রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও উত্তরকাল

বিশ্বজিৎ ঘোষ

১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী শীর্ষক গ্রন্থের সম্পাদকীয় ভূমিকার আরম্ভটা ছিল এরকম – ‘একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারী এমনি এক যুগান্তকারী দিন। শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশে ফেব্রুয়ারী সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুনিয়ার মানুষ হতচকিত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের শক্তিতে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ভাষার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের এই বিশ্ব-ঐতিহাসিক আত্মত্যাগে। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দুনিয়াজোড়া মানুষের যুগ যুগ ব্যাপী যে সংগ্রাম, একুশে ফেব্রুয়ারী তাকে এক নতুন চেতনায় উন্নীত করেছে।’১ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে একুশের আবির্ভাব ছিল, প্রকৃত প্রস্তাবেই, একটি যুগান্তের সূচনা। সম্পাদকের ওই ভূমিকাংশে একুশে ফেব্রুয়ারি তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মৌল চারিত্র্য যেমন উন্মোচিত, তেমনি প্রকাশিত এই আন্দোলনে ভবিষ্যৎবিস্তারী প্রভাবের পূর্বাভাস। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছে নতুন পথের সন্ধান, নির্মাণ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন সড়ক।
ভাষাভিত্তিক একটি জাতি হিসেবে বাঙালির ঐতিহাসিক আত্মপ্রকাশের ইতিহাসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যথার্থই একটি মহত্তম দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির আত্মজাগরণের দিন, স্বাধিকারের স্বপ্ন বপনের দিন, আপন সত্তাকে বিপুল মহিমায় ঘোষণা করার দিন, সংঘশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারণের দিন। বাস্তিল দিবসে ফরাসি জাতি শত বছরের গ্ল­ানি মুছে যেমন লাভ করেছিল নবজন্ম, তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিল তার আত্মপরিচয়ের নতুন ঠিকানা। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন প্রধানত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও পরিণতিতে তা জাতিসত্তার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনাউৎস হিসেবে পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা।
বায়ান্ন সালে ভাষা-আন্দোলন সফল পরিণতি লাভ করলেও, এ-আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল দেশবিভাগের অব্যবহিত পরেই। অবশ্য গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী, এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলেছে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে এ-বিতর্কের এক ধরনের মীমাংসা হয়ে যায়। ১৯১৮ সালে মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মুহম্মদ শহীদুল্ল­াহ্ এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ পরিষ্কার অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা।
মাউন্টব্যাটেন-পরিকল্পনা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে – এ-প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। এ সময় মুহম্মদ শহীদু­ল্লাহ্ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। তরুণ লেখক আবদুল হক এবং মাহবুব জামাল জাহেদীও অনুরূপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মিল্লাত ও ইত্তেহাদ পত্রিকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ এনামুল হক, ফররুখ আহমদ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কাসেম প্রমুখ ব্যক্তি অভিন্ন দাবির সমর্থনে লেখা প্রকাশ করেন; একই দাবির পক্ষে সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে তমদ্দুন মজলিস। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসেই গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।
সাতচল্লি­শ সালে দেশবিভাগের পরে বাংলা ভাষা সম্পর্কে বাঙালির এই আবেগকে আমলে নিতে চায়নি মুসলিম লীগ সরকার। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের ব্যবহার্য ভাষা ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু চালাবার সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। কুমিল্ল­ার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি সংশোধনী প্রস্তাবে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার্য ভাষা করার দাবি তোলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রূঢ় ভাষায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গণপরিষদে কেবল ব্যবহার্য ভাষা নয়, ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন বলে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তিরস্কৃতও হন। প্রধানমন্ত্রীর এই আচরণের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন – ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সূচিত হয় রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন। অভিন্ন দাবিতে যশোরসহ পূর্ব বাংলার নানা শহরে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এ পটভূমিতে মুহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় ঘোষণা করেন – উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ ধ্বনি তুলে জিন্নাহর ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং এভাবে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন অর্জন করে নতুন মাত্রা।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ – এই চার বছরে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন স্পষ্ট কর্মসূচির অভাবে আস্তে আস্তে থিতিয়ে পড়ে। প্রতিবছর ১১ মার্চ ভাষা-আন্দোলনের বার্ষিকী পালিত হলেও, এ-বিষয়ে তেমন কোনো সাংগঠনিক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন আবার ঘোষণা করেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, থিতিয়ে পড়া রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন পায় নতুন গতি – ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে যা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে – সৃষ্টি হয় বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়, বিশ্বমানবের উজ্জ্বল এক উত্তরাধিকার।
১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনে রক্তাক্ত বিজয়ের পরেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে থামিয়ে রাখার নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে
প্রকাশ্যে-গোপনে। পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয় ১৯৫৪ সালের মে মাসে, যুক্তফ্রন্টের কাছে সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবে বলা হয় যে, বিশ বছর পরে এ-সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। ১৯৬২ সালে গৃহীত পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধানে আবারও বিশ বছরের অপেক্ষার পালা ঘোষিত হয়। কিন্তু বিশ বছর আর অপেক্ষা করতে হয়নি। দশ বছরের মধ্যেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে ঘোষিত হয় ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।
১৯৪৭ থেকে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পেলেও কালক্রমে আন্দোলনটি ভাষা-আন্দোলন নামে ব্যাপকভাবে অভিধা পায়। সন্দেহ নেই, এই রূপান্তর রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের চারিত্র্য, লক্ষ্য ও তাৎপর্যকে খর্ব করেছে। খর্বকরণের পেছনেও আছে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির কারসাজি, আছে তাদের কেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র। রাষ্ট্রভাষা বললে যে-ব্যাপকতা আসে, পাকিস্তানের চাকরি-প্রশাসন-আইন-আদালতে বাংলা ভাষার যে-সম্ভাবনা তৈরি হয়,
ভাষা-আন্দোলন বললে তা কিছুতেই হয় না। একই ধারাবাহিকতায় চলছে বাংলাদেশের চেনাবাহিনীর কর্মকা- – তাই বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েও প্রকাশ্যেই নির্বাসনে যাচ্ছে সরকারি কর্মকা- থেকে, রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান থেকে।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, পূর্বেই ব্যক্ত হয়েছে যে, প্রথমে ছিল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। কিন্তু কালক্রমে এ-আন্দোলন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপপরিগ্রহ করে।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করা। তবে একই সঙ্গে এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল পূর্ববাংলার জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে ন্যায়বিচারের চেতনার স্বীকৃতিলাভ। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন পরিণতিতে রূপান্তরিত হয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে – রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হয়েছিল জাতি-রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন এই আকাক্সক্ষা ধাপে ধাপে রূপপরিগ্রহ করে। বায়ান্ন সালের রক্তাক্ত ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে যে-চেতনা রূপলাভ করে, উত্তরকালে প্রতি ফেব্রুয়ারিতে তা হয়ে ওঠে বলয়িত, হয়ে ওঠে গভীর ব্যাপক সুদূরসঞ্চারী। প্রতিবছরের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালিকে নতুন শপথে প্রদীপ্ত করে তুলেছে, তার চেতনায় সঞ্চারিত করেছে নতুন মাত্রা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা, আওয়ামী লীগের ছয় দফা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চোদ্দো দফা, ছাত্রসংগ্রাম কমিটির এগারো দফা, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন – সবই ঘটেছে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের অন্তর্গূঢ় প্রেরণায়, একুশে ফেব্রুয়ারির কালজয়ী চেতনা বিকাশের ধারাবাহিকতায়।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে তাদের মতাদর্শের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা এখানে জরুরি কাজ বলে মনে করি। যেসব রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় ছিল, সেগুলোকে নিম্নোক্তভাবে বিন্যাস করা যায় –
ক. বিপ্ল­বী সাম্যবাদী রাজনীতির অনুসারীরা এবং তাদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি, যুবলীগ ও ছাত্র ফেডারেশন।
খ. পাশ্চাত্য বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অনুসারীবৃন্দ (শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবদুস সালাম, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ), যাঁদের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের মধ্যে দুটি শক্তিশালী ধারা গড়ে ওঠে – এই ধারাদ্বয়ই ক্রমে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং মুসলিম ছাত্রলীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীকালে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে ধারাদ্বয় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ নামে কর্মকা- পরিচালনা করে।
গ. ইসলামী সাম্যবাদী চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত তমদ্দুন মজলিস ও ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ (অবশ্য ইসলামী সাম্যবাদী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন পৃথক একটি রাজনৈতিক উপধারাও আওয়ামী মুসলিম লিগের অভ্যন্তরে সক্রিয় ছিল।)২ রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দল, তাদের কর্মসূচি, নেতৃবৃন্দের ভাষণ, বক্তৃতা, প্রচারপুস্তিকা, পুলিশি রিপোর্ট – এসব বিশ্লে­ষণ করে উপর্যুক্ত বিন্যাসের যৌক্তিকতা সহজেই প্রমাণ করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান সৃষ্টির পাঁচ বছরের মধ্যে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এতগুলো শক্তির ঐক্য ও সহাবস্থান কীভাবে সম্ভব হয়ে উঠল?
তৎকালীন ইতিহাসের দিকে তাকালে উপর্যুক্ত জিজ্ঞাসার সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নবাব-নিয়ন্ত্রিত মুসলিম লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। নবাবরা আশরাফ মুসলমান হিসেবে প্রথম থেকেই উর্দু ভাষাকে নিজেদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। পক্ষান্তরে সচ্ছল কৃষকের সন্তান পূর্ব বাংলার নবজাগ্রত মুসলমান মধ্যবিত্ত বাঙালিরা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে বাংলা ও ইংরেজি ভাষাকেই গ্রহণ করেছিল। বাংলা কিংবা ইংরেজি ছাড়া বাঙালির পক্ষে চাকরি করা ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো প্রায় অসম্ভব ছিল। উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব অতিদ্রুত নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের পক্ষে নিয়ে আসেন। অপরদিকে দলের সাধারণ সদস্যরা ছিলেন বাংলাভাষী, ফলে তারাও স্বেচ্ছায় সংযুক্ত হন রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে। সাধারণ কৃষকসন্তানদের ভাষা-আন্দোলনে শামিল করানোর ক্ষেত্রে ধর্মীয় সাম্যবাদী ও বিপ্ল­বী সাম্যবাদী মতাদর্শের নেতৃত্ব ভাষা-আন্দোলনের পক্ষে টেনে নিয়ে আসতে সফল হয়েছিলেন। এসব শক্তির সমবায়েই গড়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে ব্যাপক জাতীয় ঐক্য।
উত্তরকালে ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লি­ষ্ট রাজনৈতিক শক্তিসমূহের নানামাত্রিক রূপান্তর ঘটেছে। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের চেতনা যতই একাত্তরমুখী হয়েছে, ততই রাজনৈতিক দলগুলোর পরিণতি চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। ইসলামি সাম্যবাদী চিন্তার ধারাটি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে, পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে তাদের অনেকে হাত মিলিয়েছেন। এমনকি, তাদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তারা চরম ভুল করেছেন। অপরদিকে বিপ্লবী সাম্যবাদী কমিউনিস্টরা জাতীয় আন্দোলনের নামে কখনো শ্রেণি-আন্দোলন ও নিজেদের স্বাধীন ভূমিকা বিসর্জন দিয়েছেন, আবার কখনো কখনো শ্রেণি-আন্দোলনের নামে জাতীয় আন্দোলনের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এরকম ডান ও বাম বিচ্যুতির ফলে তাদের সম্ভাবনা ও শক্তি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। নেতিবাচক এই প্রবণতার পেছনে আন্তর্জাতিক কেন্দ্রসমূহের ভূমিকার কথাও এখানে আমরা মনে রাখব। ফলে রাষ্ট্রভাষা-উত্তর জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে উঠতি মধ্যবিত্ত সমাজ ও তাদের রাজনৈতিক দল।
সন্দেহ নেই, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ন্যূনতম ইস্যুতে বাঙালির ঐতিহাসিক ঐক্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত। এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন মোটেই নয়। একটি সমসত্ত্ব (যড়সড়মবহবড়ঁং) বা বিরোধহীন নিখাদ আন্দোলন। সাধারণ স্বার্থের কারণে এ-আন্দোলনের স্রোতে মিলিত হয়েছিল ডান ও বামপ্রবাহ। এই প্রবাহ বা ঐক্যই আবার বহন করে দ্বন্দ্বের বীজ। এই দ্বন্দ্বই নির্মাণ করে ভাবীকালের নতুন কোনো আন্দোলন, নতুন কোনো ডিসকোর্স, নতুন কোনো থিসিস বা সন্দর্ভ।

দুই
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনে ভাষা-আন্দোলনের মতো প্রভাবসঞ্চারী কোনো অনুষঙ্গ নেই। উনিশশো বায়ান্ন সালে বাঙালি জাতির রক্তাক্ত উজ্জীবনের অব্যবহিত পরেই, শিল্প-সংস্কৃতির অন্যান্য প্রান্তের মতো, আমাদের সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। বাংলাদেশে এমন কোনো লেখক হয়তো নেই, যিনি ভাষা-আন্দোলন নিয়ে একটি কবিতা-নাটক-ছোটগল্প-উপন্যাস-ছড়া কিংবা প্রবন্ধ লেখেননি। ভাষা-আন্দোলনের মৌল চেতনা আমাদের লেখকদের সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছে; একুশে ফেব্রুয়ারি তাঁদের শুনিয়েছে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাভৈঃ বাণী। বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের বহুমাত্রিক প্রতিফলন ঘটেছে। ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্রীয় বিষয়াংশ নির্বাচন করে যেমন সাহিত্য রচিত হয়েছে, তেমনি আবার ভাষা-আন্দোলনের মৌল চেতনাকে মর্মে ধারণ করে আমাদের সাহিত্যে লেগেছে পালাবদলের হাওয়া। বস্তুত, ভাষা-আন্দোলনই আমাদের সাহিত্যিকদের সামনে তুলে ধরে জাতিসত্তার মৌল পরিচয়, আমাদের গন্তব্যের সঠিক ঠিকানা। তাই সাহিত্যে তার প্রতিফলন ছিল একান্তই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত।
বিগত পঞ্চাশ বছরের (১৯৫২-২০০৭) বাংলাদেশের সাহিত্যে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, সাহস ও সঙ্ঘশক্তি বিমিশ্র অভিব্যক্তি, যা একান্তই আমাদের ভাষা-আন্দোলনের গর্বিত উত্তরাধিকার। অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের যে-প্রতিফলন ঘটেছে, তার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য, রূপ ও রূপান্তর অঙ্কনই বর্তমান প্রবন্ধের অন্বিষ্ট বিষয়। তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরের একটি প্রবন্ধে অর্ধশতাব্দীর সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের প্রতিফলনের রূপ ও রূপান্তর অঙ্কন প্রায় অসম্ভব এক বিষয়। তাই বর্তমান নিবন্ধে বিগত অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের চারিত্র্য ও চেতনা যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা অঙ্কিত হয়েছে। অপ্রধান অনেক বিষয়কে, সজাগ থেকেই, আমি আলোচনায় অনুক্ত রেখেছি; অনুপস্থিত থেকে গেছেন অনেক সাহিত্যিক – বিশেষত কবি, অনেকের নামই এখানে উচ্চারিত হয়নি। আমি ধরতে চেয়েছি মূল স্রোতধারা, দেখাতে চেয়েছি অর্ধশতাব্দীর সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের প্রতিফলনের প্রধান প্রবণতাসমূহ। এ-কারণে জেনেশুনেই আমাকে মেনে নিতে হয়েছে সংক্ষিপ্তির আপাতত অপূর্ণতা।

তিন
সূচনা সূত্রেই উল্লে­খ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটেছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়। আমাদের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ কীভাবে এবং কোন মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে, তা শনাক্তির জন্যে এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা অগ্রসর হতে পারি নিম্নোক্ত ক্রমসূত্রে – ক. কবিতা, খ. উপন্যাস, গ. ছোটগল্প, ঘ. নাটক এবং ঙ. অন্যান্য। লক্ষণীয়, এখানে কেবল সৃষ্টিশীল রচনার কথাই উল্লে­খ করা হয়েছে, বাদ গেছে প্রবন্ধ। প্রবন্ধও, আমি বিবেচনা করি, সৃষ্টিশীল রচনা; তবু এখানে প্রবন্ধকে অন্তর্ভুক্ত করিনি, কারণ প্রবন্ধে প্রতিফলন থাকে না, থাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লে­ষণ ও বিবেচনা।

তিন (এক)
আমাদের সাহিত্যের অন্যান্য শাখা অপেক্ষা কবিতাতেই ভাষা- আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত কবিতার সংখ্যা এখন হিসাবের বাইরে। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আমরা প্রথমেই উল্লে­খ করতে চাই হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী গ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুচ্ছের কথা। ওই সংকলনে পত্রস্থ হয়েছিল এগারোটি কবিতা, আর কবিরা ছিলেন শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গনি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্ল­াহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক এবং হাসান হাফিজুর রহমান। এসব কবির সম্মিলিত শব্দস্রোতে উদ্ভাসিত একুশে ফেব্রুয়ারির কালজয়ী তাৎপর্য, সমবায়ী জাগরণ, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অভ্রান্ত ইঙ্গিত আর অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সঙ্ঘশক্তির প্রতিবাদের উত্তাপ। স্মরণ করা যায়, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক একুশের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার পর আলাউদ্দিন আল আজাদের ছন্দবদ্ধ প্রতিবাদ উন্মথিত জাগরণ –
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটিকা ধুলায় চূর্ণ যে পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য।
ইটের মিনার
ভেঙেছে, ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চারকোটি পরিবার।
(আলাউদ্দিন আল আজাদ, ‘স্মৃতিস্তম্ভ’)
– একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিকে যে ঐক্যবদ্ধ করেছে, তাদের মধ্যে যে জাগ্রত করেছে জাতীয়তাবাদী চেতনা, উপর্যুক্ত কবিতাংশে তারই সংহত উদ্ভাসন ঘটেছে।
হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’ কবিতায় শিল্পিত হয়েছে বাঙালির আত্মজাগরণের ইতিহাস। বরকত সালাম রফিক জব্বার – এইসব থোকা থোকা জ্বলন্ত নাম কীভাবে বাঙালির হৃদয়ে বর্শার ফলার মতো গেঁথে আছে, হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় তার পরিচয় উদ্ভাসিত। দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তকে উন্মাতাল করেছে এইসব শহীদের নাম – যে নাম কখনো বাঙালির হৃদয় থেকে, বাংলাভাষী মানুষের মন থেকে মুছে যাবার নয়। এইসব নামের মহিমাই উচ্চারিত হয় হাসানের কবিতায় –
আবুল বরকত নেই; সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে তাঁকে ডেকো না;
আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুচকে উঠবে –
সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার – কি বিষণœ থোকা থোকা নাম;
এই এক সারি নাম তার বর্শার তীক্ষè ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে;
… … …

যাঁদের হারালাম তাঁরা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, কণা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।
আবুল বরকত, সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার
কি আশ্চর্য, কি বিষণœ নাম। একসার জ্বলন্ত নাম।
(হাসান হাফিজুর রহমান, ‘অমর একুশে’)

বাংলাদেশের সমস্ত প্রান্তকে উন্মাতাল করে দেওয়া একুশের ভিন্নতর এক ব্যঞ্জনা প্রকাশিত হয়েছে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘কোনো এক মাকে’ কবিতায়। খোকা, যে শহীদ হয়েছে ভাষা-আন্দোলনে, আর যে কখনো উড়কি ধানের মুড়কি হাতে প্রতীক্ষারত মায়ের কাছে ফিরে আসবে না, মা তা কিছুতেই বুঝতে চায় না। এ কবিতার শরীরে ও সত্তায় প্রবহমান শহীদের রক্ত-নিংড়ানো আবেগ, যে-আবেগের ধারাজলে স্নাত হয় বাঙালি – খোকার মা হয়ে যায় দেশজননী –
কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝ’রে পড়েছে ডাঁটা;
পুঁইতলাটা নেতানো, –
‘খোকা এলি?’ –
ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠোনে, উঠোনে
যেখানে খোকার শব
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।

এখন,
মা’র চোখে চৈত্রের রোদ
পুড়িয়ে দেয় শকুনিদের।
তারপর,
দাওয়ায় ব’সে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খাই ভাজে,
খোকা তার
কখন আসে! কখন আসে!
এখন,
মার চোখে শিশির ভোর,
স্নেহের রোদে
ভিটে ভরেছে।
(আবু জাফর ওবায়দুল্ল­াহ, ‘কোনো এক মাকে’)

এইভাবে ভাষা-আন্দোলন আমাদের সামূহিক কবিচৈতন্যে নিয়ে আসে নতুন মাত্রা; ভাষা-আন্দোলন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের কবিদের অবিনাশী শিল্প-আয়োজন। যখনি শৃঙ্খলমুক্তির প্রয়োজন আসে, যখনি প্রয়োজন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-উচ্চারণ, কিংবা জনস্রোতের জোয়ার-আগমন – ভাষা-আন্দোলন আর তার শহীদেরা তখনি দ্রোহের ভূমিকায় হয় অবতীর্ণ। ওই অবিনাশী শক্তির উৎস তাই বায়ান্ন-উত্তর বাংলাদেশের কবিতার এক প্রধান অনুষঙ্গ। নির্দিষ্ট কোনো কবি নয়, সকলের ক্ষেত্রেই এ-কথা সত্য, যেমন সত্য শামসুর রাহমানের ‘ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯’ কবিতায় –
বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা
সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা
সালামের মুখে আজ তরুণ শ্যামল পূর্ববাংলা।
(শামসুর রাহমান, ‘ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯’)

একুশের প্রথম সৃষ্টি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতায়ও ধ্বনিত হয় যুগ-পরম্পরায় একুশের অবিনাশী আহ্বান – মৃত্যুকে জয় আর প্রতিবাদে উচ্চকিত হওয়ার আহ্বান। সমুত্থিত বাঙালির সম্মিলিত আবেগ আর ঘৃণা আর প্রতিশোধ-বহ্নি যেন সংহতি লাভ করে একটি কবিতার শতাধিক পঙ্ক্তিস্রোতে –
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।
আজ আমি শোকে বিহ্বল নই
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল।…

হে আমার মৃত ভায়েরা
সেই নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার
ভেসে আসবে
সেইদিন আমাদের দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নি শিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ আর বিজয়ের আনন্দে।
(মাহবুব উল আলম চৌধুরী, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’)

এইভাবে উনিশশো বায়ান্ন-উত্তর কালখ-ে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির প্রতিদিনের পথ চলার পাথেয়। একুশের আর এক নাম হয়ে ওঠে সংক্ষোভ, একুশের অর্থ দাঁড়ায় মাথা-নত-না করা, একুশ হয়ে ওঠে স্বপ্ন আর সম্ভাবনার প্রতীক। অনেক কবিই একুশকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন প্রতীক হিসেবে, যেমন করেন মহাদেব সাহা তাঁর ‘একুশের গান’ কবিতায় –
একুশ মানেই আসছে, স্বপ্ন আসছে, ভবিষ্যৎ আসছে
একুশ মানে অতীত নয়, আগামী
মৃত্যু নয়, জন্ম;
একুশ মানে শহীদদের পায়ের শব্দ
একুশ মানে অজর, অমর, অবিনশ্বর।
(মহাদেব সাহা, ‘একুশের গান’)
প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ কালখ-ে ভাষা-আন্দোলনের এই প্রতিবাদী চেতনা মধ্যআশির স্বৈরবৃত্ত সময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ে; ধাতব অস্ত্রধারী শাসকের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে ভীতির কারণ, যেমন ভীত হয়েছিল পঞ্চাশ-ষাটের সামরিক শাসকরা। একুশে ফেব্রুয়ারি তখন রূপান্তরিত হয় স্মৃতি অনুষঙ্গে। কালিক এই প্রবণতাই কবির শব্দস্রোতে অভিব্যক্ত হয় রূপক ব্যঞ্জনায় –
কবি ও কুকুরদের এইখানে আসতে দিও না।
… … …
আমাদের সুখের নিদ্রায় ওরা বড়ো উৎপাত
কবি ও কুকুরদের দূরে রাখো
বিশেষত এই মাসে,
ওরা শুধু কবরের মাটি খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে।
… … …
মাটিতে ভায়ের লাশ পচে গিয়ে কবে যেন নিমেষে নিঃশেষ
তাদের দেহের মেদ, সকল লাবণ্য মিশে হয়েছে উর্বর
এ বাগান, হায় আমাদের এই জীবনের সকল বাগান।
কবি ও কুকুরদের এইখানে আসতে দিও না।
ওদের নখরে শুধু উঠে আসে স্মৃতির কবর থেকে মৃত
ভায়ের বোনের লাশ, আমাদের সমাহিত স্মৃতির কাফন।
(খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে জনৈক
বাগান মালিক’)

কালিক এই প্রবণতার কারণে প্রতিজ্ঞার কথা উচ্চারিত হয়েও অন্তিমে প্রশ্ন, কিংবা বলি সংশয়, দেখা দেয়। একুশের আন্তরপ্রেরণায়
যে-কবি জনতার সমুদ্রে মিশে গিয়ে যখন সনখ শপথে প্রদীপ্ত হয়ে ওঠেন, তিনিই শেষে বরকতের মতো শহীদ হতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’য় ফুটে ওঠে এই ছবি – ‘আমিও অন্তরঙ্গ হয়ে যাই হঠাৎ তখন/ জনতার সমুদ্রের সাথে/ বাঘের হাতের মতো সনখ শপথ/ সোহাগের গাঢ় ইচ্ছা নিয়ে/ নেমে আসে মনের ওপর!/ নির্মম আদর পেয়ে আমিও রক্তাক্ত হবো/ বরকতের শরীরের মতো?’
(আল মাহমুদ, ‘একুশের কবিতা’)

বায়ান্ন-উত্তরকালে বাংলাভাষা ও বর্ণমালা নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক কবিতা, যা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ভাষা-আন্দোলনের স্বতন্ত্র এক উত্তরাধিকার। বাংলা বর্ণমালাকে কবিরা বিবেচনা করেছেন সত্তার পতাকা হিসেবে। কিন্তু বায়ান্ন-উত্তরকালেও সেই বর্ণমালার অপমান কবিচিত্তে জন্ম দেয় সংক্ষোভ, বর্ণমালার জন্য তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় অফুরান অনুরাগ –
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার
সত্তায়।…
হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে।

তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কি থাকে আমার?
উনিশশো’ বাহান্নোর কতিপয় তরুণের খুনের পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে-ফুলের একটি পাপড়িও আজ ছিঁড়ে নিতে দেবো না কাউকে।

এখন তোমাকে ঘিরে ইতর বেলেল্ল­াপনা চলছে বেদম,
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস।
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
(শামসুর রাহমান, ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’)

ভাষা-আন্দোলনের অব্যবহিত পর থেকে পূর্ববাংলাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা। দেশপ্রেমমূলক এই কবিতা রচনার ধারা ভাষা-আন্দোলনের ভিন্নতর এক প্রতিফলন। ওইসব কবিতার শরীরে ও মর্মে উৎকীর্ণ হয়ে আছে দেশের প্রতি আমাদের কবিদের গভীর অনুরাগের ছবি। প্রকৃতি ও মানুষের মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি, সেই জন্মভূমির ছবি চিত্রিত হয় সৈয়দ আলী আহসানের কবিতায় –
আমার পূর্ব বাংলা এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ
অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
সন্ধ্যার উন্মেষের মতো
সরোবরের অতলের মতো
কালো-কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো
বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি… ॥
(সৈয়দ আলী আহসান, ‘আমার পূর্ব বাংলা’)

সূচনাসূত্রেই আমরা উল্লেখ করেছি, বর্তমান আলোচনায় বাংলাদেশের সকল কবির সৃষ্টিসম্ভার আলোচিত হয়নি; ভাষা-আন্দোলনের প্রতিফলন দেখাতে গিয়ে প্রতিনিধিস্থানীয় কয়েকটি কবিতা গ্রহণ করেছি মাত্র। আমরা দেখাতে চেয়েছি মূল প্রবণতাগুলো, ফলে অনেক কবির নাম এবং তাঁদের কবিতা থেকে গেছে অনুক্ত। তবে অনুচ্চারিত ওই কবিদের রচনাতেও প্রতিফলিত হয়েছে উপর্যুক্ত কোনো-না-কোনো প্রবণতা।
বিগত অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশের কবিতায় ভাষা-আন্দোলনের প্রতিফলনের স্বরূপ অঙ্কনের সময় কয়েকটি পর্যায় আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ-প্রসঙ্গটিই সাঈদ-উর রহমানের ব্যাখ্যায় উঠে আসে এভাবে – ‘প্রথম সামরিক শাসন জারির পূর্ব পর্যন্ত রচিত কবিতায় বিশেষ কোনো বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি; সেগুলোতে পাওয়া যায় একটা অনির্দেশ্য সম্ভাবনার কথা, এবং একটা বেদনাকরুণ ব্যঞ্জনা।… সামরিক শাসন জারি হলে (১৯৫৮) প্রদেশে প্রতিক্রিয়াশীলতার শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং নানাভাবে চেষ্টা চলে আন্দোলনের লক্ষ্যকে বানচাল ও বিপথগামী করার। এই নৈরাজ্যজনক অবস্থা ছায়া ফেলেছে ওই সময়ের কবিতায়। তৎকালের ভাষা-আন্দোলনবিষয়ক কবিতায় লক্ষ করা যায় অসহায়তা ও আশাভঙ্গের চিত্র, কিন্তু সেগুলোতেও বলা হয়েছে, একুশের অপরাজেয় ঐতিহ্যের কথা। তারপর থেকে এই ভাব ক্রমশ কেটে গিয়ে শেষ পর্যায়ের কবিতায় প্রধান হতে থাকে প্রতিবাদী বক্তব্য, সেকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে।’৩ মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর কালখ-ে একুশের এই প্রতিবাদীচেতনাই আমাদের কবিতায় শিল্পিত হতে থাকে, তবে কখনো কখনো তা যে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে তাও নির্মম সত্য। একুশকে নিয়ে কবিতা লেখা, কিংবা একুশ উদযাপন এখন, কখনো কখনো মনে হয়, সাংবৎসরিক এক অনুষঙ্গ মাত্র। তবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একুশের বেদনা ও শোক বাংলাদেশের কবিদের যত না প্রভাবিত করেছে, তার চেয়ে বেশি প্রাণিত করেছে একুশের সংক্ষোভ ও প্রতিবাদীচেতনা।

তিন (দুই)
কবিতার মতো পরিমাণে বিপুল না হলেও, বাংলাদেশের উপন্যাসেও ভাষা-আন্দোলনের বহুমাত্রিক প্রতিফলন ঘটেছে। ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাসসমূহে মূলত শিল্পিত হয়েছে সংঘবদ্ধ বাঙালির প্রতিবাদীচেতনা। ভাষা-আন্দোলন নিয়ে প্রথম উপন্যাস রচনা করেছেন জহির রায়হান। তাঁর আরেক ফাল্গুন (১৯৬৮) ভাষা-আন্দোলনের উপন্যাস হিসেবে যেমন যুগন্ধর সৃষ্টি, তেমনি একই সঙ্গে যুগোত্তীর্ণ নির্মাণ। সামরিক শাসনের নিগ্রহের মধ্যে বাস করেও একুশের মর্মকোষ উৎসারিত আরেক ফাল্গুন পাঠ করে আমরা হয়ে উঠি সাহসী মানুষ; আসাদ-মুনিম-রসুল-সালমার মতোই অভীকচিত্তে আমরাও বলে উঠি – ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।’ জহির রায়হানের এই পূর্বাভাস যে কত সত্য, ভাষা-আন্দোলনের পঞ্চাশতম বার্ষিকী আসার পূর্বেই আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। ভাষা-আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ইতিহাস আজ বিশ্বমানবের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার। ইউনেস্কো-ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ভাষা-আন্দোলনকে নতুন তাৎপর্যে অভিষিক্ত করেছে, যার পূর্বাভাস আমরা পেয়েছিলাম আরেক ফাল্গুনে।
১৮৫৭ সালের স্মৃতি-উন্মোচনের মধ্য দিয়ে আরেক ফাল্গুনের সূত্রপাত। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ধারায় গৌরবোজ্জ্বল সব ইতিহাসকে স্মরণ করে লেখক এ-উপন্যাসকে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের আসন্ন প্রভাতে। ১৯৫৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের একটি কাহিনি নিয়ে গড়ে উঠেছে এ-উপন্যাস। ভাষা-আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। জাতীয়তাবাদী এই চেতনাই রচনা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি। জহির রায়হান এ-উপন্যাসে ভাষা-আন্দোলনের রক্তাক্ত উজ্জীবন এবং বাঙালি জাতিসত্তার অনিঃশেষ শক্তি-উৎসের শিল্পরূপ নির্মাণ করেছেন।
ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শওকত ওসমান লিখেছেন আর্তনাদ (১৯৮৫) উপন্যাস। আলোচ্য উপন্যাসেও মূলত শিল্পিত হয়েছে বাঙালি জাতিসত্তার সমুত্থিত উজ্জীবনের রক্তাক্ত আবেগ। ‘এত রক্ত জননী বাংলাভাষা, এত রক্ত ছিল এ শীর্ণ শরীরে?’ – এই জিজ্ঞাসাধর্মী শব্দগুচ্ছের পৌনঃপুনিক উচ্চারণের মাধ্যমে শিল্পিত হয়েছে বাঙালির দ্রোহ-বিদ্রোহ-আত্মসমীক্ষা ও আত্মজাগরণের ইতিহাস। ভাষা-আন্দোলনে নিহত শহীদের পিতার নিঃশব্দ আর্তনাদ ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার সীমানা ছাড়িয়ে উপন্যাসের সমাপ্তিতে দেশমাতৃকার উজ্জীবনের সমগ্রতায় বিস্তার লাভ করেছে। উপন্যাসের ‘কোরাস’ অংশে পুত্রহারা পিতার দীর্ঘশ্বাস ও আর্তনাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের রক্তাক্ত ধারা। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও, এ-উপন্যাসেও আমরা লক্ষ করি, যেমন লক্ষ করেছিলাম আরেক ফাল্গুুন উপন্যাসে, বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিবাদী চেতনা উন্মোচনই শওকত ওসমানের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য। ‘ওদের ভাষায় আমি মৃতদেহ, মূর্খ মূর্খ পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল আমার আয়তন’ – শহীদের আত্মবিস্তারধর্মী এই সংলাপের মধ্যেই প্রতিভাসিত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসের মৌল চেতনা।
আর্তনাদ উপন্যাসে শওকত ওসমানের ইতিহাসজ্ঞান, সমাজ-অভিজ্ঞতা এবং প্রগত জীবনদৃষ্টির সুস্পষ্ট ছায়াপাত ঘটেছে। একটি বিশেষ ঘটনার সঙ্গে তিনি নির্বিশেষে মিলিয়ে দিয়েছেন ইতিহাসের অকথিত অনেক ঘটনা। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আলি জাফর ঐতিহাসিক চরিত্র নয়, কিন্তু তার ব্যক্তি অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্ব-অভীপ্সা বাঙালির রক্তাক্ত উজ্জীবনের ঐতিহাসিক ঘটনাধারায় তরঙ্গিত স্পন্দিত ও বলয়িত। এভাবে একুশের এক কাহিনিকে বাঙালির সহস্র ‘একুশের’ সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে শওকত ওসমান নির্মাণ করেছেন বাঙালির সমবায়ী অস্তিত্ব-উপলব্ধির এক অখ- ব্যঞ্জনা।
ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেলিনা হোসেন রচনা করেছেন দুটি উপন্যাস – যাপিত জীবন (১৯৮১) এবং নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৭)। যাপিত জীবন উপন্যাসে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন পর্যন্ত ঘটনাধারাকে ঔপন্যাসিক-অবয়ব দান করা হয়েছে। উপর্যুক্ত সময়ের উন্মাতাল ইতিহাস যাপিত জীবনের শব্দস্রোতে বন্দি হয়ে আছে। এই উন্মাতাল সময় ব্যক্তি ও সমষ্টি-অস্তিত্বকে কীভাবে রূপান্তরিত করে দেয়, তারই শিল্প-স্বাক্ষর যাপিত জীবন। এ-উপন্যাসে
সমষ্টি-অস্তিত্বের এই রূপ-রূপান্তরকে ধারণ করে আছে কেন্দ্রীয় চরিত্র জাফর। পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে ১৯৪৭ সালে পূর্ববাংলায় স্থানান্তরিত জাফর বছর-না-ঘুরতেই নতুন জিজ্ঞাসায় আলোড়িত হতে থাকে। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকা পাঠের পর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে জাফরের মনোলোকে। এই প্রতিবাদী চেতনাই ভাষা-আন্দোলনের মৌল প্রেরণা। ভাষা-আন্দোলনের এই প্রেরণাকে ধারণ করে আছে যাপিত জীবন উপন্যাস।
বাঙালির সমষ্টিগত প্রতিবাদী চেতনা ও সংঘবদ্ধ সাহসের শিল্পরূপ সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি। সেলিনা হোসেন তাঁর উপন্যাসসাহিত্যে পৌনঃপুনিকভাবে ইতিহাসের উৎস থেকে শিল্প-উপাদান সংগ্রহ করে বর্তমান কালকে শিল্পিত করেছেন। আলোচ্য উপন্যাসেও উত্তাল চল্লিশের ঘটনাধারার প্রেক্ষাপটে বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে ভাষা-আন্দোলন পর্যন্ত এ-উপন্যাসের কাহিনি প্রসারিত। আলোচ্য উপন্যাসে সেলিনা হোসেন অসামান্য দক্ষতায় সমকালকে, সমকালীন বেশ কিছু মানুষকে চিরকালীন মহিমায় অভিষিক্ত করেছেন। সোমেন চন্দ, রণেশ দাশগুপ্ত, মুনীর চৌধুরী – এসব পরিচিত মানুষ নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়েছেন উপন্যাসের নায়ককল্প চরিত্রে। এইসব চরিত্র, এইসব নায়ক, আমাদের নিয়ত শোনায় ইতিহাসের অনিঃশেষ ঘণ্টাধ্বনি, তাঁরাই ভাষা-আন্দোলনের
প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ রূপকার, ওঁদের প্রদর্শিত পথেই ইতিহাসের ক্রমধারায় আসেন আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের মহান স্থপতিরা। চল্লিশের উত্তাল ইতিহাসকে ধারণ করে আছে বলে নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি হয়ে উঠেছে ভাষা-আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ তথা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের এক অমূল্য শৈল্পিক দলিল।

তিন (তিন)
ভাষা-আন্দোলনের অনুষঙ্গে বাংলাদেশের অনেক ছোটগাল্পিক শিল্পসফল বহু ছোটগল্প রচনা করেছেন। প্রবীণ-নবীন ছোটগাল্পিকদের রচনায় শিল্পিত হয়েছে ভাষা-আন্দোলনের বহুমাত্রিক পরিচয়। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম উপন্যাস পেতে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হলেও, ছোটগল্পের জন্য তেমন কোনো অপেক্ষা করতে হয়নি। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী পালন উপলক্ষে হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৫৩) গ্রন্থেই আমরা ভাষা-আন্দোলনের ছোটগল্প পেয়েছি। অতঃপর আমাদের ছোটগাল্পিকরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে ভাষা-আন্দোলনের শিল্পরূপ নির্মাণ করেছেন। তাঁদের রচিত গল্পে খ- খ- ঘটনার আধারে শিল্পিত হয়েছে বাঙালির রক্তাক্ত উজ্জীবনের অখ- ছবি।
ভাষা-আন্দোলনের অনুষঙ্গে রচিত বেশ কিছু ছোটগল্পের নাম আমরা এখানে উল্লে­খ করতে পারি। শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’, সাইয়িদ আতীকুল্ল­াহর ‘হাসি’, আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’, মিন্নাত আলীর ‘রুম বদলের ইতিকথা’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘খরস্রোত’, নূরউল আলমের ‘একালের রূপকথা’, মঈদ-উর-রহমানের ‘সিঁড়ি’, রাবেয়া খাতুনের ‘প্রথম বধ্যভূমি’, সেলিনা হোসেনের ‘দীপান্বিতা’, শহীদুল্লা কায়সারের ‘এমনি করেই গড়ে উঠবে’, মুর্তজা বশীরের ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘সম্রাট’, বশীর আল হেলালের ‘বরকত যখন জানত না সে শহীদ হবে’, শওকত আলীর ‘অবেলায় পুনর্বার’, রাজিয়া খানের ‘শহীদ মিনার’, রিজিয়া রহমানের ‘জ্যোৎস্নার পোস্টার’, মাহমুদুল হকের ‘ছেঁড়া তার’, রশীদ হায়দারের ‘সুদূরের শহীদ’, মঈনুল আহসান সাবেরের ‘মরে যাওয়ার সময় হয়েছে’ এবং জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘কয়েকটি সংলাপ’ ইত্যাদি ছোটগল্প ভাষা-আন্দোলনের বহুমাত্রিক শিল্পকথা হিসেবে উল্লে­খযোগ্য নির্মাণ। এসব ছোটগল্পে ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবনের এক একটি খ-ছবি অঙ্কিত হয়েছে, যেসব খ-ছবির মৌল প্রত্যয় বাঙালির সত্তাগত রূপান্তর। ভাষা-আন্দোলনবিষয়ক গল্পে যে-মৌল প্রত্যয় শিল্পিত হয়েছে, জহির রায়হানের ‘কয়েকটি সংলাপ’ থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করে আমরা তা এভাবে উপস্থাপন করতে পারি –
পদত্যাগ চাই।
ওদের পদত্যাগ চাই।
বরকতের খুন আমরা ভুলব না।
রফিক আর জব্বারের খুন আমরা ভুলব না।
বিচার চাই।
ফাঁসি চাই ওই খুনীদের।
ভাইসব। সামনে এগিয়ে চলুন।
ওদের গোলাগুলি আর বেয়নেটকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলুন।
(জহির রায়হান, ‘কয়েকটি সংলাপ’)
সংঘশক্তির প্রেরণায় শোষকের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বানই ভাষা-আন্দোলনকেন্দ্রিক গল্পসাহিত্যের মৌলবাণী।
বাংলাদেশের আরো অনেক ঔপন্যাসিক-ছোটগাল্পিক ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনা করেছেন। সেসব রচনায় ভাষা-আন্দোলন কখনো উপস্থিত হয়েছে প্রত্যক্ষভাবে, কখনোবা পরোক্ষভাবে। ওইসব উপন্যাস-ছোটগল্পের তালিকা না দিয়েও আমরা যে-কথা বলতে চাই, তা হলো ভাষা-আন্দোলনের প্রেরণায় সৃষ্ট রচনাসম্ভারই নিঃসন্দেহে তৈরি করেছে আমাদের সাহিত্যের মূল স্রোত। কথাসাহিত্যিকরা সম্মিলিত সাধনায় আমাদের সাহিত্যে বপন করেছেন যে-মানবিকতার বীজ, যে-প্রতিবাদী জীবনচেতনার ভ্রƒণপত্র, তা-ই আমাদের জাতিসত্তার মৌল পরিচয়।

তিন (চার)
ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শিল্পসফল নাটকের সংখ্যা খুবই কম – মাত্র দুটি – মুনীর চৌধুরীর কবর (রচনাকাল ১৯৫৩, প্রকাশকাল ১৯৬৬) এবং মমতাজউদদীন আহমদের বিবাহ (১৯৮৮)। বিষয়ের গৌরব এবং আঙ্গিকের অভিনবত্বে কবর নাটক এক অসামান্য নির্মাণ। সংক্ষিপ্ত পরিসরের এ-একাঙ্কিকায় মুনীর চৌধুরী ধারণ করেছেন বাঙালি জাতিসত্তার সম্মিলিত জাগরণের রৌদ্রোজ্জ্বল চেতনা। কবরই বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রথম প্রতিবাদী নাটক। সাম্প্রদায়িক, সামন্তপ্রথা, ঔপনিবেশিক শোষণ এবং সব ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখানে উচ্চারিত হয়েছে প্রতিবাদের সেø­াগান। মুর্দা ফকিরের আচরণ এবং শহীদের কবরে না-যাওয়ার প্রতীকী ব্যঞ্জনায় এখানে শিল্পিত হয়েছে সংঘশক্তির জাগরণ। তাই হাইকোর্টের কেরানি হয়েও মূর্তি-২ কেন ছাত্রদের মিছিলে এলো, আর কেনইবা এখন সে কবরে যাচ্ছে না – নেতার এই প্রশ্নের উত্তরে হাইকোর্টের কেরানি যা বলে, তাতে উদ্ভাসিত হয় শংঘশক্তির উত্তাপ –
নেতা।… কে? তুমি কে?
মূর্তি (২)। নাম বললে চিনতে পারবেন না। হাইকোর্টের কেরানী ছিলাম। তখন টের পাইনি। ফুসফুসের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিল। এপিঠ-ওপিঠ।
বোকা ডাক্তার খামোকা কেটেকুটে গুলীটা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছে। জমাট রক্তের মধ্যে ফুটো নজরেই পড়েনি প্রথমে।
নেতা। তুমিও এই দলে এসে জুটেছো না কি?
মূর্তি (২)। গুলি দিয়ে গেঁথে দিয়েছেন। ইচ্ছে করলেও আল্গা হতে পারবো না।
অত্যাচার আর নির্যাতন, শাসন আর শোষণই নিপীড়িত জনতাকে সংঘবদ্ধ করে, মূর্তি (২)-এর সংলাপে এ-সত্যই প্রকাশিত। মুর্দা ফকিরের সংলাপেও রূপান্বিত হয়েছে প্রতিবাদী জীবনচেতনা – ‘বাসি মরার গন্ধ আমি চিনি না? এ লাশের গন্ধ অন্যরকম। ওষুধের, গ্যাসের, বারুদের গন্ধ। এ-মুর্দা কবরে থাকবে না। বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ হতে যত নীচেই মাটিচাপা দাও না কেন – এ মুর্দা থাকবে না। কবর ভেঙে বেরিয়ে চলে আসবে। উঠে আসবে।’
মমতাজউদদীন আহমদের বিবাহ নাটকেও আছে ভাষা-আন্দোলনের অবিনাশী আয়োজনের শব্দছবি – সখিনা নামের এক নারীর বর শহীদ হয়েছে ভাষা-আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে। এই ঘটনা সখিনা এবং সখিনার পিতাকে উদ্বুদ্ধ করেছে বৃহত্তর উজ্জীবনের পথে, তাদের সংলাপে উদ্ভাসিত হয়েছে ব্যক্তিক বেদনা-ছাপিয়ে সামষ্টিক উজ্জীবন –
ক. কোথায়, আমার মা জননী কোথায়। কই। আজ আমার গৌরব করার দিন রে মা। একি কম কথা। আমার মেয়ের জামাই জালেমের গুলিতে শহীদ হয়েছে। বাংলাভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। এতো একটা ঘটনা না। এতো ইতিহাস, এতো একটা অগ্নিগিরি। আমি বলছি, আমার দেল বলছে – ঐ ছেলেকে আমরা মাটির নীচে রাখব না। আমার ছেলেকে হরগিজ কবরে যেতে দেব না। আমার ঐ ছেলের গোরাজাব নাই, আমার জামাই-এর জন্য বেহেস্তর সব দরজা খোলা।

খ. আমার তো সেই কবে বিয়ে হয়ে গেছে ছোট মামা। এক মধু মাসে ফাল্গুনে ঝরা পাতা ছিল। কোকিলের গান, বসন্তের ফুলের গন্ধ, শানাই-এর সুর বেজেছিল। আমার বিয়েটা হয়েছিল মহা সমারোহে। ছোট মামা বিয়ের প্রথম কথাটা শুনেছিলাম তোমার কাছে। আজ বলে যাও ছোট মামা, আমি ওকে চিরকাল ধরে রাখব কেমন করে। এক এক করে এমনি করে বায়ান্ন থেকে সাতান্ন বছর বেঁচে আছি। যতদিন বাঁচব ওকে নিয়ে বেঁচে থাকব।
– পিতা কিংবা সখিনার এই সংলাপে ভাষা-আন্দোলনের মৌল চেতনা উদ্ভাসিত।

তিন (পাঁচ)
বায়ান্ন-উত্তর বাংলাদেশের ছড়া এবং সংগীতেও ভাষা-আন্দোলনের প্রতিবাদী চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে অনেক লেখক ছড়া লিখেছেন, একুশের ছড়ায় ভাষা-আন্দোলনের শহীদেরা, বাংলাভাষা আর বাংলা বর্ণমালা নতুন ব্যঞ্জনায় রূপপরিগ্রহ করেছে। প্রসঙ্গত উদ্ধৃত করা যায় আল মাহমুদের সেই বিখ্যাত ছড়া –
ফেব্রুয়ারীর একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি ঝরে, বৃষ্টি কোথায়
বরকতেরই রক্ত।
(আল মাহমুদ, ‘একুশের ছড়া’)
একুশ নিয়ে লেখা অনেক কবিতাই উত্তরকালে সংগীতের রূপপরিগ্রহ করেছে। তাৎক্ষণিক আবেগে রচিত একুশের কবিতা গান হয়ে বাঙালির কণ্ঠে কণ্ঠে হয়েছে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। এ-প্রসঙ্গেই স্মরণীয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিখ্যাত রচনা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ –
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিত পারি ॥
(আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’)
– উত্তরকালে এই কবিতা, কিংবা বলি গান, হয়ে উঠেছে বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়, বাঙালির স্বতন্ত্র অস্তিত্বের স্মারক।
আবদুল লতিফের ‘একুশের গান’ও এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয় সৃষ্টি। ওই গানে প্রকাশিত হয়েছে বাঙালির সম্মিলিত প্রতিবাদী চেতনা, বাংলার হাজার বছরের গৌরবগাথা – ওরা আমার মুখের কথা কাইরা নিতে চায়।/ ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়/ আমার হাতে পায়। সিকান্দার আবু জাফরের কবিতাও গান হয়ে বাঙালিকে শোনায় একুশের ভয়াল বিস্ফোরণের কথা –
কালো পতাকায়
প্রাচীর-পত্রে
অশ্রু-তরল রক্তরঙের লিপি
ক্রোধের
ঘৃণার
ভয়াল বিস্ফোরণ
একুশে ফেব্রুয়ারি।
(সিকান্দার আবু জাফর, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’)

চার
ভাষা-আন্দোলনের অপর নাম প্রতিবাদী চেতনা। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনে বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার সরব প্রতিবাদের মাঝেই সুপ্ত ছিল গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, ইহলৌকিক ও স্বাধিকারের আকাক্সক্ষা। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনই বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেছে প্রতিবাদী চেতনায়। একুশের চেতনা ছিল গণতন্ত্রের চেতনা, বাঙালিত্বের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা – সকলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের চেতনা।৪ রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি ছিল তাৎক্ষণিক, কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত ছিল সুদূরপ্রসারী মূল্যবোধ। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন বাঙালিকে করেছে রক্তমুখী, সূর্যমুখী, স্বপ্নমুখী। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সাফল্যে বাঙালি বিভোর হয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্নে। ১৯৫২-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যে আমরা যে-প্রগতিচিন্তার প্রকাশ লক্ষ করি, নিঃসন্দেহে তা ভাষা-আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাবজাত। এখানেই রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের অবিনাশী সার্থকতা।
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে পাকিস্তান-আন্দোলনের যে-বীজ রোপিত হয়েছিল, ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে তার প্রভাব ছিল অক্ষুণœ। মধ্যবিত্তশ্রেণি থেকে আসা অনেক লেখক-শিল্পীই তখন পাকিস্তান-আন্দোলনের শিল্পকথা নির্মাণে ছিলেন ব্যস্ত। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনই এখানে প্রথম আঘাত হানল। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন আমাদের লেখকদের বাঙালিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে প্রেরণা সঞ্চার করে। অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক চেতনা, মৃত্তিকামূল-সংলগ্নতা, মাতৃভাষাপ্রীতি, অন্য ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা, আন্তর্জাতিকতাবোধ – এসব প্রবণতা, যা আমরা লক্ষ করি বাংলাদেশের সাহিত্যে, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল। একটি উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা কিংবা নাটকে যখনই আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ লক্ষ করি, একটি উপন্যাস যখনই মৃত্তিকামূলস্পর্শী হয়ে ওঠে, যখনি একটি ছোটগল্পের শরীরে ও সত্তায় প্রতিবাদের সুর ঝরে পড়ে, যখনই একটি কবিতা বা নাটকে উন্মোচিত হয়, আমাদের সম্মিলিত জাগরণ – তখনই আমাদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের উজ্জ্বল ইতিহাসের কথা, বাঙালির ঐতিহাসিক অভ্যুদয়ের কথা।

পাঁচ
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে ১৯৫২ সালে; এরপর অতিক্রান্ত হয়েছে দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছর। সুদীর্ঘ এই সময়ের নানা ইতি-নেতির মধ্য দিয়ে গেছে আমাদের জাতীয় জীবন। দীর্ঘ বঞ্চনা এবং নানামাত্রিক ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে আমরা মুক্তিলাভ করেছি, অর্জন করেছি আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। কিন্তু জাতীয় জীবনে বাংলাভাষা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে কতটুকু? বাংলাভাষার বর্তমান অবস্থাই-বা কেমন? স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়, দেখা দেয় বাংলাভাষার অফুরন্ত সম্ভাবনা। কিন্তু বাস্তবে ঘটে উলটো ফল। অল্প কিছুদিনের জন্য প্রশাসন এবং আদালতে বাংলাভাষা ব্যবহৃত হলেও দ্রুত তা বদলে যায় – দেখা দেয় ইংরেজির দাপট। সরকারি বড়কর্তা ভুল ইংরেজি লিখলে লজ্জিত হন; কিন্তু ভুল বাংলায় তার কোনো ভাবান্তর হয় না; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উচ্চজ্ঞানের কথা ইংরেজি ছাড়া বলতে পারেন না। অথচ বিশ শতকের গোড়ায় চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ উচ্চস্তরের পড়ালেখা বাংলাভাষায় চলত – এ-কথা তো ঐতিহাসিক সত্য।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার অবস্থা খুবই করুণ। ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে বাংলাভাষা ও সাহিত্য নামেমাত্র পড়ানো হয়, বাংলামাধ্যম স্কুলেও ভাষা শিক্ষার অবস্থা ভালো নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলায় পড়ালেখা নিষিদ্ধ না হলেও শিক্ষকদের উপদেশ থাকে ‘ইংরেজিতে উত্তর লিখবে’। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বাংলাভাষার অবস্থা নববধূর কাছে ভাশুরের মতো। পণ্যপূজাশাসিত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ননীতির বাজারের দিকে তাকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে বাজারচর্চা করে, শিক্ষার্থীর হাতে বিপুল অর্থের বিনিময়ে তুলে দেয় বাজারে বিক্রয়যোগ্য একখ- কাগজ, নাম যার সার্টিফিকেট। সবার দায়িত্বের কথা মনে রেখেই বলছি, এক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব যে রাষ্ট্র-প্রশাসনের, তা অস্বীকার করার সুযোগ কোথায়? বাংলাদেশে বাংলাভাষা নিয়ে চলছে এখন চরম নৈরাজ্য। দেখে মনে হয় এ-বিষয়ে কারো যেন কোনো দায়িত্ব নেই। প্রযুক্তির মন্দ প্রভাবে প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে এখন, বের হচ্ছে অনেক সংবাদপত্র। কিন্তু কোথাও কোনো নিয়মনীতি পালন করা হয় বলে মনে হয় না। বাংলা একাডেমির বইয়ে উপেক্ষিত হয় তাদের নিজেদের তৈরি ‘প্রমিত বানান রীতি’, স্কুল টেকস্ট বুক বোর্ডের বইয়ে একটি শব্দের নানা ধরনের বানান দেখা যায় বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যগ্রন্থে, কখনো বা একই বইয়ে। করপোরেট পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রসমূহে বাংলাভাষার নানামাত্রিক ব্যবহার সৃষ্টি করছে বহুমুখী বিভ্রান্তি, বানানরীতিতে মানা হচ্ছে না ব্যাকরণের নিয়মনীতি, বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছে উদ্ভট জগাখিচুড়ি ভাষার অনুষ্ঠান। তাত্ত্বিকেরা সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রচার করছেন এই থিসিস – প্রমিত বাংলা হচ্ছে ‘সংস্কৃত বাংলার’ ছদ্মনাম আর প্রমিত বাংলা ব্যবহারকারী ও এর পক্ষাবলম্বনকারীরা হচ্ছে রক্ষণশীল মানুষ, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্র্রদায়িক শক্তি। সন্দেহ নেই, বিশেষ উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন এসব তাত্ত্বিক। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও বাংলাভাষা নিয়ে লীলাখেলায় মেতে উঠেছে, আঘাত করতে চাইছে বাংলাভাষার ঐতিহ্যের মূলে।
সূচনাসূত্রেই উল্লে­খ করেছি যে, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন শুরুতে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে উদ্ভূত হলেও, অচিরেই তার চরিত্র বদল ঘটে, হয়ে ওঠে তা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। এ সূত্রেই এ-আন্দোলনের উত্তরপ্রভাব নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে ইতিবাচক বিকল্প নির্মাণের শিক্ষা। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির ক্রমিক ষড়যন্ত্রের মুখেও বাঙালির প্রয়াসে তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে তুলেছে ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক আন্দোলন। মেয়েদের টিপ পরা, পহেলা বৈশাখ পালন, রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার, নগ্নপায়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন, খামে বাংলায় ঠিকানা লেখা, বাংলায় কথা বলা, শিশুদের বাংলা নাম রাখা – এসব সাংস্কৃতিক প্রতিন্যাস বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিগত তিন যুগে ইতিবাচক এই বিকল্প নির্মাণের পরিবর্তে আমরা সবকিছু বিসর্জন দিতে উঠেপড়ে লেগেছি। ফলে অনেক বিজয় অর্জিত হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো বিজয় টেকেনি – অন্তিমে সর্বত্রই শোনা গেছে পরাজিত শক্তির উল্ল­াস। দাতাদের প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে নিজস্ব জাতীয় বীক্ষণ ও পরিকল্পনার আলোকে অগ্রসর হতে হবে – শ্বেতাঙ্গ মানবতা নয় বরং প্রাচ্য মানবিক চেতনা দিয়ে নিজেদের পরিস্রুত করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের গালমন্দ করলেই চলবে না, নিজেদের লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে সৎ মানুষ হবার সাধনায় ব্যাপৃত হতে হবে। নিন্দা-ভর্ৎসনা, জ্বালাও-পোড়াও আর ফাঁপা রাজনীতি নয়, অজস্র ইতিবাচক বিকল্প সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনই এখন রাজনৈতিক শক্তির প্রধান কাজ হওয়া উচিত।৫ রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের কাছ থেকেই আমরা পেতে পারি ইতিবাচক বিকল্পের সন্ধান।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনকে ভাষা-আন্দোলন বলে অভিহিত করলে এর তাৎপর্য ও গভীরতা যেমন খর্ব হয়, তেমনিভাবে খর্বকরণের আরেক সাম্রাজ্যবাদী কৌশল একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা। আমি এবং আমরা সবাই খুশি হতে পারতাম, যদি ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করা হতো। রাষ্ট্রভাষা আর মাতৃভাষা এক নয়। মাতৃভাষা মানুষ অর্জন করে স্বতঃর্স্ফূতভাবে – কিন্তু রাষ্ট্রভাষা অর্জন করতে হয় সাধনা দিয়ে, পা-িত্য ও জ্ঞান দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে। মাতৃভাষাকে অবলম্বন করেই রাষ্ট্রভাষা গড়ে ওঠে, তবু মাতৃভাষার সঙ্গে রাষ্ট্রভাষার রয়েছে দুস্তর ব্যবধান।৬ মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাষ্ট্রভাষাকে এদেশে আজ গৌণ করে তোলা হয়েছে – পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রভাষার অনুশীলন। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর আদি নৃগোষ্ঠীর মানুষদের ভাষা নিয়ে আবেগসিক্ত কথা বলার বাৎসরিক একটা পার্বণ পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু বাস্তবে ওইসব নৃগোষ্ঠীর ভাষা-উন্নয়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ব্যক্তিক এবং রাষ্ট্রিক উন্নতির জন্য মাতৃভাষা ছাড়াও আমরা আরো অনেক ভাষা শিখব, কোনো ভাষার সঙ্গেই আমাদের বিরোধ নেই। তবে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রভাষাকে গৌণ করে, মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে অন্য ভাষা আদৌ শেখা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের অন্যতম শিক্ষা ছিল অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ও গণতান্ত্রিক চেতনায় জীবন বিকাশ। কিন্তু বাংলাদেশে আজ দুটো প্রবণতাই আসন্ন মৃত্যুশোকে কাতর। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শাসকশ্রেণিই গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী – রক্তকরবীর রাজার মতোই তাদের হাতে থাকে গণতন্ত্রের পতাকা, তাদের মুখে অবিরত শোনা যায় গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা আর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের কথা। কিন্তু লেখা বাহুল্য যে, তাদেরও গণতন্ত্র লোকসমাজের গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে তা আসলে শাসকতন্ত্র, বড়জোর দলতন্ত্র, তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠীর নেতা বা নেত্রীর মতবাদ কিংবা তাদের দলীয় রাজনীতিই হয় গণতন্ত্রের মৌল পরিচয়। শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধাচরণ কিংবা ভিন্নমত প্রকাশ সরকারি দলের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হত্যার ষড়যন্ত্র কিংবা দেশ বিক্রির গোপন নীলনকশা হিসেবে অভিধা পায়। বিরোধী দল বা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। তাদের গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত হয় দলীয় স্বার্থ ও নেতৃত্বের সুযোগ-সুবিধা ও ভবিষ্যতে সরকারে আসীন হওয়ার সম্ভাব্যতার দৃষ্টিকোণে। উভয় গোষ্ঠীর কাছেই দেশের স্বার্থ এবং জনগণের অধিকার থাকে উপেক্ষিত – গণতন্ত্র আর উন্নয়ন দল আর নেতৃত্বের বৃত্তে চরকির মতো ভনভন করে আর সাধারণ মানুষের দশা হয় সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো বেসামাল, অভিভাবকশূন্য, অসহায় ও গন্তব্যহীন।
দীর্ঘ তিন যুগেও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি। বড় বড় দল পরস্পরের প্রতি সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রদর্শন করতে শেখেনি – যুক্তির পরিবর্তে পেশিশক্তির ওপরেই তাদের নির্ভরতা। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে তাদের কাছে প্রাধান্য পায় কেনাবাহিনী, চেনাবাহিনী আর সেনাবাহিনী। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের প্রকৃত পৃথককরণও গণতন্ত্র বিকাশের অন্যতম পূর্বশর্ত। রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ ও সক্রিয় ভূমিকা পালন গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার অন্যতম প্রধান দাবি। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্য জানার অধিকার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার অবশ্যম্ভাবী শর্র্ত। তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে দেশে দুর্নীতি রোধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতার একচ্ছত্র ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব। তথ্যপ্রবাহ অবাধ হলে দেশ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকেও মুক্তি পেতে পারে। এর ফলে সমাজের সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে – ক্রমশ স্বাবলম্বী হবে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
গণতন্ত্রকে বিকশিত করতে চাইলে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কেননা, সাম্রাজ্যবাদ এবং গণতন্ত্র একসঙ্গে চলে না। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সে-সাহস কোথায়? ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের মতো কে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে? এক্ষেত্রে চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত – আপসের, দাসত্বের, মাথা নতজানু করার। ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকলে গণতন্ত্র মুক্তি পাবে কীভাবে?

ছয়
রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বিষ্ণু দে একটি কাব্যের নাম রেখেছেন তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ? বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষার দুরবস্থা এবং মাতৃভাষার দৈন্য দেখে বিষ্ণু দের অনুসরণে আনিসুজ্জামান প্রশ্ন রেখেছেন – ‘তুমি শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি?’৭ একুশকে স্মরণ এখন অনেকটা সাংবৎসরিক কর্মসূচি। বাইশে ফেব্রুয়ারি থেকেই আবার এক বছরের জন্য নির্বাসনে যায় একুশে ফেব্রুয়ারি। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ভাষা-আন্দোলনবিষয়ক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন – ‘ব্যক্তির পক্ষে ধর্মান্তরিত হওয়া যত সহজ, ভাষান্তরিত হওয়া ততটা সহজ নয়।’৮ কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রবণতার দিকে তাকালে আমরা বোধকরি বলতে পারি – ব্যক্তির পক্ষে ভাষান্তরিত হওয়াও ততটা কঠিন নয়। রাষ্ট্রভাষাকে অবজ্ঞা করার এই প্রবণতা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। তাহলে কি একুশের শহীদদের মতো আমাদের আবার বলতে হবে – ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাংলার প্রকৃত রাষ্ট্রায়ন চাই’?
অসীম সমুদ্রে ভাসমান দূরগামী জাহাজের নাবিকের কাছে বাতিঘরের আলোকস্তম্ভের মতো, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন বাঙালিকে প্রতিনিয়ত শোনাবে আশা আর আকাক্সক্ষা আর সাহসের বাণী। ১৯৫২ সালে যেসব প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কারণে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, সে-কারণগুলো এখনো দূরীভূত হয়নি। এ-কারণেই রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন এখনো আমাদের কাছে প্রতিদিন প্রাসঙ্গিক। নিয়ত এই প্রাসঙ্গিকতাই ভাষা-আন্দোলনের কালোত্তীর্ণতার প্রধান শক্তি-উৎস। আমাদের সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকদের রচনাকর্মে ভাষা-আন্দোলনের এই অবিনাশী প্রাসঙ্গিকতা বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় কুসুমিত হয়ে উঠুক, পুষ্পিত হোক রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের প্রতিবাদী চেতনা – এই-ই আগন্তুক কালের শিল্পীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা। বহুবিধ বিপর্যয় ও বিপন্নতার মধ্যেও আমরা আশায় বুক বাঁধতে পারি বহুশ্রুত এক মিথ-কাহিনির অনুষঙ্গে। মিথ-কাহিনির সেই ফিনিক্স পাখিই – আপন দেহভস্ম থেকে যে আবার জেগে উঠতে পারে সপ্রাণ সত্তায় – আমাদের রক্ষা করবে। বাংলাদেশের জনগণের মাঝেই আছে ফিনিক্স পাখির সেই জেগে ওঠার শক্তি। তাই তারাই এদেশের অগ্রযাত্রায়, উন্নত সমাজ-প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শেষ প্রতিরোধ, অন্তিম ভরসা।
তথ্যনির্দেশ
১. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদক), একুশে ফেব্রুয়ারী (ঢাকা : পুঁথিপত্র প্রকাশনী, ১৯৫৩), পৃ ৫।
২. এম এম আকাশ, ‘মধ্যবিত্তের গৌরবময় উত্থান’, ভাষা- আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর, (সম্পাদক : আহমদ রফিক ও বিশ্বজিৎ ঘোষ, ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৩) শীর্ষক গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধ, পৃ ১৫৬-৫৭।
৩. সাঈদ-উর রহমান, পূর্ব বাংলার রাজনীতি-সংস্কৃতি ও কবিতা, (ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৩), পৃ ২৮৬।
৪. আনিসুজ্জামান, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমাদের সাংস্কৃ তিক চেতনা’, অমর একুশের প্রবন্ধ (সম্পাদক : মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও অন্যান্য, ঢাকা : বাংলা একাডেমি, ২০০০), পৃ ২৫৮।
৫. এম এম আকাশ, পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৮।
৬. আবুল কাসেম ফজলুল হক, ‘রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’, দৈনিক প্রথম আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭, ঢাকা।
৭. আনিসুজ্জামান, পূর্বোক্ত, পৃ ২৬০।
৮. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন’, অমর একুশের প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃ ২৪৮।