রশীদ করীমের ছোটগল্প : একটি সাধারণ বিবেচনা

সৌভিক রেজা

একটিমাত্র ছোটগল্প-গ্রন্থ, আর তারই ভূমিকায় রশীদ করীম তাঁর গল্প-রচনার নেপথ্যের অনুপ্রেরণা হিসেবে এক সুন্দরী ‘বাল্যসখীর’ কথা উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন, ‘যদ্দুর মনে করতে পারি, বড়দের জন্য আমার প্রথম গল্পটি ছাপার অক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে সওগাত পত্রিকায়।… পূর্বাশা, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী – এইসব পত্র-পত্রিকায় আমার গল্প বের হচ্ছে।… ‘একটি মেয়ের আত্মকাহিনী’ – সেই একটি গল্পের জোরেই আমি সিগনেট প্রেসের উদ্বোধনী উৎসবে নিমন্ত্রণ লাভ করেছিলাম।’ এরপরে তিনি বলছেন যে, তাঁর সে-সময়কার গল্পলেখার সময়সীমা ছিল ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ – এই সময়কাল পর্যন্ত। তারপর? রশীদ করীমের মুখ থেকেই শোনা যাক : ‘সেই সময় সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। আমার গল্প লেখার প্রয়োজনও ফুরালো। ১৯৬১ সালে উত্তম পুরুষ লিখে সাহিত্যজগতে আমার পুনঃপ্রবেশ।’ আমাদের সবারই জানা রয়েছে যে, উত্তম পুরুষ আমাদের বাংলা কথাসাহিত্যের একটি উত্তম নিদর্শন। এরপরে রশীদ করীমের কাছ থেকে আমরা বেশ কিছু উপন্যাস পেলেও ছোটগল্প খুব-একটা পাইনি। বুঝতে পারা যায় যে, কথাসাহিত্যের এই আঙ্গিকটিতে তিনি খুব-একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। এই প্রসঙ্গে উইলিয়াম ফকনারের একটি মন্তব্য মনে পড়ে, যেখানে ফকনার নিজেকে একজন ব্যর্থ কবি হিসেবে (a failed poet) উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘May be every novelist wants to write poetry first, finds he can’t, and then tries the short story, which is the most demanding form after poetry. And, failing at that, only then does he take up novel writing.’। রশীদ করীম কবিতা লিখতেন কিনা জানি না, তবে ভালো কবিতার সমঝদার যে ছিলেন তাঁর প্রবন্ধের সংকলনগুলোতে সেসবের কিছু নমুনা রয়ে গেছে। যদিও যথেষ্ট বিনয় নিয়েই বলতেন, ‘কবিতা সম্পর্কে কিছু বলতে আমার বাধে।… কারণ, সে সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুবই কম।’ তো সেই কম জ্ঞান নিয়েই তিনি আহসান হাবীব থেকে শুরু করে আবুল হোসেন, শামসুর রাহমানকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তাতে অবশ্য আমাদের এটা মনে হয়নি যে, কবিতা তিনি কম বুঝতেন। কবিতা কম বুঝতেন না ঠিকই, তবে ছোটগল্প রচনায় যে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না সেইটি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারা যায়।

 

দুই

এইটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। টলস্টয়ের (Lev Nikolayevich Tolstoy : 1828-1910) ক্ষেত্রে আমরা দেখি তিনি বিশাল ক্যানভাসে উপন্যাস লিখতে যতটা পছন্দ করতেন ছোটগল্পের বেলায় ঠিক ততোটা নয়। টলস্টয়ের ফাদার সিয়ের্গি (Father Sergius, 1898), ইভান ইলিচের মৃত্যু (The Death of Ivan Ilyich, 1886) কিংবা ক্রয়টজার সোনাটা (The Kreutzer Sonata, 1889) – এই গল্পগুলিও শেষ পর্যন্ত আর ছোটগল্প থাকেনি, এক-একটি উপন্যাসিকা হয়ে উঠেছে। আবার অন্যদিকে, চেখভের (Anton Pavlovich Chekhov, 1860-1904) হাতে নাটক, ছোটগল্প যতটা খুলতো, বড় আকারের উপন্যাস যে খুলতোই না, সেইটি বোঝার জন্য নতুন করে গবেষণার দরকার হয় না। ওই একই কথা আমরা বলতে পারি জার্মান কথাসাহিত্যিক টমাস মানের (Thomas Mann, 1875-1955) বেলাতেও। ওঁর Buddenbrooks (1901), The Magic Mountain (1924), Doctor Faustus (1947) – উপন্যাসগুলো আকৃতির দিক থেকে ৫৫০ থেকে ৭০০ পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে।  আবার, হারমান হেসের (Hermann Hesse : 1877-1962) বেলায় ঠিক তার উলটো; হেসের Gertrud (1910), Demian (1919), Siddhartha (1922), Journey to the East (1932) – এই উপন্যাসের কোনোটিই টেনেটুনে ২০০ পৃষ্ঠার ওপরে যায় না। অতো দূরে যাই কেন? আগুন-পাখি (২০০৬) আর সাবিত্রী-উপাখ্যান (২০১৩) প্রকাশের আগে হাসান (হাসান আজিজুল হক, জ. ১৯৩৯) তো শুধুই ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। উপন্যাসের আগুন যে তাঁর লেখকসত্তার ভেতরে এমন ধিকিধিকি করে জ্বলছিল, সেইটি তখন কেই-বা বুঝতে পেরেছিলেন? আবার অসীম রায়কে (১৯২৭-৮৬) দেখুন। লিখতেন কবিতা, তারপরে এলেন কথাসাহিত্যে। নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘নবীন যৌবনের এনার্জি-তে সাত মাস ধরে… ‘গোপাল দেব’ লিখলাম। চবিবশ বছরে ‘একালের কথা’, ছাবিবশে ‘গোপাল দেব’। সমস্ত ষাটের দশক জুড়ে প্রাণদায়িণী আলিঙ্গনে উপন্যাস আমাকে বেঁধে ফেলল। আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা, অভিজ্ঞতা ঢেলে দিলাম ‘দেশদ্রোহী’, ‘শব্দের খাঁচায়’, ‘আবহমানকাল’-এ। লেখকের পরাক্রম যে-সমস্ত বাধাবিপত্তি চূর্ণ করে তাকে দাঁড় করায়, বছরের পর বছর ধরে উপন্যাসচর্চা এই আত্মবিশ্বাসের পথে আমাকে নিয়ে যায়। কিন্তু গল্পে তখনও আসিনি।’ এর পরপরই জানিয়েছিলেন, ‘গল্প সম্পর্কে আমার মধ্যে একটা স্ববিরোধ ছিল। গল্প যেন একশো মিটার দৌড়। আর আমি চাই নিরবচ্ছিন্ন ম্যারাথন, যার আধার উপন্যাস।’

 

তিন

রশীদ করীম তাঁর গল্প-রচনা বিষয়ে তেমন কিছু বলেননি, যদিও কারণ হিসেবে বাল্যসখীর বিয়ের একটা অজুহাত দাঁড় করিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটি আদতেই কি এতোটা সরল? প্রথম প্রেম (প্রথম প্রকাশ ১৯৮৪; দ্বিতীয় সাহিত্য প্রকাশ মুদ্রণ ২০০২) গ্রন্থে দুটি গল্প পাচ্ছি, যেগুলোর রচনাকাল দেওয়া রয়েছে ১৯৪৫, তাও কিনা একটা প্রকান্ড জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্ন দিয়ে। তার মানে লেখক নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না। এই গল্পদুটি হচ্ছে – ‘কাহিনী নয়’ ও ‘চিঠি রসুলপুর : ১৫ই আশ্বিন’। গল্পগুলি আকারেও ছোট, নিটোল ধরনের কাহিনি একটা রয়েছে বটে, ‘সবে যাত্রা হলো শুরু’ কিংবা ‘আর নয়… আমার লেখনী রুদ্ধ হয়ে আসছে’ – জাতীয় রোমান্টিকতাও রয়েছে। কিন্তু গল্পদুটির আসল শক্তি অন্যখানে। সেইটি হচ্ছে লেখকের ভাষা-নির্মাণের শক্তি। বলা যায়, সেই শক্তির জোরেই ভাবাবেগাক্রান্ত অতিপরিচিত কাহিনিও যেন অন্যরকম হয়ে উঠেছে, এই অন্যরকমটি একেবারেই নতুন-রকম। তাই বলে আমরা ইলিয়াসের (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : ১৯৪৩-৯৭) কথা অস্বীকার করছি না যে, ‘গল্পের কাঠামো, বিষয়বস্ত্ত, লিপিকৌশল – এর সবগুলো নিয়েই গল্প, তাই সবগুলোর ওপরেই জোর দিতে হয়।’ সেই জোরটুকু সাধ্যমতো রশীদ করীম কিন্তু দিয়েছেন। যদিও তাঁর এই গল্পে ইভান তুর্গেনিভের একটা ছায়া দেখা যায়। মতলুবের সঙ্গে সাজেদার বিয়ের সম্ভাবনা যখন সাজেদার আত্মীয়-স্বজনেরা মানতে পারছে না, তখন দেখতে পাই সবচাইতে ভীত হয়ে ওঠেন সাজেদার নানিআম্মা। কেন? কারণ ‘নানিআম্মা সবচাইতে ভয় পেয়েছেন, সাজেদার অধুনা জাগ্রত ধর্মপরায়ণতায়। মেয়ে এই বয়সে নামাজ পড়তে আরম্ভ করেছে, ওর হবে কি? বুড়িমার মতো আধরাত পর্যন্ত নামাজ পড়া কি বাপু তোকে সাজে? তোর এখন হাসি-ঠাট্টা-মস্করা করার বয়স, তাতো নয়, বেটি ফকিরি লাভের ফিকিরে আছে।’ (পৃ ৮৯)। ঠিক একই রকম আচরণ করেছিলেন তুর্গেনিভের A House of Gentlefolk-এর Marfa Timofyevna, যখন লিজা তাঁকে জানায় যে, সে কনভেন্টে যাবে, সন্ন্যাসিনীর ব্রত নিয়ে তখন : ‘She is ill, she is raving, she thought : we must send for a doctor; but for which one?… But when she was convinced that Lisa was not ill… Marfa Timofyevna was alarmed and distressed in earnest. ‘But you don’t know, my darling… what a life it is in those convents!… they would feed you, my own, on green hemp oil, and they would put you in the coarsest coarsest linen, and make you go about in the cold; you will never be able to bear all that, Lisa, darling… At least, let me die in peace, and then do as you like. And who has ever heard of such a thing… — for the sake of a man — to go into a convent!’ প্রেমের ব্যর্থতাকে নিজের চরম ভবিতব্য বলে মেনে নিয়ে লিজা এভাবে আত্মবিনাশের পথ বেছে নেয়।

 

চার

ভাষার যে-সংহতি, যে-ঐক্যের কথা বলা হয়ে থাকে, সেটি রশীদ করীমের প্রথম পর্যায়ের গল্পদুটিতেও আমরা দেখতে পাই। যেমন : ‘নানিআম্মার আপত্তি বিশেষ বাধার সৃষ্টি করতে পারলো না। সাজেদাকে সমস্ত অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। বাড়িসুদ্ধ লোক যখন তার মনের দিকে নজর দিলো না, তখন সে তার পোড়া নসিবকেই মেনে নেবে সঙ্কল্প করলো। এমন দুর্নিবার অভিমান তাকে পেয়ে বসলো যে নিজেকে পীড়িত ও দহন করতে সে এক অদ্ভুত সুখলাভ করতে লাগলো। আত্মবিনাশেও যে আনন্দ থাকতে পারে সে অভিজ্ঞতা সাজেদার এই সর্বপ্রথম হলো। কেমন যেন এক নেশাগ্রস্ত আচ্ছন্ন ভাব, বুক পুড়ে যায়, তবু ভালো লাগে। মদের মতো।’ খুবই সচেতনভাবে রশীদ করীম এই ভাষা-নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। এইটা অতর্কিতে অর্জন করবার মতো কোনো দৈব ঘটনা নয়। কারণ, ‘চিঠি রসুলপুর : ১৫ই আশ্বিন’ গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা আর সেখানে চরিত্রটি (যার নাম জানতে পারি গল্পের শেষে : মুশতাক) নিজে-নিজে উপলব্ধি করছে : ‘আমি বুঝলাম… বিলক্ষণ… শব্দটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। ভাষা সম্বন্ধে অতঃপর সতর্ক হতে হবে!’ লেখার ভাষা বিষয়ে এই সতর্কতা আমৃত্যু রশীদ করীমের মধ্যে ছিল।

আমাদের কি মনে রয়েছে তাঁর আমার যত গ্লানি (প্রথম প্রকাশ, ১৯৭৩) উপন্যাসটির শুরুর বাক্যগুলো? শুরুটা ছিল এরকম : ‘আমি লোকটা আসলে একটি খচ্চর; যদিও আমার বাপ মোটের উপর ভালই ছিলেন। ভাল না বলে সজ্জন শব্দটিই ব্যবহার করতে পারতাম, কিন্তু কোথাও একটা বাধা পেলাম। তিনি যদি আর একটু অবস্থাপন্ন হতেন, তাহলে ঐ সম্ভ্রান্ত শব্দটিই ব্যবহার করা চলত’ (মুক্তধারা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৬)। কাহিনির ভাষা-নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন তেমনি ব্যবহারের বেলায়ও যে-সচেতনতা আমাদের কাম্য তা রশীদ করীমের রচনায় দেখতে পেয়ে ভালো লাগে। এই গল্পদুটিকে এই সংকলনে জায়গা দিয়েছিলেন  – তাঁর ভাষায়, ‘শুধু একটা দীর্ঘশ্বাসকে ধরে রাখবার জন্য। সেই প্রথম জীবনে… গল্পগুলো লিখেছিলাম।’

পাঁচ

‘জোড়াতালি দিয়ে গল্প’টি মূলত একটি ভ্রমণ-কাহিনি। তা-না হলে এটিকে জোড়াতালির গল্পই বলতে হয়। অবশ্য সবকিছুতেই যদি খেলনা বানানো যায় তাহলে গল্পই-বা বানানো যাবে না কেন? কিন্তু এই গল্পটিই প্রমাণ করে যে, গল্প-রচনা করতে গিয়ে রশীদ করীমের নাভিশ্বাস উঠতো। তা না হলে বহুবার বলা গল্প এভাবে বলতেন! লেখক-বন্ধুদের সঙ্গে রাজশাহীতে সাহিত্য-আসরে যোগ দিতে যাওয়া, সে-প্রসঙ্গ ধরে চলে আসেন আবুল হোসেন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, শওকত আলী, অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা প্রমুখ; আবার  এসবের সূত্রেই লেখকের নিজের অতীতের স্মৃতিচারণা, তাঁর অল্পবয়সের চাকরি-জীবনের হালহকিকত, একই সঙ্গে কত কিছুই-না উঠে এসেছে। তবে এতে নতুন কিছুই নেই। এই ঘটনাগুলোই নানা জায়গায় নানাভাবে রশীদ করীম বিভিন্ন সময়ে পাঠককে জানিয়েছেন। তাহলে গল্প কোথায়? সভা শেষে যেখন একটি মেয়ে অনেক ভিড় ঠেলে রশীদ করীমের কাছে অটোগ্রাফ নিতে এসে আশীর্বাদ চাইলো, গল্প কি সেখানে ছিল, নাকি যেখানে লেখক বলছেন, ‘তিলে খচ্চর শুনলেই এমন একটি লোকের কথা মনে পড়ে যার মাথায় কদম-ছাঁট চুল; মাথা থেকে মুখের ওপর সর্ষের তেল চুঁইয়ে পড়ছে; লোকটিকে কালো, বেঁটেখাটো আর লিকলিকে হতে হবে; একটা চোখ ট্যারা; এবং একটি পা সামান্য খোঁড়া, লেংচেলেংচে হাঁটে। অনবরত পান খায়।’ (পৃ ৫২)  এই গল্পের শেষে রহস্য রেখে দেন রশীদ করীম। বোধহয়  এরকমটি করে তিনি আনন্দ পেতেন। তাছাড়াও ভিটগেনস্টাইন (Ludwig Wittgenstein : 1889-1951) বলেছিলেন, ‘A serious and good philosophical work could be written consisting entirely of jokes.’। শুধু দর্শনশাস্ত্রের ক্ষেত্রে নয়; সাহিত্যের বেলাতেও কথাটি দারুণভাবে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। পাঠক-সমালোচকের সঙ্গে একধরনের চোর-পুলিশ খেলা-পড়া-খেলা। তবে এই লেখা-খেলা-লেখার মধ্যে পাঠক আনন্দের পাশাপাশি ভাবনার খোরাকও পাবেন; যার মূল্য মোটেও কম নয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন বিশ্বাস করতেন, ‘ভাবনারহিত কথামালা বেশিদূর যেতে পারে না, রঙের একটুখানি ঝিলিক দেখিয়ে তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, তার আর চিহ্নমাত্র থাকে না।’ রশীদ করীমের ‘জোড়াতালি দিয়ে গল্প’ এদিক থেকে অবশ্যই আলাদা; কেননা, পাঠশেষেও সেটি পাঠকের মনে নানান চিহ্ন রেখে যায়।

 

ছয়

‘মৃত্যু সংবাদের পর দু’ঘণ্টা’ গল্পটিও বেশ খানিকটা আত্মজৈবনিক। তবে গল্পটিতে লেখকের মনোযোগের অভাব প্রকটভাবেই চোখে পড়ে। হাবীবের বড়ভাই ভালো মানুষ, হাবীবকে খুব স্নেহ করতেন, হাবীব ঢাকায় থাকলেও তিনি কলকাতায় থাকতেন, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। গল্প পড়তে গিয়ে মনে হয় হাবীবের পারিবারিক-জীবনে অর্থের সাচ্ছল্য নেই, সে তার চাকরি নিয়েও সংকটে রয়েছে। যেমন : ‘দু-রকমের কর্মচারীর কাজের ওপর… কড়া চোখ রাখা হয়। যাকে প্রমোশন দেয়ার কথা চিন্তা হচ্ছে এবং যাকে সরিয়ে ফেলার কথা ভাবা হচ্ছে। হাবীব জানে না সে কোন দলে। তবে প্রমোশনের উপর তার এক ফোঁটা লোভ নেই। সে সম্ভাবনাও কম; কিন্তু সরিয়ে ফেললে উদ্বেগের কারণ আছে। কারণ চাকরিটা তার দরকার।’ (পৃ ৫৪) আর কাহিনির শেষদিকে দেখতে পাচ্ছি হাবীব অফিসে যাচ্ছে নিজের গাড়িতে চড়ে, আর ড্রাইভারকেও শেষ পর্যন্ত গাড়ি ঘোরাতে আদেশ দিচ্ছে। বড় ভাইয়ের মৃত্যু-সংবাদ বইয়ে নিয়ে অফিসে সে যাবে না! তার বড়ো ভাইয়ের মৃত্যু-সংবাদও রেডিওতে নিউজ হয়; তার মানে কেউকাটা-ধরনের কেউ ছিলেন। বড়ো ভাই বিষয়ে এতো কিছু জানা যায়, তিনি কী করতেন সেই সংবাদটা জানা যায় না। আবার এক জায়গায় বলা হচ্ছে, ‘বড় ভাইয়ার ফ্ল্যাটে কামরা মাত্র দুটি। বাথরুম মাত্তর একটা।’ (পৃ ৬৩) এটিকে মনে হয় আক্ষরিক অর্থেই টেনেটুনে লেখা গল্প। ‘গাছে আটকা ঘুড়ি’কে মনে হয় টাটকা গল্প; শুধুই টাটকা নয়, অনেকটা জ্যান্ত লেখা। লেখকের আবেগ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা আর গদ্যের জোরে একটি গল্প কীভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে, এই গল্পটি তার নিদর্শন হয়ে থাকবে। একটি বালকের ঘুড়ির প্রতি আগ্রহকে কেন্দ্র করে একটি এলাকা, তার আশপাশের মানুষজন, নারী-পুরুষ – সব যেন ফিল্মের দৃশ্যের মতো পাঠকের সামনে ভেসে ওঠে। সেই ছেলেটি, যার নাম দেওয়া হয় শাকুর, তাকে টাকা দিতে চাইলেও সে নিতে অস্বীকার করে : ‘আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। টাকার ওপর ছেলেটার কোনো লোভ নেই। দোকানের ঘুড়িও সে চায় না। সে শুধু চায়, গাছে আটকা ঘুড়ি।’ (পৃ ৭৩) এই গল্পটির শুরু শহর ঢাকার আশ্বিনের এক সকাল দিয়ে। রশীদ করীমের প্রেম একটি লাল গোলাপ উপন্যাসেও দেখি সকালবেলা সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘সকালবেলার হাওয়ার অনেক গুণ… বুদ্ধিটাকে দিব্যি সাফ করে দেয়।’ (উপন্যাস-সমগ্র, পৃ ৫১৪) তো সেই সকালবেলাতেই দেখা গেল একটি বালক গাছে আটকানো ঘুড়ি পারতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। এই দৃশ্য দেখতে গিয়ে লেখক/ কথক তাঁর চারতলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে চারপাশের এলাকায় দৃষ্টি বুলিয়ে আসেন। তখন  ‘কোনোদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। পথে একটি লোকও চোখে পড়বে না। পাড়াটা এখনো ঘুমিয়ে আছে।’ (পৃ ৬৭)  কোথাও একতলার এক মহিলা বাড়ির বাগানে এসে দাঁড়িয়েছেন। লেখকের বিবরণে, ‘বিশ পঁচিশ বয়স হবে। দেখতে ভালো। শরীরের বাঁধুনি আরও ভালো।… আমার অনুমান তিনি বাড়িঅলার গরিব আত্মীয়। কিছুদিন হলো এসেছেন।… গরম বলেই হোক কিংবা অভ্যেস নেই বলেই হোক, ভদ্রমহিলা ব্লাউজ পরেন নি। মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। বুকের একপাশ থেকে অাঁচল সরে গেছে। পাশ দিয়ে সুডৌল স্তন দেখা যাচ্ছে। সেদিকে চোখ না গিয়ে উপায় নেই। সাধারণত গ্রামের মেয়েদের বুক খুব ভালো হয়।’ (পৃ ৬৯) শরীর নিয়ে, বিশেষ করে নারী-শরীর নিয়ে রশীদ করীমের আগ্রহটি কখনো-কখনো অবসেশনে পরিণত হয়েছিল, এখানেও তার নমুনা দেখতে পাচ্ছি। আর তাঁর সব মহিলাই ফর্সা কিংবা সুন্দরী। এই গল্পেও দেখা যায়, ‘পাঁচিলের ওপাশে একতলা টিনের ঘর। সেই ঘরটির জানালা খুলে গেল।… একজন তিরিশ-বত্রিশ বছরের মহিলা। তিনি ফর্সা। মুখটি খুব সুন্দর।’ (পৃ ৭০) এমনকি বাচ্চা মেয়ে হলেও তাকে সুন্দরীর জায়গায় ফুটফুটে হতে হবে, হতে হবেই। ওই গল্পেই আছে, ‘আমি যেখানটাতে বসে লিখিটিখি সেখান থেকে খোলা জানালা দিয়ে রাস্তার ওপারে একটি তেতলা বাড়ির সামনের বারান্দা দেখা যায়।… একজন ইঞ্জিনিয়ার থাকেন বলে শুনেছি। স্ত্রী এবং তিন চার বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার।’ (পৃ ৭১)

‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’ গল্পের শুরুতেই যে-ভদ্রমহিলার কথা রয়েছে, তিনিও ‘ফর্সা, খুবই ফর্সা… দুধে-আলতা রঙ যাকে বলে তাই।… তাঁকে দেখলেই একটা টকটকে লাল গোলাপ ফুল ফুটে ওঠে আমার চোখের সামনে। না ঠিক বললাম না। সাদা গোলাপ আর লাল গোলাপের পাপড়িগুলো ছিঁড়ে যদি একটি লাল-সাদা গোলাপ তৈরি করা সম্ভব হতো, তাহলেই তুলনা চলতো, এই মহিলার সঙ্গে।’ (পৃ ১৩) মহিলার বয়স কিন্তু চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। সেই মহিলার প্রেমে পড়েছেন কথক/ লেখক : মহিলা ‘ঘরে যখন থাকেন, ব্রা রাখেন না গায়ে। গরম লাগে। পাতলা ব্লাউজের বোতামগুলো খুলতেই, দুই দরজার মাঝখানে দুধ দুটির মুখ দেখা গেল। একটু বয়স্ক স্তন বটে। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, এখনো স্বাস্থ্য আছে, রূপ আছে।’ (পৃ ১৮) এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে, তিনি যে বলেছিলেন, ‘সাধারণত গ্রামের মেয়েদের বুক খুব ভালো হয়’ – সে-কথাটি তো আর টিকছেই না। স্তনের আবার শহর-গ্রাম আছে কি না আমাদের জানা নেই। তবে ধনী-দরিদ্র ভেদ যে আছে, – সেইটি আশা করি, কম-বেশি অনেকেই মানবেন। এই গল্পে কথক, সেই রূপসী মহিলাকে কল্পনায় নিজের প্রৌঢ়া স্ত্রীর জায়গায় বসিয়ে, খেলাও করতে থাকেন। যখন একদিন সকালে তাঁর স্ত্রী নববধূর লজ্জা নিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘কাল তোমার হয়েছিল কি বলতো?… আমাকে তো জখম করেই ফেলেছো।… হঠাৎ তোমার শরীর অমন থৈ-থৈ করতে শুরু করেছে কেন?’ এইবার কথক যেন চেতনাপ্রাপ্ত হয়ে ওঠেন, অফিসে যাওয়ার পথে তাঁর মনে হয়, ‘নিজের স্ত্রীকে ওভাবে অপমান করা ঠিক হয় নি।’ (পৃ ২০) আর ঠিক এইভাবেই রশীদ করীম তাঁর লেখায় মাত্রাবোধের পরিচয় দেন। এই যে মাত্রাবোধের কথা বলছি সেইটি তিনি কিছুতেই ছাড়িয়ে যান না। তাঁর ওই প্রেমে-পড়া মহিলার বুকের কথা বলতে গিয়ে যখন ‘দুধ’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন প্রথম চোটে ধাক্কা খেলেও পরে মনে হয় যে, এইখানেও লেখক বাড়াবাড়ি করেননি, বরং শব্দ-ব্যবহারে নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। কেননা, যে-মহিলার কথা তিনি বলছেন, সেই মহিলা ‘গুটি কয়েক ছেলেমেয়ের মা’; যার কারণে শব্দটি অশ্লীল ঠেকেনি। ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’ গল্পে যেমন তেমনি এই নামের উপন্যাসটিতেও মেয়ে-শরীর নিয়ে লেখকের একইরকম খেয়ালিপনা দেখি : ‘উমরেরই পীড়াপীড়িতে রানুকে হাত-কাটা বুক-খোলা ব্লাউজ বানাতে হয়েছে। এ ব্লাউজ পরে সে রানুকে বাইরে যেতে দেয় না।’ কেন এইরকম আচরণ? লেখক জানিয়েছেন, ‘উমর স্তনের একটুখানি আভাস দেখবে, রানু যখন ঘরময় কাজ করে বেড়াবে।’ শুধু এইখানেই এর শেষ নয়। লেখক আরো বলেন, উমরের ‘আর এক আজগুবি ইচ্ছে। রানুর বাহুমূল দেখতে ভালোবাসে সে। বাহুমূলে উমর যে কী সৌন্দর্য খুঁজে পায় সে-ই জানে। কোনো কোনোদিন প্রায় উন্মাদের মতো ঘ্রাণ নেয়। বলে, এই ঘ্রাণে আমার নেশা হয়।’ (রশীদ করীমের উপন্যাস-সমগ্র, পৃ ৫২৪-৫২৫) এখানেও কি মাত্রা-রেখার সীমা অতিক্রম করেন লেখক? উত্তরটি পেয়ে যাই এর পরের দুটি বাক্যে : ‘প্রথম প্রথম রানু লজ্জা করতো, পরে আপত্তি করতো – এখন সুযোগ নেয়। আহা, স্বামীই তো। সে কী না করতে পারে। তার সঙ্গে কী না করা যায়!’ এই গল্পের শেষেও পাঠকের সঙ্গে লেখকের সেই একই রহস্য-রহস্য খেলা। কথক বলছেন, ‘আপনারা ভাবছেন, আচ্ছা লোক তো, স্ত্রীকে একটুও ভালোবাসে না; কেবল পরস্ত্রীর ওপর লোভ। কিন্তু ভুল করলেন। স্ত্রীকে আমি ভালবাসি খুবই… তাহলে ঐ মেয়েটি?… হ্যাঁ তাকেও ভালো লাগে? কি করে সম্ভব? সেটাই আপনাদের বোঝাতে পারবো না যদি না নিজ থেকেই বোঝেন। সত্যিই কি বুঝতে পারছেন না?’ (পৃ ২৩) এখানে আবার চল্লিশ পেরোনো ‘মহিলা’ লেখকের কাছে মেয়ে-হয়ে-ওঠেন! খুব সহজে লেখকের এই মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা কঠিন।

 

সাত

অসীম রায় তাঁর ‘টমাস মানের সঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছিলেন, একজন ‘লেখক তাঁর জগতে যেভাবে হাঁটেন চলেন ফেরেন, তাঁর স্বকীয় ব্যক্তিত্ব, তাঁর বিশেষ মেজাজের ছায়াপথ সমস্ত লেখাতেই প্রতিভাত।’ রশীদ করীমের বেলাতেও তার খুব-একটা অন্যথা হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়নি। অন্তত তাঁর উপন্যাস থেকে উদাহরণ সে-কথাই প্রমাণ করে। রশীদ করীমের লেখক-সত্তার ভেতরেই এইটি গ্রথিত ছিল। আমার যত গ্লানি উপন্যাসের শুরুতে যে রয়েছে, ‘আমি লোকটা আসলে একটি খচ্চর’ – কখনো-কখনো মনে হয়েছে মানুষের ভেতরকার খচরামিগুলো দেখাতে রশীদ করীম আনন্দ পেতেন। এই আনন্দের মধ্যে যে এক ধরনের গ্লানিও রয়েছে সেইটি বোধকরি তিনি নিজেও বুঝতেন। বুঝতেন কি? গোর্কি (Maxim Gorky : 1868-1936) তাঁর এক স্মৃতিকথায় আন্তন চেখভ সম্পর্কে বলেছিলেন : His enemy was vulgarity. All his life he fought against it, held it up to scorn, displayed it with a keen impartial pen, discovering the fungus of vulgarity even where, at first glance, everything seemed to be ordered for the best, the most convenient, and even brilliant.’। কথাসাহিত্যিক রশীদ করীম সম্পর্কে যদি এই কথাগুলিই হুবহু উদ্ধৃত করি, তাহলে, বাড়াবাড়ি মনে হবে না মোটেও।