শঙ্কা

বদরুন নাহার

দেশের জনগণ একবার এক মহাআবুলকে চিহ্নিত করে তার পদত্যাগ দাবি করে বসল। অতঃপর নিজেরাই আবুল বনে গেল! সরকার ক্যাছলিং করে মন্ত্রীর রদবদল ঘটালেন। সাপও মরল আবার লাঠিও ভাঙল না! আসলে সাপও মরেনি, কেবল ফণা তোলার বদলে হিস-হিস করে চলতে লাগল। এই হিসহিসানির সময় ফিসফিস করে মানুষ কেবল যানবাহনের হিসাব কষতে লাগল। গরুর গাড়ির ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ বদলে কবে থেকে কুঁ ঝিক-ঝিক।
যদিও কবি বলেছেন বেলাব থেকে উত্তরে, কিন্তু এ-শহরটা দক্ষিণের। শহরের লোকজন দেখতে পেল এখানে রাস্তায় দিনের বেলায়ও ট্রাক চলে। প্রাইভেট কার খুব কম। নতুন ব্যাংকের কর্তাব্যক্তি আর কনসালট্যান্ট ডাক্তারদের হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র। ভাড়া মাইক্রোবাসের কিছু চলাচল মাঝেমধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। তবে সরকারি অফিসের ফোর হুইলারের সংখ্যায় কম। যদিও এখন সে-ই ব্রিটিশ কেতার অবশিষ্ট যান্ত্রিক নিদর্শন। আজকাল তরুণদের তরতাজা মোটরসাইকেলের স্রোত বেড়েছে। বহু বছরের টুংটাং ক্রিং ক্রিং বাইসাইকেলের বাহুল্য ক্রমহ্রাসমান। শহরের বাহনের যে-ফিরিস্তি চলছিল কিছুদিন আগে পর্যন্ত, সেখানে প্রধান অবস্থানে ছিল রিকশা। তবে এ-রিকশার অবস্থান এখন দ্বিতীয়। বর্তমানে প্রথম অবস্থানে চীন! মানে চীনের তৈরি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। শহরের সবাই তাকে অটো বলেই ডাকে। শহরটির অভ্যন্তরীণ চলাচলরত যানবাহনের মধ্যে এগুলোই প্রধান। এর সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে শহরের অনেকেই গাড়িতে চড়ার স্বাদে মজে গেল। যদিও এই বাহন যান্ত্রিক কিন্তু অন্যান্য গাড়ির মতো হেডলাইট, ইন্ডিকেটরসহ আধুনিক সিগন্যাল পদ্ধতি সবল নয়। তবু দিব্যি চলছে। এর কারণ হিসেবে শহরবাসী লক্ষ করল, এসব বাইকের চালকরা গরু-ছাগল চেনে! তাদের সুবিধা এই যে, এই মফস্বল শহরে আগের মতো গরু-ছাগল দেখতে পাওয়া যায় না।
নছিমন নামে নতুন এক মাল্টিন্যাশনাল বাহন যুক্ত হয়েছে শহরে, যার মালিক মধ্যস্বত্বভোগী কৃষকশ্রেণি। নছিমনকে করপোরেট সিস্টেমের নতুন কৃষি সংস্করণ বললে অত্যুক্তি হবে না। শুরুতে ক্ষেতে মাটি উর্বর করতে এটা কাজ করে, লাঙল পদ্ধতির বিকল্প। জমি তৈরি হয়ে বীজতলায় বীজ মাথা তুলে দাঁড়াতেই জলসেচের জন্য আবার সে কাজ শুরু করে। এবং ফসল সংক্রান্ত এ-মেশিনটির শেষ কাজ হচ্ছে নছিমন নাম ধারণ করে ক্ষেতের ফসল হাট-বাজারে নিয়ে যাওয়া। ফেরার পথে জনপ্রতি পাঁচ টাকা দরে হাটুরেদের বাড়ি ফিরিয়ে আনা। এটাকে তৃতীয় বিশ্বের কৃষি খামারিদের ওয়াগন হিসেবে ধরা যেতে পারে। শহরবাসী জেনেছিল, এ-বাহনটির রুট পারমিট নেই; কিন্তু যখন তারা দেখতে পেল জেলা থানার সামনে দিয়ে ভটভট করতে করতে নছিমন হেঁটে যায় আর থানার কর্তাবাবুরা মুরগির পালক দিয়ে কান চুলকায়, তখন তারা আর সে-বিষয়ে কথা বলেনি।
অভ্যন্তরীণ এসব যানবাহন ছাড়াও শহর থেকে শহরে। মানে জেলা থেকে জেলায়, উপজেলায় এমনকি রাজধানীতে যাতায়াতের জন্য রয়েছে বাস এবং টেম্পো। শহরের ভেতরের মৃত রেলপথ হাঁ করে বসে আছে উপনিবেশের উচ্ছিষ্টের মতো। তার স্লিপারের কাঠে ঝুপড়ি বস্তির বিস্তর মাচা তৈরি হয়েছে পোস্ট-কলোনিয়াল ব্যবস্থাপনায়। জেলা শহরের সম্পূর্ণ চেহারায় শীত শেষের ধুলোবালির আস্তরণ। শহরের মাঝে অবস্থানরত জেলরোডের বাসাগুলোতে সম্প্রতি পৌরসভা থেকে সাদা চকে নম্বর লিখে দিয়ে গেছে। বাসাটির নম্বর ৭৬। একতলা ভবনের রং-বৃষ্টির ছাঁটে ছুটে গিয়েছে। ছাদের চারপাশে সবুজ শেওলা শুকিয়ে কালচে রং ধারণ করেছে। এই বাড়ির মালিক আমিনুর রহমান এককালে বাইসাইকেল চালাতেন, এখন চালান না। বাড়ি ছেড়ে সদর হাসপাতাল আর নিউমার্কেট যেতে লাইনের ইজিবাইক ব্যবহার করেন। তিনি ছাড়াও এ-বাড়িতে আরো দুজন থাকেন। একজন তাঁর মা ছুরতুন্নেছা এবং স্ত্রী রাবেয়া বেগম। ছুরতুন্নেছার বয়স পঁচাশি বছর। রাবেয়া বেগমের বয়স বাষট্টি আর আমিনুর রহমানের বয়স সত্তর বছর হবে। বাড়িটা যেন বদ্ধপুকুরের জলমগ্ন জীবন। জলটার তরঙ্গায়ন নেই। ধীরে ধীরে কেবল কমে যাওয়ার সময়। রবিঠাকুরের বাঁশি কবিতার মতো একটা করুণ সুরের মূর্ছনা যেন বাড়িটিতে বহমান। মূলত আমিনুর রহমানের পুত্র-কন্যাকে কাছে না পাওয়ার জন্যই সৃষ্ট সে-সুর। কিন্তু এ-বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো উচ্চবাচ্য নেই, বরং এই ভালো ভেবে তাঁরা নিরুত্তাপ জীবনযাপন করছেন।
আমিনুর রহমানও যানবাহনের চিন্তায় পড়লেন। দীর্ঘ পনেরো বছর বাদে তাঁর কানাডা প্রবাসী কন্যার দেশে আগমন উপলক্ষে তিনি এ-যানবাহন বিষয়ক ভাবনায় পতিত হলেন। তিনি সবে শহরের লোকজনের ফিসফিস আলাপ-সালাপ শুনে বাড়ি ফিরতেই মেয়ের সঙ্গে ফোনালাপ। তাই সহসা বলে বসলেন Ñ দেশে আসবি কেনরে বৃষ্টি?
বাবার এ-কথায় মেয়ে প্রচণ্ড অভিমানী হয়। বাবার সঙ্গে কথা বলে না, মাকে চেয়ে বসে। মা রাবেয়া বেগমকে সে বিস্তারিত সব জানায়। বৃষ্টির সন্তানের বয়স দশ, সে এখন পর্যন্ত তার নানা-নানিকে দেখেনি। বাবা এমন হয়ে গেছে কেন? মা মেয়েকে এ-কথা সে-কথায় সান্ত্বনা দেন। পাশের রুম থেকে ছুরতুন্নেছা চিৎকার করতে থাকেন – ও আমনুর, বৃষ্টি আইবো নিকি? ও বউ, কথা কও না ক্যান? বৃষ্টি কি আইব?
রাবেয়া বেগমের মন সেদিন খুশিতে ভরে ওঠে। তাঁর পুত্র রিয়াজের কথাও মনে হয়, সেইসঙ্গে ছেলেটাও দেশে আসতে পারত। সেই যে বিয়ের পর মেয়েটি কানাডা চলে গেল, বছর দুই পর ছেলেটাকেও নিয়ে যায়। তারপর থেকে এই তিনজনের সংসার। ফোনালাপের পর এ-বাড়ির তিন সদস্যের মাঝে চাঞ্চল্য দেখা যায়। দীর্ঘদিন পর পুকুরের পানিতে যেন তরঙ্গায়ন ঘটে। তাঁরা লক্ষ করে যে, তাদের মধ্যে এখনো প্রাণের হাতছানি প্রবল। পনেরো বছর পর বৃষ্টির দেশে ফেরার  বিষয়টা তাঁদের জন্য খুবই আনন্দের।
আগামীকাল তাঁরা তিনজন রাজধানীর উদ্দেশে রওনা হবেন। মেয়ের আবদার এয়ারপোর্টেই সবাইকে দেখতে চাই। এরই মধ্যে তাঁরা রাজধানীর পথের খোঁজ, গাড়ি-ঘোরার খোঁজ নিতে থাকে। এবার তিনজনের মধ্যেই যানবাহন বিষয়ক চিন্তার বিস্তার ঘটে। তাঁদের মনে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়। যখন তাঁরা জানতে পারে যে, স্বয়ং এয়ারপোর্টের নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে! নতুন এয়ারপোর্টের চেহারা কেমন হবে, নামটা মুখস্থ রাখতে হবে। তাঁরা এ-কথাও জানতে পারে যে, এখন আর ফেরিঘাট নেই, ব্রিজের ওপর দিয়ে তরতর করে গাড়ি চলে যায়। তাঁদের মনে অচেনা ভয়। তবু আল্লাহর মাল আল্লাহই পথ দেখাবে ভেবে তাঁরা প্রস্তুত হতে থাকে।
ছুরতুন্নেছা একটা পুরনো আমলের ট্রাভেল ব্যাগের ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে বিচলিত হয়ে ওঠেন। বারান্দায় বসা ছেলের উদ্দেশে বলেন Ñ ওই আমনুল, ব্যাগের চেইনডা দেহি ভ্যালা নাই।
আমিনুর রহমান একগোছা তালা-চাবি আর নারকেল তেলের বোতল নিয়ে বসেছেন। তিনি একটা করে তালায় চাবি ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন। তারপর ফোঁটা-ফোঁটা নারকেল তেল তালার ভেতর দিয়ে রাখেন। প্রায় বারো-তেরো বছর বাদে বাড়িঘর তালা দিয়ে তাঁরা সবাই বাড়ির বাইরে যাবেন। ছেলের জবাব দিতে দেরি হলে আবার চিৎকার করেন ছুরতুন্নেছা Ñ এমুন ব্যাগে কাপুড় নিমু ক্যামনে, ও আমনুল।
আমিনুর সাহেব এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত থেকে ব্যাগটা নেন। Ñ দেখি দ্যাও নিমাইয়ের কাছে দিয়ে আসি, পালটাই দিবেনে।
রাবেয়া বেগমের ব্যস্ততা সবচেয়ে বেশি। বাড়ির সবকিছু গোছগাছ করে রেখে যেতে হবে। রান্নাঘর গোছাতে গোছাতে হঠাৎ থমকে যান, মনে হয় চকচকে সিলভারের হাঁড়িটি যেন জলছল চোখে রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। পিঁড়িতে বসে সাজিয়ে রাখা বাসন- কোসন দেখে। বুকটা কেমন হা-হা করে ওঠে তার। কত বছর এসব হাঁড়িকুড়ি ছেড়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া হয়নি। মেয়েটা বারবার বলেছে, না গেলে কষ্ট পাবে। রাবেয়া বেগম হাঁড়িটাকে হাতে নিয়ে আঁচল দিয়ে গা মুছে দেন। যেন তিনি তাঁর আরো একটি কন্যাকে  সান্ত্ব¡না দিচ্ছেন। ভেতরে কেমন হু-হু বাতাসের গুমরানি। যদি এই সংসারে আর ফিরে না আসি! পথে বের হইলে কি আর সে-নিশ্চয়তা আছে! ঢাকা শহর এই বারো বছরে কতখানি পালটে গেছে। তিনি ঠান্ডা ইস্পাতের নারকেল কোরানিটার খাঁজকাটা মাথায় হাত বোলান। যেন তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের সংসার ছেড়ে যাচ্ছেন। আনমনে নারকেল কোরানির সঙ্গে কথা বলেন Ñ কি রে, এমনে কী দেখোস? একদিন পরেই ফিরা আসুম তো।
ফিরা আসার প্রত্যাশায় রাবেয়া বেগমের চোখ বেয়ে পানি পড়ে। চোখের পাতায় ভেসে ওঠে রাস্তার পাশে সারি সারি লাশের ছবি, দুমড়ানো-মোচড়ানো বাসের ছবি! প্রতিদিন রাতের খবরে এমন কতশত ছবি যে দেখতে হয়। তাঁর খুব মায়া হয়, তিনি নারকেল কোরানিকে আরো শক্ত করে হাতের মুঠোয় চেপে ধরেন।
রাতে আমিনুর রহমান বারবার বলতে থাকেন Ñ গাড়ি কইলাম ভোর ৭টায়, তাড়াতাড়ি বাইর হইতে হবে। যদিও রাবেয়া খুব চাইছিল একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে যাবে। তিনি একবার সে বিষয়ে খোঁজ নিতে বেরিয়েছিলেন, মোড়ের হামিদ মেডিক্যাল ফার্মেসির ইয়াকুব সাহেব বললেন, আজ নাকি একই পরিবারের এগারোজন মারা গেছে! মাইক্রোবাসে কোথায় যাচ্ছিল। এরপর তিনি মাইক্রোবাসের দিকে না গিয়ে সোজা নতুন বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসের টিকিট কেটেছেন।
ছুরতুন্নেছা জানালার পাশে বসে হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ পান। এখন এই গন্ধটাই তাঁর পছন্দ। তাঁর মনে পড়ে গ্রামে তাঁদের কতবড় বাড়ি ছিল, কত গাছ-গাছড়া। কাঁচা বেলি ফুলের কথা মনে হয়, বিয়ের পর তাঁর পছন্দের গন্ধ ছিল সেটা। বাড়ির পুকুরের পূর্বপারে পারিবারিক কবরস্থান, সেখানে তাঁর দাদা-শ্বশুরের কবরের ওপর ঝুমকো জবার খুব টুকটুকে রং ছিল। পুকুরপার ধরে কত গাছ! নারকেল-সুপারি আর সিন্দুরের আম। তিনি দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়েন Ñ আহারে।  এই বাড়িতে তো মোটে দুই-চারটা গাছ। দুইটা নারকেল, হাসনাহেনা আর একখান মেন্দিগাছ মাত্র। মেন্দিগাছের কথা মনে হতেই তাঁর মুখ দিয়ে প্রশান্তির কথা ফোটে Ñ বড় পবিত্র গাছ!  নবীজি দাড়িতে মেন্দি পরতেন।
ছুরতুন্নেছা মেন্দির পাতা পায়ে মাখেন না, কিন্তু তাঁর ছেলের বউ রাবেয়ার মধ্যে ভক্তি-শ্রদ্ধা কম। পায়ে পানিরোগ সারাতে সে মেন্দিপাতা বেঁটে মাখে! এজন্যেই তো তাঁদের সংসারের হাল এরকম। পোলাপাইনগুলারে বিদেশে পাঠায়ে সুখ পায়! পাশের রুম থেকে আমিনুর চিৎকার করেন Ñ মা, এখনো ঘুমাও নাই। সকাল সকাল কিন্তু উঠতে হইব।
ছুরতুন্নেছার রাগ হয়, বলে Ñ ঘুমাবানে…
কিন্তু তিনি পা-মেলে চাঁদের বুড়ির মতো বসে থাকেন। কত কী ভাবেন, তারপর একসময় আঁচলের পুঁটলির মতো গিঁট খোলেন। কাপড়ের ভাঁজ থেকে ছোট্ট বড়ই ফুলের মতো নাকফুল বের হয়। তাঁর সম্পদ! তিরিশ বছর আগে স্বামী মারা গেলে সবাই মিলে নাকফুলটা খুলে দিয়েছিল। সেই থেকে এটাকে অতিযন্ত্র করে লুকিয়ে রেখেছেন। খাঁটি সোনার জিনিস। ছেলে-ছেলের বউ দেখলে যদি নিয়ে যায়। সেই ভয়ে সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে রাখেন। কাল ঢাকায় যাওয়ার সময় এই নাকফুলটা তিনি কী করবে? সঙ্গে নেবেন? নাকি রেখে যাবেন? সঙ্গে নেবেন ভেবে একবার আঁচলের খুঁটে বাঁধেন। কিন্তু শান্তি পান না। যদি চোর-ডাকাত ধরে? এই কালে তো চোর-ডাকাত ছাড়াও শহরে ছিনতাইকারী না কী সব আছে। তিনি আঁচল থেকে আবার খুলে হাতের তালুতে নাকফুলটা ধরে থাকেন। তিরিশ ভরি গয়না দিয়ে তাঁর বিয়া হইছিল, সবই সেই গণ্ডগোলের বছরের শেষ। এখন আছে এই নাকফুলটা। বাড়িতে রাইখা গেলেও তো চোরে নিতে পারে। তাঁর চোখে ঘুম আসে না, তিনি হেলান দিয়ে বসে থাকেন। ছুরতুন্নেছা ঠিক করেন, হায়াত-মউতের কথা কওন যায় না। তিনি নাকফুলটা সঙ্গে নেবেন না। নাকফুলটা বাড়ি রাইখা গেলে তিনি মইরা গেলেও তাঁর উত্তরাধিকার কেউ পাবে। কিন্তু তাঁরা বাড়ি ফেরার আগে যদি চোর-ডাকাত আসে! আজকাল ঘরের মধ্যেও মানুষরে মাইরা-থুইয়া যায়। বয়স্ক মাথা চিন্তার ভারে কেঁপে যায়। শহরে শহরে পাড়ায় পাড়ায় মানুষের কথাগুলো ছুরতুন্নেছার কান পর্যন্ত এসেছিল। সবাই কীসব বলাবলি করেছে, সরকার নাকি সাফ সাফ জানায়াছে, কারো শোয়ার ঘরে পাহারা দিতে পারবো না। ছুরতুন্নেছা অবশ্য মনে করতে পারে না কোনোকালে ট্রাফিক পুলিশের মতো পাহারাদার মানুষের শোয়ার ঘরে থাকত কি-না? এখন দুনিয়া অনেক বদলাইছে, এসব কথার কোনো মানে খুঁজে পায় না সে। তাঁর মনে হয়, হাসনাহেনার চেয়ে কাঁচা বেলির গন্ধই ভালো। হাসনাহেনা গাছে সাপ আসে। তিনি জানালার বাইরে তাকিয়ে অন্ধকার দেখেন। দেখতে দেখতে অন্ধকার ভেদ করে জোনাক পোকার মতো একটা বুদ্ধি যেন খেলে যায় তাঁর মাথায়। ছুরতুন্নেছা নড়বড়ে শরীরে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যান।
রাবেয়া বেগম খাবার ঘরের বাসনকোসন গোছগাছ শেষে স্বামীর উদ্দেশে বলে Ñ ফ্রিজটা বন্ধ করবানি? তাইলে তুলিগো বাড়ি মাছ-মাংসগুলো রাইখে আসতে হইত।
আমিনুল সাহেব জানান Ñ না থাক। একদিনেরই তো ব্যাপার।
রাবেয়া বেগম টেলিভিশনের প্লাগটা খুলে রাখেন, আজ আর খবর দেখবেন না। খালি খালি দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কী? সারাদিন ম্যালা কাজে কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে, শোয়া দরকার। পানের বাটা নিয়ে বিছানার দিকে যান তিনি। কিন্তু সহসা তাঁর মনে হয়, রান্নাঘরে আটা ছেনা থালিটা কোথায় রেখেছেন? মনে করতে পারছেন না। তাঁর আরো মনে হয়, নতুন ডিসকো হাঁড়ি, সসপেন আর দুধ আনা কেতলিটা.. ঠিকমতো রেখেছেন তো? তিনি দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে যান।
ব্যাগ গোছানো শেষ করে একটা ফাইল বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আমিনুর রহমান। এটা তাঁর বাড়ির দলিল। সারাজীবনে  এ-বাড়িটাই তিনি করেছেন। বাপ-দাদার থেকে যা পেয়েছিলেন ধানিজমি আর ভিটাবাড়ি তা ছেলেমেয়ে দুইটা মানুষ করতেই শেষ। ছোটখাটো সরকারি চাকরির বেতনে খাওয়া-পরা চালাতেই শেষ। লোনের টাকায় এই বাড়ি করা। পেনশনের সব টাকা গেছে সে লোনের পেছনে। সেই জমির দলিলটা এখন তিনি কোথায় রেখে যাবেন? একবার কি মনে করে ব্যাগে ভরেন। তারপর চেয়ারে বসে একমনে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ব্যাগটা এখন তাঁর সবচেয়ে দামি সম্পদ। কিন্তু সঙ্গে নেওয়া কি ঠিক হবে? কী মনে করে আবার ব্যাগ থেকে বের করেন। তারপর স্টিলের আলমারি খুলে আবার সিন্দুকের মধ্যে ফাইলটা রেখে দেন। তাঁর এই ঢাকা যাওয়া, বৃষ্টির দেশে ফেরা সব কিছুই ঝামেলার মনে হয়।
উরে বাপরে… গেলাম রে গেলাম – বলে ভাঁজ পড়া কপালে কাঠির  মতো আঙুলগুলো দিয়ে ঘষতে থাকেন ছুরতুন্নেছা। হাতের নিচে  থলথলে কোচকানো চামড়া ঝুলে ঝুলে দুলছে।
রাবেয়া বেগম সেদিকে লক্ষ না করে দেখেতে থাকেন মেঝেতে উপুর হয়ে পড়ে আছে লবঙ্গ রাখার কালো হাকিমপুরী জর্দার কৌটা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নাকফুলের মতো লবঙ্গ। তিনি এবার ছুরতুন্নেছার দিকে চেয়ে দেখেন শাশুড়ি এখনো কপাল ডলছেন, আর ক্রমেই কপালটা কালো হয়ে যাচ্ছে। তিনি এগিয়ে যেতে যেতে বলেন, এত রাইতে রান্নাঘরে আইছেন ক্যান?
ছুরতুন্নেছা বারকয়েক খুক-খুক কাশি কেশে বলেন – গলাডা খুশখুশ করবার লাগছে, তাই লবঙ্গ নিবার আইছি।
রাবেয়া বেগম কপাল থেকে হাত সরিয়ে দেখতে যান, খুব লাগছে নিকি?
তারপর অবাক হয়ে বলেন, ওমা! এমুন কইরা কয়লা ঘষতাছেন ক্যা?
ছুরতুন্নেছা  – কই? বলে নিজের আঙুলের মাঝে ধরা কয়লার দিকে তাকান। তিনি যে কপালে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে গিয়ে হাতের কয়লার কথা ভুলে গিয়েছিলেন তা মনে পড়ে।
রাবেয়া বেগম বলে – এই তো হাতের মধ্যে কয়লা?
ছুরতুন্নেছা অপরাধীর মতো মুখ করে বলেন – সকাল সকাল যাইতে হইব, তাই রাইতে কয়লাগুলোন ঘরে নিতেছিলাম। আমি তো তোমাগো মতো পেস্ট দিয়া দাঁত মাজি না।
রাবেয়া বেগম লবঙ্গগুলো খুঁটে খুঁটে জর্দার কৌটায় ভরে তারপর শাশুড়ির দিকে বাড়িয়ে দেয় Ñ নেন, তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়েন গে যান।
ঘরে ফিরে ছুরতুন্নেছা দুহাতের তালুতে এক টুকরা কয়লা গুঁড়ো করে। তারপর আঁচলের খুট থেকে নাকফুলটা বের করে কয়লার গুড়ো মাখায়, জর্দার কৌটার লবঙ্গগুলোর মধ্যে নাকফুলটা রেখে ছানিপড়া চোখে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। – নাহ্, চেনন যায় না। বেশ নিশ্চিন্ত অনুভব করে তিনি ঘুমোতে যান। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। সকাল সকাল উঠতে হবে। তাঁর কেন যেন মনে হয়, যদি তিনি উঠতে না পারেন তাহলে তাঁকে রেখেই তারা চলে যাবেন। তাঁর বুঝি যাওয়া হবে না। তাহলে একা একা কী করে থাকবেন সে-ভাবনায় তাঁর ঘুম আসে না।
রাবেয়া দেখে শাশুড়ি ছাইতোলা হাতা ভর্তি করে ছাই চুলার পাশে রেখে গেছেন। সারাঘরেই ছাই পড়ে আছে। তিনি হাতার মধ্যে থাকা ছাইগুলোকে আবার চুলার মধ্যে ঢালেন। তারপর হাতাটাকে গুছিয়ে রেখে ঘর ঝাঁট দেন। আটা ছেনা সিলভারের থালাটাকে খুঁজে নির্দিষ্ট স্থানেই পান। রান্নাঘরের মাটির কলস ভর্তি পানি, কালো রঙের তাওয়া সব যেন কেমন মায়া চোখে চেয়ে থাকে। রাবেয়া বেগমের বাড়ি ছেড়ে দূরে যাওয়ার জন্য সকল তৈজসপত্র যেন দুঃখভারাক্রান্ত, যেন যেতে নাহি দেব। তাঁর বুকের ভেতর হাহাকার হয়। যেন চিরবিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি জিনিসকে তিনি আবার স্পর্শ করেন। তিনি ফিরে না এলে এসব জিনিসপত্র আর এই রান্নাঘরের কী যে অযতœ হবে! দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে তিনি রান্নাঘরের শিকল তুলতে গিয়ে এক অদ্ভুত হাসি হাসেন। নিঃশব্দ হাসিটা জড়বস্তুর সঙ্গে কথা বলে। যেন বলে, সোনা আমার ভালোমতো থাকিস। আমি তো এলাম বলে। ভালো থাকা মানে বহুদিন ধরে তাঁর কাছে মায়া। দূরের মায়া, রাতের দুঃস্বপ্নের মতো। মেঘের মতো মন খারাপ তার হাসিটা। যেখানে জুড়ে থাকে কান্না।
আমিনুর রহমানের চোখে ঘুম নেই। মা ও স্ত্রী শুয়ে পড়লে তিনি ঘরের দুদিকের দরজার খিল ঠিকমতো দেওয়া আছে কি-না পরীক্ষা করেন। তারপর টর্চলাইট জ্বেলে খাটের নিচ, টেবিলের নিচে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখেন। এই কাজ যে কেবল আজই করছেন তা নয়। বহুদিন ধরেই করেন। আজকাল বরং মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলেও একবার সব ঘুরে দেখেন। শহরের অন্যান্য অধিবাসীর মতো তিনিও সেই ঘটনার পর শঙ্কিত, যে-ঘটনায় সরকার আর জনগণের মধ্যে বেডরুমের নিরাপত্তা বিষয়ক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই তাঁর নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। মেয়েটার এ-সময় দেশে বেড়াতে আসাটা মোটেও ভালো লাগছে না তাঁর। ছেলেমেয়ে দুটো বিদেশে আছে দেখে কেমন শান্তি বোধ করতেন। নাতি-নাতনিদের ছবি দেখে আদর করতে ইচ্ছে যে হতো না তা নয়। কিন্তু দেশের যা অবস্থা তা ভেবে কখনো আসতে বলেন না। মেয়ে নিজে থেকে আসতে চাইতেই তিনি অবশ্য একবার বলেছিলেন, দেশে জনগণ আর সরকারের মধ্যে নিরাপত্তা বিষয়ক বিতর্ক চলছে। মেয়েটি সে-কথায় কান দিলো না। সব রুমে আরো একবার চেক করে তিনি স্টিলের আলমারির সামনে দাঁড়ান। স্ত্রীর ঘুমের ব্যাঘাত যাতে না হয় তাই খুব সাবধানে আলমারিতে চাবি ঘুরিয়ে পাল্লা খোলেন। দলিলের ফাইলটা থেকে সব কাগজ বের করে বসে বসে দেখেন। বায়নার কাগজ থেকে শুরু করে পিট দলিল। একটা ডায়েরিতে খতিয়ান নম্বরসহ কিছু তথ্য লেখেন। তারপর দলিলগুলোকে পলিথিনের ব্যাগে মুড়ে পায়চারি করতে থাকেন।
ছুরতুন্নেছা খানিকটা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু গভীর নয় বলেই শব্দটা কানে বাজল। তিনি চিৎকার কইরা ওঠেন Ñ চোর… চোর..
সে চিৎকারে রাবেয়া বেগমের ঘুমও ভেঙে যায়। তিনি বিছানায় স্বামীকে দেখতে না পেয়ে আরও বিচলিত হয়ে পড়েন।.. ও বৃষ্টির বাপ… বৃষ্টির বাপ..।
বিছানা থেকে নিচে এসে টেবিলের ওপর খালি ফাইল পড়ে থাকতে দেখে তিনি আর ভড়কে যান। Ñ ও আল্লাহ রে, আমাগো সব নিয়ে গেছে… বলে  দৌড়ে দরজার দিকে এগোন। বিশাল এক  চিৎকার দিতে যাবেন, তখন আমিনুর রহমান এসে রাবেয়া বেগমের মুখে হাত চাপা দেন। অন্য একহাতে ধরা শাপলা, রাবেয়া বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন –  ধরো, টর্চলাইটটা হাসনাহেনার তলায় রইছে, নিয়া আসি।
ইতিমধ্যে হাতের মুঠোয় জর্দার কৌটাসহ ছুরতুন্নেছাও এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের শঙ্কিত চোখেমুখে নীরবতার পাহাড়। পাড়ার মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিমের ঘুমন্তস্বরের আজান ভেসে আসে। তিনজন নিঃশব্দে অজু সেরে নামাজে বসেন। কোথাও যাওয়ার আগে দুই রাকাত নফল নামাজের ফজিলত তাঁদের এই সুবেহ সাদিকে মনে পড়ে। তাঁরা  ঠিক করেন, দুই রাকাত নফল নামাজ শেষে বেরিয়ে পড়বেন। ৭টায় তাদের বাস।