শামসুর রাহমান : বাংলার শ্রেষ্ঠ নাগরিক-কবি

কমরুদ্দিন আহমদ

নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতা আধুনিক বাংলা কবিতার আশ্রয়। শহুরে যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাত, ক্লান্তি, নৈরাশ্য, আত্মবিরোধ, অনিকেত মনোভাব ইত্যাদি তিলক পরিধান করে তিরিশোত্তর আধুনিক কবিতা তার রংরিক্ত শোভাযাত্রা শুরু করে। পঞ্চ আধুনিক – বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে ও অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা নগরকেন্দ্রিক সভ্যতাকে ধারণ করলেও তাঁরা কেউই বাংলা সাহিত্যে নাগরিক কবি হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত হননি। শামসুর রাহমান আধুনিক কবিদের উত্তরসূরি। আক্ষরিক অর্থে তিনি বাংলা সাহিত্যের নাগরিক-কবি। সত্যিকার অর্থে শামসুর রাহমানের কবিতায় নগরকেন্দ্রিক সমকালের বিবর্ণ প্রতিবেশ পৃথিবীর চৌচির মুখচ্ছবি অঙ্কিত। স্বপ্নসৌন্দর্যময় মনোবিশ্ব থেকে তিনি স্খলিত পদপাতে উঠে এসেছেন প্রতিবেশ-পৃথিবীতে। সেই প্রতিবেশ-পৃথিবী স্পষ্ট নগর। নগরটি মানচিত্রসহ নির্দেশ করা সম্ভব; যার নাম ঢাকা। বিশ্বের পটভূমিকায় বাংলাদেশে নগর তথা যথার্থ নগর ঢাকাই। এই ঢাকার অধিবাসী শামসুর রাহমান বাংলাকাব্যে নাগরিকতার ধারক।

আমরা জানি, মধ্যযুগের শেষ কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাগরিক-কবি। নগর ও পল্লিজীবনের প্রেক্ষাপটে ভারতচন্দ্রের জীবন ও কর্মকীর্তি। কিন্তু যে-অর্থে শামসুর রাহমান নাগরিক-কবি, সে-অর্থে ভারতচন্দ্র নন। ভারতচন্দ্র বিশেষ ও সীমিত অর্থে নাগরিক। তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নগরজীবনের পরিবেশের মধ্যে উদ্ঘাটিত। অবস্থার পাকে তিনি নগরজীবনের বিচিত্র তন্তুজালের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। ফলে নগরজীবনের বিভিন্ন দিক ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ তাঁর হয়েছে। তিনি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি। দরবারি সমাজের শূন্য গর্ভপর্দ ও জৌলুস, নগরসমাজের অনাচার বিলাস ও বিভ্রমের মধ্যে তাঁর দৃষ্টি ও বুদ্ধিকে তিনি আচ্ছন্ন হতে দেননি। নিছক জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষিত অভিজাত সম্প্রদায় ও দরবারি সমাজের রুচি, অহংকার, অভিমান, বিলাসলালসার ক্ষুধা তাঁকে মিটাতে হয়েছে। এজন্য মধ্যযুগের দেবনির্ভর কাব্যচেতনা ও নগরকেন্দ্রিক সমাজের মনোরঞ্জনের জন্য ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে নাগরিকতা আমদানি করেছেন মাত্র। তাঁর নাগরিকতা স্বতঃস্ফূর্ত নয়, এজন্য আধুনিক অর্থে ভারতচন্দ্র নাগরিক কবি নন। ভারতচন্দ্রের কবিকর্মে সৃষ্টিমূলক জীবনদর্শন ও সাহিত্যের প্রেরণা শিথিল। মূলত নাগরিক সমাজের শূন্যগর্ভতাকে তীক্ষè ব্যঙ্গ ও বিদ্রƒপের বাণে বিদ্ধ করেছেন ভারতচন্দ্র। তবে এ-কথা সত্য, বাংলা কাব্যে ভারতচন্দ্রই নাগরিকতার বীজ বপন করেন।

শামসুর রাহমান বাংলা কাব্যে সর্বসময় নাগরিকতার ধারক। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৫৯)। এখানে তাঁর মনোবিশ্বের চূড়ায় উড্ডীন পতাকার মূলে রয়েছে ঢাকার বস্তি-গ্রাম-নগরের মিশ্র জনপদ। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি, ব্যর্থতা, শোভাহীনতা, নৈঃসঙ্গ্য শামসুর রাহমান সেলাই করে দিয়েছেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের অনেক স্তবকে। ‘কোনো পরিচিতাকে’, ‘তিনশো টাকার আমি’, ‘আত্মজীবনীর খসড়া’, ‘যুদ্ধ’ প্রভৃতি প্রতিবেশ-নিয়ন্ত্রিত কবিতায় – এমনকি ‘রূপালি’ স্বপ্নের মতো স্বপ্নঝরা কবিতায়ও। যেমন :

এবং এখন জানি করুণ কাঠিন্য ভরা হাতে

আত্মায় নিয়েছো তুলে নগরের ফেনিল মদিরা,

আবর্তে আবর্তে মত্ত কাম, প্রাণে স্থির অন্ধগলি।

হে বহুবল্লভা তুমি আজ কড়ায় ক্রান্তিতে শুধু

গুনে নাও নিষ্কাশিত যৌবনের অকুণ্ঠ মজুরি।

(‘কোনো পরিচিতাকে’ প্র. গা., দ্বি. মৃ. আ.)

 

শামসুর রাহমানের কবিতায় বিদ্যমান নগরকেন্দ্রিক চেতনার প্রবল প্রকাশ কারো চোখ এড়ায় না। শহুরে মানুষের জীবনের ক্লান্তি, নৈরাশ্যবোধ ও অনিকেত মনোভাবের বাঙ্ময় প্রকাশ পাঠককে নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করে। তিনি তা পেয়েছেন উত্তরাধিকারসূত্রে তিরিশের কবিদের কাছে। তাঁর কবিতার-মননধর্মিতা, জ্ঞানের বিপুলভারে সৃষ্ট দুরূহতা, বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে গ্রহণপ্রবণতা সবই আধুনিক কবিতার মৌল চেতনা থেকেই পাওয়া। কিন্তু স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে, বর্ণিল তাঁর কাব্যজগৎ অপূর্ব ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ। যেমন :

শহর জেগেছে, দূরে ঘণ্টায় প্রাণের ধ্বনি,

রোগীর শরীরে নামলো নিদ্রা হাসপাতালে,

যারা কোনো দিন ভুলেও পেলো না আপন জন,

ছেঁড়াখোঁড়া সেই ক’জন রাতের জুয়োশেষের

ক্লান্তিতে ফের ভিড়লো ধোঁয়াটে রেস্তোরাঁয়।

(‘আত্মজীবনী খসড়া’,  প্র. গা., দ্বি. মৃ. আ.)

 

অনেক কবির মতো শামসুর রাহমানের প্রকৃতি-নিসর্গ-নন্দনের বরপুত্র নয়, কণ্টকিত নগরসভ্যতার নীল অভিশাপ। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, কর্মজীবন সবই ঢাকায়। আধুনিক কবিতা মাত্রই অনিবার্যভাবে নাগরিক; কিন্তু শামসুর রাহমানের কবিতা শুধু নাগরিক নয়, আরো কিছু! তাঁর       প্রকৃতি-চেতনাও নগরকেন্দ্রিক। শিশিরের জলে রূপালি স্নান সত্ত্বেও তিনি ভোলেন না তাঁর প্রতিবেশ পৃথিবীতে উত্তুঙ্গ উত্তাল এবং ভয়াল নগরবাস্তবতা অপেক্ষা করে তাঁর আশপাশে। যেমন :

নোনাধরা মৃত ফ্যাকাশে দেয়ালে প্রেতছায়া দেখে, আসন্ন

ভোরে

দু’টুকরো রুটি

না-পাওয়ার ভয়ে শীতের রাতেও এক গা ঘুমেই বিবর্ণ হই,

কোনো-একদিন গাঢ় উল্লাসে ছিঁড়ে খাবে টুঁটি

হয়তো হিংস্র নেকড়ের পাল, তবু তুলে দিয়ে দরজার খিল

সত্তাসূর্যে যেসাসের ক্ষমামেখে নিয়ে শুধু গড়ি উজ্জ্বল কথার

মিছিল।

শহরের কোনো নর্দমাতেই, – সেখানে নোংরা পিছল জলের

অগুনতি ঢেউ

খাবো কিছুকাল।

(‘রূপালি স্নান’, প্র. গা., দ্বি. মৃ. আ.)

 

তাঁর কবিতায় নাগরিকতার এ-অবস্থান তিরিশি কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাবয়ব। দুই ভিন্ন মনন স্রোত তথা রোমান্টিকতা ও ক্ল্যাসিকতা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি শামসুর রাহমানের মানসপটে। এ-কারণে প্রথমাবধি তিনি নিসর্গ সচেতন ও নগর স্পন্দিত; উচ্ছল জীবন মদিরাকাক্সক্ষী ও নির্বিন্ন হতাশ; উদ্দীপিত ও ভীত; চন্দ্রলোক পিপাসু ও খটখটে রৌদ্রঝলসিত পথের পথিক।

কবিদের কবি জীবনানন্দ দাশের নগর ও নিসর্গ চেতনায় বিবাদ ছিল, শামসুর রাহমানের তা নেই। নগরজীবনের ভালো-মন্দ সবকিছু স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণের শক্তি তাঁর তৈরি হয়েছিল জন্ম থেকেই। কারণ তিনি প্রতিনিয়ত যা দেখেছেন তা তাঁর গা-সওয়া হয়ে গেছে। অন্য পক্ষে জীবনানন্দ ছিলেন গ্রামবাংলার সন্তান। আর শামসুর রাহমানের অস্থিমজ্জায় আন্দোলিত নগর। এই জন্য নির্দ্বিধায় বলতে পারেন :

এইতো এখান নর্দমার ধারে কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন

প্রৌঢ় মাটির ভাঁড়ে

ঢক্ঢক্ শব্দ করে গিলিছে তাড়ি,

…আর রাত্রির তারাময় আঁধারে তারা হাতের মুঠোয়

কামনা করেছে অপ্সরীর স্তন, তারপর বিষাক্ত কোনো

বাষ্পে

স্ফীত হয়ে টলে টলে চলে গেছে যে যার গণিকার ঘরে।

(‘সেই ঘোড়াটা’,  প্র. গা., দ্বি. মৃ. আ.)

 

এই নারকীয় নগর প্রতিবেশেও আকাশে ওঠে দুর্মর চাঁদ; ‘বাউ-ুলে ময়লা ভিখারী আর লম্পট জোচ্চোর গ-মূর্খ আর ভ-ফকির অথবা অর্ধমগ্ন ভস্মমাখা উন্মাদিনী বেহেড-মাতাল’ অধ্যুষিত এ-শহরে কখনো ‘রজনীগন্ধার ডালে কাগজের মতো চাঁদ বুনে স্বপ্নের রূপালি পাড়’। নগরসভ্যতার ভালো-মন্দের সংমিশ্রণে শামসুর রাহমানের মনোবিশ্ব। তাই সুবরাতি মিস্ত্রি ও তাঁর ‘মনের মানুষ’ ‘দিলের হকদার’।

শামসুর রাহমানের প্রথম দিকের কবিতায় জীবনানন্দের ছায়া আছে। কিন্তু পরবর্তী বিবর্তনের নিরিখে শামসুর রাহমান জীবনানন্দ  থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। জীবনানন্দ তিরিশের কবি আর শামসুর রাহমান সাহিত্যে এসেছেন পঞ্চাশের শুরুতে। সংগত কারণেই বাংলা কাব্যের এ দুই প্রধান কবির মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতার কারণে স্বভাবগত পার্থক্য বিদ্যমান। পরিণত বয়সের কাব্যিক টেম্পারামেন্টের দিক থেকে এ দুই কবি যেন দুই মেরুর অধিবাসী। জীবনানন্দ নিসর্গলগ্ন এবং বিস্ময়াবিষ্ট। শামসুর রাহমানের মুগ্ধতা নেই, আছে এলিটীয় মোহভঙ্গ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিবমিষা। আয়রনিপূর্ণ বক্রোক্তি, শ্লেষ এবং তির্যক ভঙ্গির দিক থেকে দুজনের ভেতর পরোক্ষ সাযুজ্য হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু জীবনানন্দ শেষ কাব্যগ্রন্থ পর্যন্ত মানবসভ্যতা এবং ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মানুষকে স্থাপন করে তার মহত্ত্ব এবং নীচতা উভয় বৈশিষ্ট্যকে ধরার চেষ্টা করে গেছেন। জীবনানন্দের ভালোবাসা এবং ঘৃণা দুটোই ছিল চরম পর্যায়ের। সে-তুলনায় একজন সত্যিকারের নাগরিক মানুষের মতো শামসুর রাহমান স্থিতধী, অনেক সময় নিরাসক্ত। তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং দৈনন্দিন শহুরে বাস্তবের প্রেক্ষাপটে নিজেকে বিশ্লেষণ করা নিয়ে মগ্ন থাকার ফলে বড় ধরনের তিক্ততা তাকে গ্রাস করেনি। শামসুর রাহমানের প্রতিবাদেও এক প্রকার পরিশীলতা লক্ষণীয়। তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা আল মাহমুদের মতো লিরিকে আক্রান্ত কবি নন। তাঁর বিষয়বৈচিত্র্য বিশাল; আধুনিক জটিল জীবনের প্রায় সব স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, বিষাদ এবং অন্তর্দহন উপস্থিত তাঁর কবিতায়, অনেক সময় যা চিত্রকল্প বা রূপকের আশ্রয়ে দেশের সীমারেখা অতিক্রম করে। বাংলা কবিতার ভুবনে এই মেজাজ অনন্য এবং অশ্রুতপূর্ব।

নাগরিক-কবি শামসুর রাহমানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ রৌদ্র করোটিতের মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার পারিপার্শ্বিক জগৎ কবিতার রক্ত-মাংসে রূপান্তরিত। তিনি স্বতন্ত্র এক কাব্যমেজাজ এবং কাব্যভঙ্গি আয়ত্ত করেছিলেন। তাঁর স্টাইলটি অংশত নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো। কিন্তু এই আপাত-সাদৃশ্য এক সময় পাঠকের মন থেকে অন্তর্হিত হয়; যখন পাঠক লক্ষ করেন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চূড়ান্তভাবে বিষয়নির্ভর। আর সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর সংক্রামক গীতলতা সত্ত্বেও, বামপন্থী রাজনীতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ।  জীবনের মাঝপথে এসে শামসুর রাহমানও প্রচ্ছন্নভাবে ‘র‌্যাডিকাল স্কুলে’র দিকে ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এই কবি মূলত নাগরিক-কবি। পাশ্চাত্যের ‘আরবান পোয়েটদের’ নৈঃসঙ্গ্য, বিষণœতা এবং সংশয়কে আশ্রয় করে শুরু হয়েছিল তাঁর কবিতা। মানব-মানবীর ভালোবাসার সম্পর্ক, নিসর্গপ্রীতি পঞ্চাশের অন্য কবিদের মতো তাঁর শুরুর দিকের কবিতায়ও এক বড় জায়গা জুড়ে ছিল। কিন্তু এ-ঘোর বা আচ্ছন্নতা কাটতে তাঁর সময় লাগেনি। অল্পদিনের মধ্যে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন নাগরিক বাস্তবতার রূঢ় জমিনে।

এক নাগরিক বিষাদময় রোমান্টিকতা দিয়ে শামসুর রাহমানের কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরুতে তা যত না ছিল সামষ্টিক, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল ব্যক্তিক বেদনার কথকতা। এখানে সমষ্টি-চেতনা উঁকিঝুঁকি মেরেছে বটে, তবে তা গেড়ে বসেনি। জাতিযতই নিও-কলোনিয়াল এনকাউন্টারের দিকে এগিয়েছে, কবির ভূমিকা ততই সমষ্টির দিকে ঝুঁকেছে। নান্দনিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক-সামাজিক দায়বদ্ধতা। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত তাঁর কবিতার ধারাকে বিবেচনায় আনলে ঔপনিবেশিক বৃত্তায়নবিরোধী কবিসত্তার বিবর্তন স্পষ্ট হতে থাকে। রৌদ্র করোটিতের মধ্যে কবি উচ্চারণ করলেন :

এদেশে হায়েনা, নেকড়ের পাল,

গোখরো, শকুন, জিন কি বেতাল

জটলা পাকায় রাস্তার ধারে।

জ্যান্ত মানুষ ঘুমায় ভাগাড়ে।

(‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’,  রৌ. ক.)

 

ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ মোটা দাগের এ হচ্ছে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনকাল। এ-শাসনের বিরুদ্ধে জাগরণ ও আন্দোলন, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের যে-কাব্য প্রতীতি গড়ে ওঠে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর শেষ হলেও তার ‘আফটার শক’ বাহাত্তর-তিয়াত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে রচিত শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থগুলো ঔপনিবেশিকতার পৌনঃপুনিকতার প্রশ্নে তাঁর অবস্থানের প্রাথমিক সাক্ষী। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে, রৌদ্র করোটিতে ১৯৬৩, বিধ্বস্ত নীলিমা ১৯৬৬, নিরালোকে দিব্যরথ ১৯৬৮, নিজ বাসভূমে ১৯৭০ এবং বন্দী শিবির থেকে ১৯৭২ সালে। পাকিস্তানের বয়স যখন অর্ধশতকও পেরোয়নি, শামসুর রাহমান বাইশ কি তেইশ বছরের যুবক। তখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রশ্নে পাকিস্তানের ভাষা ছাড়া শাসিতদের ভাষার গুরুত্ব ও অধিকারের বিষয়টি গোড়ায় নাকচ করে দিয়েছিল। ফলে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দেখা গেল ভাষা-আন্দোলনকে ঘিরে সর্বপ্রথম ‘কলোনাইজার কলোনাইজড এনকাউন্টার’ – ভাষার জন্য এই প্রথম কোনো জাতি রক্তাক্ত হলো, প্রাণ দিলো। স্বপ্নিল রোমান্টিকতা ছেড়ে শামসুর রাহমান বাক্সময় করলেন স্বপ্নভঙ্গের বাস্তবতা; উচ্চারিত হলো কবির অভিশাপ :

আগুন তাতা সাঁড়াশি দিয়ে তোমরা উপড়ে ফেলো আমার

দু’টি চোখ

সেই দু’টি চোখে যাদের প্রাপ্ত দীপ্তির মৃত্যুহীন, বিদ্রোহী

জ্বালায়

দেখেছি নির্মম আকাশের নিচে মানবিক মৃত্যুর তুহিন

স্তব্ধতা।

(‘একুশের সংকলন’,  হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত)

 

বাংলাদেশের উত্থান-পতনে (রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে) রাজধানী ঢাকা নগরীই আলোড়িত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সে-নগরের বাসিন্দা কবি শামসুর রাহমান। ’৪৭ থেকে ’৬১ পর্যন্ত কোনো কিছু তাকে না ছুঁয়ে যায়নি। ‘শামসুর রাহমান নামে আছে একজন, নিজের কাছেই/ বন্দি সর্বক্ষণ।/ প্রতিদিন শহরের সবচেয়ে করুণ গলির মুখচ্ছবি/ মুখের রেখায় নিয়ে হাঁটে ফুটপাতে/ সুনিবিড় রিশ্তা তার রহস্য নামক অতিশয়/ লতাগুল্মময় প্রান্তরের সাথে কেমন অচিন/ দৃশ্যাবলি সমেত বিপুল/ অদৃশ্যের সাথে… একজন পরী হ্যালো হ্যালো বলে, ডায়াল করছে অবিরাম/ মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হয়ে যায়।’ (‘পারিপার্শ্বিকের আড়ালে’,  শূন্যতায় তুমি শোকসভা)। ঢাকা নগরীর প্রকৃতি, পরিবেশ, তার চাঞ্চল্য, নিবিড়তা, যান্ত্রিকতা, সঙ্গমতা সবকিছুকে বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো কেউ একসঙ্গে স্বাভাবিকভাবে ধারণ করেছেন বলে আমার জানা নেই। বাংলা কাব্যে এজন্য তিনিই পুরোদস্তুর নাগরিক কবি। তিনি আমাদের সমসাময়িকতাকে শব্দে ধারণ করেছেন, ছন্দোবদ্ধ শব্দগুচ্ছে বন্দি করেছেন বাঙালির উত্থানের ইতিকথা। অর্ধশতাব্দীর অধিককাল ধরে তিনি হেঁটেছেন কবিতার কক্ষপথে, নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক নগরকেন্দ্রিক কাব্যভুবন।

ঢাকা শহরবাসী শামসুর রাহমান পর্যবেক্ষণ করেন সাতচল্লিশ- পরবর্তী নতুন রাজধানীকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশের পটভূমি। তাঁর কবিতায় উঠে আসে ঢাকা শহরের উদ্ভেদ্যমান ও চলমান জীবনের, যাপনের বিচিত্র চিত্র, যাতে পুরো নগরীর ছায়াপাত ঘটেছে। কবিতায় এ দুরূহ কাজটি তিনিই সুসম্পন্ন করেছেন।

প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, নিজ বাসভূমে এ পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করতে শামসুর রাহমান সময় দেন বিশ বছর। তাঁর লেখক জীবনের ছাপ্পান্ন-সাতান্ন বছরের মধ্যে পরবর্তী ছত্রিশ বছরে কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ষাটটি। বন্দী শিবির থেকে তাঁর মোড় পরিবর্তনের কাব্য। এ-কাব্যগ্রন্থেই তিনি প্রকৃত নিজস্বতা অর্জন করেন। তাঁর কবিতার বিষয় অবশ্য পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ নিজ বাসভূমে থেকেই ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। নিজ বাসভূমেতে তিনি প্রথম আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে সমসাময়িক সময়ের রূঢ় বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হন। পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ বন্দী শিবির থেকে হতে তাঁর নিজস্ব কণ্ঠ ধ্বনিত হলো। বন্দী শিবির থেকে আগেও কোনো কোনো কবিতায় কবির এই ব্যক্তিগত উচ্চারণের রেশ পাওয়া যায়, তবে তাতে ব্যাপকভাবে সুস্পষ্টরূপে দেখা দিয়েছিল বলে মনে হয় না। এখান থেকে তিনি জোরে এবং অনেক লোককে শুনিয়ে বলার প্রবণতায় উত্তীর্ণ হলেন। এই বাকভঙ্গিটা এমন ছোঁয়াচে, কথাগুলো যে পড়ে বা শোনে, সে ভাবে তার নিজের মনের কথা শুনছে। ভালো কবিতার কাজই তো এই লেখক ও পাঠককে মিলিয়ে দেওয়া। বন্দী শিবির থেকে শামসুর রাহমানকে শুধু তাঁর কণ্ঠই দেয়নি, পরবর্তীকালে তাঁর কবিতার একটি বড় অংশ যে আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বহির্মুখী হয়, একান্ত ব্যক্তিক উচ্চারণ থেকে সামাজিক-রাজনৈতিক পথ ধরে, তার মূলেও বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থ। একাত্তরের অভিজ্ঞতা শামসুর রাহমানকে আগাগোড়া বদলে দেয়। ঠিক যেন বিগত শতাব্দীর ছত্রিশ সালের স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ পাবলো নেরুদাকে এক যন্ত্রণাবিদ্ধ আত্মাচ্ছন্ন কবি থেকে সামাজিক অঙ্গীকারের কবিতে পরিণত করেছিল। শামসুর রাহমান এখানে নিজের মনের কথা যেভাবে বলেছেন তা তাঁর স্টাইল হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে তা কোনো নিয়মিত ছন্দের আওতায় আর থাকেনি, প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ডায়েরির মতো হয়ে গেল। সে যা হোক, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিসে তাঁর দাঁড়ানোর জায়গাটাই তাঁকে শেষ স্বীকৃতি এনে দেয়। অনেকদিন থেকে দেশকালের কথা বলাই তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় হয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর এই অবস্থান কবিতার পর কবিতায় এমন গভীর আবেগের সঙ্গে রঙে রসে প্রতিফলিত হয়, যাতে অচিরেই তাঁর সামাজিক মর্যাদাও নিঃসন্দেহে স্থির হয়ে যায়। সেইসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সভা, সমিতি, সম্মেলন, মিছিলে তাঁর অকুণ্ঠিত অংশগ্রহণ, বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রদান তাঁকে এক অন্য জনব্যক্তিত্বে পরিণত করে। আশির দশকে শামসুর রাহমানের খ্যাতি কবিতার সীমাবদ্ধ জগৎকে অতিক্রম করে যায়। তিনি তখন আমাদের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জগতের এক প্রতিভা। স্বৈরাচারী সরকারের নিপীড়ন, অনাচার এবং অজস্র বিচ্যুতির দ্ব্যর্থহীন প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে শামসুর রাহমান আশি-নব্বইয়ের দশকে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের সাহিত্য সাংস্কৃতিক ভুবনের কা-ারি।

নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থে শামসুর রাহমান জাতির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালায়’। ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯’ কবিতায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে দেখেছেন একটি জাতির আত্মবিকাশের ভাষার অফুরান সম্ভাবনা ও বিকাশমান জাতিসত্তার সম্ভাবনার আশাবাদরূপে। ‘হরতাল’ কবিতায় রাজনীতি ছাপিয়ে উপচে পড়েছে শামসুর রাহমান-নির্মিত বাংলাদেশের সমকালীন জীবনের উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর চিত্রকল্প। নিজ বাসভূমের কবি স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাঁকে পেছনে তাকাতে হয়নি কোনো কাব্য ঐতিহ্যের জন্য। এড়িয়ে গেছেন নজরুল, সমর সেন, আর সুভাষের প্রতিবাদী কাব্যধারাকে। তাঁর কাছে আসাদের রক্তমাখা শার্টের রক্তাক্ত রূপান্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে কবি স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে কাটালেন স্বদেশে। স্বেচ্ছাবন্দিত্বের কালেই রচিত হয়েছে তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘তোমাকে পাবার জন্যে, হে স্বাধীনতা’। বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্বের চিত্রকল্পকে শামসুর রাহমান গ্রথিত করলেন এই কালজয়ী কবিতাটিতে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চের ভাষণের স্বাধীনতা শব্দটির মতো শামসুর রাহমানের কবিতাটিকেও অনাগত কালের বাঙালিকে স্মরণ রাখতে হবে। এ-কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যসত্তাকে। আবেগের প্রবহমানতায় বাঙালি জীবনের যা কিছু সৃষ্টিশীল সবকিছুকে আত্মসাৎ করে এই কবিতাটিকে কবি বা কবিতায় নয়, ‘স্বাধীনতা’ নামক শব্দটির শিহরিত ব্যঞ্জনা পাঠকের কাছে প্রাপণীয় হয়ে ওঠে। যার ফলে শামসুর রাহমান বাংলাদেশের একজন প্রধান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদসহ বাংলা সাহিত্যের বহু খ্যাতিমান কবি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ নিজ নিজ ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও নাগরিক কবি হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করা যায় না। কারো কারো কবিতায় নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ছোঁয়া আছে মাত্র। সর্বময় নাগরিকতা নিয়ে কেউ নিজেকে উপস্থাপন করতে সমর্থ হননি। একমাত্র শামসুর রাহমানই বাংলাকাব্যে সর্বময় নাগরিকতার নন্দিত উপস্থাপক। জীবনযাপনে, নন্দনে-মননে শামসুর রাহমান আয়ত্ত করেছিলেন একজন খাঁটি নাগরিক-কবির তাবৎ বৈশিষ্ট্য। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি আয়ত্ত করেছিলেন এক অনুকরণীয় ন্যারেটিভ বা বর্ণনামূলক বাকভঙ্গি, যা সহজবোধ্য এবং যাতে বিবরণ বা স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে একটি জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত মানস বা ‘ইথোস’কে ধরা যায়। একান্ত নিজস্ব বাকভঙ্গির মধ্যে দক্ষ শব্দ জাদুকরের মতো মিশিয়ে দিয়েছেন প্রচুর অভিনব শব্দবন্ধ, চিত্রকল্প, উপমা এবং রূপক। নাগরিক বাস্তবতার রূঢ় জমিনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন বলে শামসুর রাহমান বাংলাকাব্যের শ্রেষ্ঠ নাগরিক কবি।

 

তথ্যসূত্র

১. বাংলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাস, আশুতোষ ভট্টাচার্য।

২. আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয়, দীপ্তি ত্রিপাঠী।

৩. শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা, হুমায়ুন আজাদ।

৪. শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ পাবলিশিং,

কলকাতা।

৫. শামসুর রাহমান স্মরণসংখ্যা-২০০৬, কালি ও কলম, ঢাকা।