শিল্পসাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনা

আহমদ রফিক

শিল্পসাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার-বিবেচনার ধারাটি প্রাচীন। বলা বাহুল্য তা নিয়ে ভিন্নমত এবং যুক্তিতর্কের বিভিন্নমাত্রিক বয়ান কম নয়। তবে ওই বিতর্কের বিষয়বস্ত্ত শিল্পসাহিত্য সৃষ্টির পেছনে দুটো শক্তি সক্রিয়। প্রথমত শ্রম – তা মূলত মানসিক, কিছুটা দৈহিক, অন্যদিকে পরিবেশ ও নিসর্গ প্রভাব। শেষোক্ত দিকটি, বিশেষত নিসর্গ কখনো হয়ে ওঠে সৃষ্টির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রেরণা। সময়ের ধারায় ও মানবসভ্যতার বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টিতে উভয় ক্ষেত্রেই কথাগুলো সত্য। যেমন সাহিত্যে তেমনি স্থাপত্যে-ভাস্কর্যে বা চিত্রকলায়। তবে এক্ষেত্রে সাহিত্যসৃষ্টিই প্রধান বিবেচ্য বিষয়।

শিল্পসাহিত্য সৃষ্টির মৌল তাগিদ, নন্দনতাত্ত্বিক ভাষায় প্রেরণা মূলত কারো মতে ‘মনুষ্যস্বভাবে’ নিহিত, অন্যমতে প্রয়োজনের তাগিদে। এখানে বিষয়টির নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনা। শেষোক্ত মত ক্রিস্টোফার কডওয়েলের। কবিতার উৎস ও তার নন্দনতাত্ত্বিক বিচার ব্যাখ্যায় এমন মন্তব্যই তিনি করেছেন। মার্কসবাদীদের একাংশ ওই প্রয়োজনের সঙ্গে বিশেষভাবে ‘শ্রম’কে যুক্ত করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে।

হয়তো হোমোস্যাপিয়েন নামীয় মানবপ্রজাতির ‘মানুষ’ হয়ে ওঠা, মনুষ্যত্ববোধের অধিকারী হয়ে ওঠার পেছনে তার আকাঙ্ক্ষা ও শ্রমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলেই এমন প্রতিপাদ্য উপস্থাপন। সেজন্যই ‘মনুষ্যস্বভাব’ কথাটাও এসেছে তার বিশেষ ভূমিকা নিয়ে ক্রমে যা ‘মানবিক’ চরিত্র অর্জন করেছে। ‘বিরূপ বিশ্বের মানুষ’কে যত ‘একাকী’ মনে করা হোক না কেন সিংহভাগ মানুষ তার একাকিত্ব ঘুচাতে চায় বহুর সাহচর্যে, তাই তো সমাজ গঠন। অন্যদিকে কেউ কেউ চায় নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টির মাধ্যমে চেতনার একাকিত্ব দূর করতে।

এভাবে সমাজ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের বহুত্বধর্মী চরিত্রের প্রকাশ বলে মনে করেন বিবর্তনবাদী, সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদদের কেউ কেউ। শিল্পসাহিত্য এমন করেই একক থেকে বহুর সঙ্গে সম্পর্কিত। সংশ্লিষ্ট এক পর্যায়ে ‘সমাজ’ নামক সংঘসত্তার সঙ্গেও, আবার কারো মতে সেই সঙ্গে শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গে। তবে কডওয়েল কিন্তু আদি নন্দনতাত্ত্বিক সৃষ্টি অর্থাৎ নৃত্যগীতবাদ্যকে গোষ্ঠীস্বার্থ বা গোষ্ঠীগত প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। এক কথায় সমন্বিত জীবনের উৎসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আদি পর্যায়ে কবিতারও জন্ম তার অসংস্কৃত রূপে। ‘রস’ সেখানে অচেতনভাবে হলেও উপস্থিত।

 

দুই

রসসৃষ্টির উৎস সম্বন্ধে সচেতন বা অচেতন থেকেও প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের বিদগ্ধজন রসতত্ত্বের ব্যাখ্যায় নন্দনতত্ত্বে উদ্ভাস ঘটিয়েছেন, বিশেষ করে সংস্কৃতি সাহিত্যের আলোচনায়। তেমনি প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য, মূলত কাব্যসাহিত্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট দার্শনিকদের কাব্যতত্ত্ব (‘পোয়েটিকস’) নিয়ে বিচারে নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। প্রসঙ্গত প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের কথা বারবার উঠে আসে।

সেক্ষেত্রে কাব্য-জীবনের প্রতিরূপ হয়ে কর্মের ক্ষেত্রে যে বিশেষ রূপের অভিব্যক্তি ঘটায় সেখানে যেমন নান্দনিক বোধের প্রকাশ ঘটে তেমনি সেসব ভাবনার সঙ্গে কিছুটা হলেও মিল খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলে ভারতীয় রসতত্ত্বের বিচার-ব্যাখ্যার সঙ্গে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অসংস্কৃত বা সংস্কৃত নন্দনতাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণাগুলোর মধ্যে অভাবিত হলেও অন্তর্নিহিত কিছু মিল লক্ষ করার মতো।

প্রাচীন ভারতীয় নন্দনতাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণে রূপ, রস, সৌন্দর্য, আনন্দ ইত্যাদির মধ্যে ‘রস’ শব্দটির যেন প্রাধান্য, যে জন্য তাদের চৈতন্যে নন্দনতত্ত্ব মূলত ‘রসতত্ত্ব’ হিসেবে বিবেচিত। ভারতের নাট্যশাস্ত্রের রস বিচারের নানারূপ নিয়ে অভিনব গুপ্ত থেকে একাধিক বিদগ্ধ অলঙ্কারশাস্ত্রবিদ এ সম্বন্ধে নানামাত্রিক বিচার ও জিজ্ঞাসায় বিষয়টিকে তুলোধুনা করেছেন এবং তাতে জটিলতা বা মতভেদের ধুলোও কম ওঠেনি।

পূর্বোক্ত নাট্যশাস্ত্র বিচার উপলক্ষে শৃংঘার, বীর, বীভৎস, করুণ, কৌতুক, বিস্ময় ইত্যাদি রসের কথা বলা হলেও বাস্তব বিচারে   দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-উল্লাস, ভয়-বিরক্তি ইত্যাদি অভিব্যক্তি অস্বীকারের উপায় নেই, হোক তা নাটকে বা কাব্যে কিংবা শিল্পসাহিত্যের যেকোনো শাখায়। এসব নিয়ে সম্ভবত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে খুব একটা গরমিল নেই, স্থান ও পরিবেশ বিচারে যেটুকু অমিল তা মাথায় রেখে এমন সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে হয়।

হয়তো তাই অভিনব গুপ্তের রসবিচার প্রসঙ্গে বিলেতি বিশ্বকোষে শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি প্রসঙ্গে অন্যতর প্রধান হিসেবে আনন্দ, হাস্য, দুঃখ, ক্রোধ, ভয়, বীর, বিরক্তি ও বিস্ময় বিষয়ক আট প্রকার রসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসবের অভিব্যক্তিও হতে পারে বিভিন্ন রূপে এবং সে-সূত্রে নান্দনিক অভিজ্ঞতারও প্রকাশ। পূর্বোক্ত রসবিষয়ক বিভিন্নতা বিশেষ করে প্রকৃতিভেদ নিয়ে ভিন্নমতও কম নয়। যেমন ‘শান্ত’ রস বিবেচনার পাশাপাশি ‘ভাক্ত’ও কারো কারো মতে রস হিসেবে বিবেচ্য।

রসের উৎস হিসেবে ‘রূপ’ তথা বস্ত্তরূপ যে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে সে সম্পর্কে মতভেদ কম হলেও বিমূর্তকে নিয়ে ভাববাদীদের মাতামাতি যথেষ্ট। তারা বস্ত্তরূপের প্রাধান্য মানতে নারাজ। সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের বিধায়কগণ যত কথাই বলুন, রসের উৎস নিয়ে সেই সঙ্গে অন্যরাও যত ভিন্নমত পোষণ করুন, শিল্পসাহিত্য প্রভৃতির সৃষ্টিশীলতা প্রসঙ্গে রূপ থেকে, ব্যক্তিকভাব থেকে যে সৃষ্টি তথা রসের উদ্ভব সে-কথা অস্বীকার করা বড় কঠিন।

বিতর্কের এমন এক সূত্র ধরে দাবি করা হয়েছে যে, রূপ বস্ত্তনির্ভর হলেও এর চৈতন্য নির্ভর বিমূর্ত অস্তিত্বও সত্য। এমনকি তা হতে পারে জ্ঞানেরও অতীত। বিমূর্তবাদীদের এ জাতীয় দার্শনিক যুক্তিতর্কে রূপ-অরূপ একাকার, অরূপেও রূপের অবস্থান। তবে একথা সত্য যে, এসব ক্ষেত্রে দর্শনতত্ত্বের প্রভাবই প্রধান। এবং তখন বস্ত্তনিরপেক্ষ রূপ, কারো কারো মতে ‘শুদ্ধরূপ’ অভিজ্ঞতার অতীত হলেও মিথ্যা নয়। এসব ‘ধারণা’র সঙ্গে ভক্তিবাদ বা অধ্যাত্মবাদের যোগ নিতান্ত কম নয়।

আর অবাক হওয়ার মতো ঘটনা যে রূপ-অরূপের ভাববাদীতত্ত্বের ব্যাপকতায় প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে মতের মিল যথেষ্ট। অথচ কোনো কোনো পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীর অভিযোগ যে, দর্শন ও নন্দনতত্ত্বের বিচারে প্রাচ্যই ভাববাদ, অধ্যাত্মবাদের উৎস। ভারতীয়, চৈনিক বা জাপানি সভ্যতার নন্দনতাত্ত্বিক বা দার্শনিকগণই ভাববাদ ও বিমূর্ত চিন্তার পূর্বাপর উদ্ভাবক। এমনকি চর্চায়ও। এমন দাবি যথেষ্ট যুক্তিনির্ভর নয়। পশ্চিমা দর্শন ও নন্দনতত্ত্বে, এমনকি সাহিত্য-শিল্পতত্ত্বেও ভাববাদের প্রকট প্রকাশ মোটেও কম নয়।

 

তিন

পশ্চিমা দেশে শিল্পসাহিত্য নিয়ে সুন্দর-অসুন্দর, শুভ-অশুভ, কল্যাণ-অকল্যাণের মতো নানা বিপরীতধর্মী বিষয় নিয়ে নান্দনিকতার বিভিন্নমুখী তত্ত্বের প্রকাশ সত্ত্বেও সেখানে বিমূর্ত দার্শনিকতারই প্রাধান্য। বিদগ্ধ তাত্ত্বিকদের মেধাবী প্রকাশ সর্বজনগ্রাহ্য নন্দনতাত্ত্বিক ধারা তৈরি করতে পারেনি এমন সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। বরং বলতে হয়, তৈরি হয়েছে নানা মত, যে-যার মতে অনড়। আধুনিক চিন্তাও সর্বমতের সমন্বয় ঘটাতে পারেনি। বিপরীত ভাষ্যে দেখা যায়, যত মেধা ততো মত ও বিচারব্যাখ্যার ততোই ভিন্নতা।

দু-একটি উদাহরণ টেনে বলা যায়, এডমন্ড বার্কের নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে ‘মহৎ ও সুন্দরের’ ব্যাখ্যা যেমন সবার সমর্থন পায়নি তেমনই প্রশ্নবিদ্ধ কান্টের বস্ত্তবিচারের ভাববাদী নিরিখ। অনুরূপভাবে হেগেলীয় দর্শনের দ্বিমুখী ধারার একাংশ নিয়ে যেমন সমর্থন, অপরাংশ নিয়ে বিরোধিতা। দ্বান্দ্বিকতা ও ভাববাদ দুই ধারায় প্রসারিত গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে। এ-ধরনের বৈপরীত্য দীর্ঘসময় ধরেই একধরনের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। ফলে নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনা  হোঁচট খেতে খেতে সময়ের পথ পাড়ি দিয়েছে।

প্রসঙ্গত একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার যে, এ পর্যায়ে পশ্চিমের ভাববাদী দার্শনিকরা নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে, বিশেষত সাহিত্যশিল্পের মূল্যায়নে বিষয় ও প্রকরণের ক্ষেত্রে ‘ফর্ম’কেই প্রাধান্য দিয়েছেন। চিত্রসমালোচক ক্লাইভ বেল শিল্পসৃষ্টিতে ‘সিগনিফিকেন্ট ফর্মে’র প্রকাশ লক্ষ করেছেন। সর্বোপরি সেখানে তিনি দেখতে পান ‘পরম সত্তার’ আভাস। শিল্পসৃষ্টির মূল্যায়নে ভাববাদের এ জাতীয় চরম প্রকাশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নন্দনতাত্ত্বিকদের বিচার-ব্যাখ্যায় উপস্থিত। একে কেউ যদি ‘ফর্মের ফর্মালিজমে পথ হারানো’ বিবেচনা করেন তাহলে এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিপরীত যুক্তি খুব একটা শক্ত অবস্থানে দাঁড়ায় না।

ভাববাদীদের বিচারে ‘রূপ, বর্ণ ও স্থানে’র ত্রিমাত্রিকতায় শিল্পসৃষ্টিতে রসের উদ্ভব এমন ধারণার পক্ষে সংখ্যাগুরুর মতামত। যদিও বস্ত্ততন্ত্রবাদীরা এ-জাতীয় তত্ত্বের কট্টর সমালোচক। তাদের           চিন্তা এর বিপরীতধর্মী যা পরবর্তী পর্যায়ে বিবেচ্য। তবে অপেক্ষাকৃত অনুগ্র তাত্ত্বিক তথা মধ্যপন্থীদের বিচারে ‘বিষয় ও আঙ্গিক অবিচ্ছিন্ন সত্তা’ যদিও ওই ধারার দুচারজন এ অবিচ্ছিন্নতার মধ্যেই ‘ফর্ম’কে অপেক্ষাকৃত প্রাধান্য দিতে চান। সেক্ষেত্রে তাঁরা আর মধ্যপন্থী থাকেন না।

এদের কারো কারো মতে, শিল্পের কিছু স্থায়ী গুণ এমন নান্দনিক অনুভবের জন্ম দেয় যা শিল্পবিচারে সুন্দরের ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হতে পারে। এ ধারায় বেনেদেত্তো ক্রোচে নান্দনিকতার ব্যাখ্যায় ‘Sensory Embodiment’-এর প্রতি সর্ববাদী সমর্থন প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, শিল্পসৃষ্টিতে প্রাকৃত ঘটনা ব বস্ত্তধর্মের কোনো স্থান নেই। শিল্পকর্ম (আর্ট) সজ্ঞা বা অন্তর্জ্ঞানের সাহায্যে সৃষ্ট।

ক্রোচের দার্শনিক-নন্দনতাত্ত্বিক খ্যাতি (তাঁর নন্দনতত্ত্ব বা সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই দুর্বল) সত্ত্বেও অস্বীকার করা চলে না যে, এ জাতীয় তত্ত্বে শিল্পসাহিত্যের নান্দনিকতায় ভাববাদী বিমূর্ত ধ্যান-ধারণার অস্পষ্টতা প্রধান হয়ে ওঠে। সেখানে অধ্যাত্মবাদের মেঘও এসে জমা হয় যা ঐশী চেতনার পরম সত্তাকে ডেকে আনে। অনেকটা হেগেলীয় অধ্যাত্মবাদী ভাববাদের চাষাবাদের মতো।

ঐশীচেতনা এমনই এক বিষয় যে তার প্রগাঢ় শক্তি বাস্তবের সত্যকে ভাববাদী অনুভবের টানে ভক্তিবাদে পৌঁছে দিতে পারে। উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ। যেমন তাঁর ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে/ অাঁধার করে আসে’র মতো শিলাইদহ-পূর্ববঙ্গীয় প্রাকৃত বাস্তবতার উপলব্ধি মনোগহনে স্থিত ঐশীচেতনার টানে পূজাপর্বের ভক্তিবাদী গানের চরিত্র ধারণ করে। সুরে-স্বরে বাস্তব বিষণ্ণতা ভাববাদী চেতনার প্রকাশ ঘটায়।

পূর্বোক্ত আলোচনার সূত্র ধরে বলতে হয়, এভাবে নিরাসক্ত উদাসীনতার নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা কখনো কখনো সৌন্দর্য বিচারে ভাববাদী ফর্মের আলোয় প্রকাশ পায়। বাস্তব সত্যকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় ভাববাদী চেতনার অবাস্তবতায়। প্রসঙ্গত কান্ট-কথিত ‘নানন্দিক অভিজ্ঞতার’ কথা স্মরণ করা যেতে পারে। নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনায় ভাববাদের এতোটাই টান যে সে-প্রভাবে কখনো কখনো বস্ত্তবাদীর বাস্তবতাও ভেসে যায়।

মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় শিল্পসাহিত্য-বিষয়ক নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় উল্লিখিত বিষয়টিকে কেন জানি সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় বস্ত্ততান্ত্রিক নিরিখে বিচার করে লেখেন : ‘আমার মতে নন্দনতত্ত্বের মূল কথা হলো নান্দনিক অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার বিচার-বিশ্লেষণ করা, সাধারণ রীতিনীতি বিশেষ করে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখানোই তাত্ত্বিকের প্রধান কর্তব্য।’

তাঁর লেখায় এমন ধারণারও প্রকাশ ঘটে যে, ‘নান্দনিক অভিজ্ঞতা’ বিষয়ঘটিত হয়েও মন ও কল্পনানিষ্ঠ ব্যক্তিচৈতন্য-নির্ভর। রূপ এবং সৌন্দর্যের ধারণাও ব্যক্তিচেতনা-নির্ভর। শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে এমন ধারণার ফলে শিল্প-সর্বস্বতা নন্দনতত্ত্ব বিচারে প্রাধান্য পায়। অবশ্য কল্পনা শিল্পসৃষ্টির আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হতে পারে যদি তা পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা  উপেক্ষা করে আকাশচারী না হয়।

অন্যদিকে হিউমের বিচারে ‘নান্দনিক অভিজ্ঞতা’ থেকে ভাব, তথা ‘আইডিয়া’র উদ্ভব। কান্ট অবশ্য কল্পনাকে ‘নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা’র সঙ্গে একাত্ম করে দেখতে আগ্রহী। তাঁর বিচারে, সজ্ঞা ও ধারণাকে (Intuition ও Concept) সমন্বিত করার নেপথ্যে রয়েছে কল্পনা যা অবশেষে অভিজ্ঞতার রূপ ধারণ করে। ভাববাদ ও বাস্তবতা মিলেমিশে এভাবে নন্দনতাত্ত্বিক জটিলতার জন্ম দেয়। ভাববাদকে মনে হতে পারে বস্ত্তবাদ বা বাস্তবতার চিত্রচরিত্র।

 

চার

শিল্পসাহিত্য সৃষ্টির নান্দনিকতা নিয়ে ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবনার বিভিন্নতায় একাধিক ভিন্নমতের প্রকাশ মূলত ভাববাদের প্রাধান্যই পরিস্ফুট করে তুলেছে। এমনকি শুদ্ধ শিল্পসৃষ্টির মতবাদে বিশ্বাসী চরমপন্থীদের বক্তব্যে এমন বিশ্বাসও ফুটে উঠেছে যে, শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে শিল্পের উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা বিচার্য বিষয় নয়, সৃষ্টিই বিচার্য। অর্থাৎ শিল্পীকে একপাশে ঠেলে দিয়ে তার সৃষ্টির বিচার, যা শিল্পসর্বস্বতার চরম রূপ বলে ধরা যেতে পারে।

শিল্পসৃষ্টিকে যদি ‘আবেগের অভিব্যক্তি’ (রুশো) হিসেবে বিবেচনা করা যায়, এমনকি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যসংজ্ঞা মনে রেখে, তাহলে সৌন্দর্য ও সংগীত এ দুইয়ের প্রকাশ আর ব্যক্তি-নিরপেক্ষ থাকে না। এমনকি থাকে না কান্ট-কথিত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ। শিলার থেকে হেগেল একাধিক ধীমান শিল্পসাহিত্য-সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইতিহাস ও বুদ্ধিবৃত্তি, মেধা ও মননশীলতাকে সত্য মেনে নিয়েও রোমান্টিক ভাববাদিতাকে বড় করে দেখেছেন।

সেই ধারাবাহিকতায় কখনো পৌঁছে গেছেন অধ্যাত্মবাদ, ঐশীচেতনা, পরম বা শাশ্বতের কল্পনায়। আবার সেখানে সৌন্দর্য, সংগীত, আনন্দ নানা ভাবনার সূত্রে যুক্ত হয়ে নন্দনতাত্ত্বিক বিচারের বিষয়টিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। কারো কারো মতে, এর পেছনে রয়েছে নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনায় দর্শনের প্রক্ষেপ ও প্রভাব, যেজন্য দেবীপ্রসাদের মতো মার্কসবাদীকেও নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় ভাববাদের আঙিনায় হালকা পদক্ষেপে বিচরণ করতে দেখা গেছে।

শিল্পসাহিত্য বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে সৌন্দর্য যেমন নন্দনতাত্ত্বিক বিচারের উপাদান, তেমনি আরো একাধিক উপাদান সে বিচারের বিষয় হয়ে ওঠে। যেমন ‘আনন্দ’ (যা রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বিষয়)। শৈল্পিক সৌন্দর্যের বিচার-বিশ্লেষণে জর্জ সান্তায়ন আনন্দকে সৌন্দর্যের সঙ্গে একাত্ম করে নিয়েছেন। সুন্দর আনন্দের উৎস (কথাটা রবীন্দ্রনাথেরও, তবে তিনি কর্মকেও সেই সঙ্গে যুক্ত করেছেন)। সে-বিচারে নান্দনিক অনুভূতিরও মূল কথা। ‘মানুষের সর্ববিধ কর্মের ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িত হয়েই সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ। আর সেক্ষেত্রে তার রূপ ও অভিব্যক্তি দুই পার্শ্বমুখ হিসেবে বিবেচিত।’

বিষয়টিকে বিস্তারিত আলোচনায় যুক্ত করে তিনি ‘ভাবানুষঙ্গের’ ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এবং সেক্ষেত্রে তাঁর মতামত হলো, অভিব্যক্তিবাদের মূলকথা বস্ত্তগত উপাদান থেকে উদ্ভূত সৌন্দর্য বা আনন্দের প্রকাশ যা শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ দুই অভিব্যক্তির মিলে যে অভিজ্ঞতা তাতেই নান্দনিকতার তত্ত্বগত ও বাস্তবিক রূপ ধরা পড়ে। শিল্পকলার পদ্ধতিগত অভিব্যক্তিবাদ এভাবে ব্যাপক অর্থে ‘শিল্প’ (আর্ট) শব্দটির অন্যান্য শাখায় সত্য হয়ে ওঠে।

আধুনিক নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় ক্রোচের প্রভাব যথেষ্ট হলেও বস্ত্তবাদী তাত্ত্বিকগণ ক্রোচের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ মেনে নিতে নারাজ। বিশেষ করে ক্রোচে যখন বিষয় ও প্রকরণ এই উভয় ক্ষেত্রেই ‘ইনটুইশন’কে প্রধান করে তোলেন। ক্রোচের শিষ্য কলিংউডের নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনাও একইরকম সমস্যা তৈরি করে বস্ত্তবাদীদের জন্য। সমস্যা যেমন ‘উপায়’ ও ‘লক্ষ্য’ নিয়ে তেমনি অভিব্যক্তির স্বরূপ নিয়ে। তাঁর মতে, উপায় ও লক্ষ্য আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। বলতে হয় ভাববাদের চরম প্রকাশ। তাই তার বিচারে কল্পনা অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করে যায় আর সেটাই সত্য। তাই আধুনিক চিন্তকদের বিচারেও শিল্পের নন্দনতাত্ত্বিকতা অধিকতর জটিলতাই তৈরি করে।

 

পাঁচ

রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকে জন্ম নিয়েও দুই শতকের আধুনিকতাকে  গঙ্গা-যমুনার মতো একাত্ম করে নিতে পেরেছিলন বলেই বোধ হয় ভাববাদের সঙ্গে বাস্তবতার সত্যকে মেলানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তাঁর শিল্পভাবনা তথা নন্দনতাত্ত্বিক বিচারাদি নিয়েও কিন্তু দুই বিপরীত প্রান্ত মেলাতে পেরেছিলেন, অথবা বলা যায় মেলাতে চেষ্টা করেছেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ভুবনে অনেক পথ হেঁটে। সে-অভিজ্ঞতার গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চয় পদ্মা-শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসর হয়ে পূর্ববাংলার জীবন-জনপদ ও নিসর্গ থেকে।

পূর্ববঙ্গীয় প্রকৃতি ও জীবন-জনপদ তাঁকে অনেক কিছু বুঝতে শিখিয়েছিল। যেমন সৌন্দর্যের আনন্দরূপ তেমনি তার বিপরীত   বাস্তবতা। নিসর্গের সঙ্গে জীবন ও কর্মের সম্পর্ক। ‘বর্ষণের সঙ্গে কর্ষণ’ ও উৎপাদনের সম্পর্ক ও পরিণামে আনন্দের উৎস ও সম্ভাবনা। অনেকটা এ ধরনের কথাই বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ সফরে গিয়ে তাঁর বক্তৃতায়। প্রকৃতি ও মানুষের আত্যন্তিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু গভীর বাণী শুনিয়েছিলেন সবাইকে। উল্লিখিত সে সম্পর্কে উপস্থিত ছিল বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, এমনকি নিম্নবর্গীয় কারিগর কৃষক। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হয়েছিল নানা মাত্রিক উৎস থেকে। তাই পদ্মার ধুধু চর বা পতিসরের নির্জন নিস্তব্ধ পরিবেশ, আলো-অাঁধারের নিঃসীম নীরবতা যেমন ভাববাদী চিন্তার উৎস হয়ে ওঠে তেমনি দিনের ঝাঁঝাঁ রোদে বা শীত-বর্ষায় মানুষের কর্মতৎপরতা ও ফসলের নানারঙা প্রাকৃত উৎসব তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির আনন্দ-উৎস হয়ে দাঁড়ায়।

এমনি একাধিক অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ রবীন্দ্রচৈতন্যে ‘সৌন্দর্য’ ও ‘আনন্দ’ শব্দ দুটো নানামাত্রার বাস্তবতায় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর এই তাৎপর্যেই দুই বিপরীতের অদ্ভুত এক সমন্বয়ে তৈরি হয় রবীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনা, নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তাধারা। তবে তা একেবারে ভিন্ন অন্য তাত্ত্বিকদের থেকে, যেমন অভিনবত্বে তেমনি শব্দভাষ্যের বৈশিষ্ট্যে।

তাঁর ভাবনায় শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ‘লক্ষ্য উপলব্ধির আনন্দ, বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর এক হয়ে যাওয়াতে যে আনন্দ। অনুভূতির গভীরতা দ্বারা বাহিরের সঙ্গে অন্তরের একাত্মবোধ যতটা সত্য হয় সেই পরিমাণে জীবনে আনন্দের সীমানা বেড়ে চলতে থাকে, অর্থাৎ নিজেরই সত্তার সীমানা।’ আর সৌন্দর্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ‘অনুভূতির বাইরে রসের কোনো অর্থই নেই।… সৌন্দর্যরসের সঙ্গে অন্য সকল রসেরই মিল হচ্ছে ঐখানে যেখানে সে আমাদের অনুভূতির সামগ্রী।’

‘দ্য মিনিং অব আর্ট’ (শিল্পের অর্থ বা তাৎপর্য) নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শিল্পের বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে বলেছেন : ‘নির্বস্ত্তক রূপরস সত্য বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যার অন্তর্গত হতে পারে কিন্তু বাস্তব জগৎ শিল্পকলারই ভুবন। শিল্পের নান্দনিকতা প্রসঙ্গে আমরা যে সৌন্দর্যের কথা বলি তা সাধারণ অর্থে নয়, সৌন্দর্যবোধের গভীরতার অর্থেই বলে থাকি যা কবির ভাষায় ‘‘সত্যই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যই সত্য’’ হিসাবে উচ্চারিত।… বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতেই অর্থাৎ জীবন চিত্রণের বাস্তবতায় শিল্পসৃষ্টির সৌন্দর্য আনন্দের উৎস হয়ে ওঠে।’

উদ্ধৃত বক্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, শিল্পসাহিত্য সৃষ্টির নান্দনিকতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় যে বাস্তবতার প্রকাশ তা বস্ত্তবাদেরই সমরূপ। তবে রবীন্দ্রনাথ উনিশ ও বিশ শতকের মানুষ হওয়ার কারণেই বোধহয় ভাববাদ বা ভক্তিবাদ ও বস্ত্তবাদের অদ্ভুত এক বৈপরীত্য তাঁর মধ্যে বর্তমান। একে কেউ কেউ তাঁর স্ববিরোধিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর নান্দনিক চিন্তায়ও একই রকম বৈপরীত্যের প্রকাশ।

তাই দেখা যায়, এজরা পাউন্ডের একটি কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে শিল্পসৃষ্টিতে পরিস্ফুট সৌন্দর্যকে রবীন্দ্রনাথ ‘নৈর্ব্যক্তিক’ আখ্যা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে টেনে এনেছেন তাঁর বহুকথিত প্রিয় প্রসঙ্গ ‘বিষয়ীর আত্মতা ও বিষয়ের আত্মতা’ যা নানাভাবে তাঁর শিল্পসাহিত্যতত্ত্ব বা নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনায় ফিরে ফিরে আসে। অন্যদিকে সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে বিপরীতধর্মী কথাও বলেছেন এই রবীন্দ্রনাথই।

তাঁর মতে, প্রাকৃত সৌন্দর্য তখনই সুন্দর যখন তার সঙ্গে ‘মনের দান মেশে’। সৌন্দর্য তখন তাঁর বিচারে ‘মনোহর’ হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে তাঁর আরো বক্তব্য, ‘আনন্দময় রূপসৃষ্টিতে বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তির একাত্মতা’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই সঙ্গে আবার যথারীতি উচ্চারিত ‘পরমপুরুষের সঙ্গে ব্যক্তির পারস্পরিকতার কথা’ (যে-কথা তাঁর কবিতায় ও অসংখ্য গানে নানাভাবে ব্যক্ত) যার মাধ্যমে ‘সত্যের অসীম রহস্য, সৌন্দর্যের অনির্বচনীয়তা’ উদ্ভাসিত হয়।

এমন সব ভাববাদী উচ্চারণ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথকে পরিপূর্ণ ভাববাদী বলা চলে না এ কারণে যে, একই সঙ্গে শিল্পসৃষ্টিকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেন ঘটনা (facts) ও ভাবের (ideas) আবেগময় প্রকাশ হিসেবে, ওয়ার্ডসওয়ার্থের তুলনায় এক-দু পা এগিয়ে। পূর্বোক্ত ‘Sensory Embodiment’ রবীন্দ্রনাথে এসে অধিকতার মাত্রায় হয়ে ওঠে ব্যক্তিনির্ভর, অভিজ্ঞতানির্ভর ও উপলব্ধিনির্ভর। তখন তাঁকে আর মগ্ন ভাববাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে চলে না। বলতে হয়, শিল্প-সৃষ্টির নান্দনিকতা বিচারে তিনি মধ্যপন্থী। তাঁর কবিতা ও গান তেমন সাক্ষ্য দেবে, দেবে তাঁর কিছুসংখ্যক ছোটগল্প ও নিবন্ধ।

 

ছয়

শিল্পসাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে মার্কসবাদীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মতামত বহু আলোচিত বিষয়। একসময় তা যথেষ্ট তীব্রতা নিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। এমনকি বঙ্গেও। সেক্ষেত্রে চার্বাকপন্থা ও লোকায়ত দর্শনের বাস্তবতা নিয়ে যে আলোচনা তাতে অনেকের সঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ছিল অগ্রণী ভূমিকা, বিশেষ করে ভারতীয় ভাববাদী ও বস্ত্তবাদী দর্শনচিন্তার দ্বন্দ্ব নিয়ে।

ইউরোপীয় মনীষীদের এ জাতীয় আলোচনায় মার্কস-এঙ্গেলসের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপেক্ষা করা চলে না। তবে এ-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক আলোচনার সূত্রপাত ঘটান ফরাসি পল লাফার্গ ও রুশী চিন্তাবিদ প্লেখানভ। শিল্পকলার সঙ্গে সমাজ ও শ্রেণিস্বার্থের সম্পর্কের বিষয়টি তাঁদের বক্তব্যে যথাযথ গুরুত্বে উঠে আসে। জার্মানির ফ্রাঞ্জ মেহরিং ছিলেন একই ধারার, তবে বিশেষভাবে সমাজ-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ শিল্পসাহিত্য বিষয়ক তত্ত্বের ঘোর বিরোধী। প্লেখানভে তা আরো স্পষ্ট এমন বক্তব্যে যে, শিল্পকলার বিকাশ সমাজ ও শ্রেণিসংগ্রামের সমান্তরাল ধারায়, সে-অনুযায়ী এর তাত্ত্বিক ভাবনা বা মতবাদের প্রকাশ।

এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ লেনিনের টলস্টয় সম্পর্কিত বহু-উদ্ধৃত প্রশংসাসূচক বক্তব্যের তুলনা টানেন ফ্রেড্রিক এঙ্গেলসের ব্যালজাক বিষয়ক মন্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে। মহৎ শিল্পীর ধর্ম মতাদর্শের ঊর্ধ্বে সমাজ বাস্তবতাকে স্থাপন করা। অন্যদিকে মাও সে তুংয়ের ইয়েনান বক্তৃতার অংশবিশেষও উল্লিখিত হয় পরবর্তীকালের মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের লেখায়। বলা বাহুল্য শেষোক্তজনের বক্তব্যে মার্কসীয় মতাদর্শ প্রাধান্য পেয়েছে যা কিছুটা হলেও দেখা যায় চীনা লেখক  লু-সুনের আলোচনায়।

তবে কিছুটা বিস্ময়ের হলেও সত্য যে, মার্কিনি সাহিত্যে মানবিকতা ও জীবনবাদের পাশাপাশি চিন্তাবিদ কারো কারো লেখায় শিল্পসাহিত্যের আলোচনায় বাস্তবতার প্রসঙ্গটি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। মাইকেল গোল্ড বা ম্যাথসিয়েসেনের পাশাপাশি গ্র্যানভিল হিকস সাহিত্য সৃষ্টি ও জনমানসে কমিউনিকেশন বিষয়ক ধারণাটিকে ঐতিহ্যসূত্রে গ্রথিত করেন যথেষ্ট স্পষ্টতায় ও স্বচ্ছতায়, যা টলস্টয়ের বহু পরিচিত কমিউনিকেশন তত্ত্বের তুল্যমূল্য।

তিরিশের দশক সাহিত্যের বাস্তবতা বিচারে ইউরোপ-আমেরিকায় এক ফলপ্রসূ সময়। যেমন সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমনি সাহিত্য সৃষ্টির তাত্ত্বিক আলোচনায়। জনাকয় ব্রিটিশ কবির আধুনিক প্রগতিবাদী সৃষ্টিশীলতার কথা বাদ দিলেও উঠে আসে সাহিত্য-শিল্প ও কবিতাবিষয়ক আলোচনার মধ্যে বিশেষভাবে ক্রিস্টোফার কডওয়েলের নাম। স্পেনের গৃহযুদ্ধে গণতন্ত্রী স্পেনের পক্ষে গঠিত ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে’ যোগ দিয়ে শহীদ কডওয়েলের কবিতার উৎস ও বিকাশ বিষয়ক গ্রন্থ ইলিউশান অ্যান্ড রিয়ালিটি (১৯৩৭) ক্লাসিক মর্যাদা পেয়ে যায় এর অভিনবত্বের গুণে। চল্লিশের দশকে বইটি বঙ্গীয় সাহিত্যে, এমনকি পূর্ববঙ্গেও শিল্পাদর্শ-বিষয়ক দিকনির্দেশনার সূত্র হিসেবে পঠিত ও বিবেচিত হতে থাকে।

সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ-সম্বন্ধ, উৎপাদন সম্পর্ক বিষয়ক কডওয়েল-কথিত সূত্রটিকে একাধিক সাহিত্যচিন্তাবিদ এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জর্জ থমসন। নৃত্যগীত উৎসবের তৎপরতায় যে আদি কবিতার জন্ম – কডওয়েলের এ চিন্তাসূত্র এখনো অস্বীকার করা হয় না। তবে থমসন সমাজের উৎপাদন শক্তির সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কের ওপরই গুরুত্ব আরোপ করেন বেশি যা নিয়ে ভাববাদীদের পক্ষ থেকে বিতর্কও যথেষ্ট।

বর্তমান সময়ে সাহিত্যবিষয়ক মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় ইউরোপীয় ভুবনে বেশ কিছু নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন রেমন্ড উইলিয়ামস, টেরি এগলিটন, জাঁ পল সার্ত্রে, অঁরি আরভোঁ, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, থিয়োডোর অ্যাডোর্নো, আর্নস্ট ব্লক, গিয়র্স লুকাচ বা লুসিয়েন গোল্ডম্যান, বেট্রোল্ড ব্রেখট প্রমুখ। এঁদের মধ্যে মতাদর্শগত ভাবনার মূল এক হওয়া সত্ত্বেও ব্যবহারিক ও নীতিগত সূত্রে প্রভেদ যথেষ্ট। তবে এঁরা ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের মূল বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শিল্পসৃষ্টির নান্দনিক বাস্তবতার সূত্র অন্বেষায় পরস্পর থেকে পৃথক।

ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের গবেষণাধর্মী আলোচনায় লেখক ও উৎপাদক সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। প্রসঙ্গত আমরা মনে করতে পারি এ সম্বন্ধে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু বক্তব্য এবং নিজকে ‘কলমপেষা মজুর’ বিবেচনা করা। আগেই বলা হয়েছে ‘লেখক-উৎপাদক’ বিষয়টি নিয়ে বিপরীত পক্ষে যথেষ্ট সমালোচনা লক্ষ করার মতো। বেঞ্জামিন কমিউনিকেশনের বিষয়টিকেও যথেষ্ট দৃঢ়তায় আলোচনায় এনেছেন। একই বিষয়ে ভিন্নমাত্রায় আলোচনা করেছেন অ্যাডোর্নো।

তবে লুকাচকে এসব আলোচনার মধ্যমণি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনার মতবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লুকাচ নিঃসন্দেহে বিশিষ্টজন, যদিও অপেক্ষাকৃত উদারপন্থীরা তাঁকে মতাদর্শের দিক থেকে কিছুটা এস্টাবলিশমেন্টধর্মী বলে মনে করেন। তাঁর উপন্যাস বিষয়ক ধ্যান-ধারণা স্পেনীয় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাল্ফ ফক্সের নভেল অ্যান্ড দ্য পিপলের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। এক কথায় লুকাচের সাহিত্যবিষয়ক নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনার মূলসূত্র হচ্ছে, সাহিত্য ব্যক্তির জীবন সাধনা হওয়া সত্ত্বেও নান্দনিকতা সাহিত্যে ব্যক্তিসত্তা ও সর্বজনীন সত্তার মধ্যে অপরিহার্য যোগসূত্র। সমাজ তার প্রেক্ষাপট। সেই সঙ্গে সমাজ-সচেতনতা ও সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা।

গোল্ডম্যানকে লুকাচের অনুসারী বলা হলেও তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক  চিন্তার মৌলিকত্ব কাঠামোবাদের ধারণায়, যে-বিষয়টি নিয়ে রয়েছে তাঁর বিস্তর বিচার-বিশ্লেষণ যা ব্যবচ্ছেদের সমধর্মী। বিষয়, বিশ্বনিরীক্ষা ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাঁর সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কের বিশ্লেষণ। কাঠামোবাদ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ উভয় মেরুতে, বিশেষ করে মার্কসবাদ-নিরপেক্ষ মহলে ব্যাপক। বিষয়টি অন্তত এক্ষেত্রে আমাদের নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনায় ততোটা প্রাসঙ্গিকত নয়। তবু মানতে হয়, কাঠামোগত ধারণায় কাব্যতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্য সমীক্ষার চর্চা শিল্পসাহিত্যের নন্দনতত্ত্বকে ঘিরে নানা তাৎপর্যপূর্ণ জিজ্ঞাসা ও তাত্ত্বিক চর্চার পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে বিতর্কের ধারায় উপস্থিত মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিকগণ।

‘শিল্পসাহিত্য যে সামাজিক সচেতনতার সুনির্দিষ্ট প্রতিফলন’ এমন তাত্ত্বিক ধারণা বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে সমাজবাদী নান্দনিকতার যে প্রকাশ ঘটায় একমাত্র-সমাজবাদী দেশে তার ধারায় ইউরোপের দেশে দেশে বিশিষ্ট তাত্ত্বিকদের হাতে বিষয়টির নানা চরিত্রে প্রকাশ ঘটেছে। উপরের সূত্রাকার আলোচনায় সেই আভাস মিলবে। এ সম্পর্কে লেখাজোখা কম হয়নি, এমনকি ভিন্নমতও যথেষ্ট। একদিকে যেমন অস্তিত্ববাদী ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র, অন্যদিকে বিশ্লেষক লুকাচের বিপরীতে খ্যাতিমান জার্মান নাট্যকার ব্রেখট। শেষোক্ত দুইজনের নন্দনতাত্ত্বিক বিতর্ক রীতিমতো উপভোগ্য। তেমনই উপভোগ্য ‘অভিব্যক্তিবাদ ও সামাজিক বাস্তবতা’ নিয়ে আর্নস্ট ব্লক বনাম গিয়র্গ লুকাচ বিতর্ক।

সন্দেহ নেই সমাজবাদী চেতনায় বিশ্বাসী নাট্যকার ব্রেখট জীবনবাদী নাটক সৃষ্টি ও সেগুলোর শিল্পশোভন ও দর্শকপ্রিয় সার্থক মঞ্চায়ন সত্ত্বেও শিল্পসাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার-ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কট্টর মানসিকতার বিরোধী। সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে উদারচেতা। সম্ভবত সে কারণে তিনি ঘেরাটোপে বেঁধে দেওয়া শিল্পতত্ত্ব ঢালাওভাবে গ্রহণের পক্ষপাতী নন। তাই লুকাচের সঙ্গে বিষয়ান্তরে তাঁর মতভেদ খুবই স্পষ্ট। তিনি নির্দিষ্ট মতাদর্শ ধারণ করেও শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।

যেমন, শিল্পের বিষয় নিয়ে ব্রেখট সমাজ-বাস্তবতায় বিশ্বাসী। একই সঙ্গে মুক্ত প্রকরণ ও কলাকৌশল ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিল্পীরা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সেখানে মতবাদের নিগড় যেন শিল্পীকে বেঁধে না রাখে, হোন তিনি মঞ্চনাট্যকার বা সাহিত্যকর্মী কিংবা চিত্রশিল্পী বা ভাস্কর। হয়তো তাই ব্রেখট চেতনাপ্রবাহের সাহিত্যরীতি নিয়ে তাঁর আলোচনায় কঠোর বিচারের সম্মুখীন হন না। প্রসঙ্গত বাঙালি মার্কসবাদী কথাসাহিত্যিক গোপাল হালদারের ত্রিদিবা স্মর্তব্য, কিংবা ধূর্জটিপ্রসাদের উপন্যাস। কিংবা সূচনালগ্নের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

অনেকটা ‘যত মত তত পথে’র মতো মার্কসবাদী শিল্পসাহিত্য অঙ্গনে শিল্পতত্ত্ব তথা নন্দনতত্ত্ব নিয়ে মতভেদ ইউরো-মার্কিন বিদগ্ধ শিল্পীমহলে মোটেই কম নয়। যেমন আধুনিকতা বনাম বাস্তবতা নিয়ে (যেখানে বিতর্ক নিতান্তই অনভিপ্রেত) তেমনি ভাববাদী নান্দনিকতা বনাম মার্কসবাদী নান্দনিকতা নিয়ে। শেষোক্ত ক্ষেত্রে বিতর্ক বরং উত্তাপ সৃষ্টি করার মতো। অন্যদিকে ‘নব্যবাস্তবতা’ও বিশেষ ঘরানার মধ্যেও প্রাতিষ্ঠানিকতাবাদীদের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ রয়েছে।

শিল্পের নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনা যত সংক্ষিপ্ত হোক ইংরেজ কৃষকসন্তান স্যার হার্বার্ট রিডের শিল্পবিষয়ক তাত্ত্বিক মতামতের সূত্র উদ্ধার না করে শেষ হতে পারে না। তাঁর মুক্তচিন্তায় ‘শিল্প আবেগ বা অনুভূতির অভিব্যক্তি, কম আর বেশি’। সেখানে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধিরও স্থান রয়েছে। তাঁর মতে, নন্দনতত্ত্ব উপলব্ধির বিজ্ঞান। সেই সঙ্গে শিল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি টলস্টয়-কথিত ‘কমিউনিকেশনেও’ অনেকটাই বিশ্বাসী।

শিল্পসাহিত্য সম্পর্কে রাবীন্দ্রিক ধ্যান-ধারণার মতোই উদারপন্থী হওয়ার কারণে হার্বার্ট রিড শিল্পকলা এবং তার নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক বহুবিধ সারগর্ভ আলোচনায় সৌন্দর্য, অনুভূতি, বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে বিশদ বিচার-ব্যাখ্যায় নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। তাই মধ্যপন্থীদের মতো তাঁর বক্তব্য, ‘All art is the development of formal relations, and where there is form there can be empathy’। তাঁর কথিত ‘এমপ্যাথি’ যখন বহুজনের একাত্মতা বোঝায় তখন রিডের শিল্পতত্ত্ব বিচারে বহুত্ববাদেরও প্রকাশ ঘটে টলস্টয়-ভাবনার সমান্তরালে।

বাংলা সাহিত্যে মার্কসবাদী মতাদর্শগত প্রভাব যদিও তিরিশের দশক থেকে এবং তা যেমন সাহিত্য সৃষ্টিতে তেমনি তত্ত্বগত বিতর্কে তবু শিল্পসাহিত্য নিয়ে নন্দনতাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ সীমিত পরিসরেই বিদ্যমান ছিল। নজরুলের কবিতায় ও সম্পাদকীয় নিবন্ধে সমাজবাদী ভাবনার প্রকাশ সত্ত্বেও নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনার প্রকাশ ছিল না কোথাও। তবে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হীরেন মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বা বিনয় ঘোষ                প্রমুখের লেখায় মার্কসবাদী শিল্পবিচার প্রাধান্য পেয়েছে। তবু বলতে হয়, দু-একজন বাদে তা নন্দনতত্ত্বের ব্যাপক পরিধি স্পর্শ করেনি।

তিরিশের শেষ দিকে প্রগতি লেখক সংঘ প্রগতি সাহিত্যের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করলেও তাত্ত্বিক আলোচনা ততোটা মুক্তপরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। লুনচারস্কি থেকে ঝ্দানভের উগ্র শিল্পসংস্কৃতি নীতির প্রভাব অধিকাংশকেই বিভ্রান্ত করেছে। এমনকি করেছে চল্লিশের দশকে ভবানী সেনের মতো তাত্ত্বিক বোদ্ধাকেও। প্রমাণ মেলে ‘মার্কসবাদী’ সংকলনে প্রগতি সাহিত্যবিষয়ক ব্যাপক তর্কবিতর্ক ও আলোচনায়। উগ্রপন্থার প্রভাব সত্ত্বেও সেসব আলোচনায় বেশকিছু মৌল সত্যের প্রকাশ ঘটেছে যা ডানপন্থী মার্কসবাদীদের স্বরূপ প্রকাশ করেছিল। তবে উগ্রপন্থা কখনো বাস্তবপন্থা নয়। তবু প্রগতি সাহিত্য ও শিল্পকলার বিচারে তিরিশের শেষদিক থেকে চল্লিশের দশকের অর্জন নেহায়েত কম নয়।

 

সাত

‘ইস্থেটিকস’ বা নন্দনতত্ত্ব সৌন্দর্য ও তার আনুষঙ্গিক বোধের বিচার-বিশ্লেষণ, এমন সংজ্ঞা সত্ত্বেও আধুনিকতায় যুক্ত হয়ে এর পরিধি সীমিত অতি-তাত্ত্বিকতা থেকে মুক্ত হয়ে অনেকটাই প্রসারিত উদ্যানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর সে কারণেই আধুনিক নন্দনতত্ত্ব  শিল্প-সাহিত্যের সামগ্রিক বিবেচনাকে আলোচনা তথা বিচার-বিশ্লেষণের বিষয় করে তুলেছে। সেখানে সৌন্দর্য, আনন্দ ইত্যাদি বিমূর্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা, তেমনি জীবনবাস্তবতাও আলোচ্য বিষয়। এ-কথায় চেতনার জগৎ ও বস্ত্তজগৎ সমান গুরুত্বে বিচার্য। যেমন বিচার্য আধার ও আধেয়।

শিল্পসাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচারে দুটো প্রধান ধারা ভাববাদ ও বাস্তববাদ বা বস্ত্তবাদের বিবেচনায় নিয়ন্ত্রিত। প্রথমোক্ত ধারায় যেমন দর্শন ও বিমূর্ত ধারণার প্রভাব তেমনি দ্বিতীয়ে জীবনবাস্তবতার। তৃতীয় ধারাটি খুব একটা আলোচিত না হলেও পূর্বোক্ত দুইয়ের সমন্বয়ে মধ্যপন্থা হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। সংখ্যায় কম হলেও স্বনামখ্যাত কিছুসংখ্যক মনীষী বা প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বকে শেষোক্ত পথের যাত্রিক হিসেবে দেখা যায় যা বর্তমান আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

শিল্পসাহিত্যের বিচারে উল্লিখিত দুই ধারাকে দ্বান্দ্বিক হিসেবে বিবেচনা করাই বোধহয় সংগত। বস্ত্তসত্তা থেকে জৈবিক সত্তা দুই বিপরীতের দ্বন্দ্বেই সত্য, এবং পূর্ণতায় পৌঁছাতে চেষ্টা করে। যেমন অণু-পরমাণুতে তেমনি তার বিশালায়তন রূপ বিশ্বভুবন ও মহাবিশ্বে শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার বৈপরীত্য সৃষ্টির রহস্যসূত্র হিসেবে বিবেচিত। মানববিশ্ব ও মানবসৃষ্ট শিল্প-সাহিত্যই বা এ নিয়মের ব্যতিক্রম হবে কেন। এ-সত্যটি অনেক সময় আমরা মনে রাখি না।

সবকিছু মিলিয়ে এ সত্যও মনে রাখা দরকার যে, যে কোনো বিষয়ের মূল্যায়নে একদেশদর্শিতার পরিবর্তে দরকার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বমাত্রিক বিচার, দরকার শিল্পসাহিত্য সৃষ্টির স্বরূপ নির্ধারণে, এমনকি তার নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনার ক্ষেত্রেও। মানবসত্তা ও মানব-অস্তিত্ব দুই বিপরীত ইলেকট্রন-প্রোটনের মতো ইতি-নেতির সমন্বয়ে ধৃত হওয়া সত্ত্বেও মানব-মনন ও মনীষা কেন জানি তার ভাবনায় একদেশদর্শিতার অনুরাগী, যদিও কারো কারো আগ্রহ পূর্ণতার দিকে যাত্রায় এবং তা অর্জনে।