শিল্পী তাকাইচি সাকামোতো এবং মৈত্রীবন্ধন

শুভ জ্যোতি

গত বছরের অক্টোবরে ঢাকায় এসেছিলেন জাপানের শিল্পী তাকাইচি সাকামোতো (Takaichi Sakamoto)। গ্লোরিয়া ফাউন্ডেশন ও রিন্নির (জাপানিজ কোম্পানি) সঙ্গে বাংলাদেশ-জাপান শিল্প-সংস্কৃতি বিনিময় প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে তিনি বাংলাদেশে আসেন। বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে এক সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে নানা বিষয়। জাপানি ভাষা থেকে অনুবাদে সহযোগিতা করেছেন শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল। সেই সাক্ষাৎকারের কিছু চৌম্বক অংশ।

শুভ : আপনি তো একজন স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পী, কীভাবে এ-জগতে প্রবেশ করলেন?

সাকামোতো : হ্যাঁ, আমি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করিনি। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় ছবি আঁকা শিখেছি। খুব ছোটবেলা থেকেই অর্থাৎ, প্রাইমারি স্কুল থেকে ছবি আঁকা খুব পছন্দ ছিল। নিজে নিজে ছবি আঁকতে ভালোবাসতাম। মাত্র বিশ বছর বয়স থেকে পেশাগতভাবে একজন স্বনির্ভর শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি। কখনো কোনো চাকরি বা ব্যবসা করিনি। ছবি আঁকা ও বিক্রিই আমার একমাত্র জীবিকা।

শুভ : বিষয়টা নিশ্চয়ই খুব সহজ ছিল না। শুরুর দিকের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কি মনে আছে, যা আপনার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়?

সাকামোতো : আমার জন্ম ১৯৪৭ সালে জাপানের ইবারাকিকেন জোশোশি শহরে। সাধারণ পরিবারে অনেক ভাইবোনের সঙ্গে বড় হয়েছি। মাত্র ২০ বছর বয়সে যখন ছবি নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করতে চাচ্ছিলাম, তখন ভাবছিলাম কীভাবে শুরু করব? নিজেই বুদ্ধি বের করি। গাড়ি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছবি বিক্রি করতে শুরু করি। খুব সস্তায় ছবি বিক্রি করতে থাকি। গ্রামের সাধারণ মানুষই আমার ক্রেতা ছিলেন। দশ বছর এভাবে কাজ করেছি। একদিন এক শীতে গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের ঢালে বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকছিলাম। তখন আমার বয়স ৩২। আমার পাশ দিয়ে তরুণ এক যুগলের গাড়ি যাচ্ছিল। তারা আমার ছবি আঁকা দেখে দাঁড়ালেন। তারা আমার ছবি কিনতে আগ্রহী হলেন। আমি বললাম, ছবিটা শেষ করতে এক মাস সময় লাগবে। তারা আমার ঠিকানা নিয়ে গেলেন এবং তাদের ঠিকানাও রেখে গেলেন। এক মাস পর আমার বাসার ঠিকানায় দশ হাজার ইয়েন পাঠালেন। আমিও তাদের ঠিকানায় আমার ছবিটা পাঠিয়ে দিলাম। আবারো কয়েক মাস পর তারা আমার নতুন ছবি কিনতে আসেন পঞ্চাশ হাজার ইয়েন দিয়ে। আমিও তাদের কাছে ছবি বিক্রি করতে শুরু করি। এভাবে শুরু হয় ছবি বিক্রি করা। পরে তারা আমার স্টুডিওতে এসে পঞ্চাশ লাখ ইয়েনের ছবি কিনলেন। এ ঘটনা আমাকে খুব উৎসাহিত করল। পরে আমি বড় বড় শহরের বিভিন্ন গ্যালারিতে একক প্রদর্শনী করতে শুরু করি। এখন আমার বয়স ৬৭। এই ছোট্ট ঘটনা এখনো আমাকে উৎসাহিত করে। ছবি এঁকে গেলে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকার একটা উপায় হয়েই যায়।

শুভ : কী বিষয় ও কী ধরনের মাধ্যমে কাজ করেন?

সাকামোতো : আমি মূলত ল্যান্ডস্কেপের ছবি আঁকি। প্রকৃতিই আমার প্রধানতম বিষয়। প্রকৃতির অফুরান ভান্ডার। বৈচিত্র্যের কোনো শেষ নেই। মাধ্যম হিসেবে তেলরঙে সবসময় ছবি আঁকি। অন্য কোনো মাধ্যম আমার ভালো লাগে না।  যেহেতু আমি শিক্ষিত এবং ল্যান্ডস্কেপ চর্চা করেই ছবি আঁকা শিখেছি, তাই এটাও একটি কারণ। তবে যখন কোনো গ্যালারির জন্য কাজ করি, তখন অনেক সময়ই বিক্রির ব্যাপারটা মাথায় রেখে – যে-ধরনের ছবি বেশি বিক্রি হয় – সে-ধরনের কাজ করি। আরেকটা বিষয় হলো, বেশিরভাগ সময়ই ছোট সাইজের ক্যানভাসে ছবি আঁকি। কারণ জাপানের ঘরগুলো ছোট ছোট। বড় বড় কোম্পানি ছবি কিনলে বড় ছবি আঁকি। বাংলাদেশের শিল্পীরা দেখলাম বড় ছবি আঁকেন। এটা বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের শিল্পীদের ছবির আকারে পার্থক্য বলে মনে করি। আমি জটিল ছবি আঁকি না। দর্শক ও ক্রেতারা সহজেই আমার ছবি বুঝুক ও কিনুক, সেটাই চাই। এ পর্যন্ত মনে হয় সাতাশ হাজার ছবি বিক্রি করেছি।

শুভ : আপনার একটা আর্টিস্ট গ্রুপ আছে জেনেছি। সেটা সম্পর্কে কিছু বলুন।

সাকামোতো : আমার তিনটা স্টুডিও আছে। সেগুলো নিজ বাড়ি, পাহাড় এবং শহরে অবস্থিত। তরুণ শিল্পীদের ছবি আঁকা শেখানো শুরু করি নিজ স্টুডিওতে। যেসব শিল্পী প্রতিষ্ঠানে         শিল্প-শিক্ষা নেননি, তাঁরাই আসেন আমার স্টুডিওতে। তাঁদের নিয়েই আমি একটা গ্রুপ বানাই, যেটার নাম ‘সাদানকোওজি’। তরুণদের অনুপ্রেরণা দেওয়াই এই গ্রুপের মূল উদ্দেশ্য। প্রতিবছর টোকিও আর্ট মিউজিয়ামে এই গ্রুপের প্রদর্শনী হয়। সেখান থেকে শিল্পীদের ছবি বিক্রি হয়। এভাবে তাঁরাও পেশাগতভাবে ছবি এঁকে দাঁড়ানোর পথে এগিয়ে যান। আমরা নতুন একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। বিখ্যাত জাপানি শিল্পী ওকাকুরা তেনজিনের সঙ্গে এশিয়ার বিখ্যাত সাহিত্যিক, প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্কের একশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এশিয়ার ৪৮টি দেশের বাচ্চাদের ছবি সংগ্রহ করে সামনের টোকিও অলিম্পিকে অত্যন্ত বড় আকারের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে, যেটি অলিম্পিকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে থাকছে। বাংলাদেশের শিশুদের ছবিও থাকছে।

শুভ : বাংলাদেশে এসেছেন কতবার? কী ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে?

সাকামোতো : এ পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনবার এসেছি। গত বছর এসেছিলাম প্রথম। দ্বিতীয়বার এ-বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এখন আবারো। গ্লোরিয়া ফাউন্ডেশন ও রিন্নি কোম্পানির যৌথ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে এসেছি। রিন্নি জাপানের অনেক বড় কোম্পানি। ওদের এডুকেশন শাখার সঙ্গে কাজ করছি। মুন্সীগঞ্জে ওয়ার্কশপ করিয়েছি বাচ্চাদের। দুশো বাচ্চার দুই হাজার ছবি নিয়ে প্রদর্শনীও হয়েছে। এগুলো এখানকার পৌরসভার দায়িত্বে বিভিন্ন স্কুলে হচ্ছে। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইবারাকির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতি বিনিময় প্রোগ্রাম হবে। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়কেও যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ-জাপানের মৈত্রীবন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্লোরিয়া ফাউন্ডেশন আছে। আবদুস শাকুরসহ অনেক শিল্পীও আছেন।

শুভ : আপনাদের সঙ্গে এবার কতজন শিল্পী এসেছেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গালারিতে একটি প্রদর্শনীও তো হচ্ছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন?

সাকামোতো : এবার আমাদের বিশজনের একটি দল এসেছে। দুজন চারুশিল্পীসহ অন্যান্য মাধ্যমের শিল্পীরাও এসেছেন। জয়নুল গ্যালারির প্রদর্শনীটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এদেশের সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের কাজ দেখা ও তাঁদের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হলো।

শুভ : বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজ কেমন লাগল?

সাকামোতো : বাংলাদেশের শিল্পীরা অনেক ভালো কাজ করেন। আমার ভালো লেগেছে। এখানে অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে বেশি কাজ হয় বলে মনে হলো। ব্যাপারটা খারাপ নয়। শিল্পীদের নিজস্বতাই জরুরি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি খুব উন্নত। অর্থনীতি হয়তো ততটা নয়। শিল্পীদের কাজের ভেতরে সংস্কৃতিকে পাওয়া যায়। জাপানের অর্থনীতি উন্নত; কিন্তু শিল্পীদের কাজে ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক দিন দিন কমে আসছে। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে মিশে খুব ভালো লেগেছে। বাংলাদেশ ও জাপানের মানুষের মধ্যে বেশ মিলও রয়েছে।

শুভ : আপনাকে ধন্যবাদ। আশা করি, আপনাদের এই সংস্কৃতি-বিনিময় প্রোগ্রাম জাপান-বাংলাদেশের মৈত্রী আরো দৃঢ় করবে।

সাকামোতো : আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। আপনাকেও ধন্যবাদ। আমিও সেরকম আশা করি।