শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধের কবিতা

চৌধুরী শাহজাহান

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের একটি গুরম্নত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাঙালি জাতি দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরম্নদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করে অর্জন করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা। প্রকৃতপক্ষে এই স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটেছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারির ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। একুশের  ভাষা-আন্দোলনকে নিয়ে যেমন উন্নত কবিতা রচিত হয়েছে, তেমনি রচিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়েও। সাতচলিস্নশের দেশবিভাগ, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন, আটান্নর সামরিক শাসন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ – এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই আন্দোলনগুলো আমাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য পরিম-লে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কবিতায় এর প্রভাব ও প্রসার ঘটে ব্যাপকভাবে। ফলত ১৯৫০ সালে আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খানের যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নতুন কবিতা। পাকিস্তান আমলের প্রথম কবিতা-সংকলন হিসেবে নতুন কবিতার ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। এই সংকলনের পরই বের হয় হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রম্নয়ারী (১৯৫৩) সাহিত্য-সংকলনটি। একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে উপলক্ষ করে রচিত কবিতাগুলোতে পাওয়া যায় অমিত সম্ভাবনার কথা, অসহায়তা ও আশাভঙ্গের করম্নণ চিত্র। একুশকে নিয়ে যাঁরা কবিতা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-৮৩), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৭), বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৭), আবদুল গনি হাজারী (১৯২১-৭৬), ফজলে লোহানী (১৯২৮-৮৫), আনিস চৌধুরী (১৯২৯-৯০) আবু জাফর ওবায়দুলস্নাহ (১৯৩৪-২০০১), আতাউর রহমান (১৯২৭-৯৯), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) ও সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫) উলেস্নখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবন ও মননে হীরকখ–র মতো দ্যুতিময়। বাঙালির শিল্প-সাহিত্য তথা রাজনীতি ও  সমাজ-ভাবনায় এবং বাঙালির জাতীয়তার স্বরূপ চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের গভীর প্রভাব পড়েছে। সময় যত অতিক্রান্ত হচ্ছে, আমাদের মুত্তিযুদ্ধের সাহিত্য ততই সমৃদ্ধ হচ্ছে নিজস্ব গৌরব ও অন্তর্নিহিত চেতনায়। সাহিত্যের প্রতিটি আঙিনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফুটে উঠেছে সগৌরবে। গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছড়া ও কবিতায় যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে, তেমনি এসেছে সংগীতে। বস্ত্তত মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতি ফিরে পেয়েছে নিজস্ব ভাষা, জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, স্বাধিকার-চেতনা ও নিজস্ব একটি মানচিত্র। দীর্ঘ সাধনা ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই এক টুকরো মানচিত্রই বাঙালি জাতির গৌরব ও অহংকার।

একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামে বিশ্বের মানচিত্রে এক নতুন রাষ্ট্রের উদয় হলো। মুক্তিযুদ্ধ কবি-মানসে প্রচ- উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। তার খানিকটা ধরা পড়ে প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের ‘টেলেমেকাস’ নামক কবিতায়। হোমারের মহাকাব্য ওডিসির কাহিনি কবিতাটির প্রেরণা। অডিসিউস যখন দেবতার অভিশাপে সমুদ্রে দিকভ্রষ্ট তখন বিভিন্ন দেশের রাজা অডিসিউসের পত্নী পেনেলোপকে বিবাহ করে ইথাকা দখল করতে চেয়েছিল। তাদের থামানোর জন্য পেনেলোপ একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি একটি কাপড় বুনছিলেন, বলেন, এটি বোনা শেষ হলে স্বয়ম্বরা হবেন। কিন্তু দিনের বেলায় তিনি যা বুনতেন রাতের বেলায় তা খুলে দিতেন। সুতরাং বোনা আর শেষ হয় না। অন্যদিকে তার পুত্র টেলেমেকাস পিতার প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছেন। এই কাহিনি শামসুর রাহমান কীভাবে তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন, এখন তা দেখা যাক। তিনি ঢাকাকে ইথাকা আর নিজেকে টেলেমেকাস রূপে দেখেছেন। আর পশ্চিম পাকিস্তানি যেন আগ্রাসী বিদেশি রাজন্য। তিনি চাইছেন পিতা অডিসিউসকে, অর্থাৎ ঢাকার পরিত্রাতাকে

‘ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে/ দরোজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।/ এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্ত্তল তোমার/ বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ/ আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে এ টঙ্কার?’ (‘টেলেমেকাস’, নিরালোকে দিব্যরথ)

শামসুর রাহমান একজন সমকাল ও সমাজ-সচেতন কবি। সমকালীন বাঙালির জাতীয় জীবনের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্ত মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়। শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মধ্য পঞ্চাশের দশক থেকে কাব্যচর্চা শুরম্ন করেন। কাব্যচর্চার প্রথমদিকে তিনি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু,  বিষ্ণু দে ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত – এ চারজন কবি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। জীবনানন্দের আত্মসচেতন ও নিজস্ব দর্শনজাত কবিতাই তাঁর কাব্যের প্রথম মৌলিক প্রেরণা। তিনি পরবর্তী ষাটের দশকে খুঁজে পেলেন নিজস্বতা। তিরিশের কবিদের প্রভাবমুক্ত হলেন, যুক্ত হলেন পরিপার্শ্বের সঙ্গে। শামসুর রাহমানের কবিতায় ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর জীবন, একটি বিশেষ জনপথ, শহর, মানুষ ও স্বদেশ ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে বারবার। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। ছিল না তাঁর হাতে রাইফেল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কবিতা লিখে বাঙালি জাতিকে সাহসী হওয়ার মন্ত্র দিয়েছিলেন। আরো দিয়েছেন শক্তি, স্বপ্ন ও সাহস। শামসুর রাহমানের উলেস্নখযোগ্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০), রৌদ্রকরোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বসত্ম নীলিমা (১৯৬৭), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮), নিজবাসভূমে (১৯৭০), বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২), দুঃসময়ের মুখোমুখি (১৯৭৩), ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা (১৯৭৪), আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি (১৯৭৪), এক ধরনের অহংকার (১৯৭৫), আমি অনাহারী (১৯৭৬), শূন্যতায় তুমি শোকসভা (১৯৭৭), প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে (১৯৭৮), বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে (১৯৭৭), উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ (১৯৮২) ইত্যাদি।

বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা একজন সন্ত্রসত্ম, ব্যথিত কবির অভিজ্ঞতা ও ভাবনা বেদনার অভিজ্ঞান। শামসুর রাহমান এই কাব্যে যুদ্ধকে ছেঁকে তুলে আনতে চেষ্টা করেন তাঁর কবিতায়। তিনি  নিজেকে একজন যোদ্ধা বা বন্দি হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন কবি হিসেবে। আর সেজন্য কবিতাও ধরা দেয় তাঁর কাছে। এ-কাব্যের শরীরে-মাংসে-রক্তে ধরা পড়েছে একাত্তরের বুলেটবিদ্ধ হৃৎপি–র ওঠানামা। বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটি বিশেস্নষণ করা যাক – ‘স্বাধীনতা’ নামক শব্দটিকে তিনি দেখেছেন বিভিন্নভাবে। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে তিনি ভরাট গলায় উচ্চারণ করে তৃপ্তি পেতে চান। শহরের অলিতে-গলিতে, আনাচে-কানাচে, প্রতিটি রাস্তায়, বাড়িতে, সাইনবোর্ডে, পাখিতে, নারীতে ঝলকিত হতে দেখেছেন প্রিয় শব্দটিকে। স্বাধীন দেশের কবিদের সম্বোধন করে জানালেন যে, তিনি আজ  ক্ষুব্ধ। কেননা স্বাধীনতা নামক শব্দটি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বাংলায় – ‘অথচ জানে না ওরা কেউ/ গাছের পাতায়, ফুটপাতে/ পাখির পালকে, কিংবা নদীর দু’চোখে/ পথের ধুলায়, বসিত্মর দুরন্ত ছেলেটার/ হাতের মুঠোয়/ সর্বদাই দেখে জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটা।’ (বন্দী শিবির থেকে)

শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধের কবিতার মধ্যে বহুল প্রচারিত দুটো কবিতা হচ্ছে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’। কবিতাদ্বয় যুগল কবিতা নামে পরিচিত। কবিতা দুটোর অভ্যন্তরে সেস্নাগানের প্রাবল্য লক্ষ করা যায়। অবশ্য সে-প্রাবল্যকে কবি শাসন করেছেন কবিতায় নরম আবেদনের মাধ্যমে। তাই যা হতে পারত নিছক সেস্নাগান, তা হয়ে উঠেছে বিষাদের গাথা। যেমন – ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতোকাল ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়/ আর কতোবার দেখতে হবে খা-ব দাহন?/ তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ সখিনা বিবির কপাল ভাঙলো/ সিথির সিঁদুর মুছে গেলো হরিদাসীর।’

এই কবিতায় শামসুর রাহমান স্বাধীনতাকাঙক্ষী এমন কিছু মানুষের কথা বলেছেন যারা একেবারে খেটে-খাওয়া মানুষ, দরিদ্র সাধারণ মানুষ। যেমন – উদাস হাওয়ায় বসে থাকা এক থুত্থুরে বুড়ো – যার চোখের নিচে অপরাহ্ণের দুর্বল আলোর ঝিলিক। দগ্ধ ঘরের নড়বড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মোলস্নাবাড়ির এক বিধবা মহিলা। পথের ধারে শূন্য থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক অনাথ কিশোরী। ঢাকার রিকশাওয়ালা রম্নসত্মম শেখ, শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগির আলী, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিঞা এবং অন্য সবাই প্রতীক্ষা করছে স্বাধীনতালাভের আশায়। কবিতাটির উপামেত্ম কবি আমাদের নিশ্চিত আশার বাণী শুনিয়েছেন – ‘পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিকবিদিক/ এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে/ হে স্বাধীনতা।’ (‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’)

‘স্বাধীনতা’ সম্বোধন ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় প্রায় গানে পরিণত হয়েছে। যদিও সম্ভাবনা ছিল সেস্নাগানে পরিণত হওয়ার। কবিতাটি যে-সেস্নøvগানে শিহরিত না হয়ে সুর মুখরিত হয়েছে এর মূলে রয়েছে শামসুর রাহমানের নিঃসঙ্গ পাশে কেউ নেই, তাই সম্ভব শুধু একান্ত, আন্তরিক, রূপময়, অতিশয়োক্তি – উজ্জ্বল প্রিয় সম্বোধন।

স্বাধীনতা নামক শব্দটিকে তিনি সাজিয়েছেন নানা বর্ণে-রূপে-সুরে এবং তিনি তা সংগ্রহ করেছেন বাংলার নৈসর্গিক জীবনাচার থেকে। স্বাধীনতাকে নজরম্নলের বাবরি চুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শহীদ মিনার, পতাকা মিছিল, ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি, গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেমন – ‘স্বাধীনতা তুমি/ রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/ স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরম্নল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরম্নষ, সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে কাঁপা -’

বন্দিত্বের ব্যথা, ক্ষোভ ও হতাশা ইত্যাদি ব্যক্ত হয়েছে বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব কবিতায়। তিনি কখনো
ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, আবার কখনো ভয়ে সন্ত্রসত্ম হয়েছেন। ‘পথের কুকুর’ কবিতার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে একাত্তরের সেই অবরম্নদ্ধ জীবনের কথা, যেখানে ভয়ে সন্ত্রসত্ম থাকত পুরম্নষ-নারী, ছেলে-মেয়ে-বুড়ো সবাই। সমসত্ম শহরে ছিল সৈন্যদের অত্যাচার, যখন-তখন গুলির আওয়াজ। যত্রতত্র মরা মানুষের লাশ। সব মিলিয়ে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল মানুষের জীবনে-মননে। ‘পথের কুকুর’ নামক কবিতাটিতে বন্দি ও প্রাণভয়ে আতঙ্কগ্রসত্ম মানুষের চিত্র বিধৃত হয়েছে এভাবে – ‘আমি বন্দি নিজ ঘরে। শুধু/ নিজের, নিঃশ্বাস শুনি, এত সত্মব্ধ ঘর।/ কবুরে সত্মব্ধতা নিয়ে বসে আছি/ দেয়াল-বিহারী টিকটিকি – / চকিতে উঠলে ডেকে, তাকেও থামিয়ে দিতে চাই,/ পাছে কেউ শব্দ শুনে ঢুকে পড়ে ফালি ফালি চিরে মধ্যবিত্ত/ নিরাপত্তা আমাদের। সমসত্ম শহরে/ সৈন্যরা টহল দিচ্ছে, যথেচ্ছ করছে গুলি, দাগছে কামান/ এখন চালাচ্ছে ট্যাঙ্ক যত্রতত্র। মরছে মানুষ/ পথে ঘাটে, ঘরে যেন পেস্নগবিদ্ধ রক্তাক্ত ইঁদুর।’ (‘পথের কুকুর’)

এই কবিতায় কুকুরের অসীম সাহসের কথা বলা হয়েছে। জলপাই রং, সন্ত্রাস, সশস্ত্র কতিপয় সৈনিকবোঝাই একটি জিপকে বারবার তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে পথের কুকুর। কিন্তু অসহায় মানুষের সশস্ত্র সেই জিপ তাড়াবার সাহস নেই। তাই কবিতার উপামেত্ম কবি ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ‘যদি অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর’।

যুদ্ধকালীন প্রতিদিনের বাসত্মবচিত্র ধরা পড়েছে ‘প্রাত্যহিক’ কবিতায়। পুলিশ এবং রাজাকারের দৌরাত্ম্য, নারীর চিৎকার, হাত বাঁধা মানুষ, রাইফেলধারী পাঞ্জাবি সৈনিক ইত্যাদির বাসত্মব চিত্র ফুটে উঠেছে এ-কবিতায়। চারিদিক পালাবার সমসত্ম পথ বন্ধ করে দিয়েছে হানাদার বাহিনী। যেমন – ‘পশ্চিমা জোয়ান আসে তেড়ে/ স্টেনগান হাতে আর প্রশ্ন দেয় ছুঁড়ে ঘাড় ধরে/ ‘বাঙালী হো তুম?’ আমি রম্নদ্ধবাক, কি দেব জবাব?/ জ্যোতির্ময় রৌদ্রালোকে বীরদর্পী সেনা/ নিমেষেই হয়ে যায় লুটেরা, তস্কর।’

কবিতাটির শেষের দিকে একাত্তরের পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি অর্থাৎ মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম প্রভৃতির সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার, আলবদর, শামিত্ম কমিটি, আলশামস ফ্যাসিবাদীদের কর্মতৎপরতার বর্ণনা এসেছে এভাবে – ‘তুমুল গাইছে গুণ কেউ কেউ কুণ্ঠাহীন খুনী/ সরকারের। কেউ কেউ ইসলামী বুলি ঝেড়ে তোফা/ বুলবুল হতে চায় মৃতের বাগানে।/ অলিতে গলিতে দলে/ মোহাম্মদী বেগ ঘোরে, ঝলসিত নাঙ্গা তলোয়ার/ নেপথ্যে মীরজাফর বঙ্কিম গোঁফের নীচে মুচকি হাসেন।’ (‘প্রাত্যহিক’)

যুদ্ধকালীন সময়ে এ-দেশীয় দালাল এজেন্টদের সাহায্য-সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনীর  অত্যাচার ও নিপীড়ন ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
প্রথমদিকে পাকিস্তানি বাহিনী এদেশের পথঘাট কিছুই চিনত-জানত না। কিন্তু পরবর্তীকালে আমাদের দেশীয় স্বার্থপর ও লোভী দালালদের সঙ্গে হাত করে গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর এরা ধ্বংস ও লুটপাট করতে লাগল। একদিকে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী, অন্যদিকে এদেশীয় আলবদর-রাজাকার বাহিনীর হত্যা, লুণ্ঠন আর ধর্ষণের ফলে নিরীহ বাঙালির জাতীয় জীবন হয়ে উঠল অতিষ্ঠ। তাই এই দুর্যোগময় পরিস্থিতি থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে লাগল বাঙালি। বাঙালি বুঝতে পারল যুদ্ধ ছাড়া উদ্ধার সম্ভব নয়। ‘উদ্ধার’ কবিতায় সেই কথাই বিধৃত – ‘বিষম দখলীকৃত এ শহর/ পুত্রহীন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করম্নন/ যন্ত্রণা জর্জর ঐ বাণীহীন বিমর্ষ কবিকে/… জননীকে হারিয়ে সম্প্রতি খাপছাড়া/ ঘোরে ইতসত্মত তাকে জিজ্ঞেস করম্নন/ হায় শামিত্মপ্রিয় ভদ্রজন,/ এখন বলবে তারা সমস্বরে। যুদ্ধই উদ্ধার।’ (‘উদ্ধার’)

‘উদ্ধার’ ও ‘কাক’ কবিতাদ্বয় শামসুর রাহমানকে উদ্ধার করেছে আটকেপড়া বৃত্তাবদ্ধ জীবন থেকে। ‘উদ্ধার’ কবিতাটির কথা পূর্বেই উলেস্নখ করা হয়েছে। ‘কাক’ কবিতাটি আকারে কাকের মতো ছোট হলেও এর মধ্যে বিধৃত হয়েছে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাসত্মব সমাজ আলেখ্য। মাঠে কোনো গরম্ন নেই, রাখাল ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। শূন্য মাঠ, নির্বাক বৃক্ষ, নগ্ন রৌদ্র, স্পন্দমান কাক – এগুলো হাহাকার ও শূন্যতার প্রতীক। নিম্নে কবিতাটি তুলে ধরা হলো –

গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরম্ন/ নেই কোনো, রাখাল উধাও, রম্নক্ষ সরম্ন/ আল খাঁ খাঁ, পথ পার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক/ নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।

বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের একটি উলেস্নখযোগ্য স্মৃতিচারণমূলক কবিতা হচ্ছে ‘মধুস্মৃতি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রেসেত্মারাঁর নাম মধুর ক্যান্টিন। যার নাম অনুসারে এই রেসেত্মারাঁর নামকরণ করা হয়েছে, তিনি হলেন ‘শ্রী মধুসূদন দে’। মধুদা বলে তিনি সকলের কাছে অতিপরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সকলের প্রিয় মানুষ। এই মধুর ক্যান্টিন ছিল আমাদের সকল জাতীয় আন্দোলনের সূতিকাগার। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে মধুদাকে ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাই মধুদার স্মৃতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে শামসুর রাহমান লিখলেন অমর কবিতা ‘মধুস্মৃতি’ কবিতাটি। যেমন – ‘আপনার নীল লুঙ্গি মিশেছে আকাশে,/ মেঘে ভাসমান কাউন্টার। বেলা যায়, বেলা যায়/ত্রিকালোজ্ঞ পাখী উড়ে, কখনো স্মৃতির খড়কুটো/ ব্যাকুল জমায়। আপনার স্বাধীন সহিষ্ণু মুখ – /হায়। আমরাতো বন্দী আজো – মেঘের কুসুম থেকে/ জেগে ওঠে, ক্যাশবাক্স রঙিন বেলুন হয়ে উড়ে।’

মধুদার মতো প্রিয় মানুষকে খুন করায় কবি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মাতৃভূমিকে যারা গোরস্তানে পরিণত করেছে তাদের বিরম্নদ্ধে তিনি অভিশাপের বাণী উচ্চারণ করেছে। ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থে ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতায় তা ফুটে উঠেছে। এই ধরনের অভিশাপের বাণী  বাংলা কবিতায় সম্ভবত প্রথম ধ্বনিত হয়েছে এবং তা শামসুর রাহমানের কবিতায়। যেমন – ‘আমাকে করেছে বাধ্য যারা/ আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রম্নত/ সিঁড়ি ভেঙে যেতে,/ ভাসতে নদীতে আর বন বাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে/ অভিশাপ দিচ্ছি, ওরা বিশাল গলায়/ নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিত নাছোড় মৃতদেহ – / অভিশাপ দিচ্ছি। ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার/ কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, সে রক্ত বাংলায়/ বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র/ জোয়ারের মতো/ অভিশাপ দিচ্ছি।’

শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দীর্ঘ নয় মাসের করম্নণ চিত্র বর্ণনা করেছেন বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাংশে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো – ‘তখন ঢাকা এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। সুদীর্ঘ ন’মাস আমরা যে পরিবেশে বাস করেছি তাকে কাফকার জগৎ বললে কিছুই বলা হয় না। উৎপীড়ন, হত্যা এবং সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে রচনা করেছিল এক ভয়ংকর তমসাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় পটভূমি। আমরা তৃষিত হয়ে পড়েছিলাম এক ঝলক আলোর জন্যে। নীরন্ধ শ্বাসরোধকারী সেলের ভিতর বন্দী যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে এক ফোটা আলোর জন্য, ঠিক তেমনি। ঘরের দরোজা জানালা বন্ধ, শিশুরা নিশ্চুপ,ফৌজী জিপের গর্জন, ট্রাকের ঘর্ঘর, বুটের শব্দ, আগুন, আর্তনাদ আমরা এই নিয়েই ঢাকা ছিলাম তখন। আমরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতাম। সব সময় মনে হতো কেউ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ঘুমের ভেতর চিৎকার করে উঠতাম কোনো কোনো রাতে। বধ্যভূমির ধারে বেঁধে রাখা জীবজন্তুর অনুরূপ আমরা আতঙ্কে জেনেছি নিত্যসঙ্গী বলে। এমন কোনো দিনের কথা মনে করতে পারি না, যেদিন হত্যা কিংবা ধরপাকড়ের কোনো না কোনো খবর কানে না আসতো।’ এই ছিল যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাসত্মবচিত্র। এই বিভীষিকাময় সময়ে লেখা তাঁর একটি কবিতায় যুদ্ধের চিত্র প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। যেমন – কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে।/ মনে হয়, ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই/ দিন দুপুরেই জীপে একজন তরম্নণকে কানামাছি করে/ নিয়ে যায় ওরা।/ মনে হয়, চোখ বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে।/ বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গায় কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে,/ মনে হয়, স্বাধীনতা লখিন্দর যেন,/ বেহুলা বিহীন,/ জলেরই ভেলায় ভাসমান,/ যখন শহরে ফাটে বোমা, হাতবোমা, অকস্মাৎ/ ফাটে ফৌজী  ট্রাকের ভেতর,/ মনে হয়, স্বাধীনতা গর্জে ওঠে ক্রোধান্বিত দেবতার মতো।

‘তুমি বলেছিলে’ কবিতায় বর্বর হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে নিঃসংকোচে। নয়াবাজার, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মসজিদ, মন্দির, মানচিত্র, পুরনো দলিল ইত্যাদি ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। একে-একে তারা সব ধ্বংস করেছে। ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহর ছেড়ে পালাচ্ছে সবাই দিকবিদিক। বনপোড়া হরিণী যেমন বন থেকে পালায়, তেমনি নবজাতককে বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী শহর ছেড়ে পালাচ্ছে।

দাউ-দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়াবাজার/ পুড়ছে দোকানপাট। কাঠ/ লোহালক্কড় সত্মূপ মসজিদ এবং মন্দির/…

অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তাচষে জঙ্গী জীপ/ আর্ত শব্দ সবখানে। আমাদের দু’জনের। মুখে আগুন/ খরতাপ। আলিঙ্গনে থরোথরো/ তুমি বলেছিলে।/ আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও।

(‘তুমি বলেছিলে’)

প্রসঙ্গক্রমে কবি জসীম উদ্দীনের ‘দগ্ধ গ্রাম’ কবিতাটির কথা উলেস্নখ করা যায়। একাত্তরের রণাঙ্গনের সময় বাংলার গ্রামের বাসত্মব চিত্র অংকন করা হয়েছে এই কবিতায় –

কি সে কি হইলো। পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি,/ সারাগাঁও ভরি আগুন জ্বালিয়ে হাসিল অট্টহাসি।/ মার কোল হতে শিশুরে কাড়িয়া কাটিলো যে খান খান,/ পিতার সামনে মেয়েরে কাটিয়া করিল রক্তস্নান।/ কে কাহার তরে কাঁদিবে কোথায় যূপকাষ্ঠের গাঁয়।/ শত সহস্র পুড়িল মানুষ ভীষণ খড়ক ধায়।

ঘাতক খান সেনারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে নির্বিচারে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে অট্টহাসির উৎসবে মেতে উঠত। মায়ের কোলের শিশু ও পিতার সামনে মেয়েকে হত্যা করার কথা বলা হয়েছে এ-কবিতায়। জসীম উদ্দীনের এই কবিতায় যেমন দগ্ধ গ্রামের ছবি পাই, তেমনি শামসুর রাহমানের ‘তুমি বলেছিলে’ কবিতায় দগ্ধ শহরের অবস্থার বর্ণনা মেলে।

অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনকে পটভূমি করে রচনা করেন বিখ্যাত নাটক কবর। তিনি ছিলেন ভাষা-আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত নাটক রক্তাক্ত প্রান্তর। বিজয় যখন আমাদের হাতের মুঠোয় অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের মাত্র দুদিন পূর্বে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঘাতকরা তাঁকে হত্যা করে। একই সঙ্গে শহীদ মুনীর চৌধুরীর মতো আমরা হারালাম আরো কয়েকজন প্রাগ্রসর বুদ্ধিজীবীকে। যেমন – গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, শহীদুলস্না কায়সার, আনোয়ার পাশা, আবদুল আলীম প্রমুখ। ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ কবিতায় মুনীর চৌধুরী ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর কথা শামসুর রাহমান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বাঙালি জাতি যখন বিজয়ের আনন্দে উলস্নাস করছে তখন মুনীর চৌধুরীর মতো অসীম সাহসী ব্যক্তিরা মুক্তিযুদ্ধের ফল ভোগ করতে পারলেন না। তাই হয়তো কবি আর ‘এই যে কেমন আছো শামসুর রাহমান তুমি?’ বলে কুশল জিজ্ঞেস করবেন না। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে তিনি চির অমস্নান হয়ে থাকবেন। তাই মুনীর চৌধুরীকে উদ্দেশ করে শামসুর রাহমান বলেন – ‘শুনুন মুনীর ভাই/ কালো-জঙ্গী পায়ের তলায় চাপা পড়া/ আপনার বাংলাদেশ লক্ষ লক্ষ বুটের চেয়েও/ বহু ক্রোশ বড় বলে বর্গিরা উধাও। বহুদিন/ পরে আজ আমাদের মাতৃভূমি হয়েছে স্বদেশ।’ (‘রক্তাক্ত প্রান্তর’)

যুদ্ধকালীন সময়ে একটি অতি পরিচিত নাম গেরিলা। যুদ্ধের সময় ছদ্মবেশ ধারণ করে শত্রম্ন বিনাশে যারা স্বাধীনতার সপক্ষে কাজ করেছেন তাদের সাধারণত আমরা গেরিলা বলে জানি। এই গেরিলাও শামসুর রাহমানের কবিতায় বিষয়বস্ত্ত হয়ে ধরা পড়েছে। কিন্তু এই গেরিলা দেখতে কেমন, সে কী ধরনের পোশাক-আশাক পরে চলাফেরা করে, নাকি মাথায় জটাজাল। কেউ কি তাকে দেখেনি? দেখে থাকলেও তাকে কেউ চিনতে পারেনি। আসলে এটা জটাজালধারী গেরিলা, আমাদের অপরিচিত কেউ নয়। সে আমাদেরই ভাই, আমাদেরই সমত্মান। যেমন –

দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে/ কুলজি তোমার আতিপাতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে/ জানু গুপ্তচর, সৈন্য পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন/ করে খোঁজে প্রতিঘরে। পারলে নীলিমা চিরে বের করতো/ তোমাকে ওরা। দিতো ডুব গহন পাতালে।/ তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর/ সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া,/ তুমি তো আমার ভাই, নতুন, সমত্মান আমার।

(‘গেরিলা’)

অনেকে প্রশ্ন করে গেরিলা দেখতে কেমন। খুঁজে কুলুজি আতিপাতি অর্থাৎ গেরিলার ঠিকানা খোঁজে ঘাতকরা। জানু গুপ্তচররা ও সৈন্যরা পাড়ায়-পাড়ায় প্রতিঘরে গেরিলাদের খুঁজে বেড়ায়। প্রয়োজনে নীল আকাশ ভেদ করতে কিংবা পাতালে ডুব দিতেও শত্রম্নদের কুণ্ঠা নেই। অথচ সে আমাদেরই সমত্মান, আমাদেরই ভাই। গেরিলা আর ভবিষ্যৎ হাত ধরাধরি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ‘গেরিলা’ শিরোনামে কবিতা লিখেছেন। গেরিলারা দক্ষিণ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ, অ্যাংগোলা ও মোজাম্বিকে সতর্ক ও নিঃশব্দ পায়ে অবিরাম হেঁটে চলে। তাই গেরিলা সম্পর্কে কবি বলেছেন -‘নিসর্গের ভেতর দিয়ে/ সতর্ক নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে যাও। সারাদিন সারারাত যখন গ্রামগুলো/ জনশূন্য চাতাল চিড় গাওয়া আর উপাসনা চত্বরগুলো/ অনবরত ঢেকে যায়-নিঃশ্বাসের শব্দের ভেতরে/ দাউ দাউ। নাপামের/ মধ্যে তুমি/ হেঁটে যাও।/ উদ্যত/ একাকী জনশূন্য জনপদে/‘উন্মূল এক চিতা।’                 (‘গেরিলা’, সৈয়দ শামসুল হক)

ঘাতকদের বর্বরতা দেখে আমাদের কবিরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কবিতার পঙ্ক্তিতে সেই ক্ষোভ ও ঘৃণা আরো তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থের ‘রক্তসেচ’ কবিতায় তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ‘টিক্কার ইউনিফর্মে শিশুর মগজ/ যুবকের পাঁজরের গুঁড়ো।/নিয়াজীর টুপিতে রক্তের প্রস্রবণ/ ফরমান আলীর টাইএর নীচে ঝুলন্ত তরম্নণী… তুমি কি তাদের কখনো করবে ক্ষমা?’ (‘রক্তসেচ’)

মাতৃভূমি শামসুর রাহমানকে যে কবিতাগুচ্ছ উপহার দিয়েছে দুঃসময়ের মুখোমুখিফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো তারই স্বাক্ষর বহন করে। শাসকের অত্যাচার, সত্তরের প্রলয়ঙ্করী সর্বগ্রাসী জলোচ্ছ্বাস ও একাত্তরের রক্তোচ্ছ্বাস – এই তিন প্রকারের প্রেরণা

কাজ করেছে তাঁর কবিতার মধ্যে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ফলবান হচ্ছে রক্তাক্ত একাত্তর। ‘স্যামসন’ কবিতাটি শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের চিত্র এবং তা ‘টেলেমেকাসে’র স্বগোত্র। ‘টেলেমেকাসে’ কবি যেমন ছদ্মবেশ ধারণ করে মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন তেমনি ‘স্যামসনে’ও মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এরপরও এ-কবিতা যে মুখোশ ছিঁড়ে সহজেই বেরিয়ে পড়েছে তার ও মাতৃভূমির মুখ। একাত্তর, একাত্তরের স্মৃতি ও স্বাধীনতা-উত্তর নিজস্ব অভিজ্ঞতাজাত কবিতাগুচ্ছ – ‘স্বাধীনতা একটি বিদ্রোহী কবিতার নাম’, ‘বহু কিছু থেকে দু’টি’, ‘ম্যাজিক’, ‘বারবার ফিরে আসে’, ‘জাল’, ‘কি করে লুকাবে’, ‘হে বঙ্গ’ (দুঃসময়ের মুখোমুখি) ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘অস্থি’, ভীতিচিহ্নগুলি’, ‘এ কেমন বৈরী তুমি’, ‘মহররমী  প্রহর’, ‘স্মৃতির পুরাণ’, ‘আমি তো মেলারই লোক’, ‘একদিন রাস্তায়’, ‘এই মেলা’ (ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা) এর মধ্যে কিছু কবিতায় একাত্তরের রক্তপাতের হৃদয়স্পর্শী বিবরণ দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতা কামনার সঙ্গে। দুঃসময়ের মুখোমুখিফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যদ্বয়ের একশ্রেণির কবিতা যুদ্ধকালের চিত্র ও স্বাধীনতা-আকাঙক্ষার শিহরণের বহিঃপ্রকাশ এবং অন্য আরেক শ্রেণির কবিতায় স্থান পেয়েছে যুদ্ধোত্তর দুঃস্বপ্ন ও উন্মত্ততা। যেমন – ‘অস্থি’ এবং ‘ভীতিচিহ্নগুলি’ কবিতায়। স্বাধীনতা শামসুর রাহমানের কাম্য ছিল; কিস্ত্ত স্বাধীনতা পাওয়ার পর কবির মনে কী কোনো ক্ষোভের জন্ম হয়েছে? ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থের রক্তপাত ও লাশময়তা থেকে কবি উঠে আসতে চেয়েছেন। কাঁটার পরিবর্তে তিনি চেয়েছেন গোলাপফুল এবং দাবি করেছেন ‘ছড়িয়ে দাও পদ্মকেশর বাংলাদেশ’।

দুঃসময়ের মুখোমুখি কাব্যগ্রন্থের ‘জাল’ কবিতায় হতাশা তীব্র হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন -খুব কালো জাল পড়েছিলো ঠিকই চতুর্দিকে, আমি/ আটকা পড়িনি ভাগ্যবলে। বোকা হবার মতন/ বেঁচে আছি অপ্রস্ত্তত। মৃত্যুর প্রতীক্ষা সর্বক্ষণ/ জুড়ে রয় চেতনায়। মৃত্যু আতংকেরই অনুগামী।/ এখন তো বেঁচে থাকাটাই হাস্যকর ভয়ানক।/ কখন যে দৃষ্টি থেকে পৃথিবীর আলোক/ মুছে যাবে। দেহ থেকে তাপ। কাকের মতোই চোখ/ বন্ধ করে  জীবন গচ্ছিত রাখি ফাটলে নিছক।

(‘জাল’, দুঃসময়ের মুখোমুখি)

শামসুর রাহমান সমকালীনতাকে সময় নামক হিংস্র পশু দ্বারা আক্রান্ত দেখেছেন। ফলে তাঁর প্রিয় ঢাকা শহর ও প্রিয় জন্মভূমি দাঁড়িয়েছে দুঃসময়ের মুখোমুখি। এই দুঃসময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসুস্থতারই ফসল। কবি শামসুর রাহমান ‘আত্মজৈবনিক’ কবিতায় চিত্রায়িত করেছেন ঘাতক সময়ের বিবরণ, যুদ্ধোত্তর দাঙ্গা ও মর্মামিত্মক স্বাধীনতা এবং  রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহীনতা।

যৌবন দুর্ভিক্ষ বিদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ভাঙে দেশ,/ এদিকে নেতার কন্ঠে নির্ভেজাল স্বদেশী আকুতি/ ভাষা খোঁজে আদর্শের ভরাডুবি মহাযুদ্ধ শেষে/ মঞ্চ তেরী, কে হবে নায়ক তবে? করি তার স্ত্ততি?

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি। অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পুনর্বাসিত হয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অপরদিকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর, এদেশীয়  স্বার্থান্বেষী এজেন্টরা যুদ্ধের সময় লুটপাট ও লুণ্ঠন করে রাতারাতি বড়লোক হয়েছেন এবং সগর্বে এরাই রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাচ্ছেন। তাই কবি ক্ষোভ ও দুঃখে শেস্নষ প্রকাশ করেছেন। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেন, তাঁকে যেন একজন তুখোড় রাজাকার বানিয়ে দেন। সিরাজ উদ দৌলøvর সঙ্গে মীরজাফরের যে-সম্পর্ক, মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে রাজাকারের সে-সম্পর্ক। কবি সেই ঘৃণিত রাজাকার হওয়ার বাসনা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে আমাদের নষ্ট সময়কেই চিহ্নিত করেছেন তাঁর কবিতায়। দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে কাব্যগ্রন্থের ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতায় শামসুর রাহমান তাঁর ক্ষোভকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে –

হে পাক পরোয়ার দেগার, হে বিশ্বপালক

আপনি আমাকে লহমায়

একজন তুখোড় রাজাকার করে দিন। তা হলেই আমি

দীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায়

তেল ঢালতে পারবো অবিচল।

গরীবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর

মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে

ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগ্বিদিক আর সবার নাকের তলায়

একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো অহর্নিশ

কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো অবকাঠামো।

 

এ ছাড়া বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের ‘আমিত্মগোনে’, ‘জনৈক পাঠান সৈনিক’, ‘শমীবৃক্ষ’, ‘প্রতিটি অক্ষরে’, ‘উদ্বাস্ত্ত’, ‘মৃতেরা’, ‘আমাদের মৃত্যু আসে’, ‘ধ্বসত্ম দ্বারকায়’ ইত্যাদি কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ, যুদ্ধকালীন সময় ও যুদ্ধোত্তর সময়ের বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শামসুর রাহমান দেশত্যাগ করে পালিয়ে যাননি। তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। দেশের সাধারণ মানুষের জ্বালা, যন্ত্রণা, ক্ষোভ, ক্রোধ ও ঘৃণা প্রভৃতি তিনি নিজের করে নিয়েছিলেন এবং সেই চেতনার আলোকে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলো রচিত হয়েছে।

বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে এই তুখোড় তরম্নণ কবি সেই বর্বরোচিত হত্যাকা–র বিরম্নদ্ধে ঘৃণা প্রদর্শন করে কবিতা লিখে অংশগ্রহণ করেছিলেন আমাদের প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সেই জাতীয় চেতনারই বর্ধিত ও চূড়ান্ত পরিণতি। এই পর্বেও শামসুর রাহমান সমান সক্রিয় ছিলেন। গণআন্দোলন, স্বদেশ চেতনা, মধ্যবিত্তের পরাজয়, অভ্যুত্থান, যুদ্ধকালীন আর যুদ্ধোত্তর সময়ের অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞানকে তিনি মুদ্রিত করেছেন তাঁর কবিতায়। শামসুর রাহমান প্রথমদিকে ছিলেন রোম্যান্টিক – নারী ও প্রকৃতিতে নিবেদিত, শব্দে ও ছন্দে ঝংকৃত এবং জীবনানন্দে নিমজ্জিত। দ্বিতীয় গ্রন্থ থেকেই শামসুর রাহমান রোম্যান্টিক অবস্থান ছেড়ে দেশ-কাল-সমাজ-প্রতিবেশের দিকে যাত্রা করেন। পরিশেষে বলা যায়, শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক কবিতাগুলো আমাদের জাতীয় চেতনারই হীরকখচিত অংশ।

 

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকা

শামসুর রাহমান নিঃসঙ্গ শেরপা, হুমায়ুন আজাদ, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৩।

বাংলাদেশের আধুনিক কাব্য পরিচয়, দীপ্তি ত্রিপাঠী, কলকাতা, ১৯৯৪।

আধুনিক কবি ও কবিতা, হাসান হাফিজুর রহমান, বাংলা একাডেমি, ১৯৭৩।

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, আবুল হাসনাত-সম্পাদিত, সন্ধানী  প্রকাশনী, ১৯৯১।

বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার কবিতা : তুলনামূলক ধারা,   মাসুদুজ্জামান, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩।

পূর্ব বাংলার রাজনীতি-সংস্কৃতি ও কবিতা, সাঈদ উর রহমান, ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৩।

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, রফিকুল ইসলাম, সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ, দিলারা হাফিজ, বাংলা একাডেমি, ২০০২।