শিল্পী কে. জি. সুব্রহ্মণ্যন : শ্রদ্ধায় স্মরণ

সুশোভন অধিকারী

সদ্য প্রয়াত হলেন দেশের অন্যতম প্রবীণ শিল্পী কে. জি. সুব্রহ্মণ্যন, সকলের ‘মানিদা’। আধুনিক শিল্পকলার প্রেক্ষাপটে তিনি যে বিশেষ অগ্রপথিক, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সদ্য প্রয়াত হয়েছেন বলে আবেগের বশে নয়, বরং একটু তলিয়ে দেখেই বলতে হয় – শিল্পের ইতিহাসে এমন সৃষ্টিশীল আর্টিস্টের দেখা সহসা মেলে না, যিনি তিরানব্বই বছর বয়সেও ছবির জগতে এত অনায়াস ও অফুরান। শুধু শিল্পরচনার ক্ষেত্রে নয়, শিল্পের ভাবনা আর বিশ্লেষণের ব্যাপারেও এই সজাগ মানুষটিকে বোধকরি কাল স্পর্শ করতে পারেনি। শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর শিল্পীসত্তার অনুভূতি ছিল একাধারে তীব্র ও গভীর। তাই শুধু প্রবীণ বলেই তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তা নয় – বৈদগ্ধ্য, আভিজাত্য আর জীবনবোধে তাঁকে যেন একজন দার্শনিক বলে মনে হয়। এ ছাড়া তাঁর অসামান্য বাকপটুতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। সর্বদা তাঁর কথার ফাঁকে-ফাঁকে শব্দের মোড়কে জড়ানো সূক্ষ্ম রসিকতা স্ফটিকখ-ের মতো ছিটকে পড়ত, সেইসঙ্গে তাঁর দীপ্ত চাহনি আর স্মিত হাসির ঝিলিক শ্রোতাদের মনে দীর্ঘকাল আঁকা হয়ে থাকবে। আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রখ্যাত চিত্রী হিসেবে হয়তো অনেকের নাম আমাদের মনে আসে, কিন্তু তাঁর মতো মেধা আর অ্যারিস্টোক্র্যাসির এমন আশ্চর্য মিশেল সচরাচর চোখে পড়ে না।

স্বভাবতই এমন একজন শিল্পীর জীবনের কথা খুঁটিয়ে জানতে ইচ্ছে করে, বুঝতে ইচ্ছে করে কীভাবে গড়ে উঠছিল তাঁর মানসিক বুনিয়াদ, কোন উপকরণে গাঁথা হয়েছিল শিল্পীর মনের ভিত্তি। কী সেই আশ্চর্য অভিঘাত, যা তাঁকে ক্রমশ এমন পরিণত আর আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছে? ছোটবেলার দিকে তাকালে দেখি, দক্ষিণের মালাবার অঞ্চলের একটি ছোট্ট শহর মাহেতে কেটেছে তাঁর বাল্যকাল। একটু দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে লেখাপড়ার সূচনা হয়েছে কিছু দেরিতে। শরীরের জন্যেই হয়তো খেলাধুলোর চেয়ে বাড়িতে বসে ছবি আঁকতে বেশি ভালোবাসতেন। আর শৈশবে চিত্রকলার প্রতি সেই অমোঘ টান তাঁকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত টেনে রেখেছিল, একচুল শিথিল হতে দেয়নি। পরবর্তীকালে কেবল ছবি আঁকার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, অজস্র মাধ্যমে কাজ করেছেন। ছবির পাশাপাশি টেরাকোটা, গ্লাস-পেইন্টিং, ছাপাই ছবি, ভিত্তিচিত্র, সিরামিক, এনামেলের ওপর কাজ, সরাচিত্র বা ভাস্কর্য থেকে শুরু করে পাপেট তৈরি পর্যন্ত কে. জি. সুব্রহ্মণ্যনের শিল্পকাজের বিস্তৃতির অন্তর্গত। আর কোনো বিভাগেই তিনি কেবল আলগোছেভাবে দু-একটা কাজ করে ক্ষান্ত হননি। যে-মাধ্যমকে স্পর্শ করেছেন তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছেন। গভীর অনুসন্ধানী এক সতেজ মন সব সময় তাঁকে চালনা করত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৃজনের কাজে তিনি ক্লান্তিবোধ করেননি।

লক্ষ করলে দেখি, তাঁর মনের অন্দরে ছোটবেলা থেকেই যেন একটা প্রতিজ্ঞা, একটা জেদ প্রচ্ছন্ন ছিল। পড়াশোনায় মেধাবী সুব্রহ্মণ্যন কিশোর বয়সে মার্কসবাদী মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তবে বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই প্রভাবের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে গান্ধীজির আদর্শের প্রতি বিশ্বাস। আপনমনে ছবি আঁকার পাঠ চালিয়ে গেলেও কলেজ-জীবনে তিনি অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। কলেজের ছাত্রাবস্থায় মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে। এই প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পরিণামে ছমাস জেল খাটতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পেয়েও শিল্পচর্চা থেমে যায়নি, নিঃসন্দেহে সেটিই ছিল তাঁর নিজস্ব আইডেন্টিটি। এই সময়ে হঠাৎ করে তাঁর কিছু ছবি, স্কেচ-খাতা মাদ্রাজ আর্ট স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর হাতে পড়ে এবং তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ধীরে-ধীরে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চান সুব্রহ্মণ্যন। আর এ-পর্বেই তাঁর চিত্তের অভিমুখটি সম্পূর্ণ ঘুরে যায় চিত্রকলার দিকে। ইতোমধ্যে তাঁর দাদা শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর কাছে দরবার করে কলাভবনে তাঁর শিল্পচর্চার বিষয়টি পাকা করে দেন। তারপর নন্দলালের নির্দেশে উনিশশো চুয়াল্লিশে শিল্পের পাঠ নিতে তাঁর শান্তিনিকেতনে আসা। সেই থেকে দুই হাজার ষোলো পর্যন্ত আমৃত্যু সুদীর্ঘ তিনি কলাশিল্পের গভীরে বুঁদ হয়ে ছিলেন। যখন শান্তিনিকেতনে আসেন, তখন সদ্য তিরোধান ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের। বিশ্বভারতীর আচার্যের পদে আসীন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছাত্র হিসেবে কলাভবনে যোগ দিয়ে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে নন্দলাল, বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের উজ্জ্বল উপস্থিতি গোড়াতেই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর প্রথম দিনের অমলিন স্মৃতিটুকু ছবির মতো এঁকে রেখেছেন আমাদের সামনে। যখন এসেছিলেন, তখন বোধকরি বসন্তের শেষ অধ্যায় – ‘লাল রঙে মুড়ে আছে গোটা শান্তিনিকেতন। চারদিকে শিমুল আর পলাশের মেলা। এ যেন স্বপ্নের দেশ। পৌঁছলাম বিশ্বভারতীর গেস্ট হাউসের কাছে। অদূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে রামকিঙ্করের ‘বাতিদান’ ভাস্কর্যটি। আরো সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রত্যক্ষ করলাম ভারতের প্রথম আধুনিক ভাস্কর্যকে। দিনটা ছিল বুধবার। ভেসে আসছে মন্দিরের গান। পুলকিত হলাম। ভাবলাম, বাহ বেশ জায়গা তো! শিল্প ও নিয়মবিধির সম্মিলনে সেই শান্তিনিকেতন, প্রথম দেখাতেই অপূর্ব মনে হলো।… মানুষ আর

প্রকৃতিকে আলাদা করা যাচ্ছে না।’ ছাত্রাবস্থায় সুব্রহ্মণ্যন যখন কলাভবনে আসেন, সেই সময় বোম্বে শহরে বিশ্বভারতীর একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে আশ্রমের অনেকেই সেখানে গিয়েছেন। এসব অনুষ্ঠানে কলাভবনের ওপর মঞ্চসজ্জা, মেকআপ ইত্যাদির দায়িত্ব থাকত। তা ছাড়া গান, অভিনয়েও ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিতেন, ফলে কলাভবনের চত্বর তখন বেশ ফাঁকা। তাই প্রথম অবকাশে কলাভবনের তিনজন মহাশিক্ষক – নন্দলাল, বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর – আধুনিক ভারতীয় শিল্পের তিনটি প্রধান স্তম্ভের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। একজন নবাগত ছাত্রের পক্ষে এটা কম সৌভাগ্যের কথা নয়। সুব্রহ্মণ্যনের কাছ থেকেই জানতে পারি, নন্দলাল তাঁর ছবি দেখে খুশি হয়ে ছবির আরো গভীরে প্রবেশের জন্য তাঁকে বিনোদবিহারীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আর আমরা জানি, প্রথম থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ছাত্রটির মনে বিনোদবিহারীর আসন কত গভীরভাবে আঁকা হয়েছিল! এমনকি এ-মুহূর্তে, মাত্র কিছুদিন আগে, তাঁর শান্তিনিকেতনের বাড়িটি যখন বিশ্বভারতীকে দান করলেন – তখন তা উৎসর্গীকৃত হলো বিনোদবিহারীর স্মরণে। গুরুর প্রতি শিষ্যের এর চেয়ে বড় নৈবেদ্য আর কী হতে পারে? অবশ্য তার মানে এই নয় যে, নন্দলাল ও রামকিঙ্করের প্রতি তাঁর আন্তরিক শ্রদ্ধায় কিছু খামতি ছিল। ‘মাস্টারমশাই’ আর ‘কিঙ্করদা’র প্রতি তাঁর আকর্ষণ যে কোন পর্যায়ে উন্নীত ছিল, তা তাঁর সারাজীবনের অজস্র লেখা আর কথাবার্তায় ধরা আছে। তবে তাঁর অ্যানালিটিক্যাল মানসিক স্তরের সঙ্গে বোধহয় বিনোদবিহারীর চিন্তাভাবনার মিল খুঁজে পেতেন সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেওছেন – ‘তিনি (বিনোদবিহারী) আমার কাছে এককথায় অতুলনীয়।… চিত্রকলা সম্পর্কে জ্ঞান যে অপরিসীম ছিল সেটা নিয়েও নতুন কিছু বলার নেই। পাশাপাশি, সাহিত্য সম্পর্কেও তাঁর উৎসাহ ছিল দৃষ্টান্তমূলক। যে-বইটি তিনি পড়ে ফেলেছেন, তার পাতায়-পাতায় কী লেখা আছে, বইটি না দেখে অনুপুঙ্খ বলতে পারতেন বিনোদদা। এরকম ভিজুয়াল মেমোরিসম্পন্ন লোককে তো পাওয়াই মুশকিল। আরও একটা গুণ ছিল ওর – সকল বিষয় নিয়েই খোলামেলা কথা বলতে পছন্দ করতেন তিনি।’

আবার রামকিঙ্করের সঙ্গে স্কেচ করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও তাঁর স্মৃতিতে আজীবন অমলিন থেকেছে। তিনি নিজেই জানিয়েছেন – ‘শান্তিনিকেতনে গোড়ার দিকে খুব স্কেচ করতে ভালো লাগত। কিঙ্করদার সঙ্গে বহুদিন ঘুরে-ঘুরে ছবি এঁকেছি। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। একদিন কী মনে হলো, কিছু স্কেচ মাস্টারমশাইয়ের কাছে নিয়ে গেলাম। দেখে তিনি বিস্মিত, বললেন – ‘তুমি তো অনেক কাজ করেছ রে।’ উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি ছবির খুঁতগুলোও ধরিয়ে দিলেন। স্কেচে বিষয়গুলিকে আমি যে অনুপুঙ্খভাবে নিয়ে এসেছি, অর্থাৎ ডিটেলিং, সেই প্রবণতা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিলেন তিনি। আরো বললেন, ‘তুমি তো পেনসিল-পেন দিয়ে ড্র করো, না? আমি তোমাকে একটা বড়ো চারকোল দিই। এটা দিয়ে ড্র করো দেখি -’ এই প্রথম আমি হাতেনাতে বুঝলাম, দুটো মাধ্যমের ভাষা কতখানি ভিন্ন। মাস্টারমশাই সেটা আমাকে প্রথম ধরিয়ে দিলেন।’

ছাত্রজীবনের সেই প্রথম জীবনের স্মৃতি সুব্রহ্মণ্যনের মনে গভীরভাবে ছাপ রেখে যায়। পরবর্তীকালে তিনি যে কত বিভিন্ন ও বিচিত্র মাধ্যমে কাজ করে গেছেন, তা আমাদের অজানা নয়। তবে বিভিন্ন মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য-অনুযায়ী শৈলী ও আঙ্গিকের যে ফারাক ঘটে, সেই অনুসন্ধিৎসার অঙ্কুর হয়তো এই ছোট্ট ঘটনার মধ্যে নিহিত আছে।

সুব্রহ্মণ্যন চিরকালই সাহিত্য, শিল্প তথা ইতিহাসের অনুভবী পাঠক ছিলেন। আগেই বলেছি, এই কারণে বিনোদবিহারীর সঙ্গে তাঁর মানসিক স্তরের একটা বিশেষ সাযুজ্য ছিল। এখানে আরেকটা কথাও বলতে হয়, একেবারে নিখাদ মাটির স্তর থেকে উঠে-আসা রামকিঙ্করও আশ্রম-আচার্য রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন, তার কিছু খবর আমাদের জানা। আশ্রমের খোলা মাঠে, কোয়াইয়ের ধারে বসে উঁচু গলায় বই পড়তে-পড়তে তাঁর হাসির আওয়াজ আজও অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সুব্রহ্মণ্যনের সাক্ষ্য থেকেও জানতে পারি পাঠক রামকিঙ্করের কথা – ‘কিঙ্করদার বাড়িতে যখন নিয়মিত যেতাম, দেখেছি, কী নিবিড়ভাবে তিনি পাঠ নিচ্ছেন ইংরেজি সাহিত্যের। বার্নার্ড শ ওঁর খুব প্রিয় ছিল। শ-র দ্য আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান নাটকটি অনুপ্রাণিত করেছিল কিঙ্করদাকে। অনেকেই রামকিঙ্করকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, উচ্চস্বরে, খুব জোরে-জোরে নাটক পড়লে ইংরেজি উচ্চারণে নাকি সড়োগড়ো হওয়া যায়। শুধু এই কারণেই নয়, ইংরেজি নাটক তাঁকে উদ্দীপ্তও করত, গলা ছেড়ে কিঙ্করদা পড়ে যেতেন। এভাবে কিঙ্করদার ইংরাজি ভাষার ওপর অন্যরকম এক দখল তৈরি হলো।… শেখার এই অদম্য ইচ্ছার পাশাপাশি কিঙ্করদার আর যেটা ছিল, প্রবল অনুভব-শক্তি।… কোনো একটা ইংরেজি শব্দের মানে যথার্থভাবে তিনি জানেন না, কিন্তু

অনুভবী-শক্তির জোরে বিষয়ের অন্তরাত্মাকে চট করে স্পর্শ করে ফেলতেন তিনি।’ রামকিঙ্করের এই তন্নিষ্ঠ ছাত্রটি কীভাবে তাঁর শিক্ষকের মনের অন্দর মহলে প্রবেশ করেছিলেন – এই টুকরো যেন তাঁর প্রত্যক্ষ দলিল। অপরদিকে পাঠক সুব্রহ্মণ্যনের প্রতিও তাঁর দুই শিক্ষক বিনোদবিহারী এবং রামকিঙ্করের সাগ্রহ দৃষ্টি ছিল, তাঁরা প্রায়শই খোঁজ নিতেন, উৎসাহ দেখাতেন এই নবাগত ছাত্রটির সাহিত্যপাঠ প্রসঙ্গে। জানতে চাইতেন, চিত্রচর্চার ফাঁকে কী পড়ছে এই অনুভূতিশীল পড়–য়া ছাত্রটি। একজন চিত্রকরের মধ্যে প্রায়শই দুটো সত্তা কাজ করে, একটা যদি শিল্পী বা স্রষ্টার, তবে অন্যটা শিক্ষকের। এমনটা প্রায় দেখা যায়, কেউ শিক্ষক হিসেবে অসাধারণ, ছাত্রের শিল্পচর্চায় দেখার চোখ খুলে দিতে তাঁর জুড়ি নেই। কিন্তু কলাজগতের বড় প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্র শিল্পী হিসেবে নিজেকে হয়তো প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। কাজে বা শিল্পভাবনায় তাঁর ব্যক্তিগত টিপছাপ সেভাবে ফুটে উঠতে চায় না। এ যেন এক আশ্চর্য আয়রনি! যিনি ছাত্রের শিল্প-জিজ্ঞাসাকে উসকে দিয়ে তাকে ঠেলে দিচ্ছেন আলোর দিকে অথচ তাঁর নিজের কাজে বুঝি সে- আলোর ঝলকের অভাব রয়ে গেল। আবার এর বিপরীতটাও কি ঘটে না? দেখতে পাই, কোনো শিল্পীর খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা অনেক ওপরের সারিতে থাকলেও শিক্ষক হিসেবে ছাত্রের মনে ছাপ ফেলতে পারেন না, তাদের মনে জমে-ওঠা কৌতূহলের পিপাসা সেভাবে মেটাতে পারেন না। ইতিহাসের পাতায় এমন উদাহরণের অভাব নেই, যিনি শিল্পী হিসেবে মহত্তর স্বাক্ষর রেখেও শিষ্যের মনকে উদ্দীপিত করতে পারেননি, শিক্ষক হিসেবে কোথাও গ্রহণযোগ্যতার খামতি রটে গেছে। তাই মনে হয়, গুরুমশাই সেজে ক্লাসরুমে শিল্পের পাঠ দেওয়া আর আর্টিস্ট হিসেবে নিজের ক্রিয়েটিভ সত্তার ভুবনে যথার্থ চিহ্ন রেখে-যাওয়া সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। সৃজনের এই আপাত বৈপরীত্য কোথাও যেন ভিন্ন খাতে বইতে চায়। আবার এও ঠিক, শিল্প-শিক্ষকের ক্লাসরুম আর শিল্পীর স্টুডিওর এ-দ্বন্দ্ব দোলাচল আজকের নয়, তা চিরকালীন। কেউ-কেউ অবলীলায় এই দুইয়ের মধ্যে সেতু বাঁধতে পারলেও স্বীকার করতে হবে, শিল্পী আর শিক্ষক এই দুদিকেই সমান জোরদার – এমন মানুষের সংখ্যা বেশি নয়, সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে এঁরা যথেষ্ট অপ্রতুল। এ-বিষয়ে অবনীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ টেনে আনতে পারি। তাঁর ছাত্রদের স্মৃতিকথায় জানা যায়, শিক্ষক অবন ঠাকুর, শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের চেয়ে কিছুমাত্র কম ছিলেন না। শিল্পচর্চায় এক অননুকরণীয় ভঙ্গি ছিল তাঁর, শিষ্যদের মনে তিনি তীব্র অভিঘাত তৈরি করে দিতে জানতেন। ছাত্রের কোনো ছবির ব্যাপারে তিনি কতটা কনসার্নড ছিলেন – তার খবর আমাদের অজানা নয়। নন্দলালের ‘উমার তপস্যা’ ছবি ঘিরে অবনীন্দ্রনাথের ব্যাকুলতা আমরা পড়েছি। আবার কখনো সাধারণ ছাত্রের কাছে তাঁর পা-িত্যের বিপদের দিকটাও ছায়া ফেলেছে বইকি। গুরু অবনীন্দ্রনাথ কী বলছেন, সেটা ধরতে না-পেরে কেউ-কেউ তাঁর শিল্পশৈলীর অন্ধ অনুকরণ করে বসেছেন। ছাত্রের ছবিকে কেন্দ্র করে শিক্ষক নন্দলালের অনেক ছোট-বড় ঘটনার কথাও শুনেছি। বিনোদবিহারী, রামকিঙ্করের কাছে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছাত্রছাত্রীরা অনেকে বলেছেন। সেই সূত্র ধরে পরম্পরার মতোই শিক্ষক সুব্রহ্মণ্যনের প্রসঙ্গ এসে পড়ে।

শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন ‘মানিদা’? নিঃসন্দেহে আর্টিস্ট ‘মানিদা’র পাশাপাশি গুরু সুব্রহ্মণ্যনের ক্লাস, সে যেন এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আর্টিস্ট সুব্রহ্মণ্যনকে জানার জন্য রয়েছে তাঁর শিল্পের সম্ভার। সময়ের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে কাজের প্রতি খেয়াল করলে তাঁর শিল্পীসত্তার বাঁকগুলো অনেকটা অনুধাবন করা যায়। কিন্তু শিক্ষক সুব্রহ্মণ্যনকে ছুঁতে পারা তেমন সহজ নয়। তাঁর কাছে যাঁরা শিল্পের পাঠ নিয়েছেন তাঁরা জানেন, প্রতিটি ক্লাসে কীভাবে তিনি ছাত্রছাত্রীদের মোহাবিষ্ট করে রাখতেন! আমরা জানি, আশির দশকের মাঝামাঝি তিনি অধ্যাপনার সূত্রে বরোদার আর্ট কলেজ থেকে কলাভবনে যোগ দিলেন। আর সেই বছরেই কলাভবন হারিয়েছিল দুই কিংবদন্তি শিল্পীকে। একজন রামকিঙ্কর, অন্যজন বিনোদবিহারী। একজন সারাটা জীবন কাটিয়েছেন কবির আশ্রমে, দ্বিতীয়জন সাতের দশকের গোড়ায় দিল্লি চলে গেছেন। গভীর দুঃখের কথা, সুব্রহ্মণ্যন যখন শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন, সেই বছরেই তাঁর দুই প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত হলেন। আর মানিদাও যেন কলাভবনের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিলেন। ব্যক্তিগতভাবে কলাভবনে গ্র্যাজুয়েশন শেষে আমরা তখন পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। তাঁর মতো শিল্পীর কাছে ক্লাস করার সুযোগ আসছে – এই ভাবনায় মনের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা। অবশ্য এর আগেও তাঁকে আমরা পেয়েছিলাম। ১৯৭৭ সালে তিনি অতিথি-অধ্যাপক হিসেবে কিছুকাল ছিলেন শান্তিনিকেতনে। তখন বড়রাই তাঁকে অধিকার করেছিল, তিনি ছিলেন আমাদের নাগালের বাইরে। তবে সে-পর্বে আমাদের লাইফ-স্টাডির ক্লাসের একদিকে দাঁড়িয়ে তিনি একটা নিজস্ব ছোট ইজেলে বোর্ড লাগিয়ে মাঝে-মাঝে স্টাডি করতেন। আমরা বালখিল্যের দল সেই সময়ে ভালো করে বুঝতেও পারিনি – কার পাশে দাঁড়িয়ে কাগজে আঁচড় কেটে চলেছি। এবারে সরাসরি তাঁর কাছেই ক্লাস, উত্তেজনা তো হবেই। তাঁর কথা বলার একটা বিশেষ ভঙ্গি ছিল। ক্লাসে আমাদের ছবি নিয়ে আলোচনার সময় কখনোই ‘এই জায়গাটা এইভাবে করো’ বলে স্পষ্ট নির্দেশ দিতেন না। এমনভাবে বলতেন যাতে ছাত্রদের বেশ খানিকটা এক্সারসাইজ করতে হয়, পরিশ্রমের বাইরে কোনো শর্টকাট পন্থা ছিল না। ক্লাসে ছাত্রদের ছবি নিয়ে আলোচনার সময় মনে হতো, সে-সমস্যাটা তাঁর নিজের ছবির – এতটাই একাত্ম হয়ে উঠতেন তিনি। ছবিকে ঘিরে নানা ধরনের গল্প, কত রেফারেন্স, ক্রস-রেফারেন্স জড়ো হতো, তার ইয়ত্তা নেই। আমরা বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনতাম, ভেতরে-ভেতরে যেন ভাবনার স্বতন্ত্র বনেদ গড়ে উঠতে চাইত। ছাত্রদের কাছে ছবি আঁকার ক্লাসকে এত কৌতূহলোদ্দীপক করে তোলার মতো শিক্ষক সহসা পাওয়া যাবে না। সুব্রহ্মণ্যনের ছবির বিশেষত্ব হলো এই যে, তাঁর ছবি একদিকে যেমন আধুনিক তেমনি তার একটা সার্বিক আবেদন আছে, যা সকলকে ছুঁয়ে যেতে পারে। বিষয় আর আঙ্গিক দুভাবেই তাঁর ছবি সরাসরি দর্শকের চোখে এসে পৌঁছয়। বিষয় বা প্রকাশের ভঙ্গি সুস্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ, চিত্রপটের সঙ্গে রংতুলির সপাট অভিব্যক্তিতে কোনো বিচিত্র কৌশল, কোনো লুকোচুরি খেলা নেই। তুলির ক্ষিপ্র টানে, রং লাগানোর আকুলতায় শিল্পীর অন্দরে যেন একজন ছটফটে শিশু বাস করে, অথচ যার নিষ্কম্প আঁচড়ে কোথাও এতটুকু দ্বিধা নেই। প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্তি তাঁর ছবিকে হয়তো শিশুর মতো সহজ বলে মনে হতে পারে; কিন্তু ছবির বিন্যাস, পটের স্থানবিভাজন দেখে বুঝতে বাকি থাকে না, এই ছবির বুনোট কত ঘন, নির্মিতি কতটা জোরালো! তাঁর কালার-প্যালেটেও যেন রঙের অবিরত ঝরনা প্রবাহিত। একাধারে যেমন পটের ছবির মতো অত্যন্ত উজ্জ্বল, তেমনি প্রাথমিক ও পরিপূরক বর্ণের ব্যবহারে টানটান। আবার কোথাও তা ¯িœগ্ধ প্যাস্টেল-শেডের সূক্ষ্ম টোনাল মূর্ছনায় স্নাত। সুব্রহ্মণ্যনের চিত্রমালায় প্রাথমিক তীব্র বর্ণের পাশাপাশি কিছুটা অপরিচিত রঙের ব্যবহার ও তাদের মৃদু স্পর্শ এমনভাবে ছড়ানো থাকে – যা ছবির সামনে না-দাঁড়ালে বোঝা যায় না। সচরাচর ব্যবহার না-হওয়া কিছু রং, যেমন মভ, চড়া পিঙ্কের মতো ব্রাত্য শেডগুলোও অনাবিল সাহসে ক্যানভাস অধিকার করে। আবার আফ্রিকান ট্যাপিস্ট্রির ঘন-বাদামি, ছাই, নীলচে কালোর মধ্যে থেকে হয়তো উঁকি মারে আগুন রঙের ফুলকি। জাভা-বাটিকের খয়েরি-ঘেঁষা কাছাকাছি রঙের নানা শেড দেখে কখনো মনে হয়, এই জাতীয় মনোক্রোম ছবিতেই বুঝি শিল্পী সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ। গ্যালারিতে তাঁর একগুচ্ছ ছবির সামনে গেলে বোঝা যায় তাঁর কালার-প্যালেটটি কতদূর বিস্তৃত। আবার একই সঙ্গে অত্যন্ত সীমিত প্যালেটে রচিত ছবির উদাহরণও কম নয়। চিত্রী সচেতনভাবেই রং-রেখা-আকারের প্রত্যক্ষ অভিঘাতে দর্শকের দৃষ্টিতে স্বতন্ত্রভাবে ঘা দিতে চান। হয়তো এই কারণে কলাভবনের সবুজ গাছগাছালির মধ্যে অবস্থিত একটি গোটা বাড়ি, ডিজাইন-স্টুডিওর দেয়াল একেবারে সাদাকালোর বৈপরীত্যে বেঁধে ফেলতে চান। যেখানে অন্য সমস্ত রং বর্জিত হয়েছে, শুধু কালো আর সাদা – ফিল্মের নেগেটিভের মতো। মানিদার ছবিতে সাদাকালোর এই আকর্ষণের নেপথ্যে চীনে-জাপানি ছবির প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। অবশ্য সাম্প্রতিক অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাব, দূর-প্রাচ্যের চিত্রকলার হাত ধরে নন্দলাল-বিনোদবিহারীর কাজেও সাদাকালোর দুর্মর আগ্রহ অব্যাহত ছিল।

কলাভবনের ডিজাইন বিভাগের দেয়ালে সাদাকালোর ব্যবহার সম্পর্কে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন – ‘কলাভবনের বিল্ডিংগুলো খুব সাধারণ। প্রথমবার সেখানে ওই মুরালটা করার সময় বলা যায়, একটা ধাক্কা দেওয়ার জন্যেই আমি ওই সাদা-কালো রংটাকে বেছে নিলাম। মনে করুন কোনো ছবির বই ছাপছেন। সেখানে নর্মাল ইমেজগুলোর মধ্যে হঠাৎ একটা রিভার্স ইমেজ ছেপে দিলে যেটা হয়, একটা বৈপরীত্য তৈরি হয়। কলাভবনে করা ওই সাদাকালো মুরালটি অনেকগুলো নরমাল ইমেজের মধ্যে একটা রিভার্স ইমেজ।’

বিনোদবিহারী বা রামকিঙ্কর যখন স্টুডিয়োর বাইরে এসে কাজ করতেন, তখন আশপাশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আদিবাসী মানুষজনের মন্তব্যের প্রতি খেয়াল রাখতেন। আমাদের মনে পড়বে, একবার গরু-মহিষের দল স্কেচ করার পরে বিনোদবিহারী আশপাশের কৌতূহলী সাঁওতাল মেয়েদের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছবিটা কেমন লাগছে তাদের। তারা সহজ নিষ্কম্প কণ্ঠে বললে মন্দ হয়নি, তবে সবই তো বড় পূর্ণ গরু-মহিষের ছবি আঁকা হয়েছে, একটাও বাছুর নেই কেন। তাদের উত্তরে বিনোদের মনে হয়েছিল তাঁর ছবি যে সত্যিই অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। তেমনি কলাভবনের গা-ঘেঁষে চলা রাঙারাস্তার ধারে তাঁর ‘সাঁওতাল পরিবার’ ভাস্কর্যটির কাজ চলছে, তখন পথচলতি মানুষজন, মাঝি-মেঝেনের দল সকলে কৌতূহলী চোখে দাঁড়িয়ে দেখত।

রামকিঙ্কর এমনিতেই তাদের কাছের লোক, খোলা প্রাঙ্গণের কাজটি নিয়ে সকলেই আগ্রহী ছিলেন। ভাস্কর্য যখন প্রায় শেষের পথে, একবার রামকিঙ্কর ভিড়-জমানো সাঁওতালদের প্রশ্ন করলেন, কেমন লাগছে তাঁর কাজ। তারাও শিল্পীকে হতবাক করে জবাব দিলো ‘করছিস তো মাঝি, দেখাচ্ছে যেন দেবতা’। এই আশ্চর্য উত্তরে কি নিঃশব্দে জড়িয়ে রইল না শিল্পের উত্তরণ? সম্প্রতি মানিদার সাদাকালো মুরাল আঁকার সময়েও এমনই এক ব্যাপার ঘটেছিল। কাজ যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখনো বাড়ির পেছন দিকে দেয়ালের একটা বড় অংশ ফাঁকা ছেড়ে রেখেছিলেন – বিশেষ কিছু তৈরির পরিকল্পনায়। সেখানে ছাত্রদের কাজ হতে পারে, বা তাঁর একটা পুরনো ছবি ‘পিকাসোকে একটা ষাঁড় তাড়া করছে’ এমন কিছু মজার বিষয়ে ছবি আঁকা যেতে পারে। কিন্তু তাঁর বাড়িতে কাজ করতে-আসা সাঁওতাল ছেলেটি একদিন বলল, ‘বাবু আপনি তো ওই জায়গাটা খালিই রেখেছেন – ওইখানে একটা দেবীর মূর্তি করুন না।’ শিল্পীর মনে হলো ‘হ্যাঁ, সেটাই করা যায়।’ রামকিঙ্কর-বিনোদের মতো তাঁর কাছেও সাঁওতাল ছেলেটির সরল ভাবনাটুকু সানন্দে বিবেচিত হলো। তার কথাতে দেয়াল চিত্রিত হলো দুর্গার ছবিতে। তবে ‘মানিদা’র এই দুর্গা কোনো অস্ত্র হাতে লড়াই করে না, যুদ্ধ করে ফুল নিয়ে। তাঁর মতে, কোনো শক্তিকে দমন করতে হলে বিপরীত শক্তিকেই প্রয়োগ করতে হয়। সে-ভাবনার সূত্রে বলি, পৃথিবী জুড়ে এই হানাহানিতে বন্দুকের নলের সামনে আমাদেরও আজ ফুল দিয়ে যুদ্ধ করার সময় এলো।