শিল্পের আলোয় ভঙ্গুরতায় পথচলা

জাহিদ মুস্তাফা

সমাজবদ্ধ মানুষ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ঘর গড়ে, ঘর সাজায়। এভাবেই একটু-একটু করে গড়ে উঠেছিল সভ্যতা। তারপর কত ঘটনা, কত পালাবদল! সভ্যতার আলোয় যেমন আলোকিত হয়েছে মানুষ, তার রুচি ও শৌর্য প্রকাশের স্মারক স্থাপনাও হয়েছে দেশে-দেশে। পাশাপাশি জঞ্জালও জন্মেছে, সময়ের করালগ্রাসে পরিত্যক্ত হয়েছে পুরনো বসত। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর চাহিদার চাপে ক্রমাগত কমে আসছে বসতের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ। ভেঙে গেছে, ভেঙে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি-মানবিক সম্পর্কসমূহ। এ নিয়ে সৃজনশীল মানুষের অনুভূতির

বাঙ্ময় প্রকাশ ঘটেছে শিল্প ও সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখায়। শিল্পের অবয়বে এরূপ ভঙ্গুরতার বিষয়-আশয় তুলে ধরেন শিল্পী বিপুল শাহ তাঁর চিত্রকর্মে।

সম্প্রতি ঢাকার ধানম–তে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হলো নববইয়ের দশকের চিত্রশিল্পী বিপুল শাহের অষ্টম একক চিত্রপ্রদর্শনী। ‘ভঙ্গুরতায়

পথচলা’ শিরোনামের এ-প্রদর্শনীতে শিল্পীর  কয়েক বছর ধরে আঁকা চিত্রকর্ম থেকে বাছাই করা ৩০টি ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। কাগজে ও ক্যানভাসে শিল্পী কাজ করেছেন জলরং, নরম প্যাস্টেল আর অ্যাক্রিলিক রঙে।

বিপুল শাহ তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে প্রথম পাঁচটি একক প্রদর্শনী করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে। ‘নিসর্গের সংগীত’ শিরোনামে প্রথম একক প্রদর্শনী করেন ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৭ সালে ‘সাদাকালো’ শিরোনামে নিজের অঙ্কন নিয়ে করেন দ্বিতীয় একক, ১৯৯৯ সালে পেইন্টিং ও অঙ্কন নিয়ে তৃতীয় এককের শিরোনাম ছিল – ‘জীবন, প্রকৃতি, বাসত্মবতা’। ২০০০ সাল এবং ২০০২ সালে ‘ভঙ্গুরতার ইমেজ’ শিরোনামে চতুর্থ ও পঞ্চম একক প্রদর্শনী করেন শিল্পী। এখান থেকেই তাঁর চিত্রকর্মে স্বকীয়তার একটা মাত্রা যুক্ত হতে শুরু করে।

২০০৩ সালে বিপুলের ষষ্ঠ একক চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজিত হয় জাপানের টোকিওতে চুওয়া গ্যালারিতে। ‘ভঙ্গুরতার ইমেজ’ শীর্ষক ওই প্রদর্শনীতে তাঁর কাজ প্রশংসিত হয়েছে সেদেশের শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধা মহলে। ২০০৭ সালে ঢাকার উত্তরায় গ্যালারি কায়ায় ‘ভঙ্গুরতায় পথচলা’ শিরোনামে শিল্পীর সপ্তম একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দীর্ঘ একটা বিরতি নিয়েছেন শিল্পী নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যসত্মতার জন্য। তবে অব্যাহত রেখেছেন নিজের সৃজন-চর্চা।

বিপুলের জন্ম ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন ১৯৯২ সালে। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল নানা কর্মকা– নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। যেমন – চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনালগ্নের অন্যতম কর্মী তিনি। শিল্পের সঙ্গে রুচিশীল সাধারণ মানুষের সম্পর্ক তৈরির মানসে চারুকলা অনুষদের বিপরীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশমুখে সমসাময়িক একদল উদ্যোগী শিল্পীর সঙ্গে মিলে ছবির হাট গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর শিল্পী বিপুল শাহ। তিনি একজন কার্টুনিস্ট। সেই নববইয়ের দশকের গোড়া থেকে তখনকার ভোরের কাগজ হয়ে এখনো প্রায় প্রতিনিয়ত সামাজিক নানা অসংগতি নিয়ে তাঁর আঁকা কার্টুন ছাপা হচ্ছে দৈনিক প্রথম আলোয়।

আঁকায়, রেখায়, বর্ণ-প্রয়োগে বিপুলের দক্ষতা ও মাত্রাজ্ঞান শিল্পীমহলে সুবিদিত। বেশ কয়েকবার পুরস্কৃত হয়েছেন তাঁর নন্দিত কাজের জন্য। এর মধ্যে সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য অর্জন তাঁর ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে সম্মান পুরস্কার লাভ। তবে প্রচারবিমুখ হওয়ায় শিল্পের পাদপ্রদীপের আলোয় দেখা যায় না তাঁকে।

এ-প্রদর্শনীর ত্রিশটি চিত্রকর্মের মধ্যে বেশিরভাগ কাজ ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা, শিল্পী কয়েকটি ছোট পটে এঁকেছেন নরম প্যাস্টেল এবং জলরঙে। একবারে সহায়-সম্বলহীন অতিসাধারণ মানুষ ও তার বসবাসের স্থান এবং কর্মপরিবেশ বিধৃত হয় এই শিল্পীর একেকটি চিত্রকর্মে। যেমন তাঁর জলরঙে আঁকা ‘ভঙ্গুরতায় পথচলা’ শীর্ষক ২০-সংখ্যক ছবিতে আমরা দেখতে পেলাম সিংহদরজার মতো একটি আবছায়া স্থান থেকে বেরিয়ে আসছেন কয়েকটি মানব

আকৃতি সদৃশ শরীর। এখানে শিল্পীর কাজের ধরন বাসত্মবানুগ যা আমাদের দেখার সঙ্গে মিলে যায়।

শিল্পী বিপুল শাহ গ্রাম-নগরের চারপাশের অস্থায়ী স্থাপনা, অতিসাধারণ ভঙ্গুর বাড়িঘর ও এর এলোমেলো পরিবেশকে চিত্রপটে বাঙ্ময় করে প্রকাশ করেন। সাধারণ মানুষ ও তার বসবাসের জায়গার ভঙ্গুরতার চিত্র তুলে ধরে শিল্পী যেন প্রকারান্তরে আমাদের দেশ ও সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের দুঃখ-দারিদ্র্যকে শিল্পীসুলভ মমতায় স্পর্শ করতে চেয়েছেন। আবার এও তো দেখি, জনমানবহীন গোডাউন বা বড় হলরুমের মতো পরিত্যক্ত স্থাপনায় ফেলে যাওয়া, ফেলে রাখা নানা দ্রব্য। ‘ভঙ্গুরতায় পথচলা’ শীর্ষক ১-সংখ্যক ছবিতে এমন অবস্থা তুলে ধরেছেন শিল্পী। কোনো প্রাণীর উপস্থিতি নেই, অথচ মনে হয় একটু আগেও এখানে প্রাণের অসিত্মত্ব ছিল। শিল্পে এ একধরনের পরাবাসত্মবতার প্রকাশ। আবার একই শিরোনামের ২-সংখ্যক চিত্রে দরজাসদৃশ এক আলো-আঁধারিতে সুতোয় ঝুলন্ত চারটি জীবন যেন জানান দিচ্ছে মানুষ ও তার তৈরি সভ্যতা এমন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ঝুলে আছে।  ‘ভঙ্গুরতায় পথচলা’ শীর্ষক ১৫-সংখ্যক চিত্রে দুর্ঘটনায় পতিত ভাঙা, দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া এক যানবাহন ও ব্যান্ডেজবাঁধা মৃত বা আহত

দুটি শায়িত দেহ উপস্থাপন করেছেন শিল্পী। মানিকগঞ্জের জোবরা গ্রামে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মর্মামিত্মক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ নিহত ও আহতদের শোকাবহ স্মৃতি তুলে ধরেছেন।

তাঁর কতক কাজে আমরা অবলোকন করি ভাঙা ও পরিত্যক্ত দ্রব্যের মধ্যে চোখের অঙ্কন, যেন ভঙ্গুরতা এখানে জীবন পেয়েছে। আরেকটি ছবিতে শিল্পী যেন আকাশকেই ভঙ্গুর করে তুলে ধরেছেন, আর নিচে আলোর উদ্ভাসনে স্থাপন করেছেন একটি অযান্ত্রিক রিকশা। বাসত্মবতার পরাবাসত্মব পরিবেশনা দেখতে মন্দ লাগে না। ভঙ্গুরতাকে ঠেলে ফেলে না দিয়ে তাকে সযত্নে শিল্পিত মায়ায় তুলে ধরেছেন বিপুল শাহ। এখানেই শিল্পী অন্যের চেয়ে আলাদা উচ্চতায় আসীন হন স্বকীয় অর্জনের কৃতিত্বে।

ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে এ-প্রদর্শনী চলে ১১ থেকে ২৫ মার্চ, ২০১৬ তারিখ পর্যন্ত।