শান্তনু কায়সার

শান্তনু কায়সার। এই নামেই তাঁর খ্যাতি, পরিচিতি এবং সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা ঘটে। যদিও তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মো. আবদুর রাজ্জাক। প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন ছাড়া প্রকৃত নাম তিনি ব্যবহার করতেন না। স্বভাবে লাজুক, কিছুটা নেপথ্যচারী এবং স্পষ্টভাষী ছিলেন শান্তনু কায়সার। আড্ডায়, আলোচনায় তাঁকে কখনো মুখর কিংবা সরব হতে দেখা যায়নি। তবে মঞ্চে বক্তৃতাকালে তাঁর ব্যতিক্রমী ভিন্ন দৃষ্টিকোণ, গভীর বিশেস্নষণ, শ্রোতা-দর্শকদের মুগ্ধ এবং বিমোহিত করত। প্রচলিত সমাজের সঙ্গে খাপ না খাওয়া ও ঋজু স্বভাবের এক অনন্যসাধারণ চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন শান্তনু কায়সার। না, কারো সঙ্গে মেলানো যায় না তাঁকে। লোভ ও লাভের পথে হাঁটেননি তিনি। সামাজিক অসংগতি, অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের আস্ফালন – এসবের নিন্দা এবং কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। বলা যায়, তিনি প্রথাগত সমাজের উলটো স্রোতের যাত্রী ছিলেন।

শান্তনু কায়সারের জন্ম ১৯৫০ সালের ৩০ ডিসেম্বর, বর্তমান চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সাচনমেঘ (সাজনমেঘ) গ্রামে। পিতা মো. সিরাজুল হক। তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মচারী ছিলেন। মা মোসাম্মৎ মাকসুদা খাতুন। শান্তনু কায়সার ঢাকা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তাঁর মাকে হারান। তাঁর মা ছিলেন আদর্শ-মিতব্যয়ী শিক্ষানুরাগী এক সমত্মানবৎসল মা। শান্তনু কায়সার এক জায়গায় উলেস্নখ করেছেন যে, তাঁর বাবা তাঁর মায়ের জন্য একটু বেশি দাম দিয়ে একটি শাড়ি কিনে দিলে তিনি সেই শাড়ি ফেরত দিয়ে সেই দামে দুটি শাড়ি আনার ব্যবস্থা করেন। এভাবে টাকা বাঁচিয়ে তিনি তাঁর সমত্মানদের লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় করেছেন। শান্তনু কায়সার আরো উলেস্নখ করেছেন যে, তাঁর মায়ের কাছেই তাঁদের সকল ভাইয়ের হাতেখড়ি হয়। ভাইয়েরা ছিলেন চারজন – জহিরুল হক, মুজিবুল হক, শান্তনু কায়সার ও নেসার আহমেদ। (ধানসিঁড়ি, ২০১৩) শান্তনু কায়সারের স্ত্রীর নাম সালেহা বেগম পাখি। দুই পুত্র অদুদ রায়হান (উজ্জ্বল) ও সোহেল রায়হান (রাসেল) এবং কন্যা সাহানা নার্গিস (আলো)। তিনি এ. মালেক ইনস্টিটিউট, লাকসাম, কুমিলস্না থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক করেন ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৮ সাল। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে (অনার্সসহ) স্নাতক (১৯৭১) এবং স্নাতকোত্তর (১৯৭২) ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলেন স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মুস্তাইন বিলস্নাহ। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি অধ্যাপনাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করলেও সাহিত্যই হয়ে ওঠে তাঁর আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের প্রধান ক্ষেত্র।

উত্তরকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিলস্নার বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবসরগ্রহণের পর তিনি খ-কালীন অধ্যাপক হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে কিছুদিন কাজ করেন। পেশাগত পরিচয়ের বাইরে শান্তনু কায়সার প্রধান হয়ে উঠেছিলেন মূলত একজন সৃজনশীল লেখক, নাট্যকার ও মেধাবী মননশীল গদ্যশিল্পী হিসেবে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং শিক্ষকতা করলেও শান্তনু কায়সার সমকালীন বাংলা সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হয়ে ওঠেন। ছাত্রজীবনে ঢাকা কলেজে শিক্ষক হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন শওকত ওসমানকে (১৯১৭-৯৮) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। এ দুজন শিক্ষকের স্নেহসান্নিধ্যে শান্তনু কায়সারের লেখকসত্তা গড়ে ওঠে। একজনের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন সৃজনশীল অনুপ্রেরণা, অন্যজনের কাছ থেকে নিয়েছিলেন মননশীলতার পাঠ। তৃতীয় মীর (১৯৯৪) গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে প্রিয় শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে শান্তনু কায়সার লিখেছেন-

শওকত ওসমান

যাঁর কাছে পাঠ্যবইয়ের

পরিবর্তে জীবন পড়েছি।

তরুণ বয়সে, কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও পরবর্তীকালে সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় নানারকম নিরীক্ষা করেছেন শান্তনু কায়সার। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে – কবিতা : রাখালের আত্মচরিত্র (১৯৮২), শুভ সুবর্ণজয়মত্মী (২০০২)। কবিতায় তাঁর বিষয়ভাবনার গভীরতা হৃদয়কে স্পর্শ করে। যেমন –

এতক্ষণে নিশ্চয় বাঁশ-টাঁশ কাটা হয়ে যাবে, অন্তিম গোসলের         জন্য

ধরাধরি করে সবাই আমাকে নিয়ে যাবে পর্দার আড়ালে

তারপর অন্য খাটে শুয়ে শুয়ে কবরস্থানে যাব, আমাকে নাবিয়ে

দেবে মাটির শয্যায়

অতঃপর মাটি ছড়াতে ছড়াতে সবাই পড়বে, মিনহা খালাকনা

কুম…

তখনো কি নিঃসঙ্গ বাতাবিলেবু গাছটির মতো তুমিও

একলা দাঁড়িয়ে থাকবে কুসুম?

ভাববে না, আগামী দিনগুলো কী করে চলবে?

(‘অন্তিম যাত্রা’, রাখালের আত্মচরিত)

এখানে মৃত্যুচিমত্মার সঙ্গে প্রেম-বিরহের জাগতিক ও মানবিক অনুভব, নতুন এক সংবেদনশীলতা হৃদয়কে সিক্ত করে। যদিও উত্তরকালে কবিতায় তাঁর কোনো স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়নি।

ছোটগল্প : শ্রীনাথ পণ্ডিতের প্রাণপাখি (১৯৮৭), ফুল হাসে, পাখি ডাকে (২০০১), অর্ধশতাব্দী (২০১০)। গল্পে তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, জীবনবোধ ও গদ্যভাষার নিজস্বতা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে শান্তনু কায়সার কেন যে গল্প লেখায় অগ্রসর হলেন না, জানি না।

উপন্যাস : ঐ নূতনের কেতন ওড়ে (২০০৬), ত্রয়ী (২০০৮)।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আত্মচরিত বা অটোবায়োগ্রাফি হিস্টোরি নিয়ে ঐ নূতনের কেতন ওড়ে রচিত। মোট তিনটি পর্বে উপন্যাসটি বিন্যস্তহয়েছে। প্রথম পর্ব ‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’, দ্বিতীয় পর্ব ‘সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে’ এবং তৃতীয় পর্বের নাম ‘আমি চিরতরে’। গঠনবিন্যাসের স্বাতন্ত্র্য ছাড়াও এ-উপন্যাসে নজরুলের সৃজন-মননের ভিন্ন এক স্বরূপকে উন্মোচিত করেছেন শান্তনু কায়সার। ত্রয়ী তিনটি নভেলেট – নেই, প্রতিদ্বন্দ্বী এবং দর্শনের দর্শন। কথ্যরীতির নিরীক্ষা তিনটি উপন্যাসকে স্বাতন্ত্র্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।

নাটক : নাট্যত্রয়ী (২০১২)।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ত্রয়ী নাটকের মধ্যে রয়েছে সাজনমেঘ, রূপান্তরআমরা। তিনটি নাটকই মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। ‘ভূমিকা’য় তিনি উলেস্নখ করেছেন-

স্প্যানিশ নাট্যকার লোপে দে ভেগার কৃষকনাট্য ফুয়েমেত্ম অভিজুনার অনুবাদ করতে গিয়ে দেখি, বেশ কয়েক শতাব্দীর আগের এ-ঘটনার সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাদৃশ্য রয়েছে। ধর্মের স্থূল স্বার্থপরতা ও ভ-ামির পরিবর্তে মাটির মানুষের সদাচার যেমন জীবনের নুন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধেরও প্রেরণা। সে-সময় আমার মনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক রচনার প্রেরণা জাগে। অতঃপর আমি পরপর লিখে ফেলি তিনটি নাটক – সাজনমেঘ, রূপান্তরআমরা

(‘কায়সার’, ২০১২)

সাজনমেঘ শান্তনু কায়সারের নিজের গ্রামকে নিয়ে লেখা কল্পনা ও ভালোবাসার সৃষ্টি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা হঠাৎ নিস্তরঙ্গ গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়। নাটকে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে রাজাকার কাশেম আলীকে হত্যা করে; কিন্তু হত্যার কথা কেউ স্বীকার করে না। তারা যা করেছে, তা কোনো ব্যক্তিমানুষের জন্য করেনি, পুরো সাজনমেঘ গ্রামের জন্য করেছে, সারাদেশের মানুষের জন্য করেছে। যদি ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করে – কে হত্যা করেছে? তারা সমষ্টিকণ্ঠে বলবে – ‘সাজনমেঘ’।

হাফিজের সংলাপ : আমরা একবাক্যে জবাব দিমু, সাজনমেঘ। ব্যক্তিগতভাবে আমরা কেউ তা করি নাই, আমাগ জাতির কণ্ঠ যারা চাইপা ধরতে চাইছিল তাগোরে আমরা সমষ্টিগতভাবে উৎখাত করছি। ছায়াসুনিবিড় এই গ্রামে যারা আগুন লাগাইতে আইছিল মেঘের বজ্র তাগোরে আঘাত করছে। কাশেম আলীরে কে হত্যা করেছে?

সবাই : সাজনমেঘ। (‘কায়সার’, ২০১২, নাট্যত্রয়ী)

এই সমষ্টিগত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপ লাভ করে। শান্তনু কায়সার তাঁর নাটকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এভাবে শৈল্পিক পরিচর্যা করেছেন। সাজনমেঘ চট্টগ্রামের অরিন্দম নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চায়িত করে। রূপান্তর নাটকটি রিফাত আমিনের নির্দেশনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমি মঞ্চায়ন করে। তিতাস একটি নদীর নাম (অদ্বৈত মলস্নবর্মণের উপন্যাস অবলম্বনে) (১৯৯৪)। এটিও কুমিলস্না টাউনহল, শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চে অনেকবার মঞ্চায়িত হয়। অনূদিত নাটক ফুয়েমেত্ম অভিজুনা শেক্সপিয়রের সমকালীন স্প্যানিশ নাট্যকার লোপে দে ভেগার (১৫৬২-১৬৩৫) নাটক। প্রায় পাঁচশো বছর আগে ভিন্ন এক রাজনৈতিক পটভূমির নাটক হলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যে-সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

তুমি সন্দেশ – ঢাকা থেকে প্রকাশিত শান্তনু কায়সারের ইতিহাসভিত্তিক মৌলিক নাটক। নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফা ছিলেন মোহনলালের বোন। লুৎফার প্রকৃত নাম ইতিহাসে হারিয়ে গেছে। সমকালীন প্রাসঙ্গিকতায় সেই লুৎফাকে নিয়ে তিনি ইতিহাসের এক দ্বন্দ্বময় নাটক রচনা করেন।

বিদ্রোহী নাট্যতত্ত্ব : ত্রয়ী নাট্যকার (১৯৮৭) গ্রন্থে  বের্টল্ট ব্রেখট, লুইজি পিরান্দেলো এবং জাঁ জেনে – এ তিন প্রথাবিরোধী নাট্যকারের শিল্পভাবনার সঙ্গে সমকালীন বাংলাদেশের নাটকের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন শান্তনু কায়সার। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নাটক ও নাট্যবিষয়ক সাহিত্য ছিল তাঁর অন্যতম বিচরণক্ষেত্র। বিদেশি নাটকের অনুবাদ ছাড়াও তিনি নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধ অনুবাদ করেন। নিজের মৌলিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে তিনি ইউরোপীয় নাট্যদ্বন্দ্বের সঙ্গে প্রাচ্য নাট্যরসের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন এক শিল্পভাবনার ভিত্তি স্থাপন করেন।

জীবনীগ্রন্থ : অদ্বৈত মলস্নবর্মণ (১৯৮৭), অদ্বৈত মলস্নবর্মণ : জীবন, সাহিত্য ও অন্যান্য (১৯৯৭), মতিউল ইসলাম (১৯৯২), মোহাম্মদ মোর্তজা (১৯৯৪), রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী (১৯৯৯), নাজমা জেসমিন চৌধুরী (২০১১), আরজ আলী মাতাববর (২০১২), শওকত ওসমান (২০১৩)। তাঁর লেখা জীবনীগ্রন্থগুলো যেমন তথ্যবহুল তেমনি হৃদয়গ্রাহী। আমি উপলব্ধি করেছি যে, লেখকদের জীবন ও সাহিত্যকর্মকে অভিন্ন সূত্রে গ্রন্থিত করে লেখকের ভেতরের শিল্পীসত্তাকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন তিনি।

সম্পাদনা : মতিউল ইসলাম স্মারকগ্রন্থ (১৯৮৫), খান মোহাম্মদ ফারাবী রচনাসমগ্র (১৯৯২), তিতাস একটি নদীর নাম, ভূমিকাসহ অদ্বৈত মলস্নবর্মণের জীবন ও উপন্যাসের শিল্পরূপ নিয়ে বিসত্মৃত আলোচনা করেছেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯৮৫)।

শিশুসাহিত্য : ছোট্টবন্ধুরা (২০০১)।

প্রবন্ধ-গবেষণা : বঙ্কিমচন্দ্র (প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব ১৯৮৪),  কাব্যনাটক (১৯৮৬), তৃতীয় মীর (১৯৯৪), গভীর গভীরতর অসুখ : গদ্যসত্তার জীবনানন্দ (১৯৯৭), বাংলা কথাসাহিত্য : ভিন্ন মাত্রা  (২০০১), ফুল ও নজরুল (২০০১), স্বর্ণ ও শুভ (২০০২), সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ : না নিন্দা না স্ত্ততি না দূষণ (২০১৩), রবীন্দ্রনাথ : চার অধ্যায় (২০১১), নজরুল কেন নজরুল (২০১৩), ফুল ও নজরুল (২০০১)।

অর্থাৎ মননশীল গদ্য রচনা ও গবেষণা ছিল শান্তনু কায়সারের প্রধান ক্ষেত্র। তাঁর মেধা ও প্রতিভার অসাধারণ বিকাশ লক্ষ করা যায় সাহিত্য-সমালোচনা এবং গবেষণায়। সমকালীন সাহিত্যে শান্তনু কায়সারের মতো অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সাহিত্য-সমালোচক বিরল ছিল। বাংলা উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তিনি লিখেছেন আলোকদীপ্ত গ্রন্থ। এ-গ্রন্থ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন লিখেছেন, ‘শান্তনু কায়সার তীক্ষন শিল্পবোধ প্রয়োগের মাধ্যমে বঙ্কিম-সাহিত্য বিশেস্নষণ করেছেন।’ (‘রশীদ আল ফারুকী’, ১৯৮৪, পৃ ৩১)

আমার বিবেচনায় তৃতীয় মীর (১৯৯৪) তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। ‘প্রসঙ্গত’তেতিনি লিখেছেন, ‘তৃতীয় মীর’ বলতে আমি যা বুঝেছি তার ব্যাখ্যা প্রথম প্রবন্ধ, ‘জগৎ পরাধীন কিন্তু মন স্বাধীনে রয়েছে’। এটি এ-বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, মীর মশাররফ হোসেন একদিকে ব্যক্তি, অন্যদিকে শিল্পী। প্রথম মীরকে যদি ব্যক্তি বিবেচনা করি, দ্বিতীয় মীর তবে শিল্পী। কিন্তু এ-দুয়ের দ্বন্দ্ব ও প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এক তৃতীয় মীরের। তাঁর অভিমত-

বাঙলায় সাহিত্যিক গদ্য রচনার সেই সূচনাপর্বে বঙ্কিমের প্রবল উপস্থিতিতে স্বতন্ত্র এবং সংকীর্ণ জীবন পরিবেশে উপন্যাসের উপাদান খোঁজা আর তাকে আঙ্গিকঋদ্ধ করে তোলার জন্য মীরের উপরই প্রথম দায়িত্ব বর্তেছিল। পথিকৃতের ওই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে নানা মৌলিক শিল্পভাবনা আর রীতি উদ্ভাবন করতে হয়েছে, এবং তা করতে গিয়ে বিষয় আঙ্গিকের দ্বারস্থ হয়েছে, আঙ্গিক বিষয়ের। অন্যদিকে যে পরাধীন জগতে মীর বসবাস করেছেন, তাঁর শিল্পী আর স্বাধীন মন বরাবরই চেয়েছে তাকে অতিক্রম করতে। ফলে এই সবকিছু মিলে, বিষয় ও আঙ্গিক, পরাধীন জগৎ ও স্বাধীন মন তাঁর শিল্পোপকরণ নির্বাচন এবং আঙ্গিক উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক দ্বান্দ্বিক এবং জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সমস্তঅর্জন ও সীমাবদ্ধতাসহ এই পরিস্থিতির জীবনঋদ্ধ ও শিল্পগত রূপায়ণের নাম মীর মশাররফ হোসেন। তিনিই আমাদের বিবেচনায় তৃতীয় মীর। (‘কায়সার’ : ১৯৯৪, পৃ ৪৫)

মীর মশাররফ হোসেনের দ্বন্দ্বজর্জর ব্যক্তিজীবন এবং শিল্পসত্তাকে এমন নন-অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর পূর্বে কেউ বিশেস্নষণ করেননি। এভাবে সম্পূর্ণ নতুন মীর আবিষ্কার ও উন্মোচিত হয়েছেন শান্তনু কায়সারের হাতে।

গভীর গভীরতর অসুখ : গদ্যসত্তার জীবনানন্দ (১৯৯৭) গ্রন্থে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার সবচেয়ে প্রভাবসঞ্চারী কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৫) কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখেছেন সে-বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তাঁর কবিসত্তার বিপরীত কণ্ঠস্বর হচ্ছে তাঁর গদ্যসাহিত্য। সমকালীন প্রতিক্রিয়ায় তীব্র মন ও মনন নিয়ে গদ্য রচনাও অব্যাহত রেখেছিলেন জীবনানন্দ। সে বিপুল গদ্যসম্ভারকে তিনি বাক্সবন্দি করে রেখে গিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের সংবেদনশীল কবিসত্তা এবং প্রতিক্রিয়াজাত মননময় গোপন গদ্য, এই দুইয়ে মিলে যে অখ- জীবনানন্দ, তাকেই আবিষ্কার করেছেন ও তুলে ধরেছেন শান্তনু কায়সার এ-গ্রন্থে। অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত জীবনানন্দ দাশের সেই গদ্যচর্চার স্বরূপ ও প্রকৃতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, – ‘এ কবির গদ্য রচনা তাঁর সমগ্র সত্তারই অপরিহার্য অংশ, তাকে বাদ দিয়ে জীবনানন্দকে তো নয়ই, তাঁর কবি-সত্তাকেও সম্পূর্ণ চেনা যাবে না।’ (‘কায়সার’ : ১৯৯৭, পৃ ৩৮)

স্বাতী ভট্টাচার্য এ-বই সম্পর্কে লিখেছেন – ‘শিল্পে যে কলায় তাঁর সিদ্ধি, যে কাব্যলোকে তাঁর অবাধ বিচরণ, সেই গ–র বাইরে নিজেকে প্রকাশ করতে জীবনানন্দের অসীম কুণ্ঠা ছিল। অথচ নিজের গল্প-উপন্যাসগুলি তিনি সারা জীবন রক্ষা করেছেন সযত্নে। নিজের সম্পূর্ণ সাহিত্যসত্তার চাবিকাঠিটি উত্তরকালের হাতে তুলে দিয়ে যাবার জন্যই তাঁর এ আয়োজন। সেই কাজটি হাতে নিয়েছেন শান্তনু কায়সার।’ (‘স্বাতী’ : ১৯৯৮, দেশ)

বাংলার অপরূপ রূপে কবি মুগ্ধ; কিন্তু যুদ্ধ ও মন্বন্তরের বিরূপতা তাঁকে রূপমুগ্ধ থাকতে দেয়নি। জীবনানন্দের শিল্পীসত্তার দ্বন্দ্বজটিল সেই দিকটির প্রতি আলো ফেলেছেন তিনি।

বাংলা কথাসাহিত্য : ভিন্ন মাত্রা (২০০১) গ্রন্থটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যায়, কী নিবিড় অবলোকন, কত গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল তাঁর কথাসাহিত্য বিষয়ে। বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্ এখানে নতুনভাবে মূল্যায়িত হয়েছেন তাঁর হাতে।

কাব্যনাটক (১৯৮৬) মূলত বাংলা একাডেমির ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালার সিরিজ থেকে প্রথম প্রকাশিত হলেও পরে এটির পরিবর্ধিত সংস্করণ শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হয়। কাব্যনাটক তত্ত্বীয় বই। কাব্যনাটকের একটি সমৃদ্ধ ধারা থাকলেও এ-বিষয়ে কোনো তত্ত্বীয় বই ছিল না। শান্তনু কায়সারই প্রথম কাব্যনাটক বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করে সে-অভাব দূর করেছেন। অদ্বৈত মলস্নবর্মণ : জীবন, সাহিত্য ও অন্যান্য (১৯৯৮) তিতাসপারের এই মাটিবর্তী ঔপন্যাসিককে শান্তনু কায়সারই প্রথম অনুসন্ধান ও আবিষ্কার করে ব্যাপক পাঠকের কাছে তুলে ধরেন। তিনিই অদ্বৈতচর্চার সূত্রপাত করেন। উত্তরকালে অদ্বৈত-বিষয়ে শান্তনু কায়সারই নির্ভরযোগ্য অথরিটি হয়ে ওঠেন। এছাড়া সমকালীন পত্রপত্রিকায় শান্তনু কায়সারের শতাধিক মূল্যবান গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যা অগ্রন্থিত। সারাজীবনের সাহিত্যপাঠ ও সাহিত্য-গবেষণাকে শান্তনু কায়সার শেষ বয়সে এসে গ্রন্থরূপ দেওয়ার কাজে নিমগ্ন ছিলেন। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে অসমাপ্ত পা-ুলিপির কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শান্তনু কায়সারের কলম ছিল সচল, চলিষ্ণু।

আমৃত্যু সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তনু কায়সার পেয়েছিলেন অনেক পুরস্কার এবং সম্মাননা।

পুরস্কার : প্রত্যাশা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯০), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫), অদ্বৈত মলস্নবর্মণ স্মৃতি পুরস্কার, ভারত (১৯৯৯), অদ্বৈত মলস্নবর্মণ পুরস্কার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (২০১৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১৪), জীবনানন্দ পুরস্কার (২০১৩), কুমিলস্নার কাগজ পুরস্কার (২০০৫)। কবিতা, কথাসাহিত্য, নাটক, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ-গবেষণা, অনুবাদ ও সম্পাদনা মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ৪৫টি।

শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা এবং সাহিত্যসাধনা ছিল শান্তনু কায়সারের সারাজীবনের ব্রত। তাঁর লেখা বাক্যে ও ভাষ্যে, বিবেচনায়, তিনি অমর হয়ে থাকবেন নিশ্চয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শান্তনু কায়সারের মতো মেধাবী গদ্যলেখক আর চোখে পড়ে না। আমাদের ম্রিয়মাণ সমালোচনা সাহিত্য এবং যুক্তি ও বিশেস্নষণহীন প্রবন্ধ-সাহিত্যে শান্তনু কায়সার ছিলেন সুস্পষ্ট ব্যতিক্রমী লেখক। তিনি সাহিত্যকে প্রথাগত দৃষ্টিতে দেখেননি, বিচার-বিশেস্নষণ করেছেন ননঅ্যাকাডেমিক জায়গা থেকে, নিজস্ব পাঠ-অভিজ্ঞতা ও শিল্পবোধ দিয়ে। তাঁর অবলোকন ও আবিষ্কার ছিল ভিন্নমাত্রার। গত ১২ এপ্রিল ২০১৭ সালে মাত্র ৬৭ বছর বয়সে শান্তনু কায়সার চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। সাহিত্যের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মেধাবী গদ্যলেখক শান্তনু কায়সারের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

 

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যপঞ্জি :

১. বাংলা একাডেমি লেখক অভিধান, সম্পাদক : সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ

ও অন্যান্য, ১৯৯৮।

২. তৃতীয় মীর, শান্তনু কায়সার, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৪।

৩. রাখালের আত্মচরিত, শান্তনু কায়সার, দ্রাবিড়, ১৯৮২।

৪. নাট্যত্রয়ী, শান্তনু কায়সার, বাংলা একাডেমি, ২০১২।

৫. তৃতীয় মীর, পূর্বোক্ত।

৬. গভীর গভীরতর অসুখ : গদ্যসত্তার জীবনানন্দ, শান্তনু কায়সার,

বাংলা একাডেমি, ১৯৯৭।

৭. স্বাতী ভট্টাচার্য, দেশ, ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৮, কলকাতা।

৮. পিয়াস মজিদ, আমাদের সময়, ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ঢাকা।

৯. ধানসিঁড়ি, ২০১৩, বরিশাল।

১০. বাংলাদেশে বঙ্কিমচর্চা, রশীদ আল ফারম্নকী, ১৯৮৪।