শুঁড়

রশীদ হায়দার

গল্পটি বলার চেষ্টা করছি ১৯৫৩ সালের জুলাই থেকে। বহুবার লিখতে বসেছি, দশ-বারো লাইন, দেড় পাতা-দুপাতা লেখার পর মনে হয়েছে, ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে তা আসছে না, কিছুতেই আসছে না। ব্যর্থতায়, অসমর্থতায় নিজেকেই গালমন্দ করেছি, বড় বড় লেখক কীভাবে লেখেন বোঝার জন্য অনেক লেখা পড়েছি, এমনকি আমার নিজের লেখাও, যা একটু-আধটু প্রশংসা পেয়েছে, সেগুলোও পড়েছি, পড়ে মনে হয়েছে, এগুলো কি আমার লেখা? নিজের লেখা গল্প সম্পর্কেও সংশয় জেগেছে, নতুন করে চেষ্টা করেছি। তাও আসেনি। বিশেষ করে এই গল্পটি। মাঝে আরো প্রচুর গল্প ও অন্যান্য লেখা হয়েছে, বই বেরিয়েছে, সাধুবাদ

পেয়েছি, একাধিক পুরস্কারও জুটেছে। কিন্তু এই লেখাটি সামান্য শুরু, কিছুটা শুরু করেও শেষ করতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় বহন করছি বাষট্টি বছর।

বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি বলেই মনে হয় মনমতো হয়ে আসতে চায়নি। আমি বিষয়টিকে যেভাবে দেখেছি ও শুনেছি তা আনতে পারার জন্য একজন শক্তিমান লেখক প্রয়োজন। অকপটেই বলি, আমি শুধু ঘটনাটি অনুভব করেছি, এর মূল স্পর্শ করতে গিয়ে শুধুই মনে হয়েছে, আকাশে মেঘের চেহারা ও আকার যেমন ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়, তেমনি এই গল্পটিও বলে, এভাবে নয়, এইভাবে নয়, আমাকে এইরকম করে রূপ দাও। বিপত্তিটা বাধে ওইখানেই। এইরকম আর ওইরকম হয় না।

বলেছি ঘটনাটি ১৯৫৩ সালের। পড়ি ক্লাস সিক্সে। ইতোমধ্যে গোটা কয়েক গুণ অর্জন করে ফেলেছি। বিড়িতে টান দেওয়া শিখেছি ১৯৫০ সালেই, ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়। ছেলেবেলা থেকেই বাজার করা আমার প্রিয় বিষয়, কিন্তু এই বিষয়ের মূলে ছিলো বাজারের খরচ থেকে টাকায় এক আনা মেরে দেব। এক টাকা থেকে এক আনার হিসাব মেলানো এমন কিছুই কষ্টকর ব্যাপার নয়। মা ভাবতেন, ছেলেটি আমার বড় দায়িত্বশীল ও হিসেবি। কিন্তু মা তো জানে না, সেই এক টাকার এক আনা এক আনা জমিয়ে সাড়ে তিন আনা অর্থাৎ চৌদ্দ পয়সা হলেই পাবনার রূপকথা বা বাণী সিনেমা হলে অবশ্যই সিনেমা দেখা। আমি তখন ওই বয়সেই নার্গিস, মধুবালা, সুরাইয়া, মীনাকুমারী, গীতাবলী, সুচিত্রা সেনদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। মনে মনে একে পছন্দ না হলে ওকে বিয়ে করছি, তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও ঘটছে। কল্পনায় বিষয়টিকে সাজাতে রঙের ওপর রং চড়াতে কখনো কার্পণ্য করিনি। এর সঙ্গে আরেকটা বিষয় যোগ হয়েছিলো। ভ্রমণ।

আমার ছোট খালু তখন রেলওয়েতে চাকরি করেন ঈশ্বরদীতে। তিনিই ঈশ্বরদী রেলওয়ে ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ডান দিককার লাইনগুলো দেখিয়ে বলেছিলেন, এগুলো গেছে রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ হয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, আর বাঁদিকের লাইন গেছে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, কলকাতার দিকে। কলকাতা শুনেই আমার মন ছলকে উঠেছিলো। তখনই মনে মনে যাত্রা করেছিলাম কলকাতা, বোম্বাইয়ে নার্গিস, মধুবালা, সুচিত্রাদের কাছে। ভ্রমণের এই স্বপ্ন আমার এখনো আছে।

ঠিক তেমনই গ্রাম-গ্রামান্তরে যাওয়ার আগ্রহটা এখনো কমেনি। শহরের কোলাহল, যানজট, জনজট চিরকালই আমাকে অসুস্থ করে, তাই সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি এদিকে-সেদিকে। গ্রামই আমাকে টানে বেশি, যদিও জানি বাংলাদেশের সব গ্রাম দেখতে একই রকম। ওই একই ধরনের টিনের বা খড়ের ঘর, কোথাও কোথাও গরুগাড়ির ছইয়ের মতো ঘরে একগাদা মানুষ থাকে কী করে, সে-বিস্ময়ও আমাকে ঘিরে রেখেছে বহুক্ষণ, বহুদিন। গ্রামে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে পাখিদের অবাধ ওড়াউড়ি, ডাকাডাকি, গাছের ডালে ডালে তাদের নাচন, সবচেয়ে মজা মাঠে মোষ বা গরুর শিংয়ে ফিঙে বা শালিক বসে আরামে দোল খায়, বসেই এখান থেকে ওখানে যায়। বেশ ছোটবেলায় এই দৃশ্য দেখে ফিঙে বা শালিক হতে ইচ্ছে হয়েছে, আরো একটু বড় হয়ে চিল হওয়ার সাধও জেগেছে। চিলেরা আকাশের বহু ওপর দিয়ে উড়ে এ-জেলা সে-জেলা হয়ে দেশ-দেশান্তরে চলে যায়, কোথায় যায়, কেন যায়, আকাশে তো আকাশ ছাড়া যেখানে কিছুই নেই, সেখানেই যেতে তাদের এত আনন্দ কেন জানতে মনে বড় সাধ জাগে।

ওই ১৯৫৩ সালেই ক্লাস সিক্সে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শেষে দুই সপ্তাহের স্কুল বন্ধ পেলে মার কাছে অনুরোধ আর জিদ করে করে যখন আর অনুমতি মেলে না, তখনই শান্তিবুর স্বামী মুস্তাফা দুলাভাই গ্রাম থেকে এলেন, শহরে কী একটা কাজে, এসে উঠলেন আমাদের বাড়িতেই। আমাদের বাড়িতেই উঠতে হবে। কারণ ভাগ্নি শান্তিকে আববা বিয়ে দিয়েছিলেন নিজের মেয়ের মতো করেই। শান্তিবু-মুস্তাফাভাই শ্বশুরবাড়ি বলে জানতেন আমাদের বাড়িকেই। মুস্তাফাভাই আসামাত্র আমার ইচ্ছেটা তরতর করে বেড়ে বড় গাছটা ছাপিয়ে আকাশে উঠে যায়। আমিও নাছোড়বান্দা হয়ে যাই,      মুস্তাফাভাইও আমাকে নিয়ে যেতে পারলে খুব খুশি হবেন জানালে মা ও আববা সম্মতি দিলেন। আমি গেলাম পাবনা শহর থেকে বিশ মাইল পুবে খালইভরা গ্রামে, যে-গ্রামে গ্রাম ছাড়া আর কিছুই নেই।

তাতেই আমার আনন্দ। আমি খোদ শহরের ছেলে, সিনেমা দেখে দেখে পেকে উঠেছি। কিন্তু সেই আমাকে গ্রাম একটুও ক্লান্ত করে না, আনন্দ দেয় প্রকৃতির সবুজ দিয়ে, পাখ-পাখালির অবিরাম ডাকাডাকি ও পাখা ঝাপটানি দিয়ে, ঝড়ের আগে অধিক শান্ত হয়ে, ঝড়ের সময় গাছপালা, মাঠঘাট কাঁপিয়ে যখন সবকিছু তছনছ করে ফেলে, তখন আমার কিন্তু আনন্দই লাগে। শহরের প্রকৃতি আর গ্রামের প্রকৃতি যেন দুটি অচেনা ভাই, একজন আছে না থাকে, কখনো বলে না।

খালইভরা গ্রামে আমার ভালোই কাটছে। অবারিত মাঠ কাটা ধানের গোছা নিয়ে বুক চিতিয়ে শুয়ে আছে, হাজারে হাজারে চড়ুই আর শালিক মাঠে খুঁটে খুঁটে ধান খায়, কখনো বিরাট একটা চিল শোঁ করে নেমে এসে একটা চড়ুই ধারালো ঠোঁটে তুলে নিয়ে চলে গেল। এই খবর মুহূর্তে পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। দেখি বউ-ঝিরা তাদের মুরগি আর তার বাচ্চাদের আগলে রাখতে ব্যস্ত হয়ে যায়। আকাশে চিলের ওড়াউড়ি বেড়ে যায়। সেদিন চিলের আক্রমণের পরপরই শান্তিবুর বাড়ির কাছাকাছিই শোরগোল বেশি শুনি। মল্লিকা আর মালতীদের একটা নয়, দুটো মুরগির বাচ্চা চিলে তুলে নিয়ে গেছে। বাচ্চাদের চিঁ-চিঁ চিৎকারে মুরগিগুলো শুধু দাপাদাপি করে, তারপরই তারা থেমে যায়। যেন কিছুই হয়নি বা ঘটেনি। গ্রামটা কিছুক্ষণ আগেও জীবন্ত হয়ে ওঠে, আবার মরে যায়।

সেইদিনই শান্তিবুর পিঠের দুই পাশ ঘেঁষে দুটি বালিকাকে পুঁইশাক ও বেগুন কাটতে দেখি। শান্তিবু আমাকে রান্নার কড়াই থেকে মুখ তুলে একটা হাসি দিয়ে বলে, আয়, পিঁড়িটা পেতে বস।

শান্তিবু যেখানে বসতে বলে সেখান থেকে মল্লিকার দূরত্ব দুই হাত, মালতীরও তাই। বোম্বাই, কলকাতার সিনেমা দেখে দেখে পেকে ঝানু হয়ে গেলেও দুই বোনের অতো কাছে বসতে কেমন যেন লজ্জা-লজ্জা লাগে। আমি দাঁড়িয়েই থাকি। মালতী চোখ দিয়েই শান্তিবুর কাছে জানতে চায়, কে?

আমার মামাতো ভাই। পাবনায় থাকে।

আমি জানতে চাই, ওরা কারা?

শান্তিবু মাথা না ঘুরিয়েই বাঁহাতের তর্জনী দিয়ে দেখিয়ে বললো, ওই তালগাছের পেছনেই ওদের বাড়ি। মালতী, মল্লিকা, তোরা যেন কোন ক্লাসে পড়িস?

জবাব দেয় মালতী, আমি মালতী ও মল্লিকা।

বলেই ফিক করে হেসে বলে, বলেন তো আমাদের দুজনের মধ্যে কে বড়?

আমি ধাঁধায় পড়ে যাই। দুজনই কিশোরী। চট করে সঠিক জবাব দেওয়া সম্ভব হয় না। বুঝতে পারি দুই বোনের বড়-ছোট প্রশ্ন ওদের একটা খেলা। আন্দাজেই মালতীকে দেখিয়ে বলি, ও বড়।

দুই বোন খলবল করে হেসে ওঠে।

হলো না! হলো না!

আমি যে হেরে গেলাম বুঝেও পরাজিত বোধ করিনে, বোন দুটি আমার বোনকে যে দুপাশে গোলাপ হয়ে ঘিরে রেখেছে দেখে আমি আর চোখ ফেরাতে পারিনে।

জিগ্গেস করে মল্লিকা, তুমি কী পড়ো?

চমকে উঠি আমি। এই প্রথম দেখা, প্রথম পরিচয়, প্রথম কে বড় কে ছোট জানা, তা সত্ত্বেও শুরুতেই সম্বোধন তুমি শুনে বলি, আমি ক্লাস সিক্সে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা দিয়েছি।

এটা যেন বিবেচনার বিষয়ই নয়। দুই বোন এক বছরের  ছোট-বড় হলেও পড়েও একই ক্লাসে। চেহারায়ও বড়-ছোটর ছাপ নেই। আমি চোখ জুড়িয়ে দুই বোনের শান্তিবুকে কাজে সাহায্য করতে দেখি। শান্তিবু খুন্তি দিয়ে কড়াইয়ে তরকারি           নাড়তে-নাড়তেই বলে, এই মালতী-মল্লিকা, তোরা দুপুরে এখানে খাবি। দুলাল এসেছে। একসঙ্গে খাওয়া হবে।

মালতী হাততালি দিয়ে হেসে বললো, কাকি, তোমার ভাইয়ের নাম জেনে গেলাম।

আজ না হোক কাল তো জানতিই।

হ্যাঁ গো দুলালদা, তুমি শহরের মানুষ, আমাদের গ্রাম ভালো লাগবে?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেও মুখে বলতে ইচ্ছে হয়, আমি শহরের চাইতে গ্রামে-গ্রামে ঘুরতেই বেশি ভালোবাসি। শহরের ওই     হই-হট্টগোল আমার বেশি ভালো লাগে না। মনে-মনে এ-কথাও বলি, তোমরা থাকলে গ্রাম আমার আরো ভালো লাগবে। বললাম শান্তিবুকে, বু, আগেরবার তো ওদের দেখিনি।

শান্তিবুর জবাবটা দেয় মল্লিকা।

আমরা সে-সময় বারাসাতে বড় মামার ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম, তাই তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি।

আমি আর কোনো জানার বিষয় খুঁজে না পেয়ে আস্তে-আস্তে বাড়ির বাইরের আঙিনায় পা বাড়ালে শুনি দুই বোন হেসে কুটিপাটি হতে-হতে মালতী বললো, শহরের ছেলে এমন মুখচোরা হয়?

আমি মাথা ঘুরিয়ে ফিরে তাকালে দেখলাম শান্তিবু খুন্তি দেখিয়ে ওদের একটু ভয় দেখালো। দুই বোনের মজা আরো বেড়ে যায়।

দুপুরে মুস্তাফাভাইসহ খেতে বসলে আমি বলেই ফেলি, মালতী-মল্লিকা আসবে না?

কী জানি! আমাকে কাজেকর্মে একটু সাহায্য করে, এর মধ্যে তুইও এসেছিস বলে ওদের খেতে বলেছিলাম।

সহসা চোখ পড়ে মুস্তাফাভাইয়ের দিকে। দেখি ভাই মিটমিট করে হাসছে।

আপনি হাসছেন কেন?

খাবার চিবুতে চিবুতে মুখভর্তি হাসি নিয়েই ভাই বলে, কী, শালাবাবুর কোনটাকে মনে ধরেছে?

ধমকে ওঠে শান্তিবু,

কী যে বলো না!

না, তোমার ভাইয়ের আগ্রহ দেখে বললাম আর কি!

আমার কিন্তু ইচ্ছে করেছিলো দুই বোনে আসুক। এই গ্রামের ভেতর গ্রামে ফুলের নামে নাম নিয়ে দুই বোন যেভাবে হেসে-খেলে বেড়ায় তাতে মনে হয় গোটা গ্রামটাই যেন মাতোয়ারা থাকে। এবারে আমার এই গ্রামটা আরো বেশি ভালো লাগতে শুরু করেছে।

খেতে খেতে আবার জিগ্গেস করি, আপনাদের গ্রামে এখন হিন্দুর সংখ্যা কত?

হঠাৎ এ-প্রশ্ন?

না, মানে অনেক হিন্দু চলে গেছে কিনা! আমারই এক ক্লাসমেট, পাবনায় কী বিরাট গেঞ্জির কারবার, হঠাৎ একদিন শুনি হিন্দুস্তান চলে গেছে।

তুমি জানতে না?

আমি কেন, আমার সেই ক্লাসমেটের পাশের বাড়ির বাতেন সাহেবও জানতেন না আজ রাতের অাঁধারেই ওরা চলে যাবে। ওরা আগে থেকেই নাকি কিছু জিনিসপত্র বিক্রি করা শুরু করেছিলো।

মুস্তাফাভাই শুধু একটা লম্বা শ্বাস ফেলেন। এবং কী আশ্চর্য, খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্তিবু বা মুস্তাফাভাই কিংবা আমি একটা কথাও বলি না; খাওয়া শেষে নিঃশব্দে উঠে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বাইরে গিয়ে একটা গাছতলায় দাঁড়াতেই চোখে পড়ে অদূরে মাঠের আলের ওপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে মালতী একটা গাই বাছুরকে ওদের বাড়ির দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ডাক দিলাম।

মালতী, ও মালতী!

থমকে দাঁড়ায় মালতী।

ডাকছো কেন?

হাসতে হাসতেই বলি, রাখালনী হলে কবে?

রুখে দাঁড়ানোর মতো দাঁড়ায় মালতী।

নিজের কাজ নিজে করবো, তাতে তোমার কী?

না, না, আমার কিছু না। বুবু তোমাদের দুই বোনকে খেতে বলেছিলো, এলে না কেন?

আমরা তো কাকির ঘরে হরহামেশা আসছি, খাচ্ছি, নিচ্ছি, এটা তো আমাদের নিজের বাড়ির মতোই। শোনো, আজ চিনেখরার হাটে যাবো, তুমি যাবে?

আমি মাথা নেড়ে না জানালে মালতী আবার গরু তাড়াতে তাড়াতে বাড়ির দিকে চলে যায়। আমি শুধু নির্বাক চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিইবা করতে পারি।

সহসা মাথায় চক্কর মারে। ওরা হাটে যাবে? গ্রামে মেয়েমানুষ হাটে যায়? পাবনা শহরে অবশ্য অনেক মেয়ে, মহিলাকে শাড়ির দোকানে, গয়নার দোকানে যেতে দেখেছি, কিন্তু শহরের সবচেয়ে বড় মাছ-তরকারির বাজারে কোনো মেয়ে মহিলাকে দেখিনি।

মল্লিকা-মালতী আজ চিনেখরার হাটে যাবে কথাটা বললাম  মুস্তাফাভাইকে। ভাই চোখ মটকে মুচকি হেসে বললো, শান্তি, ও শান্তি, তোমার ভাই কিন্তু মজেছে।

দুলাল আবার কিসে মজলো?

খানিক পর শালাবাবু মালতী আর মল্লিকার সঙ্গে হাটে যাবে।

কথাটার কোনো গুরুত্বই দিলো না শান্তিবু।

যাবে! তাতে কী হয়েছে? ওরা হিন্দু মানুষ, এতে ওদের লজ্জাটজ্জা নেই।

মুস্তাফাভাই চুপসে গেলেও মুখ থেকে হাসিটুকু মোছে না। আমার কিন্তু ভালোই লাগছে ছুটির বন্ধে মা-বাবা, আপন  ভাইবোন, ঘরবাড়ি, বন্ধুদল, বলখেলা, দাড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, ঘুড়ি ওড়ানো ছেড়ে গ্রামে পড়ে আছি, ঘুরছি-ফিরছি, মালতী-মল্লিকার মতো কাজলমাখা মায়াভরা দুটি মেয়ের এতো তাড়াতাড়ি অতি আপন হয়ে গেলাম ভেবে খালইভরা গ্রামটাকে আমার কাছে বেহেশত-বেহেশত মনে হয়। থ্রি-ফোরে পড়ার সময় আরবি মাওলানা স্যার আগাম স্বপ্ন জাগিয়ে রেখেছিলেন পুণ্য কাজ করে বেহেশতে যেতে পারলে সত্তর হাজার হুরপরী পাওয়া যাবে। সেই হুরপরির দুজন তো এখানেই এই খালইভরা গ্রামেই। ওরাই আমাকে হাটে যাবার কথা বলেছে।

ইচ্ছে হয়েছিলো ওই গরমে গাছতলায় মাদুর পেতে শুয়ে থাকবো। গ্রামের চারদিকের গাছপালার সবুজে আকাশের নীল মিশে যে মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, সেখানে শুধু মালতী আর মল্লিকাকেই বারবার দেখতে পাই। প্রতিমুহূর্তেই মনে হয় কখন ওরা বাইরে বেরোবে, হাটে যাবে।

একসময় দেখি দুই বোন দুটো বেতের ঝুড়ি দুলিয়ে এগিয়ে আসছে। মালতীই আমাকে প্রথম দেখতে পায়।

দুলালদা, তুমি এখানে একা-একা বসে কী করছো?

তোমরা কি হাটে যাচ্ছো?

যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের জবাব তো পেলাম না!

বলে ফেলি, যদি সঙ্গে নাও তাহলে যেতে পারি।

দুই বোন হেসে কুটিকুটি হয়ে একজন বলে, তখন যে বললে যাবে না!

তখন বলেছি। কিন্তু এখন বলছি, যাবো।

তা বেশ তো। চলো!

হেসে বললাম, পুরুষ মানুষের সঙ্গে যেতে খারাপ লাগবে না? লোকে কিছু বলবে না তো?

মল্লিকা-মালতী দুবোনই থমকে দাঁড়ায়। একে অপরের মুখের দিকে তাকায়, আর আমি দেখি দুই বোনের চোখ অবিশ্বাসে কৌতুকে ফেটে ফেটে যাচ্ছে।

তুমি পুরুষ মানুষ? গোঁফের রেখা নেই, দাড়ি তো নেই-ই, নাক টিপলে দুধ বেরোবে, সে কিনা পুরুষ মানুষ! মালতী, এ বুড়ো কি বলে রে?

আমি কিশোর থেকে এক লাফে বুড়ো হয়ে গেলাম দেখে রাগও হলো, মজাও লাগে।

বললাম, বুড়ো বললে কিন্তু যাবো না।

থতমত খায় দুই বোন। স্পষ্ট দেখলাম দুজনেরই চোখ-মুখ থমথমে হয়ে গেল। আমার মুহূর্তে মনে হয়, খালইভরা গ্রামের সব গাছের পাতারা নাচতে শুরু করেছে, সব পাখি একসঙ্গে গান গাইতে শুরু করলো।

তিনজন একসঙ্গেই এগোই, কিন্তু কোনো কথা হয় না। জ্যৈষ্ঠ মাসের রুক্ষ মাঠ, গাছের পাতাও নড়ে না। জ্যৈষ্ঠ মাসেই যে   আম-কাঁঠাল পাকে তা শহরে বাস করে ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু এই গ্রাম আমাকে মধুমাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি, দুই বোনের মুখে মধুর কোনো আভাই নেই। আমি সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাবে ওরা যে অস্বস্তিতে পড়বে এমনটি ভাবার কোনো কারণই মনে আসে না। শুধু মনে হয়, কোনো অভাবের সুতোয় টান পড়ে মালতী-মল্লিকা এমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে?

চিনেখরা হাটে পৌঁছেও দুই বোনের ভাবান্তর দেখিনে। আমি হাটের পাশে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানতে চাই, এই রাস্তা কোনদিকে গেছে?

শান্ত গলায় জানায় মালতী, পুবদিকের এই রাস্তা গেছে দুলাই, কাশীনাথপুর, রাজনারায়ণপুর, নগরবাড়ি আর পশ্চিম দিকের রাস্তা পাবনা। পাবনা থেকে যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারো।

বাববা! তুমি দেখছি একটা আস্ত ভূগোল। গড়গড় করে কেমন বলে গেলে।

আমাদের গ্রাম, গ্রামের চারপাশের গ্রামের কথা আমরা জানবো না? জানো, নগরবাড়ি গিয়ে যমুনা পাড়ি দিয়ে যেমন ঢাকা যাওয়া যায়, তেমনি পাবনা থেকে ঢাকা যেমন যাওয়া যায়, কলকাতাও যাওয়া যায়। তোমার কলকাতা যেতে ইচ্ছে করে না?

করে তো! কিন্তু ওই হিন্দুস্তানে তো আমাদের কেউ নেই। কার কাছে যাবো?

মল্লিকা-মালতী কেউই আমার এ-কথার জবাব দেয় না। আমিই বলি, আমি এখানেই দাঁড়াই, তোমরা কেনাকাটা করোগে।

দেখলাম দুই বোন খুশি বা অখুশি কিছুই না হয়ে আর দশটা হাটে যাওয়া মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবে হাটের ভিড়ে হারিয়ে গেল।

হাটশেষে দুই বোনের হাতে তেলের শিশিতে তেল, দুটো গামছা আর ঠোঙায় লবণ দেখলাম।

এই তোমাদের হাটের কেনাকাটা?

আমার এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয় না দুই বোন। শুধু মল্লিকা জানতে চায়, দুলালদা, তুমি বাড়ি যাবে কবে?

কেন?

এমনি জানতে চাইলাম।

যাবো স্কুল খোলার দিনদুয়েক আগে।

কিন্তু সেটা কবে?

এই সামনের শনি বা রোববারে।

চোখ পড়ে মল্লিকার হাতের দিকে। দেখি আঙুলের কড়ে দিন গুনছে।

তুমি আর চারদিন আছো। দেখতে দেখতে চলে যাবে। আচ্ছা, আমাদের এই গ্রাম তোমার ভালো লাগে?

আগেও একবার এসেছি, কিন্তু এবার বেশি ভালো লাগছে।

মুখ টিপে হাসে দুই বোন। শুধু বলে,

কেন?

জানিনে।

কথা আর এগোয় না।

শান্তিবুর বাড়ির কাছাকাছি এলে একসঙ্গে হঠাৎ থেমে যায় দুই বোন। একজন বললো, জানো, বারাসাত গেলে আমি খালইভরার খানিক মাটি নিয়ে গিয়েছিলাম।

চমকে উঠে বলি, এতোকিছু থাকতে মাটি?

আমাকে চমকে দিয়ে মালতী শুধু বলে, তুমি একটা গাধা।

আর মল্লিকা যোগ করে, আস্ত ছাগলও।

বলেই আর দাঁড়ায় না দুই বোন; পায়ে যেন ঝড় লাগে, ছুটে দৌড়োয় তালগাছের পেছনের বাড়িটার দিকে।

আমি আমার বয়সের কাছে জিগ্গেস করি ওরা নির্বোধ পশুর সঙ্গে আমার তুলনা করলো কেন; বয়স জানায়, আমি গাধা ও ছাগলেরও অধম। অবাক হয়ে ওদের যাওয়ার রাস্তাটা দেখলাম। ধুলো উড়ছে, গাছ থেকে একটা-দুটো পাতা পড়ছে, আকাশের বহু ওপরে একটা চিল চিঁ-চিঁ করে ডেকে উঠলো। আমার মনে তখন একটা কষ্টই খোঁচাখুঁচি করে। আমি এই গ্রামে আর চারদিন আছি বলে ওদের মনে কি দুঃখ জাগলো? নিজেকেই শুনিয়ে বলি, আমি সামনের বছরও আসবো, তোমরাও আরেকটু বড় হয়ে বনেবাদাড়ে, ধানক্ষেতে, খালের ধারে বেড়াতে যাবে, সঙ্গে আমিও যাবো।

পাবনা যাওয়ার দিন সকালেই চারপাশ ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। আমি ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে ওপরের দিকে মুখ তুলে               দেখি আকাশ কোত্থেকে যেন রাশি রাশি মেঘ এনে আকাশের        পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর দক্ষিণ, সব কোণ ভরিয়ে তুলেছে। কোথাও একটু নীল নেই, সূর্যের আলোরও সাধ্যের বাইরে মেঘ ভেদ করে পৃথিবীতে আসে। মুস্তাফাভাইও আকাশ দেখে গম্ভীর গলায় বললো, এ তো দেখি অকাল বর্ষার লক্ষণ। জষ্টি মাসে এরকম মেঘ তো এর আগে কখনো দেখিনি।

শান্তিবু ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললো, ঝড় উঠবে মনে হয়। ঝড় হলেই সব মেঘ কেটে যাবে।

শান্তিবুর ঝড়ের চিন্তার চাইতে আমার চিন্তা বেশি।

পাবনা থেকে আসার সময় মাধপুর থেকে যখন হাঁটা শুরু করি, তখন সূর্য মাঝ আকাশে আসেনি। সকালে পাবনা থেকেই দেখে আসছি আকাশে পাতলা পাতলা ভাসমান মেঘ, ওই মাধপুর থেকে আধো ছায়া আধো রোদ, সঙ্গে বাতাসও থাকায় মাধপুর বনগাঁ চিনেখরা খালইভরা আট মাইল রাস্তা হেঁটে আসতে আমার একটুও কষ্ট হয়নি, যেন নতুন জায়গায় নতুন আবিষ্কারে যাচ্ছি – এই আনন্দ নিয়ে যখন শান্তিবুর উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাক দিই, বু!

আমার এক ডাকেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে শান্তিবু। একটুও কষ্ট হয়নি ঠিকই, কিন্তু ঘেমে গেঞ্জি-জামা যে জবজবে হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারি বুর কথায়।

তুই আসবি আগে থেকে খবর দিবি না?

দিলে কী হতো?

গরুর গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। মাধপুর থেকে নিয়ে আসতো।

আমি বু-কে কী করে বোঝাই এই আকাশ, গরমকাল হলেও স্নিগ্ধ খোলা বাতাস আর সবুজ আর সবুজে নেয়ে আসার আনন্দ বু তুমি বুঝবে কী করে। গ্রাম যে আমার খুব প্রিয়। কিন্তু এখন? গ্রাম যতই প্রিয় হোক, শহরে আমাকে ফিরতেই হবে, স্কুলে আমাকে যেতেই হবে, পড়াশোনা না করলে তো নিস্তার নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেঘের গর্জন আর দাপট দেখতে দেখতে সহসা মনে               হয়, আমি এই গ্রামের কে, এটা তো মুস্তাফাভাইদের গ্রাম,  মালতী-মল্লিকাদের গ্রাম। এটা ওদের সব, সমগ্র জীবন।             হিন্দু-মুসলমানে মিলেমিশে ওরা একটা জীবন হয়ে আছে।

বুঝতে পারি ঠান্ডা বাতাসের একটা ঝাপ্টা লাগলো, সাথে এটাও বুঝি বাতাসের ঝাপ্টাটা এলো পশ্চিম থেকে, যমুনা নদীকে ছুঁয়ে। তাহলে ওদিকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে? আর ঠিক তক্ষুনি দেখি চিনেখরা হাটের দিক থেকে মল্লিকা কালো গাইয়ের বাছুরটাকে যেন মায়ের আদরে আদরে সিক্ত করে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ডেকে বলি,

মল্লিকা, এই সাতসকালে ওদিক থেকে বাছুরটা আনলে কোত্থেকে?

দাঁড়িয়ে পড়ে মল্লিকা। দাঁড়িয়ে যায় বাছুরটাও। যেন মায়ের কাছ থেকে শিশু একটু দূরে সরে গেলে যদি হারিয়ে যায়, এমনিভাবেই মল্লিকা বাছুরের দড়ি ধরে থাকে, জবাব দেয়,

সকালেই ছুটতে ছুটতে কেন যে হাটে গিয়ে উঠলো ও-ই জানে।

হেসে বলি, হাটে হয়তো ওর কিছু কেনাকাটা করার ছিলো!

যা! ও কি মানুষ যে হাটে কেনাকাটা করবে?

তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে গোয়ালে তুলে রাখো। দেখছো না আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসছে?

বৃষ্টির শব্দ আমি যেমন বুঝি, মল্লিকাও তেমনই বোঝে। আমি আরো বুঝি এই পাগলপারা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে হলে এক্ষুনি ছুট লাগাতে হবে। মল্লিকা চলে যাওয়ার পরও আমি আর চোখ ফেরাইনি, এদিকে বৃষ্টি ঘন থেকে ঘনতর হয়ে গোটা গ্রামটা চোখের আড়াল হয়ে গেল। তখনই মনে পড়ে মল্লিকা চলে যাওয়ার সময় আমার দিকে একবার গভীরভাবে তাকিয়েছিলো।

আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। এ-সময়টায় বিছানায় থাকার কথা নয়, কিন্তু বৃষ্টির ঝাপটা আর মেঘের আকাশ প্রকৃতি-কাঁপানো গর্জন আমাকে বিছানায় বন্দি করে ফেললে ঘুরেফিরেই মনে হতে থাকে, বৃষ্টি এলো কিন্তু মালতী কিংবা মল্লিকা এলো না, ওরাও কি আমার কথা মনে করে অস্থির হচ্ছে?

কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়ি মনে নেই; ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে শুনি টিনের চালে বৃষ্টির অবিরাম বাজনা। এমন সময় শান্তিবুর ডাক শুনি, এই দুলাল উঠবি না, খাবি না?

শুয়েই জবাব দিই, উঠবোও, খাবোও। কিন্তু যাবো কী করে?

গরুগাড়ি ঠিক করে দেবো?

পেছন থেকে মুস্তাফাভাইয়ের গলা শুনি।

আমি মোকসেদকে খবর দিয়েছিলাম। ও এই বৃষ্টি-কাদায় গাড়ি নিয়ে যেতে রাজি না। বুঝতেই তো পারছো এই বৃষ্টি-কাদায় রাস্তায় গরুর গাড়ি আটকে গেলে সে হবে আরেক বিপদ।

আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি বিছানা থেকে।

তাহলে আমার স্কুল?

তোমার যাওয়ার এখন একটাই উপায় আছে।

কী?

হেঁটে যেতে হবে।

আসার দিন মাধপুর থেকে হাঁটার কথা মনে হয়, কিন্তু যাওয়ার দিনে যে আকাশ আমাকে এভাবে আটকে দেবে তা তো মাথায় আসেনি। কিন্তু যেতে তো আমাকে হবেই।

বললো মুস্তাফাভাই, মোকসেদ গাড়ি নিতে পারবে না, কিন্তু তোমাকে মাধপুর পৌঁছে দিয়ে আসবে।

আট মাইল আট মাইল ষোলো মাইল হাঁটবে মোকসেদভাই?

হেসে ফেলে শান্তিবু।

ষোলো বিশ মাইল হাঁটা ওদের জন্যে কিছু না। ও এখান থেকে হেঁটে আতাইকুলা পুষ্পপাড়া হাটে যায়, সে তো আরো দূর।

আমি মনে মনে বলি, পুষ্পপাড়া থেকে আর কিছুটা এগোলেই তো পাবনা শহর। বাববা। এতো হাঁটতে পারে এরা? ছোট বুদ্ধি দিয়ে বুঝি, বেঁচে থাকার জন্যে হাঁটতেই হয় এদের।

মুস্তাফাভাই হিসাব করে, এখন সাড়ে দশটা বাজে, এগারোটা সোয়া এগোরোটার দিকে বেরিয়ে গেলেই সন্ধ্যার বাসটা পাবে। তবে শালাবাবু, বাস কিন্তু ওই একটাই। ধরতে না পারলে মাধপুরেই থাকতে হবে।

শুনে আমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। আর দেরি নয়। আগে গিয়ে বসে থাকবো তাও আচ্ছা।

দুটো ছেঁড়াফাটা ছাতা জোগাড় করেছে মুস্তাফাভাই। শান্তিবু গরম ভাতে খানিক ঘি ঢেলে ডিম ভেজে দিলে আমি দুটো নাকেমুখে দিয়েই উঠে পড়ি। শান্তিবু আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে, চোখে, মাথায় ফুঁ দিতে থাকলে মুস্তাফাভাই হেসে ফেলে,

এখন ছাড়ো। আচ্ছা শান্তি, দুলাল যে আজ যাবে, মালতী-মল্লিকারা জানে না?

জানে। ওদের বলেছি।

কিন্তু ওদের কেউ তো এলো না!

তার আমি কী বলবো?

কী শালাবাবু, যাওয়ার আগে দেখা হলো না বলে মন খারাপ লাগছে?

বয়েই গেছে।

মুখে বয়েই গেছে বললেও মন তো সত্যিই বলছিলো এলে চোখের দেখাটা তো হতো, সেই দেখাটা সারাটা দিন চোখে এঁকেই বৃষ্টি-কাদা মাথায়-পায়ে মেখে পথ চলতে আমার একটুও কষ্ট হবে না। আবার সামনের বছর আসার ইচ্ছে আছে, তখন ওরা আরো খানিক বড় হবে না? সুন্দরও হবে।

মোকসেদভাই গ্রামেরই মানুষ, হেঁটে চলাফেরা, হাটবাজার, কাজকর্ম, এ-গ্রাম সে-গ্রাম করা তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। আমি প্রায় দৌড়েও তার সঙ্গে হেঁটে পারিনে। আমাকে ফেলে সে বেশ খানিক এগিয়ে গিয়ে আবার থামে, আবার থামতে হয় তাকে, পাছে আমি অনেক পেছনে পড়ে যাই। টিপটিপ বৃষ্টি, ঝমঝম বৃষ্টি, ঠান্ডা হাওয়া, দমকা হাওয়ার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আমার থেকে থেকেই মনে হয়, মাধপুর আরো পিছিয়ে যাচ্ছে, মাধপুরের বাস কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টার্ট নিয়ে আমাকে ফেলে চলে যাবে।

চলছি ঝোঁকের মাথায়। কখন যে বনগাঁ পার হয়েছি জানিনে, এখান থেকে মাধপুর আর কতোদূর তাও আমার অজানা।   কাদায়-পানিতে একসা হয়ে যখন পা ভেঙে আসছে তখনই আমি থমকে নয়, স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। মোকসেদভাই তখন বেশ এগিয়ে গেছে। দেখলাম, রাস্তায় বেশকিছু লোক উত্তর আকাশের দিকে তাকিয়ে হায় হায় করে বলাবলি করছে,

নিয়ে গেল, নিয়ে গেল রে, সবকিছু তুলে নিয়ে গেল।

আমিও উত্তর আকাশের দিকে গোল্লা গোল্লা চোখে তাকিয়ে দেখলাম লম্বালম্বি হয়ে ঘন কালো মেঘের মোটা একটা রেখা মাটিতে নেমে এসেছে।

ভীত গলায় জানতে চাই, কী? ওটা কী?

কিছু লোকের একজন বলে, ওটা হাতির শুঁড়।

জবাবে মনে-মনে প্রবল ধাক্কা খাই। আকাশ সমান হাতি হয়? বছর দেড়েক আগে পাবনার মাদ্রাসা মাঠে কমলা সার্কাস এসেছিলো, তারা হাতি এনেছিলো, আমরা বাচ্চারা ‘এ হাতি তোর পায়ের তলায় বরই বিচি’ বলে তাকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টাও করেছিলাম, কিন্তু সার্কাসের হাতি না ক্ষেপে একবারই শুধু শুঁড় তুলে বেশ শব্দ করেই ডেকে ওঠে। সেই ডাকার শব্দেই আমরা ভয় পেয়ে ছুটে পালাই, মনে হয়, হাতি আমাদের পায়ের তলায় বরই বিচির মতো পিষে ফেলার জন্যে তেড়ে আসছে। কিন্তু হাতি আসে না। খানিক পর পেছনে তাকিয়ে দেখি হাতি একটা ছোটখাটো কলাগাছ শুঁড় দিয়ে তুলে মুখে পুরে নিচ্ছে। আমাদের সমস্ত ভয় কেটে যায়। আবার ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করি, কিন্তু সে কানেই তোলে না।

কিন্তু এই মেঘভরা আকাশের নিচে কোথায় হাতি, আকাশ থেকে যখন তার শুঁড় নেমে এসেছে, তখন নিশ্চয়ই তার মাথাটা চতুর্থ আসমানে না হোক, তৃতীয় আসমানে নিশ্চয়ই। এমন সময় আমার কাঁধে মোকসেদভাইয়ের হাত।

দুলাল, যাবে না?

ভাই, ওরা বলছে ওটা হাতির শুঁড়, সবকিছু তুলে নিয়ে গেল।

হাসে মোকাসেদভাই।

হাতি কি আকাশসমান হয়? ওই যে শুঁড়ের মতো নেমেছে, ওটার কি যেন একটা ইংরেজি নাম আছে, তবে ভালো বাংলায় কয় ঘূর্ণিঝড়। আমরা বলি ‘বাঁওসোত’। দেখছো না ঘূর্ণির মতো ঘুরতে ঘুরতে আরো উত্তরে সরে যাচ্ছে! ওই শুঁড়ের মধ্যে পড়লে বাড়িঘর, মানুষ, গরু-বাছুর, গাছপালা, পুকুর খাল-বিলের মাছটাছও আকাশে উঠে যায়, এক সময় ধপাস ধপাস করে মাটিতে পড়ে। আল্লাহ বাঁচিয়েছে আমাদের, হাতির শুঁড়টা এদিকে নামেনি। চলো, চলো, তাড়াতাড়ি চলো। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার ফিরতে হবে না?

মোকসেদভাই যে এক-নিশ্বাসে এতো কথা বলে গেল, তার মধ্যে আমার বিশেষভাবে মনে হয় ওই শুঁড়ের টানে মানুষও ওপরে উঠে যায়, অদৃশ্য হয়ে যায়। এই জিনিস আমি আগে কখনো দেখিনি।

মানুষ শূন্যে উঠে যায়, ওপরে চলে যায়, ওখান থেকে ধপাস ধপাস করে পড়ে, তারপরে মরে যায়? কতো রকম মৃত্যুফাঁদ যে আছে তা গুনতে গিয়ে দেখলাম অর্থহীন সে-গণনা। ওই ঘূর্ণিঝড়ে নিশ্চয়ই অনেক মানুষ আকাশ থেকে মাটিতে নামতে নামতে নেই হয়ে গেছে। নেই হয়ে কোথায় যায় ওরা – প্রশ্নটা মনের মধ্যে ওই ঘূর্ণিঝড়ের মতোই ঘুরতে থাকলে আমি মোকসেদের একটা হাত খপ করে ধরে ফেলি, ওই ঝড় ঘুরতে ঘুরতে আবার এদিকে আসবে না তো?

আরে না। দেখলে না ওটা ঘুরতে ঘুরতে আরো উত্তরে চলে গেল? আর আমরা তো যাচ্ছি পুবে। নাও, পা চালাও। তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে তারপর খালইভরা যাবো।

বাস ছাড়া পর্যন্ত তুমি থাকবে না?

দুর পাগল! বাস তো ছাড়বে সন্ধ্যার দিকে। প্যাসেঞ্জার আসবে, গাড়ি ভরবে, তারপরে না ছাড়বে! পা চালাও, পা চালাও।

 

পা না চালিয়ে উপায় নেই। মোকসেদভাইয়ের কথায় মাধপুরে বাসের দূরত্ব মাইলখানেক হবে, এই প্যাচপেচে কাদা মাড়িয়ে এই মাইলখানেক যেতে কতোক্ষণ লাগবে জানিনে। সন্ধ্যা এখনো লাগেনি, আকাশ পরিষ্কার থাকলে সূর্যের অবস্থান দেখেও সময় অনুমান করা যায়, কিন্তু কোথায় সূর্য, কোথায় নীল আকাশ। আমি চারপাশে শুধু মেঘের ঘন আনাগোনা দেখি। আমার মাথায় তখন বাড়ির চিন্তা, গাড়ির চিন্তাও। মনে আছে হাতির শুঁড় দেখার আগে আমার থেকেও শান্তিবুর করুণ মুখখানা মনে পড়ছিলো, চোখে ভাসছিলো মাঠে-হাটের রাস্তায় খালের ধারে পেয়ারাগাছের ডাল থেকে ডালে মালতী-মল্লিকার সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটানো, আকাশে মেঘের ভয়ংকর চেহারার মধ্যে মল্লিকার বাছুর নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যাওয়া, সব, সবকিছু ছবির মতো চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়, আমি আচ্ছন্নের মতো হাঁটতে থাকি। পা চলে না, তবু হাঁটি, চলতে হয়, হাঁটতে হয়।

মাধপুর পৌঁছে দেখি বাস দাঁড়িয়ে আছে, কোনো যাত্রী নেই। কাছেই একটা চায়ের ও একটা মুদির দোকান, কিন্তু দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। এই অকাল ঘোর বর্ষায় যাত্রী কোথায়, লোক কোথায়, দোকান থেকেও নেই। মোকসেদকে ছাড়তে হবে। আমিই ওকে ঠেলে দিই চিনেখরা খালইভরার রাস্তায়। মোকসেদ আমাকে ছেড়ে যাবার আগে শুধু বলে, ভয় নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোক এসে যাবে।

আমি বাসে উঠে ভেজা জামা খুলে পুঁটলি থেকে একটা শুকনো জামা ও লুঙ্গি পরে গাড়ির জানালা দিয়ে বৃষ্টিভেজা মাধপুর দেখতে দেখতে কখন যে কাত হয়ে সিটের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়ি জানিনে, বাস যে কখন চলতে শুরু করেছে তাও বলতে পারবো না। তখনই আমি বুঝি, কারো একজনের থাইয়ের ওপর আমার মাথা। কে যেন পরম যত্নে আমার কপালের ওপর হাতটা রেখেছে। বাসের ভেতরে বাতি নেই, বুঝতেও পারছিনে কার হাত ওটা। ঠিক সে-সময় আমার ডান চিবুকে একটু গরম পানির একটা ফোঁটা আমাকে কাঁপিয়ে দেয়, আমি ধড়মড় করে উঠে বসতে চেষ্টা করতেই একটা নারীকণ্ঠ কোমল গলায় বলে, বাবা, তুমি ঘুমোও, ঘুমোও!

মহিলা হাতচাপা দিয়েই আমার মাথাকে আশ্রয় দেয়, আমিও আর নড়িনে, মনে হচ্ছে মায়ের থাইয়ের ওপরেই মাথা রেখেছি। এর পরেই বুঝতে পারি মহিলা ফোঁপাচ্ছে।

মা, তুমি কাঁদছো কেন?

সব ছেড়ে গেলে কান্না পায় না? ওই শ্বশুরের ভিটে, তোর বাপ ঠাকুরদার চৌদ্দো পুরুষের জন্ম, সেই কোন ছোটবেলায় বউ হয়ে এসেছিলাম, ওই ঘরবাড়ি, আমগাছ, জামগাছ, পেয়ারা গাছ, তালগাছ…

মহিলা বাক্য শেষ করে না, আবার ফোঁপায়, আবার ফুঁপিয়ে কাঁদে। তালগাছে কথা থেমে গেলে আমার মনে হয়           মালতী-মল্লিকাদের বাড়ির গা-ঘেঁষেই একটা বড় তালগাছ আছে, সেখানে বাবুই পাখির বাসারাও বাতাসে দোল খায়। আমি কি তবে মল্লিকা-মালতীর মায়ের আশ্রয়ে শুয়ে আছি? মালতীর মায়ের কণ্ঠস্বর আমি কখনো শুনিনি, শুধু তাকে দেখেছি, শান্তিবুকে বলতে শুনেছি, দিদি, ও আমার ছোট ভাই। পাবনায় থাকে। দেখলাম, মালতীর মা শুধু একটা স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে আমাকে স্নেহ দিলো। এরপরে যে কয়দিন খালইভরা ছিলাম একদিনও মল্লিকা-মালতীর মাকে দেখিনি, কথাও শুনিনি।

শুধু শুনি মহিলা অস্পষ্ট কথাদের গেঁথে গেঁথে কেঁদে যায়, তার মধ্যে একবারই শুনি একটা পুরুষ কণ্ঠ চাপাগলায় একটা ধমক দেয়, দেশ ছেড়ে যখন একেবারে চলে যাচ্ছো, তখন আর কাঁদছো কেন?

তখনই মালতীর গলা শুনি, মা, বাবা তো ঠিকই বলছে।

ভগবান! হায় ভগবান, ওই হাতির শুঁড় আমাদের গরুর গাড়িটাকেও তুলে নিয়ে গেল না কেন? নিলে দেশের মাটিতেই তো পড়তাম, মরে যেতাম।

বুঝতে পারি, মালতীর বাবার গলা ধরে আসছে। শুনি মালতীর মা-ও ধরা গলায় বললো,

আচ্ছা, ওরা কি আমাদের জবা গাছটি রাখবে?

কী করে বলবো?

তুলসীতলাটা রাখবে না?

জানিনে, জানিনে!

আর আমাদের ঠাকুরঘরটা?

আর ঠাকুরঘর!

বুঝি মালতীর বাবার দীর্ঘশ্বাসে গাড়িটা ভরে গেল।

আমার আর কোনো সন্দেহই থাকে না এই গাড়িতেই         মালতী-মল্লিকারা চৌদ্দো পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে একেবারে দেশ ছাড়ছে।

কিন্তু কী আশ্চর্য, কাল বিকেল পর্যন্তও ওদের সঙ্গে হেসেখেলে দিন কাটালাম, ওরা আমাকেও দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা বললো না?

বাসের ঘটর-ঘটর শব্দে আর কোনো কথা শুনিনে। মাঝে একবার শুধু মনে হয় কেবল মালতী-মল্লিকার জন্যেই আমি আবার এই গ্রামে আসতে চেয়েছিলাম।

সহসা বাইরে থেকে বৃষ্টির প্রচন্ড একটা ঝাপটা এসে বাসের জানালায় ধাক্কা দিলে মনে হয়, ঝড় উঠলো নাকি? ঠিক সে-সময় মালতীর মা ডুকরে কেঁদে ওঠে, এই ঝড়-বৃষ্টিতে রাখাল কি     গরু-বাছুরগুলিকে গোয়ালে তুলেছে?