মোবাশ্বির আলম মজুমদার
অচেনা নক্ষত্র পুজো দিয়ে যায় আমাদের তলস্নাটে
রাত্রি-দিন
রৌদ্রজ্বলা পাথরের একটানা গল্প
ফেরি করে মধ্যদুপুর
– হোসাইন কবির
এই শহরের মানুষগুলো করপোরেট সংস্কৃতিতে আক্রামত্ম। বেশভূষায়, চলনে-বলনে, দিনযাপনের নানা ব্যসত্মতায় নিজেকে পুঁজিবাজারের উপকরণ হিসেবে দেখাতে ব্যসত্ম। এই বঙ্গের মানুষ কি তাই? নিজেকে সভ্য করে তোলার চেষ্টা করতে-করতে এক সময় নিজেই হয়ে ওঠে অন্যের লাভের পণ্য। সভ্যতা এভাবে এগোয় না। সভ্যতা একটি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষই এ সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক।
শেখ আফজাল মানুষের দেহে লেপ্টে থাকা কাদামাটির গন্ধ িআঁকেন। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে শেখ আফজালের শিশু মানুষগুলো দুরমত্ম হয়। নিজে-নিজে ভাবে, নিজের সঙ্গে কথা বলে। তাঁর ক্যানভাসের প্রতিটি মানুষ আলাদা। কখনো শিশু লাটিম নিয়ে ব্যসত্ম সময় কাটাচ্ছে। কখনো মায়ের সঙ্গে অবুঝ আহ্লাদে ব্যসত্ম শিশু। অন্যদিকে আবহমান বাংলার নদী আর নারীর সৌন্দর্য শেখ আফজালের কাজে সব সময়ই প্রিয় হয়ে আছে। গুরু জয়নুলের চষা জমিতে মই-দেওয়ার ছবির কথাও মনে করিয়ে দেন তাঁর নিজের িআঁকা মই-দেওয়া ছবি িআঁকার মাধ্যমে। শেখ আফজাল শিল্পের তৃষ্ণা মেটান বাংলার সবুজ মাঠ, টলটলে নদীর জলের নীলের কাছ থেকে। আফজাল শিল্পের বিষয় খোঁজেন বাংলার মাঠ-ঘাটে ছড়িয়ে থাকা মানুষের কাছ থেকে। আফজালের মানুষগুলো নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে। ছাগশিশু-কোলে দুই শিশু, ঘুড়ি ওড়াতে ব্যসত্ম চার শিশু, পানিতে নামানো গরুর গা ধুয়ে দিচ্ছে বাবার সঙ্গে শিশু, কৃষকের দুপুরের খাবার খাওয়ার মুহূর্তকে মনে করানো দেখে বোঝা যায় শেকড়ের কথা আফজাল বুকে করেই রাখেন।
বিশ্বায়নের এ-সময়ে শিল্পকলার বিষয়ে বিমূর্ত ভাষা নির্মাণের চেষ্টায় মগ্ন শিল্পীদের মাঝে মানবদেহের নির্দিষ্ট ভঙ্গির উলেস্নখ না থাকলেও মানুষী দেহে গতির চিহ্ন দেখা যায়। শেখ আফজালের শিল্পকর্ম মূর্ত। বাসত্মবরীতির নির্মাণশৈলী তাঁর কাজে স্পষ্ট। বাসত্মবরীতির অঙ্কনশৈলীর ভেতরে বিষয়ের সঙ্গে একরকম বুনট নির্মাণ করেন। কোথাও-কোথাও বুনট নির্মাণের পর আবার তা রঙের প্রলেপে মুছে দেন। রঙের প্রলেপে ফিগারের ভেতরের বুনট মুছে দিলেও ফিগারের বাইরের বুনট তিনি রেখে দেন। চিত্রতলে মসৃণ ও অমসৃণ তলের সঙ্গে বৈপরীত্য গড়ে তোলার জন্যই তিনি এ-প্রক্রিয়া বেছে নেন। চিত্রতলে বুনট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন এভাবে – ‘দেখো, ছবির যে ক্যানভাস, তাতে সুতার বুননে রিপিটেশন তৈরি হয়। আর পৃথিবীতে কোনো কিছুই এক রকম না, একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের মতো না। এই রিপিটেশন বা পৌনঃপুনিকতাকে মুছে দিতে এই টেক্সচারের ব্যবহার। তাছাড়া ছবির বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখেই আমি টেক্সচার বা বুনট তৈরি করি। আবার কখনো ছবির ফিগারে টেক্সচার উঠে এলেও তা মসৃণ করে দিয়ে ফিগারের গায়ের মসৃণতা তৈরি করি।’
শেখ আফজাল ঢাকা ও টোকিও দুদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানে চিত্রকলায় পাঠ নিয়েছেন। জাপানের শিল্পশিক্ষায় চিত্রতলে বুনট নির্মাণের নিরীক্ষা গুরুত্ব পেয়েছে। খ্যাতিমান শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়াও জাপান থেকে শিল্পশিক্ষা নিয়েছেন। কিবরিয়ার চিত্রকলায় বিষয় হয়ে উঠেছিল শুধু টেক্সচার আর রং। শেখ আফজাল শিল্পকর্মে বাসত্মবধর্মী মানুষ নির্মাণের সঙ্গে রেখা ও বুনটের সমাবেশ দেখিয়েছেন। শেখ আফজাল বুনট ও রেখার নিরীক্ষায় সফল। তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে বুনটের প্রাধান্য কাজকে আলাদা বৈশিষ্ট্যম–ত করে তোলে। রঙের আড়ালে আরেকটি রঙের প্রলেপ কাজকে ভারি করে প্রকাশ করে।
আশির দশকের শেষভাগে ও নববইয়ের দশকের শুরুতে শেখ আফজাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঠিক একই সময়ে তিনি জাপানে শিল্পকলা শিক্ষার জন্যে গমন করেন। দুদেশে অবস্থানকালে তাঁর কাজের ধরন পালটে যেতে থাকে। চিত্রতলে মসৃণ জমিনে বুনট রেখা প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। কাজের ভিসা অপরিবর্তিত রেখে ছবির করণকৌশলে পরিবর্তন আসতে দেখা যায়। শেখ আফজালের ছবিতে সে-সময় থেকে মানুষের মুখের বিস্তারিত রেখা-রঙের উপলব্ধি চোখে পড়ে। প্রতিকৃতি অঙ্কনে দক্ষতা পাওয়া যায় তখন থেকেই। তিনি সে-সময় থেকে হয়ে উঠতে থাকেন প্রথম সারির প্রতিকৃতি-শিল্পী। অনেক বিখ্যাত মানুষের মুখ িআঁকার অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। িআঁকা প্রতিকৃতি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় জাতীয় জাদুঘরে। এ ছাড়া সারাদেশে অসংখ্য প্রতিকৃতি ছড়িয়ে আছে। উলেস্নখযোগ্য প্রতিকৃতির মধ্যে রয়েছে – রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর িআঁকা মানুষের মুখে দেখা যায় সে-মানুষের অমর্ত্মগত ভাষা। শেখ আফজাল প্রতিকৃতিতে সে-মানুষের অমত্মর্গত চিন্তাকে স্পষ্ট করে তোলেন।
এ-প্রদর্শনীতে অ্যাক্রিলিক, মিশ্রমাধ্যম ও রেখাচিত্রসহ মোট ৪৫টি শিল্পকর্ম রয়েছে। প্রদর্শনীর কাজগুলোর মধ্যে বেশকিছু নিসর্গচিত্র আছে যাতে কোনো মানবদেহের উপস্থিতি নেই। যেমন – ‘সুন্দরবন-২’ ও ‘লাইফ অব সুন্দরবন’। এতে লতাগুল্ম এতটাই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যে, ক্যানভাসে এসে একটি ছন্দময় আকৃতি গড়ে উঠেছে। ‘সুন্দরবন-১’ ছবিটিতে ঘন ঝোপঝাড়ের মাঝখান ধরে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে ছোট নদী। গাঢ় সবুজের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসছে শুকনো ডালপালা। তেমনিভাবে ‘ফরেস্ট’ ছবিতে ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা পথের মাঝে আলো ঠিকরে পড়ছে। ‘মর্নিং অব সুন্দরবন’ ছবিতে উজ্জ্বল সকালের আহবান দেখা যায়। শেখ আফজালের নিসর্গের ছবিগুলোতে দেখা যায় গাঢ় সবুজের উপস্থিতি। রেখা হিসেবে টেনে দেন লতাগুল্পের ডালপালার অবয়ব।
এ প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় ছবিটির শিরোনাম ‘জলকে চল’। এ-ছবির দৈর্ঘ্য ৩৬৬ X ১৮৩ সে.মি.। এটি মিশ্রমাধ্যমে িআঁকা। পুরো ছবির বিষয় হলো, আবহমান বাংলার নদীবিধৌত অঞ্চলের একদল নারীর কলসি কাঁখে জল সংগ্রহের মুহূর্ত। এখানে একটু ভিন্ন আঙ্গিক স্পষ্ট। জল তোলা নারীরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটি সত্মরে তিনি নারীর এ-ভঙ্গি গড়ে তুলেছেন। একটি হলো, অনেক স্পষ্ট করে নারীর অবয়বকে দৃশ্যমান করা; দ্বিতীয়ত, কিছুটা হালকা করে নদীর ফিগার রচনা করা এবং একেবারে শেষে বুনটের গা থেকে শুধু রেখার সাহায্যে ফিগারের আবহ তৈরি করা। সুপার ইম্পোজ বা কোনো চরিত্রকে মূল উপজীব্য হিসেবে তৈরি করার মাঝেই শেখ আফজাল ছবিতে সত্য নির্মাণ করেন। আবহমান বাংলার এই জল তুলে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পূর্বে নারী ও নদীর সঙ্গে তৈরি হওয়া সম্পর্কের মধ্যে এক কমনীয়তা দেখা যায়। নদীর মাঝে যেমন কোমলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নারী দেহেও তেমনি এক লাবণ্য প্রকাশ পায়। শেখ আফজাল প্রকৃতির এ-রহস্যের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করেন। প্রকৃতির এই সত্যকে চাক্ষুষ করে তোলার মধ্যে তিনি আনন্দ পান।
অতিচেনা কিছু মুহূর্ত যেমন একদল বালক ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ঘুড়িতে মগ্ন হয়ে থাকা আরেক বালককে আবছা দেখা যাচ্ছে এমন ছবিটির নাম ‘কাইট’। আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ির আকৃতিতে দেখা যায় পরিবর্তন। এ-ছবিটি আমাদের অতিচেনা মুহূর্তের রূপায়ণ। শেখ আফজাল চিত্রতলে বিষয়কে হাজির করে তার পেছনে আবার সে-বিষয়ের ছায়া তৈরি করেন। ছবির বিষয়ের ভেতরে আরেকটি ছবি তিনি গড়ে তোলেন ইচ্ছাকৃতভাবেই। এক্ষেত্রে উলেস্নখ করতে হয় ‘আয়না’ ছবিটির কথা। দেয়ালে হেলান দেওয়া কিশোরী, তার বাইরে বুনট-আবৃত নীলচে সবুজের মাঝে ফিগার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার পাশ থেকে ভেসে উঠেছে মেয়েটির ছায়ামুখ। আনমনা মেয়েটির মনের ভেতরে থাকা কুয়াশা ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়ভাবে। এভাবে শেখ আফজাল ছবির বিষয়ে বৈচিত্র্য আনেন। বাসত্মবরীতিতে গড়ে তোলেন চেনা মুহূর্ত। শেখ আফজাল আমাদের চিত্রকলার ইতিহাসে বাসত্মবানুগ নির্মাণরীতি অনুসরণ করেন। একই সঙ্গে বলা যায়, বাসত্মবধর্মী চিত্র নির্মাণের সঙ্গে নিরীক্ষা ও বিমূর্ততার বন্ধন তৈরির সাক্ষ্য দেয়। ‘ইটার্নাল অ্যাফেকশন’ শিরোনামের এ-প্রদর্শনীটি গত ১৬ এপ্রিল শুরু হয়ে শেষ হয় ৭ মে। প্রদর্শনীটি আয়োজন করে অ্যাথেনা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.