শম্ভু মিত্র

আবুল হাসনাত

বাংলা নাটকে আধুনিকতার পথ নির্মাণ ও সৃজনে বহুমাত্রিকতা এবং ঐতিহ্যভাবনার কথা যখন ওঠে তখন খুব শ্রদ্ধাভরে আমরা শম্ভু মিত্রকে (১৯১৫-৯৭) স্মরণ করি। কত ভাবেই না তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চকে করে তুলেছিলেন ঐতিহ্যিক প্রবাহের সঙ্গে ঐশ্বর্যবান ও আধুনিক। মঞ্চে প্রাণশক্তিসঞ্চারে নবধারার প্রবর্তক তিনি। বহুরূপী ও তাঁর নির্দেশিত নাটক বোধে নবীন ও দীপ্তিতে উজ্জ্বল; বাংলা মঞ্চধারায় নতুন প্রতিশ্রুতির প্রবর্তক। শুধু রবীন্দ্র-নাটকের প্রয়োগরীতি ও মঞ্চকুশলতার জন্যই নয়, নাটককে উৎকর্ষের উচ্চতায় পৌঁছোনোর সাধনায় তাঁর তুল্য ব্যক্তি নেই। সামগ্রিকভাবে তাঁর বোধ, বুদ্ধি, সাধনা ও সিদ্ধি উপলব্ধির জন্য পূর্বকালীন মঞ্চধারার রীতি ও শম্ভু মিত্র-প্রবর্তিত নাট্যধারা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়।

মঞ্চে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি যখন শিখরস্পর্শ করেছিলেন এবং পেশাদারি থিয়েটারের বৃত্ত ভেঙে নবনাট্য আন্দোলনে নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন, তখন কি কেউ ভেবেছিল এই মানুষটি বাংলা নাট্যমঞ্চকে দীর্ঘদিনের ভাবনায়, পরিশ্রমে, প্রজ্ঞায়, মননে, জিজ্ঞাসায় ও অনুজদের দীক্ষাদানে নব রীতি-কৌশলে কত উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাবেন। আমার তো কেবলই মনে হয়, তিনিই বাংলা নাট্যমঞ্চে আধুনিকতার পথ-প্রদর্শক। অপরিসীম সৃজন-প্রতিভার জোরে এবং নাটক ও নাট্যভাবনায় প্রতিদিন নিজেকে প্রস্ত্তত করে তিনি যে অভিনয়রীতি ও মঞ্চশৈলী নির্মাণ করে গেছেন তা উৎকর্ষে ও উচ্চতায় বাংলা আধুনিক নাটকে শম্ভু অধ্যায় বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। আজ জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।

নির্দেশনা এবং অভিনয়ের গুণে তিনি দর্শক-হৃদয়ের নানা স্তরে পরিশীলিতভাবে জীবন সম্পর্কে এমনভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন যা ছিল শুধু শম্ভু মিত্রের একক অবদান। ধরা যাক রাজা অয়দিপাউসে তাঁর অভিনয়ের গুণে দর্শক-হৃদয়ে যে টানটান উত্তেজনা অভিনয়ে যে গ্রিক আবহের সৃষ্টি অয়দিপাউসের আর্ত হাহাকার কিংবা রাজা নাটকে স্বরের ওঠানামা,  অন্ধকারের মধ্যে শুধু গলার ভেতর দিয়ে উচ্চারণ, যা বুকের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এ-উচ্চারণ কখনো কখনো মৃদু, তীব্র ও সূক্ষ্ম অভিনয়গুণের দিক থেকে সেখানে তিনি নিঃসঙ্গ, একক ব্যক্তিত্ব, তুলনারহিত। সমকালীনদের মধ্যে সেখানেই তিনি ছিলেন ভিন্ন।

তাঁর তিরোধানের পর তাঁর তুল্য কোনো প্রতিভা বাংলা নাট্যমঞ্চে আবির্ভূত হননি। যদিও আমরা জানি যে, তাঁর সমকালীন উৎপল দত্ত কিংবা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয়গুণে ও নির্দেশনায় বহুদিক থেকে মান্য এবং তাঁরা দুজন সত্তরের ও আশির দশকে বাংলা নাট্যমঞ্চে অভিনয় ও নির্দেশনায় যে-সমৃদ্ধি এনেছিলেন তা মঞ্চ-ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে আছে।

পূর্বজ নাট্যাচার্যদের মহান কীর্তি বাংলা মঞ্চের স্তম্ভকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে এবং লোকপ্রিয় করেছে বটে, তবু কথা থেকে যায়। বিনোদন, বীররস, ঐতিহাসিক বিষয় এবং জীবনের দুঃখ-বেদনাকে ধারণ করে যে-পেশাদারি মঞ্চ দর্শক-আনুকূল্য অর্জন করেছিল তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। সেই সময়ের রঙ্গালয় ও নাট্যসাধনা পরবর্তীকালের নাট্যচর্চায় গতিবেগ সঞ্চারিত করেছে কিন্তু তা কোনোভাবেই সমকালীন জীবনচর্যা ও সংকটকে প্রতিফলিত করেনি। দেশি-বিদেশি কত নাটকই তো অভিনীত হয়েছে নাট্যাচার্যদের প্রযত্নে ও পরিশীলনে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে পেশাদারি রঙ্গালয় দর্শক তৈরি করেছে, নাটক ও বিনোদনে ভূমিকা রেখেছে – এ-তথ্য খুবই জরুরি আমাদের কাছে। তবু এই নাট্যচর্চাকে জীবনের সচল ধারার প্রতিচ্ছবি হয়তো বলা যায় না। সমকালীন জীবন-চেতনা এবং ঐতিহ্যিক ধারার সমন্বয়ে সেক্ষেত্রে শম্ভু মিত্র বহুরূপী নিয়ে যে-নাট্যধারার সূচনা করেছিলেন তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অসীম।

শম্ভু মিত্র তিরিশ বছর বহুরূপীর প্রাণপুরুষ হিসেবে যে-নাট্যধারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা হয়ে উঠল বাংলা নাট্যমঞ্চের অভূতপূর্ব এক ইতিহাস। পঞ্চাশের ও ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক কর্মপ্রবাহেও এর প্রভাব পড়েছিল।

আমাদের ভাবতে ভালো লাগে যে, পূর্বজদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নাট্যমঞ্চে তাঁদের অভিনয়গুণ এবং অবদান সম্পর্কে শম্ভু মিত্র শ্রদ্ধাশীলই ছিলেন। বিশেষত শিশির ভাদুড়ী সম্পর্কে তিনি কত না প্রেম নিয়ে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছেন এবং মঞ্চে তাঁর অভিনয়ের কুশলতায় মুগ্ধ হয়েছেন। শম্ভু মিত্র-লিখিত একটি প্রবন্ধ থেকে উপলব্ধি করা যায় তাঁর হৃদয়ের ঔদার্য ও পরিগ্রহণবোধও কত তীক্ষ্ণ ছিল – ‘দিনের পর দিন আমি উইংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর অভিনয় দেখেছি আর আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি যে এতো প্রচন্ড জীবনীশক্তি একটা মানুষের থাকে কী করে!….’

‘তিনি তো নিকৃষ্ট হাতের আঁকা একটা নীরক্ত দ্বিমাত্রিক ছবি ছিলেন না। একটা বিরাট শিল্পী অজস্র জটিলতা দিয়ে একটা রক্তমাংসের পরিপূর্ণ মানুষ সৃষ্টি করেছিলো যার নাম শিশিরকুমার ভাদুড়ী।… কতোবার যে শিশিরকুমারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার এই কথাগুলোই মনে পড়েছে – মনে হয়েছে, মানুষটি একটি ব্যক্তি নয়, – অনেকগুলো ব্যক্তিত্বের একটা জটিল সংমিশ্রণে এই অনন্য মানুষটির সৃষ্টি হয়েছে। তাই হয়তো কখনো রাগ করেছি, ঝগড়া করেছি, কিন্তু তবু আত্মীয় বলে মনে করেছি। চারদিকের এই নিষ্ঠাহীন পেশাদার লোলুপতার মধ্যে তিনিই ছিলেন একটা অনমনীয় লোক যাঁর পা দিয়ে পয়সা ছুঁড়ে ফেলতে কোনো দ্বিধা হতো না।’ প্রসঙ্গ : নাট্য।

এই শতাব্দীর প্রারম্ভে একটির পর একটি রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অভিনয়-কুশলতা এবং বিষয়বৈচিত্র্য সঞ্চারের জন্য কত না আচার্য ও নটসূর্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। জীবনের অন্তিম দিনগুলোতে, দারিদ্র্য ও লাঞ্ছনা সত্ত্বেও এক স্বপ্ন বুকে নিয়ে শুধু মঞ্চকে ঘিরে অভিনয়কে নিয়ে তাঁরা জীবন অতিবাহিত করেছেন। কত ধনাঢ্য ব্যক্তি, বাঙালি ও অবাঙালি-নির্বিশেষে, রঙ্গালয় এবং নাটকে অর্থবিনিয়োগ করে নিজেদের ধন ও সম্পত্তিকে স্ফীত করেছেন, অনেকে আবার সর্বস্বান্তও হয়েছেন। অনেকেরই স্মৃতিচারণ থেকে এ-কথা জানা যায়। এ-প্রসঙ্গে সমকালের এক শক্তিমান অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের এক পর্যবেক্ষণকে আমাদের খুবই গুরুত্ববহ মনে হয়। রুদ্র বলছেন, ‘মজার ব্যাপার, যাঁরা পাইওনিয়ার হন, তাঁরা বুঝতে পারেন যে ভাবী কাল কোন পথে যাবে। সাংসারিক অসুবিধা বা খিদের সমস্যার বাইরে গিয়ে থিয়েটার যে আভাঁগার্দে হতে পারে, ওয়ে অফ লাইফ হতে পারে, সেটা শম্ভুদার আগে আমাদের দেশে কেউ ধরতেই পারেননি। তাঁর আগে যাঁরা আমাদের থিয়েটারের মাথা ছিলেন তাঁরাও গুণিজন, কিন্তু খানিকটা অগোছালো। তাঁদের মধ্যে একটা নেটিভ ইন্টেলিজেন্স ছিল। অ্যাক্টিং জানতেন। কিন্তু, নাটক পড়ে ছিল আবেগসর্বস্ব মান্ধাতার আমলে। শম্ভুদার থিয়েটারের মধ্যে বুদ্ধিদীপ্তি, সমাজ-সচেতনতা, শিল্পগুণ – এই তিনের সবটা ফলিতভাবে এল।’

সেই সময়ে শত বিরূপতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতারণার ভেতর দিয়ে এক-একজন মঞ্চ অভিনেতা এবং অভিনেত্রী এক ইউটোপিয়াকে ধারণ করে মঞ্চে অভিনয় করেছেন। এ সম্পর্কে বিনোদিনী দাসীর রচনা এবং আত্মজীবনী আমাদের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করে এবং তাঁর স্মৃতির ভিতর দিয়ে আমরা পৌঁছে যাই তাঁর কালের নাট্যচর্চা, মঞ্চ ও নাট্য-সাধনা এবং জীবনের বহুস্তরের সংগ্রামে। দল ভেঙেছে, থিয়েটার ভেঙেছে, ক্ষুৎপিপাসা মেটেনি, তবু অদম্য জেদ নিয়ে এবং অভিনয়ের অনলস্পর্শে স্পন্দিত হয়ে দিনের পর দিন অভিনয় করে গেছেন। নাটক করতে গিয়ে প্রতারিতও হয়েছেন সন্ধে হলে ছটফট করেছেন, কখন মঞ্চের পাদ-প্রদীপের আলোর নিচে এসে দাঁড়াবেন। কখনো হাসি-কান্নায়, কখনো বীররসে সিক্ত করেছেন দর্শকের হৃদয়কে। কখনো জীবনের বৃহত্তর পরিমন্ডল সম্পর্কে দুঃখ, বেদনা ও তাপ সম্পর্কে, দর্শকদের মনকে আলোড়িত করে স্থায়ী আসন রেখে গেছেন।

থিয়েটারের এই যাত্রাই নবনাট্য আন্দোলনের একটা পথ তৈরি করে দিয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে অভিনেতা কুমার রায় স্মারক বক্তৃতায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় যে-কথাটি বলেছেন, তা বেশ প্রণিধানযোগ্য : ‘যেখান থেকে বাংলা থিয়েটারের আধুনিক পর্ব শুরু হয়েছিল তার পেছনে আমাদের প্রথম পেশাদার থিয়েটারের, গিরিশচন্দ্রের থিয়েটারের একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল। সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে বাংলা থিয়েটার তার নাড়ির যোগ কখনো ছিন্ন করেনি। দ্বিতীয় একটা পর্বে গণনাট্য সংঘ সম্পূর্ণ অন্য একটা আদর্শে বাংলা থিয়েটার নিয়ে এসেছিল, তার প্রভাব হয়তো শেষ পর্যন্ত প্রত্যক্ষত খুব ফলপ্রদ হয়নি। তারপর যখন নবনাট্য আন্দোলন শুরু হলো, তার পুরোভাগে বহুরূপী একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। বহুরূপীই বেঁধে দিয়েছিল সেই নাট্যগোষ্ঠীধর্ম, যাতে একজন নাট্য-নির্দেশককে কেন্দ্র করে তাঁরই প্রতি প্রচন্ড আনুগত্য, প্রচন্ড নিষ্ঠা, প্রচন্ড শ্রদ্ধায় সম্পূর্ণ তদ্গত একটা সম্প্রদায় তৈরি হয়, যাদের আদর্শবাদ পেশাদার থিয়েটার থেকে নিজেদের সচেতনভাবে বিচ্ছিন্ন করতে প্রাণিত করে। এই থিয়েটারের কর্মীরা ভেবে গর্ববোধ করতেন যে, তাঁরা উপার্জনের জন্য, অর্থের জন্য, কারবারের জন্য থিয়েটারে আসেননি; থিয়েটারের নিজস্ব একটা ভূমিকা আছে, সেই বোধে সেই ভূমিকার প্রতি আনুগত্য থেকে তাঁরা থিয়েটারে এসেছেন।’

শম্ভু মিত্রের নির্দেশনা বাংলা মঞ্চের প্রচলিত ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। ইউরোপীয় প্রসেনিয়াম থিয়েটারের আদলে চৌরঙ্গী থেকে বেলগাছিয়া, পাইকপাড়া, পাথুরেঘাটা এবং অনেক ধনী ব্যক্তির নাটমন্দিরে যে-ধারা ও রীতিতে অভিনয় হতো তা তিনি বদলে সম্পূর্ণ নতুন এক আঙ্গিক প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি সৃজনে উৎকর্ষকে প্রাধান্য দিলেন এবং মঞ্চের বিন্যাস, আলো, পোশাক, ভাষা, উচ্চারণ বা স্বরক্ষেপণে পূর্বজদের রীতিকে ভেঙে দিলেন এবং মঞ্চের বিন্যাসে এমন এক শিল্পিত পরিপ্রেক্ষিতের স্পর্শ দিলেন যা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। এ নিয়ে তিনি বহু ভেবেছেন এবং এক রূপকল্পে নাটকের অন্তর্নিহিত শক্তিকে ধরতে চেয়েছিলেন, যা ছিল অনেক দিক থেকে সংবেদনশক্তিতে তীব্র ও উজ্জ্বল। শম্ভু মিত্রের ভেতর অঙ্গীকার ছিল, ভিন্ন আদর্শ ছিল। তিনি যখন গণনাট্য সংঘে নবান্ন করছেন তখনই নাটকের বিন্যাস ও সামগ্রিক উপস্থাপনা নিয়ে নতুন কিছু করার জন্য প্রাণিত বোধ করেছেন। গণনাট্য সংঘে তৎকালে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন ভারতবর্ষের খ্যাতিমান সব সৃজনশীল ব্যক্তি। তাঁদের সৃজনে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আর্তি ও সংগ্রাম, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। নাটকে, সংগীতে, চলচ্চিত্রে ও চিত্রকলার সৃজনে সাধারণ মানুষের জীবনছবি যে-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছিল তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী – বক্তব্যে এবং বিন্যাসে নবীন। গণনাট্য সংঘের সৃজন-উদ্যোগ সত্যিকারভাবেই ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের হৃদয়-মনকে একদিকে বৃহত্তর সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল, অন্যদিকে সংঘের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বামপন্থার প্রসারণ, তা অর্জিতও হয়েছিল। সংঘ যখন এই লক্ষ্য অর্জনে উন্মুখ – কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ ও শিল্পের স্বাধীনতা প্রশ্নে এবং পার্টির খবরদারিতে সঙ্ঘ ভেঙে যায়। বেরিয়ে আসেন অনেকে, নির্মাণ করেন সৃজনের ভিন্ন পথ। যদিও আমরা জানি যে, যুবা বয়সে নাটকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি সাধারণ রঙ্গালয়েও অভিনয় করেছেন। তিনি এই সময়ে শিশিরভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী, যোগেশ চৌধুরী, ভূমেন রায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখের সঙ্গে অভিনয় করেন। নট নাট্যকারদের সঙ্গে এই সময়ে পরিচিত হন। সেই যুবা বয়সেই তাঁর মননে নাটক মঞ্চায়ন সম্পর্কে যে বোধ ও উদ্ভাবনী কৌশল কিছুটা হলেও কল্পনার রূপ পেয়েছিল তার সঙ্গে এই রঙ্গালয়ে অভিনীত নাটকের কোনো সাদৃশ্য তিনি খুঁজে পাননি।

আইপিটিএ থেকে বেরিয়ে এসে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে শম্ভু মিত্ররা গোষ্ঠীচেতনা ও নবনাট্য আন্দোলনকে সঞ্জীবিত করার জন্য নাটক শুরু করলেন ১৯৪৮ সালে। তখনো দলের কোনো নামকরণ হয়নি। এ প্রসঙ্গে শম্ভু-কন্যা শাঁওলী মিত্র বলেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টির সংসর্গচ্যুত এই যুবকেরা যখন বুঝে উঠতে পারছেন না কী তাঁদের করণীয়, তখন মহর্ষি [মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য] সাহস দিয়ে বলেছিলেন, Why are we eating our hearts out? আমরা কিছু করি। আমাদের সঙ্গে তো ঝগড়া নেই কারও-র। আমরা যেমন করে পারি, যেটা ভালো মনে করি, করতে শুরু করে দিই।’ এই অনুপ্রেরণা থেকেই ১৯৪৮ সালে বহুরূপীর জন্ম। কাজ শুরু হয়ে যায়। যদিও নামকরণ হয়েছিল বছর দুই পরে, ১৯৫০ সালে। দেশের এবং ব্যক্তিগত জীবনের চরম বিপর্যয়ের মধ্যেই বহুরূপীর জন্ম। বলা যেতে পারে বহুরূপী তাঁদের প্রথম সন্তান। যে-সন্তানটির প্রতি তাঁদের একাগ্র মনোযোগ, সমস্ত যৌবন দিয়ে তাকে গড়ে তোলবার সাধনা। আর তা এতই স্বাভাবিক ছিল, সে যেন নিঃশ্বাসের মতোই।’

বহুরূপী-প্রযোজিত নবান্ন নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল রঙমহলে ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। এরপর ক্রমান্বয়ে বহুরূপী মঞ্চে আনে পথিক, উলুখাগড়া, ছেঁড়া তার, বিভাব, চার অধ্যায়, দশচক্র, স্বপ্ন, এই তো দুনিয়া, ধর্মঘট, রক্তকরবী প্রভৃতি নাটক। রক্তকরবী প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১০ মে ১৯৫৪ সালে, ইবিআর ম্যানসন ইনস্টিটিউট শিয়ালদহে, শেষ অভিনয় ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে।

১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৭৫ – এই দীর্ঘকাল বহুরূপীর পথযাত্রায় মঞ্চস্থ রক্তকরবী শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জীবনচেতনায় এবং বিশেষত নাট্যপ্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত সকলকে জিজ্ঞাসা-উন্মুখ ও নবীন
পথপ্রবাহ-সৃষ্টির জন্য প্রণোদিত করেছিল।

বহুগুণান্বিত শম্ভু মিত্রকেই আধুনিকতার পথিকৃৎ বলে মনে পড়ে। তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, কল্পনা, স্বপ্ন ছিল নাটক। সেই নাটক যা দর্শককে করবে জীবন সম্পর্কে আকুল কিংবা ভাবনা ও জিজ্ঞাসাকে উন্মুখ করে তুলবে। নির্দেশনা কেবল নির্দেশনা ছিল না তাঁর কাছে। কত পরিশ্রমে, কতভাবে চরিত্রের অন্তর্নিহিত মাধুর্য, সৌন্দর্য ও বোধ তাঁকে বলীয়ান করেছিল নাট্যচর্চায় তা নানাজনের স্মৃতিকথায় উল্লিখিত হয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নাটক সম্পর্কে ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান, পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে শম্ভু মিত্র এ কৃতি অর্জন করেছিলেন।

বহুরূপীর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন শম্ভু মিত্রের। বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর যে-যুগ – তারপরে নবনাট্যের মধ্য দিয়ে তিনিই আরেক অধ্যায়ের সূচনা করেন। তিনটি দশক তিনি সক্রিয় ছিলেন বহুরূপীতে। ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেননি। তাঁরই প্রবর্তনায় রবীন্দ্রনাটক পুনরাবিষ্কৃত হয়েছে।

বাংলা নাট্যমঞ্চ নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে বিবর্তিত হয়েছে। বহুরূপীতে শম্ভু মিত্র যে-অধ্যায় নির্মাণ ও প্রবর্তনা করেছেন তা আজ বাংলা মঞ্চনাটকে এক ইতিহাস হয়ে আছে।

১৯৪৮ সালের ২৮ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়েছিল। আইপিটিএতে তাঁর সৃজন-উদ্যোগ শ্রদ্ধা অর্জন করলেও তিনি এই সংঘে থাকতে পারেননি। বহুবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম ছিল শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন এবং কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বের রদবদল। ‘শোধনবাদী’ লাইন অনুসরণের অপরাধে পি সি যোশীকে সরিয়ে দেওয়া হলো।

যোশী ছিলেন সর্বতোভাবে ভদ্র, সজ্জন, তাত্ত্বিক গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে এবং শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সৃজন-উদ্যোগে শ্রদ্ধাশীল। তিনি মনে করতেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বসাধারণকে বৃহত্তর সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। আমরা সাজ্জাদ জহীর, হীরেন মুখার্জী, বিষ্ণু দে-র স্মৃতিকথা থেকে জানি যে, সেজন্যেই তিনি যখন পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন সে-সময়ে তাঁরই উদ্যোগ ও স্নেহছায়ায় কত না সৃজনশীল মানুষ ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘ ও গণনাট্য সংঘে সমবেত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলের নানা ভাষার এত অগণিত সৃজনশীল নক্ষত্রের মতো ব্যক্তিত্বের সমাবেশ এর আগে বা পরে আর ঘটেনি।

যোশীর জীবনীকার গার্গী চট্টোপাধ্যায় তাঁর বইটিতে এ-প্রসঙ্গে একটি অধ্যায়ে যে-বিবরণ দিয়েছেন তা বেশ আগ্রহোদ্দীপক।

শিল্পীর স্বাধীনতা এবং কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আছে পন্ডিত রবিশঙ্করের। রবিশঙ্করেরা যখন একের পর এক সব অসাধারণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতবর্ষের মানুষের চিত্ত জয় করছেন কিংবা নবচৈতন্যে মানবিক হওয়ার সাধনার শ্রেয়োবোধের পথ নির্মাণ করছেন, রবিশঙ্কর অনুধাবন করলেন, পার্টির ওপর মহল থেকে তখন করণীয় সম্পর্কে নিত্য-নতুন নির্দেশ আসছে। এই নির্দেশের মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতির অনুষঙ্গ যত না ছিল তার অধিক ছিল পার্টির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বিশেষত তেলেঙ্গনা আন্দোলনের পর এই নির্দেশগুলি বড় বেশি পরিমাণে একরৈখিক হয়ে পড়েছিল।

শম্ভু মিত্র নির্দেশিত ও অভিনীত বেশ কয়েকটি নাটক দেখার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। শম্ভু মিত্রের প্রতিভা ও অভিনয় যখন গগনচুম্বী এবং কিছুটা কিংবদন্তিতে তিনি পরিণত হয়েছেন, সেই সত্তরের ও আশির দশকে আমি কয়েকটি নাটক দেখেছি। অভিনয় ও নাট্য-নির্দেশনার ক্ষেত্রে তখন তাঁর সফলতা আকাশচুম্বী। অগণিত নাট্য মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তিনি তখন সর্বভারতে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। সেই সময়ে রক্তকরবী, চার অধ্যায়, রাজা অয়দিপাউস, বাকি ইতিহাস, পাগলা ঘোড়া এবং আশির দশকে গ্যালিলিউ অভিনয় দেখতে পাওয়া আমার জীবনে পুণ্যস্মৃতি হয়ে আছে। বিশেষত রক্তকরবী, রাজা অয়দিপাউস ও তাঁর নির্দেশিত পাগলা ঘোড়া এখনো অম্লান। উপরিউক্ত সকল নাটকে তিনি অভিনয় করেননি বটে, কয়েকটিতে শুধু নির্দেশক ছিলেন।

রক্তকরবীতে রাজার সঙ্গে নন্দিনীর যে-সংলাপ সেখানে তিনি দৃশ্যমান ছিলেন না বটে কিন্তু প্রতিটি সংলাপই ছিল অর্থব্যঞ্জনায় ও স্বরের ওঠানামায় গভীর থেকে গভীরতায় যাত্রা। অন্তিম পর্যায়ে রাজা (শম্ভু মিত্র) বেরিয়ে এলেন। দর্শকরা দেখলেন তাঁকে, যাঁর কণ্ঠ এতক্ষণ অমোচনীয় ছিল দর্শক হৃদয়ে। দীর্ঘক্ষণ ধরে যে উত্তেজনা আর কৌতূহলকে রাজা-নন্দিনী ধরে রেখেছিল অন্তিমে তার পরিণত রূপ পেল সংগ্রামের আহবানে। আমরা দেখলাম শম্ভুর নির্দেশনা। মোহিত হলাম। তৃপ্তি মিত্রকে দেখলাম। নন্দিনী মঞ্চে ছিলেন প্রাণবন্ত, উচ্ছল ও আবেগে উদ্দীপিত এবং সমগ্র নাটকটিকে একটি সূত্রে বেঁধে রেখেছিলেন।

রাজা অয়দিপাউস নাটকে তিনি যখন মেষপালককে প্রশ্নের পর প্রশ্নে প্রকৃত ঘটনাবলি জানতে চাইছেন এবং প্রশ্নের অন্তর্মুখী চাপ নাটকটিকে এক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, অনিবার্য হয়ে উঠছে তখন এক দুঃখ। কী এক উত্তেজনা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং এক অনিশ্চিতি ভর করে থাকে নাটকটির শরীরে। দুঃখভারাক্রান্ত ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা – পিতার হত্যাকারী ও জননীর সঙ্গে দাম্পত্যের সম্পর্ক স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে, মঞ্চে বাক্যহীন নিঃশব্দ অভিব্যক্তির মধ্যে দর্শকেরা শম্ভুর আর্তনাদ ও হাহাকারে দীর্ণ হয়ে কষ্টকেও ধারণ করেন বুকে।

এ নাটকটি আমি যতবার দেখেছি শম্ভুর অভিনয়শৈলী আমাকে বিস্মিত করেছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর গোষ্ঠীসদস্য কুমার রায় তাঁকে নিয়ে একটি অনন্য গ্রন্থ লিখেছেন। এই নাটকটি আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলছেন :

মধ্যমঞ্চ থেকে শুরু করে মঞ্চগভীর পর্যন্ত মঞ্চজোড়া পাটাতন ধূসর কাপড়ে ঢাকা। রঙ্গশীর্ষে মধ্যিখানে লালচে মেরুন রঙের দুটি বৃহৎ থাম – স্বল্প অলংকৃত। কয়েক ধাপ সিঁড়ি থামের মধ্যস্থানে পাটাতনের ওপর থেকে উঠে গেছে। থামের মাঝখানে সিঁড়ি শেষের সমতলের পিছনে লাল রঙের ফ্ল্যাট। অভিনেতার ডানদিকে অন্দরে যাওয়ার আলোকিত পথ। থামের বাইরে দিয়ে দুদিকে প্রসারিত কালো পর্দা। মঞ্চব্যাপী পাটাতনের সামনের অংশে রঙ্গস্থলে দুদিকে খানিকটা ছেড়ে দুটি কিংবা তিনটি ধাপের টানা সিঁড়ি। অভিনেতার ডানদিকে সেই সিঁড়ির ধাপের শেষে একটা ঢালু সরু চাতাল নেমে এসেছে মঞ্চতল ছুঁয়ে। মঞ্চবামে মূল পাটাতনের ওপর একটা প্রার্থনা জানানোর বেদি। সেটার রংও ধূসর এবং গ্রিক মোটিফের অলংকরণ তার গায়ে। দুই থামের ওপরদিকে মধ্যবর্তী স্থানে একটা ছোটো মেরুন রঙের ফ্ল্যাট লাগানো থাকত – তার মাঝে দেব আপোল্লোনের প্রতীক সোনালি-হলুদ রঙের সূর্য। ওই সূর্যচিহ্নযুক্ত ফ্ল্যাটটা লাগানোর ফলে থামের মাঝে একটা প্রবেশ পথের অনুরূপ তৈরি হত। অন্ধকার (প্রেক্ষায় যবনিকা উঠতে শুরু করলেই যারা নতজানু হয়ে মূল মঞ্চে, সিঁড়ির ধাপে, হাতে পল্লব ও পশম নিয়ে বসে থাকত (প্রায় তিরিশ জন) তাদের মুখে রাজার নাম নিয়ে আর্তনাদ শোনা যেত।

সেসময় যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় শ্রীনিরপেক্ষ (অমিতাভ চৌধুরী) জানিয়েছিলেন সে-অভিনয়ের দর্শক প্রতিক্রিয়া :

সময়ের দূরশ্রুত হাহাকার সমস্ত রাজকীয় দন্ডকে ছাপিয়ে ইদিপাসের প্রাসাদের রক্তিম স্তম্ভ চূড়ায় যেন ক্ষণকালের জন্য আবদ্ধ হয়েছিল এবং নাটকের চরম সর্বনাশের মুহূর্তে হতবল, হৃততেজে অন্ধ ইদিপাস যখন শেষবারের মতো এই প্রাসাদ গহবরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন – শম্ভু মিত্রের স্মরণীয় অভিনয় নৈপুণ্যে সেই বিষাদগম্ভীর পরিণতি সমস্ত প্রেক্ষাগৃহকে অশ্রুতে বিস্ময়ে নির্বাক করে দিয়ে গেল।

সমগ্র প্রযোজনায় ঘটনাপ্রবাহকে এই পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, অভিনয়, আলো, মঞ্চ, পোশাক, অভিনেতাদের বিন্যাস, কণ্ঠস্বরের ঐকতান একটা সাংগীতিক গঠনে বাঁধা হয়েছিল। সমবেত আর্তনাদ দিয়ে নাটক শুরু হল – শেষ হল একক আর্তিতে ‘আমাকে আমার সম্পূর্ণতার পথে নিয়ে চলো’ – অন্ধ মানুষটি হাতড়াতে হাতড়াতে হামাগুড়ি দিয়ে যখন সিঁড়ির মাথায় তখন থামের মাঝখানে সোজা হয়ে একবার দাঁড়িয়ে দু-হাত ঊর্ধ্বে তুলে যেন সূর্যটাকে ছুঁতে চেষ্টা করছেন – সুতীব্র স্বরে ‘আপোল্লোন’ বলে আর্তনাদ করে শরীর ছেড়ে দিয়ে মুক্ত হয়ে যেতেন।’

বহুরূপীর ইতিহাস ও নানাজনের স্মৃতি থেকে জানা যায়, মহলার সময় শুধু শৃঙ্খলা নয়, অভিনয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়, উচ্চারণ ও চরিত্রের অন্তর্নিহিত শক্তি সম্পর্কে তিনি সদস্যদের কত যত্ন ও পরিশ্রমে শিক্ষা দিতেন। কোনো কিছুই তুচ্ছ ছিল না তাঁর এই শিক্ষণের পদ্ধতিতে। অনুজ কোনো নাট্যজন যতক্ষণ না চরিত্রের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারতেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে নানা দিক থেকে চরিত্রটির তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য তিনি বুঝিয়ে দিতেন।

শম্ভু মিত্রের অনুজসম ও বহুরূপীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, সংগঠক কুমার রায় তাঁর শিক্ষণ-নির্দেশনা সম্পর্কে যে-বিবরণ দিয়েছেন তা শুধু প্রণিধানযোগ্য নয় – তাতে শম্ভু মিত্র একটি চরিত্রের অন্তর্নিহিত বোধ দ্বারা কতভাবে স্পন্দিত ছিলেন, কতভাবে যে ছুঁতে চেয়েছেন জীবনযন্ত্রণার মরুপথকে, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

শম্ভু মিত্র ওঁকে বলেছিলেন : ‘নিজেকে কখনো একলা অনুভব করেছ? রাত জেগে অন্ধকারের মধ্যে চেয়ে থেকেছ, একলা ঘরের মধ্যে খাটের বাজু অাঁকড়ে ধরে কাউকে আর্ত হাহাকার করতে শুনেছ, দেখেছ, তার সারা শরীরের থরথরানি? – কল্পনা কর সেই মানুষ রাতের অন্ধকার পাড়ি দিয়ে আলো দেখতে পেল। আলোময় আকাশের দিকে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে সংকল্পবদ্ধ দৃঢ় পদক্ষেপে সবার অলক্ষ্যে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়ল পথে, তখন দেখা হল ক্ষিপ্ত জনতার সঙ্গে, সেই মানুষ তখন কী করে তার অনুভূতিকে, উপলব্ধ সত্যকে, তার ছটফটানিকে প্রকাশ করবে? – তোমার অভিজ্ঞতায়, কল্পনায়, এই কষ্ট, এই বেদনা উপলব্ধ হয়ে থাকলে তবেই তোমার মধ্যে দিয়েই সেই মানুষটিকে দেখতে পাবে।’

বহুরূপীর যখন জন্ম হলো এবং পঞ্চাশের দশকে শম্ভু মিত্র যে ঐকান্তিক সাধনায় বাংলা মঞ্চনাটকে প্রতিমান সৃষ্টি করলেন, জীবনঘনিষ্ঠ জিজ্ঞাসা সঞ্চারিত করলেন, বিচিত্রমুখী করে তুললেন তা পূর্ববর্তী নাট্যকারদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ নির্মাণ করেছিল। বিষয়ে, উপস্থাপনায় এবং অভিনয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে তাঁর আগে ওভাবে কেউ ভাবেননি।

বাঙালি নাট্যদর্শক ও নাট্যশিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ কেবল রবীন্দ্রনাটক-মঞ্চায়নের পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণের জন্যই নয়, তিনিই রবীন্দ্রনাটকের সফল নির্দেশক। রবীন্দ্রনাটকের বিন্যাসে এবং অর্থ উপলব্ধির বোধগম্যতায় তিনি এমন মাত্রা সঞ্চার করেছিলেন যা হয়ে ওঠে বাস্তবানুগ। সেজন্য রক্তকরবী প্রযোজনার কিছুদিনের মধ্যে এই নাটকের বক্তব্য এবং মঞ্চায়ন নিয়ে বহুরূপী ও শম্ভু মিত্রকে কত না তর্ক করতে হয়েছে। প্রতীক থেকে যখন বাস্তবভিত্তিক জনচেতনায় এ হয়ে উঠল অনন্য একটি মঞ্চনাটক, বুদ্ধিবাদী মহলকে প্রবলভাবে তা আলোড়িত করেছিল। এ-নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দিতে হয়েছিল অনেককেই। গোপাল হালদারের মতো ধীমান ভাবুক, প্রশান্ত মহালনবীশের মতো রবীন্দ্র সান্নিধ্যধন্য সুধীজনও এতে অংশ নিয়েছিলেন।

বিশ্বভারতীর আমন্ত্রণে শম্ভু মিত্র ১৯৭৭ সালে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে এক বছর শান্তিনিকেতনে ছিলেন। এই সময়ে তিনি নাট্য-সম্পর্কিত যে-বক্তৃতা দেন তার মধ্যে বিশিষ্ট ছিল ‘রক্তকরবী ও রবীন্দ্রনাথ : উপলব্ধি ও আবিষ্কার’। এই বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেছেন কীভাবে নানা পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্যের স্বাদ আস্বাদন করে তিনি পেঁŠছে যান রবীন্দ্রনাথকে মঞ্চে উপস্থাপনায়। এই উপস্থাপনায় কত না স্তর এবং অভিজ্ঞতায় নদীর মতো বাঁক রয়েছে। চার অধ্যায়, বিসর্জন আর রক্তকরবী এক ধরনের প্রযোজনা নয়। মঞ্চে বক্তব্য ও বিন্যাসে কত না পৃথক
এ-তিনটি নাটক।

পরিশেষে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে নাট্যকেন্দ্র স্থাপন, মঞ্চ-নির্মাণ ও ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলের নাট্যচর্চাকে অনুধাবন ও সম্যক পরিচয়লাভের জন্য অনুবাদ সেল গঠনেরও প্রস্তাব দেন তিনি। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলা নাট্যসংস্কৃতির গৌরবময় কেন্দ্র হয়ে উঠবে শান্তিনিকেতন – এ-আশাবাদও ব্যক্ত করেন তিনি।

বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে লেখা চিঠিটি পাঠ করার পর আমাদের মনে হয়, শম্ভু মিত্র নাট্যমঞ্চ ও নাট্যকেন্দ্র নির্মাণের জন্য
যে-সুপারিশ করেছিলেন তা বাস্তবায়িত হলে সত্যিকার অর্থে ভারতবর্ষের ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের নাট্যচর্চায় নবীন মাত্রা অর্জন করত। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই, কলাভবন প্রতিষ্ঠার পর চিত্রকলার ক্ষেত্রে যে বিকল্প রীতি ও শান্তিনিকেতন স্কুল চিত্রকলার প্রয়াসে যে অবদান রেখেছে তা ভারতবর্ষের চিত্রকলা আন্দোলনে নবধারার প্রবর্তক বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। শান্তিনিকেতনে শম্ভু মিত্র-প্রস্তাবিত এই দুটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলে নাট্য চর্চা, গবেষণা ও পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে আরো একটি দিগন্ত উন্মোচিত হতো, আমাদের দুর্ভাগ্য তা হলো না।

১৯৭৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপাচার্য শ্রী সুরজিৎ সিংহকে শম্ভু মিত্র একটি চিঠিতে লেখেন। এই চিঠিতে শান্তিনিকেতনে নাট্যচর্চা সম্পর্কে কিছু কথা বলেন। খুবই চিন্তাপ্রসূত ছিল এই চিঠি। এই চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছিল শ্রী উমা দাশগুপ্ত ও শ্রী অনাথনাথ দাস-সম্পাদিত Visva-Bharati News পত্রিকায় (XLV/8, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮)।

 

বিশ্বভারতীতে নাট্যচর্চা

শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনে নাট্যচর্চার মান কীভাবে উন্নত হতে পারে সে-সম্পর্কে আমার কিছু চিন্তার কথা বলেছিলাম। এখন সেটাই মোটামুটিভাবে লিপিবদ্ধ করে আপনাকে পাঠাচ্ছি। আশা করি, আপনারা আলোচনা করে এ-সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত নেবেন।

শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের একটা বহুমূল্য মূলধন আছে সেটা হল রবীন্দ্রনাথের নাট্যকৃতি। এবং এরই সঙ্গে একটি দায়িত্ব আছে, তা রবীন্দ্রনাথের নাট্যসম্ভারকে আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থময় করে দেশকে উপহার দেবার।

এখানে ‘আজকের দিন’ বলতে আজ ও আগামী যুগের পরিপ্রেক্ষিতেই রবীন্দ্রনাথের নাটককে বারবার নতুন অর্থময়তায় মন্ডিত করবার কথা বলছি। আমার ধারণা, রবীন্দ্রনাথের নাটকে সেই ক্লাসিক রূপ আছে। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি ধরা যায় যে তা নেই, তাহলেও তাঁর সৃষ্টিকে অবলম্বন করে বাংলা নাট্যসংস্কৃতি যে তার একটা মহামূল্য ভিত্তি খুঁজে পাবে, সে-বিষয়ে আশা করি কেউই আপত্তি করবেন না।

তার ওপর শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন গ্রামের মানুষের কাছাকাছি অবস্থিত। সুতরাং গ্রামের ও শহরের যে-মিলটা হওয়া আজ আমাদের দেশের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজন, আনন্দের ক্ষেত্রে সেই মিলটা আনার জন্যে তদ্গত হয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করলেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি সবচেয়ে বড়ো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়া হবে। এই চিন্তায় আমি নিম্নলিখিত পরামর্শগুলো দিচ্ছি।

এ কাজের দুটি দিক। একটি তত্ত্বগত আর একটি কর্মগত।

পৃথিবীতে কিছু দেশের নাট্যবিদরা নাট্যকলা সম্পর্কে নানান বই লিখে গেছেন। অবিলম্বে সেই বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করবার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাতে যে কেবল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যশিশিক্ষু ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে তাই নয়, সমগ্র বাংলার নাট্যচর্চা এর দ্বারা প্রভাবিত হবে।

এর জন্য একটি কমিটি করা দরকার। যারা স্থির করবেন কোন কোন বই কার কার দ্বারা অনুবাদ করানো যাবে এবং তারাই অনুবাদের মান সম্পর্কে যত্ন নেবেন।

এ-ছাড়া দেশী ও বিদেশী বিখ্যাত অভিনেতৃবর্গের আবৃত্তি বা অভিনয়ের রেকর্ডের একটা শোনার লাইব্রেরি করা।

ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের কুশলী শিল্পীদের এনে – বিশেষ করে  যাকে folk form বলা হয়, যেমন নৌটাঙ্কি, ভাওয়াই, তমাশা যক্ষগান এদের দলগুলোকে সংগ্রহ করে এনে – অভিনয়ের বন্দোবস্ত করা। তাতে সারা ভারতবর্ষের নাট্যপ্রকরণ কী ছিল বা আজো আছে, তার সম্পর্কে সবাই অবহিত হবে। এবং তার ফলে অনেক শহুরে নাট্যকর্মী, যিনি হয় পশ্চিমের নকল করেন নয়তো ‘জনসাধারণের জন্যে’ মোটা দাগের জিনিষ করেন, – এই অস্থিরতা থেকে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন রক্ষা পাবে বলে আশা করি। কিন্তু এই অভিনয়গুলো করানোর জন্যে জায়গা চাই। এখন শান্তিনিকেতনে একটা ভালো মঞ্চ নেই, এটা খুবই দুঃখের। রবীন্দ্রনাথের পীঠস্থানে ভারতবর্ষের সবচেয়ে ভালো রঙ্গমঞ্চের মধ্যে একটি থাকা উচিত। সেটা বিপুল আয়তন করার কোনো দরকার নেই, কিন্তু শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের পক্ষে যেন কোনো বাধা না হয়।

আর এরই সঙ্গে প্রয়োজন একটি মুক্তাঙ্গন মঞ্চ। এটিও যথেষ্ট বিবেচনা করেই করা প্রয়োজন। কোনোমতে একটি চবুতরা গেঁথে দেওয়ার মতো কাজ এটা নয়।

এই দুই মঞ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যশিশিক্ষুদের ব্যবহারের জন্য অবারিত থাকুক, যেখানে তারা হাতে-কলমে অনেক কাজ করতে করতে শিখতে পারবে।

সংক্ষেপে এইটুকুই বলবার।

আশা করি, আপনারা এই সম্পর্কে এমন কিছু দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নেবেন যার ফলে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন বাংলা নাট্যসংস্কৃতির গৌরবময় কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

রক্তকরবী সম্পর্কে ১৯৫৬ সালে রচিত একটি প্রবন্ধে শম্ভু মিত্র বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের নাটককে বোধ দিয়ে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করতে না পারলে বোধহয় বাংলা নাটকের মান উন্নত হবে না।’ শম্ভু মিত্র কতভাবে যে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকটি অনুভব করতে চেয়েছিলেন, এর গুরুত্ব কোথায়, তার বেশ কয়েকটি লেখায় এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে। বহু ভাবনায় আন্দোলিত হয়ে দেশীয় নাটকের একটি অবয়বও নির্মাণ করেন তিনি রক্তকরবীর মধ্যে।

বৌদ্ধিক দিক থেকে অগ্রসর চেতনার মানুষ অশোক মিত্র। থাকেন তখন দিল্লিতে। ’৫৬ সালে সাপ্রু হাউসে যখন মঞ্চস্থ হলো রক্তকরবী । তখন দল বেঁধে দেখতে গেলেন। যুবা বয়সে তাঁদের কতভাবে যে এই প্রযোজনাটি জীবনকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে শিখিয়েছে তা একটি লেখায় বর্ণনা করেছেন। ‘‘এমন সময় নতুন দিল্লির সপ্রু হাউস মঞ্চে ‘বহুরূপী’র ‘রক্তকরবী’। দল বেঁধে দেখতে গেছি আমরা, অভিজাত নারী-পুরুষের ঠাসাঠাসি ভিড়, বেশ-কিছু অধমর্ণেরও, প্রশ্ন-প্রত্যাশা-কৌতূহল, কেউ কেউ অবশ্য ঠিক নাটক দেখতে আসেননি, নিজেদের দেখাতে এসেছেন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁরা ঠিক ফ্যালনা নন, গুণ সবে জগৎজনে।

যবনিকা উন্মোচন, এ কোন মায়াবী পৃথিবীতে পৌঁছে গেলাম আমরা। আলোর এতগুলি পর্যায়ের পারস্পরিক সহাবস্থা, অন্ধকারও যেন আলোতে উদ্ভাসিত, না কি অন্ধকারও আলোর একটি বিশেষে অভিক্ষেপ। সপ্রু হাউসের মঞ্চ তেমন প্রশস্ত নয়, অথচ নাটকীয় জাদুতে তা বহু ব্যাপ্তির, বহু নিবিড়তার আবহ রচনা করেছে। মঞ্চ জুড়ে স্তব্ধতা, কিন্তু তার চেয়ে বাঙময় কিছু হতে পারে না, এরই মধ্যে তৃপ্তি মিত্র, শোভেন মজুমদার, তাদের কথোপকথন, পাশাপাশি তাঁদের নৈঃশব্দ্য দিয়েও যেন কোন রূপকথার গহনে আমাদের উপনীত করলেন, এক সঙ্গে অনেক কণ্ঠস্বর। আলোড়নের পর এক আবেগের আলোড়ন, যেন খাদ থেকে আরেক আবেগের নাকি উত্তুঙ্গ পর্বতশীর্ষ থেকেই, শম্ভু মিত্রের কণ্ঠস্বর মন্ত্রোচ্চারণের মতো নেপথ্য থেকে নির্গত হচ্ছে, রূপের বন্যায়, রসের বন্যায় আমরা ভেসে যাচ্ছি, আমাদের শ্রবণ-দর্শন যেন আর আলাদা-আলাদা অনুভূতি নয়, সমস্ত কিছু পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে এক অত্যাশ্চর্য সংশ্লেষণের সৃষ্টি। খালেদ চৌধুরীর মঞ্চসংগঠন, তাপস সেনের আলোক বিচ্ছুরণ, ‘বহুরূপী’র কুশীলবদের আবির্ভাব নিষ্ক্রমণ, রবীন্দ্রনাথের কোনো গানের একটি দুটি কলি, সব ছাপিয়ে ‘রক্তকরবী’র অন্তঃস্থিত আকৃতির পীড়ন। যে-কোনো মুহূর্তে একটি মস্ত বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, অথচ ঘটছে না, নাকি ঘটছে, ভিতরে মুচড়ে দুমড়ে যাচ্ছি আমরা, আলো তা হলে এত উজ্জ্বল, অন্ধকার তা হলে এত সমাহিত, অভিনয়কলা তা হলে ভাবনার আবেগের, একটির পরে আর একটির, আরো একটির, দুয়ার খুলে যাওয়া?

‘রক্তকরবী’ তার অন্তিমে পৌঁছলো, যবনিকা পড়লো, কিন্তু সেই সায়াহ্নকালে আমরা কয়েকজন মুখর যুবক কেমন নির্বাক হয়ে গেলাম। আমরা বিপর্যস্ত, অথচ সেই সঙ্গে এমনো বুঝতে পারছি আমরা সংস্কৃততর, উন্নততর। ‘রক্তকরবী’ থেকে আমরা আনন্দ ছেঁকে-ছেনে নিয়েছি, বিষণ্ণতার আনন্দ, তা-ও ছেঁকে-ছেনে নিয়েছি। কী প্রত্যাশা নিয়ে সপ্রু হাউসে সেই কনে দেখা আলো বিকেলে ‘বহুরূপী’ সম্প্রদায়ের অভিনয় দেখতে গিয়েছিলাম তা স্পষ্ট করে এখন আর ব্যক্ত করা সম্ভব নয়, তবে যবনিকা নেমে আসার পর, অভিনয়গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার মুহূর্তে, আমরা, হতচকিত, হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, ‘রক্তকরবী’র মন্ত্রবলে আমরা, ঐ যুবকদল, পরস্পরের আরো অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি, ‘রক্তকরবী’ আমাদের বিশুদ্ধতর করেছে, পবিত্রতর করেছে, জ্যোতিহীনতা থেকে ধাঁধানো উজ্জ্বলতায় উপনীত করেছে। কষাঘাতে আমাদের জর্জরিত করেছে ‘রক্তকরবী’, আমাদের প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে  ‘রক্তকরবী’, আমরা অভিভূত, কারণ আমরা এই প্রতীতির অভিজ্ঞানে উত্তীর্ণ হয়েছি যে, নাটক একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, আমাদের সবাইকে ভাবায়-হাসায়-কাঁদায়, এবং এই রহস্যঘন সাযুজ্যের মধ্যবর্তিতায় পাড়াপড়শীদের পরস্পরের নৈকট্যে পৌঁছে দেয়।’

রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায়ে তিনি স্পর্শ করতে চাইছিলেন সমকালের সংকটকে। এ-নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি অতীন চরিত্রে, এলা হয়েছিলেন তৃপ্তি মিত্র। রবীন্দ্রনাথের নানা জিজ্ঞাসা-সঞ্চারিত এই উপন্যাসে বাস্তব ও সমকালীন রাজনৈতিক জীবনচেতনাকে ছুঁয়ে যেসব অর্থ ও প্রশ্নের প্রকাশ হয়েছিল, নাটকেও তা সঞ্চারিত হওয়ায় এখনো অনেক ভাবনার জন্ম দেয়। চার অধ্যায়ের রচনাকাল ১৯৩৪। প্রযোজনাটি হয়েছিল ১৯৫১ সালে। ১৭ বছর বাদে। যখন তা মঞ্চস্থ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন তার দশ বছর আগে। রাজনীতি ছিল উপন্যাসে। ’৪৭-এর দেশবিভাগের পর দেশ স্বাধীন হয়েছে। রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন হলেও, শম্ভু মিত্রের মনে হয়েছিল, রাজনৈতিক অনুষঙ্গে বড়রকম কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সেজন্যে তিনি উপন্যাসের সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে এর মঞ্চায়ন করেছিলেন। তিরিশ বছর বহুরূপী এ-নাটকটি মঞ্চস্থ করেছে। নকশাল আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনো এর রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ও ঐতিহাসিকভাবে এই নাটকটি যেন এক দায় পালন করেছিল। রাজনৈতিক আবহ ধারণ করে চার অধ্যায় রচিত হয়েছিল, নকশাল আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে সেই চেতনাকে ধারণ করে কতভাবেই না তা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় ভারতবাসীকে। এ-প্রসঙ্গে সম্প্রতি সৌমিত্র বসু বলেছেন, ‘চার অধ্যায় নিয়ে কথা উঠেছে যখন, সেই প্রসঙ্গে আর একটু বলি। যাঁরা নাটকটা দেখেছেন, তাঁরা শুরুর অংশ নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন। সব আলো নিভে গেলে নেপথ্য থেকে ভেসে আসত গম্ভীর গলায় চন্ডীর স্তোত্র, যার মোটামুটি বাংলা হলো : বাঘছাল পরা, শুষ্ক মাংসে ভয়ঙ্করী, বিশাল হাঁ হয়ে রয়েছে, লকলক করছে তাঁর জিভ, রক্তলাল চোখে সেই মূর্তি হুঙ্কারে চারিদিক প্রকম্পিত করে তুলছে। এই স্তোত্র শেষ হতে না হতেই শোনা যেত বহু কণ্ঠের একটা সুর, সেটা শেষ হত ‘বন্দেমাতরম’-এ গিয়ে। তিনবার ‘বন্দেমাতরম’ বলার পর শোনা যেত গুলির শব্দ। দু-এক পলকের জন্য নিস্তব্ধতা। তারপরে একটু ঢিমেভাবে শোনা যেত কথাহীন সেই সুর, যেন তার মধ্যে ব্যর্থতার কষ্ট মিশে যাচ্ছে।’

একটু খতিয়ে ভাবলে বোঝা যায়, এই প্রারম্ভিক আবহটা, যাকে থিয়েটারের ভাষায় বলে ‘ওভার্চার’ – কতগুলো স্বরে কত রকমের অনুষঙ্গকে প্রকাশ করছে। কালীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে হিংস্রতার। একটা সময়ে ডাকাতরাও তো কালীভক্ত হতো। বন্দেমাতরমের সঙ্গে কালীস্তোত্র মিশিয়ে তা স্বদেশি ডাকাতের একটা অনুষঙ্গ হিসেবে বুনে দেওয়া হলো। নিশ্চয়ই মনে আছে, স্বদেশিদের ডাকাতি করার একটা গল্প আছে চার অধ্যায় উপন্যাসে, যে-ডাকাতদলে থেকে অতীনের মনে হয়েছিল, সে তার স্বভাবকে হত্যা করেছে, সব হত্যার চেয়ে যা বড় পাপ। ওভার্চারের পর এই কালী আবার ফিরে আসবেন দ্বিতীয় দৃশ্যে। এলার ঘরের এক পাশে রাখা থাকবে কালীর একটি ছবি, জবা ফুল দিয়ে আচ্ছন্ন। দৃশ্যের প্রায় শেষে ছমছমে উৎকণ্ঠার মুহূর্তে মঞ্চের সব আলো নিভে যাবে। শুধু একটা আলো পড়ে থাকবে সেই ছবির ওপর। হিংসা যেন দীর্ঘ ডানা দিয়ে ঢেকে দিতে চাইবে এলা আর অতীনের ভালোবাসাকে। কল্পনা, যুক্তি আর থিয়েটারের নিজস্ব ভাষার একটা চমৎকার যোগাযোগ তৈরি হলো না এখানে?

দীর্ঘদিন এমত ধারণা ছিল যে, রবীন্দ্রনাটক মঞ্চ-উপযোগী নয়। মঞ্চায়নের জন্য যা প্রয়োজন তা রবীন্দ্রনাটকে নেই। শম্ভু মিত্রের রক্তকরবী প্রযোজনা নানা দিক থেকে স্মরণীয়তার মূল্য পেয়েছে শুধু মঞ্চায়নে জীবনের অনুষঙ্গের সাযুজ্যের জন্য নয়, তিনিই রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়নকে সহজ করে তুলেছিলেন। শম্ভু মিত্রের রক্তকরবী-প্রযোজনার পূর্বে এ-নাটক মঞ্চায়নের প্রয়াস হয়নি তা নয়। কিন্তু সে-সব প্রযোজনা ছিল প্রতীক-চিহ্নিত। শম্ভু মিত্র এই ধারণাকে শুধু ভাঙেননি, রবীন্দ্রনাথের নাটক তাঁরই নির্দেশনায় হয়ে উঠেছিল প্রাণের আবেগে দীপ্ত। রক্তকরবী অগণিত দর্শককে মুগ্ধ করেছে, বছরের পর বছর মঞ্চস্থ হয়েছে কলকাতায় এবং দিল্লি, মুম্বাই ও ভারতের বিভিন্ন নাট্যোৎসবে।

এই নাটক যে জীবনসম্ভুত এবং এর সফল মঞ্চায়নের ভেতর দিয়ে যক্ষপুরী হয়ে উঠেছিল সমাজেরই প্রতিবিম্বন। রবীন্দ্রনাথ নাটকটি রচনা করেছিলেন ১৯২৬ সালে। শম্ভুর নির্দেশনায় প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ এ-নাটকের সার্থক মঞ্চায়নের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২৮ বছর। শঙ্খ ঘোষের ভাষায় ‘প্রতীক থেকে রক্তমাংসে’ পৌঁছে বাংলা মঞ্চনাটক যেন
প্রাণ-প্রবাহিনী হয়ে উঠেছিল। রক্তকরবীর বোধ ও উপলব্ধিতে বিমূর্ততার যৎসামান্য আচ্ছাদন থাকলেও এ যে জীবনেরই প্রতিচ্ছবি তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন শম্ভু মিত্র। সেজন্যে তাঁর কাছে নাট্যজন ও শিক্ষার্থীদের ঋণের শেষ নেই।

এ-প্রসঙ্গে মঞ্চস্থপতি খালেদ চৌধুরীর উদ্ধৃতি : থিয়েটারের ক্ষেত্রেই এক অভূতপূর্ব ঘটনা। খালেদ চৌধুরী বলেছেন, ‘শম্ভু মিত্রের সঙ্গে পরিচয় না হলে হয়তো আমি কোনো দিন নাটকের সঙ্গে যুক্তই হতাম না।… শম্ভু মিত্রই একমাত্র লোক যাঁর মধ্যে আমি নাটকে সর্বকলার একত্রীকরণ, সমন্বয়সাধন, সুষ্ঠু শৈল্পিক রূপায়ণ এবং নাটকের প্রথম থেকে শেষ অভিনয় পর্যন্ত সমমান বজায় রাখার নীতি এবং অভ্যাস প্রত্যক্ষ করেছি।…’ আর শম্ভু মিত্র খালেদ চৌধুরী সম্পর্কে বলেছেন, ‘…ওর মতো আমি আর কাউকে দেখিনি। মানে এত অদ্ভুত বুদ্ধি না!… কোনও জিনিস এত দ্রুত এত সামান্য ব্যাপারে করে দিতে পারে।’

রক্তকরবীর মঞ্চ, আলো, আবহ, পোশাকভাবনা, অভিনয় এবং সর্বোপরি নাট্য-উপস্থাপনার অনন্যতা মানুষকে নিয়ে যেত শিল্প-অভিজ্ঞতার সেই স্তরে, যেখানে সচরাচর কেউ পৌঁছতে পারে না।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে রক্তকরবী কেন অনন্যতার মর্যাদা পেয়েছিল, সে-সম্পর্কেও একটু বলার প্রয়োজন আছে। যদিও তার আগে রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় অভিনীত হয়েছে, তবু তাতে স্বল্পসংখ্যক অভিনেতা কাজ করেছিলেন। রক্তকরবী নাটকে চরিত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং প্রায় সব চরিত্রই উচ্চমানের অভিনয় দাবি করে। আর চার অধ্যায় নাটকের কাহিনির চেয়ে রক্তকরবীর কাহিনি আলাদা, তার সংলাপের ধরনও পৃথক।

পূর্ববর্তী নাট্য-মঞ্চায়নের চেতনা থেকে বহুরূপী ও পরবর্তী নাট্য-প্রয়াসের যে চারিত্র্যলক্ষণ বর্ণিত হলো তা হয়ে উঠল খুবই গুরুত্ববহ।

এই পথ ধরে পরবর্তীকালে কিছু নিরীক্ষা হয়েছে বটে এবং পাশ্চাত্যের নাটকের অনুকরণে কিছু নাটক মঞ্চে অভিনীত হলেও তা প্রাণের আবেগে স্ফূর্তি অর্জন করেনি।

ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৩ সালে। এতে খ্যাতনামা শিল্পী, লেখক, নাট্যজন ও গায়কেরা সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। সঙ্ঘের সদস্যরা অধিকাংশ ছিলেন চিন্তার দিক থেকে বামপন্থী। অঙ্গীকারের চেতনা নিয়ে তাঁরা সমাজে সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মানুষের সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন ও জীবনসংগ্রামকে উদ্দীপিত করার প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন। সত্যিকার অর্থেই এই সঙ্ঘ সমাজজীবনে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড দিয়ে।

শম্ভু মিত্র সেখানে যোগ দেন ১৯৪৩ সালের মধ্যভাগে। এই সময়ে এই সঙ্ঘ বহুমুখীন কর্ম দ্বারা মর্যাদার আসন অর্জন করেছিল। শুধু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নয়, শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যেও সঙ্ঘ ভিন্ন আসন অর্জন করেছিল। শম্ভু মিত্রের সঙ্গে এই সময়ে বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, গোপাল হালদার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, চিন্মোহন সেহানবিশ প্রমুখ পরিচিত হন। গণনাট্য সংঘের উদ্যোগে ১৯৪৪ সালে অভিনীত হলো নবান্ন। বিজন ভট্টাচার্যের লেখা এ-নাটকটির যুগ্ম নির্দেশক ছিলেন শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্য। নাটকটি ভারতবর্ষে নাট্য-আন্দোলনকে বড়মাত্রায় আলোড়িত করেছিল। জনচেতনা ও গণমানুষের দুঃখ-বেদনায় মূর্ত নাটকটি কৃষক-শ্রমিক-মজুরদের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে প্রাণিত করেছিল।

লেখক এবং বিপ্লবী সাংস্কৃতিক নেতা সাজ্জাদ জহীর তাঁর আত্মস্মৃতি রোশনাইতে এ-সংঘ সম্পর্কে যে-আগ্রহোদ্দীপক বর্ণনা দিয়েছেন তা সে-সময়ের চেতনাকে উপলব্ধির জন্য একটি প্রামাণিক বয়ান বলে বিবেচিত হয়ে আছে।

এই সময়েই ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটারের (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ) আন্দোলন শুরু হয়, যার কেন্দ্র ছিল বোম্বাইয়ে। অভিনেতা, সংগীতশিল্পী এবং নৃত্যশিল্পীদের সর্বভারতীয় একটি সংগঠন ছিল এটি। বোম্বাই ছাড়াও মালাবার, অন্ধ্র, বাংলা, যুক্তপ্রদেশ ও পাঞ্জাবেও এর শাখা তৈরি হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন অংশে পিপলস থিয়েটারের সাফল্য আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে একটি অভিনব ঘটনা ছিল। এর কর্মীরা (অভিনেতা, সংগীতশিল্পী এবং নৃত্যশিল্পী) ছিলেন অধিকাংশই তরুণ-তরুণী, তাঁদের অধিকাংশই আবার রাজনৈতিক কর্মী এবং এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার দেশের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এঁদের ক্ষেত্রে শিল্প, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। তাঁদের গোটা জীবনটাই দেশের স্বাধীনতা ও সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক বিজয়ের লক্ষ্যে চালিত হতো।

পিপলস থিয়েটারের নাটকে গান ও নাচ অন্তর্গত থাকত। আমাদের প্রাচীন কাহিনি, লোকসংগীত, লোকনৃত্য ও লোকনাট্যকে অবলম্বন করে, সেই শৈলীতে বিপ্লবী চেতনা ও জনগণের জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র, তাদের সুখ-দুঃখ, উন্নততর স্বপ্নকে বিধৃত করার প্রচেষ্টা থাকত। বলা বাহুল্য যে, এসব প্রচেষ্টার মধ্যে অনেক খামতি ছিল, কিন্তু যে কোনো নতুন শিল্পরীতিতেই এই ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। সেজন্য প্রয়োজন ছিল দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকশিল্প শেখা এবং সেই সঙ্গে বিদেশের শিল্প সম্পর্কেও অবহিত হওয়া। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ছিল যে, আমরা আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে জানব, তাকে উন্নত ও সুন্দর করার জন্য, তাদের সংগ্রামকে গভীর বিশ্বাস ও সহানুভূতির সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাব।

আইপিটিতে বলরাজ সাহানী যখন যোগ দিয়েছিলেন তাঁর ভিতর নবীন চেতনা নিয়ে কাজ করার প্রেরণা সঞ্চার হয়েছিল। তাঁর নির্দেশনায় খাজা আহমদ আববাসের রচনায় গুণিজনদের অভিনয়ে ধরতি কি লালের চলচ্চিত্রায়ন যে-সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছিল ভারতবর্ষে প্রগতিশীল চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তা মাইলফলক হয়ে আছে। বলরাজ সাহানী-রচিত স্মৃতিকথায় আইপিটিতে তাঁর প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার যে-বর্ণনা পাই তা অসাধারণ। এছাড়া এই স্মৃতিকথায় তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর জীবন, মননে ও সাংস্কৃতিক চর্যায় এই সঙ্ঘ যে-জীবনদৃষ্টি গড়ে তা ছিল সৃজনশীলতার ভিত্তিভূমি। সেজন্য তিনি গর্বিত। এ তিনি জীবনব্যাপী লালন করেন।

কাজেই পিপলস থিয়েটার যখন ধরতি কি লাল তৈরি করল, তখন ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক বিপ্লব ঘটল। এই গল্পের নায়ক এ-দেশেরই একজন কৃষক, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তার সংগ্রামের কাহিনি নিয়েই এ-ছবি। এর কাহিনি ও চিত্রনাট্য খাজা আহমদ আববাসের, নির্দেশকও তিনি। কিন্তু এ-চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, অনেকে মিলে ছবিসংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতেন। বলরাজ সাহানী এ-ছবির মুখ্য চরিত্রাভিনেতা ছিলেন। আবার তিনি নির্দেশনাতেও অংশ নিতেন। শম্ভু মিত্রও তাই। এ-ছবিতে তৃপ্তি মিত্রের ভূমিকা ছিল এক তরুণী কৃষকবধূর; তাঁর অভিনয় এত নরম, আকর্ষণীয় ও বাস্তবানুগ হয়েছিল যে, ছবি প্রদর্শিত হওয়ামাত্র দেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীদের সঙ্গে একসারিতে তাঁর জায়গা হয়েছিল। বলরাজ সাহানী, শম্ভু মিত্র এবং হামিদের অভিনয়ও অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। গানগুলির অধিকাংশ ছিল সর্দার জাফরীর লেখা, ফিল্মের সেরা গায়ক ছিলেন বিনয় রায়।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নাটকের পঠন-পাঠন, রীতি ও ধারা সম্পর্কে নানা জিজ্ঞাসা শম্ভু মিত্রকে  যুব বয়সে করে তুলেছিল নাটক সম্পর্কে আগ্রহী। মাতৃহীন বাল্যকাল তাঁর কেটেছিল লখনউ ও এলাহাবাদে। পরবর্তীকালে এলেন কলকাতায়। যে-আগ্রহ সঞ্চারিত হয়েছিল নাটক সম্পর্কে তাঁর কল্পনার সঙ্গে তৎকালীন নাট্যচর্চার কোনো মিল পাননি। কিন্তু অবলোকন করেছেন গভীর আগ্রহে ও পরম জিজ্ঞাসা নিয়ে। এই জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা থেকে তিনি অভিনয় করেছেন রঙ্গালয়ে।

গণনাট্য সংঘের প্রতিটি সদস্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। গোষ্ঠী-চেতনায় উদ্বুদ্ধ, সমাজের কল্যাণ ও শ্রেয়োবোধে উজ্জীবিত। সৃজনশীল এই মানুষের অনেকেরই শিল্পপ্রতিভা এই চেতনাকে ধারণ করে বিকশিত হয়েছিল। এঁদের অনেকেই আবার ছিলেন শিল্প-সৃজনের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক। গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা যখন সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মপ্রবাহে নাটক, সংগীত, চলচ্চিত্র এবং চিত্রকলায় নিজেদের যুক্ত করলেন, তখন একদিনের জন্যও এই চেতনাকে পরিত্যাগ করেননি। দারিদ্রে্যর কশাঘাতে জর্জরিত হয়েছেন অনেকে; অনেকের সম্মুখে অর্থ, বিত্ত ও বৈভবের দুয়ার উন্মুক্ত থাকা সত্ত্বেও জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হননি। প্রাণ-মন সঁপে দিয়েছিলেন। এই সংঘের অন্যতম সদস্য ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। কী প্রবল প্রেম নিয়ে মৃত্যুর আগের দিন রাত্তিরে তিনি মঞ্চে অভিনয় করেছেন। কুমার রায় স্মারক বক্তৃতায় সে-কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় – ‘আমি তো ভুলতে পারি না, বিজন ভট্টাচার্য তাঁর মৃত্যুর আগের রাত্রে মরা চাঁদ নাটকে অভিনয় করছেন, মুক্ত অঙ্গনের ভাঙা, জীর্ণ, পেরেক বার করা মঞ্চে। আমার মনে আছে, তাপস সেনের সঙ্গে পাশাপাশি বসে দেখছি সেই দৃশ্য যেখানে পবনকে তাঁর স্ত্রী ধাক্কা মেরে ফেলে চলে যান। বিজনদা মাটিতে ছিটকে পড়ে গিয়ে দুবার তিনবার মঞ্চের মাটিতে গড়িয়ে যান। আমি তাপসবাবুকে বিরক্ত হয়ে বলি, উঃ! বিজনদা কি কখনো শিখবেন না পাকা অভিনেতারা কীভাবে গা বাঁচিয়ে, ত্বক বাঁচিয়ে, শরীর বাঁচিয়ে কত হিসেব করে মঞ্চের উপর দিয়ে গড়িয়ে যান! দেখুন, বিজনদা কীরকম করে গড়াচ্ছেন, দেখুন! লাগছে না?’ অভিনয়ের শেষে পিছনে গিয়ে দেখি, বিজনদা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে, আর কে একজন পায়ে তুলো চেপে ধরে বসে আছে, রক্ত পড়ছে। জানলাম, মঞ্চে পায়ে পেরেক ঢুকে যাওয়ায় সেটাকে বার করে রক্ত পড়া থামানো হচ্ছে। তখনো বিজনদা আমায় থাকতে বলছেন, বলছেন, কথা আছে। ক্লান্ত, আহত মানুষটাকে কথা বলতে দিতে চাইনি। বলেছি, কাল কথা হবে। পরের দিন সকালেই নবারুণ ফোন করে খবর দেয়, বিজনদা মারা গেছেন। জীবনের শেষ রাত্রেও রক্তক্ষরণ করে বিজনদা অভিনয় করেছেন, তখনো আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। এ দৃষ্টান্ত একক নয়। এইভাবে একের পর এক মানুষ যাঁরা আমাদের গর্ব তাঁরা ওই ইউটোপিয়ার স্বপ্নকে ছাড়েননি এবং রক্তক্ষরণ করেও শেষ পর্যন্ত থিয়েটারকেই লালন করে গেছেন।’

নাটকের জন্য এই রক্তক্ষরণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বুকে নিয়ে শম্ভু মিত্রও মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত নাটকেরই লালন করেছেন। অবমানিত হয়েছেন, বহুরূপীতে। তাঁকে সত্তরের দশকের অন্তিম পর্যায়ে এড়িয়ে চলেছে বহুরূপী গোষ্ঠী। কতভাবেই না তাঁর কর্মপ্রবাহ ও প্রবর্তিত ধ্যান-ধারণাকে, শিক্ষাপদ্ধতিকে অবহেলা করা হয়েছে। দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছিন্নতাকে ভিন্ন রং দিয়ে তিনি যাতে গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে পড়েন সেদিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দলের ভেতর যখন অন্তর্কলহ ও বিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছে এবং তাঁর অপরিহার্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কিংবা গোষ্ঠীর প্রাণপুরুষকে অবহিত না করে নানা কর্মপ্রবাহ পরিচালিত হয়েছে তখনো শম্ভু মিত্রের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়েছে, কিন্তু তিনি থেমে যাননি। এই সময়েও দেখি তাঁকে সৎ নাটক নিয়ে ভাবতে। পরবর্তীকালে গ্যালিলিউ প্রযোজনাকালে তাঁকে যখন প্রয়োজন হলো তিনি সেই আহবানে সাড়া না দিয়ে পারেননি।

কলকাতায় ছোট-বড় দল নিয়ে গড়ে উঠেছিল ক্যালকাটা রেপার্টরি থিয়েটার। জর্মন নির্দেশক ফ্রিৎজ বেনেউইৎজের পরিচালনায় শম্ভু মিত্র গ্যালিলিউর ভূমিকায় অভিনয় করলেন। মোট ২২ রজনী তিনি ওই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ২২ আগস্ট ২০১৪ তারিখে অরুণ মুখোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় মহলা ও অভিনয়কালে তাঁর যে-অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার মনোগ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন। ‘সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটল যখন শম্ভু মিত্র ‘কলকাতা রেপার্টরি’ প্রযোজিত এবং ফ্রিৎস বেনেভিৎস-নির্দেশিত ব্রেশটের ‘গ্যালিলিওর জীবন’ নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হলেন। তখনই সত্যিকারের সুযোগ মিলল ওঁকে কাছ থেকে দেখার। নানা পরিস্থিতিতে ওঁর আচার-আচরণ লক্ষ করা এবং মহলায়, আলোচনা-বিতর্কে ওঁর সক্রিয় ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করা – সবকিছুর মাধ্যমে ওঁর ব্যক্তিত্বের একটা স্পষ্ট রূপ আমার চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম। পান্ডুলিপি সংশোধন থেকে শুরু করে চরিত্রায়ণে, পরিচালকের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক অবস্থানে, সহশিল্পীদের সঙ্গে নিখুঁত বোঝাপড়ায় তাঁর গুণপনার নানা দিক প্রকাশিত হতে থাকল। যে-কোনো ভাবের অন্তর্গূঢ় মূর্ত করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর প্রজ্ঞা এবং সর্বোপরি তাঁর মেধা সদা তৎপর থাকত – হাঁকডাকের খুব একটা প্রয়োজন পড়ত না। উনি পাশে থাকলে ছোট-বড় যে-কোনো চরিত্রের অভিনেতারই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার কথা – যদি না তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি অপ্রস্ত্তত শিল্পীকে অস্বস্তিতে না ফেলত।

শম্ভু মিত্রকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে চিনলাম। এবং কেন যে তাঁর সম্পর্কে আজগুবি গাল-গল্প গজিয়ে ওঠে তার কারণটাও বুঝলাম। দৈনন্দিন জীবনে সাধারণভাবে আমরা যেসব ঘটনার মুখোমুখি হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি, অজান্তে ভনিতার আশ্রয় নিয়ে ফেলি, সত্যকে সরাসরিভাবে চিহ্নিত করতে না পেরে দ্বিচারিতা করি – কী জীবনে, কী চরিত্র-রূপায়ণে – শম্ভু মিত্র সেটাকেই সরাসরি মোকাবিলার সাহস দেখান। সত্যকে এড়িয়ে জীবনের যথার্থ রূপ প্রকাশ পায় না, শিল্পও অসম্পূর্ণ থাকে – এই প্রত্যয় ছিল তাঁর। প্রতিদিন মহলায় চুলচেরা বিশ্লেষণে চরিত্রটিকে গড়তে দেখেছি। গড়ছেন, আবার ভাঙছেন, পরদিন আবারো সেই ভাঙাগড়ার খেলা। গ্যালিলিও চরিত্রটির সঙ্গে তাঁর মিল নজরে পড়ার মতো। অতলান্ত গভীরে ডুবে গ্যালিলিও জ্ঞানের নুড়ি সংগ্রহ করতেন। বারবার পরীক্ষা না করে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও কোনো সত্যকেই গ্রহণ করতেন না। সারাদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছতেন সেটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই পরের দিনের কাজ শুরু হতো। সন্ধ্যাবেলা আগের দিনের সিদ্ধান্তেই পৌঁছনোর পর এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতেন, ‘তাহলে কি এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত?’ শম্ভু মিত্রের চরিত্র-বিশ্লেষণের পদ্ধতিটাও ওইরকম ছিল। এটা সত্যি যে, চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে পরিচালক ফ্রিৎস বেনেভিৎসের কিছু মতানৈক্য ঘটেছিল এবং সেই নিয়ে কিছু মুখরোচক মন্তব্য মতামতও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু, সত্যিটা হলো এই – এটা বিখ্যাত বিদেশি পরিচালক এবং বিখ্যাত দেশীয় নটের ‘ইগো’র লড়াই ছিল না। কিংবা ব্রেশটের অভিনয়শৈলীর সঙ্গে শম্ভু মিত্রের পদ্ধতির কল্পিত সংঘাতও ছিল না। চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে এ-ধরনের বিরোধ বা মতানৈক্য যে কোনো সময়েই ঘটতে পারে। ঘটে থাকেও। ওই ঘটনাকে বাড়তি কোনো বিশেষণে ভূষিত না করাটাই সংগত।

শেষ কয়েকটি বছর শম্ভু মিত্র পাদপ্রদীপের আলো থেকে সম্পূর্ণ সরে আসেন। এ ছিল তাঁর স্বেচ্ছানির্বাসন। এই সময় শম্ভু মিত্র প্রায় অন্ধ হয়ে পড়েন এবং তাঁর অভিনয়রীতি এবং এই অন্ধত্ব নিয়েও নানা কথা রটনা হয়েছিল। এই সময়ে গোষ্ঠী-সদস্যদের প্রতাপ এবং অভিনয়রীতি ও শিক্ষণ যে ভিন্ন পথনির্মাণ করেছিল সে-সম্পর্কে বিরূপ কথাও প্রচারিত হয়েছিল। শম্ভু মিত্রকে নিয়ে নানা ধরনের বিরূপ কথাবার্তা ও আচরণ তাঁকে খুবই বিষণ্ণ করেছিল, খুবই বিব্রত এবং বিমূঢ় করেছিল। তবু তিনি বিচলিত হননি। হৃদয়-মন নানা কারণে ভেঙে গেছে তবু তিনি প্রকাশ্যে কোনো কিছু বলেননি। তিনি এ-ক্ষেত্রে কত অভিজাত ও আধুনিক মনের অধিকারী ছিলেন এ-সময়ে তাঁর নির্মোহ অভিব্যক্তিই তার প্রমাণ বহন করে। শম্ভু মিত্র নাট্যাঙ্গনে যে-প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন, তাঁর এই ভিন্ন পথনির্মাণ, নিজের আস্থা ও বিশ্বাস তাঁকে অনমনীয় করে তুলেছিল। ভারতবর্ষের নাট্যচর্চা ও সাধনায় অসামান্য কাজ বলে শ্রদ্ধা অর্জন করলেও গোষ্ঠীর কয়েকজন সদস্যের অবস্থান এবং তাঁর প্রতি বিরূপ আচরণে তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছেন। একাগ্র সাধনা ও চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি যে নাট্যশৈলী এবং অভূতপূর্ব এক পথ তৈরি করেছিলেন তা অনেকের মধ্যে বিস্ময় জাগালেও বহুরূপীর            অভ্যন্তরীণ সংকটজনিত কারণ ও ব্যক্তিত্বের সংঘাতে তাঁর নির্মিত পথ কিয়ৎপরিমাণে হলেও প্রশ্নদীর্ণ হয়। শম্ভু মিত্র তাঁর নাট্যাদর্শ ও নির্মিত পথ নিয়ে সংশয়িত ছিলেন না। তিনি তাঁর অবস্থান থেকে এক বিন্দু সরে আসেননি। সেজন্যে তিনি অহংকারী – এ-অপবাদও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। ব্যথিতচিত্তে অভিনয়, নির্দেশনা কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছিলেন না। যদিও কিছুদিন আগে চাঁদ বণিকের পালার মঞ্চপাঠ আরেকবার প্রমাণিত করেছিল শম্ভুর উচ্চতা। শুধু এই পাঠ দিয়েই মনসামঙ্গলের উপাখ্যানকে সজীব চেতনায় ধরতে চাইছিলেন তিনি। এ-পাঠ শুধু পাঠ ছিল না এ-পাঠ হয়ে উঠেছিল দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাত্রার অভিজ্ঞতা। তাঁর চাঁদ বণিক হয়ে উঠেছিল জীবনকে ভালোবাসার এক বিশেষ ব্যাখ্যাও। মঞ্চে এই পাঠ শোনার যাঁদের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁরা এখনো খেদ প্রকাশ করেন, শম্ভুকৃত চাঁদ বণিক নাটকটি তিনি মঞ্চায়নের যে-পরিকল্পনা করেছিলেন তা বাস্তবায়ন হলে বাংলা নাট্যমঞ্চ আরেক অবয়ব খুঁজে পেত, যা হয়ে উঠত লোকায়তিক ধারায় সত্যিকার এক অনন্য নাটক ও আধুনিক।

বহুরূপীর সদস্য, মঞ্চে আলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, দিলীপ ঘোষ এই নাটক প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন, ‘১৫ আগস্টই অ্যাকাডেমি মঞ্চে টিকিট বিক্রী করে প্রথম নাটকপাঠ, – ‘চাঁদবণিকের পালা’। ঐ নাটকপাঠের আলোটা কেমন হবে জিজ্ঞাসা করায় এত সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন, যা সবটা শোনার পর মনে হলো যেন একটা কবিতা। এতদিন নাটকের আলো করে এসেছি, কিন্তু নাটকপাঠের জন্য আলোর ব্যবহার যে এইরকম নতুন মাত্রা যোজনা করতে পারে, সেটা ছিল আমার কল্পনাতীত। ইতিপূর্বে এইভাবে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে নাটকপাঠের কথা শোনা যায়নি, বহুরূপীর হয়ে ঐ ১৫ আগস্ট ১৯৭৮-এ শম্ভু মিত্রের শেষ মঞ্চাবতরণ। এরপর থেকেই দেখতে পাবো আস্তে আস্তে তিনি দূরে সরে যাচ্ছেন দলের কাছ থেকে। যদিও এই পচনটা শুরু হয়েছে আরো বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। তবে কিভাবে এই পরিণতিটা হলো সে আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন।’

তাঁকে নিয়ে তাঁর জীবন নিয়ে তাঁর খ্যাতনামা কন্যা শাঁওলী মিত্র ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট-প্রকাশিত যে-দীর্ঘ বইটি লিখেছেন তাতে শম্ভুর এই স্বেচ্ছানির্বাসনের যে-বিবরণ পাই তা খুবই কৌতুককর এবং নানা অনুষঙ্গভরা এক বিবরণ। তাঁর অন্তিম জীবনের খুঁটিনাটি এবং দাম্পত্য জীবনে তৃপ্তির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বহুরূপীর নির্মাণ ও সৃষ্টির পথকে কণ্টকময় করে তুলেছিল – নির্দ্বিধায় এ-কথা তো বলাই যায়। বহুরূপীর অনুজজনদের স্মৃতি থেকেও এই সময়টি যেভাবে আমাদের চোখে ফুটে ওঠে তা বাংলা মঞ্চনাটকের বড়ই দুঃখময় অধ্যায় হয়ে থাকে। আসলে আমাদের তো কেবলই মনে হয়, শম্ভু মিত্র বাংলা নাটককে যে-উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন বহুরূপী গৌষ্ঠী যে-পথ ছুঁয়ে অনন্য হয়ে উঠেছিল দলীয় চেতনায়, শৃঙ্খলায়, নবনাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে তা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তিনি নাট্যজনকে শিক্ষাদীক্ষায়, অভিনয়শৈলীতে, শৃঙ্খলায় ও গ্রুপ থিয়েটারের ভাবনায় এমনভাবে সঞ্জীবিত করতে চাইছিলেন যা হয়ে উঠেছিল ভারতীয় নাট্যসাধনায় ও চর্চায় সম্পূর্ণ ভিন্ন আদলের এক পথ। শম্ভু মিত্র রুচি ও সংস্কৃতিতে নাট্যচর্চা ও নাট্যাঙ্গনকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করতে চাইছিলেন, বাঙালিত্বের সাধনায় যা হয়ে ওঠে মানবিক এবং আন্তর্জাতিক। তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, নাট্যজনেরাও এই সাধনা এবং চর্চায় এক ইমারত গড়ুক, এই শৃঙ্খলা ও সংস্কৃতি ব্যক্তিগত জীবনেও প্রতিফলিত হোক। বাংলা মঞ্চনাটকে এই চর্চা এক প্রতিমান হয়ে উঠুক, নাট্যজনের জীবনসাধনাকে সমৃদ্ধ করুক, এই অভিপ্রায় ও স্বপ্ন ছিল শম্ভু মিত্রের। পরবর্তীকালে শম্ভুর শিক্ষাপদ্ধতি এবং শৃঙ্খলা গ্রহণে দলের অভ্যন্তরে খুবই অনীহা লক্ষ করা যায়। বহুরূপীর এই প্রাণপুরুষ কোনোদিন দলের কার্যনির্বাহী কমিটির উচ্চ পদে ছিলেন না। তবে তিনিই ছিলেন প্রাণদায়ী ব্যক্তিত্ব। অথচ তাঁর জীবনের অন্তিম পর্যায়ে বহুরূপীর বহু কার্যই পরিচালিত হয়েছিল তাঁকে উপেক্ষা করে। এই কষ্টকে বুকে ধারণ করে তিনি সরে এলেন বহুরূপী থেকে।

১৯৭৮ সালে বহুরূপীর ৩০ বছর পূর্তি উৎসব হলো। তারপর আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিলেন নিজেকে।

অন্যদিকে ছিল শিখরস্পর্শী স্ত্রী অভিনেত্রী তৃপ্তির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা। এ কি ছিল কেবল ব্যক্তিত্বের সংঘাত কিংবা পঠন-পাঠন অভিজ্ঞতা ও অভিনয়ে অনন্য দুই নাট্যব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব? এই মুহূর্তে স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়। বাংলা নাটকে অভিনয়কুশলতা ও নবনাট্যের বোধ ও আদর্শ সঞ্চারিত করার জন্য এই দম্পতি জীবনের প্রারম্ভে ও মধ্যপর্যায়ে যে-অবদান রেখেছিলেন সংসারের সকল দাবিকে অগ্রাহ্য ও তুচ্ছ করে, তার বিশাল মূল্য রয়েছে। দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও দেখা যায়, তৃপ্তি মিত্র যখন কর্কট রোগে ধ্বস্ত এবং মৃত্যুর অতল অন্ধকারের মুখোমুখি শম্ভু মিত্র কত না প্রেমে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন, স্বপ্ন ও অতীতকাতরতায় প্রাণিত করতে চেয়েছেন। এই মানবিকতা প্রকাশ শম্ভু মিত্রের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

দীর্ঘদিন যে-শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে বহুরূপী মহলা দিয়েছে, নতুন নাটক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করে চরিত্র ভাগ করেছে, এক পর্যায়ে গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে এ-চেতনার প্রতিফলন আর দেখা যায় না। শম্ভু-তৃপ্তির বিচ্ছিন্নতা কি তৎকালে বহুরূপীর কর্মপ্রবাহে কোনো সংকট সৃষ্টি করেছিল? এ-সম্পর্কে অবশ্য বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। যে-কটি গ্রন্থ তাঁর জীবন ও কর্মপ্রবাহ সম্পর্কে আমরা পাঠ করেছি তাতে এ-বিষয়টির উল্লেখ আছে, তবে বিস্তারিত কিছু নেই। পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে সমবায়ী চেতনা নিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে এ দুজন কত না সৌধ গড়ে তুলেছেন নাট্যমঞ্চে, তাঁদের অভিনয়কুশলতা জনরুচিকে কতভাবেই না সমৃদ্ধ করেছে!

শম্ভু মিত্র বাংলা নাট্যমঞ্চে সাধণায়, চর্চায় ও নাট্য প্রয়াসের কর্মে যে কত প্রাসঙ্গিক এবং তাঁর নাট্যমননচেতনার আবেদন যে ফুরিয়ে যায়নি আসন্ন শতবর্ষের প্রাক্কালে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে সে-কথা স্মরণ করি।

আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ শঙ্খ ঘোষকে সত্তরের দশকের শুরুর দিকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। কলকাতার তালপাতা প্রকাশনালয় থেকে এই সাক্ষাৎকারটি ২০০৮ সালের মার্চে বই হয়ে বেরোয় এক বক্তার বৈঠক নামে। এতে শম্ভু মিত্র তাঁর নাট্যজীবন, নাট্যচর্চা নিয়ে কতভাবেই না বলতে চেয়েছেন। শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চার প্রসঙ্গ, লেখনী, নির্দেশনা, রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, চাঁদ বণিকের পালার জীবনচেতনা খুবই গভীর প্রত্যয় নিয়ে উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে।

এছাড়া নাট্যভাবনা নিয়ে শঙ্খ ঘোষের কয়েকটি প্রবন্ধে শম্ভু মিত্রের রবীন্দ্র নাট্য ভাবনা ও মঞ্চায়ন সম্পর্কে যে নানাকৌণিক বিশ্লেষণ আছে তাতে এই নাট্যশিল্পীকে আমরা বৃহৎ এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে খুঁজে পাই এবং নানাদিক থেকে দেখতে শিখি। শঙ্খ ঘোষের কাছে সেজন্যও আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

শম্ভু মিত্রের নাট্যপ্রয়াস আলোচনাকালে আরেকটি বিষয় তাঁর জীবনচর্যায় খুবই প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হয়। ষাটের দশকে তাঁর নাট্যধারা যখন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জীবনচর্যায় এবং ভারতবর্ষের নাট্যকলায় অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে তখন তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন কলকাতায় একটি স্থায়ী মঞ্চের। সেজন্যে কয়েকটি নাট্যগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে নানাভাবে নাটক মঞ্চায়ন করে, বিত্তবানদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে একটি তহবিলও গঠন করেছিলেন। প্রায় পনেরো বছর শম্ভু মিত্র এই নাট্যমঞ্চের সম্ভাবনা নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু মঞ্চের জন্য প্রত্যাশিত সাহায্য এবং জমি সরকার দেয়নি বলে তাঁর মনোকষ্টের শেষ ছিল না। তিনি যখন অনুধাবন করলেন মঞ্চের জন্য জমি কোনোভাবেই পাওয়া যাবে না, তখন স্থায়ী নাট্যমঞ্চ নির্মাণের জন্য গঠিত তহবিলের অর্থ ফেরত দিলেন। বামপন্থী সরকার তাঁকে হতাশ করেছিল।

আশাহত শম্ভু মিত্র এ-অবহেলা থেকেও কষ্ট পেয়েছেন। এই কষ্ট এবং বহুরূপীর অভ্যন্তরীণ সংকট ও সমকালীনদের তাঁকে এড়িয়ে চলা তাঁকে যে-বেদনা দিয়েছিল সেজন্যেই বোধকরি               মৃত্যুর কিছুদিন আগে রচিত ক্ষুদ্র একটি ইচ্ছাপত্রে শম্ভুর অভিমান, ক্ষোভ ও বিপন্নতা উন্মোচিত হয়েছে। শম্ভু মিত্র অন্তিম জীবনে সমাজ, রাষ্ট্র, সহযাত্রী ও আত্মজনকে কোন দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞানে বুঝতে চাইতেন, এ-ইচ্ছাপত্র যেন তারই নিদর্শন হয়ে থাকলো। এ শুধু প্রামাণিক দলিল নয়, এ-ইচ্ছাপত্রে আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাঁর জীবনদর্শনেরও অনুষঙ্গ। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভন্ডামি ও ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ এ-ইচ্ছাপত্র। এ ধরনের ইচ্ছাপত্র বাঙালির চৈতন্যে কি কোনো আঘাত করেছিল? বোধকরি হ্যাঁ, এবং না।