শাঁখ-মাজা ডানা

শিহাবের এবারেরটা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো কক্সবাজার যাওয়া। সে প্রথমবার এসেছিল তার বিয়ের পরপর। নতুন বউকে নিয়ে। সেই জার্নির প্রথম পর্বটা ছিল সারারাত ট্রেনে। ঢাকা-চট্টগ্রাম। পরে পাবলিক বাসে। তবে ব্যক্তিগত কারে আসা-যাওয়ার দলে সে কোনোদিন পড়েনি।

দ্বিতীয়বার শিহাব এসেছিল অফিসিয়াল ট্যুরে। সরকারি খাদ্য অধিদপ্তরের অডিট টিমের সঙ্গে। তার সঙ্গে ছিল তার বস ঊর্ধ্বতন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। সর্বমোট ছয়জনের টিম। বিভাগীয় প্রধান তার বিভাগের জন্য নতুন কেনা লাক্সারি মাইক্রোবাসটি দিয়েছিল। কেননা, অডিট টিমের যাতায়াত সমাদর না করতে পারলে আখেরে হিসাব-নিকাশের গরমিল বের হয়। হোটেল আগ্রাবাদে এক রাত কাটিয়ে সকাল সকাল রওনা দিয়েও দীর্ঘ জিকজাক রোড ধরে কক্সবাজারে পৌঁছতে প্রায় বেলা এগারোটার মতো বেজে গিয়েছিল। তারা সবাই তাদের জন্য বরাদ্দ কলাতলীর বিশেষ গেস্ট হাউসে যেতে যেতে শিহাব সাগরের সফেন উত্তাল ঢেউয়ের পরে ঢেউ দেখে প্রথমবারের মতোই আকৃষ্ট হয়। আনন্দিত হয়। সে দেখে ওপরের দিকে নীল আকাশে নিশ্চল ভেসে থাকা গাংচিলও। তা তাকে আনমনা করে। আর তখন তার প্রিয় কবিতাটির পঙ্ক্তিমালা ‘শাঁখ-মাজা ডানা মেলে…।’ মনে পড়ে যেতে থাকে।

প্রথমবার এসেও এই লাইন কয়টি তার মনের গহিনে অভিনব এক সুরের দ্যোতনা জাগিয়ে তুলেছিল। আর তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল অরুণীমা সেনের নিবিষ্ট হয়ে ক্লাস করার দৃশ্য। এই দৃশ্য তাকে বরাবরই দারুণ আকৃষ্ট করত। বিশেষ করে তার অনিন্দ্যসুন্দর হাতদুটি। শিহাব ক্লাসে অরুণীমার পাশ থেকে কায়দা করে এমন এক অ্যাঙ্গেলে বসতো যে, তার কয়েকটা সোনার চুরির মাঝে শাঁখার দুটি শুভ্র সাদা বালা ঝলমলে হয়ে থাকতো। তাদের সেই কমন ক্লাসগুলোতে শিহাবের ক্লাস-লেকচারের প্রতি কোনো মনোযোগ ছিল না। তখন তারা জগন্নাথ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে সে অরুণীমাকে আর পায়নি। শুনেছে, সে কলেজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল অন্য কোথাও। কিন্তু তার সেই শাঁখা-পরা হাত সে ভুলতে পারেনি পনেরো-ষোলো বছর পরেও।

সেদিন জোয়ারের টান আসেত্ম আসেত্ম কমে গিয়ে ভাটির টান এসে গেলে সাগরের রূপও বদলে যেতে থাকে। তখন শিহাবের খেয়াল হয়েছিল, রিকশায় তার পাশে বসে আছে তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী কুলসুম। তখন সে তার অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার খোলস থেকে বেরিয়ে বউয়ের সঙ্গে হালকা
একথা-সেকথা বলে। তারা সেদিন এগিয়ে গিয়েছিল কলাতলী ছাড়িয়ে তাদের অফিসিয়াল গেস্ট হাউসের দিকে। কুলসুম উৎফুলস্ন হয়ে বলেছিল, ‘তাই বলে সাগর এতো বড়, এতো সুন্দর।’ শিহাব বলেছিল, ‘এর কত যে রূপ। ক্ষণে ক্ষণে তা বদলায়।’

‘শাঁখ-মাজা ডানা মেলে…।’ শিহাব এই মোহমুগ্ধকর কবিতার পঙ্ক্তিমালার সন্ধান পেয়েছিল পথেঘাটে হাঁটতে হাঁটতে। তখন সে জগন্নাথ কলেজ থেকে এমএ ডিগ্রির পাঠ চুকিয়ে বেরিয়েছে। চাকরির সন্ধান করতে সকাল সকাল বেরিয়ে অ্যাড সংগ্রহ করে। একটা পত্রিকা কিনে তেমন সুবিধা হয় না দেখে সে ঢাকার উলেস্নখযোগ্য বাংলা-ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাগুলোর অফিসে অফিসে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। তখনকার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী অফিস একটি পুরো পত্রিকা বাইরের নির্দিষ্ট জায়গায় এঁটে দিতো। এতে কৌতূহলী স্থানীয় গরিব পাঠক ও পথচারীদের সুবিধা হতো। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকাটি দেখে নিত।

শিহাব নিয়মিত উলেস্নখযোগ্য কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা অফিসে হানা দিত। সঙ্গে থাকতো খাতা-কলম। চাকরি-বাকরির অ্যাড পেলেই টুকে নিত এবং সময় করে সেসব অফিসে গিয়ে হানা দিতো। সেখান থেকে সে অ্যাপিস্নকেশন ফরম ও অন্যান্য নিয়মকানুন জেনে নিতো। আর চলতে-ফিরতে সে রাস্তার ধারের পুরনো ম্যাগাজিন-বইপত্রের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেসব হাতিয়ে দেখতো। পছন্দ হলে দামদরও করতো। পড়ে সময় কাটানোর মতো কিছু পেয়ে গেলে কম পয়সায় কিনে ফেলতো। সময় সময়। একদিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত পুরনো একটা মাসিক পত্রিকা উলটিয়ে-পালটিয়ে দেখছিল শিহাব। তখন কবিতা ছাপানোর বিশেষ অংশে ‘সাগর থেকে ফেরা’ নামটা তার নজরে পড়ে। ড্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিহাব কবিতাটি পড়ে। দু-চারটা ছত্র তাকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে। পত্রিকাটি দামদর করতে গেলে দোকানদার আট-আনা দাম চায়। শিহাব চার-আনা বললে, দোকানি আগ্রহী হয়ে তাকে তা দিয়ে দেয়। যেন আপদ বিদায়।

মাসিক পত্রিকাটি হাতে নিয়ে শিহাব প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘সাগর থেকে ফেরা’ কবিতাটি আবার পড়তে শুরু করে ‘সাদা ফেনা থেকে যেন শাঁখ-মাজা ডানা মেলে’… পরের লাইনটা শেষ না করে থমকে দাঁড়ায় শিহাব। সে চলে যায় চার-পাঁচ বছর আগেকার তার প্রথম বর্ষের কোনো এক সময়ে। নিবিষ্ট হয়ে ক্লাস করছে অরুণীমা সেন। তার হাতে শাঁখার চুড়ির ঝলমলে শুভ্র আভা ছড়িয়ে আছে। সেদিন শিহাব আনমনা হয়ে কতটা পথ হেঁটেছিল সে বলতে পারবে না। গাজীপুরে তার বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। বাবা দুশ্চিন্তা করছিলেন। বাবাকে একথা-সেকথা বলে কাটানো যায়। মা বেঁচে থাকলে হয়তো পারা যেত না।

শিহাবের তৃতীয়বার এই সাগরপাড়ে আসার বড় আকারের সুযোগ হয় অধিদপ্তরের বার্ষিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। এর আগে ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত হেড অফিসের সীমানা ছাড়িয়ে এমন সম্মেলন হয়নি কোনোদিন। এর পেছনে কাজ করছিল দুটি কারণ। প্রথমটা ডাইরেক্টর জেনারেল ইমতিয়াজ আহমেদ উনত্রিশ বছর একনিষ্ঠ সততা ও মেধা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের সেবা করেছেন। আগের তুলনায় এ-অফিসকে অনেক সক্রিয় করে তুলেছিলেন। তিনি অবসরে যাবেন আগামী ফেব্রম্নয়ারির শেষাশেষি। তাই তার বিদায় উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পরবর্তী পর্যায়ের অফিসার-কর্মচারীবৃন্দের সক্রিয় উদ্যোগে তা কক্সবাজারে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সাতদিনের আয়োজন। তবে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এই আপত প্রমোদভ্রমণকে জায়েজ করা কঠিন হবে বলে তারা এর নামকরণ করে, ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব প্রেজেন্ট স্কোপস অ্যান্ড লিমিট অব গেস্নাবাল ফুড ক্রাইসিস উইথ স্পেশাল কনটেক্সট টু বাংলাদেশ।’

শুধু আকর্ষণীয় আন্তর্জাতিক সমাবেশের নাম দিলেই তো সব হয়ে যায় না। সমাবেশ বাস্তবায়নের জন্য চাই ভারী অর্থায়নের যোগ। সেটা দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান না। এসব ক্ষেত্রে সচিবরা খুঁটিনাটি তলিয়ে দেখেন। সংশিস্নষ্ট অধিদফতরের উৎসাহী অফিস-কর্মচারীদের ব্যাপারটা জানা। তাই তারা এসব ক্ষেত্রে দু-চারটা বিদেশি অতিথিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। এখানে তাই হলো। বিশেষ করে ইউএসডির দুজন প্রবীণ বিজ্ঞানী এবং ব্রাজিল ও সিয়েরালিয়নের খাদ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মচারী বাংলাদেশে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এছাড়া দেশীয় কৃষি বিশেষজ্ঞরা তো আছেনই। তারাও আসবেন। সব মিলিয়ে খাদ্য অধিদপ্তর যখন ভারী ফাইলটি মন্ত্রণালয়ে পাঠায়, তখন সচিব মহোদয়গণ সংযুক্ত বিদেশি-দেশি চিঠিপত্র দেখেন। দু-একজনের মন্তব্য চালাচালির পর অর্থায়নের অনুমতি দিয়ে দেন। আর তখন থেকে এই আন্তর্জাতিক খাদ্য সম্মেলনের কাজ শুরু হয়ে যায়। এর প্রস্ত্ততিপর্বের পস্ন্যান অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে চারজনের টিম স্থলপথে কক্সবাজার চলে যায়। চারদিন আগে। আর ডিজিসহ অন্য চারজন ভিআইপি অফিসার সরাসরি বিমানে রওনা দেন কনফারেন্সের আগের দিন। সেই দলে সিনিয়র অফিসার যূথিকা মিত্র, শিহাব সরকারও ছিলেন। দুজন পরিচালক রয়ে গেলেন ঢাকায়। বিদেশি অতিথিদের রিসিভ করে তারা আসবেন। বিমানে ডিজির পাশে বসেন যূথিকা। শিহাব দেখেন যূথিকা বাঁ-হাতটা তার সিটের বাঁ-পাশের হাতলে আলগোছে ফেলে রাখা। আর তাতে শোভা পাচ্ছে কয়েকটা সোনার চুড়ির মাঝে সুন্দর শুভ্র একটা শাঁখার বালা। শিহাব তখন আনমনা হয়ে চলে যায় পনেরো-ষোলো বছর আগেকার জগন্নাথ কলেজে এক বিশেষ ক্লাসরুমে, যেখানে অরুণীমা তার সুচারু হাত বেঞ্চে মেলে রেখে নিবিষ্ট মনে ক্লাস লেকচার শুনতো।

ঢাকা-কক্সবাজারের ইন্টার্নাল ফ্লাইট আধঘণ্টার মতো। তাও চট্টগ্রামের অপেক্ষমাণ যাত্রী ওঠানো নিয়ে। বিমান থেকে নেমেই তারা তাদের জন্য অপেক্ষায় থাকা স্থানীয় অফিসের দুজন প্রশাসনিক কর্মচারীকে দেখতে পান। কর্মচারী দুজন হন্তদন্ত হয়ে প্রায় ছুটে এসে ডিজি সাহেবের হাতব্যাগ নিয়ে নেয়।

‘আসেন স্যার। আমাদের মাইক্রোবাসও রেডি।’ গাড়িতে উঠেই ডিজি সাহেব তাদেরকে এখানকার কনফারেন্সের সার্বিক প্রস্ত্ততি নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন করতে থাকেন। তারাও সাধ্যমতো উত্তর দিয়ে যেতে থাকে। এই জওয়াব-সওয়ালের এক পর্যায়ে ডিজি সাহেবের টার্গেট গ্রম্নপ বদলে যায়। এবার ঢাকা থেকে তার সঙ্গে আসা সদস্যদের নিয়ে পড়েন।

‘যূথিকা-শিহাব … সবাই তোমরা মনে রাখবে এটা সাধারণ কোনো সমাবেশ নয়। এটা এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। এতে যোগ দিচ্ছে আমেরিকাসহ কয়েকজন নামিদামি খাদ্যবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ। তাদের যথাযথ আদর-যত্নই শুধু নয়। তাদের জ্ঞান-গরিমার সঙ্গে আমাদেরও হতে হবে যথেষ্ট বিচক্ষণ ও সাবধানি। অর্থাৎ তাদের সামনে আমরা যেন না হয়ে যাই আনাড়ি। অনভিজ্ঞ কর্মী।’

একটু থেমে আবার বলে যান ডিজি সাহেব।

‘বুঝেছ যূথিকা, আমাদের পরিস্থিতি যথেষ্ট নাজুক। এর ওপরই নির্ভর করছে আমাদের অনেক কিছু … প্রজেক্ট, অর্থ বরাদ্দ … ফেলোশিপ-ট্রেনিং ইত্যাদি।’

যূথিকা-সালমান সায় দেয়।

‘জি স্যার … এটা সত্য।’ শিহাবও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

তিনি আরো বলেন, ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার সাহেব … আপনারা সম্পূর্ণ ফুরসত হয়নি তো? আমরা মোটেলে গিয়েই কাজে বসে যাব। অনেক কাজ …।’

পরিস্থিতি আন্দাজ করে উপস্থিত সবাই এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। সবাই বুঝে নেয়, এটা নিছক প্রমোদভ্রমণ নয়। সাগরপাড়ে হাওয়া খাওয়া নয়। হি মিনস বিজনেস।

এতক্ষণে শিহাব বুঝতে পারে বসের কথার তোড়ে এয়ারপোর্ট থেকে কলাতলী ছাড়িয়ে মোটেলের দীর্ঘ পথজুড়ে বরাবরের মতো সাগরের উচ্ছল অপরূপ শোভা দেখার ফুরসত হয়ে ওঠেনি তার। ফুরসত হয়নি ‘আনমনা হাসির শামিল’ নীল আকাশের নিচে জলে ভাঙাচোরা ছায়া ফেলে ভেসে থাকা গাংচিল দেখার।

হোটেলে পৌঁছে যে যার মতো গুছিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে হালকা বিশ্রাম নিয়ে আজকের প্রোগ্রাম অনুযায়ী সবাই এখানকার খাদ্য অধিদফতরের শাখা অফিসের হলরুমে জমায়েত হয়। ডিজি সাহেব আসেন সামান্য পরে। সিনিয়র অফিসাররা যার যার ফাইলপত্র নিয়ে তার দুপাশে কাছাকাছি বসে যান। বিদেশি অতিথিরা আসবেন আগামীকাল। তারা সর্বমোট তিনদিন থাকবেন এখানে। প্রথম দুদিন তাঁরা সম্মেলনে থাকবেন। শেষের দিন পৃথিবীর দীর্ঘতম সমতল সাগরসৈকত উপভোগ করবেন। সেই উপলক্ষসহ কনফারেন্সের ভেন্যু সেশনের সভাপতি-বক্তা বাছাই, ফাঁকে ফাঁকে লাইট রিফ্রেশমেন্ট, খাওয়া-দাওয়া, বিদেশিদের জন্য বিশেষ পার্টি, কালচারাল ইভিনিং – সব বিষয়ের ওপর আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সবাই সিরিয়াস। এক ফাঁকে চা-বিস্কিট আসে। সভা চলে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। আসর ভাঙার আগমুহূর্তে ডিজি সাহেব কালচারাল উপ-কমিটিতে যূথিকার নাম জুড়ে দেন। ‘সে শো-তে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করবে।’

এ-সময় ডিজি সাহেব তার বার্ধক্যের দোহাই টেনে সভার কার্যক্রম শেষ করেন।

‘আর কত? কোন সকালে ওঠা অবধি বিশ্রাম নেই। আমি হোটেলে গিয়ে একটু নিরিবিলি হই। বাড়িতে ফোন করি। আর আপনারা
যার যার মতো সময় কাটান। সূর্য অস্ত যেতে শুরু করেছে।’ যূথিকা-সালমান আগ্রহ প্রকাশ করে।

‘তাই স্যার … সূর্যাস্ত দেখার সময় তো নাও হতে পারে। কনফারেন্স শুরু হয়ে গেলে … যা টাইট শিডিউল।’

শিহাব এমনি একটা কিছু আশা করছিল। সেও উৎফুলস্ন হয়।

ঢাকা থেকে আসা সাত-আটজন সবাই হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ায়। মাইক্রোবাসে চড়ে হোটেলের দিকে রওনা দেয়। সালমান নিজে থেকে নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে যায়।

‘হোটেলরুম থেকে অল্প সময়ের মধ্যে … বড়জোর দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে তারা বেরিয়ে পড়ে। যূথিকাকে সাজুগুজুর সময় দেওয়া যাবে না।’

যূথিকা বিব্রতবোধ করে।

‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তোমরা পারলে আমিও পারবো।’

কথামতোই তারা যার যার রুম থেকে বের হয়। বের হয় যূথিকাও শিহাবের লাগোয়া রুম থেকে। দেখা গেল অল্প সময়ের মধ্যেই যূথিকা মোটামুটি তার আঙ্গিক পালটে ফেলেছে। শাড়ি পালটে কামিজ-ঢোলা পাজামা। আর বদলে ফেলেছে তার চুলের ধরন। চুল বাঁধনছাড়া … ঘাড়ে-পিঠে ছড়ানো।

সূর্য ডোবার আগমুহূর্ত। সাগরের জলে ঢেউ বেড়েছে। গোলাকার উজ্জ্বল সূর্যের রক্তিম বলয়ের তীক্ষন রশ্মি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চারদিক উদ্ভাসিত করে তুলেছে। আর এরই মধ্যে ঠিক সাগর সীমানার শেষ রেখার কাছাকাছি মনে হলেও দূরত্বে উড়ে উড়ে উতলা হয়েছে গাংচিলের দল। এলোমেলো হয়ে উড়ছে।

সব বাধা … সব মহড়ার রেশ ডিঙিয়ে সূর্য একসময় সুড়ুত করে ডুবে গেল। কালো-লাল নোনাজলের গভীরে। সাগরপাড়ে জমে থাকা দর্শকের ভিড়ে হা-হুতাশের হই-হুল্লোড় জেগে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। চারদিকে অন্ধকার নামে। শুধু সামনের কালো অথই অন্ধকার জলে জেগে ওঠে কয়েকটি জেলে সাম্পানের লণ্ঠন-বাতি। নিঃশব্দ প্রহরীর চোখের মতো।

অল্প সময়ের মধ্যে সন্ধ্যালগ্নে জটলা-বাঁধা, দাঁড়িয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। যে যার মতো এদিক-সেদিক হয়। হেঁটে এগিয়ে যায়। আবার ফিরেও আসে। সোজাসুজি, না-হয় চক্রাকারে। পুরো সমাগম এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। সালমান-যূথিকাদের সামনেও তেমন কোনো নির্দেশনা নেই। তারাও ইতস্তত হাঁটে আর দশজনার মতো। শিহাব সাগরজলের তর্জন-গর্জন শোনে। আনমনা হয়ে এগোয়। কিছুটা সময় পার হলে সে টের পায় এই ছোট দলও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যূথিকা শিহাবকে ডাকে, ‘ওরা কোথায়?’

‘আমিও তো খুঁজছি।’

‘আসুন … এদিকে … আসুন।’

তারা কাছাকাছি হয়। তাদের সঙ্গে এসে জড়ো হয় অপেক্ষাকৃত জুনিয়র অফিসার মুসা ইরফান।

যূথিকা সমাধান দেয়।

‘সালমানদের খোঁজাখুঁজি করে সময় নষ্ট না করে আমরা বরং প্রোগ্রাম করি। শুনেছি সামনের দিকে কোথাও একটা নতুন বাজার হয়েছে। ঝিনুক মার্কেট। চলুন সেদিকে এগোই।’

সবাই তাতে সায় দেয়। তারা সেদিকে এগোতে থাকে।

ঝিনুক মার্কেটটা জমজমাট। জনসমাগমেরও কমতি নেই। দেশীয় পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশির সংখ্যাও কম নয়। তারা শেল-শঙ্খ, কোরাল পাথরের প্রাকৃতিক জিনিসপত্রের দোকানপাটের দিকেই বেশি ভিড় করে আছে। ঘুরেফিরে একসময় যূথিকা-শিহাবরাও এদিকেই আকৃষ্ট হয়। কাচের শো-কেসের ভেতরটা কাছ থেকে দেখায় আগ্রহী হয় যূথিকা। সে ঝুঁকে পড়ে শেল-ঝিনুক, নানা জাতের শামুক, প্রবাল পাথর দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তার বাঁ-হাত শোকেসের কাচের ওপর রাখা।

শিহাব মুগ্ধ চোখে যূথিকার সাদা শাঁখা পরা হাতটা দেখে। তার তখন সেই কলেজজীবনের শাঁখার চুড়ি পরা অরুণীমার কথা মনে পড়ে যায়। সে ভাবালু হয় খানিক।

যূথিকা দেখেশুনে একটা শঙ্খ কেনে। তা সে ফুঁ দিয়ে বাজিয়ে দেখে। আমাদের পর্ব-উৎসবে উলুধ্বনির সঙ্গে শঙ্খ না বাজালে বাড়ির অমঙ্গল হয়।

শিহাব সায় দেয়।

‘হ্যাঁ … সিনেমা-নাটকে তো তা দেখি। আমাদের গ্রামের পূজা-পার্বণেও শঙ্খধ্বনি শুনেছি অনেকবার।’

মুসা-ইরফানের এসবে তেমন আগ্রহ নেই। মুসা অন্য প্রস্তাব দেয়।

‘দিদি আসেন চটপটি খাই। হাঁটতে হাঁটতে কাহিল হয়ে গেছি।’

যূথিকা আগ্রহী হয়।

‘হ্যাঁ, আমি ফুচকা খাব।’

ঝিনুক মার্কেটের ট্যুরিস্টদের ভিড় কমতে কমতে রাতও বাড়ে। শিহাব সবাইকে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

‘আমাদের ফেরা দরকার … যেতে হবে অনেকদূর। কাল উঠতে হবে সকাল সকাল। অবশ্য রিকশায় গেলে তেমন সময় লাগবে না।’

যূথিকা বাধা দেয়।

‘রিকশায় কেন? হেঁটে যাব।’ তাকে রোমাঞ্চ-সন্ধানীর মতো শোনায়।

সবাই তখন মার্কেট চত্বর থেকে বের হয়ে তাদের হোটেলের দিকে হাঁটে। তা ঠিক সাগর বরাবর বালিপথ ধরে নয়। বালি-সীমানার ওপরকার কাঁচা-পাকা রাস্তা ধরে। শিহাব আড়চোখে দেখে, তার সহকর্মী নয়, ভরাদেহী এক আকর্ষণীয় রমণী হাঁটছে। দেহের কোমল ছন্দিল ভঙ্গিমার জানান দিয়ে।

রাত বাড়ছে। বাড়ছে সাগরজলে জোয়ার-ভাটার তর্জন-গর্জনও। তীক্ষন বাতাসের তোড় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সারি সারি ঝাউগাছে। আধো অন্ধকারে ঝাউবন দুলছে বেসামাল।

 

ফিরতে দেরি হলেও হোটেলে ডাইনিং হলের আয়োজনে নিয়োজিত বেয়ারারা পাহারায় ছিল। তারা জানে, সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে এলে কারো রুটিন ঠিক থাকবে না। এটাই নিয়ম। যূথিকা-শিহাবদের দেখে তারা ঝটপট এগিয়ে আসে।

‘আসেন স্যার … হাতমুখে পানি দিয়ে নেন। বাতাসে তো খালি বালু।’

রাতের খাবার সেরে তারা যার যার রুমের দিকে এগোয়। মুসা-ইরফানের রুম দোতলায়। আর যূথিকা-শিহাবের রুম চারতলায়। তাদের পাশাপাশি রুম। যূথিকা তার রুমের তালা খুলে ভেতরে চলে যেতে যেতে বলে,

‘এ-সময় এক কাপ গরম গরম চা হলে মন্দ হতো না। আমি ক্লান্ত … এতো পথ হাঁটিনি তো।’

শিহাব ঘর খুলতে খুলতে যূথিকার কথা শোনে।

‘কী বললেন? চা … এই রাতে। বলেন যদি চেষ্টা করে দেখি।’ শিহাব নিচে নেমে যায়।

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে শিহাব ফিরে আসে। তার দুহাতে দুকাপ চা। গরম গরম ধোঁয়া উঠছে। যূথিকার ঘরের দরজা ভেড়ানো। সে মনে হয় টের পেয়েছে। দরজা মেলে দেয়।

‘ও, আপনি এসে গেছেন … সফল … এতো রাতে!’

‘হ্যাঁ, বাবুর্চিরা শুয়ে পড়েছিল। এক ছোকরা বাবুর্চিকে ঘুষ দিয়ে তুলেছি।’

‘তাই বলে এতো কষ্ট করে … না হলেও চলত।’

‘নাহ … এখন মনে হচ্ছে, আমারও চায়ের পিপাসা …।’

ডান হাতের কাপটা যূথিকার হাতে তুলে দেয় শিহাব।

‘থ্যাংকস’।

ঘরে পাতা টেবিল-চেয়ার দূরে দূরে। তারা পাশাপাশি বিছানায় বসে চায়ের পেয়ালা মুখে তোলে। আর তখনই শিহাব দেখে যূথিকার সুডৌল সুন্দর হাত। হাতে স্বচ্ছ-কারুকাজে ভরা শাঁখার চুড়ি।

অন্ধ এক দেহজ প্রলোভন শিহাবকে টেনে নিয়ে চলে। এর সীমারেখা ধরে রাখার মতো অবস্থা তার ছিল না। যূথিকার হাতটা আলতো ছুঁয়ে সে মোহগ্রসেত্মর মতো তার ওপরের দিককার বাহুমূলের দিকে এগোতে গেলে সে আচমকা উঠে দাঁড়ায়। সজোরে এক চড় কষিয়ে দেয় শিহাবের গালে।

‘এক্ষুনি বেরিয়ে যান … অসভ্য কোথাকার …।’ রাগে ফেটে পড়ে যূথিকা।

‘কালই আমি ডিজিকে বলব, আমি ঢাকা চলে যাব … এই অসভ্যদের মেলে …। তখন দেখবেন …। আমি দেখব আপনার চাকরি কীভাবে থাকে?’

শিহাবের মুখের ওপর সশব্দে দরজা লাগিয়ে দেয় সে। ভেতর থেকে সজোরে ছিটকিনি আটার শব্দ হয়।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় কাকুতি-মিনতি জানাতে থাকে শিহাব।

‘দেখুন … আমি ভুল করেছি … আমি অপরাধী … আমি ভীষণভাবে লজ্জিত। আমায় ক্ষমা করুন। আমি মাফ চাইছি…!’

কিন্তু কোনো ফল হলো না। অগত্যা শিহাব ঘরে ফিরে আসে। মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে থাকে। ঘরে বাতি জ্বালাতেও ভুলে যায় সে। চারপাশে তায় ভর-আতঙ্কের অক্টোপাস যেন তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। সে জানে, তার সার্ভিস রেকর্ড খুব একটা ভালো নয়। আগামী তেরো-চৌদ্দ বছরে সে পেনশনে যাবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যদি তার পার্সোনাল ফাইলে একবার লাল কালির দাগ বসিয়ে দেয় … আজ যে তা করার মতোই এক কাজ করে বসেছে সে। তার যে উপায় নেই। পেনশন কেন তার যে চাকরিও যেতে পারে। তাহলে সে তার পরিবার নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ভাড়া বাসায় থাকে সে। বড় মেয়েটা স্থানীয় স্কুলে নাইনে পড়ে। সে লেখাপড়ায় ভালো। ছেলেটা ফাইভে। স্ত্রী স্থায়ী ঘাড়ের ব্যথায় আক্রান্ত। দেশেও তেমন কিছু নেই।

শিহাব চোখের সামনে অন্ধকারের সাগর দেখে। তার যা মনে হলো, যূথিকা কমপেস্নইন করবে। ডিজি সাহেবও একরোখা মারমুখী মানুষ, আর সে ভাবতে পারে না। তার মাথা কাজ করছে না। সে হাত দিয়ে কপাল চাপড়ায়। এমন কাজ কেমনে…। এদিকে ফজরের আজান পড়ে। শিহাব টের পায় একইভাবে সে বসে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সে উঠে দাঁড়ায়। পায়চারি করে খানিক। আর ভাবার চেষ্টা করে, যূথিকা ভোরে ঘর থেকে বের হলেই তার পায়ে পড়বে সে … ‘আমাকে বাঁচান। আমাকে আপনি শাস্তি দিন … বড় সাহেবদের বলবেন না … পিস্নজ …।’

এছাড়া যে তার আর কোনো উপায় নেই।

শিহাব দরজা ফাঁক করে ওতপেতে থাকে। সে জানে, আজ ব্রেকফাস্ট সকাল ৭টায়। কনফারেন্স উদ্বোধন সকাল ৯টায়। সেই সেশনে স্থানীয় ডিগনিটরিজরাও থাকবেন। সে দ্রম্নত আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে বিধ্বস্ত দেখায়। সে ঝটপট হাতে-মুখে পানি দিয়ে চুল পরিপাটি করে নেয়। কাপড়-জামা সামান্য গোছগাছ করে।

তাড়াতাড়ি আবার ফিরে আসে। দরজার ফাঁক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘড়ি দেখে। যূথিকা বের হবে। সাতটা বাজতে খুব একটা দেরি নেই। তার এই বিশ্রী পরিস্থিতিটির কথা মনে হলে তার কান্না পেতে চায়। মুহূর্তের ভুলে কী একটা অবস্থায় পড়ে গেছে সে? এর থেকে পরিত্রাণের উপায় যে তার জানা নেই। আর তখনই যূথিকার ঘরের ছিটকিনি খোলার শব্দ হয়। সে ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে ঝটপট হিল-জুতার টুক-টাক শব্দ তুলে হেঁটে গিয়ে সিঁড়ি ধরে। লিফটের জন্য অপেক্ষা করে না। শিহাব টের পায়, তাকে উপেক্ষা করার জন্যই তার এ-ব্যবস্থা। এরপরও শিহাব যূথিকার পিছু ধরে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে অনুনয়-বিনয় করার চেষ্টা করে।

‘দেখেন … দেখেন … আমি অপরাধ করেছি। আমায় ক্ষমা করুন … অফিসকে জানাবেন না …। আমায় মাফ …।’

যূথিকা শিহাবকে একেবারে উপেক্ষা করে নিচতলায় ডাইনিং হলে চলে যায়। শিহাব হলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। যথেষ্ট ভীত-বিচলিত হয়ে সামান্য পায়চারি করার চেষ্টা করে।

বিভাগীয় কর্মচারীরা একে একে ডাইনিং হলে এসে জড়ো হয়। একসময় শিহাবও শরিক হয় সবার সঙ্গে।

ডিজি সাহেব আসেন বিদেশি অতিথিদের নিয়ে। তারা নির্দিষ্ট জায়গায় আসন গ্রহণ করেন। এর উলটোদিকের আসনে যূথিকা বসেছে। ডিজি তাকে কাছে ডেকে অতিথিদের পাশে বসান। এ অবস্থায় শিহাবের হাত-পায়ে কাঁপুনি ধরে। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ৯টায়। স্থানীয় ডিগনিটরিজরাও এতে যোগ দেন। যূথিকা ঘোষিকার আসনে। ডিজি সাহেব অবস্থা বুঝে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন।

কনফারেন্সকে কেন্দ্র করে যূথিকার ডিজির কাছাকাছি অবস্থানকে শিহাব ভয়ের-আতঙ্কের চোখে দেখতে থাকে। সে ভাবতে শুরু করে, এমনি এক পরিস্থিতিতে হয়তো যূথিকা গতরাতের ঘটনাটা ডিজির কানে দিয়ে দেবে। আর তার জীবনে নেমে আসবে ভয়ংকর এক বিপর্যয়। এ পরিস্থিতিতে কত কী না হতে পারে। তাকে হয়তো ডিজির এক ভার্বাল অর্ডারে তৎক্ষণাৎ ঢাকায় চলে যেতে হবে।

শিহাব কক্সবাজারে আসার সময় যথেষ্ট উৎফুলস্ন হয়েছিল। সমুদ্র দেখার সাধ তার বরাবরের। কিন্তু পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের বক্তৃতা-কথোপকথন শোনার সুযোগ ও সাগর উপভোগ করার কোনো পরিস্থিতিই যে তার আর রইল না। শুধু ভীত-চকিত হয়ে যূথিকার গতিবিধি, কারো সঙ্গে তার কথাবার্তা অনুসরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে থাকে।

অডিটরিয়ামভর্তি বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী-অতিথি-শ্রোতা। সবাই যার যার মতো নিমগ্ন, মনোযোগী হয়ে আছে। কেউ কেউ আলোচনায় যোগদান করছে। কেউ কেউ প্রশ্ন রাখছে বক্তার কাছে। অথচ শিহাব এসবের কিছুতে যোগ দিতে পারছে না। মনোযাগ দিতে পারছে না। চারপাশে তার শুধু এক ভয় – যূথিকা। গত রাতের তার কথাগুলো কেবলই তার চারপাশে যেন আস্ফালন করছে … ‘দাঁড়ান কালই আপনাকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি … ডিজিকে বলে। অসভ্য কোথাকার…।’

কনফারেন্সের তিনদিন কেটে যায়। যোগদান করা বিদেশিরা আগামীকাল সকালে চলে যাবে। রাতে গ্র্যান্ড পার্টি হয়। দেশি-বিদেশি খাবার, স্থানীয় ঋতুর বাহারি ফল … সব জোগাড় করা হয়। পার্টি সফল করার প্রচেষ্টার কোনো ত্রম্নটি ছিল না। অধিদফতরের সবাই ব্যস্ত। ছোটাছুটি করছে। ডিজি-যূথিকা আলাপ-পরামর্শ করছেন সারাক্ষণ।

খাওয়া-দাওয়ার পর স্টেজের পর্দা ওঠে। যূথিকার হাতে মাইক্রোফোন। সে প্রথমে ইংরেজিতে বিদেশি অতিথিদের উদ্দেশে লিখিত স্বাগত ভাষণ দেয়। সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিরও একটা ধারণা উপস্থাপন করে।

বক্তব্য শেষ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে চারদিক থেকে সমাবেত যন্ত্রসংগীত বেজে ওঠে। আর সঙ্গে সঙ্গে স্টেজের দুদিক থেকে সুসজ্জিত নাচিয়ের দল ছন্দিল মোহময় অঙ্গভঙ্গিতে উজ্জীবিত করে তোলে পুরো অডিটরিয়াম।

একের পর এক প্রোগ্রাম চলতে থাকে। ঘোষিকা যূথিকারও আগমন ঘটে বারবার। সে আজ ট্র্যাডিশনাল শাড়ি ও বাঙালি সাজে সেজেছে। বিদেশি অতিথিদের এটাও তো এক দেখার বিষয়। পুরো আয়োজনে অতিথিরা মন্ত্রমুগ্ধ। খাদ্য অধিদপ্তরের ডিজি ও সিনিয়র কর্মকর্তারা আহ্লাদিত।

গান-বাজনার প্রতি বরাবর শিহাবের নিখাদ আকর্ষণ। কিন্তু আজ কোনোকিছুতে তার মনোযোগ দেওয়ার জো নেই। সে সচকিত-আতঙ্কিত। তার মাথার ওপর যে খড়্গ ঝুলে আছে।

অনুষ্ঠান চলে দীর্ঘ সময় ধরে। মাঝে মাঝে ওয়ান মোর … ওয়ান মোর আবেদনও আসে শ্রোতা-দর্শকদের মধ্য থেকে।

অনুষ্ঠান শেষ হয়। মেহমানদের এগিয়ে নিয়ে যায় ডিজি ও অন্যরা। এ-দলে যূথিকাও আছে। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাদের সম্মান জানায়। শিহাব ছিল শেষের রোয়ের এক পাশে। গেস্টদের নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল ডিজি বেরিয়ে যেতে যেতে শিহাবকে দেখে বলেন, ‘শিহাব সাহেব আগামীকাল নাশতা খেয়ে আমার সঙ্গে একবার দেখা করবেন … কনফারেন্স শুরুর আগেই।’

শিহাবের মাথায় যেন খাড়া বাজ পড়ে। সে ভেবে নেয়, বিদেশি অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ডিজি সময় পায়নি। আগামীকাল কর্মশালার তেমন চাপ নেই। কাজেই…। তার চাকরিজীবনের অবসান আসন্ন। সে বসে পড়ে। উঠে দাঁড়াতে পারে না। সে আরো ভাবে, সে যে অন্যায় করেছে এর কোনো ক্ষমাও নেই।

সবাই চলে যাওয়ার শেষের দিকে শিহাবও কাঁপা ধীর পায়ে তার রুমে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। বসে থাকে সারারাত। দূরে-কাছে থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসতে থাকে। আসছে সাগরজলের উত্তাল শব্দও। শিহাব সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, পরাস্ত। সে কোনো রকমে উঠে দাঁড়ায়। ওয়াশরুমের দিকে প্রায় শক্তিহীন পা তুলে এগিয়ে যেতে যেতে সে ভাবে, লাশকাটা ঘরেও তো রাত পোহায়।

নাশতার পর্ব প্রায় শেষের দিকে। শিহাব সামান্য কিছু মুখে তুলে চায়ের কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে ডিজি সাহেবের একতলার ভিআইপি রুমের দিকে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কর্তব্যরত দারোয়ান তাকে থামায়।

‘আপনার কী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?’

‘হ্যাঁ … উনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন।’

‘আচ্ছা দেখি’ বলে সে রুমের ভেতরে যায়। ফিরেও আসে। ‘যান।’

ডিজি সাহেব আজ ফরমাল স্যুট-কোট ছেড়ে শার্ট-প্যান্ট পরেছেন। বসে বসে সিগারেট টানছেন ও কী একটা কাগজ দেখছেন নিবিষ্ট হয়ে।

তিনি ইশারায় তাকে বসতে বলেন এবং কাগজ থেকে চোখ না তুলে বলে যান, ‘শিহাব সাহেব শুনেন … আমাদের সবচেয়ে দরকারি কাজটা হয়নি এখনো … প্রেস রিলিজ … এটি অ্যাডমিন অফিস করছে। আমি ভাবছি, এদের সঙ্গে আপনিও থাকেন। এরা তো শুধু জানেন দাপ্তরিক ভাষা। ভালো বাংলা তো আর জানে না।’

এটুকু বলে তিনি তার দিকে চেয়ে হাসেন।

‘শুনেছি … আপনি তো নাকি আবার সাহিত্যানুরাগী। কাজেই … আমি চাই লেখা ভালো হোক … মন্ত্রী-আমলারাও তো দেখবেন। যাক … আপনি সোজা চলে যান অ্যাডমিন শাখায়। আজকের ওয়ার্কশপটা তেমন জরুরি নয়।’

তিনি উঠতে গিয়ে আবার বসেন।

‘…ও ভালো কথা, এই কনফারেন্সের সবক’টা পেপার জোগাড় করে রাখবেন। এটার একটা প্রসিডিঙ্কস হবে। ভালো একটা কম্পাইলেশন করে যেতে চাই … পেনশনে যাওয়ার আগে। আসুন…।’

‘জি স্যার। সালামুআলায়কুম।’

 

অ্যাডমিন অফিসে গিয়ে শিহাব পরপর দু-গস্নাস পানি খায়। সিনিয়র অ্যাডমিন অফিসার মোমিন তাকে যত্ন করে বসতে দেন। বড় সাহেব পাঠিয়েছেন। তৎক্ষণাৎ বেল টিপে চায়ের অর্ডার দেন।

শিহাব প্রশান্ত হয়ে ঘরটার চারদিক চোখ বুলিয়ে দেখে। ঘরটা পুরনো হলেও বড়সড়। সমুদ্রমুখী বড় বড় দুটো জানালা। হু-হু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে।

শিহাব এ কদিনের অশেষ মানসিক নির্যাতন, গভীর দুর্ভাবনা থেকে যে এখন মুক্ত তা তার বিশ্বাস হতে চায় না। সে ভাবে, এটা কেমন করে হয়। সে যেন এই মাত্র ফাঁসির দড়িতে ঝুলে বেঁচে গেছে। তাহলে কি যূথিকা কাউকে কিছু বলেনি? তার বিশ্বাস হতে চায় না।

বড় সাহেব বিশ্বাস করে তাকে কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। তাড়াতাড়ি কাজ নিয়ে বসে শিহাব। প্রশাসনিক বিভাগ প্রেস রিলিজের কাজটা করার চেষ্টা করেছে, তবে তা অগোছালো। কাজটা ফেয়ার করে প্রিন্ট আউট নিয়ে গুছিয়ে-গাছিয়ে উঠতে উঠতে দুপুর ১২টা বেজে যায়। শিহাবের ক্ষক্ষদে পেয়েছে তখন। তার মনে পড়ে, সে সকালে নাশতাও খায় নাই। অগত্যা মোমেন সাহেবকে বলতে হয়, ‘কাজ তো শেষ হয়নি … দুপুরের খাবার …।’

‘সেটা আপনার ভাবতে হবে না। আমি কনফারেন্সের ডাইনিং হল থেকে খাবার নিয়ে আসছি। আপনি কাজ করুন।’

‘হ্যাঁ, এখনো তো প্রসিডিংয়ের কাজটা ধরতে পারিনি।’

খাবার এসে গেলে শিহাব মনোযোগী হয়ে তৃপ্তিসহকারে খায়। খেতে খেতে তার মনে হয় কতদিন যেন সে খায়নি। খাবারের মধ্যে একটা শুঁটকির আইটেম ছিল। তখন তার মনে পড়ে, আসার সময় কুসুমের মেয়ে শুঁটকি নেওয়ার কথা বলেছিল। তার মেয়ের শুঁটকি খুব পছন্দ।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে প্রসিডিংয়ের পেপারগুলো সিরিয়ালি সাজিয়ে ফেলে শিহাব। ওয়ার্কশপও শেষ। আজ তা আধবেলা ছিল। বেশিরভাগ লোক খেয়েদেয়ে ঘরে ফিরে গেছে। আগামীকাল সবার বাড়ি ফেরা। শিহাব চিমিত্মত হয় খানিক। শুঁটকি কেনার সময়টা কই?

ব্যাপারটা নিয়ে মোমিন সাহেবের সঙ্গে কথা বলে শিহাব। তিনি তাকে নিশ্চিন্ত করেন। ‘আপনি মোটরসাইকেল চালাতে পারেন?’

‘হ্যাঁ … তা পারি।’

‘তাহলে আর কী, এই নেন চাবি … ছুটিয়ে চলে যান বার্মিজ মার্কেট হয়ে শুঁটকিঘাটায়। সব পেয়ে যাবেন।’ প্রস্তাবটা মন্দ লাগেনি শিহাবের।

ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে বের হয়ে স্বচ্ছন্দ গতিতে শিহাব মোটরসাইকেলটা গোছগাছ করে স্টার্ট দেয়। তখনই মিহি মেয়েলি কণ্ঠের ডাকে তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়। সে দেখে যূথিকা জুতা হাতে দৌড়ে আসছে।

‘শিহাব দাঁড়ান…।’

সে লজ্জা-শঙ্কা-দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

যূথিকা এগিয়ে আসে।

‘কোথায় যাবেন?’

শিহাবের সংযত-ঠান্ডা উত্তর। ‘বার্মিজ মার্কেট।’

‘আমিও যাব।’

‘কীভাবে?’

‘কেন আপনার বাইকে চড়ে।’

শিহাব কেমনতর দুর্ভেদ্য এক বিভ্রামিত্মতে তলিয়ে যেতে থাকে।

যূথিকা তাড়া দেয়।

‘স্টার্ট দেন … আর দেরি কেন?’

শিহাব স্টার্ট দিয়ে বাইকে চড়ে বসলে যূথিকাও তার কাঁধে হাত রেখে পেছনে বসে যায়। নড়েচড়ে জুত করে।

কলাতলী অফিস এলাকা ছাড়িয়ে গেলে শিহাব বাইকের গতি বাড়িয়ে দেয়। সময় কম। কেনাকাটা…।

যূথিকা তখন তার কাঁধ ছেড়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে দুহাতে শিহাবের কোমর জড়িয়ে ধরে।

শিহাব আড়চোখে দেখে, কোমরে জড়ানো যূথিকার দুহাতে শুভ্র সাদা শাঁখার চুড়ি।