শহীদ কাদরীর কবিতার বিষয়বৈভব

কামরুল ইসলাম

না, না, তার কথা আর নয়, সেই

বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো – শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।

(অগ্রজের উত্তর)

চর্যাপদ থেকে আজ অবধি কতশত কবিতা লেখা হয়েছে, সে-হিসাব আমাদের কাছে গৌণ এ-কারণে যে, কাল পরম্পরায় কবিতার ইতিহাস জাগরূক সত্যের চর্চিত সমন্বয় মাত্র, যাকে আমরা অসংখ্য চিহ্ন ও সময়ব্যাপ্তির সূত্রগুলোয় খুঁজে পাই। ফলে একটি কাল-পরিচয়ের মধ্যে কবিতারও একধরনের পরিচয় আভাসিত হয় এবং বোধের জানালায় সেগুলোর চেহারা উদ্ভাসিত হলে আমরা কেবল কিছু মুখস্থ সূত্র কিংবা উপরিতলের ছায়াকে ঘিরে কাগজ ব্যয় করে একটি আলোচনা কিংবা ডিসকোর্স তৈরি করি। এই নির্মাণ আবার বিনির্মিত হয়ে ফিরে আসে, এতে শিল্প কিংবা কবিতার কতটুকু পাওয়া সম্ভব সে-বিষয়ে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তবু আমরা লিখি, লিখছি – কখনো অনুরুদ্ধ হয়ে কখনো স্বতঃপ্রণোদনায় এবং এইভাবে অজস্র লেখার মধ্যে ভেসে উঠছে কবিতার রহস্যাবলি নানা ধরনের বিশ্বাসের রং মেখে। সেই রংগুলো কখনো চোখ-ধাঁধানো, কখনো বিনম্র ভাবের উন্নাসিকতায় আচ্ছন্ন আবার কখনো কৌশলী বিচ্ছিন্ন চেতনায় অন্বিষ্ট। তবে এ-কথা মানতেই হয় যে, হয়ে ওঠার পথে কবিতার জাত বিচার বড়ই কঠিন কাজ এবং প্রকৃত কবিতা চেনার বিষয়ও কোনো বিশেষ কালখন্ডের কোনো ব্যাপার নয়।

আমরা বিভ্রান্ত হই, কখনো বিচলিত হই, আবার কখনো নিজের রুচি ও বিশ্বাসের তলায় খুঁজে পেতে চেষ্টা করি মাটি – কখনো খেই হারিয়ে ঘুরতে থাকি শূন্যে, কারণ নিজেরও একটা শেষ আছে, আছে একটি পরিধি – এই শেষে এসে মনে হতে থাকে ‘কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো’। কবির হাতে তখনই সৃষ্টি হয় কবিতার যখন অন্ধকার, হাড়গিলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে কবির সামনে, মরুঝড় কিংবা অন্ধকার কবির চোখে ঢেলে দেয় চিরকালের স্তব্ধতা, তখন দূরের কোনো সিম্ফনি বকছানার মতো ঘুরতে থাকে কবির শবাধার ঘিরে, সেই গোলচক্রের ভেতর থেকে জন্ম হয় কবিতার – ঈশ্বর স্বয়ং নিজ হাতে লালন করেন সেই কবিতা। কবিতার সত্য সম্পাদিত হয় কবির মৃত্যুতে; অজস্র মৃত্যুর মধ্যে কবিকে পথ হাঁটতে হয়, মৃত্যুময় পরানে বেজে ওঠে কবিতা – সেই কবিতার জন্য যারা প্রস্ত্তত মূলত তারাই কবি।

কবিকে সংগ্রাম করে যেতে হয়। আজীবন। সেই সংগ্রাম অবশ্যই বহুমাত্রিক এবং বহুস্তরিক – জীবনের অনেকানেক না-পাওয়ার মধ্যে সেই সংগ্রাম যেমন গ্রথিত, তেমনি সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রপঞ্চের মধ্যেও যার রয়েছে সাহসিক বিস্তৃতি। তবে কবির এই সংগ্রাম মূলত কবিতার জন্য সংগ্রাম। একটি ভালো কবিতা লেখার জন্য কবিকে যে সংগ্রাম করতে হয় তা কবি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। কবির এই সংগ্রামকে জে আইজাকস এভাবে দেখেছেন : ‘অনেক সময় আমি ভেবেছি, যদিও কথাটা আপাতবিরোধী মনে হতে পারে যে, শেষতঃ সব কবিতাই কবিতা বিষয়ক এবং ‘কবিতার জন্য কবিতা’ কথাটি কিছুটা অর্থপূর্ণ। তবে আসন্ন বিপদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য নন্দনতাত্ত্বিক অর্থে কাব্যে আশ্রয় গ্রহণের কথা আমি বলছি না; বরং কাব্যকলায় দক্ষতা অর্জনের প্রচেষ্টাই যে পৃথিবীতে কবির অস্তিত্বের প্রধান যুক্তি আমি এ-কথাই বুঝাতে চাচ্ছি। এই দক্ষতা অর্জন না করা অবধি এবং সমস্যাক্রান্ত জীবনের অসংগতি ও প্রচাপ, অন্যের অর্জিত ছাঁচ ও শক্তি, প্রতিদ্বন্দ্বী ঈশ্বরের ছাঁচ ইত্যাদি তার নিজের অর্থ ও সুরসংগতিতে পুনর্বিন্যস্ত না করা পর্যন্ত কবি সংগ্রাম করে যান।’ (‘আধুনিক কাব্যের পটভূমি’) এই সুরসংগতি কিংবা দক্ষতা অর্জনের দীর্ঘ সংগ্রামে অপারগ কবিরাই মাইনর পোয়েটস, অবশ্য কবিতার সাম্রাজ্যে এই মাইনর কবিদেরও গুরুত্ব রয়েছে। মাইনর কবিরা থাকেন বলেই মেজর কবিদের সহজে চেনা যায়।

মধ্যযুগীয় আবহ থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে তা নানা ভাবে-বৈচিত্র্যে বিকশিত হয়েছে। মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার দুই পথিকৃৎ, যাঁদের হাতে বাংলা কবিতা আধুনিকতার স্পর্শ পেয়েছে এবং কবিতার সানন্দ মুক্তি ঘটেছে। পাশ্চাত্য-প্রভাবিত আধুনিকতার উন্মেষ ঘটে ত্রিশের দশকে এবং সেই দশকে বাংলা কবিতার চারপাশে জীবন ও জগতের যে শক্ত আবরণ গ্রথিত হয়, তাকে একটি মহাবৈপ্লবিক দৃষ্টি দিয়েই দেখতে হবে। এ-সময়ের পাঁচজন কবির কবিতার ওপর ভর করে পরবর্তীকালে এবং আজ অবধি বাংলা কবিতার যে মহাপ্লাবী  পথ-পরিক্রমা এবং নানা বাঁকে বাঁকে নানা গুঞ্জরণ, তা ওই তিরিশের কবিদের পথ করে দেওয়া ছাড়া সম্ভব হতো না। যে-কারণে বাংলা কবিতার সেই তিরিশের কাব্যান্দোলনের সমূহ বার্তাকে এক রেনেসাঁস হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। তিরিশের কবিতারই বিস্তৃতি দেখা যায় চল্লিশ, পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে, যদিও চল্লিশের কিছু কবির মধ্যে অধিক সমাজ-সচেতনতা ও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির এক আলাদা স্বর লক্ষ করা যায়।

পঞ্চাশে (বাংলাদেশের কবিতার উন্মেষের কালে) শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এবং সৈয়দ শামসুল হকসহ বেশকিছু কবির কবিতায় বালাদেশের জল-হাওয়া-সংগ্রাম-ঐতিহ্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয় বাঙালির ঐকান্তিক বোধের সামগ্রিকতা। নগর-চেতনা ও নাগরিক জীবনের অমঙ্গল-উৎপাত, আশা-নিরাশার চিত্রও দেখা গেল কোনো কোনো কবির কবিতায়। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময়ে এবং তৎপরবর্তী কবিতায় গণসচেতনতা বৃদ্ধি পেল। এ-সময়ে এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আবহ বাংলা কবিতায় যোগ করল নতুন মাত্রা। কবিতায় দেখা গেল অতি-সারল্য এবং সরাসরি কথা বলার ভঙ্গি, ন্যারেটিভ কাব্যিকতায় মুক্তি-জাগানিয়া শব্দের আগমন; ব্যক্তি-নিঃসঙ্গতাসহ অতৃপ্তি ও স্বপ্নভঙ্গের নানা পীড়নে কবিদের মধ্যেও দেখা দিলো অস্থিরতা এবং বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পরে কবিদের আশাহত মনে যে ক্ষোভ ও বেদনার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল, রাজাকারদের পুনরুত্থানসহ যে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিতে স্বদেশ-ভূমি উদ্বেলিত হলো, তার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল কবিতায়।

অল্প লিখেও বেঁচে থাকা যায়। শুধু প্রতিভার প্রাবল্যে নয়, এক বিদগ্ধ প্রস্ত্ততির মধ্যে শিল্পীকে এগোতে হয়। সেই অল্প লেখার জন্য বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড চষে বেড়াতে হয়, বোধের অনামী গুঞ্জরণে ভেসে ভেসে জেগে উঠতে হয় এক মহামহিম নদীর মোহনায়। শিল্পীমাত্রই অন্তর্গত বিষাদের ভারে জর্জরিত, বিকশিত এবং বিশ্বজনীনতায় অন্বিষ্ট। আধুনিক শব্দটা যেভাবেই আসুক না কেন, এতে সাম্রাজ্যবাদ কিংবা উপনিবেশের যত গন্ধই থাকুক না কেন, একে ব্যাপকভাবে সময়-সংগতিতে মিলিয়ে দেখলে দেখা যায় এবং সেই অর্থে আধুনিক মনন ও কসমোপলিটন বোধের সমন্বয়ে এবং স্বাদেশিক চেতনার মিশেলে কোনো কবি গাইতে পারেন জীবন-বৈভব অকুণ্ঠচিত্তে। কবি শহীদ কাদরীর মধ্যে এসব গুণ ছিল।

তাঁর কবিতারও বিষয়বস্ত্ত বাংলাদেশের নানা সময়ের সংকট ও বিপর্যয়কে ধারণ করেছে, কিন্তু তাঁর কবিতায় চিত্ত-চাঞ্চল্যের ব্যাপারগুলো একটি নিবিড় শিল্পবোধে সমাকীর্ণ হয়েছে। যে-কারণে তাঁর কবিতাকে আলাদাভাবে না দেখলে অনেকখানিই অবিচার করা হবে। তাঁর শিল্পবোধ পাশ্চাত্য শিল্পবোধের অনুগামী হলেও তিনি যে বাংলাদেশের কবি তা তাঁর কবিতার সামগ্রিকতায় উদ্ভাসিত। তিনি একজন আধুনিক কবি। তিনি তিরিশি আধুনিকদের সার্থক উত্তরসূরি। বোদলেরীয় বিবমিষা, অন্ধকার জগৎ, ফরাসি প্রতীকবাদীদের আলোকসঞ্চারী প্রভাব এবং ইউরো-আমেরিকান আধুনিক কবিদের ছায়াপাত সত্ত্বেও তাঁর কবিতায় শোনা যায় এক মৌলিক গুঞ্জরণ। নাগরিক জীবনের নানা অসংগতি, উৎপাত এবং অন্তঃসারশূন্যতার চিত্র তাঁর কবিতার অন্যতম মৌলিক সুর। তাঁর কাব্যভঙ্গিটা উন্মেষকালেই অন্যের থেকে আলাদা।

মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা এই কবি তাঁর সৃষ্টি-মহিমার এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে স্বেচ্ছানির্বাসনে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ উত্তরাধিকারে (১৯৬৭) তাঁর সপ্রতিভ নাগরিক-সংশ্লিষ্টতার আধিক্য দেখা যায়। তাঁর নগরচেতনার অবয়বকে দেখে নিতে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক :

 

১. ঝুলে থাকে মাঝরাতে রেস্তরাঁর কড়িকাঠ থেকে, –

বাদুড় না বেলুন বন্ধু, স্বপ্ন না হতাশায় ঠাসা?

২. ল্যান্টর্নের ম্লান রাত্রে সৈনিকের সিগারেট, রুটি,

উপহার

এবং সঙ্গম-পিষ্ট সপ্তদশী অসতর্ক চিৎকার কন্যার।

(‘উত্তরাধিকার’, উত্তরাধিকার)

৩. জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে –

সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগরে দিল যেন

দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নীচে, সন্ত্রস্ত শহরে

(ওই)

৪. বিপদ-সংকেত জ্বেলে একজোড়া মূল্যহীনচোখে

পড়ে আছি মাঝরাতে কম্পমান কম্পাসের মতো

অনিদ্রায়।

(ওই)

৫. কিছুই শোনে না কেউ তলপেটে অনাস্বাদিত বিহবল

২কাম

আত্মার ভেতরে ওড়ে নীল মাছি বিরক্তির,                                                                   মগজে উদ্যান।

(‘পাশের কামরার প্রেমিক’, ওই)

৬. জরা মৃত্যু আর্তির চন্দন-ফোঁটা তার অবয়বে

প্রশান্ত করেছে তাকে সন্ধ্যার মতো আগাগোড়া

আততায়ী, – লুকিয়ে রয়েছে প্রেমিকার অনুনয়ে,

অনুজের মূল্যবোধে, আমাদের উদ্বাস্ত্ত দশকে

(‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, ওই)

৭. উনুনের লালে আঁচে গাঁথা-শিকে জ্বলছে কাবাব

শীতরাতে কী বিপজ্জনক ডাক দেয় আহ্লাদে শহর,

(‘মোহন ক্ষুধা’, ওই)

‘আলোকিত গণিকাবৃন্দ’ কবিতায় খুব দরদ দিয়ে তিনি গণিকাবৃত্তির উপাসনা করেছেন। বাংলা কবিতার ইতিহাসে এরকম কবিতা আর দু-একটি পাওয়া মুশকিলই বটে। ‘শহরের ভেতরে কোথাও হে রুগ্ন গোলাপদল,/ শীতল কালো ময়লা সৌরভের প্রিয়তমা,/ অস্পৃশ্য বাগানের ভাঙাচোরা অনিদ্র চোখের অপ্সরা,/ দিগ্ভ্রান্তের ঝলক তোমরা, নিশীথসূর্য আমার!… ক্ষণকাল সে নকল স্বর্গলোকের আমি নতজানু রাজা/ কানাকড়ির মূল্য যা দিলে জীবনের ত্রিকালে তা নেই/ অচির মুহূর্তের ঘরে তোমরাই তো উজ্জ্বল ঘরনী/ ভ্রাম্যমাণেরে ফিরিয়ে দিলে ঘরের অঘ্রাণ,/ তোমাদের স্তব বৈ সকল মূল্যবোধ যেন ম্লান!’ জীবন ও সমাজের বহির্বৃত্তের নানাবিধ সঞ্চয় তাঁর কবিতায় অনুবিম্বিত। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, মস্তিষ্কের খোলা জানালায় তিনি দেখেছেন এসব বীভৎসতা কিংবা অন্ধকার। তাঁর কবিতায় যে অন্ধকার-সন্ত্রাস-পচন ও কামক্লেদের দৃশ্য আমরা পাই, তা তাঁর ঘনিষ্ঠ জীবনবোধ এবং সাবলীল নাগরিক-অন্বিষ্টতার পরিচয় বহন করে। বোদলেরীয় জগতের ছায়া-প্রচ্ছায়ার উপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর  নগর-চেতনার সারাৎসারে রয়েছে তাঁর একান্ত নিজের বিষয় ও চিন্তার কাঠামোগত সমন্বয়, যা তাঁর চিত্তবৈভবপ্রসূত শিল্পচেতনার মৌলিক অঙ্গীকার। যে কারণে তিনি নগরচেতনার দিক থেকেও বাংলা কবিতায় অন্যের থেকে আলাদা। তাঁকে শুধু নগরচেতনার কবি বললে খন্ডিতভাবে দেখা হয়। তাঁর কবিতায় নাগরিক জীবনের বাইরেও বাংলাদেশের বিস্তৃর্ণ নিসর্গ, পশু-পাখি কিংবা লোকজীবনের নানা প্রপঞ্চেরও সন্ধান মেলে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, শোষণ-বঞ্চনা, রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা, ক্ষুধা ইত্যাদিও তাঁর কবিতার শরীরে ভর করে আছে। জীবনানন্দীয় পরাবাস্তবতার চিত্রকল্পের উদ্ভাসন দেখা যায় তাঁর ‘পরস্পরের দিকে’ কবিতায়, যদিও বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে তা সম্পূর্ণই জীবনানন্দ থেকে আলাদা। ‘কোন সংগোপন উৎস থেকে বেরিয়ে আসছে/ অনর্গল ছেঁড়া-খোঁড়া দৃশ্যগুলো :/ একটা মদির অশ্ব বারবার লাফিয়ে উঠছে/ বাতাসে শূন্যতায়, -/ বাখানে ঝুলন্ত চাঁদ জবার মতো লাল।’ উল্লেখ্য, এই সময়ের কবিরা ত্রিশের কবিদের দ্বারা প্রাথমিকভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং উন্মেষলগ্নে জীবনানন্দগ্রস্ততা ছিল তাঁদের কাব্যস্বভারের একটি স্বাভাবিক ব্যাপার।

তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪) মূলত মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সমাজবাস্তবতাকে ধারণ করেছে। এসব কবিতার কাব্যভাষায় মাধুর্যের চেয়ে দীপ্র উচ্চারণ চোখে পড়ে বেশি। উপমা, শ্লেষ কিংবা উত্তুঙ্গ শব্দের সমাহার লক্ষ করা যায় এই সময়ের কবিতায়। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কবিতায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা।  গ্রেনেড, মেশিনগান, ট্যাংক, বেয়নেট, বুলেট, গেরিলা, রাইফেলসহ নানাবিধ যুদ্ধগন্ধী শব্দের সঙ্গে কবিতার মেলবন্ধন ঘটে এ-সময়ে। তাঁর এ-সময়ের কবিতায় জীবনঘনিষ্ঠ নান্দনিকতার সন্ধান মেলে। ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট’  কবিতায় রাষ্ট্রের অত্যাচার-পীড়ন-ব্যর্থতা, সামরিক শাসন, ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতার ফল যে সামরিক শাসন, কিংবা রাষ্ট্রকে নিপীড়নের হাতিয়ার করে ফেলা – এসব বিষয়ের অবতারণায় কবিতাটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পক্ষে এক নান্দনিক শক্তি হিসেবে ভাবিত হতে পারে।  ‘রাষ্ট্র মানেই রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা/ রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা মানেই/ লেফট রাইট, লেফট রাইট লেফট -’। যুদ্ধোত্তর মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ, রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতা, উদ্বাস্ত্ত, ক্ষুধার্ত মানুষের কথা সশব্দে উচ্চারিত হয়েছে ‘স্কিৎসোফ্রেনিয়া’ কবিতায়। ‘পেটের ভেতর যেন গর্জে উঠছে গ্রেনেড/ কার্বাইনের নলের মতো হলুদ গন্ধক-ঠাসা শিরা,/ গুনাগার হৃদয়ের মধ্যে ছদ্মবেশী গেরিলারা/ খনন করছে গর্ত, ফাঁদ, দীর্ঘকাঁটা বেড়া।… একটি নিবিড় আলিঙ্গনের আয়ুষ্কালে/ ৬০০০০০০ উদ্বাস্ত্তর উদ্বিগ্ন দঙ্গল/ লাফিয়ে উঠলো এই টেবিলের ’পর;’।  ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতায় অস্থির অসুখী মনের যে আর্তি তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সত্তরের দশকের সেই উন্মাতাল, অস্থির সময়ের কথা যখন অনিশ্চয়তা, নৈরাশ্য কিংবা নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিতে রুগ্ণ সমাজবাস্তবতার মধ্যে শিল্প-সাহিত্যেরও রুগ্ণতা পরিলক্ষিত হচ্ছিল, সেই অসুস্থ সময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন। ‘আমাদের চৈতন্যপ্রবাহে তুমি ট্রাফিক আইল্যান্ড/ হে রবীন্দ্রনাথ’ কিংবা ‘তুমি সে রাতের পার্কে আমার আলো-জ্বলা/ অন্তিম রেস্তোরাঁ!’

কবিতাকে তিনি নান্দনিক সৃষ্টিশীল অস্ত্র হিসেবে দেখতে চেয়েছেন ‘কবিতা, অক্ষম অস্ত্র আমার’ কবিতায়। কবিতার আত্মপ্রত্যয়ী অনুভবের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের বীজ বপন করেছেন কবি। তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে বেগবতী কবিতার প্রয়োজন। ঝিমানো কবিতা তাঁর অপছন্দ, কবিতাকে তিনি ফিল্ডগানের মতো গর্জে ওঠার আহবান জানাচ্ছেন, ‘হে আমার শব্দমালা, তুমি কি এখনও বৃষ্টি-ভেজা/ বিব্রত কাকের মতো/ আমার ক্ষমাহীন ডাইরির পাতার ভেতর বসে নিঃশব্দে ঝিমুবে,… যদি পারো গর্জে ওঠো  ফীল্ডগানের মতো অন্তত একবার…’। ‘নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের আবহ ফুটে উঠেছে। যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ, নির্বিচার গণহত্যা এবং স্বদেশভূমির ‘বিকলাঙ্গ ভায়োলিনের মতো’ অবস্থা কবিকে দারুণভাবে আহত করেছে। ‘তবে কি এই নিয়তি আমাদের, এই হিরণ্ময় ধ্বংসাবশেষ,/ এই রক্তাপ্লুত শার্ট আজীবন, এই বাঁকাচোরা ভাঙা ভায়োলিন?’ ‘ব্ল্যাক আউটের পূর্ণিমায়’ কবিতায় খুব দরদের উচ্চারণে বিধৃত হয়েছে স্বদেশের ছবি; অনিন্দ্য চিত্রকল্পে, মমতার শুভ্র বন্ধনে। ‘একটি আংটির মতো তোমাকে পরেছি স্বদেশ/ আমার কনিষ্ঠ আঙ্গুলে কখনও উদ্ধত তলোয়ারের মতো/ দীপ্তিমান ঘাসের বিস্তারে, দেখেছি তোমার ডোরাকাটা/ জ্বলজ্বলে রূপ জ্যোৎস্নায়।’ কবির প্রত্যয় এবং আশাবাদের উষ্ণ মিশ্রণে গণজাগরণের পূর্ণিমায় নিজস্ব ঘরে ফেরার দৃশ্য সাবলীলভাবে ভেসে ওঠে যখন শুনি ‘ব্ল্যাক আউট অমান্য করে তুমি দিগন্তে জ্বেলে দিলে/ বিদ্রোহী পূর্ণিমা। আমি সেই পূর্ণিমার আলোয় দেখেছি :/ আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠোন পার হয়ে/ নিজেদের ঘরে।’ ‘রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন’ কবিতায় আমরা দেখি কবি রাষ্ট্রপ্রধানকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সকল ক্ষেত্রে শিল্প-সাহিত্য তথা সৌন্দর্যচর্চার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। ‘রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো/ জেনারেলদের হুকুম দেবেন রবীন্দ্রচর্চার? মন্ত্রীদের/ কিনে দেবেন সোনালি গীটার? ব্যাঙ্কারদের/ বানিয়ে দেবেন কবিতার নিপুণ সমঝদার?’ এই গ্রন্থের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় কবিতা ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’। এই কবিতায় স্বদেশভূমিকে প্রিয়তমা সম্বোধন করে কবি অঙ্গীকার করছেন ‘ভয় নেই/ আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে/ শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন/ আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে/ গণচুম্বনের ভয়ে হন্তারকের হাত  থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।’ এই কবিতায় একটি সুস্থ-সবল-নান্দনিক-গণতান্ত্র্রিক-সন্ত্রাসমুক্ত-চোরাচালানহীন-খুনহীন রাষ্ট্রকাঠামোর স্বপ্ন দেখেছেন কবি। কবির এই স্বপ্ন থেকে আমরা আজো অনেক দূরে রয়েছি, কবির এই স্বপ্নের বাংলাদেশ আমাদেরও স্বপ্ন ছিল, যা আজো বাস্তবায়িত হয়নি, বরং স্বদেশের গতি আজ উলটোদিকে। দেশ নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে কবি নানামুখী ভাবনায় তাঁর কাব্যপ্রত্যয়কে যুক্ত করেছেন। যুদ্ধোত্তর সময়ে দেশের দুর্ভিক্ষ এবং রেশনের দোকানের স্বজনপ্রীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধেও কবি কলম ধরেছেন। ‘নীল জলের রান্না’ কবিতায়  ‘সরু, মিহি সাদা চাল’ এবং ‘লাল, মোটা চালে’র আলাদা আলাদা মানুষের এই রাজনীতি কবির চোখ এড়ায়নি। ‘জতুগৃহ’ কবিতায় তাঁর আক্ষেপের কথা আমরা জানতে পারি, তিনি স্বদেশকে যেভাবে ‘ভেঙেচুরে খুব সহজ আর সরল’ করতে চেয়েছিলেন তা করতে পারেননি।

কোথাও কোনো ক্রনদন নেই (১৯৭৮) তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থের অনেক কবিতায় তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের অনুরণন রয়েছে। তবে এই গ্রন্থের বেশকিছু কবিতা পরিণত শিল্পসুষমায় ঋদ্ধ। এখানে যুদ্ধ, স্বদেশ কিংবা নগরকেন্দ্রিক উদ্বেলতা তেমন তীক্ষ্ণভাবে কাজ করেনি। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোয় পশুপাখির আধিক্য চোখে পড়ার মতো। প্রথম কবিতা ‘আজ সারাদিনে’ আমরা দেখি প্রকৃতি ও পাখির  কোলাজ-প্রতীক এবং উদ্বাস্ত্ত পলায়নপর মানুষের ভ্রামণিক দৃশ্যাবলি। এটি নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার কবিতা। ‘আজ সারাদিন বাতাস, বৃষ্টি আর শালিক/ আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো’ এবং যা আমাদেরকে অভিভূত করে তা হলো ‘ঐ শালিকের ভেতর উনুনের আভা, মশলার ঘ্রাণ।’ অমিয় চক্রবর্তীকে উৎসর্গীকৃত কবিতা ‘সঙ্গতি’তে আমরা দেখি প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের বৈপরীত্য। ‘বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা/ মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,/ কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা/ ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ’ – এর পরে কবি বলছেন, ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…’। তাঁর কবিতায় আমরা শালিককে ঘুরেফিরে আসতে দেখি (মরা কিংবা জীবিত) ‘একটি মরা শালিক’ কবিতায় আমরা একটি পরাবাস্তব দৃশ্যের ধারণা পাই, ‘অথচ আজ ভোরে নৈশকালীন বাতাস ও বৃষ্টির পর/ দরোজা খুলেই দেখি – উঠোনের কিছু প্রগাঢ় সবুজ/ লতাপাতার মধ্যে একটি হলুদ মরা শালিক কাৎ হয়ে পড়ে আছে/ তারপর সারাদিন সেই মরা শালিকটা/ ঘুরে বেড়ালো আমার সঙ্গে সঙ্গে/ আশ্চর্য নাছোড়বান্দা – ঘর থেকে ঘরে।’ ‘বিচ্ছিন্ন দৃশ্যাবলী’ কবিতায় পশুপাখির ওপর কবির অসম্ভব দরদের পরিচয় মেলে। ‘তবু থাক, দীর্ঘ আয়ু পাক হরিণের সঙ্গমখানি, রাজহাঁসটির/ একাকী ভ্রমণ।’ ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না’ কবিতায় আমরা একঝাঁক পশুপাখির সন্ধান পাই এবং তাঁর কবিতায় পাখির প্রস্রাবেরও হদিস মেলে। ‘ফুটপাতে শুয়ে থাকা নেংটো ভিখিরির নাভিমূলে/ হীরার কৌটের মতো টলটল করছে শিশির/ এবং পাখির প্রস্রাব;’। এই গ্রন্থভুক্ত অধিকাংশ কবিতায়ই আমরা শালিক, কাক, মোরগ, মাছ, হরিণ, খরগোস, টিয়াসহ নানা ধরনের পশু ও পাখির সন্ধান পাই। ‘যাই, যাই’ কবিতায় তিনি বলছেন, ‘হে আমার মোরগের চোখের মতন খুব ছেলেবেলা।’ এই গ্রন্থের কিছু দীর্ঘ কবিতা আমার কাছে তুলনামূলকভাবে কিছুটা নিষ্প্রভ বলে মনে হয়েছে। এই গ্রন্থের অনেক কবিতায় তাঁর কাব্যশক্তির পরিচয় রয়েছে। শামসুর রাহমান এবং শহীদ কাদরীকে নাগরিক কবি বলা হলেও এই দুই কবির কবিতায় পশুপাখির তুমুল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। শামসুর রাহমানের কবিতায় এগুলো এসেছে বর্ণনার অনুষঙ্গ হিসেবে, কিন্তু শহীদ কাদরীর কবিতায় অনেক ক্ষেত্রেই পশুপাখির প্রতীকী ব্যবহার লক্ষণীয়। তার নিসর্গ ও পশুপাখির আবরণের তলে রয়েছে এক বিদগ্ধ জীবন-চেতনা যে জীবন আধুনিক এবং নাগরিক-বৃত্তে উদ্বেলিত। একধরনের দার্শনিক প্রত্যয়, নান্দনিক রহস্য তাঁর কবিতার আবরণে জড়িয়ে আছে. যা তাঁর কবিতাকে উচ্চকিত করেছে ।

আমাদের চেনাজানা জগতের অনেক কিছুই কবির সৃষ্টির রসায়নে পরিবর্তিত হয়ে বেঁকেচুরে নতুন অবয়বে আমাদের সামনে আসে, যা আমরা আর সহজে চিনতে পারি না। কবিতার সবটাই উতরে যায় না, কিছু কিছু পঙ্ক্তি, ধ্বনি মনে দাগ কেটে যায় – সেটুকুই কবির কৃতিত্ব। শহীদ কাদরীর এই তিনটি কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা, অনেক কবিতার পঙ্ক্তি, অনেক ধ্বনি, অনেক জীবনমন্থিত উপাদান, জীবনদর্শন এবং নান্দনিক রহস্য আমাদের অভিভূত করে, এমন এক জগতে নিয়ে যায, যা তাঁর মৌলিক কাব্যচেতনার পরিচায়ক। মেধা, মনন ও নান্দনিকতার সমন্বয়ে লিখিত তাঁর বেশকিছু কবিতা তাঁর কালজয়িতাকে নিশ্চিত করেছে। এ-সময়ের কবিরা ষাটের দশকে টেড হিউয়েজ, অ্যালেন গিনসবার্গ এবং অ্যাড্রিয়ান হেনরিসহ পশ্চিমের অনেক কবির কবিতা পড়েছিলেন এবং কিছুটা প্রভাবিতও হয়েছিলেন, তবে সে-প্রভাব তাঁদের কবিতার ক্ষেত্রে বড় হয়ে দেখা দেয়নি। পৃথিবীর সব বড় কবির বেলায়ই এ-কথা খাটে, কেউ না কেউ কারো কারো দ্বারা প্রাথমিকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন এবং প্রতিভার প্রাবল্যে সে-প্রভাব কাটিয়েও উঠেছেন, পেতেছেন নতুন কবিতার সংসার। সুতরাং, সেসব কথা বাদ দিয়েই বলা যায়, শহীদ কাদরী একজন বড়মাপের কবি, তাঁকে আরো গভীরভাবে অধ্যয়ন করা দরকার। রোলাঁ বার্থের মতে, ‘There are multiple entrances to a text, and one can enter anywhere.’ শহীদ কাদরীর অনেক কবিতারই textual plasticity রয়েছে, যে-কারণে তাঁর কবিতার বিচিত্র পাঠ সম্ভব।

‘Poetry and the Primitive’ প্রবন্ধে কবি ও কবিতা বিষয়ে Gary Snyder লিখেছেন : ‘Poetry must sing or speak from authentic experience. Of all the streams of civilized tradition with roots in the Paleolithic, poetry is one of the few that can realistically claim an unchanged function and a relevance which will outlast most of the activities that surround us today. Poets, as few others, must live close to the world that primitive men are in; the world in its nakedness, which is fundamental for all of us – birth, love, death; the sheer fact of being alive.’

বিশ্বস্ত চৌহদ্দিতে কবিকে দাঁড়াতেই হয় এবং কবিতার মৌল উপাদানে সেই অভিজ্ঞতার সত্যাসত্য লেগে না থাকলে কবিতা বড় ঠুনকো হয়ে যায়। জীবনের সত্য-মিথ্যা-সংশয় এ সবকিছু যখন কবিতায় সমসত্ত্বভাবে মানিয়ে যায়, তখনই কবিতার দিগন্তে সূর্য ওঠে; কবি শহীদ কাদরী সেই সূর্য-ঝলসিত কবি, নিঃসন্দেহে।

‘Each poem grows from an energy-mind-field-dance, and has its own inner grain. To let it grow, to let it speak for itself, is a large part of the work of the poet ’(Gary Snyder).  কোনো কবির এই energy-mind-field-dance যখন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে কিংবা শুকিয়ে যায় তখন কবিকে সরে দাঁড়াতে হয়, কবি শহীদ কাদরী এই নিয়তির শিকার কিনা আমরা জানি না, তবে এটুকু জানি যে, একটি বিশেষ পর্যায়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অক্ষমতা কিংবা  অভিমান যা-ই হোক না কেন, তিনি পরবর্তীকালে তেমন উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম আমাদের আর উপহার দেননি কিংবা দিতে পারেননি, হয়তো-বা তার প্রয়োজনও ছিল না – এসবই সত্যি।

মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্র তাঁর কাব্যদর্শনের প্রধান দিক। জীবনের দিকে, শুভত্বের দিকে, শান্তির দিকে তাঁর শিল্পপ্রয়াসের সারাৎসার। শহীদ কাদরীর কবিতা গ্রন্থের মলাটে লিখিত আছে ‘আধুনিক মনন, বিশ্বজনীনতা ও স্বাদেশিকতার মিশেলে এক বিশিষ্ট শিল্পবোধ ও কাব্যভঙ্গি শহীদ কাদরীর অনায়াস আয়ত্ত, সন্দেহাতীতভাবে যা তাঁর অনন্যতারই পরিচয়বাহী। তিনটি মাত্র কাব্যগ্রন্থের এই কবি তাই খুব সহজেই বাংলাকাব্যে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তাঁর কবিতায় সম্পৃক্ত দীপ্র আধুনিকতা, কাব্যশক্তি আর বাকভঙ্গির বিশিষ্টতা, সেই সাথে দৃষ্টিভঙ্গির চমকের সঙ্গে গভীর জীবনবোধ, অন্তর্গত বিষাদ ও বৈরাগ্যের যোগ পাঠকদের জন্য সর্বদাই এক নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ভান্ডার।’ শহীদ কাদরীর কবিতা-পাঠে এসব কথার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়।

শহীদ কাদরী একজন বহুমাত্রিক, বহুস্তরিক কবি। যুদ্ধবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদবিরোধী সামরিক-স্বৈরাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক-চেতনাও তাঁর কবিতার অন্যতম মৌলিক সুর। তিনি নিঃসন্দেহে একজন প্রভাবসঞ্চারী কবি এবং সে হিসাবে তাঁর কবিতা অনাগত কালের কবি ও পাঠকের কাছে অনিবার্য পাঠ হিসেবে বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে। বাংলা কবিতার একটি কালখন্ডের ইতিহাসে কবি শহীদ কাদরীর নাম উচ্চারণ করতেই হবে – এ যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি যে, এমন কিছু কবিতার রচয়িতা তিনি যে-কবিতাগুলো বাংলা কবিতার বিপুল স্রোতধারায় চিরকাল আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই কবি বাংলাদেশ ও বাঙালির অন্তর্জগৎ স্পর্শ করেছেন ঐকান্তিক বোধে, নিবিড়  মমতায়।