শহীদ কাদরীর তিনটি কবিতা

মানুষ, নতুন শতকে

 

আজ আবার উদ্যত ছুরি মানুষের হাতে,

ওর পায়ের নিচে

পিষ্ট হচ্ছে নারী,

শিশুরা নিহত হচ্ছে চতুর্দিকে!

 

কবি, তোমার বর্মগুলো বের করে নাও।

তোমার কবিতাই শ্রেষ্ঠ বর্ম আজ!

 

মধ্যযুগের অন্ধকার ছিঁড়ে

আবার উদ্যত ছুরি

মানুষের হাতে।

আমাদের চেনা নগরগুলো থেকে

উঠছে ক্রন্দনধ্বনি

কবি, ওকে প্রতিহত করো।

কবি তুমি জানো আমাদের প্রিয় কবিতার

অমর পঙ্ক্তিগুলো

হত্যার বিরুদ্ধে চিরকাল – চিরকাল…

কবি, ওকে প্রতিহত করো

 

এখন সেই সময়

 

যাকে অসময় বলতে পারো, দুঃসময় বলতে পারো

দোয়েলের গান কেউ পছন্দ ক’রছে না

কোয়েলের গান কেউ পছন্দ ক’রছে না

পৃথিবীব্যাপী এখন শুধু

পাতা ঝরার শীতার্ত গান ছাড়া

অন্য কোনো ধ্বনি নেই

ওক গাছ কিংবা পাইন গাছ

শিমুল অথবা কৃষ্ণচূড়া

শীতের আক্রমণ থেকে নিস্তার নেই কারুর

শুধু আর্তনাদ ঝরা-পাতার

 

আমাদের লাল, নীল, সবুজ পাতাগুলো,

আমাদের প্রিয় পাতাগুলো ঝ’রে পড়ছে,

স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিকদের মতো ঝ’রে পড়ছে,

শুধু পাতা ঝ’রার আর্তনাদ

শুধু পাতা ঝরার শোকার্ত চিৎকার চতুর্দিকে।

 

অথচ সমস্ত পৃথিবীর ঝরা-পাতাদের চিৎকারকে ছাপিয়ে

ভূকম্পনে বিধ্বস্ত গ্রামের মন্দিরে

 

 

ঘণ্টাধ্বনির মতো,

জলোচ্ছ্বাসের পরের প্রথম ভোরের

আজানের মতো,

কবি তার উত্থানের গানটি গাইবে

অসময় বলো, দুঃসময় বলো,

গান থামবে না।

 

 

 

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গল্প

 

সেদিন দুপুরবেলা

অন্যমনে ছিলাম ব’সে মন্দির-চত্বরে

আমার কৈশোরের এক

ছায়াচ্ছন্ন দিনে।

 

এয়ারগানের ছর্রাবেঁধা নিহত কাকের কলকাতাকে

স্মৃতির একটি গুচ্ছে

মিলিয়ে নিয়ে,

সংহত ক’রে,

বসেছিলাম আমরা তিনজন (আমি,

জাহাঙ্গীর আর সুকুমার)।

আবাল্য অবাধ্য কথক আমি নতুন

 

বন্ধুদের শোনাচ্ছিলাম কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে

ঘুরে ঘুরে আমার (জন্মদিনে পাওয়া)

এয়ারগান কত-না চড়ুই আর কাকাতুয়া নির্দ্বিধায়

শিকার করেছে।

 

আর সূর্যটাকে সেদিন

মনে হয়েছিল একটা লাল বিশাল ললিপপ্ (নিউ-

মার্কেট থেকে কেনা) – আমার মুখে এই

উক্তিটা শুনে জাহাঙ্গীর উঠলো ব’লে ‘আর

গুল-তাপ্পি মারিস না-তো’ আর আমি যেই বলতে গেছি

‘ঠিক্ বলেছিস্!’ অমনি চোখজোড়াটা

আটকে গ্যালো বটগাছের নিচে,

দেখি, একটা মরা শালিক

টেলিভিশনের অ্যান্টেনার মতো

শূন্যে দু’পা তুলে

 

নিশ্চিন্তে রয়েছে প’ড়ে।

আর লাইন দিয়ে সারিসারি লাল পিঁপড়ে

শালিকটার চোখের মণি খুঁটেখুঁটে খাচ্ছে!

কোথাও কোনো বেদনার চিহ্ন নেই,

না-নৃত্যরত গাছের পাতায়, না-গগনম-লের অসীম

নীলিমায়

এ-ভাবেই আমার বিশ্বাসগুলো

পাখির চোখের মতো খুঁটেখুঁটে

খেয়ে ফেলেছে দুপুর-বেলার সেই লাল পিঁপড়েগুলো।

Published :


Comments

Leave a Reply