শিল্পগুরু সফিউদ্দীন

মিজানুর রহিম

৮ জুন ২০১২ শুক্রবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে গিয়েছিলাম আমার এক আপনজনের জানাজার নামাজে উপস্থিত হওয়ার জন্য। জানাজা শেষে মসজিদ সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত কবরস্থানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো একাকী প্রবেশ করলাম, যেখানে আছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিসৌধ। সৌধের ঠিক উত্তরপাশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আর পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসানের সমাধির পাশেই অতিসম্প্রতি ২২ মে ২০১২ আমরা সমাধিস্থ করেছি শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদকে। দেয়ালের পাশেই আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান আর্ট কলেজ (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) – এই তিন প্রবাদপুরুষের স্বপ্নের ফসল। শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী ও সুধীজনের ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই সম্ভব হয়েছে এমন একটি স্থানে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদকে সমাহিত করা। আমরা সবাই সম্মানিত, গর্বিত এবং ভাগ্যবান। ভরদুপুরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবনত মস্তকে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি তাঁদের উদারতার জন্য, আমাদেরকে সম্মানিত করার জন্য। ধন্যবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
আমাদের শিল্পকলার হাতেখড়ি, চর্চা, প্রচার-প্রসার, সমৃদ্ধির ইতিহাস চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এক বিশাল গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এই ইতিহাসের মহানায়কদেরই একজন শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ। ২৩ জুন ১৯২২ সালে কলকাতার ভবানীপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত শিক্ষা শেষ করে ১৯৪৪ সালে শিক্ষকতার কোর্সে ভর্তি হয়ে ১৯৪৬ সালে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন এবং এই কোর্স শেষেই কলকাতা আর্ট স্কুলে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। চিত্রকলা মাধ্যমে অধ্যয়নকালে তাঁর শিল্পকর্মের জন্য বহুল প্রশংসা ও খ্যাতি অর্জন করেও শিক্ষকতা কোর্সে তিনি বেছে নেন ছাপচিত্র মাধ্যম। ছাপচিত্রে তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন প্রখ্যাত ছাপচিত্রশিল্পী ও শিক্ষক রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। রমেন চক্রবর্তীর সাহচর্যে এসে সফিউদ্দীন আহমেদ ছাপচিত্র মাধ্যমের বিভিন্ন দিকের করণকৌশল আয়ত্ত করে তাঁর নিষ্ঠা, একাগ্রতা, অধ্যবসায় এবং অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে শিল্পসৃষ্টিতে সাফল্যলাভ করে খ্যাতি অর্জন করেন। তেলচিত্র ও ছাপচিত্র – উভয় মাধ্যমেই উল্লেখযোগ্য শিল্পসৃষ্টির জন্য শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ লাভ করেন একাধিক আকর্ষণীয় সম্মান এবং পুরস্কার।
১৯৪৭ সালের পর সফিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা আসেন এবং ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ড্রইং শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সঙ্গে সঙ্গে চারুকলার একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের চারুকলা অনুষদে তাঁর চাকরি-জীবনের সবটুকু সময় দিয়েছেন। শিল্পচর্চায় নিয়োজিত থেকে শিল্প-শিক্ষার্থীদের মাঝে তাঁর তুলনীয়-অতুলনীয় জ্ঞানের ভান্ডার বিতরণ করছেন। গত বছর তাঁর জন্মদিনে ধানমন্ডিতে তাঁর বাসায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা আর শ্রদ্ধা জানাতে শিল্পগুরুর সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। অসুস্থ অবস্থায়ও আমাকে নাম ধরে ডেকে আমার হাতে হাত রেখে কুশল জিজ্ঞাসা করায় আমার আনন্দাশ্রু ঝরেছিল। নিজেকে ধন্য মনে করেছি। সাদাসিধে জীবন যাপনকারী, স্বল্পভাষী পাহাড়সমান ব্যক্তিত্বের অধিকারী সফিউদ্দীন স্যারকে দেখেছি ১৯৬৩ সালে, আমি চারুকলায় ভর্তির সময় থেকে। তবে এর আগে থেকেই তাঁর এবং তাঁর শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে আমার পরিচয়লাভের সুযোগ হয়েছিল। সফল মানুষ সফিউদ্দীন, শিক্ষক সফিউদ্দীন, শিল্পী সফিউদ্দীন – সব মিলিয়ে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। ছাপচিত্র শিক্ষার প্রবর্তক, প্রচারবিমুখ সফিউদ্দীন স্যারকে দেখতাম রিকশা থেকে নেমে ডানে-বাঁয়ে না যেয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে সরাসরি এসে ঢুকতেন ছাপচিত্র শাখার ক্লাসরুমে। ক্লাসরুমেই ছিল তাঁর বসার টেবিল-চেয়ার। পাশেই ছিলো আমাদের শিল্পকলার আরেক দিকপাল, শিল্প-পথপ্রদর্শক মোহাম্মদ কিবরিয়া স্যারের টেবিল-চেয়ার। সারাক্ষণ ক্লাসরুমেই কাটাতেন এই দুই শিল্পস্রষ্টা। কথা বলতেন দুজনে, তাঁদের কণ্ঠস্বর শোনা যেত না, তাকিয়ে বুঝতাম কথা হচ্ছে – নিশ্চয়ই শিল্প-বিষয়ক। আশ্চর্য হতাম, অবাক বিস্ময়ে দেখতাম একজোড়া ব্যতিক্রমী মানুষকে – শিল্পস্রষ্টাকে।
শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পসৃষ্টির ইতিহাস আর নিদর্শন এক বিশাল ভান্ডার। প্রচারবিমুখ এই শিল্পগুরু নিভৃতে কাজ করেছেন, একাগ্রচিত্তে সারাটি জীবন করেছেন ছাপচিত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সৃষ্টি করেছেন ছাপচিত্রে সফিউদ্দীনের জগৎ। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনযাত্রা, বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম, নিসর্গচিত্র থেকে শুরু করে আধুনিক সমকালীন ছাপচিত্রে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টি আমাদের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদের উত্তরসূরি আমরা। আমরা ধন্য, ধন্য দেশ ও জাতি। 