রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প : একটি পর্যালোচনা

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বাঙালিকে তাঁর গান গাইতে হবে। তাঁর অন্য কোনো শিল্পসৃষ্টি সম্পর্কে এমন ভবিষ্যদ্বাণী তিনি করেননি। করলে কি সেটা তাঁর ছোটগল্প সম্পর্কে হতো? নাকি এই শিল্পমাধ্যমটি সম্পর্কে ততটা আত্মবিশ্বাসী তিনি ছিলেন না? কিন্তু তিনি না বললেও, তাঁর মৃত্যুর সার্ধশতাধিক বছর পর আজ আমরা বোধহয় প্রবল নিশ্চয়তার সঙ্গেই বলতে পারি, সাহিত্যের এই শাখাটিতে তাঁর যে-সাফল্য, তার সঙ্গে তুলনীয় মানের দক্ষতার পরিচয় তাঁর আগে বা পরে বাংলা সাহিত্যে আর কেউ দিতে পারেননি। এক্ষেত্রে তিনিই পথিকৃৎ আবার তিনিই পুরোধা। বাংলা ছোটগল্পের সূত্রপাত তাঁর হাতে, আবার তিনিই একে তার পরিণতিতে পৌঁছে দিয়েছেন।

হতে চেয়েছিলেন তিনি কবিই। মাঝপথে ‘মনের সুখে’ গল্প লিখতে শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে ১৮৯৪ সালের ২৭ জুন শিলাইদহ থেকে ইন্দিরা দেবীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আজকাল মনে হচ্ছে যদি আমি আর কিছু না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তাহলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে হয়তো পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্তঅবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে, এবং রৌদ্রের সময় পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াবে।১ রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রচনার প্রাথমিক প্রেরণা বা উদ্দেশ্যের কিছুটা আভাস হয়তো এ-কথাগুলোর মধ্যেই পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গটিও বহু-আলোচিত যে, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রচনা ও তার শিল্পসার্থকতার পেছনে আমাদের আজকের এই বাংলাদেশ নামে পরিচিত ভূখ-টির – এর পলিস্ন-প্রকৃতি ও জনজীবনের একটা বড় ভূমিকা আছে। সেদিন যদি জমিদারি দেখার সূত্রে তাঁর পূর্ব বাংলায় আগমন না ঘটত, আর নদীপথে এ-দেশের এক বিসত্মীর্ণ অঞ্চল পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন না করতেন, তাঁর অনেকগুলো সেরা গল্পই হয়তো লেখা হতো না। কবির নানা সময়ের বক্তব্য থেকেই এ-কথার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। যেমন ১৯০৯ সালের ২ মে শান্তিনিকেতনে এক আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমে কেবল কবিতাই লিখতুম, গল্পে টল্পে বড় হাত দিই নাই। মাঝে একদিন বাবা ডেকে বললেন, – ‘তোমাকে জমিদারীর বিষয়কর্ম দেখতে হবে।’ আমি তো অবাক; আমি কবি মানুষ, পদ্যটদ্য লিখি, আমি এ সবের কি বুঝি? কিন্তু বাবা বললেন – ‘তা হবে না; তোমাকে এ কাজ করতে হবে।’ কী করি? বাবার হুকুম, কাজেই বেরতে হ’ল। এই জমিদারী দেখা উপলক্ষে নানা রকমের লোকের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয় এবং এই থেকেই আমার গল্প লেখারও শুরু হয়।’১ তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি গল্প যে পদ্মাতীরের পটভূমিতে লেখা, সে-কথার উলেস্নখ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মানবসত্য’ (১৩৩৯) প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সাজাদপুরে যখন আসতুম চোখে পড়ত গ্রাম্যজীবনের চিত্র, পলস্নীর বিচিত্র কর্মোদ্যোগ। তারই প্রকাশ ‘পোস্টমাস্টার’, ‘সমাপ্তি’, ‘ছুটি’ প্রভৃতি গল্পে। তাতে লোকালয়ের খ- খ- চলতি দৃশ্যগুলি কল্পনার দ্বারা ভরাট করা হয়েছে।২ তাঁর এই পর্বের গল্পগুলো সম্পর্কে কয়েকজন হিন্দিভাষী লেখক ও স্বদেশকর্মীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি যা বলেছিলেন তাও এ-প্রসঙ্গে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। আমরা এখানে একটু বিশদভাবেই তা উদ্ধৃত করছি :

The river system of Bengal, the best part of this province, fascinated me and I used to be quite familiar with those rivers. I got glimpses into the life of the people which appealed to me very much indeed. At first I was quite unfamiliar with the village life as I was born and brought up in Calcutta and so there was an element of mystery for me. My whole heart went out to the simple village people as I came in close contact with them. They seemed to belong to quite another world so very different from that of Calcutta. My earlier stories have this background and they describe this contact of mine with the village people. They have the freshness of youth. Before I had written these short stories there was not anything of that type in Bengali literature. No doubt Bankimchandra had written some stories but they were of a romantic type; mine were full of temperament of the village people. There was the rural atmosphere about them. …My later stories haven’t got that freshness, that tenderness of earlier stories. ৩

 

দুই

রবীন্দ্রনাথের গল্প বলতে আমরা সাধারণভাবে তাঁর গল্পগুচ্ছের গল্পগুলোর কথাই বুঝি। এ-কথা ঠিক যে, তাঁর সেরা ও বিখ্যাত গল্পগুলোর বেশিরভাগই গল্পগুচ্ছে সংকলিত হয়েছে। বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর বিভিন্ন খ–ও এই গল্পগুলো গল্পগুচ্ছের অন্তর্ভুক্ত হয়ে স্থান পেয়েছে। আর সেভাবেই কিংবা বর্তমানে অখ- গল্পগুচ্ছের মাধ্যমে এগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটলেও, এই গল্পগুলোর অনেকই বিভিন্ন সাময়িকপত্রে ছাপা হওয়ার পর, প্রথমে তাঁর ছোটগল্প (১৩০০ বঙ্গাব্দ), বিচিত্র গল্প (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ, ১৩০১ বঙ্গাব্দ), কথা-চতুষ্টয় (১৩০১ বঙ্গাব্দ), গল্প-দশক (১৩০২ বঙ্গাব্দ), গল্প (১৩০৭ বঙ্গাব্দ), কর্মফল (১৩১০ বঙ্গাব্দ), আটটি গল্প (১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ), গল্প চারটি (১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ), গল্পসপ্তক (১৩২৩ বঙ্গাব্দ), পয়লা নম্বর (১৩২৭ বঙ্গাব্দ), তিনসঙ্গী (১৩৪৭ বঙ্গাব্দ) ইত্যাদি পুস্তকে প্রকাশিত হয়। আবার গল্পগুচ্ছের বাইরেও রয়েছে তাঁর বেশ কিছু গল্প। এগুলো রয়েছে তাঁর লিপিকা (১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ), সে (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) ও গল্পসল্প (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) পুস্তকে।

গল্পগুচ্ছের প্রথম গল্পটির নাম ‘ঘাটের কথা’। এটি প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকার কার্তিক ১২৯১ সংখ্যায়। তার আগে একই পত্রিকার ১২৮৪ বঙ্গাব্দের (১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ) শ্রাবণ-ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘ভিখারিণী’ গল্পটি। এখন পর্যন্ত যতদূর জানা যায়, এটিই তাঁর লেখা প্রথম গল্প, যা কোনো সাময়িকপত্রে প্রকাশিত  হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন মাত্র ষোলো। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর কোনো গ্রন্থে অবশ্য এ-গল্পটিকে স্থান দেননি। বিশ্বভারতী প্রকাশিত গল্পগুচ্ছের চতুর্থ খ– (১৩৬৯ বঙ্গাব্দ/ ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ) এবং রবীন্দ্র রচনাবলীর চতুর্দশ খ– (১৩৯৮ বঙ্গাব্দ) এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। রচনাবলির একই খ– অন্তর্ভুক্ত আরো চারটি গল্প ‘খাতা’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘উলুখড়ের বিপদ’ ও ‘প্রতিবেশিনী’ কবে লিখিত, বা কোনো সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল কিনা, জানা যায় না। ভারতীর যে সংখ্যায় ‘ভিখারিণী’ গল্পটি ছাপা হয় তার পরের সংখ্যা (আশ্বিন ১২৮৪) থেকে ওই একই পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ গল্পটি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতির খসড়ায়১ এ-রচনাটিকে ‘গল্প’ বলেই অভিহিত করেছেন এবং পরবর্তীকালে গল্পগুচ্ছের চতুর্থ খ– (১৩৬৯ বঙ্গাব্দ) এটি স্থান পেয়েছে। তবে অনেকেরই মতে, এটি আসলে একটি (অসমাপ্ত) উপন্যাস – রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম উপন্যাস। দশটি কিসিত্মতে প্রায় বছরকাল ধরে (মাঝে দুটি সংখ্যা বাদ দিয়ে) ২৭ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত রচনাটি ভারতীর পাতায় ছাপা হয়। পরে সজনীকান্ত দাস তাঁর সম্পাদনায় শনিবারের চিঠির রবীন্দ্র শতবর্ষ সংখ্যায় (১৯৬১) এটি পুনর্মুদ্রণ করেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের খুব বিখ্যাত একটি গল্প ‘নষ্টনীড়’ গল্পগুচ্ছের (দ্বিতীয় খ-) অন্তর্ভুক্ত হলেও রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় প্রকাশিত রবীন্দ্র গ্রন্থাবলীতে (১৩১১) এটিকে উপন্যাস হিসেবে স্থান দেওয়া হয়। এ থেকে বোঝা যায়, ‘নষ্টনীড়’ গল্প নাকি উপন্যাস, এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনেই অল্পাধিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। আমরা ‘করুণা’কে গল্পসমগ্রের বাইরে রাখলেও ‘নষ্টনীড়’কে অন্তর্ভুক্ত করেছি।

ভারতীতে প্রকাশিত ‘ঘাটের কথা’ ও ‘করুণা’ এই রচনাদুটির কথা বাদ দিলে, রবীন্দ্রনাথ নিয়মিতভাবে গল্প লিখতে শুরু করেন ১৮৯১ সালে। বাংলা সনের হিসাবে ১২৯৮-এ। তাঁর এই প্রথম পর্যায়ের গল্পগুলোর বেশিরভাগই প্রকাশিত হয় সাধনা পত্রিকায়। সাধনায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্পটির নাম ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, যা পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১২৯৮ (১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় ছাপা হয়। আর এই পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের শেষ গল্প ‘অতিথি’। এটি প্রকাশিত হয় সাধনার ভাদ্র-কার্তিক ১৩০২ (১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায়। সে পর্যন্ত প্রায় চার বছরে পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের মোট ছত্রিশটি গল্প প্রকাশিত হয়। দেখা যায় ১৩০০-১৩০১ সনের কয়েক মাস বাদ দিয়ে প্রতি সংখ্যায়ই তিনি গল্প লিখেছেন।

সাধনারও আগে সাপ্তাহিক হিতবাদী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখেছিলেন। পদ্মিনীমোহন নিয়োগীকে লেখা এক পত্রে (২৮ ভাদ্র ১৩১৭) রবীন্দ্রনাথ জানান, সাধনারও আগে হিতবাদীতে তাঁর ছোটগল্প লেখার ‘সূত্রপাত’। তাঁর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি ১২৯৮ সনে এই হিতবাদীতেই প্রকাশিত হয়েছিল। একই বছরে আগে-পরে রবীন্দ্রনাথের আরো অন্তত পাঁচটি গল্প হিতবাদীতে প্রকাশিত হয়। এগুলো হলো – ‘দেনাপাওনা’, ‘গিন্নি’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ব্যবধান’ ও ‘তারাপ্রসন্নের কীর্তি’। ‘অন্তত’ বলার কারণ, কারো কারো অনুমান অনুযায়ী, ‘খাতা’ গল্পটিও হিতবাদীতে ছাপা হয়ে থাকতে পারে। হিতবাদীতে পরবর্তী সময়ে তাঁর আর গল্প না লেখার কারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ রাণী চন্দকে যা বলেছিলেন তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। আমরা এখানে সে-কথাগুলো উদ্ধৃত করছি :

‘গল্পগুচ্ছ’-য় বাংলায় ছোটোগল্পের আমিই আরম্ভ করেছিলুম।

তখন ‘হিতবাদী’তে পাঁচ হপ্তায় পাঁচখানা ছোটোগল্প লিখেছিলুম। কিন্তু আমাদের এডিটর কৃষ্ণকমল – তিনি বললেন, ‘দেখো রবি, তুমি যা লিখছ এ কি সবাই বুঝতে পারে। আমরা যাদের নিয়ে কারবার করছি, এরা কি কিছু বুঝবে। এ যে high class literature।’ হয়তো তখন বঙ্কিমের যুগ বলেই এই গল্প চলল না – তখনকার মাপকাঠিতে যথেষ্ট Romance ছিল না। সে যা-ই হোক, উনি এইটে বলাতে, আমি তখনকার মতো ছোটোগল্প লেখা বন্ধ করে দিলুম।

একই প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাসকেও রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, গল্পগুলি ‘সাধারণের পক্ষে গুরুপাক’ হচ্ছে এবং ‘আরও লঘু রকমের রচনা আবশ্যক’ কৃষ্ণকমলের এমন কথায় ‘বিরক্ত হয়ে’ই তিনি হিতবাদীতে লেখা ছেড়ে দেন।

পূর্বোলিস্নখিত ‘ভিখারিণী’ ও ‘ঘাটের কথা’ বাদ দিলে, দ্বিতীয় পর্বে ভারতীর বৈশাখ ১৩০৫ (১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে পৌষ ১৩১৮ (১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের মোট তেরোটি গল্প প্রকাশিত হয়। গল্পগুলোর মধ্যে ছিল ‘দুরাশা’, ‘ডিটেকটিভ’, ‘অধ্যাপক’, ‘মণিহারা’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘ফেল’, ‘নষ্টনীড়’, ‘রাসমণির ছেলে’
প্রভৃতি। বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১৩০৯ সনের (১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ) ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয় যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথের ‘দর্পহরণ’ ও ‘মাল্যদান’ গল্প দুটি। প্রবাসীতে ছাপা হয় ‘মাস্টার মশায়’, ‘নামঞ্জুর গল্প’, ‘বলাই’ ও ‘বদনাম’সহ মোট ছটি গল্প। এগুলো প্রকাশিত হয় পত্রিকার আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩১৪ (১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে  আষাঢ় ১৩৪৮ (১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত বিভিন্ন সংখ্যায়।

প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় সবুজপত্র প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকায় গল্প লিখতে শুরু করেন। ‘হৈমমত্মী’, ‘বোষ্টমী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘শেষের রাত্রি’, ‘পয়লা নম্বর’সহ তাঁর অনেক বিখ্যাত গল্পই সবুজপত্রে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটিতেই (বৈশাখ ১৩২১ বঙ্গাব্দ/ ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ) ছাপা হয় তাঁর ‘হালদার গোষ্ঠী’ গল্পটি। এরপর পৌষ ১৩২৪ বঙ্গাব্দ/ ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর মোট দশটি গল্প সবুজপত্রে প্রকাশিত হয়। সবুজপত্রেই রবীন্দ্রনাথ চলিত বা কথ্যভাষায় গল্প লিখতে শুরু করেন।

ওপরে উলিস্নখিত পত্রিকাগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সময় নবজীবন, বালক, সখা ও সাথী, প্রদীপ, ছোটগল্প, শনিবারের চিঠি, আনন্দবাজার পত্রিকা, বিশ্বভারতী পত্রিকা এবং ঋতুপত্রেও রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। এ-গল্পগুলো সম্পর্কেও এখানে কিছু তথ্য দেওয়া যেতে পারে। নবজীবনের অগ্রহায়ণ ১২৯১ (১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় প্রকাশিত ‘রাজপথের কথা’ গল্পটিকে রবীন্দ্রনাথ ‘রাজপথ’ শিরোনামে তাঁর বিচিত্র প্রবন্ধ (১৩১৪ বঙ্গাব্দ) পুস্তকেও স্থান দিয়েছেন। বালকের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১২৯২ (১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় প্রকাশিত ‘মুকুট’কে একটি ক্ষুদ্র উপন্যাসও বলা যেতে পারে। এটি গল্পগুচ্ছ বা রবীন্দ্রনাথের অন্য কোনো গল্পসংকলনে স্থান পায়নি। ছুটির পড়া (১৯০৯) পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার আগে মুকুট নামেই রবীন্দ্রনাথ এর একটি নাট্যরূপ (১৯০৮) দেন। সখা ও সাথী  পত্রিকায় (আশ্বিন ১৩০২ বঙ্গাব্দ/ ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথকে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের ‘অত্যন্ত পীড়াপীড়ি’তে লিখে দিতে হয়েছিল বলে ঔপন্যাসিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে লেখা এক পত্রে (৬ চৈত্র ১৩০২) তিনি জানিয়েছিলেন। আর ‘প্রগতিসংহার’, ‘শেষ পুরস্কার’ ও ‘মুসলমানীর গল্প’ – এই তিনটি গল্প প্রকাশিত হয় যথাক্রমে আনন্দবাজার পত্রিকার বিশেষ শারদীয় সংখ্যা ১৯৪৮ এবং বিশ্বভারতী পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৪৯ (১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ) ও ঋতুপত্র পত্রিকার আষাঢ় ১৩৬২ (১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায়। এর মধ্যে শেষ দুটি গল্প রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে লিখলেও ছাপা হয় বলা বাহুল্য তাঁর মৃত্যুর পর। এ পর্যন্ত যে-গল্পগুলোর কথা উলেস্নখ করা হলো, তার সবই গল্পগুচ্ছের কোনো না কোনো খ– (প্রথম-চতুর্থ) সংকলিত হয়েছে। গল্পগুচ্ছেরই অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গল্প ‘কর্মফল’ ১৩১০ সনে (১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ) সরাসরি পুসিত্মকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এ-গল্পটিকে পরে ১৯২৬ সালে শোধবোধ নামে নাটকে রূপান্তরিত করা হয়।

পরে গল্পগুচ্ছের চতুর্থ খ–র (১৩৬৯ বঙ্গাব্দ/ ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এমন তিনটি গল্প ‘রবিবার’, ‘ল্যাবরেটরি’ ও ‘শেষ কথা’ ইতোপূর্বে একত্রে সংকলিত হয়ে তিন সঙ্গী নামে ১৩৪৭  সনে (১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এ-গল্পগুলোর মধ্যে ‘রবিবার’ ও ‘ল্যাবরেটরি’ আনন্দবাজার পত্রিকার যথাক্রমে ১৩৪৬ (১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) ও ১৩৪৭ সনের (১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ) শারদীয় সংখ্যায় এবং ‘শেষ কথা’ শনিবারের চিঠির ফাল্গুন ১৩৪৬ (১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘শেষ কথা’ গল্পটির একটি ভিন্নতর পাঠ অবশ্য ‘ছোটগল্প’ শিরোনামে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩৪৬ (১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় মুদ্রিত হয়। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনে লেখা এ-তিনটি গল্পকে সমালোচকরা তাঁর একেবারে ভিন্ন কোটির এবং খুবই আধুনিক ধরনের গল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের নিজেরও তাঁর এই শেষ পর্বের গল্পগুলো নিয়ে বিশেষ আগ্রহের কথা জানা যায় পুত্রবধূ প্রতীমা দেবীর নিম্নোক্ত স্মৃতিচারণ থেকে :

অসুস্থতার মধ্যে পুজোর আনন্দবাজার বেরল, তাতে ল্যাবরেটরি গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল, অসুখের মধ্যে সেদিন তিনি [রবীন্দ্রনাথ] ভালো ছিলেন তাই কাগজখানি আসবামাত্র আমার স্বামী [রথীন্দ্রনাথ] তা নিয়ে গিয়ে তাঁকে দেখিয়েছিলেন। কী আগ্রহ তাঁর গল্পটি দেখে, ডাক্তারদের বারণ সত্ত্বেও তিনি কাগজখানি হাতে নিয়ে আগাগোড়া চোখ বুলিয়ে গেলেন। সোহিনীকে নিয়ে যখন কেউ-কেউ আলোচনা করতেন, তাঁদের প্রায়ই বলতেন, সে একেবারে এখনকার যুগের সাদায়-কালোয় মিশনো খাঁটি রিয়ালিজম, অথচ তলায় তলায় অমত্মঃসলিলার মতো আইডিয়ালিজমই হল সোহিনীর প্রকৃত স্বরূপ।’ বন্ধুবান্ধব এসে গল্পটির প্রশংসা করলে অসুখের মধ্যেও তাঁর মুখ কত উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

 

তিন

রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্প রচনার পেছনেই এক বা একাধিক গল্প বা কাহিনি আছে। আর সেগুলোও কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। যদিও গল্প বা কাহিনি না বলে এগুলোকে বরং ঘটনা বা অভিজ্ঞতা বলাই ভালো। এসব অভিজ্ঞতা তাঁর গল্প রচনার সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। বিভিন্ন সময়ে নানাজনের সঙ্গে চিঠিতে ও আলাপচারিতায় তিনি নিজেই এমন কিছু ঘটনার উলেস্নখ করেছেন। নমুনা হিসেবে আমরা এখানে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন দুটি মাত্র অভিজ্ঞতার বয়ান উদ্ধৃত করছি। যেমন ‘কঙ্কাল’ প্রসঙ্গে :

ছেলেবেলা আমরা যে ঘরে শুতুম, তাতে একটা মেয়ের skeleton ঝুলোনো ছিল। আমাদের কিন্তু কিছু ভয়ডর করত না। তারপর অনেক দিন কেটে গিয়েছে, আমার বিয়েটিয়ে হয়ে গিয়েছে, আমি তখন ভিতর-বাড়িতে শুই। একদিন কয়েকজন আত্মীয়া এসেছেন, তাঁরা আমার ঘরে শোবেন, আমার উপর হুকুম হয়েছে বাইরে শোবার। অনেকদিন পরে আমি আবার সেই ঘরে এসে শুয়েছি। শুয়ে চেয়ে দেখলুম, সেজের আলোটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিবে গেল। আমার মাথায় বোধহয় তখন রক্ত বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল, আমার মনে হতে লাগল কে যেন মশারির চার দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বলছে, ‘আমার কঙ্কালটা কোথায় গেল? আমার কঙ্কালটা কোথায় গেল?’ ক্রমে মনে হতে লাগল সে দেয়াল হাৎড়ে হাৎড়ে বন্ বন্ করে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। এই আমার মাথায় গল্প এসে গেল আর কি।

কিংবা ‘নামঞ্জুর গল্প’ প্রসঙ্গে :

গল্পগুচ্ছের ‘নামঞ্জুর’ গল্পের যে জায়গায় পদসেবা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ার গল্প আছে – তা আমার নিজের জীবনেই ঘটেছিল। তখন আমি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগছি, সারা গায়ে ব্যথা, ওষুধপত্র আনা-আনি, ছুটোছুটি খুব চলেছে। তেতালার ঘরে রয়েছি। বৌমা একদিন বেরিয়েছেন রানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। বৌমার সংসারের কাজের জন্য তিনি একটি সঙ্গিনী গ্রাম থেকে আনিয়েছিলেন। বৌমার কাজে সাহায্য করতো। একটু দূরে দূরেই থাকে সে। সেদিন শুয়ে আছি, গায়ে খুব ব্যথা এপাশ-ওপাশ করছি, এমন সময়ে সেই মেয়েটি এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। এমনিতে আমি কখনো কারো সেবা নিতে পারতুম না; কেউ আমার পায়ে গায়ে হাত দেবে তাতে বরং বিরক্তই হতুম, কিন্তু সেই মেয়েটিকে আমি বারণ করতে পারলুম না। এমন সময়ে ‘ – ’ এসে ঘরে ঢুকল। ‘ – ’ ঢুকেই মেয়েটিকে দেখে এমন দৃষ্টি হানল – তা মেয়েমানুষ ছাড়া কেউ পারে না। সে গিয়ে তক্ষুনি বাড়ির দুটি মেয়ে এনে হাজির করলে আমার পদসেবার জন্যে। আমার পদসেবার একটা মূল্য আছে, সেখানে সেই মেয়েটি যেন আসতে পারে না। তারপর চলতে লাগল আমার পদসেবা পুরোদমে। মানাও করতে পারি নে – মহা মুশকিল। টেপার দরুন পা আরো ব্যথা করতে লাগল। আমি মাঝে মাঝে আর না পেরে বলি – দেখো, হয়েছে – আর লাগবে না – কিন্তু কে কার কথা শোনে। পদসেবা চলতেই লাগল। তারপর না পেরে শেষটায় নীচের তলায় চলে আসতে আমাকে বাধ্য হতে হল। শেষে ঐ গল্পটা লিখি।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব গল্পেরই কাহিনি যে আপন অভিজ্ঞতা বা কল্পনার ভিত্তিতে গড়েছেন, তা কিন্তু নয়। তাঁর কিছু গল্পের পস্নট বা কাহিনিসূত্র তিনি অন্যদের কাছ থেকেও পেয়েছেন। এমনি একটি গল্প ‘পুত্রযজ্ঞ’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ইহা আমার ভ্রাতুষ্পুত্র সমরেন্দ্রের রচনা, তবে উহাতে আমারো কিছু হাত আছে।’ যদিও রবি কাকার এই ‘হাত থাকা’র ব্যাপারটির ব্যাখ্যা সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছেন এভাবে : ‘আমি কেবলমাত্র উহার আখ্যানবস্ত্তটি আমার কাঁচা ভাষায় লিখিয়া খামখেয়ালি সভায় পাঠের জন্য তাঁহাকে দেখাইয়াছিলাম, তিনি উহা দেখিয়া তাহার আমূল সংশোধন করিয়া ও নিজের অতুলনীয় ভাষায় লিখিয়া সেই সভায় আমার লিখিত বলিয়া পাঠ করেন।’ ভারতী পত্রিকায়ও গল্পটি প্রথমে সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামেই ছাপা হয়। যদিও পরে রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প হিসেবেই এটি গল্পগুচ্ছ দ্বিতীয় খ–র অন্তর্ভুক্ত হয়।

রবীন্দ্রনাথ নিজে যেমন অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া পস্নট অবলম্বনে তাঁর কয়েকটি গল্প লিখেছেন, তেমনি অন্যদেরও কোনো কোনো গল্পের পস্নট দিয়ে তাঁদের বলেছেন তার ভিত্তিতে গল্প লিখতে। এভাবেও তিনি বাংলা সাহিত্যের এ-শাখাটিকে সমৃদ্ধ করতে অবদান রেখেছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাসের লেখা থেকে জানা যায় :

রবীন্দ্রনাথ ‘যৌতুক’ গল্পের পস্নটটি শরৎকুমারীকে দেন এবং উহা লইয়া তাঁহাকে একটি গল্প রচনা করিতে অনুরোধ করেন। এই অনুরোধ-মতো পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই শরৎকুমারী ‘যৌতুক’ গল্পটি লিখিয়া ফেলেন। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ইহা জানিতেন না; কারণ পরবর্তীকালে তিনি এই পস্নটটি আবার চারু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেন এবং তিনি ‘চাঁদির জুতা’ গল্পটি লেখেন। গল্পটি চারুবাবুর ‘বরণডালা’ নামক পুস্তকে স্থান পাইয়াছে।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘দেবী’ গল্পটিরও (যা অবলম্বন করে সত্যজিৎ রায় তাঁর দেবী চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছেন) মূল কাহিনি বা ‘আখ্যানভাগ’ রবীন্দ্রনাথের ‘দান করা’ বলে স্বয়ং প্রভাতকুমার জানিয়েছেন। এভাবে অন্যদের গল্পের পস্নট সরবরাহ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নাকি একবার চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘তোমরা সব বড় পরে জন্মেছো। বছর কুড়ি আগে যদি জন্মাতে তাহলে তোমাদের আমি দেদার পস্নট দিতে পারতাম। তখন আমার মনে হতো আমি দুহাতে পস্নট বিলিয়ে হরির লুট দিতে পারি।’

 

চার

লিপিকার (১৩২৯ বঙ্গাব্দ/ আগস্ট ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ) গল্পগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘কথিকা’। এ-বিষয়ে প্রমথ চৌধুরীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ছোট ছোট গল্পকে ‘কথাণু’ না বলে ‘কথিকা’ বলা যেতে পারে। ‘গল্পস্বল্প’ বললে ক্ষতি কি?’ লিপিকায় মোট ৩৯টি গল্প আছে। এর মধ্যে প্রথম গল্পটির নাম ‘পায়ে চলার পথ’। এটি প্রকাশিত হয় প্রবাসীর আশ্বিন ১৩২৬ সংখ্যায়। যদিও প্রবাসীর আগে সবুজপত্রের মাঘ ১৩২৪, ফাল্গুন ১৩২৫, বৈশাখ ১৩২৬ ও আষাঢ় ১৩২৬ সংখ্যায় যখাক্রমে ‘তোতা-কাহিনী’, ‘স্বর্গ-মর্ত’, ‘ঘোড়া’ ও ‘প্রথম শোক’ গল্পগুলো ছাপা হয় (এর মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশের সময়  ‘ঘোড়া’ ও ‘প্রথম শোক’ রচনা দুটির শিরোনাম ছিল যথাক্রমে ‘মুক্তির ইতিহাস’ ও ‘কথিকা’)। বাংলা ১৩২৪ থেকে ১৩২৯ সালের মধ্যে প্রবাসীসবুজপত্র ছাড়াও ভারতী, মানসীমর্মবাণী, আগমনী, শান্তিনিকেতন, আঙুর, মোসলেম ভারতবঙ্গবাণী পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় গল্পগুলো প্রকাশিত হয়। তবে রবীন্দ্রনাথের অন্য অনেক রচনার মতো এই গল্পগুলোরও কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে পত্রিকায় প্রকাশিত ও গ্রন্থে সংকলিত পাঠের অল্পাধিক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। লিপিকার এই গল্পগুলো রচনার একটি পটভূমি আছে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ যা স্মরণ করেছেন এভাবে :

মনে আছে আপনার সেই ‘লিপিকা’র কথা? তার আগে শরীর খুব খারাপ, জালিওয়ানওয়ালাবাগের ব্যাপার নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। আমি একদিন আপনাকে পেনিটির বাগানে নিয়ে গেলাম। সেখানেও ভালো লাগলো না। কদিন কি রকম করে কাটলো। তারপর যেদিন নাইটহুড ছাড়ার চিঠি পাঠিয়ে দিলেন সেইদিন থেকে নিশ্চিন্ত। সকালবেলা আমি চিঠিখানা দিয়ে গেলাম, আর বিকেলে এসে দেখি তেতলার ঘরে চলে গিয়েছেন। ঘরে ঢুকতেই একটা ছোট্টো লাল খাতা আমায় দিয়ে বললেন, ‘এই নাও আর একটা লেখা।’ দেখি – ‘বাপ শ্মশান হতে ফিরে এসেছে’ ঐটে লিখেছেন। এইটাই ‘লিপিকা’র প্রথম লেখা। তারপরে কদিনের মধ্যেই হুড়মুড় করে সমস্তবইখানা লেখা হয়ে গেল।

আর রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর লিপিকা রচনার কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :

বেশ মনে আছে দিনের পর দিন ‘লিপিকা’ লিখছি। কোথায় গেছে জালিওয়ানওয়ালবাগ, কোথায় গেছে পলিটিক্স। আমার আর কিছুই মনে নেই, কেবল লেখার মধ্যে ডুবে রয়েছি। ভাষা কী! একেবারে নতুন চেহারা নিয়েছে। আশ্চর্য! কোথা থেকে এল ও রকম ভাষা? আমি অনেকবার দেখেছি কোনো কিছু একটা নিয়ে মনটা বড্ড বেশি নাড়া খেলেই তারপর আমার লেখা বেরোয়। …প্রশান্ত আবার সেই ‘লিপিকা’র খাতাখানা একবার বোলপুর এসে সারারাত জেগে বসে একরাত্রের মধ্যে কপি করে দিল। আমি যা যা কাটাকুটি করেছিলুম, ও তাও সমস্তখুঁটিয়ে উদ্ধার করে নিয়েছে। পরে সব গবেষণা করবে, প্রথম যেটা লিখেছিলাম সেই কথাটাই ভালো ছিল, না শেষে যেটা বসিয়েছি সেইটাই ভালো; এইসব কত কি।

লিপিকার রচনাগুলো সম্পর্কে ‘নতুন কিছু নয়’ এবং এগুলো আসলে গদ্যকবিতা – ‘বিশুদ্ধ গদ্যকবিতা’ – ‘লেখাটা গদ্যের ছাঁদে, এই মাত্র তফাৎ’, বিভিন্ন সময় নানাজনকে এমন কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ।  এমনকি পুনশ্চ কাব্যের ভূমিকায়ও লিপিকার রচনাগুলোকে তাঁর ‘প্রথম গদ্যকবিতা লেখার চেষ্টা’ হিসেবে উলেস্নখ করে বলেছেন, ‘ছাপবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খ–ত করা হয়নি – বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ।’ তবে অনেকটা কবিতার ধাঁচে লেখা হলেও এগুলোর মধ্যে গল্প আছে। আর সমালোচকরা পরবর্তীকালে রচনাগুলোকে গল্প হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।

সে-র (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) গল্পগুলোকে অনেকে মনে করেন শিশুপাঠ্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই রচনাগুলো সম্পর্কে বলেছেন, ‘পাঠকেরা ওটাকে শিশুপাঠ্যের কোঠায় ফেলে দিয়ে ওর প্রতি কৃপাকটাক্ষপাত করেছে – জানে না কাহিনীটা ছোটো থেকে ক্রমে বড়ো হয়ে উঠেছে স্বয়ং রচয়িতারই মতো।’ রবীন্দ্রনাথ এই কথাগুলো লিখেছিলেন বনফুলকে (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়), তাঁর এক পত্রের জবাবে। ইতোপূর্বে বনফুল সে-পাঠের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘আমার ধারণা ছিল বইখানি শিশুপাঠ্য। পড়ে দেখলাম এ শুধু শিশুপাঠ্য নয় চির শিশুপাঠ্য। যাদের উদ্দেশ্যে আপনি বইখানি লিখেছেন তাদের শিশুত্ব কোনোকালেই ঘুচবে না।’ পাঠক যে-বইটিকে শিশুপাঠ্য মনে করে তার কারণ এর গল্পগুলোর শ্রোতা পুপে, রবীন্দ্রনাথের নাতনি, যার বয়স মাত্র নয় বছর, ‘পুপুদিকে সামনে বসিয়ে এবং সে-কে উপলক্ষ্য করে’ লেখক তাঁর গল্প ফেঁদেছেন। অনেকটা রূপকথার ঢংয়ে। এও এক রকম রূপকথাই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় : ‘…শিশুকাল থেকে মানুষ বলছে ‘গল্প বলো’; সেই গল্পকে বলে রূপকথা। রূপকথাই সে বটে; তাতে না থাকতে পারে আবশ্যক সংবাদ, সম্ভবপরতা সম্বন্ধেও তার হয়তো কোনো কৈফিয়ত নেই। সে কোনো-একটা রূপ দাঁড় করায় মনের সামনে, তার প্রতি ঔৎসুক্য জাগিয়ে তোলে, তাতে শূন্যতা দূর করে; সে বাস্তব। …গল্প শুরু করা গেল …ছোটো মেয়ে চোখ দুটো মস্তকরে হাঁ করে শোনে। আমি বলি, ‘আজ এই পর্যন্ত।’ সে অস্থির হয়ে বলে, ‘না, বলো, তার পরে।’

সে-র প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ের কোনো কোনো অংশের পূর্বতন পাঠ মাসিক সন্দেশের (নবপর্যায়) ১৩৩৮ সনের আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ সংখ্যায় এবং পঞ্চম অধ্যায়ের কিছু অংশ রংমশাল পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম (কার্তিক ১৩৪৩) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। মাঝে ‘এক ছিল মোটা কেঁদো বাঘ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয় মুকুল পত্রিকার বৈশাখ ১৩৪১ সংখ্যায়। তখন এর শিরোনাম ছিল ‘বাঘের শুচিতা’। পুস্তকাকারে প্রকাশের সময় বইটিতে রবীন্দ্রনাথের আঁকা বেশকিছু স্কেচ বা ছবি যুক্ত হয়।

গল্পসল্প প্রকাশিত হয় ১৩৪৮ সনের ২৭ বৈশাখ (১০ মে ১৯৪১), অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। যদিও ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি যখন অসুস্থ অবস্থায় কালিম্পংয়ে, তখনই বইটির নামপত্র এঁকে রাখেন। দু-তিনটি বাদে গল্পসল্পের গল্পগুলো রবীন্দ্র-জীবনের একেবারে শেষ বছরে (১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) লেখা। ব্যতিক্রম ‘পালের সঙ্গে দাঁড়ের বুঝি’ (১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) ও ‘যেমন পাজি, তেমনি বোকা’ (১৯৪০) এ-দুটি গল্প। ‘ইঁদুরের ভোজ’ গল্পটিও কিছু আগে লেখা বলে ধারণা করা যায়, যেহেতু এ-গল্পটি বঙ্গলক্ষ্মী পত্রিকার আষাঢ় ১৩৪৬ (১৯৩৯) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন অবশ্য গল্পটি সেখানে রবীন্দ্রনাথের নাতনি নন্দিনীর নামে ছাপা হয়। গল্পসল্প যখন প্রথম বই আকারে বেরোয় তখন এ-গল্পটি তাতে ছিল না। অনেক পরে ১৩৭২ সনের (১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) সংস্করণে এটি সংযোজিত হয়।

 

পাঁচ

কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, এমনকি এখনো কতকটা পরিমাণে সে-অভিযোগ প্রচলিত আছে যে, তিনি কল্পনাবিলাসী, গজদন্ত মিনারবাসী কবি। তিনি জমিদার পরিবারের সমত্মান, সাধারণ জনজীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল না বললেই চলে। ফলে বৃহত্তর সে-জীবনের কথা তাঁর কাব্যে স্থান পায়নি। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কবি হিসেবে তাঁর কাব্যসাধনায় এই ফাঁক বা ‘সুরের অপূর্ণতা’র কথা স্বীকার করে সমালোচনাটিকে একরকম যথার্থতা দিয়েছেন। তাঁর শেষদিকের কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতায় নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের খুঁটিনাটি কিছু চিত্র, অনুভব বা অনুষঙ্গের উপস্থিতি সে-অভিযোগকে নাকচ করার পক্ষে যথেষ্ট কি না, সে অন্য প্রসঙ্গ, আর তা নিয়ে আলোচনা করার স্থানও এ নয়। তবে ছিন্নপত্রের চিঠিগুলোতে যেমন, তেমনি রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্পে গ্রামীণ কৃষিজীবী মানুষ বিশেষ করে নারীদের জীবনচিত্র নিপুণ দক্ষতায় আঁকা হয়েছে দেখতে পাই। যদিও সমকালে এ-বিষয়টির স্বীকৃতি তিনি পাননি। এ নিয়ে গভীর একটা দুঃখবোধও তাঁর মধ্যে ছিল। নানা সময়ে ও উপলক্ষে যা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর সেসব বক্তব্য বা ব্যাখ্যা একই সঙ্গে তাঁর অভিমান ও আত্মবিশ্বাসকে তুলে ধরে। যেমন :

১. সেদিন দেখলুম একজন সমালোচক লিখেছেন, আমার গল্প অভিজাত সম্প্রদায়ের গল্প, সে তাঁদের হৃদয় স্পর্শ করে না। গল্পগুচ্ছের গল্প বোধ হয় তিনি আমার বলে মানেন না। সেদিন গভীর আনন্দে আমি যে কেবল পলস্নীর ছবি এঁকেছি তা নয়, পলস্নী সংস্কারের কাজ আরম্ভ করেছি তখন থেকেই – সে সময়ে আজকের পলস্নীদরদী লেখকেরা ‘দরিদ্রনারায়ণ’ শব্দটার সৃষ্টিও করেননি।

২. লোকে অনেক সময়ই আমার সম্বন্ধে সমালোচনা করে ঘরগড়া মত নিয়ে। বলে, ‘উনি তো ধনী-ঘরের ছেলে। ইংরেজিতে যাকে বলে রুপোর চাম্চ মুখে নিয়ে জন্মেছেন। পলস্নীগ্রামের কথা উনি কী জানেন। আমি বলতে পারি, আমার থেকে কম জানেন তাঁরা যাঁরা এমন কথা বলেন। কী দিয়ে জানেন তাঁরা। অভ্যাসের জড়তার ভিতর দিয়ে জানা কি যায়। যথার্থ জানায় ভালোবাসা। কুঁড়ির মধ্যে যে কীট জন্মেছে সে জানে না ফুলকে। জানে বাইরে থেকে যে পেয়েছে আনন্দ। আমার যে নিরন্তর ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে আমি পলস্নীগ্রামকে দেখেছি তাতেই তার হৃদয়ের দ্বার খুলে গিয়েছে। আজ বললে অহঙ্কারের মতো শোনাবে, তবু বলব আমাদের দেশের খুব অল্প লেখকই এই রসবোধের চোখে বাংলাদেশকে দেখেছেন। আমার রচনাতে পলস্নীপরিচয়ের যে অন্তরঙ্গতা আছে, কোনো বাঁধাবুলি দিয়ে তার সত্যতাকে উপেক্ষা করলে চলবে না।…

৩. আমার রচনায় যাঁরা মধ্যবিত্ততার সন্ধান পাননি বলে নালিশ করেন তাঁদের কাছে আমার একটা কৈফিয়ৎ দেবার সময় এলো। …এক সময়ে মাসের পর মাস আমি পলস্নীজীবনের গল্প রচনা করে এসেছি। আমার বিশ্বাস, এর পূর্বে বাংলা সাহিত্যে পলস্নীজীবনের চিত্র এমন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়নি। তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লেখকের অভাব ছিল না, তাঁরা প্রায় সকলেই প্রতাপসিংহ বা প্রতাপাদিত্যের ধ্যানে নিবিষ্ট ছিলেন। আমার আশঙ্কা হয়, এক সময়ে ‘গল্পগুচ্ছ’ বুর্জোয়া লেখকের সংসর্গদোষে অসাহিত্য বলে অস্পৃশ্য হবে। এখনই যখন আমার লেখার শ্রেণীনির্ণয় করা হয় তখন এই লেখাগুলির উলেস্নখমাত্র হয় না, যেন ওগুলির অসিত্মত্ব নেই।…

তবে মৃত্যুর কিছুদিন আগে পরিচয় পত্রিকায় (জৈষ্ঠ্য ১৩৪৮) প্রকাশিত হরপ্রসাদ মিত্রের একটি প্রবন্ধ ‘গল্পগুচ্ছের রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে তাঁর এই দুঃখ বা বেদনাবোধ কিঞ্চিৎ হলেও প্রশমিত হয়েছিল। অন্তত রাণী চন্দকে বলা তাঁর কথাগুলো থেকে তাই মনে হয়।

৪. …বাংলাদেশের যে একটা মাহাত্ম্য আছে – আমার আগে এ আর কেউ দেখেনি এই চোখে। আমাদের দেশের লোকের ধারণা আছে যে, আমি কী করে বুঝব – আমি কি তাদের মধ্যে থেকেছি, দেখেছি। আমি হলুম বড়োলোক; গরিবের বেদনা, দৈনন্দিন সুখদুঃখের ওঠানামা – তার আমি কী জানি।

আমি চুপ করে সব সহ্য করে গেছি। কিন্তু এই ছোটো গল্পগুলিতে বিশেষ একটা recognition আমার পাওনা ছিল – যা আমি পাইনি এতকাল। এবার ‘পরিচয়’-এ পেলুম তা।

এ-বিষয়ে পরিচয় পত্রিকার হিরণকুমার সান্যালকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি পত্রও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাতে তিনি বলেন :

আমার বয়স তখন অল্প ছিল। বাংলাদেশের পলস্নীতে ঘাটে ঘাটে ভ্রমণ করে ফিরেছি। সেই আনন্দের পূর্ণতায় গল্পগুলি লেখা। চিরদিন এই গল্পগুলি আমার অত্যন্ত প্রিয় অথচ আমার দেশ গল্পগুলিকে যথেষ্ট অভ্যর্থনা করে নেয়নি, এই দুঃখ আমার মনে ছিল; এবার তোমাদের ‘পরিচয়ে’ এতদিন পরে আমি যথোচিত পুরস্কার পেয়েছি। …এই কৃতজ্ঞতা তোমাকে না জানিয়ে পারলুম না।

তাঁর গল্পগুলো সম্পর্কে গীতধর্মিতার অভিযোগও নাকচ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :

আমি একটা কথা বুঝতে পারিনে, আমার গল্পগুলিকে কেন গীতধর্মী বলা হয়। এগুলি নেহাৎ বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি তাই বলেছি। ভেবে আর কল্পনা করে আরকিছু বলা যেত; কিন্তু তা তো করি নি আমি।

বুদ্ধদেব বসুর মতে, রবীন্দ্রনাথ যখন গদ্য লেখেন তখন তাও লেখেন কবিতার মতো। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন :

…অসংখ্য ছোট ছোট লিরিক লিখেছি – বোধ হয় পৃথিবীর অন্য কোনো কবি এত লেখেননি – কিন্তু আমার অবাক লাগে তোমরা যখন বলো যে, আমার গল্পগুচ্ছ গীতধর্মী। একসময় ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলার নদীতে নদীতে, দেখেছি বাংলার পলস্নীর জীবনযাত্রা। একটি মেয়ে নৌকো করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল, তার বন্ধুরা ঘাটে নাইতে নাইতে বলাবলি করতে লাগল, আহা, যে পাগলাটে মেয়ে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওর কী না জানি দশা হবে। কিংবা ধর একটা ক্ষ্যাপাটে ছেলে সারা গ্রাম দুষ্টুমির চোটে মাতিয়ে বেড়ায়, তাকে হঠাৎ একদিন চলে যেতে হলো শহরে তার মামার কাছে। এইটুকু চোখে দেখেছি, বাকিটা নিয়েছি কল্পনা করে। একে কি তোমরা গান জাতীয় পদার্থ বলবে? আমি বলবো গল্পে বাস্তবের অভাব কখনো ঘটেনি। যা-কিছু লিখেছি নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। … কল্পনায় গড়েছি, কবিতায় রচনা করেছি মানসসুন্দরীকে। এ হল কবিতার কথা, কিন্তু গল্পের উপাদান এ নয়। গল্পে যা লিখেছি তার মূলে আছে আমার অভিজ্ঞতা, আমার নিজের দেখা। তাকে গীতধর্মী বললে ভুল করবে। ‘কঙ্কাল’ কি ‘ক্ষুধিত পাষাণ’কে হয়তো খানিকটা বলতে পার কারণ সেখানে কল্পনার প্রাধান্য, কিন্তু তাও পুরোপুরি নয়। তোমরা আমার ভাষার কথা বলো, বলো যে গদ্যেও আমি কবি। আমার ভাষা যদি কখনো আমার গল্পাংশকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মূল্য পায়, সেজন্য আমাকে দোষ দিতে পারো না। এর কারণ, বাংলা গদ্য আমার নিজেকেই গড়তে হয়েছে। ভাষা ছিল না, পর্বে পর্বে স্তরে স্তরে তৈরি করতে হয়েছে আমাকে। আমার প্রথম দিককার গদ্যে, যেমন ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’, ‘কেকাধ্বনি’ এসব প্রবন্ধে পদ্যের ঝোঁক খুব বেশি ছিল, ওসব যেন অনেকটা গদ্য-পদ্য গোছের। গদ্যের ভাষা গড়তে হয়েছে আমার গল্পপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে। মোপাসাঁর মতো যেসব বিদেশী লেখকের কথা তোমরা প্রায়ই বলো, তাঁরা তৈরি ভাষা পেয়েছিলেন। লিখতে লিখতে ভাষা গড়তে হলে তাঁদের কী দশা হত জানিনে।

ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে, আমি যে ছোট ছোট গল্পগুলো লিখেছি বাঙালি সমাজের বাস্তব জীবনের ছবি তাতেই প্রথম ধরা পড়ে।

রবীন্দ্রনাথের গল্পে সমাজ-বাস্তবতার অভাব কিংবা তাঁর গদ্যের বিরুদ্ধে গীতিধর্মিতার অভিযোগ দুয়েরই জবাব তাঁর নিজের বলা এ-কথাগুলোতে খুব ভালোভাবেই দেওয়া হয়েছে বলে মনে করি।

 

টীকা

১.      রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছিন্নপত্র

২.      জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘শামিত্মনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ’।

৩.      রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানুষের ধর্ম

৪.      চন্দ্রগুপ্ত, সুদর্শন, সত্যবতী দেবী ও বনারসীদাস চতুর্বেদForward, ২৩ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৩৬।

৫.      বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ ১৩৫০।

৬.      রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয়

৭.      রাণী চন্দ, আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ

৮.      নির্বাণ

৯.      সীতা দেবী, ‘পুণ্যস্মৃতি’।

১০.    রাণী চন্দ, আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ

১১.     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র  : ১০।

১২.    ‘গ্রন্থপরিচয়’, গল্পগুচ্ছ (অখ-)।

১৩.    ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকামত্ম দাস, শরৎকুমারী চৌধুরাণীর রচনাবলী

১৪.     প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, নব-কথা

১৫.    চারম্নচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রবিরশ্মি

১৬.    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র : ৫।

১৭.    নির্মলকুমারী মহলানবিশ, বাইশে শ্রাবণ

১৮.    ওই।

১৯.    চারম্নচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র : ১৫।

২০.    মৈত্রেয়ী দেবী, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ

২১.    দেশ সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৮২।

২২.    ওই।

২৩.    ‘সাহিত্যতত্ত্ব’, সাহিত্যের পথে

২৪.    জন্মদিনে, ১০ সংখ্যক কবিতা।

২৫.    শ্রীপ্রভাতচন্দ্র গুপ্ত, ‘প্রভাত-রবি’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪৪।

২৬.    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আমার উত্তর’ (১৯৪০), প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪৭।

২৭.    নন্দগোপাল সেনগুপ্তকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি, কবিতা, আষাঢ় ১৩৪৮।

২৮.    রাণী চন্দ, আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ

২৯.    উদ্ধৃত : প্রমথনাথ বিশী, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প

৩০.    রাণী চন্দ, প্রাগুক্ত।

৩১.    বুদ্ধদেব বসু, সঙ্গ নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ

৩২.           রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘সাহিত্য, গান ও ছবি’, প্রবাসী, আষাঢ় ১৩৪৮।