শেষ নমস্কার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রাজু আলীম
ভালোবাসা, প্রেমের যেমন কোনো জাত হয় না, লেখকেরও কোনো জাত নেই। নেই কোনো দেশ। একজন লেখক, শিল্পী, সৃজনশীল মানুষ বিশ্বব্যাপী বিরাজমান। সে-কারণেই শেক্সপিয়র আমাদের, অ্যারিস্টটল, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, প্লেটো, ও’ হেনরি, জ্যঁ পল সার্ত্রে, মার্কেস, হেমিংওয়ে কিংবা ভ্যান গঘ, পিকাসো – এঁরা সবাই আমাদের। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শরৎচন্দ্র কিংবা শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, কাইয়ুম চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু ও শাহাবুদ্দিন যেমন আমাদের বাঙালি লেখক-শিল্পী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন তেমনি আমাদের লেখক, বাঙালি লেখক। বাংলাদেশে জন্ম হওয়ার কারণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে আমি সবসময় গর্ববোধ করি। আমি অবশ্য অন্য একটি কারণে সুনীলের জন্য একটু দুর্বলতা অনুভব করেছি এজন্যে যে, তিনি আমাদের এলাকায় জন্ম নেওয়া মানবসন্তান। বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারীপুরে আড়িয়াল খাঁ নদী-তীরবর্তী গ্রামে তিনি জন্মেছেন, আর আমি জন্মেছি বৃহত্তর ফরিদপুরের শরীয়তপুরের কীর্তিনাশা নদী-তীরবর্তী তুলাসারের দক্ষিণ গোয়ালদী গ্রামে। আমার কিশোরবেলায় আমাদের জেলা ছিল ফরিদপুর, মহকুমা ছিল মাদারীপুর। তিনি যেমন আড়িয়াল খাঁ নদীতে সাঁতার কেটেছেন, জেলেদের ইলিশ মাছধরা দেখেছেন, আমিও তেমন দেখেছি। আমি অবশ্য সুনীলদা কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মস্থান যে মাদারীপুর, এটা অনেক পরে জেনেছি। তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি আগে।
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে হাঁটার প্রাথমিক মুহূর্তেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা পড়েছি আমরা। বিশেষ করে আমার কবিতাচর্চার শুরুতেই সুনীলের ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। নীরা কিন্তু আর সম্ভবত সুনীলদার একার ছিল না। কবিতার চরিত্রের এই রমণী আমাদের তরুণ কবিসমাজের সবারই শ্রদ্ধার পাত্রী হিসেবে গণ্য হতেন। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য, জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কিংবা সুরঞ্জনার মতো সুনীলদার নীরাও আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। নীরা পড়তে গিয়ে সুনীলদার সব কবিতার বই-ই পড়ার চেষ্টা করেছি। তারপর তাঁর লেখা উপন্যাস, গল্প তো আছেই। আমরা এ-প্রজন্মে যাঁরা কবিতা লিখি, তাঁদের অনেকের কাঁধেই হয়তো সুনীলদা চড়ে বেড়ান। তিনি বলতেন, ঢাকা হবে বাংলাসাহিত্যের রাজধানী। তিনি অত্যন্ত একজন দূরদর্শী কবি, প্রজন্ম থেকে এগিয়ে থাকা একজন মানবসন্তান। কেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকাকে সাহিত্যের রাজধানী বলতেন, সেটা এখন খুব বেশিই উপলব্ধি করছি। সুযোগ পেলেই তিনি বাংলাদেশে চলে আসতেন অগণিত পাঠকের কাছে। তাঁর কবিতা কিংবা উপন্যাস-গল্পের কত যে ভক্ত-শুভানুধ্যায়ী আছেন, তিনি নিজেও হয়তো তা জানতেন না। এদেশের লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, সৃজনশীল মানুষ তাঁকে অভিবাদন জানাতেন বাংলাদেশের মাটিতে। তাঁকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের কলমবন্ধু। তিনি বাংলাদেশকে অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে সবসময়ই পাশে থেকেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা সেই সময়ের কথা আমরা কে না জানি।
বাংলাদেশে তাঁর বিখ্যাত বন্ধু বা ভক্ত কিংবা শুভানুধ্যায়ী অনেকেই রয়েছেন। কবি শামসুর রাহমান, গাজী শাহাবুদ্দীন, কাইয়ুম চৌধুরী, বেলাল চৌধুরী, মতিউর রহমান, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, হুমায়ূন আহমেদসহ অনেকেই তাঁর শুভাকাক্সক্ষীর তালিকায় ছিলেন। তিনি ঢাকা এলে আমরা তরুণ কবি-লেখকরা দেখা করতে যেতাম। তাঁর সহজাত লেখকসুলভ ভালোবাসায় মুগ্ধ হতাম। সত্যিকার অর্থে আমি নিজে একজন কবিতাকর্মী হিসেবে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করতাম তাঁর একটু স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে। আমি একবার বাংলাদেশের মূলধারা বাংলা কবিতা উৎসবের প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলাম। আর সচেতন পাঠকর অবশ্যই জানেন, মূলধারার সভাপতি কবি সৈয়দ আল ফারুকের আয়োজনে সেই কবিতা উৎসব কতটা উৎসবমুখর হয়েছিল। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উড়ে এসেছিলেন এ-উৎসবে বিশেষ অতিথি হিসেবে। তাঁর সঙ্গে আরো এসেছিলেন তাঁর সহধর্মিণী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। আরো এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আবৃত্তি-ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র মিত্র, বিনোদন বিচিত্রার সম্পাদক মালবিকা মিত্র, কবি সুবোধ সরকার, মল্লিকা সেনগুপ্ত এবং জয় গোস্বামী। সে-সময়ে আমি কলকাতার বিনোদন বিচিত্রার ঢাকা সংবাদদাতা ছিলাম। সে-উৎসবের স্মৃতির কথা চিরজীবনে ভোলার নয়। মালবিকা মিত্র আমাকে খুব আদর করে ঢাকার দেবর বলে ডাকতেন। এই ভালোবাসা কি আর ভোলা যায়? কবি জয় গোস্বামীকেও আমি একটু সমীহের চোখে দেখি। তিনি তখন দেশ পত্রিকার কবিতার পাতা দেখতেন। উৎসবের বেশ কয়েক বছর আগে আমি অবশ্য কলকাতায় দেশ পত্রিকায় সুনীলদা ও জয় গোস্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেখানেই তাঁদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল আমার। সে-সময়েই অপর্ণা সেন-সম্পাদিত সানন্দার সাহিত্যপাতা দেখতেন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। তিনি সানন্দার পাতায় আমার কবিতা ছেপেছিলেন। সুনীলদাকে দেখতে গিয়েই সবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার, পরিচয় হয়েছিল সাহিত্যের এক নতুন যোগসূত্রের সঙ্গে।
সুনীলদাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে হয়তো অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। কলকাতা ও ঢাকায় অনেকবার তাঁর সঙ্গে ঘুরেছি। অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক। কলকাতায় একবার কবি অরুণ সেনের ফ্ল্যাটে সুনীলদাদের ‘বুধ সন্ধ্যা’ নামে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন সুনীলদা। আরো ছিলেন ধ্র“বজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, সুবোধ সরকার, মল্লিকা সেনগুপ্ত, জয় গোস্বামী, আবুল বাশার, আফসার আমেদ, তারাপদ রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়দেব বসু, সেবন্তী ঘোষ, বীথি চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণা বসু, অনুরাধা মহাপাত্র, মন্দাক্রান্তা সেন, বাংলাদেশের বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, অসীম সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, সৈয়দ আল ফারুক, শিল্পী নাহিদ নাজিয়া, তারিক সুজাতসহ অনেকেই। সে-সন্ধ্যায় আমিই মনে হয় সবচেয়ে তরুণ সদস্য ছিলাম। আমার খুব মনে আছে, তরুণ কবি হিসেবে সে-আড্ডায় সুনীলদা কবিতা পাঠ করে শোনাতে বলেছিলেন। বই ছাড়া মুখস্থ কয়েকটি কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলাম আড্ডায় আগতদের। মজার এ-আড্ডা থেকে অনেক কিছু শিখেছি আমি। এরপর আমরা সবাই মিলে কলকাতার স্যাটারডে ক্লাবে ডিনারে গিয়ে কলকাতার আরো অনেক লেখকের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলাম। সুনীলদা আমাকে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা কৃত্তিবাসে লেখা পাঠাতেও বলেছিলেন। সুনীলদাকে ঘিরে সেরকম আড্ডা কি আর কখনো হবে! তিনি বাংলাদেশে এলেও এরকম অনেক আড্ডায় অংশ নিয়েছি সুনীলদার সঙ্গে। কখনো  ঢাকা ক্লাবে, গুলশান ক্লাবে, গাজী ভবনে কিংবা কোনো লেখক-সাহিত্যিকের বাসায়। সুনীলদা কি কলকাতার লেখক, পশ্চিমবঙ্গের লেখক? তিনি বাঙালি লেখক, বাংলাদেশের লেখক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে কবে, কখন আমাদের কাছে সুনীলদা হয়ে গেলেন, কেউ টেরই পাইনি। তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস, কবিতার সব বই যে আমি পড়েছি, তা বলব না, তবে যেগুলোই পড়েছি, সেগুলো আমার মনে দাগ কেটে আছে। হঠাৎ নীরার জন্য, নীরা, হারিয়ে যেও না, সুন্দরের মন খারাপ মাধুর্যের জ্বর, একা এবং কয়েকজন, কবিতাসমগ্রসহ আত্মপ্রকাশ, সেই সময়, পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম আলো, অরণ্যের দিন-রাত্রি, কবি ও নর্তকী, ভালোবাসা প্রেম নয়, রাধা-কৃষ্ণ, রক্তমাংস, সোনালী দুঃখ, প্রথম নারী, কিশোর ও সন্ন্যাসিনী, ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ, ছবির দেশে কবিতার দেশে আমার প্রিয় বই।
তাঁর পায়ের তলায় ছিল সরষে, সেই যে তিনি কিশোরবেলায় মাদারীপুর থেকে কলকাতায় গিয়েছেন, সে-থেকে তিনি হেঁটে চলেছেন, দৌড়ে চলেছেন, উড়ে চলেছেন, দেশে-বিদেশে – একখণ্ড বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাসাহিত্য নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের পরে সাহিত্যের সব শাখায় যে-লেখক সবচেয়ে বেশি লিখেছেন, কিংবা সত্যিকার অর্থে একজন লেখকের জীবনযাপন করেছেন, তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আমার প্রিয় সুনীলদা। সুনীলদা, আপনি চলে গিয়েছেন না-ফেরার দেশে। চোখের সামনে আপনাকে আমরা আর দেখব না। দেখব আপনার কাজ, পড়ব আপনার গল্প-উপন্যাস, কবিতাসহ অনেক কিছু। সুনীলদা আপনার জন্মস্থান বৃহত্তর ফরিদপুরে আমার জন্ম। আপনার নামে মাদারীপুরে প্রতি বছর ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করা হয়ে থাকে। কিছুদিন আগে সেই সুনীল সাহিত্য পুরস্কারটি এই সামান্য মানুষ আমাকে আপনার এলাকার সাহিত্যের সন্তান হিসেবে প্রদান করা হয়েছিল। আপনি নেই; কিন্তু আপনার নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই অসামান্য অবদানটি আমি সারাজীবন বয়ে বেড়াব। সুনীলদা আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। শেষ নমস্কার সুনীলদা, জয়তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।