শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস

শওকত ওসমান (১৯১৭-৯৮) বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের সমকালমনস্ক এক জীবনবাদী কথাশিল্পী। সমাজ ও সময়ের কাছে দায়বদ্ধ থেকে তিনি আমৃত্যু লিখে গেছেন। তাঁর রচনায় আমাদের জাতীয় আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ভিন্ন এক শিল্পমাত্রা লাভ করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি করে তিনি লিখেছেন চারটি উপন্যাস – জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৯১)১, দুই সৈনিক (১৯৭৩)২, নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩)৩ ও জলাংগী (১৯৭৪)৪।

জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসটি ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতা বসে লেখা। দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশের জন্য সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাড়া দিয়ে এটি লেখান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এটাই সম্ভবত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস। এ-উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে প্রথমদিকের চালচিত্র উঠে এসেছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে শওকত ওসমানের বড় ছেলে বুলবন ওসমান লিখেছেন –

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা বাবার বাংলাদেশে থাকাটা নিরাপদ নয় মনে করে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিই। এ ব্যাপারে আমার মেজভাই আসফাক ওসমান সব ব্যবস্থা করে। সে তখন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ অফিসার হিসেবে চাকরিরত। তার পিয়ন ইদ্রিস মিয়া ও অন্যতম অধঃস্তন অফিসার জীবনকে সঙ্গে নেয়। ওদের বাড়ি কুমিল্লা কোনাবন বর্ডারের কাছে। ওরা বাবাকে আগরতলা পৌঁছে দেবে। আমার ছোটভাই জাঁনেসারও ছিল ওদের সঙ্গে। এই সময় বাবার যে মানসিক দ্বন্দ্ব তা আমরা তার মুখ দেখে বুঝতে পারতাম। যেটি উপন্যাসে বারবার এসেছে।… এই উপন্যাসে গাজী রহমান দেশ ছেড়ে যাচ্ছে প্রাণ সংশয়ের কারণে। তার যাবার পথে নানা ঘটনার অবতারণা। সবই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের ঘটনা। গাজী রহমান যে শেখ আজিজুর রহমানের ছদ্মবেশ তা লেখককে যারা চেনেন তাঁদের বুঝতে অসুবিধা হবে না।৫

জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসের কাহিনির কোনো উত্থান-পতন নেই, দ্বন্দ্ব এবং চরিত্রের বিকাশও চোখে পড়ে না। পাকবাহিনীর হাতে আক্রান্ত স্বদেশ, তাদের অত্যাচার-নির্যাতন, জ্বালাও-পোড়াও, হত্যাযজ্ঞের কারণে প্রিয় মাতৃভূমি এখন ‘জাহান্নামে’ (দোজখে) পরিণত হয়েছে।

এই ‘জাহান্নাম’ থেকে স্কুলের এক প্রবীণ শিক্ষক গাজী রহমান প্রাণভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। গাজী রহমান তার এক ছাত্র ইউসুফের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি স্বস্তি পেলেন না। ইউসুফের শ্যালক খালেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার কোনো খোঁজ না পাওয়ার কারণে ইউসুফের স্ত্রী সখিনা ভাইয়ের শোকে মুহ্যমান। এরকম পরিবেশে গাজী রহমান বেশিদিন থাকতে চাইলেন না। ইউসুফের বাড়ি নরসিংদী থেকে নবীনগর যাওয়ার পথে এক বৃদ্ধের সঙ্গে তার দেখা হয়। হানাদার বাহিনী এই বৃদ্ধকে দিয়ে দোকান লুট করিয়ে নিয়েছে। নৌপথে যাওয়ার সময় নৌকায় এক মাতারিকে দেখেন তিনি, যার স্বামীকে হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি দেখেছেন গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে হানাদার বাহিনী। অজস্র মানুষ প্রাণভয়ে একবস্ত্রে শহর ত্যাগ করছে। তিনি নিজেও টুথব্রাশ, পেস্ট, দুটো লুঙ্গি, পাজামা, ছেঁড়া গেঞ্জি একটা ঝোলার মধ্যে নিয়ে বেরিয়ে ছিলেন। সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে বন্ধু অ্যাডভোকেট রেজা আলীর বাড়িতেও আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাকে। বাসে করে যাওয়ার পথে দেখলেন মুক্তিফৌজদের বিধ্বস্ত করা ব্রিজ, পুড়ে যাওয়া গ্রাম। আলমের মুখে শোনেন আজিমগঞ্জের যুদ্ধের মর্মস্পর্শী বিবরণ। ১৫ জন হানাদারকে মারতে অস্ত্রহীন গ্রামবাসীকে ৬৫ জন নিহত এবং ২০০ জন আহত হয়েছিল। সীমান্ত পথনির্দেশক সৈয়দ আলীকে গাজী রহমান পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে সে যা বলেছিল, তা প্রণিধানযোগ্য –

গোলামের পরিচয় থাকে না স্যার। গোলাম, গোলামই। স্বাধীন বাংলাদেশই হবে আমার পরিচয়।৬

সৈয়দ আলীর এই অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে শুধু লেখক শওকত ওসমানের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্যাশাই ব্যক্ত হয়নি, সমগ্র বাঙালি জাতির স্বপ্নময় আকাঙ্ক্ষা ধ্বনিত হয়েছে। ওই সময়ে সমস্ত বাঙালির একটি মাত্র প্রত্যাশা – দেশ স্বাধীন হবেই। সেই স্বাধীন দেশেই হবে তাদের স্বপ্নের অধিবাস। আলমের মুখে আজিমগঞ্জের গ্রামবাসীর পাঞ্জাবি নিধনের বয়ান শুনে গাজী রহমান মনে মনে  ভাবে –

সেও তো দেশকে ভালোবাসে। তার এই মানসিক জোর নেই কেন? বয়স, ভদ্রলোক হওয়ার ফল, প্রাণভয়? না, আর কিছু?৭

গাজী রহমানের এ-ভাবনা বাঙালি মধ্যবিত্তের মানস-চরিত্রের পরিচয় বহন করে। বাঙালি মধ্যবিত্তের শ্রেণিচরিত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – আত্মরক্ষা, আত্মোন্নতি, নিরাপদ থাকার স্বার্থচিন্তা। পলায়নপর মানসিকতায় সে ক্রমাগত বিপদ ও বৈরী বাস্তবতা থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। অথচ তার বিবেক জাগ্রত, সেও মনেপ্রাণে মুক্তি কামনা করে, তার মধ্যেও প্রবল দেশপ্রেম রয়েছে। তবু তার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে। গাজী রহমানের মানসিক অবস্থার মধ্যে তারই প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।

শহরতলির পাশে এক বাঁশের ঘরে কয়েকদিন কাটায় গাজী রহমান। ঢাকা শহরের সেইসব দিনরাত্রির স্মৃতি তাকে পীড়িত করে। ভয়ে, ত্রাসে সমস্ত শহর নিস্তব্ধ। লাখ লাখ লোক পলাতক। দাম্ভিকের জুতাপেটা খেয়ে সহায়হীন ব্যক্তি কতদিন স্তব্ধ থাকতে পারে। সেই দমবন্ধ নিস্তব্ধতার ছবি ফুটে ওঠে কয়েকটি বাক্যে –

গোটা বাংলাদেশ স্তব্ধ। শব্দের মালিক তারাই, যাদের হাতে মেশিনগান প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র আছে, পিতলের নক্ষত্র উর্দির উপর বসিয়ে যারা নিজেদের ভাবে পৃথিবী এবং আকাশ বিজেতা।৮

সৈয়দ আলীর সহায়তায় গাজী রহমান নৌকাযোগে বর্ডারের খুব কাছাকাছি এসে পড়ে। ফিসফিস করে সৈয়দ আলী বলে – ‘স্যার আমরা বর্ডারের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি। নৌকা খুবজোর আর তিন মাইল।’ কথাগুলো আচমকা তার কানে ধাক্কা খায়। বড় অস্থির লাগে। এতক্ষণ নৌকার মধ্যে স্তব্ধতার যন্ত্রণায় বুঁদ হয়ে ছিলেন।

মাঝি চালাও, জোরে চালাও, আরো জোরে, জোরে চালাও। তোমার নৌকা হাঁটে না কেন?… জোরে চালাও জোরে – আরো জোরে। দেখছো না চারদিকে দোজখ। অগ্নিকুন্ড দাউদাউ জ্বলছে। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য নরনারীশিশু দলে দলে… এরা কেউ কিন্তু কোনো পাপ করেনি।… জোরে জোরে চালাও মাঝি। এই নরক থেকে আমি বাইরে যেতে চাই।৯

এই নরক থেকে বাইরে যেতে চায় গাজী রহমান। কারণ, এখানে হয় তুমি কসাই অথবা মাংস। মাঝামাঝি রাস্তা বন্ধ। নির্জন বিল পেরিয়ে বর্ডারে এসে থামে দুজন। কিরণ রায়, রেজা আলীর ছবি দেখতে পায় গাজী রহমান। পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে বলে – ‘এটা আমার ছাত্র ইউসুফ চৌধুরীকে নিজে পৌঁছে দিও।’ ওপরে লেখা ‘সখিনা চৌধুরাণী’। চিঠির কিয়দংশ –

মা, আমার দোয়া জানিও। তোমার সেবা যত্ন আমি ইহজন্মে ভুলিতে পারিব না। যদি খোদা চাহেন, আবার তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিবে… খালেদের সহিত আমার দেখা হয় নাই। কিন্তু এখানে শুনিয়াছি, মুক্তিফৌজদের মধ্যে তার বীরত্বের খুব নামডাক আছে। কিছুদিন আগে নাকি এই বর্ডারে ছিল। এখন অন্য জায়গায় বদলি হইয়াছে। তাহার জন্য চিন্তা করিও না। জন্মভূমির ডাক তাহাকে ঘর ছাড়া করিয়াছে। এমন ডাক শুধু সৎ, সুন্দর এবং ভাগ্যবানেরাই শুনিতে পায়।… খালেদ তেমন পথই বাছিয়া লইয়াছে। মুক্তিফৌজরা আমাদের গর্ব। প্রাণসোপর্দ প্রতিজ্ঞায় অটল মুক্তিফৌজেরা আমাদের জন্য নতুন সমাজ গড়িতেছে – যেন দেশবাসী সকল দুঃখ-দারিদ্রে্যর হাত হইতে মুক্তি পায়। খালেদের কাজে তোমার বুক বোন হিসেবে ভরিয়া ওঠা উচিত।… ‘মিথ্যের সঙ্গে এই হোক আমার শেষ আপোষ’।১০

ছাত্র ইউসুফ চৌধুরীর স্ত্রী সখিনা চৌধুরাণীকে লেখা গাজী রহমানের এই চিঠির মধ্য দিয়ে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে, তা মূলত লেখক শওকত ওসমানেরই অভিব্যক্তি। বর্ডারে দাঁড়িয়ে আগরতলা যাত্রাপথে পা বাড়ানোর আগে তাঁর মানসিক অবস্থা ও হৃদয়ের অনুভূমি সেই সময়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি মানুষের মনের কথা হয়ে উঠেছে। সত্যিকার দেশপ্রেম এবং মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার মানবিক অধিকার থেকে উঠে আসা সেই আবেগে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে ওঠে কণ্ঠ, অশ্রুতে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে গাজী রহমান পা ফেলতে লাগলেন। বর্ডার অতিক্রান্ত কিন্তু লোকালয় দূরে, আরো তিন মাইল হাঁটতে হবে। পেছনে মেশিনগানের গুলি ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটছে। কোলাহল, আর্তনাদ, সঙ্গিনের আগায় গাঁথা শিশুর চিৎকার, জল্লাদের অট্টহাসির পৈশাচিক উল্লাসের শিকার, ধর্ষণের লালাসিক্ত ঠোঁট, মর্টারের আওয়াজে কম্পমান ভূমি –

কিন্তু সব শব্দ গাজী রহমানের কর্ণপট থেকে মুছে গেল সৈয়দ আলীর সংলাপের পুনরুত্থানে ‘গোলামের কোনো পরিচয় থাকে না। গোলাম গোলামই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাই আমার পরিচয় হোক।’…

গাজী রহমান হঠাৎ বিপরীতে পেছনে ফিরলো। পুনরায় জন্মভূমির দিকে মুখ। তারই উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্ববাহু-সে মনে মনে উচ্চারণ করল :

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ি নদীটির তীরে এই বাংলায়

কুয়াশার বুকে ভেসে আবার আসিব এই কাঁঠাল ছায়ায়।

 

হয়তো কয়েক লহমা।

আবার গন্তব্যমুখী গাজী রহমান।

জয় বাংলা।

এই একটি স্তননের জের শুধু পেছনে পড়ে রইল।১১

এভাবে জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। উপন্যাসের কাহিনীতে কোনো উত্থান পতন নেই। ব্যক্তি গাজী রহমানের চেতনার আড়ালে লুকিয়ে আছে যুদ্ধপীড়িত দেশের দেড় মাসের কিছু চালচিত্র। আতঙ্কজনক পরিস্থিতি, স্বজন হারানোর বেদনা, নরসিংদী থেকে নবীনগরের পথে গাজীর চৈতন্যে ভেসে ওঠা বৃদ্ধের অভিব্যক্তি, ডেমরা ঘাঁটির চেকপোস্ট পার হয়ে ছইয়ের নিচে মাঝির অভিব্যক্তি, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী জীবন, মাতারির ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ইত্যাদি।১২ এসব ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকের। আক্রান্ত, শত্রুকবলিত স্বদেশের মাটি থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাঁচার অসহায় মানুষের বিবরণ। কিন্তু এখানে গাজী রহমানের চরিত্রের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে কয়েকটি দিক। যেমন –

ক. বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসিক দ্বন্দ্ব।

খ. শত্রুকবলিত দেশ থেকে অসহায় আক্রান্তগ্রস্ত মানুষের নিরাপদ গন্তব্যে যাত্রা।

গ. হানাদার বাহিনীর হত্যা, নির্যাতনের নির্মমতার চিত্র।

ঘ. ব্যক্তি গাজী রহমানের প্রতিরূপ শওকত ওসমানের মানসিক যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার চিত্র।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গাজী রহমানের মধ্যে লেখক শওকত ওসমানের আত্মচরিত্র প্রক্ষেপ হয়তো অস্পষ্ট নয়। তাই সমালোচক মন্তব্য করেছেন, ‘শওকত ওসমান এই উপন্যাসের গাজী রহমানের ভেতর দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। সংকট থেকে পলায়ন – কেবল নিজেকে বাঁচানোর জন্যে ব্যাকুল, ব্যস্ততা গাজী রহমানের মধ্যে এই প্রবণতা বর্তমান।’১৩ সমালোচকের এই মন্তব্য সর্বাংশে সঠিক নয়, কারণ, গাজী রহমান বয়সে প্রৌঢ়, সরাসরি যুদ্ধ করার মতো শারীরিক সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু পেশায় তিনি শিক্ষক। তাই তার চেতনা তীক্ষ। হৃদয় সংবেদনশীল। তাই সে মানসিক উপলব্ধিতে যন্ত্রণাদগ্ধ হয়। তাঁর মানসিক অবস্থার বিবরণ উপন্যাসে পাওয়া যায় –

গত দেড় মাস তার চিন্তার পদ্ধতি যে কোনো ন্যায়িক গন্ডির মধ্যে অচল ছিল। নানা স্মৃতি এবং ঘটনার ছায়ার অরণ্যে… দুঃস্বপ্নের পর তবু অর্ধজাগ্রত অর্ধঘুমন্ত অবস্থায় যুক্তির রেশ কিছু থাকে। গাজীর মগজের কোষে তার চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া দুষ্কর ছিল।… সে পুরাতন হেডমাস্টার। সব জ্ঞান, বিশেষত আত্মমর্যাদা জ্ঞান এখনো টনটনে। তার কোনো প্রশান্তি পাওয়ার কথা নয়। হয়তো অস্থিরতার তোড়ে সে ভেসে যেত। তাই সচেতন বোধের সাহায্যে আর কিছুই নিজের কাছে টেনে আনার ব্যর্থ প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকত।১৪

নানা ঘটনা ও স্মৃতি প্রৌঢ় শিক্ষক গাজী রহমানকে যন্ত্রণাদগ্ধ করে। অধোঘুমে, আধোজাগরণে, অস্থির, দুঃস্বপ্নের মধ্যে সে দেড় মাস কাটিয়েছে। তার মানসিক চিন্তা কোনো ন্যায়িক গন্ডির মধ্যে ছিল না। সে মনে-প্রাণে চায় যুদ্ধ করতে, স্বদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে, কিন্তু শারীরিক অক্ষমতা তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই যন্ত্রণায় কাতর হন তিনি। অস্থির, আতঙ্কে, দুঃস্বপ্নে কাটে তার সময়। কিন্তু হৃদয়ে স্বদেশের প্রতি রয়েছে গভীর মমত্ববোধ। তাই বর্ডার পেরিয়ে নিরাপদ গন্তব্যের দিকে পা বাড়ানোর পরও জন্মভূমির দিকে আরো একবার ফিরে তাকান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে উচ্চারণ করেন জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি ‘আর আসিব ফিরে ধানসিড়ি নদীটির তীরে – এই বাংলায়।’ হানাদারকবলিত ‘নরক’সদৃশ জন্মভূমি থেকে বিদায় গ্রহণের মর্মন্তুদ ভাবার্থের দিক থেকে বিবেচনা করলে জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসের নামকরণ খুবই তাৎপর্যময় এবং সার্থক বলা যায়। আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭১), শওকত ওসমানের জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১) ও শওকত আলীর যাত্রা (১৯৭৬) – এই তিনটি উপন্যাসের মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তিনটি উপন্যাসের (রাইফেল রোটি আওরাতের সুদীপ্ত শাহীন, যাত্রা উপন্যাসের অধ্যাপক রায়হান এবং জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসের গাজী রহমান) কেন্দ্রীয় চরিত্র পেশায় শিক্ষক এবং লেখকত্রয়ও পেশায় শিক্ষক। ফলে উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যে তাঁদের আত্মচরিত্রের প্রক্ষেপ ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির প্রতি তাঁদের অসীম মমত্ব রয়েছে এবং তাঁরা মনেপ্রাণে চান দেশ স্বাধীন হোক কিন্তু কেউ প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন না। মধ্যবিত্তসুলভ আত্মরক্ষা তাঁদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু চেতনায় তাঁরা উজ্জীবিত, মানসে যন্ত্রণাদগ্ধ।

 

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যপঞ্জি

১.    জাহান্নাম হইতে বিদায় ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বরের দিকে কলকাতায় বসে লেখা। দেশ পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশের জন্য সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাড়া দিয়ে লেখান। কলকাতার ‘মুক্তধারা’ থেকে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে ‘মুক্তধারা’ ঢাকা থেকে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে।

২.     দুই সৈনিক উপন্যাসটি ঢাকার ধানশীষ প্রকাশনী থেকে ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমান এবং শহীদ কাদরীকে উৎসর্গিত।

৩.    নেকড়ে অরণ্য, আদিল ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং, ঢাকা ১৯৭৩।

৪.    জলাংগী, নওরোজ সাহিত্য সংসদ, ঢাকা, দ্বি. মু., ১৯৮৬।

৫.    কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, বুলবন ওসমান, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৪, পৃ ২৭-২৮।

৬.    জাহান্নাম হইতে বিদায়, মুক্তধারা, ঢাকা ১৯৮৭, পৃ ১০৮।

৭.     ওই, পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৫।

৮.   ওই, পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৬।

৯.    ওই, পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৮।

১০.  ওই, পূর্বোক্ত, পৃ ১৬৪।

১১.  ওই, পূর্বোক্ত, পৃ ১৬৭।

১২.  রাজনৈতিক চেতনা : বাংলাদেশের উপন্যাস, শহীদ ইকবাল,  সাহিত্যিকা, ঢাকা, ২০০৩, পৃ ১২৪।

১৩. শওকত ওসমানের কথাসাহিত্যে জাতীয় আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, অনীক মাহমুদ, উত্তরাধিকার অক্টোবর-ডিসেম্বর সংখ্যা, ১৯৯১, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

১৪. জাহান্নাম হইতে বিদায়, পূর্বোক্ত, পৃ ২।