রবীন্দ্রনাথ ও জাপান

মনজুরুল হক
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কের শেকড় কতটা গভীরে প্রোথিত ছিল তা নিয়ে গবেষণা ভারত-বাংলাদেশের বাইরে জাপানেও কম হয়নি। ফলে সম্পর্কের উৎস এবং এর নানামুখী প্রভাব নিয়ে অনেক কিছুই আমাদের এখন আর অজানা নয়। তবে যে-দিকটায় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা হলো আত্মিক সে-সম্পর্কের টানাপোড়েনের দিকগুলো। আমরা জানি, ১৯১৬ সালে প্রথমবার জাপানভ্রমণে যে-বাণী জাপানিদের রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন, এদেশের নেতৃস্থানীয় অনেক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের সেটা পছন্দ হয়নি। ফলে আপ্যায়ন জানিয়ে জাপানে নিয়ে আসার ঠিক পরপরই রবীন্দ্রনাথকে অবজ্ঞা করার একধরনের মনোভাব জাপানের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন এশিয়ার পরাধীন একটি দেশের এক কবি জাপানভ্রমণে এসে দেশটির মাথা তুলে দাঁড়ানো দেখতে পেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাঁদের গুণকীর্তন গাওয়া বার্তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেবেন। আর তাই শুরু থেকেই সেরকম কিছু হতে না দেখাটা তাদের প্রত্যাশায় চিড় ধরিয়ে দেয় এবং অবাক হয়ে তাঁরা ভাবতে শুরু করেন, এ কোন অতিথি তাঁদের দরবারে উপস্থিত যে কি-না চারদিকের চাকচিক্য দেখেও মোটেই বিমোহিত নয়। ফলে সমালোচনার তীর তখন থেকেই ধাবিত হতে থাকে পরাধীন দেশের কবিকে পরাভূত করার বাসনা নিয়ে। আর তাই আমরা বলতে পারি যে, সম্পর্কের টানাপোড়েনের সূচনাও লক্ষ করা গেছে কবিগুরুর কাছে থেকে জাপানকে দেখার শুরুর সে-দিনগুলো থেকেই।
তবে সম্পর্কের এই টানাপোড়েন সত্ত্বেও জাপানকে যে রবীন্দ্রনাথ সত্যিকার অর্থে ভালোবেসেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ একেবারেই নেই। ভালোবাসার উৎস অবশ্যই হচ্ছে জাপানের নান্দনিক উৎকর্ষ এবং সমৃদ্ধ শৈল্পিক বোধ সম্পর্কে অবগত হতে পারা। সেদিক থেকে পুবের এ-দেশটি সম্পর্কে কবিগুরুর বোধোদয় জাগ্রত করে তোলায় তেনশিন ওকাকুরার ভূমিকার প্রশংসা না করলেই নয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্রত নিয়ে ওকাকুরা ভারতে যাননি। ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন মূলত সমগ্র এশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ক একটি সম্মেলন আয়োজনের সম্ভাবনা যাচাই করে দেখার উদ্দেশ্যে, যে-সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে এশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐক্যের ধারণা বিশেষ করে ভারত ও চীনে পৌঁছে দেওয়া ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। ভারতে যাওয়ার আগে থেকেই স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ঘটে এবং বিবেকানন্দের সঙ্গে তিনি বুদ্ধ গয়া ও সারনাথ ভ্রমণ করেন।
ভারতে পা রাখার আগে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ওকাকুরা শুনে থাকবেন কি-না সে- বিষয়ে সন্দেহ পোষণের সংগত কারণ রয়ে গেছে। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি প্রধানত বঙ্গ প্রদেশের বলয়ে সীমিত ছিল এবং বাংলার বাইরে এমনকি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও তিনি তখনো অপরিচিত এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর রচনার অনুবাদের গণ্ডিও ছিল খুব সীমিত। ফলে বলা যায়, ওকাকুরার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আগে থেকে জানার সেরকম কোনো সুযোগ একেবারেই ছিল না।
অন্যদিকে ওকাকুরার ভারত ভ্রমণের সংবাদও রবীন্দ্রনাথের অগোচরেই থেকে যাওয়ার কথা। কেননা, বাংলার কবির সঙ্গে সাক্ষাতের বাসনা নিয়ে ভারতভ্রমণে তিনি যাননি এবং তৎকালীন ভারতীয় সমাজে তাঁর পরিচয়ের গণ্ডিও ছিল খুবই সীমিত। সেরকম অবস্থায় ওকাকুরা ভারতে পৌঁছার বেশ কয়েক মাস পর, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র ও শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাধ্যমে বাংলার কবি ও জাপানের শিল্প-সমালোচক একে অন্যের দেখা পেয়েছিলেন এবং অল্পদিনের মধ্যে নিবিড় এক সম্পর্ক তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল।
এশিয়ার শিল্প ও সংস্কৃতির মধ্যে বহমান একক এক ধারার যে-বাণী ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন, কবিগুরু তাতে নিশ্চিতভাবেই আকৃষ্ট হয়ে থাকবেন। তবে তার চাইতে বেশি যেটা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল তা হলো – জাপানের সমৃদ্ধ শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হতে পারার সুযোগ যে সাক্ষাৎ করে দিয়েছিল সেই বাস্তবতা। এতদিন পর্যন্ত জাপানকে রবীন্দ্রনাথ দেখে এসেছিলেন পশ্চিমের দেখা চোখ ধার করে নিয়ে। সেবারই প্রথম জাপানের একজন নেতৃস্থানীয় চিন্তাবিদ তাঁকে শুনিয়েছিলেন প্রাচ্যের সেই দেশটির কথা, যে-দেশের রয়েছে কয়েক হাজার বছরের সমৃদ্ধ এক ইতিহাস, যা কি-না দেশটিকে পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ায় অনুপ্রাণিত করছে। তবে সামনে পা বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ায় জাপান যে ভারত ও চীনকেও সঙ্গে রাখতে আগ্রহী, ওকাকুরার বক্তব্যে সেটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, যদিও রবীন্দ্রনাথ কিংবা সে-সময়ের আন্যান্য ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ধারণা করতে পারেননি যে, ওকাকুরার সেই এশিয়ার একক সত্তার ভাবনা জাপানেও ততদিনে সংখ্যালঘুর ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাপানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এর কিছু আগে থেকেই এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করতে শুরু করে সাংস্কৃতিক বলয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকে নয়, বরং সম্পদ আহরণের হিসাব-নিকাশের আলোকে। সেদিক থেকে ওকাকুরা ছিলেন সে-সময়ের ব্যতিক্রমী এক ব্যক্তিত্ব, স্বপ্নচারী এক মন নিয়ে ভারত এবং চীন যিনি ভ্রমণ করেছিলেন। বলা যায়, ওকাকুরার ভারতভ্রমণ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে জাপান সম্পর্কে একধরনের বোধোদয় জাগ্রত করে তুলেছিল, যে-তাগিদ থেকে পরবর্তীকালে ওকাকুরার সুপারিশে জাপানি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের শিক্ষা দেওয়ার জন্য জাপান থেকে শিক্ষক ও সেইসঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি শিখতে আগ্রহী জাপানের শিক্ষানবিশদেরও নিয়মিতভাবে তিনি শান্তিনিকেতনে নিয়ে এসেছিলেন। ফলে ১৯১৬ সালে কবির দীর্ঘ প্রত্যাশিত জাপানভ্রমণ বাস্তবায়িত হওয়ার সময় জাপানের অনেক কিছুই তাঁর জানা হয়ে গিয়েছিল, যে-প্রমাণ আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের জাপান যাত্রীতে।
জাপান যাত্রী বিশুদ্ধ অর্থে কোনো ভ্রমণকাহিনি নয়। বরং এটা হচ্ছে জাপান সম্পর্কে কবির ভাবনা-চিন্তা তুলে ধরা এক ভ্রমণবৃত্তান্ত, যার অর্ধেকের বেশি অংশ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন জাপানে পৌঁছার আগে জাহাজে কাটানো অলস সময়ে। নিজের চোখে কাছে থেকে জাপানকে দেখার পরও আগের লেখা সে-অংশের তেমন কোনো রদবদল রবীন্দ্রনাথ করেননি। ফলে জাপান যাত্রী সত্যিকার অর্থেই যেন হয়ে উঠেছে জাপানের প্রতি যে-ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথ বরাবর অনুভব করে গেছেন তারই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য দলিল। নেই সেখানে যারা তাঁকে জাপানে অবজ্ঞার চোখে দেখতে শুরু করেছিল, তাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক কোনো আস্ফালন, কিংবা এমনকি সমালোচনার যে-ঢেউ প্রথমবারের মতো কবির জাপানে অবস্থানের সেই সময় থেকেই বইতে শুরু করেছিল তার জবাব দেওয়ার বাসনা। বরং শান্ত, নিরুদ্বেগ এক মন নিয়ে তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর দৃষ্টিতে মনে হওয়া জাপানের ভালো-মন্দের দিকগুলো, মন্দের চাইতে ভালোর পাল্লা যেখানে অনেক ভারী। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবারের মতো জাপানভ্রমণ করার সময়ে লেখা সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল এর প্রায় তিন বছর পর। সেই তিন বছরে যে-আশঙ্কা কবি জাপানে অবস্থানের সময়ে করেছিলেন, সমরবলের সেই চোরাবালির পথে জাপান আরো অনেকটা অগ্রসর হলেও কোনোরকম রদবদল না করেই বইটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এটাও হচ্ছে পুবের সেই দেশ ও এর জনগণের প্রতি যে-ভালোবাসা কবির মনে সদা জাগ্রত ছিল, তারই প্রতিফলন।
প্রথমবারের জাপানভ্রমণে যে-বার্তা তিনি জাপানিদের শোনাতে চেয়েছিলেন, তা ছিল জাপানের প্রতি ভালোবাসা থেকে মনে দেখা দেওয়া তাঁর ইচ্ছার প্রকাশ, কোনোরকম বিদ্বেষ কিংবা হিংসার অভিব্যক্তি যা নয়, যদিও জাপানে যাঁরা তাঁর সেই বাণী অপছন্দ করেছিলেন, বার্তার সেরকম এক ব্যাখ্যা তুলে ধরতে তাঁরা ছিলেন প্রয়াসী। সেই ১৯১৬ সালে জাপানে আগমনের প্রথম কয়েকদিনেই রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, পশ্চিমের কাছ থেকে ধার করে নেওয়া যে-পথ ধরে জাপান সামনে এগিয়ে চলেছে, তা একদিন জাপানকেও হয়তো আত্মবিধ্বংসী এক পথের দিকে ধাবিত করবে। ফলে জাপানকে সতর্ক করে দিতেই তিনি যেন বলেছিলেন : ‘জাপানের অবশ্যই জানা উচিত যে, আসল শক্তি কখনো অস্ত্রের বলে সীমিত থাকতে পারে না, বরং সেই শক্তির মূলে আছে মানুষ, যারা সেই অস্ত্র হাতে তুলে নেয়; এবং সে যখন ক্ষমতার লালসায় আত্মাকে বিকিয়ে দিয়ে অস্ত্রের ভাণ্ডারকে করে তোলে সমৃদ্ধ, সেরকম অবস্থায় নিজেই সে হয়ে ওঠে শত্র“র চাইতেও অনেক বেশি বিপজ্জনক।’
রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথমবারের মতো জাপানভ্রমণ করেন, বিশ্বজুড়ে তখন চলছিল সর্বনাশা এক যুদ্ধ। এশিয়া সরাসরি সে-যুদ্ধে জড়িত না হলেও এশিয়ার কিছু কিছু এলাকায় পরোক্ষ সংঘাত রক্তক্ষয়ী আকার নিয়েছিল। অন্যদিকে আধুনিকতার পথ ধরে এগিয়ে চলা জাপানেও চলছিল সমরপ্রস্তুতি। ১৯০৫ সালে রাশিয়াকে পরাজিত করার পর থেকে জাপানের আত্মবিশ্বাস ছিল ঊর্ধ্বমুখী এবং দেশের সমরায়নের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা থেকে দেখা দেওয়া সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ভাবনা-চিন্তাও জাপানি নেতৃত্বকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ফলে জাপানের মানুষের প্রতি যে-টান রবীন্দ্রনাথ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে অনুভব করে গেছেন, সেটাই তাঁকে এরকম সতর্কতা উচ্চারণ করায় উদ্বুদ্ধ করেছিল যে, আত্মম্ভরিতা কেবল নিজের ধ্বংসই নিয়ে আসতে পারে।
জাপানের মানুষের প্রতি নিজের মনের সেই নিখাদ ভালোবাসার উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে সরাসরি করেছিলেন রাসবিহারী বসুকে লেখা এক চিঠিতে। রাসবিহারী বসুরা চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে জাপানের চীন ও এশিয়ার অন্যান্য ভূখণ্ডের ওপর চালানো অন্যায় হামলার পক্ষে সাফাই গাওয়াতে। ফলে ১৯৩৭ সালে আবারও জাপান সফরের যে-আমন্ত্রণ রাসবিহারী বসু জাপান সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়েছিলেন, তার জবাবে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘আপনি তো জানেন জাপানের জনগণের জন্য আমার রয়েছে নিখাদ ভালবাসা এবং সেই জনগণকে শাসকরা যে প্রতিবেশী ভূখণ্ডে নিয়ে যাচ্ছে অমানবিক কর্মকাণ্ডে তাদের জড়িত করার জন্য, যা কি-না মানবতার ইতিহাসে দীর্ঘ সময়ের জন্য তাদের নামকে করবে কলঙ্কিত; সেখানে গিয়ে তা দেখা আমার জন্য নিশ্চিতভাবেই হবে খুবই বেদনাদায়ক।’
ফলে জাপানের সমরনায়ক ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসরদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে গেলেও জাপানের মানুষের প্রতি ভালোবাসায় কোনোরকম ছেদ রবীন্দ্রনাথের জীবনে একেবারেই পড়েনি। জাপানে রবীন্দ্র-বার্ষিকী উদযাপন তাই সেদিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।