শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী

অমিতাভ সেনগুপ্ত

…যাত্রীদল হতেছে উধাও

নাও ওগো ত্বরা ক’রে নাও

– ওমর খৈয়াম (নরেন্দ্র দেব)

গত বছর কলকাতায় আমাদের শেষ আড্ডায়, নিজের কথা নয়, কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতিচারণ করছিলেন শিল্পী এসএম সুলতানকে নিয়ে। নড়াইলের সুলতান। সুলতানের বোহেমিয়ান জগৎ, তাঁর শিল্প ও ঘটনা সবই যেন একে একে পাতা ওলটাচ্ছেন কাইয়ুম চৌধুরী। সেইসঙ্গে লক্ষ্য করছিলাম তাঁর সশ্রদ্ধ ও ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি।

ঠিক তাই। কাইয়ুম চৌধুরীর মধ্যে সহজে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা নেই। অথচ তিনি নিজেও বাংলাদেশের এক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ২০০৮ সালে। কলকাতার আর্ট ট্রাস্ট ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে দুই বাংলার শিল্পীদের প্রদর্শনী চলছিল। কিন্তু কলকাতার উৎসাহী শিল্পীরা ঘিরে আছে কাইয়ুম চৌধুরীকে। তিনি পুরনো শিল্পীদের সবাইকেই চিনতেন। সুতরাং প্রথম আলাপটা অনেকটাই আনুষ্ঠানিক।

আমার সুযোগ এলো এর কিছু পরে যখন ঢাকায় গেলাম, বেড়াতে। এক বন্ধুর বাড়িতে কয়েক সন্ধ্যা এবং বেঙ্গল গ্যালারির ক্যাফেটেরিয়ায় আমরা এক ঘনিষ্ঠ আলাপে মেতে উঠলাম। কলকাতায় এলেই দেখা হতো। গত বছর সুবীর এলো বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে দুই বাংলার শিল্পীদের নিয়ে ক্যাম্প ও ICCR-এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন উপলক্ষে। এসব পর্ব সেরে এক সন্ধ্যায় আমাদের আড্ডা, সেটাই শেষ পর্ব। সুবীরের সঙ্গে শুধু আরেকবার মাঝখানে দেখা হয়েছিল।

এইসঙ্গে একটা ছবি যেন মনে লেগে আছে, সস্ত্রীক কাইয়ুম চৌধুরী। সেটাই যেন তাঁর সম্পূর্ণ রূপ। কখনো তাঁকে একা দেখলে, ঢাকায় বা কলকাতায়, মনে হতো, একি বউদি আসেননি? দুজনেরই জগৎ যেন এক, আর্ট কলেজ ও ঢাকার শিল্প-পরিবেশে দুজনেই যুক্ত, পরিচিত। সুতরাং আড্ডায় অনেক ঘটনাই বউদি ধরিয়ে দিতেন। কাইয়ুম চৌধুরী একবার তাঁর কিশোরবেলার কথা বলেছিলেন। কারণ, জিজ্ঞেস করেছিলাম, ছবি আঁকার অভ্যাস কবে থেকে সচেতন অবস্থায় এলো? তাঁর গল্পে এলো দেবসাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত শিশুসাহিত্য। তখনকার দিনে প্রতুল ব্যানার্জী, ফণী গুপ্ত, সমর দে, এঁদের আঁকা ইলাস্ট্রেশন থাকতো। তাঁর চোখে এগুলি মনোমুগ্ধকর আকর্ষণ। তাঁকে আরেক কল্পনার জগতে নিয়ে যেত যেখানে শুধু রং আর ছবি। আমার ছেলেবেলাতেও দেখা প্রবাসী, বসুমতী, ভারতবর্ষ – এইসব পত্রিকায় থাকত একটা করে সমকালীন শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রিন্ট। আমাদের সমসাময়িক পরিবেশ প্রায় একই। ষাট-সত্তরের দশকের পরিবর্তন তখনো শুরু হয়নি। মোবাইল নেই, কম্পিউটার নেই অথবা প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া – এসব ঘটনার সূত্রপাত আর কিছু পরে। তাঁর চলিলশ বা পঞ্চাশের দশকের কৈশোরে শহর, মফম্বল বা গ্রামজীবনে প্রকৃতি আরো বোধহয় ঘনিষ্ঠ ও বাস্তব। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নড়াইল, নোয়াখালি বা ময়মনসিংহে তাঁর ছোটবেলা কেটেছে, এমনি করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে; কারণ তাঁর পিতা ছিলেন ব্যাংকের অফিসার এবং বদলি হতেন মাঝে মাঝেই।

তাঁর মানসিক গঠনের আরেক সূত্র খুঁজে পাই তাঁর পারিবারিক পরিবেশেও। এখানে যেন এক বিশেষ চর্চার হাওয়া – সামাজিক পরিবর্তন লক্ষ করা, সংগীত ও সাহিত্যচর্চা – অর্থাৎ সময়ের বিবর্তনকে লক্ষ করার পরিবেশ ছিল। অভ্যাস ছিল সাহিত্য ও নানা বিষয় নিয়ে পড়ার। সুতরাং কাইয়ুম চৌধুরী যে শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট হবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তিনি শিল্পী হলেন আরো নানা কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে।

আর্ট কলেজে শিক্ষকতার সুযোগ এলেও মনস্থির করলেন আরো পরে। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল, এই কয়েক বছর তিনি কাজে লিপ্ত হলেন ডিজাইন সেন্টারে, অবজারভার পত্রিকায় গ্রাফিক শিল্পী হিসেবে। তাঁর বহু ডিজাইন, প্রচ্ছদ নানা জায়গায় পুরস্কৃত হয়েছে। ইতোমধ্যে বিবাহিত। স্ত্রীও শিল্পী। ১৯৬৫ নাগাদ আবার সুযোগ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রূপান্তরিত ইনস্টিটিউট অফ ফাইন আর্টসে শিক্ষকতা করার। অনেকটা এভাবেই হয়তো তাঁর এক স্থিত কর্মজীবনের সূত্রপাত হলো এবং নিজের ছবি আঁকা আরো ব্যাপ্ত হতে থাকল। ১৯৬৫ থেকে ২০০২ – এই দীর্ঘ সময়ে তিনি শিক্ষায় এবং বিভিন্ন সদস্যপদে যুক্ত ছিলেন। এই পর্বে শিল্পকর্মের প্রদর্শনীও হয়েছে দেশে-বিদেশে। তিনি পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মান। ইতোমধ্যে লক্ষ্য করার, সময়ের এই পর্ব প্রতিফলন করে আরেক সামাজিক বিবর্তনকেও।

অর্থাৎ ঘটনার আবর্তে সত্তরের দশকের পর থেকে বাংলাদেশের নতুন পরিবেশে শিল্পের জোয়ার আরো এক বিশেষ রূপ নিল। শিল্পীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, শিল্পের ভাষাও বিবর্তিত হয়ে চলেছে শিল্পশিক্ষা ও শিল্পচর্চায়। এসবের সূত্রপাত দেখতে পাই কিছু আগের ইতিহাসে। যেমন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ এঁদের প্রচেষ্টায় শিল্পশিক্ষার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত; পরবর্তী যাঁরা এলেন, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম প্রমুখ। শিল্পের হাওয়া আরো প্রসারিত হলো। এলেন রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, মনিরুল ইসলাম, রফিকুন নবী, কালিদাস কর্মকার, ফরিদা জামান, মাহমুদুল হক এবং শাহাবুদ্দিন। আরো কত নাম, বাংলার শিল্পকে যেন আরেক পর্যায়ে পৌঁছে দিলো। পরিবর্তনের দ্রুততা লক্ষণীয় উত্তরসূরিদের কাজে। কয়েকজনকে মনে পড়ছে, যেমন রোকেয়া সুলতানা, কনক চাঁপা চাকমা। নিসার হোসেন তাঁর কর্মকান্ডে যোগ করলেন গ্রামশিল্পের খোঁজ। অথবা পরবর্তী আরো অনেকে মিশে গেলেন শিল্পের বিশ্বায়নে।

সময়ের এক বিশেষ সন্ধিতে যেন দাঁড়িয়ে আছেন কাইয়ুম চৌধুরী – দেখছেন সামনে-পিছনে দূর দিগন্তের শিল্পভূমি। যদি সংক্ষিপ্ত করা যায় এই ইতিহাসকে। তিনটি বিশেষ পর্ব মনে আসে – প্রাথমিক ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক ধারা। এরপর ফরাসি আধুনিকতার জোয়ার ও তার স্থানীয় রূপ এবং বিশ্বায়ন। এই বিবর্তন বিশেষভাবে মিশে আছে নানা ঘটনা যেমন ভাষা-আন্দোলন, বাংলাদেশ হওয়া ও পরবর্তী বাস্তবের তীক্ষ্ণ সংঘাত। শিল্পের বিবর্তন ছুঁয়ে আছে যেন সব স্তরে। আলাপচারিতায় কাইয়ুম চৌধুরী এই সময়বোধের পরিচয় দিতেন প্রায়শ। তাঁর সামাজিক পরিসরও ছিল বিস্তৃত – শিল্পী, গায়ক, কবি-লেখক এবং আরো কত অনুভবী সমাজে তার ছিল অনায়াস আনাগোনা। একটা কথা আছে ‘ডায়ালগিং’ – কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে তাই মনে হতো আড্ডায় বসে। তবু সময় ফুরিয়ে যায়।

ইউটিউবে দেখা

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে উচ্চাঙ্গসংগীতের এক অনুষ্ঠান ছিল। ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে। সেখানে বক্তব্য রাখার পর যথারীতি কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর আসনে ফিরে আসেন। কিন্তু আবার উঠলেন, হয়তো আরো কিছু বলার ছিল, ভুলে গেছেন বলতে, অথবা কিছু সংযোজনা।  কিন্তু মাইকের সামনে এসে বলা হলো না। সময়ের ডাক এলো আচমকাই।