানের প্রেমপর্বের ৩৯৫টি গানের কোনোটিই। [গীতবিতান, ঝিনুক পুস্তিকা, বৈশাখ ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ, মে ১৯৭৬]

কিন্তু, এই দ্বন্দ্বে ফেলে দেয় পর্ববিভাজনে গীতবিতানের সবচেয়ে বড় খন্ড পূজা পর্বের ৬১৭টি গানের অনেকগুলোই। যে-গানগুলো খুব বেশি দেয় আনন্দের জ্বালা, খুব বেশি তৈরি করে ভ্রান্তিবিভ্রান্তির ঘোর, সেগুলোরও সবগুলো নয়, কয়েকটিমাত্র স্মরণের বড় তাগিদ মিলছে। সারবেঁধে দাঁড়িয়ে বলছে – যতই ভাববে, ততই অবাক মানবে। অক্ষরে আমাদের বাঁধার সময় কী খেলা খেলেছেন রবি, একবার দেখে নিতে পার।

একটি খেলা এই, তাঁর ঈশ্বর সবার ঈশ্বরের মতো নয়। তাঁর ঈশবর তাঁরটির মতোই। অন্য কারোটির সঙ্গে তা মেলে না। এই ঈশ্বরের সঙ্গে বিবাদ চলে, মান-অভিমান চলে, এই ঈশ্বরের কাছে নালিশ করা যায়, অভিযোগ করা যায়, ওজর-আপত্তি তোলা যায়, তাঁকে যেন ধরা যায়, ছোঁয়া যায় এবং তাঁর সঙ্গে মানবিক সম্পর্কের মতোই এক ধরনের সম্পর্ক পাতানো যায়। সবচেয়ে বড় কথা বোধহয় এই হওয়াই ভালো হবে যে, এই ঈশ্বরকে ভালোবাসাও যায়। মানুষ মানুষকে যেভাবে ভালোবাসে, লিঙ্গান্তরের মানবমানবী যেমন অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে দোহার সঙ্গ দোহে যাচে এবং একে অন্যের কাছে আসে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঈশ্বরও যেন তেমন ভালোবাসার এক মানুষ। তাকে প্রেমে বাঁধা যায়, ভালোবাসায় ভোলানো যায়।

দ্বন্দ্বে-ডোবা আনন্দকষ্ট, ‘ব্যক্তিগত’ প্রকৃতির ‘ভাবনবীক্ষণে’র মতো শোনালেও, প্রথমবার বড় তীব্রতায় এক ধাক্কা মিললো – ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি’তে। বড় অসহায় অবস্থায় নিজেকে প্রশ্ন করতে হয় – যাকে আমি বড় ভালোবাসায়, বড় শুচিতায়, বড় পবিত্রতায় আমার বুকের গভীর কোণে একটা ছোট ডিবের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম, যে আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায় আমার কাছে ছিল; তার কাছে যে আমি যাইনি। যে গোপনে আমার প্রাণের গভীরে থেকে আমার দুঃখ-সুখের সকল গানে সুর দিয়েছিল, আমি তার গান যে গাইনি; আমি শুধু বাহিরপানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়পানে চাইনি – এই কথাগুলো আমি যাকে ভালোবাসি, ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলবার অপেক্ষায় আমার বুকের গহিন কোণে পেতে রাখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আসনে, হৃদিপদ্মাসনে যাকে বসিয়ে রেখেছি, যার সঙ্গে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে আমি ‘বিনিকথার কথা’ বলি – তার উদ্দেশে এমন নিবেদন তো আমি করতেই পারি। আমাকে ঈশ্বরের উদ্দেশে না বললে হবে না কেন এসব কথা! ‘বিপদে পড়া পাঠক’ এমন প্রশ্ন করতেই পারে! করতে করতে সেই পাঠক ক্রুদ্ধও হয়ে যেতে পারে, বলতেই পারে, আমাদের ভাষণ ও স্বপন নিয়ে অত কেন রগড়াও কবি!

এক-এক করে বললে বলতে হবে, ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’-এর কথাটিও। যাকে ভালোবাসি, তার কাছে আমি প্রতিদানের আশা করবো কেন। (তার বদলে আমি চাইনে কোনো দান\) যে আমাকে প্রাণের গানে ও প্রেমের টানে ভালোবাসার পাথারে ডোবায়, আমার প্রাণ বাঁচানো নিয়ে মধুরমোহন সংকট তৈরি করে, তার অন্তরভুক ও সর্বনাশা গান শুনতে শুনতে মুগ্ধবিস্ময়ে তার মুখের পানে তাকিয়ে আমিই তো বলবো –

তুমি  কেমন করে গান করো হে গুণী,

আমি  অবাক্ হয়ে শুনি কেবল শুনি \…

কইতে কী চাই, কইতে কথা বাধে –

হার মেনে যে পরাণ আমার কাঁদে,

আমায় তুমি ফেলেছ কোন্ ফাঁদে

চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি \

যার নয়নের গভীরতায় আমি দেখি বিশ্বভুবন, যার নয়নের ছলছলানোয় আমি দেখি জীবনমরণ, গভীর রাতে নিজের নয়ন মুদবার আগে যার উদ্দেশে প্রশ্ন পাঠাই – আজকে তুমি কেমন আছো, আমি তো তাকেই বলবো –

তোমার নয়ন আমায় বারে বারে  বলেছে গান গাহিবারে।

ফুলে ফুলে তারায় তারায়

বলেছে সে কোন্ ইশারায়

দিবস-রাতির মাঝ-কিনারায় ধূসর আলোর অন্ধকারে।

রক্তের মাংসের মানবিক অনুভব ও অনুভূতির সেই মানবীকে বাদ দিয়ে আমাকে ঈশ্বরসন্ধানে স্বেদসিক্ত হতে হবে কেন! এত যুদ্ধ করার কী দায় আমার পড়েছে!

আমার যখন গাইতে ইচ্ছে করে ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে – আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।’ অথবা, ‘তুমি  ডাক দিয়েছ, কোন্ সকালে কেউ তা জানে না, আমার মন যে কাঁদে আপন-মনে কেউ তা মানে না।’ অথবা, ‘আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, সেথায় চরণ পড়ে,/ তোমার সেথায় চরণ পড়ে। তাই তো আমার সকল পরাণ কাঁপছে ব্যথার ভারে গো,/ কাঁপছে থরোথরে\’ কিংবা ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে/ জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে \’ তখন আমি যদি বলি – আমি আমার চারপাশে কোনো ঈশ্বর খুঁজে পাই না, আমি শুধু মানুষ খুঁজে পাই, প্রিয়প্রিয় সব মরণশীল মানুষ, বিশেষবিশেষ সম্পর্কে বাঁধা হৃদিকাড়া সব লিঙ্গান্তরের মানুষ, কে আমাকে দুষবে! মাথা পেতে অভিযোগ মানবার কিংবা কান পেতে কথা সইবার মতো অপরাধ কী আমার!

হৃৎকন্দরে মানবিক প্রেমের বোধ সমস্যা তৈরি করে তখনো, যখন শুনতে হয় ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।/ অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহিরে/ ধরায় যখন দাও না ধরা, হৃদয় তখন তোমায় ভরা,  এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে।’

এ অনেকটা সে-রকম, যেমন ‘হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে’। এমন বোধের সন্ধান মিলবে আরো একটি গানে। ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।/ হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।’

অথচ, দৃষ্টান্তের যে-কটা গীতবিতানের পূজাপর্ব ঢুঁড়ে বের করার চেষ্টা হলো – এর সবই সীমাবদ্ধ ও খর্ব আমাদের অনেকের মনে প্রেমের বোধ নিয়ে ভ্রান্তি জাগায়। কখনো-কখনো মনের যে-ধারণপাত্র, দেহের যে-খাঁচা – তার বিষয়েও উৎসাহের সলতে পাকিয়ে তুলতে চায়। ছেঁকেছেনে দেখতে চাইলে আরো পাওয়া যাবে। অনেক পাওয়া যাবে।

পাওয়া যে যাবে, তাই তো স্বাভাবিক। স্বদেশের জন্য প্রেমের বোধ; মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার বোধ – আত্মিক ও প্রাকৃতিক, হৃৎকেন্দ্রিক ও রিপুভিত্তিক, তণুকেন্দ্রিক ও অধিদৈহিক এবং জাগতিক ও পারমার্থিক। প্রকৃতির জন্য প্রীতি ও মুগ্ধতার বোধ এবং ঈশ্বর নামের বিশ্বাসের কিংবা ধারণার প্রতি নিবেদন সমর্পণ ও পূজনের বোধ – এগুলো পৃথকভাবে সম্পর্কশূন্যতা ও সংযোগহীনতার মধ্যে বায়ু ও জলপ্রবাহনিরোধী কোনো প্রকোষ্ঠে বেঁধে রাখার বিষয় নয়।

তাই, এ নিয়ে কথার পর কথা বলে আর কী হবে, সসীম মানুষ আর অসীম ঈশ্বরের মধ্যে ধাঁধা তৈরি হয় যখন কানের স্পর্শকাতর পর্দা খপ করে ধরার জন্য তৈরি হয়ে যায় ‘যদি  প্রেম দিলে না প্রাণে/ কেন  ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে ।/ কেন  তারার মালা গাঁথা,/ কেন  ফুলের শয়ন পাতা,/ কেন  দখিন-হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে।’; ‘আমার  প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,  তাই হেরি তায় সকলখানে।/ আছে সে নয়নতারায় আলোক-ধারায় তাই না হারায় -/ ওগো,  তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়/ তাকাই আমি যেদিক-পানে\’; ‘আমার  ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়  পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন!/ তারি গলার মালা হতে  পাঁপড়ি হোথা লুটায় ছিন্ন।/ এল যখন সাড়াটি নাই, গেল চলে জানালো তাই -/ এমন ক’রে আমারে হায়  কে বা কাঁদায় সে জন ভিন্ন \’ ইত্যাদি, এবং ইত্যাদি।

এসবের বাইরে একটি গানের টান বড় প্রবল মানতে হচ্ছে। গানটি প্রেমপর্বেরও নয়, পূজাপর্বেরও নয়, প্রকৃতিপর্বের। কিন্তু চরণ তো চরণ, মনে হতে চায় যে ফাঁকা জায়গায়ও তার উচ্চারণ যে দিয়ে যায় প্রেমের মরণ সেই তো বলতে পারে ‘আমার  মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি/ তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি।’

যাকে বলি – তোর কাছে রাখলাম জীবন বন্ধক, তাকে তো আমিই বলবো – আমার পরম যত্নের মল্লিকাবনের প্রথম কলি দিয়েই তোর জন্য অঞ্জলি বাঁধবো। এদের উদ্দেশেই তো মানুষ বলে – তুই হবি জননী তুই হবি ঘরণী প্রেমিকা আমার। নয়তো, বলে আর কার উদ্দেশে! এদের উদ্দেশেই তো আমরা বলি – আমার যেমন অশ্রু ঝরে তোমার কেন ঝরে না! আমার যেমন পরাণ কাঁপে, তোমার কেন কাঁপে না! আমার যেমন চিত্ত দোলে তোমার কেন দোলে না! আমায় যেমন মরণ টানে তোমায় কেন টানে না!

ভ্রমণের এই বিন্দুতে মন বলে দেয় – তিনি ঈশ্বরের প্রেমের ভাবন ও প্রেমের ভাবনে ঈশ্বরপূজন নিয়ে বড় ‘বিপদ’ তৈরি করেছেন আমাদের জন্য। হোক সে-বিপদ আনন্দের, প্রশ্ন তো তাকে করাই যায় – খেলো কেন অমন খেলা তুমি সবার  সনে!