শহীদ কাদরী: কিংবদন্তি ও কবিতাবিচার

শিহাব সরকার

মাত্র চারখানা বই বের করে, এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে কিছু অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত কবিতা, একটি দেশের কবিতাভুবনে কিংবদমিত্মতুল্য খ্যাতি পেয়েছেন – এমন কবির সংখ্যা বিরল। হাতেগোনাই বলা চলে। সদ্যপ্রয়াত শহীদ কাদরী (১৯৪২-২০১৬) এই কবিদের একজন। মেধায়, মননে, পা–ত্যে এবং পাঠকপ্রিয়তার বিচারে শহীদ কাদরী বাংলা সাহিত্যে অনন্য। অতি প্রতিভাধরদের ক্ষেত্রে যা হয়। তাঁর সৃজনশীলতাসঞ্জাত আবেগ তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। তাঁকে তা বাহ্যত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কোনো-কোনো সময়, এর ফলপ্রসূ ব্যবহার করতে পারেননি; আমরা বিষাদের সঙ্গে লক্ষ করি বিশাল এক অপচয়। গা-ছেড়ে দেওয়া এবং একই সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত বন্ধুসাহচর্যে দিন পার করে দিয়েছেন তিনি। ওসব আড্ডায় উপস্থিত তাঁর অনুরাগীরা তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত হয়েছেন, কিন্তু কবির মূল কাজ – কবিতা রচনা সম্পর্কে তিনি রয়ে গেছেন বরাবর উদাসীন।

তবু শহীদ কাদরী চারখানা বই রেখে গেছেন পাঠকদের জন্য। এ আমাদের সৌভাগ্য। দীর্ঘ, অনিশ্চিত এবং সময়-সময় বিপর্যস্ত প্রবাসজীবনে কবিতাই ছিল তাঁর বাঁচার প্রেরণা এবং মূল সঞ্জীবনী শক্তি। তিনি তা তাঁর কবিতাপস্নুত জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। বলা হয়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কবি না হয়ে হতে পারতেন সফল অধ্যাপক, পণ্ডিত বা দার্শনিক। কিন্তু তিনি কবিতার ভেতরেই খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের মোক্ষ। একই বিষয় খাটে শহীদ কাদরীর বেলায়। তাঁর স্নাতক পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ছাড়পত্র ছিল না। কিন্তু তাঁর অগাধ মেধাসম্পদের প্রাচুর্য সম্পর্কে আমরা যারা অবহিত, নির্দ্বিধায় বলতে পারি, শহীদ কাদরী আমাদের যে-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন একজন সর্বজনমান্য জ্ঞানাচার্য হিসেবে।

সাহিত্যই ছিল শহীদ কাদরীকেন্দ্রিক আড্ডাগুলোর মূল বিষয়। শিষ্য ও অনুরাগীদের সঙ্গে গ্রিক দার্শনিকদের নিয়মিত বৈঠক সম্পর্কে  যেমন শোনা যায়, শহীদ কাদরীর সহজাত প্রাণস্ফূর্তির কারণে তাঁর আড্ডায় ভারি ভাবগম্ভীর বিষয় নিয়েও একটানা আলোচনা বড় একটা ঠাঁই পেত না। সর্বজনীন লঘু এক আবহ বিরাজ করত ওখানে। ব্যঙ্গবিদ্রূপ এবং নির্মল হাস্যরসেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল ওসব আড্ডায়। কিন্তু একসময় ওখানে উপস্থিত সকলের বিশ্বাস হয়েই যেত যে, আড্ডার মধ্যমণি অবশ্যই শহীদ কাদরী। একসময় সকলের অজামেত্ম ওখানে ঝলকে উঠতে শুরু করত জ্ঞাননির্ভর মেধার দ্যুতি, হালকা তাত্ত্বিক আলোচনা ইত্যাদি। উপস্থিত কবিরা, বিশেষ করে যারা তরুণ, প্রতিশ্রম্নতিশীল এবং মেধাবী, ওসব আলোচনা শেষে কোনো না কোনোভাবে ঋদ্ধ হয়ে ফিরতেন। প্রচুর পড়তেন শহীদ কাদরী। তাঁর মুখ থেকে শোনা নতুন অথবা অধুনা-দুষ্প্রাপ্য বিদেশি কোনো বইয়ের নাম, কোনো কবির উলেস্নখ অথবা বাঙালি কোনো কবির বিস্মৃতপ্রায় পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি ওসব আড্ডায় থাকা কবি এবং কাব্যানুরাগীদের জন্য ছিল পরম প্রাপ্তি। বিচিত্র ছিল তাঁর আড্ডার কেন্দ্রগুলো। পঞ্চাশের দশকে সমসাময়িক কবি-গল্পকারদের নিয়ে তিনি বসতেন পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিং এবং আরো কিছু নির্ধারিত রেসেত্মারাঁয়। ষাটে তাঁর বসার জায়গা উঠে এলো গুলিসত্মান এলাকার রেক্সে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই রচনার লেখকও তাঁর আড্ডাগুলোতে নিয়মিত হাজিরা দিতে শুরু করে। এসব সাহিত্য-বৈঠক তখন রেসেত্মারাঁ থেকে কবিদের বাসভবনে চলে আসতে শুরু করে। এসবের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল ‘বুড়োভাই’ বা ‘বুড়ো’ নামে খ্যাত মোশাররফ রসুলের র‌্যাংকিন স্ট্রিটের অবিন্যস্ত শ্রীছাঁদহীন ব্যক্তিগত থাকার ঘরটি, এলিফ্যান্ট রোডে কবি সিকদার আমিনুল হকের বৈঠকখানা, মাঝে-মাঝে হাতিরপুলের লাগোয়া ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হকের বইয়ে ঠাসা বসার ঘর – এমনকি এই লেখকসহ ব্যাচেলর কবিদের এক-দুই কক্ষের দীনদরিদ্র বাসাও ছিল ওই তালিকায়। এ পর্যায়ে প্রতি রোববার নিউমার্কেটের লিবার্টি রেসেত্মারাঁর আড্ডা হয়ে ওঠে আমাদের জন্য এক প্রধান আকর্ষণ। এ-আড্ডায় নিয়মিত আসতেন পঞ্চাশ দশকের কবি শহীদ কাদরী ছাড়াও ষাট এবং সত্তরের বেশ কজন কবি।

নিষ্কলুষ আড্ডার নেশা শহীদ কাদরী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লেখকদের মধ্যে। আড্ডা এবং কবিতা যৌবনের শুরু থেকেই তাঁর কাছে হয়ে ওঠে একে অপরের পরিপূরক। ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে এই নির্ভেজাল আড্ডা সংক্রমিত করেন শহীদ কাদরী। পুরনো ঢাকায় সওগাত অফিসের বিখ্যাত আড্ডাটিতে পঞ্চাশের প্রতিষ্ঠিত এবং তরুণ কবিদের প্রচুর সমাগম হতো। কিন্তু ওটার মেজাজ ছিল সাহিত্যবাসরের মতো। ওখানে লেখা পাঠ করা হতো, তাৎক্ষণিক আলোচনা হতো – আবার লঘু কথাবার্তাও হতো। কিন্তু সবকিছুই যেন ছিল একটা নিগড়ে বাঁধা। শহীদ কাদরীর আড্ডায় কবিতা পাঠ হতো না, আবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেউ নিজের সদ্য লেখা রচনা পড়লে নিরুৎসাহিতও করা হতো না। তবে সেই কবিকে আড্ডার কোনো না কোনো ফাঁকে শহীদ ভাইয়ের তির্যক মমত্মব্য সহ্য করতেই হতো। ফলে ওই আড্ডায় কোনো কবিরই রচনা পাঠ করার দুর্মতি হতো না সাধারণত।

১৯৭৬-এ শহীদ কাদরী লুম্বাগো ব্যাধিতে আক্রামত্ম হলেন। এ এক মারাত্মক অসুখ, যার চিকিৎসা স্রেফ কাঠের বিছানায় দুমাস লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা। শারীরিকভাবে পুরোপুরি স্থবির এবং অচল শহীদ ভাইয়ের ঠাঁই হলো তাঁর ওই সময়ের শ্বশুরালয়ের একটি ঘরে, যা মূল বাসভবন থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। শয্যা নিলেন শহীদ ভাই, দুশ্চিমত্মাগ্রস্ত এবং বিষণ্ণ। কী করে এই একলা ঘরে একটানা লম্বা শুয়ে থেকে, দুটি মাস কাটাবেন তিনি! কিন্তু তাঁকে অপেক্ষা করতে হলো মাত্র দু-একদিন। পুরো শহরে বার্তা রটে গেল শহীদ কাদরী গৃহবন্দি, আড্ডার সঙ্গী খুঁজছেন। এবং এ-আড্ডা চলবে দুমাস কি তার বেশি সময় ধরে। দলে-দলে ঢাকার তাবৎ কবিকুল ছুটলেন শহীদ কাদরীর পুরানা পল্টনের ওই বিখ্যাত ঘরটির দিকে। তারপর থেকে চলল দিনের পর দিন সকাল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যমত্ম আড্ডা, মুহূর্তে-মুহূর্তে চাঁদা করে তোলা পয়সায় চা এবং সসত্মা বিস্কুট। শহীদ কাদরীর মাথার কাছে টেবিলে বইয়ের সত্মূপ এবং একটা ছোট টেপরেকর্ডার, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দি গানের ক্যাসেট। রবীন্দ্রসংগীতও ছিল। দুপুরের দিকে আড্ডায় লেখকদের উপস্থিতি খুব ক্ষীণ হয়ে গেলে শহীদ ভাই বইয়ে ডুবে যেতেন বা গান শুনতেন। কিন্তু আড্ডার আবহ কাটত না। পড়া বা গান শোনার ফাঁকে-ফাঁকেই তিনি তরুণ অথবা সিনিয়র কোনো কবির সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন। পুরো দুমাস ধরে চলল এই আড্ডা। একটানা, প্রায় বিরতিহীন। বোধহয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ-ধরনের আড্ডার নজির নেই। এ-সময় একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, শহীদ কাদরীর কবি-ব্যক্তিত্বের চৌম্বক শক্তি অপ্রতিরোধ্য।

শহীদ কাদরীর বৈঠকি মেজাজ এবং নগরকেন্দ্রিকতা তাঁর প্রথম বই উত্তরাধিকারের অধিকাংশ কবিতায় প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত। বইটি  বেরোয় চট্টগ্রামের বইঘর প্রকাশনী থেকে ১৯৬৭ সালে। তখন শামসুর রাহমানের দুটি বই বেরিয়ে গেছে। ১৯৬৭-তে প্রকাশিত তৃতীয় গ্রন্থ বিধ্বস্ত নীলিমা। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই শামসুর রাহমানের কবিতা ঢাকার পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করে। তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায়। শহীদ কাদরী এবং আল মাহমুদ তখন তরুণ কবি। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে দুজনই প্রকাশিত কবি।

১৯৫৬ সালে এ-দুজনের কবিতা প্রকাশিত হয় কবিতা পত্রিকায়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ একদা এক রাজ্যে, ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হলেও সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম কবিতা বেরোয় হাসান হাফিজুর  রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রম্নয়ারি সংকলনে ১৯৫৩ সালে। পঞ্চাশের এ-চারজন প্রায় সমসাময়িক কবি। এবং প্রত্যেকের রচনাতেই অনুভব করা যায় তাঁদের স্বাতন্ত্র্য। শামসুর রাহমানের তিন-তিনটি বই বেরিয়ে যায় অল্প সময়ের ব্যবধানে। পাঠক-সমালোচকেরা সহজেই শনাক্ত করে ফেলেন তাঁর কবিতার মেজাজ, যাতে তাঁর নিসর্গনিমগ্নতার সঙ্গে মিশে থাকে নাগরিক-জীবনের যান্ত্রিকতা বিষয়ে সচেতনতা। এই সচেতনতা কখনো ঔদাসীন্যের জন্ম দেয়, কখনো তিক্ততা। আল মাহমুদের পরবর্তীকালের গ্রামীণ প্রকৃতি, এর মানুষ এবং জীবন সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক স্পষ্ট হয় আরো বেশ কিছুকাল পর।

প্রথম বইয়েই শহীদ কাদরীর কবিতা পাঠককে জানাল তিনি সবার চেয়ে পৃথক। পাঠক এবং সমালোচক – উভয়ই অবহিত হলেন তাঁর ভিন্ন ধরনের এক পরিশীলিত কণ্ঠস্বর সম্পর্কে। এবং চমৎকৃত হলেন, অভিভূত হলেন। নগর-জীবনের কবি শামসুর রাহমানও। কিন্তু তাঁর প্রথম দিকের বইগুলোতে এই পরিচয় স্পষ্ট হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, পাঠক কিংবা সমালোচক, কেউই তাঁকে ‘নাগরিক কবি’ হিসেবে অভিহিত করেননি। কিন্তু উত্তরাধিকার প্রকাশের পরপরই শহীদ কাদরী আমাদের সামনে আবির্ভূত হলেন ‘নাগরিক কবি’ হিসেবে। নগরজীবনের বিচ্ছিন্নতা ও বিষাদ, ক্লামিত্ম ও ক্লেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ-বইয়ের বেশ কিছু কবিতায়। আবার এ-ও ঠিক, অনেক পাঠক-সমালোচক শহীদ কাদরীকে বিশুদ্ধ অর্থে নগরজীবনের কবি বলতে নারাজ। তাঁদের মতে, নাগরিক কবি জাতীয় অভিধা আরোপ করার ফলে এই শক্তিমান কবি একটি ক্ষুদ্র গ–তে আবদ্ধ হয়ে যান। আসলে তাঁর ব্যাপ্তি অনেক বড়। এই পর্যবেক্ষণের সমর্থনে আমরা পেয়ে যাই তাঁর পরবর্তী দুখানা বই। তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা (১৯৭৪) এবং কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮)।

প্রথম বই উত্তরাধিকারের সংহত চরিত্র এবং টানটান ঋজুতা অনেকাংশে অনুপস্থিত শহীদ কাদরীর পরের তিনটি বইয়ে। এগুলোর মধ্যে শেষটি প্রকাশিত হয় তাঁর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাস-জীবনে। উলেস্নখ না করলেই নয়, উত্তরাধিকার-পরবর্তী বইগুলোতে শহীদ কাদরী ব্যক্তির সীমাবদ্ধ অবস্থানকে অতিক্রম করে নিজেকে ছড়িয়ে দেন বৃহত্তর এক  ক্যানভাসে।

অনেকের মতে, এই অতিক্রমণ, এক অর্থে উত্তরণও বটে, কবিকে তাঁর প্রথম বইয়ের কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে বের করে আনে। কারণ তাঁর বীক্ষণ তখন ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের অতীত সমষ্টিকেন্দ্রিক নানামুখী বাস্তবতায় স্থিত হতে শুরু করেছে। অবশ্য তাঁর এই পটভূমিগত বিসত্মৃতি সবসময় তাঁর অনুকূলে থেকেছে, তাও নয়। কোনো-কোনো রচনা তাঁর কবিতার প্রতি অবিচল অঙ্গীকারকে মস্নান করেছে বলে মনে হয়। তবে তাঁর এ-দুটো বইয়েও উত্তরাধিকারের মূল চারিত্র্যের রেখাপাত খুঁজে পাওয়া যায়। এক বই থেকে আরেক বইয়ে পূর্ববর্তী কবিতার সম্প্রসারণ ঘটে বহু কবির ক্ষেত্রে। নগরবিষয়ক আবহপ্রধান বেশ কিছু কবিতা-চরিত্রের ক্ষীণ ছায়া আমরা পাই তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা গ্রন্থে। উত্তরাধিকারের ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’, ‘আমি কিছুই কিনবো না’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘মোহন ক্ষুধা’ বা ‘আলোকিত গণিকাবৃন্দ’ শিরোনামের কবিতাগুলোর প্রতিচিত্র আছে তাঁর দ্বিতীয় বইয়ে। লঘু চরিত্রের ক্লিশে-প্রধান এবং বিপুল জনপ্রিয় ‘রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট রাইট লেফ্ট’ এবং ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ কবিতা দুটি শহীদ কাদরীর মূল কাব্যমেজাজ থেকে পৃথক। এ-ধরনের কবিতা তিনি আগে লেখেননি। এ-দুটো ছাড়া বইয়ের প্রায় সব কবিতাই কাদরীয়। উত্তরাধিকারে শহীদ কাদরী নিজস্ব ও সমষ্টির জীবন এবং পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে যা বলেননি তা যেন এক পূর্ণাঙ্গ অবয়ব পেয়েছে তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থে।

তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা গ্রন্থটি উত্তরাধিকারের সম্প্রসারিত সংকলন। এ-বই আগেরটির চেয়ে অনেক সান্দ্র, স্থিতধী এবং লক্ষ্যভেদী। এর কবিতাগুলোও কবির মনোজগতের ছবি আঁকে অনেক বিশদভাবে। এসব চিত্র যে-কোনো শুদ্ধ কবিতার ধরনে স্ফুটোন্মুখ বাঙ্ময়তায় গনগনে রক্তিম এবং একই সঙ্গে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিটেইলে চিত্ররূপময়। প্রথম প্রকাশনা হিসেবে শহীদ কাদরীর জীবনে উত্তরাধিকার এক মাইলফলক। এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠতর কবিতাগুলোর সংকলন মূলত তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা

শুরু থেকেই কবিতার প্রথাগত শৃঙ্খলের বাইরে থাকতে চেয়েছেন শহীদ কাদরী। তৃতীয় গ্রন্থ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই-এ তাঁকে কবিতার আঙ্গিকের ব্যাপারে মনোযোগী হতে দেখি। এখানে বোঝা যায়, কবিতার প্রকরণের বিবেচনায় তিনি একজন কুশলী শিল্পী। ছন্দ এবং বিষয়ের এক অপূর্ব সম্মিলনের মুখোমুখি হই আমরা এ-গ্রন্থে। এ-গ্রন্থে যেমন আছে গদ্যভঙ্গিতে লেখা ‘কেন যেতে চাই’, ‘একটা মরা শালিক’, ‘একটি ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের জার্নাল’ অথবা ‘অটোগ্রাফ দেয়ার আগে’র মতো কবিতা, তেমনি আছে ছন্দোবদ্ধ এবং সংহত মেজাজের ‘সঙ্গতি’, ‘শীতের বাতাস’, ‘চাই দীর্ঘ পরমায়ু’, ‘একটি দিন’-এর মতো মনোগ্রাহী রচনা। তৃতীয় বইয়ের কবিতাগুলোর সার্বিক পর্যালোচনা থেকে মনে হয়, শহীদ কাদরী আদৌ কোনো ‘নাগরিক কবি’ নন। যে-কোনো খাঁটি কবির মতো বৃহত্তর মানবজীবনকেই রাখেন তিনি তাঁর কবিতা-ভাবনার পটভূমি হিসেবে। তাঁর মনোভুবনে আলোড়ন তুলে যাচ্ছে সমসময় এবং বিভিন্ন সামাজিক ও দৈনন্দিন বাস্তবতা। বেশ কিছু রচনায় ব্যক্তিগত বিষয়াদিও পরোক্ষভাবে ছায়া ফেলে যায়। সুপাঠ্য এবং মনে রাখার মতো কয়েকটি প্রেমের কবিতা আছে এ-বইয়ে। ঘুরেফিরে লিরিক বা গীতলতার দিকে কবিকে একসময় ফিরে আসতে হয়, এই সত্যকে কাদরী কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই-এ অল্প-বিস্তর উপলব্ধি করেন বলে ভাবতে পারি আমরা।

২০১৫-এর ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় শহীদ কাদরী-নীরা কাদরীর বাসায় চার-পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী এক অমত্মরঙ্গ ঘরোয়া আড্ডায় থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। শহীদ কাদরী তখন পুরোপুরি হুইলচেয়ারবন্দি। নিজ থেকে চলাফেরা করতে পারেন না, সপ্তাহে তিনদিন কিডনি ডায়ালিসিস করাতে হয় তাঁকে – অপার মমতায় সেবাশ্রম্নশ্রূষা করে যাচ্ছেন স্ত্রী নীরা। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, শহীদ কাদরী চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর মন, ভাবনা-জগৎ পুরোপুরি সজাগ ও সচল। দেশের নানা ধরনের সংকট নিয়ে সারাক্ষণ বিচলিত থাকেন তিনি। একই সঙ্গে ভারত উপমহাদেশ এবং বিশ্বরাজনীতির সর্বশেষ পরিস্থিতিও তাঁর নখদর্পণে। শুভবুদ্ধি এবং মানবিক মূল্যবোধের ক্রমাগত পরাজয়ে তিনি আতঙ্কিত। তিনি বলছিলেন বারবার, এক গভীর অমানিশায় তলিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর বড় একটি এলাকা। গুটিকয়েক নগরকেন্দ্রিক অঞ্চলে কেবল আলোকবিন্দু দেখা যায়। আর সব নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢাকা।

এসব ভাবনা ও পর্যবেক্ষণ শহীদ কাদরীর শুরু হয়েছিল তাঁর প্রবাস-জীবনের শেষ অধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রে আসার পরপরই। পুরোপুরি ব্যাধিক্লিষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ক্রমশ শানিত এবং স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে ব্যক্তিগত জীবন, সমসময় ও সমগ্র মানবজাতি নিয়ে তাঁর নানামুখী উপলব্ধি। তৃতীয় গ্রন্থ প্রকাশের একত্রিশ বছর পর ২০০৯-এ বেরোয় কবির আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও। এ-বইয়ের প্রায় সব কবিতা আমরা ধরে নিতে পারি মার্কিন মুলুকে লেখা। আশ্চর্যজনকভাবে সমাজ-সভ্যতা এবং স্বদেশ নিয়ে তাঁর নিজস্ব ভাবনাগুলোর বীজ রোপিত হয় জীবনের এই পর্ব থেকে তাঁর আমেরিকা-বাসের পর্যায়ে। জীবনের এই পর্ব থেকে ২০১৬-তে মৃত্যুর আগ পর্যমত্ম শহীদ কাদরীর মনোরসায়নে ক্রিয়াশীল ছিল মানুষ এবং অনুকূল ও বৈরী উভয় প্রেক্ষাপটে তাঁর অবস্থান। জীবনের অপেক্ষাকৃত কোমল বিষয়গুলো – যেমন প্রেম ও প্রকৃতির উলেস্নখযোগ্য উপস্থিতিও লক্ষ করা যায় তাঁর চতুর্থ গ্রন্থে। তবে এসব অভিজ্ঞতাকে বিবেচনা করতে হবে অবশ্যই এই চিমত্মা মাথায় রেখে যে, কবি তখন প্রবাস-জীবনযাপন করছিলেন। ছিলেন মাতৃভূমি থেকে
বিচ্ছিন্ন।

দীর্ঘ তিন দশক বিরতির পর শহীদ কাদরীর প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই নিয়ে পাঠকের আগ্রহের শেষ ছিল না। শহীদ কাদরীর কবিতার সঙ্গে দীর্ঘকাল যাবৎ পরিচিত অনেকে নতুন বইটিতে তাঁদের চেনা কবিকে খুঁজে পাননি। ঢাকাকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনের হালকা রেশও দেখি না আমরা এ-বইয়ে। অজস্র বিষয়, ঘটনাস্রোত, চিত্রাবলি ও মেসেজসংবলিত এর কবিতাগুলো বিশুদ্ধ অর্থে বৈচিত্রময়। পুরোপুরি মার্কিনি আবহে রচিত বেশ কিছু কবিতা আছে এখানে – যেমন ‘শীতরাত্রির স্বপ্ন’, ‘প্রবাসের পঙ্ক্তিমালা’, ‘কবি’ ইত্যাদি। এখানে বৈশ্বিক পটভূমি জুড়ে রয়েছে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অমিত্মম সংকট নিয়ে কবির হতাশা এবং উদ্বেগ। শ্রেণিহীন সমাজের জন্য, একটি কল্যাণময় মানবসমাজের জন্য তাঁকে আমরা উন্মুখ দেখি অনেক কবিতায়। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অমত্মর্কলহ ও স্ববিরোধিতা এবং অবশেষে এর ক্ষয়ের প্রক্রিয়ার সূচনা কবিকে সংগত কারণেই এক বড় ধরনের বিভ্রামিত্মর দিকে ঠেলে দেয়। চতুর্থ গ্রন্থে তাই হয়তো শহীদ কাদরীকে দেখা যায় তিনি বিপরীতমুখী স্রোতের মিশ্রণ থেকে সৃষ্ট এক ঘূর্ণাবর্ত থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় খুঁজছেন। তা তিনি খুঁজে পানও। ফেলে আসা স্বদেশের জন্য স্মৃতিকাতরতা, নিজস্ব বিশ্বাস ও দর্শনের বিশেস্নষণ এবং জীবনের বন্দনার ভেতর কবি পরিত্রাণের পথ খুঁজে পান হয়তো। আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও-এ শহীদ কাদরী একাধারে প্রাঞ্জল এবং দুরূহ। এখানে তাঁর কবিতার প্রকরণও ভিন্নতর।  বিবৃতিমূলক ভঙ্গিতে লেখা নাতিদীর্ঘ কবিতা যেমন আছে এ-গ্রন্থে, তেমনি আছে সুসংহত এবং মিশ্র ছন্দে লেখা সুললিত লিরিকও। আবার কিছুটা এলোমেলো এবং বিক্ষেপ্তও মনে হয় তাঁকে কোনো-কোনো কবিতায়। এটা অবশ্য বড় বিষয় নয়। যে-ব্যাপারটি বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য, চতুর্থ বইয়ে শহীদ কাদরীর অজামেত্মই তাঁর কবিতার বড় ধরনের এক পালাবদল অবয়ব নিচ্ছিল। ঠিক যেন এর পরপরই ফের ছেদ পড়ে তাঁর লেখায়। ধীরে-ধীরে বয়সের ক্লামিত্ম, নৈঃসঙ্গ্য, স্বদেশের জন্য নিষ্ফল আকুলতা এবং সবশেষে ব্যাধির থাবা – এ সবকিছুই তাঁর কবিতার পথে দুর্ভেদ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। লেখা প্রায় ছেড়েই দিলেন শহীদ কাদরী। বা ছাড়তে বাধ্য হলেন। অথবা অনেক বড় কবির ক্ষেত্রে যা হয়, চারখানা গ্রন্থই ছিল হয়তো তাঁর ভবিতব্য।

চারটি বই এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত কিছু কবিতা নিয়েই বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকার জন্য তিনি হয়তো জন্মেছিলেন। আধুনিক ফরাসি কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ জ্যঁ আর্তুর র্যাঁবো মাত্র একখানা বই নিয়ে বিশ্বকবিতায় বেঁচে আছেন। আধুনিক বাংলা কবিদের প্রধান পুরুষদের অনেকের বইয়ের সংখ্যা হাতেগোনা। বড় কবি তো বটেই, শহীদ কাদরী বাংলা কবিতায় একজন বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবেও টিকে থাকবেন। অজস্র মিথের কুয়াশাজাল থেকে বের করে এনে কবি শহীদ কাদরীর সৎ পর্যালোচনা জরুরি। কিংবদমিত্মর আলো-আঁধারি কবির মূল সত্তাকে আড়াল করে রাখে অনেক সময়। শেষ পর্যমত্ম কবিতাই কবিকে বাঁচিয়ে রাখে। নির্মম সময় আর সব পরিচয় মুছে দেয়।