শিল্পযাত্রার কীর্তিমান এগারো

মোবাশ্বির আলম মজুমদার

ত্রিশের দশকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘনঘটা ও বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক দুরবস্থার সময়ে শিল্পীরা পৌরাণিক, ধর্মীয়, ইতিহাসনির্ভর শিল্প সৃষ্টির ধরন পরিহার করে সমকালীন বাস্তবতার প্রতিফলন দেখান শিল্পে।  চলিস্নশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রম্নতিতে বাংলায় ঘটে যাওয়া মন্বমত্মরে (১৯৪৩) লাখো মানুষ প্রাণ হারায়। এ-সময়কার বাস্তবতায় প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন দুজন শিল্পী। একজন কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের তরুণ শিল্পী জয়নুল আবেদিন, অন্যজন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী শিল্পী চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য।

জয়নুল মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন কালি-তুলি। গ্যালারি চিত্রকের এ-প্রদর্শনীতে দেখা যায় ১৯৭১-এর প্রতিবাদী শিল্পী জয়নুলের কাজ। জয়নুলের কালি-তুলির প্রতিবাদী রূপের সঙ্গে একাত্তরে আঁকা মুক্তিকামী মানুষের প্রতিবাদী মুখে তীব্র রেখার গতি খুঁজে পাওয়া যায়। ‘বীরাঙ্গনা’ কাজটি এ-প্রদর্শনীর সবচেয়ে অনুজ্জ্বল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পাচার্যের আঁকা অন্যান্য কাজের সঙ্গে এর ব্যবধান বোঝা যায়। বিষয়টি মর্মস্পর্শী এক বীরাঙ্গনার মুখ মনে করিয়ে দেয়। ধূসর রঙে ঝাপসা মুখের রেখায় আঁকা। মুক্তির আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন আলোছায়ার ব্যবহারের মাধ্যমে। এ-প্রদর্শনীতে রয়েছে শিল্পাচার্যের কালি-তুলির দুটি কাজ – দুটি পেনসিলের ড্রইং, একটি কাঠখোদাই প্রিন্ট। শিল্পের নানা মাধ্যমে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চর্চার প্রকাশ দেখা যায় প্রদর্শনীর সবকটি কাজে।

পটুয়া কামরুলের তুলি আর রঙের কাজ আমাদের কাছে অতিচেনা। কামরুল হাসান মানে লাল-সবুজ পতাকা। আবহমান বাংলার মানুষের মুখ। রং-তুলির বাইরে কামরুল হাসানের ছাপচিত্র নির্মাণে বিশেষ দক্ষতা ছিল। ‘কাক ও শকুনের ভোজ’ শিরোনামের লিথোগ্রাফ প্রিন্টের কাজটিতে বাস্তবানুগ শিল্প নির্মাণের ঝোঁক লক্ষ করা যায়। ‘দইওয়ালা’, ‘দুই নারী’, ‘পাখি ও গাছ’, ‘গরু’ শিরোনামে জলরঙে আঁকা কাজগুলো পটশিল্পীদের আঁকার কৌশল মনে করিয়ে দেয়। বাংলার লোকজশিল্পীদের কাজের ধরন মনে রেখে কামরুল হাসান রং ও রেখার প্রয়োগ করতেন।

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চা শুরুর আগে কলকাতায় যে তিন পথিকৃৎ শিল্পী প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা গ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ ব্যতিক্রমী ধারার শিল্পী। তিনি বাস্তবানুগ রীতির বাইরে মাধ্যম নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন বেশি। বিশেষ করে ছাপচিত্রে কাঠখোদাই ও ধাতুর পাতখোদাই শিল্পে তিনি একজন প–ত। চিত্রকের এ-প্রদর্শনীর সাতটি কাজের মধ্যে দুটি চারকোল ও ক্রেয়নের ড্রইং, দুটি কপার পেস্নট এনগ্রেভিং ও একটি কাঠখোদাই প্রিন্ট রয়েছে। কপার এনগ্রেভিং দুটি কাজের শিরোনাম হলো ‘মেমোরি ৭১’। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের আঁকা ছবিতে দেখা যায় শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতির চারপাশে অগণিত চোখ ও জলের আবহ। এলোমেলো কালো রেখায় আঁকা চোখের গঠন থেকে বোঝা যায় মুক্তি-সংগ্রামের সময় অশ্রম্নঝরা দিনগুলোর কথা।

বাংলাদেশের পথিকৃৎ তিন শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পকর্মের করণকৌশল ও বিষয় থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি ত্রিশের দশকের পূর্ববর্তী সময়ে বাংলা অঞ্চলে শিল্পকলার রূপ পরিবর্তিত হয়েছে জয়নুল, কামরুল ও সফিউদ্দীন আহমেদের হাত ধরে।

মোহাম্মদ কিবরিয়া এ-প্রদর্শনীর একমাত্র জ্যামিতিক নির্বস্ত্তক শিল্পকলার জনক। মোহাম্মদ কিবরিয়ার চারটি কাজে প্রতীকবাদী আচরণ আমরা দেখতে পাই। বাংলাদেশের শিল্পকলায় বাস্তব ও আধাবাস্তব রীতির ধরনকে পালটে দিয়ে শুধু জ্যামিতিক আকার, আকৃতি, আলোছায়া দিয়ে ক্যানভাস তৈরি করেছেন। প্রদর্শনীর কাজে কিবরিয়ার পরপরই দেখা যায় আমিনুল ইসলামের বাস্তবধর্মী জলরঙের কাজ – ‘কৃষক পরিবার’। কাজটিতে বতিচেলিস্নর কাজের ধরন খুঁজে পাওয়া যায়; তিনটি ফিগারের সঙ্গে একটি গরুর উপস্থিতি আবহমান বাংলার চেনা রূপকে দেখিয়ে দেয়। আমিনুল ইসলামের অন্য চারটি কাজ জলরং ও কালি-তুলিতে করা। জ্যামিতিক আকৃতি আর ছন্দময় রেখায় ছুটে চলা কাজ এক গতির আবহ তৈরি করে দেয়। প্রদর্শনীর একটি কাজে শামসুর রাহমানের কবিতার সঙ্গে আমিনুল ইসলামের অলংকরণ দেখা যায়। শামসুর রাহমানের কবিতার শিরোনাম এমন – ‘কোন দৃশ্য সবচেয়ে গাঢ় হয়ে আছে’?

‘কোন দৃশ্য সবচেয়ে গাঢ় হয়ে আছে

এখনো আমার মনে? দেখছি তো গাছে

সোনালি বুকের পাখি, পুকুরের জলে সাদা হাঁস।’

আমিনুলের কাজে ঐতিহ্য সরাসরি নেই। জ্যামিতি ভর করে ঐতিহ্যের সুর আভাস দেয়। কবিতা আর রেখার গতি দুয়ে মিলে এ-ছবিতে তৈরি হয়েছে আরেক শিল্প।

চিত্রকের এ-প্রদর্শনীতে রাখা আব্দুর রাজ্জাকের বাস্তবধর্মী কাজের আভাস পাওয়া যায়। বাস্তবধর্মী নির্মাণের সঙ্গে আব্দুর রাজ্জাক তাঁর প্রিয় রং সবুজের সমাবেশ রেখেছেন কাজগুলোতে। রশীদ চৌধুরী একনাগাড়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠক ও শিল্পভাবনার মানুষ। তাঁর এ-প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম ঊর্ধ্বমুখে ছুটে চলা মানুষের ছন্দের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রকৃতি ও মানুষের সান্নিধ্যে ছন্দ তৈরি হওয়ার মুহূর্তকে তিনি তুলে ধরেছেন। এ-প্রদর্শনীর প্রথম সাতজন শিল্পী আমাদের মাঝে নেই। তাঁদের সৃজনচিন্তা ও কর্ম আমাদের শিল্পকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চার পথ সুগম করে দিয়েছে।

এ-প্রদর্শনীর কাজের মাঝে মুর্তজা বশীরের ছাপচিত্রে বহু বর্ণ ব্যবহারের কৌশল দেখা যায়। মুর্তজা বশীরের কাজে ছাপচিত্র নির্মাণের সহজ ধরনের সঙ্গে বিষয়ের সরলীকরণ চোখে পড়ে। অ্যাচিং ও অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের কাজগুলো আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। সমরজিৎ রায়চৌধুরী প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন। প্রদর্শনীর পাঁচটি কাজে প্রকৃতির নানা রেখা ও আকৃতি উজ্জ্বল রঙে দেখা যায়। উজ্জ্বল রঙের বিন্যাস সমরজিৎ রায়ের কাজে জ্যামিতিক আকৃতির সঙ্গে মেশানো এক আবহ তৈরি করেছে। আবহমান বাংলার রং-রেখা আর রূপ নির্মাণ সমরজিতের ছবির বিষয়।

শিল্পী রফিকুন নবীর এবারের কাজগুলো একেবারে ভিন্ন। পরিবার, কৃষক, টোকাই ও তাঁর বন্ধুরা, কাকের ভোজ এসব কাজের মধ্যে বিষয় নির্বাচন দেখে অতীতের কাজের সঙ্গে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। ছবির ক্যানভাসে বাস্তব নির্মাণরীতির সঙ্গে নিজস্ব কৌশল প্রয়োগ আরেক রফিকুন নবীকে প্রকাশ করে। মনিরুল ইসলাম আধুনিক ছাপচিত্রের পথিকৃৎ হলেও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে তিনি ক্যানভাস গড়েন প্রতীকের সাহায্যে। চিত্রকের এ-প্রদর্শনীর চারটি কাজে ধূসর রং লেপনের সঙ্গে গতির সঞ্চার করেছে। মনিরুল ইসলামের কাজ আমাদের অন্য এক ভুবন দেখায়। প্রকৃতির ভেতরে চলতে থাকা সূক্ষ্ম রং আর রেখার নাচন দর্শকদের দেখিয়ে দেন তিনি।

বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার ১১ জন পথিকৃৎ শিল্পী আমাদের দেখিয়েছেন, শিল্পকলা শুধু আলোকচিত্রের অনুকরণজাত কোনো সৃষ্টিকর্ম নয়। পৃথিবীব্যাপী চলতে থাকা শিল্প সৃষ্টির আধুনিক নির্মাণ-কৌশল শিল্পকলার এক নতুন দুনিয়া। গ্যালারি চিত্রকের এ-আয়োজন দর্শকদের বাংলাদেশের শিল্পকলার আধুনিক অভিযাত্রার মাইলফলক। গ্যালারি চিত্রকে গত ২৮ মার্চ শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হবে ২০ এপ্রিল। r