রূপলাবণ্যের নিসর্গ দর্শন

জাহিদ মুস্তাফা

বিচিত্র রূপের বাংলাকে আমরা দেখতে পাই তার প্রকৃতির ভেতর ঢুকলে। বাংলা প্রকৃতির রূপলাবণ্য নিয়ে আমাদের প্রধান শিল্পীরা অসংখ্য ছবি এঁকেছেন, আঁকছেন নবীনরাও। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের চিত্রপটেও আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাপ্রকৃতির সৌন্দর্যবর্ণনা। সম্প্রতি শিল্পী মোখলেসুর রহমানের একক চিত্রপ্রদর্শনীতে আবার আমরা বাংলাদেশের রূপলাবণ্যের মাধুর্যকে তাঁর চিত্রপটে নতুন করে দেখতে পেলাম।

গত ২৮ জানুয়ারি শনিবার থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ শুক্রবার পর্যন্ত দুই সপ্তাহব্যাপী এ-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার ধানম-িতে সমকালীন চিত্রশালা শিল্পাঙ্গনে। এটি তাঁর অষ্টম একক চিত্রপ্রদর্শনী। ২০০৩ সালে তাঁর প্রথম ও ২০১১ সালে ষষ্ঠ একক প্রদর্শনী  আয়োজন করেছিল বেঙ্গল শিল্পালয়। এ দুটি প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল যথাক্রমে – সীমাহীন দিগন্ত ও নিঃশব্দ প্রকৃতি। তাঁর দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালে শিল্পাঙ্গনে। তৃতীয় একক আয়োজিত হয় কলকাতায় আকাদেমি অব ফাইন আর্টসে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তাঁর চতুর্থ ও পঞ্চম একক যথাক্রমে ভারতের হায়দরাবাদ ও দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তম একক আয়োজিত হয়েছিল ২০১১ সালে ইতালির রাজধানী রোমে। উল্লেখ্য, বাকি ছয়টি এককের শিরোনাম – ‘রূপসী বাংলা’।

এবারের প্রদর্শনীতে শিল্পীর প্রায় অর্ধশত চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগ কাজ বিগত দু-তিন বছরে আঁকা। শিল্পী কাজ করেছেন প্রধানত মিশ্রমাধ্যমে ও কাঠখোদাই ছাপচিত্র-মাধ্যমে। ক্যানভাসেও তিনি কাঠখোদাই ছাপ নিয়েছেন। এটি নতুন ধরনের নিরীক্ষা। আরেক নিরীক্ষায় ছাপা কাগজ ও ছাপার কাঠ একসঙ্গে ফ্রেম করে এই শিল্পী ২০০১ সালে দশম এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্র্যান্ড পুরস্কার পেয়ে বাংলাদেশের চারুশিল্পের সুনামকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর আরেকটি বিশেষ অর্জন হচ্ছে – ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত ৫৫তম ভেনিস বিয়েন্নালে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। বাংলাদেশের আটজন চারুশিল্পীর সমন্বয়ে গঠিত সেই প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য হিসেবে আমি তাঁর কাজ দেখেছি। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শাড়ির ওপর বাংলার প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ নিয়ে তিনি ছাপচিত্র-মাধ্যমে কাজ করে ভেনিসে আসা নানা দেশের শিল্পী ও শিল্পানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

শিল্পী মোখলেসুর রহমান গ্রামের সন্তান; মেধাবী ও কঠোর পরিশ্রমী। নদীবিধৌত শরীয়তপুরের শস্যক্ষেত্রের উদার পটভূমি ও বৃক্ষশোভিত ছায়াঘেরা মায়াময় পরিবেশে তাঁর জন্ম ১৯৬১ সালে। শিল্পীর ছবিতে আমরা তাঁর গ্রামের সেই মধুর পরিবেশের ব্যঞ্জনা পেয়ে যাই। ‘রূপসী বাংলা’র কবি জীবনানন্দ দাশ যেমন বরিশালের নদীমেখলা মধুর পরিবেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠায় প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে পাঠ করে অসামান্য এক কবি হয়ে উঠেছিলেন। কবির সেই সৌন্দর্যচেতনার অন্তঃসলিলা অনুভবকে যেন চিত্রকলায় তুলে এনেছেন শিল্পী মোখলেসুর রহমান।

বিশাল মাঠের ফাঁকায় চরাচরে আঁকাবাঁকা নদীর বিস্তার। তাতে কত পালতোলা নৌকা, ডিঙি ও গয়না নৌকার চলাচল। ওপরে ভারি নীলচে বর্ষার আকাশ, নিচে লতাগুল্মময় সবুজ-জীবন। শিল্পী এ-ধরনের চিত্রমালার শিরোনাম দিয়েছেন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জননন্দিত গানের পঙ্ক্তি – ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’। এটি  দেশপ্রেমী বাঙালির অত্যন্ত পছন্দের গান – মাঝেমধ্যে গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন অনেকেই। যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। গানে গানে গুনগুনিয়ে শিল্পী সে-সৌন্দর্যে অবগাহন করে মেলে ধরেছেন বাংলার রূপ।

একই শিরোনামের আরেকটি কাজে গ্রামাঞ্চলের ভরা বর্ষার খরস্রোতা নদীর দুপাশে সবুজ সুফলা জমিন চিত্রিত করেছেন শিল্পী। প্রকৃতির বাস্তব ছবিকে শিল্পী তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে রাঙিয়েছেন। এই সিরিজের কয়েকটি কাজ ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা।

আবার একই শিরোনামে শিল্পী কয়েকটি ছাপচিত্র করেছেন। মাধ্যম বদলের জন্য এগুলো অন্যরকম দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে। ওপর থেকে ঝুলে-পড়া সোনালু ফুল, দূরদিগন্ত পেরিয়ে সূর্যের আলোক প্রক্ষেপণ, চিত্রপটে কাটা কাটা আলো-আঁধারির খেলা, রঙের প্রলেপ ছাপিয়ে কাঠের স্বভাবজাত রূপের খানিকটা প্রকাশ – এসব মিলিয়ে শিল্পী মোখলেসুর রহমানের চিত্রকর্ম নন্দিত হয়ে উঠেছে।

আরেকটি কাঠখোদাই ছাপচিত্র, যার শিরোনাম রবিঠাকুরের গানের কলি অনুসারে – ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’, বর্ণ প্রয়োগ, আলোছায়া ও গঠনের চমৎকারিত্বে মজাদার হয়ে উঠেছে। ‘বসন্তের জন্ম’ শিরোনামে শিল্পীর দুই মাধ্যমে আঁকা আরো কয়েকটি চিত্রকর্মে বাংলার নারী ও নদীর সম্পর্কের গভীরতাকে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন শিল্পী।

তাঁর আরেকটি সিরিজ – ‘আশ্বিনের গান’। এর ৫ ও ৬-সংখ্যক চিত্রের মাধ্যম ক্যানভাসে উডকাট প্রিন্ট। শিল্পী অতীতে কাগজে, শাড়িতে ও গামছায় প্রিন্ট নিয়েছেন। এবারই প্রথম তিনি ক্যানভাসে ছাপচিত্র করলেন। এটি শিল্পী হিসেবে যেমন তাঁর জন্য এক নতুন ধারণাকে তুলে ধরার প্রয়াস, তেমনি দর্শক হিসেবে আমাদের জন্যও এক নতুন অভিজ্ঞতা। অন্তত আমি সেরকমই ভাবছি।

মিশ্রমাধ্যমেও বেশকটি দৃষ্টিনন্দন ছবি এঁকেছেন শিল্পী।

প্রকৃতির সৌন্দর্যের দারুণ সব বিষয় ও ফর্ম নিয়ে তিনি কাজ

করে নিজের ভালোলাগাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন শিল্পানুরাগী দর্শকদের মধ্যে।