শিল্পের দর্শন অথবা একটি মতাদর্শিক বিতর্ক

আহমদ জসিম

 

কথাশিল্পের জল-হাওয়া

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

শুদ্ধস্বর

ঢাকা, ২০১৩

১৭০ টাকা

আমরা কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের আরেকটি প্রবন্ধগ্রন্থ হাতে পেলাম, যে-গ্রন্থের ভেতর দিয়ে লেখক তাঁর সাহিত্য ও সমাজবিষয়ক দার্শনিক অবস্থান আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন, তুলে ধরেছেন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কিংবা সাহিত্যের মুক্তির প্রশ্নে নিজসচিন্তা। গ্রন্থের শুরুতেই, ‘কথার শিল্প, কথার স্বাধীনতা’ শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি শিল্পের প্রারম্ভিক ইতিহাস থেকে সূচনা করে বর্তমান নানা মতাদর্শিক অবস্থান ও তার বৈপরীত্য পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। তবে প্রবন্ধটি পাঠশেষে আমাদের চিন্তাজগৎকে একধরনের ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়। লেখক একটি মতাদর্শিক বিতর্কে মতান্তরে বিরোধে গিয়ে যেন নিজেই স্ববিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন। একদিকে তিনি মানুষের ক্ষমার ওপর আস্থাশীল হয়ে বলছেন – ‘একজন মানুষের বড়ো কৃতিত্ব হচ্ছে, সে তার ঈশ্বরত্ব নাজেল করতে জানে।’ আবার ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ভয়ানক সন্দিহান। প্রশ্ন তুলছেন – ‘স্বাধীনতা মানে তো নিজের অধীনে থাকা, তাই তো? এর মানে এখানে একটা অধীনতা রচিত হয়েই আছে।’ লেখকের কথামতে স্বাধীনতা কথাটা নতুনভাবে বিচারের দাবি রাখে; কিন্তু লেখকের এ ‘অধীনতা’ আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। এভাবে তিনি যখন ইতিহাস প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইতিহাসেরও ইতিহাস থাকে’, তখন লেখকেরই কথার মধ্যে দিয়ে আমরা যেমন ইতিহাসকে নানা চিন্তার ভেতর দিয়ে বিচার করার কথা বুঝে নিই। আবার বিচার করার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিটা আমাদের কাছে থেকে যায় অজ্ঞাত। লেখক প্রচলিত শিল্পের নানাবিষয়ক মতাদর্শিক অবস্থান, যথা নৈরাজ্যবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ ও অস্তিত্ববাদের মতো চিন্তাকে শিল্পীর নিজস্ব মনোজগতের বিষয় হিসেবে বর্ণনা দিয়ে বলছেন, ‘একসময় সাম্যবাদকেই প্রগতিশীলতার চূড়ান্ত রূপ বলে অনেকেই বিশ্বাস করতেন।’ কিন্তু এই মতে তাঁর আস্থা-সংকটের কারণ সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্রের প্রশ্নে। এখন কথা হচ্ছে, সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্র তো কোনো ব্যক্তির শাসন নয়, এটা বরং শ্রেণির ওপর শ্রেণির আধিপত্য বিস্তার। তাই ঢালাওভাবে এ-ধরনের সমালোচনা লেখকের চিন্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একইভাবে নানা চিন্তার বৈপরীত্যের ভেতর দিয়ে আমাদের পাঠ এগিয়ে যায়, কোথাও সমমতের উচ্ছ্বাসে আমরা উচ্ছ্বসিত হই, কোথাওবা নতুনভাবে ভাবনার অবতারণা ঘটে, যেভাবে লেখক সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন – ‘শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ শুধু অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির ভেতর দিয়ে ঘটবে কি-না, এ প্রশ্ন থেকেই যায়।’ অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নটা যদি সামগ্রিক মানবমুক্তির প্রশ্ন হয়ে থাকে, তবে মানবমুক্তির প্রশ্ন থেকে শিল্প-সংস্কৃতির মুক্তির প্রশ্নটা বিচ্ছিন্নভাবে ভাবার অবকাশ কোথায়? এক্ষেত্রে লেখকের সংশয় নিশ্চিতভাবে বলা যায় পরাজিত চিন্তা ও বিজিত চিন্তা দ্বারা দমিত হওয়া নিয়ে। যেখানে সমগ্র মানবমুক্তির প্রশ্নটা জড়িত, সেখানে শিল্প-সংস্কৃতির মুক্তির প্রশ্নটা যে অবশ্যম্ভাবী সে-কথা লেখক বেমালুম এড়িয়ে গেলেন। মানবমুক্তির প্রশ্ন থেকে যে শিল্প-সংস্কৃতির মুক্তির প্রশ্নটা আলাদা নয়, এ-কথা লেখক আবার নিজেই প্রমাণ করেন প্রাগুক্ত প্রবন্ধেই – ‘জন্মের পর অত দীর্ঘসময় পরাধীন আর কোনো প্রাণীই থাকে না। অথচ সাপের জীবন খেয়াল করুন, জন্মের পরপর এরা মুক্ত স্বাধীন!’ লেখক বোধকরি পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে গড়ে-ওঠা মানব সমাজকে আমাদের সামনে পরাধীনতা হিসেবে হাজির করতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র লেখককে বলা যায় – সাপেরও কিন্তু রোগ হয়, সে-রোগের চিকিৎসা করানোর জন্য কোনো সাপ ডাক্তারিবিদ্যা শেখে না। মানুষের বিকাশজনিত ইতিহাসের নিবিড় পর্যবেক্ষক হিসেবে যিশুকে অবহিত করে লেখক দাবি করছেন, ‘শোনা যায় মার্কস তার (যিশু) দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।’ এই শোনা কথার বস্ত্তনিষ্ঠতা নিয়ে আমাদের কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত দিলে পাঠককুল নিঃসন্দেহে উপকৃত হতেন। শ্রেণি-বিলোপের ভেতর দিয়ে মানবজাতির সামগ্রিক অর্জনের কথা স্বীকার করে লেখক শেষে লিখছেন, ‘রাষ্ট্রপালিত দলীয় ক্যাডাররা তখন সবজান্তা ওস্তাদ হয়ে ওঠেন।’ অথচ সত্য হচ্ছে, শ্রেণির সপক্ষে বল প্রয়োগের সবচেয়ে বড় অস্ত্রটা হচ্ছে স্বয়ং রাষ্ট্র। আর শ্রেণি-বিলোপ মানেই তো রাষ্ট্র-বিলোপ, যেখানে রাষ্ট্র নেই, সেখানে রাষ্ট্রপালিত ক্যাডারের প্রশ্ন আসে কোথা থেকে। ‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’ শিরোনামে আমরা দেখছি মরমি সাধক লালন সাঁইজিকে নিয়ে লেখকের ব্যতিক্রমধর্মী মূল্যায়ন। সাম্প্রতিক সময়ে করপোরেট মিডিয়াসহ নানাভাবে উপাদেয় হয়ে-ওঠা লালন আমাদের কাছে যেভাবে পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন ছিল ঠিক সেভাবে লেখক লালনকে উপস্থাপন করলেন আমাদের কাছে। ইতিহাসের বিচারে লালন দূর-অতীতের কোনো বিষয় নয়, তবু লালনের জন্ম-মৃত্যু কিংবা ধর্মপরিচয় নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কেন এ-বিতর্ক? প্রশ্নটা আমাদের সামনে লেখকও তুলেছেন। তবে লেখক নিজে আমাদের সামনে এই বিতর্কের কোনো সমাধান হাজির করতে পারলেন না; পারলেন না কথাটা এ-কারণেই বলছি, তিনি জাতপাত থোড়াই কেয়ার না-করা এই লালনকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন মুসলমান পরিবারের একজন হিসেবে। কতিপয় ভক্ত কর্তৃক ভারতীয় জাতপাতনির্ভর সমাজের বিরুদ্ধে আমৃত্যু বিদ্রোহের মহানায়ক লালনকে রবিঠাকুরের গুরু বানানোর হীন প্রয়াসকে লেখক নস্যাৎ করে দেন তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে। আর মধ্যবিত্তের লালনপ্রীতিকে খারিজ করেন স্বপ্ন-বিলাসিতার প্রবণতাকে চিহ্নিত করে। ‘লিটলম্যাগচর্চা ও সময়ের কথাশিল্প’ প্রবন্ধে আমরা দেখছি, লিটলম্যাগ সম্পাদক ও লেখক হিসেবে তাঁর সামগ্রিক দার্শনিক অবস্থাটা আমাদের কাছে তুলে ধরছেন, লেখক আমাদের লিটলম্যাগ সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন, ‘সমাজ-রাষ্ট্র পরিবারকে দমিয়ে রাখার যে-টেন্ডেন্সি চালু থাকে তার বিরুদ্ধে দ্রোহ বা সংগ্রাম বজায় রাখা।’ লেখকের তথ্যমতে, আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলে পরিচিত গোষ্ঠীবদ্ধ লিটলম্যাগ চর্চা চালু হয়েছে গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে। স্বাভাবিক নিয়মেই জিজ্ঞাসা আসে – তবে কি আমাদের দেশে আশির দশকের আগে প্রতিষ্ঠানের কোনো আধিপত্য ছিল না? তো, লেখক নিজেই একটা লিটলম্যাগের সম্পাদক। তাই লিটলম্যাগ বিষয়ে তাঁর অবস্থানটা আমাদের কাছে পরিষ্কার করে বলেন, ‘পণ্যবহুল চলিত সাহিত্যভুবনের বাইরে একটা নির্মোহ কিন্তু পাল্টা বিকল্প সাহিত্যধারা চালু রাখার মানস থেকেই।’ লেখকের এ-উক্তির ভেতর লিটলম্যাগবিষয়ক অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মেলে। তবু থেকে যায় একটা প্রশ্ন, এই পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদিত ও অর্থবিনিময়যোগ্য সবকিছুই তো আদপে পণ্য। তবে সেই সর্বগ্রাসী পণ্যতত্ত্ব থেকে একটা লিটলম্যাগ কী করে মুক্ত হতে পারে – লেখক এ-বিষয়ে আমাদের সরাসরি অবহিত না করলেও পুরো প্রবন্ধ পাঠ করে একটা ধারণায় পৌঁছাতে পারি, তা হলো, লিটলম্যাগ আকৃতির বিষয় নয়, এটা নির্ভর করে তার প্রকৃতির ওপর। অর্থাৎ চেতনায় লেখক এবং একটা ছোট কাগজকে চলিত সাহিত্য ভুবনের বাইরে বিকল্প সাহিত্য হিসেবে জিইয়ে রাখবে। ‘একজন চলমান ঈশ্বরের গল্প’ শিরোনামের প্রবন্ধে আমরা দেখছি রায়হান রাইনের অনুবাদ করা ‘কিতাব আল তাওয়াসিনে’র নাতিদীর্ঘ আলোচনা। লেখকের ক্ষুরধার আলোচনায় গ্রন্থটির আদ্যোপান্ত যেমন আমরা জেনে যাচ্ছি, একইভাবে আনাল হক নামক সুফি সাধক সম্পর্কে লেখকের বাড়তি তথ্যগ্রন্থটা পাঠ করতে আমাদের উৎসাহ তৈরি করছে। একইভাবে ‘নিশিতে জাগরণে শাহেরজাদে’ আমরা দেখছি ঐতিহাসিক আরবি সাহিত্য আলিফ লায়লা নিয়ে লেখকের দীর্ঘ আলোচনা ও চুলচেড়া বিশে�­ষণ। লেখকের মতে, ‘সেমেটিক ধর্মের মিথে ঠাসা হলেও এ-জনপদের গল্পকে নিজেদের বলে রায় দেওয়ার কিঞ্চিৎ বাসনাও তাদের নেই।’ তবে এই তারা কারা? আমাদের সমাজেও পুঁথিসাহিত্যকে অন্ত্যজশ্রেণি যেভাবে আপন করে গ্রহণ করে, সেভাবে তো মধ্যবিত্ত করে না। লেখক কি তবে আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বীকৃতির কথা বলছেন? এ-প্রবন্ধের ভেতর দিয়ে লেখক আমাদের কাছে নতুন এক তথ্যের সন্ধান দেন, সেটা হলো – দুই সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা রামায়ণ আর আলিফ লায়লার কিছু মিল ও অভিন্নতা। এই অভিন্নতাকে আমরা বলতে পারি বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর চিন্তাগত ঐক্য হিসেবে। ‘জাতীয় কবি ও তাঁর কথাশিল্প’ প্রবন্ধে আমরা  দেখছি নজরুলের উপন্যাসসত্তার নানা দিক নিয়ে আলোচনা, যে-আলোচনায় উন্মোচিত হচ্ছে বাংলাসাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস বাঁধন হারা, তাঁর লেখার সময়, সমাজসহ নানা প্রসঙ্গ। একইভাবে ‘মানুষ আহমদ ছফা’ প্রবন্ধে লেখক ছফার কিছু প্রসিদ্ধ গ্রন্থের সূত্র ধরে আমাদের সামনে নতুনভাবে হাজির করছেন আহমদ ছফার সাহিত্য ও সমাজচিন্তাকে। আমরা পাঠ করে জানতে পারছি লেখকের আহমদ ছফা নিয়ে মুগ্ধতার শুরু ১৯৯৮ সালে বঙ্কিমচন্দ্র : শতবর্ষের ফেরারি পাঠের মধ্যে দিয়ে। লেখকের দাবিমতে, এ-মুগ্ধতা ক্রমশ যৌক্তিকতার দিকে পৌঁছায় একে একে জাগ্রত বাংলা, ওঙ্কার, অলাতচক্রসহ নানা গ্রন্থপাঠের ভেতর দিয়ে। আমরা এ-প্রবন্ধ পাঠের ভেতর দিয়ে লেখকের এক ধরনের অভিমান লক্ষ করি, ছফার সেসব সাগরেদের ওপর, যারা তাকে জোর করে মুসলমান বানাতে চায়। তবে আমরা সমগ্র প্রবন্ধটা পাঠ করে ছফা সম্পর্কে লেখকের মূল্যায়ন দেখে বিস্মিত হই। লেখক যেভাবে বলেন, ‘ধর্মীয় বিহবলতা থেকে তিনি কখনও মুক্ত হতে পেরেছেন বলে মনে করা মুশকিল। তিনি এক সময় ধর্মসখা হুজুরদের সাথেও সখ্যতা শুরু করেন…।’ ‘তার দ্রোহে কোন ফিলসফি আছে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।’ একজন লেখকের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের জন্য তাঁর সামগ্রিক জীবনটাকেও বিচারের দাবি রাখে, যেভাবে আহমদ ছফাকে মূল্যায়ন করতে গেলে তাঁর জাসদ রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক আর লেখক-শিবিরের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেওয়ার ইতিহাসটাও স্মরণ রাখা চাই। ছফার ধর্মঘেঁষা হুজুরদের সঙ্গে সখ্য করার ব্যাখ্যা আমরা তাঁর নানা সাক্ষাৎকারে পাই। এক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে নিকারাগুয়ার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খ্রিষ্টান যাজকরা। আর ফিলসফি প্রসঙ্গে বলা যায়, লেখকের ফিলসফি তাঁর লেখার ভেতরেই থাকে, এটা যদি কোনো পাঠক খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হন, এটা সে-পাঠকের সমস্যা, লেখকের নয়। ‘যে মৃত্যু নিজের মৃত্যুর ছোঁয়া’ – সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের জন্য এক চিলতে শোকগাঁথা, তারেক মাসুদ নিয়ে লেখকের ব্যক্তি-অনুভূতির প্রকাশ। ‘হুমায়ূনকথা’তে আমরা দেখছি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য ও সাহিত্য-দর্শন নিয়ে সবিস্তার আলোচনা। লেখক তাঁর আলোচনায় হুমায়ূন আহমেদের পাঠককে মুগ্ধ করার ক্ষমতার যেমন প্রশংসা করছেন, একইভাবে সর্বদা পাঠককে খুশি করার প্রবণতারও সমালোচনা করছেন – এই দুই প্রবণতা উদ্ঘাটনের ভেতর দিয়ে লেখক আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির অসাধারণ প্রতিভা এবং সে-প্রতিভাকে বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা। ‘কখনও কাব্যকথন, কখনও-বা কথাকাব্যে আমরা দেখছি একজন কথাসাহিত্যিকের কবিতাবিষয়ক অভিব্যক্তির প্রকাশ। লেখক প্রবন্ধে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, তিনি কখনো কবিতা লেখেননি, তবু কবিতা নিয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত নেই। সেই ভাবনার জায়গা থেকে তিনি কবিতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন এভাবে – ‘যথাযথ শব্দ যথাস্থানে বসাতে জানলেই কবিতা হয়।’ লেখকের কবিতা নিয়ে এমন সংজ্ঞা দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে – তবে কী শব্দজ্ঞানই কবিতা। কবিতায় কি ভাবের কোনো মূল্য নেই? এ-প্রশ্ন দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে, যা আমাদের এ-আলোচনায় অসম্ভব। সম্প্রতি আমাদের সাহিত্য কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভাষা-ব্যবহার নিয়ে এক ধরনের বিতর্কের সূচনা হয়েছে। এ-বিতর্কই বোধকরি লেখককে ‘মনের ভাষা, জানের ভাষা’ শিরোনামের ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তবে লেখক আলোচনাটা শুধু চলমান বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি তুলে এনেছেন ভাষার ইতিহাস, বিকাশ, রাষ্ট্র দ্বারা ভাষা অবরুদ্ধ হওয়ার যাতনা এবং সর্বোপরি সামনে এনেছেন রাষ্ট্র দ্ধারা নানা জাতিসত্তার ভাষা অবরুদ্ধ হওয়ার বিষয়টি। এক্ষেত্রে লেখক আলোচনায় যে-বিষয় এড়িয়ে গেছেন বলে আমাদের মনে হয় তা হলো, ভাষার মুক্তির সঙ্গে মানবমুক্তির প্রশ্নটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেখানে মানুষই অবরুদ্ধ, সেখানে ভাষা মুক্ত হয় কীভাবে? ‘বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক কিন্তু অসাম্প্রদায়িক’ – এই চিরায়ত ভাবনাকে খন্ডন করার জন্যই লেখক বোধকরি লিখলেন ‘মধ্যবিত্তকথা ও সাম্প্রদায়িকতা’ শিরোনামীয় প্রবন্ধ। লেখকের দাবিমতে, ওপরে আলোচিত বিষয়টি স্রেফ মধ্যবিত্তের মুখরোচক কথা। ধর্মের ভেতর যেখানেই নিজের মতের আধিপত্যের ব্যাপার আছে, সেখানে একই সঙ্গে ধর্ম এবং অসাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি থাকতে পারে না! লেখক একটি মৌলিক প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন বটে, তবে ধর্মের বিচার শুধু ধর্মের ভেতরকার বিধান দিয়ে নয়, বরং ধর্মের সঙ্গে সমাজের সম্পর্কের বিষয়গুলোও বিচারের দাবি রাখে। যে-কারণে আরবের মোহাম্মদি ধর্মের ইউরোপে আমরা এক ধরনের রূপ দেখি আবার একই ধর্ম যখন দক্ষিণ এশিয়ায় আসে, তখন তার রূপ হয় ভিন্ন। লেখকের ভাষ্যমতে, মধ্যবিত্তের এই অসাম্প্রদায়িক ধারণা সমগ্র বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা সামগ্রিকতার প্রশ্নে যদি অন্ত্যজ শ্রেণিকে হিসাব করি, তবে এই অসাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটা বরং তাদের নিজস্ব দর্শন বলেই মনে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের এখানে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার হয়েছে ঠিকই, তবে স্রেফ ধর্ম দিয়ে কোনো রাজনৈতিক শক্তি দাঁড়াতে পারেনি কখনো। আর ধর্মান্তরের কথা বলে লেখক যখন অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটা সামনে আনেন তখন বলতে হয়, বিশ্বাসের কারণে নয় বরং সমাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনে ধর্মান্তর হয়েছে মানুষ। ‘একটি সভা, একটি ছোটকাগজ, তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি আমাদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে ছোটকাগজের নানা আয়োজন সংবাদ, একই সঙ্গে তার মানিক পাঠ ও মানিক বিষয়ে লেখকের নিজস্ব ভাবনা পাঠকে জানাচ্ছেন। তবে গ্রন্থের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্য ও তত্ত্ববহুল এক প্রবন্ধের নাম ‘নোবেল রাজনীতি ও একজন মারিয়ো ভার্গাস ইয়োসা’ এই প্রবন্ধ পাঠের ভেতর দিয়ে আমরা নোবেল পুরস্কার ও তাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সমীকরণ যেমন জানতে পারছি, তেমনি নোবেলপ্রাপ্তির শর্ত হিসেবে একজন লেখকের রাজনৈতিক চৈতন্যের নানা পরিবর্তনের বিষয়ও তিনি তুলে এনেছেন। গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধের নাম ‘অনলাইন সাহিত্য’, যার মধ্য দিয়ে লেখক আমাদের অনলাইন সাহিত্যমাধ্যমগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এবং সে-মাধ্যমগুলোর চর্চিত সাহিত্যসমূহ সম্পর্কেও দিচ্ছেন নানা ধারণা। এতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিল্প-সমাজ-সাহিত্য বিষয়ে লেখকের তীক্ষ্ণ বীক্ষণ। লেখকের এই বীক্ষণে একজন পাঠক হিসেবে সমস্ত বিষয়ে সমমত পোষণ করতে না পারলেও অসংখ্য বিষয়ে নতুন করে ভাবনা-খোরাকের জোগান পাই।