শেষ পারানির কড়ি

রিজিয়া রহমান

চারদিকে জলের গর্জন, ভেজা বাতাসের ঝাপটা, আকাশ ধোঁয়াটে মেঘলা – হয়তো বৃষ্টি নামবে। আমি এসব কিছুই দেখছি না, অনুভবও করছি না। আমি কি এখানে নেই? কোথায় তাহলে আমি?
সেই তো বিশাল নদী পদ্মার অবিরাম গর্জন, পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমে উদ্দাম মাতামাতি, সেই হলুদ রঙের স্টিমারে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের একটানা ধকধক শব্দ, অবিরাম দুলুনি – সবই তো রয়েছে একই রকম, বদলে যায় নি কিছুই। বদলে গেছি কি কেবল আমি? বদলে গেছে আমার দিন-রাত, আমার জীবন? এমনি কি হয়? দুর্বিপাকের ঝঞ্ঝায় মানুষের জীবন তো অন্যরকম হয়ই! কিন্তু বিপর্যয় না ঘটলেও বাঁক নিতে নিতে বারে বারেই জীবন বদলায়, বারবারই গড়তে হয় মানুষকে নতুন অভিবাসন, হয়ে যেতে হয় অন্যরকম নতুন কেউ।
এতসব কঠিন দার্শনিক তত্ত্ব চিন্তা করার মতো পরিপক্ব নয় বোধশক্তি, আমি তখন বসে আছি, চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা নারায়ণগঞ্জগামী স্টিমারের লেডিস ইন্টারক্লাসের যাত্রী আসনে। গন্তব্য আমার বাল্যস্মৃতির ধূসর নগরী ঢাকা। সেখানেই হবে আমার স্থায়ী ঠিকানা। সেই মুহূর্তে এসব নিয়ে আমি ভাবি না। তাকিয়ে থাকি ছায়াচ্ছন্ন আকাশ আর নদীতে। ঢেউয়ের অবিরাম ওঠা-পড়ায় খুঁজতে থাকি হারিয়ে ফেলা শৈশবের রৌদ্রস্নাত সবুজ ভুবনটিকে। পাশের সহযাত্রিণী বলে ওঠেন – ও মাইয়া, জানালাটা বন্ধ কর। দেখতাছ না ম্যাঘ পড়তাছে, ভিজা গ্যালা যে!
নিজেই জানালা বন্ধ করে দিলেন বর্ষীয়সী মহিলাটি, বসে পড়লেন আমার পাশেই, প্রশ্ন করলেন – কই থিকা আসতাছ? যাইবা কই? লগে কেউ নাই? একলাই যাইতাছ? এতগুলো প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছে করে না। তাকে বলি না, চাঁদপুর থেকে ঢাকায় যাচ্ছি; সঙ্গে আছেন আমার ছোট মামা। সেখানে আমার মা আর ভাইবোনেরা আছে। সেই ঢাকাতেই আমি থাকব এখন থেকে। থাকব আমাদের কাকরাইলের বাড়িতে। বায়ান্ন সনে কেনা যে বাড়িটিকে এক পড়ন্ত বিকেলে মা-বাবার সঙ্গে গিয়ে প্রথম দেখেছিলাম। মাঠের ধারের সেই বাড়িটিই আমার অপেক্ষায় রয়েছে এখন। মহিলার অনুসন্ধিৎসা শেষ হয় না, আবার জিজ্ঞেস করেন – চান্দপুরেই বুঝি দ্যাশ?
– না, ওখানে আমার মামা চাকরি করেন।
– তোমার মা-বাপ? তারা কই?
– মা ঢাকায়।
– ঢাকায় বুঝি দ্যাশ?
মুখ না ফিরিয়ে জবাব দেই – ঢাকায় দেশ নয়, দেশ নেই।
মহিলা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমাকে দেখেন। তারপর উঠে চলে যান নিজের আসনে। প্রশ্ন করেন না আর। হয়তো ভাবেন, মেয়েটি এমন অদ্ভুত কথা বলে কেন? এত বিষণ্ণই বা কেন? বিষণ্ণই ছিলাম হয়তো। মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার স্টিমারযাত্রা আমার বিষণ্ণতা দূর করতে পারে নি। এমন বিষণ্ণযাত্রা তো আরো একবার করতে হয়েছিল। গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারেই চলেছিলাম চাঁদপুরে, ছোট মামার সঙ্গেই। আমার ছোট দুটি ভাই – মিলু আর মানু ছিল সঙ্গে।
খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই ছোট মামা প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। হঠাৎই মাকে বললেন – ওকে আমার সঙ্গে চাঁদপুরে নিয়ে যাই। বড় বেশি কান্নাকাটি করছে। এখান থেকে সরিয়ে নিলে কিছুটা শান্ত হবে।
আজো বুঝি না, কেন নির্বাক ছিলাম সেদিন। কেন যন্ত্রচালিতের মতো স্যুটকেস গোছাতে বসেছিলাম। মা-ও বোধহয় বুদ্ধিহারাই ছিলেন, বলতে পারেন নি – ও এখন এখানে সবার সঙ্গেই থাকুক। একা কেমন করে সহ্য করবে এত বড় শোকের আঘাত! শুধু উদ্ভ্রান্তের মতো বলেছিলেন – নিয়ে যাও।
মিলু হঠাৎ ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করল, আমার সঙ্গে সে-ও যাবে চাঁদপুরে। আর মানু আমাকে দুহাতে জড়িয়ে তুমুল কান্না – আমাকে সে কিছুতে যেতে দেবে না। কতটুকুই বা তখন মানু – ফুটফুটে ফরসা, সবার ছোট আমার ভাইটি। ওর নাওয়া-খাওয়া, ঘুম পাড়ান – সবই আমার দায়িত্বে। সেই ছোট্টটি যখন, ‘ইন্ডি-পিন্ডি-সিন্ডি’ ছড়া গান গেয়ে ঘুম পাড়াতাম আমিই। মুখে মুখে ছড়া শিখিয়েছিলাম – ও পাড়ার ওই ময়রা বুড়ো/ রথ করেছে তের চূড়ো/ তোরা রথ দেখতে যা/ তোদের হলুদ মাখা গা।
একদিন বায়না ধরেছিল, গায়ে হলুদ মেখে সে যাবে তেরো চুড়োর রথ দেখতে। এই নিয়ে খুব হেসেছিলাম। ওকে ভুলাবার জন্যই বলেছিলাম – আমরা পয়সা কোথায় পাব?/ আমরা উলটো রথে যাব।
সেই ছোট্ট মানু, সবে যার অক্ষর-পরিচয় শুরু আমার কাছে, চাঁদপুরে হঠাৎ একদিন বলে বসল – আপা, আমরা উলটোরথেও যাব না। আমাদের পয়সা নেই, তাই না?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম – কে বলল তোকে আমাদের পয়সা নেই?
বিষণ্ণ মানু আস্তে বলে – আববা নেই তো! কে দেবে পয়সা?
মানুকে কোলের কাছে নিয়ে চোখের জল মুছে বলতে হয়েছিল – আববা নেই তাই কী! আমি তোকে পয়সা দেব। আর শোন, আমরা রথ দেখব না, চল, আমরা আকাশের তারা দেখব।
মানুকে কোলে নিয়ে জানালা দিয়ে আকাশের তারা দেখিয়ে বলেছিলাম – দেখেছিস, কত তারা আকাশে, আমাদের আববাও আকাশের তারা হয়ে আছে। ওখান থেকেই তোকে, আমাকে সবাইকে দেখছে। হৈমন্তী আকাশে তারার রাজ্যে মানু বাবাকে খুঁজে পেয়েছিল হয়তো। রোজ সন্ধ্যায় আকাশে তাকিয়ে তারা দেখত, বলত – ওখানেই আববা আছে। আববা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে?
বুদ্ধিমতী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আমার মা বোধহয় তখন অসহায় বিভ্রান্ত, কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন, ছোট মামাকে বলে দিলেন – মিলু আর মানুকেও সঙ্গে নিয়ে যাও!
তখন তো বুঝি নি, আমার একান্ত প্রিয় শহরটিতে আর আমি ফিরে আসব না। ফিরে আসবে না আর আমার শৈশবের আনন্দ, কৈশোরের উচ্ছলিত দিন।
– আরে ঘুমাইয়া যাইতাছ দেখি। শরীরটা কি খারাপ?
সহযাত্রী মহিলা আবার আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, নিজের টিফিন ক্যারিয়ারের খাবার খাওয়াবার জন্য সাধাসাধি করেন। হোল্ডঅল খুলে চাদর এনে বিছিয়ে দেন সিটে। বলেন – খাইলা না তো কিছু, তাইলে এট্টু ঘুমাইয়া লও।

দুই
বাবার শরীর ভালো যাচ্ছে না একেবারেই। তবু বুঝতে দিতে চান না আমাদের। দুবেলাই হাসপাতালে যান, রোগীদের চিকিৎসা করেন, সপ্তাহে দুদিন জটিল সব অপারেশান শেষ করে বেলা গড়িয়ে বাড়ি ফেরেন, খেয়েই শুয়ে পড়েন বিছানায়। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে যান সঙ্গে সঙ্গেই। মা বেশ চিন্তিত, প্রায়ই বাবাকে বলেন – এবার ছুটি নাও। ডা. শামসুদ্দিন তখন অত করে বললেন তোমাকে, কিছুদিন ছুটি নিয়ে বিশ্রাম করতে।
খ্যাতনামা কার্ডিওলজিস্ট ডা. শামসুদ্দিন তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক। আমার বাবার সঙ্গে পরিচয় আছে। ছোট আপার বিয়েতে ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা যখন ঢাকায়, সে সময় বাবা তার কাছে গিয়েছিলেন। তিনি বারবারই বলেছিলেন – কিছুদিন রেস্ট নাও, হার্টটাকে বাঁচাও। সেসব দিনে হার্টের রোগ নির্ধারণে এনজিওগ্রাম বা উন্নত ধরনের টেস্ট করবার সুবিধা ছিল না। তবু অভিজ্ঞ চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দিন বেশ উদ্বিগ্নই হয়েছিলেন বাবাকে নিয়ে। বাবাও চিকিৎসক হিসেবে যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিলেন। বুঝেছিলেন, দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস তার হার্টটিকে অকর্মণ্য করে ফেলেছে। তবু কেন যে তিনি নিজের প্রতি উদাসীন ছিলেন, তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। মাঝেমধ্যেই বাবা বলতেন – চাকরিটা ছেড়েই দেব, একটা এক্স-রে মেশিন কিনে ঢাকায় গিয়ে প্র্যাকটিস করব।
বলা পর্যন্তই। বলাটাকে বাস্তব করে তুলতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতেন না।
আসলে বাবা তার পেশাকে, তার রোগীদের ভালোবাসতেন; নিমগ্ন থাকতেন রোগী নিয়েই। ডাক্তারি পাশ করেই বাবা (আইএমএস) ব্রিটিশ সরকারের অধীন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে নিয়োগ পান। অবিভক্ত ভারতে তিনি অনেক নামকরা হাসপাতালে কাজ করেছেন, অনেকগুলো বছর ধরে রোগীর ভিড়েই কেটেছে জীবন। ডাক্তার হিসেবে নাম-যশও পেয়েছেন। রেডিওলজিতে বিশেষজ্ঞ হয়েও শুধু এক্স-রে মেশিন আর এক্স-রে প্লেট নিয়েই আবদ্ধ থাকেন নি। ‘ইস্ট পাকিস্তান মেডিক্যাল সার্ভিসে’ সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হওয়ার কারণে তাকে মেডিসিন, সার্জারি সব বিভাগেরই দায়িত্ব পালন করতে হতো। সে সময়ে সবাই বলত – ডা. সিদ্দিকের মেডিসিন এবং সার্জারি দুটিতেই সমান দক্ষতা। আমরাও সেটা জানতাম। অনেক জটিল অপারেশানে তিনি পারদর্শিতা দেখিয়ে রোগীকে সুস্থ করে তুলতেন। একটি ঘটনা বেশ মনে আছে। সেদিন হাসপাতাল থেকে অনেক দেরিতে ফিরেছেন বাবা, খেতে বসেছেন অবেলায়। তখন এক মহিলা উদ্ভ্রান্তের মতো এসে দাঁড়ালেন আমাদের উঠোনে, পাগলের মতো চিৎকার করে বলতে লাগলেন – কোথায় ডা. সিদ্দিক, বেরিয়ে আসেন। আমার মেয়ে মরে যাচ্ছে, বাঁচান আমার মেয়েটাকে।
আমরা সবাই বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। জানা গেল, মহিলা ফরিদপুরে সদ্য বদলি হয়ে আসা এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়রের স্ত্রী। তার মেয়েটি বিদেশি ক্যান্ডি খেতে খেতে, ক্যান্ডির সরু লম্বা কনটেইনারটাও চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। পাতলা অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি সেই কনটেইনার আটকে গেছে গলায়। তাকে নিয়ে আসা হয়েছে হাসপাতালে। ভাতের প্লেট ফেলেই উঠে দাঁড়ালেন বাবা। দ্রুত হাতে কাপড় পালটে চলে গেলেন হাসপাতালে।
ইঞ্জিনিয়র সাহেবের মেয়েকে অপারেশান করে বিপদমুক্ত করতে অনেক সময় লেগেছিল। সে সময়ে আজকের দিনের মতো আলট্রাসনো, স্ক্যানিং ইত্যাদির সুবিধা ছিল না। অস্ত্রোপচারের আধুনিকতম সরঞ্জামও তেমন ছিল না। গলায় অপারেশান ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সার্জেনের দক্ষতা ও সতর্কতাই ছিল বড় সহায়ক। মেয়েটি সম্পূর্ণ নিরাময় হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়র সাহেব ও তার স্ত্রী আমার বাবাকে তাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে বহুদিন পর্যন্ত ভোলেন নি।
অনেক বছর পরে (বাবা তখন আর বেঁচে নেই) এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়র সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো আমাদের। উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার বাবার কথা বললেন, মেয়েকে বিয়েবাড়ির ভিড় থেকে খুঁজে আনলেন। সে তখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তার গলার দাগটি আমার মাকে দেখিয়ে বললেন – এই দেখুন, আপনার স্বামীর সৎকাজের চিহ্ন। আমার মেয়ে যতদিন বাঁচবে, এই দাগের সঙ্গে ডা. সিদ্দিককে মনে রাখবে। বাবার আরো অনেক কৃতিত্বপূর্ণ চিকিৎসার কথা আমি ভুলি নি। তখন আমি কোন ক্লাসের ছাত্রী, ঠিক মনে নেই। একদিন দুপুরে সারা হাসপাতালে, আমাদের বাড়িতেও হইচই পড়ে গেল – বাঘের আক্রমণে জখম হওয়া এক রোগী এসেছে হাসপাতালে। ঘটনাটা নিঃসন্দেহে ছিল উত্তেজনার এবং উদ্বেগেরও।
এ ঘটনা প্রসঙ্গে আরো একটি ঘটনাও উল্লেখ করবার মতো। আমরা ফরিদপুরে আসবার কিছুদিন পরেই, এক শীতকালে শহরে খবর রটে গেল – ‘বাঘ এসেছে’।
কলকাতা ছেড়ে ফরিদপুরে এসে জেনেছিলাম, সেটি সাপের আড্ডা। সাপেদের নির্বিঘ্ন বিচরণভূমি হলেও সেখানে সাপের সঙ্গে বসবাস সয়েই গিয়েছিল। কিন্তু বাঘ এসে হানা দেওয়ার দুঃসংবাদটি ছিল কল্পনারও অতীত। শহরের সব বাড়িতে বিজলিবাতির আলো তখনো না থাকলেও বড় রাস্তায় বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে, বাঘের আস্তানা গাড়বার মতো ঘন ঝোপ-জঙ্গলও তেমন নেই। শহরজুড়ে মানুষের বসবাস, চলাচল। তবু সেই ‘বাঘ এসেছে’ সতর্ক-সংকেতের রবটি শহরের সবাইকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল, নানা রকম গুজবও তৈরি হচ্ছিল। বাঘের ডাকও নাকি শুনছিল কেউ কেউ।
কোনো একসময়ে সুন্দরবন অঞ্চলসংলগ্ন এলাকাগুলোতে এমন সংকেত ছিল প্রজন্মান্তরের পরিচিত। সে সময়ে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের হানা দেওয়াটা ছিল খুবই অভ্যস্ত ব্যাপার। বিশেষ করে, বাঘিনীরা বাচ্চা প্রসবের সময় সুন্দরবন ছেড়ে চলে আসত, আস্তানা গাড়ত গ্রামের ঝোপ-জঙ্গলে। সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাগুলোকে নির্দয় পুরুষ বাঘেদের খেয়ে ফেলার ভয়েই মা-বাঘ সরে আসত নিরাপদ দূরত্বে, মানুষেরা কিন্তু তাতে মোটেই নিরাপদ বোধ করত না। তারা জানত, মানুষ ধরে খাওয়াটা সুন্দরবনের বাঘেদের পুরোন অভ্যাস। মানুষখেকো বাঘেরা অনেক সময় নর-মাংসের লোভেও লোকালয়ে এসে হানা দিত।
কিন্তু আটচল্লিশ-ঊনপঞ্চাশ সনে একটি বসতিপূর্ণ শহরে বাঘের হানা দেওয়াটা তেমন বিশ্বাস্য ব্যাপার ছিল না, তবু শহরে কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। ভয় পেয়েছিলাম আমিও। বাঘের গুজব ছড়িয়ে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে ফেউ ডাকার শব্দও নাকি অনেকে শুনতে পাচ্ছিল। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে ভয় পাওয়ার মতোই।
বাঘ-আতঙ্ক নিয়ে আমাদের বাড়ির কেউ চিন্তিত না হলেও আমি কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারি নি। সন্ধ্যা না লাগতেই বাড়ির সব দরজা-জানালা বন্ধ করবার ব্যাপারে অতিমাত্রায় কর্তব্যপরায়ণ হয়ে উঠেছিলাম। আমার বিছানার পাশের জানালা তো খুলতেই দিতাম না। ভয় হতো, জানালার শিক ভেঙেই না ঘরে ঢুকে পড়ে বাঘ! পশ্চিমবঙ্গে আমার বাবার দেশ সুন্দরবন থেকে খুব দূরে নয়। ছোট্ট বয়স থেকেই মানুষখেকো বা ম্যান-ইটার বাঘের আচার-আচরণের গল্প অনেক শুনেছি। জানালার লোহার শিক ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়বার ঘটনা না শুনলেও লোকালয়ে এসে তাদের অনেক দুঃসাহসী আক্রমণের গল্প শুনেছি।
মা একদিন রাগ করে বললেন, – মেয়েটার হয়েছে কী! সন্ধ্যা না হতেই সারা বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়! মাকে বলি – জানালা দিয়ে যদি বাঘ ঢুকে পড়ে ঘরে।
মা হেসেই বাঁচেন না, বলেন – বাঘেদের তো আর প্রাণের মায়া নেই যে বাড়ির জানালা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়বে! যত্তো সব আজগুবি কথা। মায়ের কথায় নির্ভরতা পাই না, বলি – জানালা ভেঙে বুঝি বাঘ ঘরে ঢুকতে পারে না! ছোট ফুফু যে বলেন, তাদের দেশে নাকি বাঘেরা নৌকা থেকে মানুষ ধরে খেয়ে ফেলে, ঘরের দাওয়া থেকে ঘুমন্ত মানুষ ধরে নিয়ে যায়…।
মা আবার হাসেন – তোমার ছোট ফুফুর দেশ তো বাঘেরই দেশ।
আমার ছোট ফুফুর শ্বশুরবাড়ি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-চবিবশ পরগনার একেবারে দক্ষিণে, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষেই। ছোট ফুফুর কাছেই শুনেছি, গ্রামে বাঘ এলে শেয়ালেরা ফেউ ফেউ করে ডাকে, মানুষ বুঝে যায় গ্রামে বাঘ ঢুকেছে।
মাকে আবার বলি – বাঘ এলে তো শেয়ালেরা ফেউ ডাকে। এখানেও তো লোকে ফেউ ডাক শুনছে। কাল রাতে অম্বিকাপুরের দিকে ‘ফেউ ফেউ করে কী যেন ডাকছিল, আমি শুনেছি’। অম্বিকাপুর আমাদের বাড়ির কাছের খালের ওপারেই। সেখানে যদি বাঘ আসে, লাফিয়ে খাল-পেরিয়ে এপারেও তো এসে যেতে পারে। এত কাছে এসে বাঘের ঘোরাঘুরির দুঃসংবাদ আমলেই আনেন না আমার মা। বিরক্ত হয়ে বলেন – ফেউ না ঘোড়ার ডিম। এমন ভীতু হয়েছ যে কেন! শোন, বেশি শীত লাগলে শেয়ালেরা মুখে লেজ পুরে ও রকম ফেউ ফেউ করে ডাকে।
আমি কিন্তু বাঘের সম্ভাবনাকে মায়ের মতো নাকচ করতে পারি না, সবাই তো বলছে ফরিদপুর শহরে অনেক দিন পরে শীতকালে আবার বাঘ এসেছে।
বাঘ আসা নিয়ে সেদিন বেশ গল্প জমে বাড়িতে। আমাকে নিয়ে হাসাহাসিও হয়। কোথায় বসন্তপুর, না কানাইপুরে, নাকি খানখানাপুরের জঙ্গল থেকে বেরিয়েছে এক গুল-বাঘা (বাঘ-ডাশা)। তাই নিয়ে বাঘের গুজব তৈরিতে মেতেছে শহরের লোকেরা। দাদা আমাকে মুখ ভেংচে বলে – তুই যেমন শুঁটকি-বাঁশের কঞ্চি, তোকে খেলে বাঘের পেটও ভরবে না। বাঘ তোকে ভুলেও খেতে আসবে না।
দাদার ওপরে যথেষ্ট রাগ হয়, তবু বাঘের ভয় আমার থেকেই যায়।
তারপর বাঘের গল্প পুরোন হয় একসময়। গুজবের বাঘ হয়তো চলে যায় অন্য কোথাও, আমার বাঘের আতঙ্কও শেষ হয়।
কিন্তু বছর না ঘুরতেই বাঘে আক্রান্ত রোগী এসে যায় হাসপাতালে, বাবার কাছে। বাঘের খপ্পর থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া রোগীটিই শুধু নয়, গোটা একটা বাঘও এসে গেল তার সঙ্গে; অবশ্য জীবিত নয়, মৃত বাঘ। একেবারে নির্ভেজাল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বাবাকে দেখাবার জন্য মৃত বাঘটাকে বাঁশের ভারায় ঝুলিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল আমাদের বাড়িতে। ফরিদপুরের চরাঞ্চলেই বাঘটিকে মারা হয়। ঘটনাটা ছিল খুব চমকপ্রদ। চরে ধান কাটছিল চাষিরা। আচমকা বাঘ এসে লাফিয়ে পড়ল একজনের ওপরে। পাশেই ধান কাটছিল তার বড় ভাই। ছোট ভাইকে বাঘে ধরে নিচ্ছে দেখে হিতাহিত ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বড় ভাই। ভাইকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য বাঘের মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় হাত। বাঘ তখন ছোট ভাইকে ছেড়ে বড় ভাইয়ের হাত কামড়ে ধরে। দুঃসাহসী লোকটি আরেক হাত দিয়ে তখন বাঘের চোয়াল টেনে ধরে প্রাণপণে। ছোট ভাইটি ও অন্যরা এসে দা, কাস্তে দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে ক্রুদ্ধ বাঘকে, তাতেই বাঘের মৃত্যু হয়। বড় ভাই প্রাণে বেঁচে যায়। বাঘে-মানুষে এই অকল্পনীয় লড়াই অবিশ্বাস্য মনে হলেও গল্পটি ছিল একশ ভাগ সত্যি। ছোট ভাই তার ঘাড়ে আক্রমণের জখম নিয়েই ফরিদপুরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, আর বড় ভাইয়ের একটি হাত কবজি পর্যন্ত বাঘের কামড়ে একেবারে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল। সে-ও ছিল আমার বাবার চিকিৎসাধীন। খাঁটি একটি মানুষখোকো বাঘ কী করে ফরিদপুরের চরে এসে হানা দিয়েছিল, সে খবর তখন জানা হয় নি। তবে বাঘের গল্প ফিরছিল সবার মুখে মুখে। বাবা বলেছিলেন – লোকটার হাত বোধহয় কেটে বাদ দিতে হবে। তবু চেষ্টা করে দেখি। লোকটির সৌভাগ্যই বলতে হবে। আমার বাবার সযত্ন চিকিৎসায় তার হাতটি শেষ পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল। ছোট ভাইও ভয়ংকর বাঘের আক্রমণে ক্ষতের দাগ সারা জীবনের জন্য ঘাড়ে-পিঠে নিয়ে সম্পূর্ণ নিরাময় হয়েছিল। মৃত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের চামড়াটা তারা আমার বাবাকে উপহার দিয়ে গিয়েছিল, সেই চামড়ায় কাস্তে আর দায়ের কোপের দাগ থেকে গিয়েছিল। আমার ছোট ভাইবোনেরা ভয়ংকর সেই কালো-হলুদ ডোরাকাটা বাঘের চামড়া মুড়ি দিয়ে হালুম-হুলুম ডাক ছেড়ে বাঘ সাজার খেলা খেলত।
কলকাতার ভবানীপুর পুলিশ হাসপাতালে একটানা ন’বছর কাজ করেছেন আমার বাবা। সে হাসপাতালে বাবা কী ধরনের রোগীদের চিকিৎসা করতেন, পুরোপুরি জানবার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি সম্ভবত তখনো আয়ত্তে আসেনি। ফরিদপুরে এসেই ক্রমে নানা ধরনের রোগ ও রোগী সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম। টাইফয়েড, ম্যালারিয়া, জন্ডিস, আমাশয় ইত্যাদি জীবাণু-সংক্রমিত রোগের রোগী ছাড়াও নানা ধরনের দুর্ঘটনা-আক্রান্ত রোগীও আসত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। বাঘে ধরা রোগী আমরা ফরিদপুরে থাকতে একবারই এসেছিল। তবে সাপে কাটা রোগী প্রায়ই আসত। সে সময়ে পথে-ঘাটে, বাগানে, পুকুরপাড়ে, বাড়ির উঠোনে ইসকুলে কিংবা খেলার মাঠে যখন-তখনই সাপ দেখা যেত। পথে পথে যেমন বেওয়ারিশ কুকুরেরা ঘুরে বেড়ায়, দেয়ালের ওপরে, ঘরের ছাদে ঝাঁক বেঁধে উড়ে এসে বসে কাকেরা। কিংবা চোর-বেড়ালেরা রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করে, যাদের দেখতে দেখতে প্রায় অভ্যস্তই হয়ে গিয়েছিলাম। যখন তখন, যেখানে সেখানে সাপের চলাচল ছিল যেন তেমনি অভ্যস্ত ব্যাপার। তবু সাপের আধিক্যের তুলনায় সাপে কাটা রোগী কমই আসত হাসপাতালে। হতে পারে, সাপের কামড়ের রোগীরা হাসপাতাল পর্যন্ত এসে পৌঁছত না, (অবশ্য হাসপাতালের অধিকাংশ রোগীই আসত শহরতলি অথবা গ্রামাঞ্চল থেকে) তারা আগেই মারা যেত অথবা সাপের বিষ নামানোর জন্য ওঝার শরণাপন্ন হতো। (সে সময়ে, গ্রামাঞ্চলে বা মফস্বল শহরেও সাপের বিষ নামানোর জন্য ওঝাদের ঝাড়ফুঁকই ছিল একমাত্র চিকিৎসা) একবারই শহরতলি থেকে সাপে কাটা এক রোগীকে ডাক্তারি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আনা হয়েছিল। দংশনকারী বিষধর সাপটি রোগীর ঘরের দেয়ালেরই গর্তে বাসা বেঁধেছিল। সেসব দিনে সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসা আজকের দিনের মতো সম্ভবত সহজ ছিল না, তবে সাপে কাটা রোগীটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। অবশ্য তার আগেই রোগীর বাড়ির লোকেরা সাপুড়ে ডেকে সাপটিকে ধরিয়েছিল। সাপটা ছিল যথেষ্ট বড়, মাথায় ছিল পদ্ম-ফুলের নকশা, মুখ বন্ধ মাটির হাঁড়িতে ভরে সাপটিকে আমাদের বাড়িতে আনা হয়েছিল। সাপুড়ে যখন আমাদের দেখাবার জন্য সাপটিকে হাঁড়ি থেকে বের করে আনছিল, বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া সেই সাপ ভীষণ আক্রোশে ফোঁসফোঁস করছিল, প্রচন্ড শক্তিতে লেজ মোচড়াচ্ছিল। এমন ক্রুদ্ধ সাপ আগে আর দেখি নি বোধহয়। মা বলেছিলেন, ওটা পদ্ম গোখ্রো। ভীষণ বিষাক্ত।
আরেকবার একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। গ্রাম থেকে এক আসন্নপ্রসবা মহিলাকে এনে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। স্বাভাবিক প্রসবে সম্ভবত কোনো জটিলতা ছিল, সিজারিয়ান অপারেশানে আমার বাবা যে মৃত শিশুটিকে মায়ের গর্ভ থেকে বের করে আনলেন, সে ছিল অদ্ভুত আকারের এক মানব শিশু। চোখ দুটি ছিল (যতদূর আমার মনে পড়ে) তার মাথার ওপরে, সারা শরীরে ছিল বেশ বড় বড় লোম, হাত দুটি ছিল বুকের সঙ্গে জোড়া লাগানো আর পা দুটি শরীরের তুলনায় খুবই ছোট। সারা শহরে কেমন করে যেন খবর রটে গেল, – হাসপাতালে এক মহিলার পেট থেকে রাক্ষস জন্ম নিয়েছে। সকাল-বিকেল দলে দলে লোক আসতে শুরু করল রাক্ষস শিশু দেখতে। যেন মেলা বসে গেল হাসপাতালের গেটের সামনে। মৃত সেই অপূর্ণাঙ্গ, বিকৃত অবয়বের শিশুটিকে রাখা হয়েছিল ল্যাবরেটরিতে ওষুধে ডুবিয়ে, বড় একটি কাচের জারে। প্রথমদিকে ডিউটিরত এক নার্স কৌতূহলী মানুষের অনুরোধে বারান্দায় সেই কাচের জার নিয়ে দাঁড়াতেন। লোকজন সারি বেঁধে এসে দেখে যেত। শিশুটি যে রাক্ষস নয়, মানব শিশুই – এ কথা দর্শকদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলতে বলা হয়েছিল নার্সকে। এ ব্যাখ্যায় দর্শকেরা সম্ভবত সন্তুষ্ট হতে পারেনি, তারা শিশুটিকে ‘রাক্ষসের বাচ্চা’ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে রাজি ছিল না। তাদের মুখে মুখে মানুষের পেটে ‘রাক্ষস শিশু’ জন্ম নেওয়ার ঘটনা রটনা হয়ে এত ছড়িয়ে পড়ল যে, দূরদূরান্ত থেকে মানুষের দল এসে প্রতিদিন হাসপাতালে মহা হট্টগোল জুড়ে দিল। হাসপাতালের রোগীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষার জন্যই আমার বাবা ‘রাক্ষস শিশু’ দেখানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিলেন।

তিন
ছোট মামার সঙ্গে আমরা তিন ভাইবোন চাঁদপুর স্টিমার ঘাটে নামলাম। সন্ধ্যা নেমে গেছে বেশ আগেই। সে সময়ে মহকুমা শহর চাঁদপুরে বিজলিবাতির ঝলক প্রায় ছিলই না। টিমটিমে কুপি আর হারিকেনের অপর্যাপ্ত আলোর আলো-অাঁধারিতে মোড়া শহরের পথঘাট ছাড়িয়ে রিকশা এসে থামল মামার বাংলোর গেটে। বিভ্রান্ত আমরা এসে দাঁড়ালাম ছোট মামার বাংলোর বারান্দায়। মা-বাবা, পরিবার ছেড়ে অনেক দূরের এক শহরের অচেনা রাতটি কেমন কেটেছিল, সে বোধটি এখন প্রায় অস্পষ্ট।
তবু চাঁদপুরের ভূমিকা আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কাটানো দেড়টি বছরে আমাকে ধীরে ধীরে জানতে হলো, শৈশবের সবুজ ভুবনটিকে আমি হারিয়ে ফেলেছি, কৈশোরের সব কৌতূহলী অনুসন্ধিৎসাও সংকটাপন্ন। চাঁদপুরের বাস আমাকে অসবল, প্রতিবন্ধকতার জীবনে প্রবেশ ঘটাল। অথচ ছোট্ট সেই শহরটি অনায়াসে আমাকে মুগ্ধ লেখক করে তুলতে পারত। পরিবেশটা ছিল তেমনি। অবশ্য ফরিদপুরে সেই শৈশব অতিক্রান্ত সময়েও মানুষের জীবনের আর এক বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিতি ঘটছিল আমার।
আমরা ফরিদপুরে যখন এসেছিলাম, যতদিন ছিলাম শহরটিতে, সে শহর প্রাজ্ঞ শিক্ষকের মতোই জীবনের পাঠগুলো সহনীয়ভাবেই শিক্ষা দিয়ে চলেছিল। অনেক কম বয়সেই অনেক বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলাম। সাধারণ মানুষের সহজ-সরল সততা যেমন বুঝতে শিখে ফেলেছিলাম, তেমনি গ্রামের মানুষের, বিশেষ করে চরাঞ্চলের মানুষের চরিত্রের আগ্রাসী এবং নেতিবাচক দিকটিও অজানা থাকে নি।
এখনকার আমি, অভিজ্ঞতা ও পরিণত বুদ্ধি দিয়েই জেনেছি, বৈরী পরিবেশ মানুষকে রুক্ষ ও আগ্রাসী করে তোলে, সেই বয়সে বিশেষ অঞ্চলের মানুষের উগ্র আচরণের নেপথ্য কারণটি বুঝে ওঠা সম্ভব ছিল না। জানতাম না, নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের নদীর ভাঙাগড়া এবং প্রকৃতির বিরূপ প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সংগ্রাম করেই চিরকাল নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হয়েছে। সেই কারণেই এদেশের বিশেষ কিছু অঞ্চলের মানুষ প্রজন্মপরম্পরায় হয়ে যায় হিংস্র, দাঙ্গাপ্রবণ, নিষ্ঠুর। খুনোখুনি, রক্তপাত এদের জীবনাচরণে হয়ে ওঠে উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ড।
নদীর ভাঙন, বন্যা, চরভাঙা ইত্যাদির কারণে ভূমিচ্যুত হয়েছে মানুষ বারবার। তাই ভূমির অধিকারী হওয়াই এখানকার মানুষের বড় স্বপ্ন। নদীতে জেগে ওঠা নতুন চরের দখল, চর বা জমি নিয়ে দাঙ্গা, খুন, ফৌজদারি মামলা-মোকদ্দমা ছিল ওই ভূমিরই অনুষঙ্গ।
ফরিদপুর হাসপাতালের এক প্রান্তে ছিল একটি ছোট্ট একতলা দালান, তার কামরা দুটি তালাবন্ধই থাকত। আমাদের বাড়ির সামনের পুকুরটির ওপারের রাস্তার শেষ মাথায় ছিল সেই নির্জন রহস্যময় দালানটি, যার নাম ছিল লাশ-কাটা ঘর। আমরা বাইরের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন দেখতাম, সাদা অ্যাপ্রোন পরা আমার বাবা পুকুরের ওপারের রাস্তা দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলেছেন, সঙ্গে চলেছে দু-চারজন সহকারী, বুঝে নিতাম হাসপাতালে এসেছে কোনো খুন-হওয়া লাশ, বাবা লাশ-কাটা ঘরে চলেছেন লাশের পোস্টমর্টেম করতে। কাটাকুটির শেষে (লাশটি যদি কোনো বেওয়ারিশ হিন্দুর হয়), ডোম তাকে বাঁশের চাটাই মুড়ে পৌঁছে দেবে শ্মশানে, মুসলমান হলে গোরস্তানে। আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তাটি দিয়েই চাটাই জড়ান লাশ বয়ে নিয়ে যেত ডোমেরা। এসব লাশের অধিকাংশই ছিল জমিজমা-সংক্রান্ত দাঙ্গাতেই নিহত। পুলিশের তদন্তের সিদ্ধান্ত নির্ভর করত বাবার রিপোর্টের ওপরে। প্রায়ই পুলিশি তদন্তের সহায়তার জন্য কোর্টে যেতে হতো আমার বাবাকে।
একটি ঘটনা আমি আজো ভুলতে পারি নি, তখন বোধহয় আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। হাসপাতালে এলো চোদ্দো বছরের এক কিশোরের লাশ, বলা বাহুল্য, পুলিশ কেসের সুবাদেই। মৃত কিশোরের মা ও পড়শিদের অভিযোগ, চরের মাতবরের লাঠিয়ালরা মালিকের হুকুমেই ছেলেটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। অপরাধীপক্ষ যথারীতি সেটা অস্বীকার করেছে।
পোস্টমর্টেমে বাবা প্রমাণ পেলেন, ছেলেটিকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে, লিভার-কিডনি ফেটে গেছে। ঘটনাটায় হাসপাতালে এবং আমাদের বাড়িতেও সবাই দুঃখিত হয়েছিল। এরই মধ্যে একদিন বিকেলে অচেনা একটি লোক এলো আমাদের বাড়িতে। বাইরের ঘরের বারান্দায় বসে আমি তখন গল্পের বই পড়ছিলাম। লোকটি জুতোর মচমচ শব্দ তুলে উঠে এলো বারান্দায়। চরাঞ্চলের ভাষায় রুক্ষ শব্দে আমার কাছে জানতে চাইল, ডাক্তার সাহেব বাড়িতে আছে কিনা! থাকলে সে দেখা করতে চায়, খুব জরুরি দরকার। লোকটির জুতোর শব্দে তুলে ভারিক্কি চালে হেঁটে আসবার ভঙ্গিতে এবং কণ্ঠস্বরে যে একধরনের আত্ম-অহংকারের গরিমা প্রকাশ পাচ্ছিল, বুঝতে সেই বয়সেও অসুবিধে হয় নি আমার। চরের অবস্থাপন্ন মানুষের মতো চকচকে জুতো, নতুন লুঙ্গি, মাফলার আর পরনের কালো কোটটিতেও যেন দম্ভেরই প্রচার ছিল।
খবরটি বাবাকে পৌঁছে দিলাম। বাবা তখন বিকেলের রাউন্ডে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। বললেন – বসতে বল, আমি আসছি।
বাইরের ঘরের বারান্দায়, কিছু চেয়ার থাকত লোকজনের জন্য। লোকটিকে সেখানে বসতে বলে চলে এলাম বাড়ির ভেতরে। ঘরে এসেই থমকে দাঁড়াতে হলো। শুনলাম বাবার কণ্ঠ। কাকে যেন চড়া গলায় ধমক দিচ্ছেন। ব্যাপারটা অভাবনীয়। বাবা যে সহজে রাগেন না, অত্যন্ত ভদ্র-বিনয়ী মানুষ তিনি, সবাই সেটা জানে।
হতভম্ব হয়ে কিংবা কৌতূহলের বশে বাইরের ঘরের দরজায় উঁকি দিলাম। দেখলাম, একটু আগে আসা চরের লোকটিকে বাবা ধমকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন – কত বড় সাহস আপনার, আমার বাড়িতে এসেছেন আমাকে ঘুষ দিতে। বেরিয়ে যান, এক্ষুনি বেরিয়ে যান। দেখলাম, রাগে কাঁপছেন বাবা। আর রাজা-রাজা ভাব নিয়ে যে-লোকটি আমাদের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল, চোরের মতো মাথা নিচু করে পালিয়ে যাচ্ছে সে।
লোকটি চলে যাওয়ার পর বাবার মেজাজ খারাপ ছিল। হাসপাতাল থেকে ফেরার পরও। ঘটনাটি জানা গেল পরদিন মায়ের কাছ থেকে। লোকটি চর এলাকার প্রতাপশালী এক মাতবর। চৌদ্দ বছরের হতভাগ্য কিশোরটিকে তার হুকুমেই নির্মমভাবে খুন করা হয়। আর খুনের কারণটি এতই নগণ্য যে ভাবতে হয়, মানুষ খুন করা যেন পিঁপড়ে মারার মতোই তুচ্ছ ব্যাপার।
হতদরিদ্র সেই কিশোরটি ছিল বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান, বাবার রেখে যাওয়া একটি ঘোড়া ছাড়া তাদের আর কিছুই ছিল না। হাটের দিনে ভাড়ায় মাল টানার কাজে লাগত ঘোড়াটি। অন্য সময় চরের ঘাস কেটে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে পৌঁছে দিত মালিকের বাড়িতে। এতেই কোনোরকমে দুটি প্রাণীর সংসার চলত। কিছুদিন থেকে সে চরভদ্রাসনের ডাকসাইটে মাতবর রহমত পালের চরে ঘাস কাটছিল। ঘোড়াটি একদিন মাঠে ঘাস খেতে খেতে ঢুকে পড়েছিল অন্য এক মাতবরের ধানক্ষেতে। মাতবরের লোকেরা ধানক্ষেত নষ্ট করবার অপরাধে ঘোড়াকে পিটিয়ে পা ভেঙে দিয়েই ক্ষান্ত হলো না, মাতবরের হুকুমে ছেলেটিকেও ধরে নিয়ে এলো, তারপর বস্তায় ভরে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মারল।
সেকালে চর নিয়ে এসব ক্ষমতাশালী মাতবরের মধ্যে ছিল রক্তক্ষয়ী শত্রুতার সংঘাত। রহমত পালের চরে কাজ করবার অপরাধেই হয়তো অন্য মাতবরের আক্রোশে প্রাণ হারাতে হলো দরিদ্র কিশোরটিকে। রহমত পালই ছেলেটির শোকাতুর মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল। খুনের বিচার চেয়ে মামলা করেছিল। তবে এই পক্ষপাত কতটুকু নিরপরাধের প্রতি সহানুভূতিতে ছিল, আর কতটা ছিল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার জন্য, সে বিশ্লেষণ করা তখন আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
বিচারে ছেলেটির হত্যাকারীদের এবং হত্যার পরিকল্পনাকারীর শাস্তি হয়েছিল, আমার বাবার দেওয়া পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এ ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়ক ছিল। কোর্টের রায়ে হত্যাকারীদের শাস্তির খবরটা সবাই জেনেছিল। বেশ আড়ম্বরে ঘোড়ার পিঠে কয়েক ঝাঁকা পদ্মার ইলিশ পাঠিয়ে সুখবরটা আমাদের জানিয়েছিলেন চরভদ্রাসনের রহমত পাল। সন্তানহারা বিধবাটির হয়ে বাবাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে রহমত পাল নিজেই এসেছিলেন।
বাবা অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন – মাছগুলো আপনি ফিরিয়ে নিয়ে যান। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি, এর জন্য সরকার আমাকে প্রতি মাসে মায়না দিচ্ছে।
রহমত পাল অত্যন্ত বিনয়ে নাকি জানিয়েছিলেন, মাছগুলো ফিরিয়ে দিলে নাকি আল্লাহ নারাজ হবেন। বলেছিলেন – এই মাছ তো তবারক, এইগুলোতে রয়েছে অসহায় শোকাতুর মায়ের দোয়া। আমার মা-ই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে বললেন – মাছগুলো ফেরত দিলে ওরা দুঃখ পাবে। কী দরকার মানুষকে দুঃখ দেওয়ার।
যতদূর মনে পড়ে, ঝাঁকাবোঝাই সেই মাছ মা হাসপাতালের স্বল্প মায়নার স্টাফদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের জন্য রেখেছিলেন অল্প কয়েকটি।
ফরিদপুরে সে-সময়ে চরের মানুষ অনেক দেখেছি, চরের মাতবরও দেখা। তকী মোল্লা নামের এক ডাকসাইটে মাতবর কী এক কাজে যেন দেখা করতে এসেছিলেন আমার বাবার সঙ্গে। গোল মুখের গোলগাল ভারী শরীরের মিশকালো মানুষটি সঙ্গে দুজন গাট্টাগোট্টা তল্পিবাহক নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের বাইরের ঘরে বসে চা-নাশতা আর পান খেয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। চরের মানুষের মতো হাবভাব থাকলেও মানুষটি ছিলেন বেশ স্বল্পবাক, কিছুটা গম্ভীর। তার ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারাটি আমার মনে আছে। সবার মধ্যে মনে হয় রহমত পালই ছিলেন কিছুটা অন্যরকম। যথেষ্ট জমিজমা, সম্পদ-সম্পত্তির অধিকারী হয়েও বেশ সহজ আলাপি; পোশাকে-আচরণে অনেকটা শিক্ষিত শহুরে মানুষের মতোই, কিছুটা মার্জিত।
তবে চর দখল, ভূমি অধিকারের দ্বন্দ্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তির লড়াইয়ে হয়তো ছিলেন সেকালের অন্যসব মাতবরের মতোই আগ্রাসনবাদী; পদ্মা পারের অন্যান্য অভিজাত ধনী ভূস্বামীদের মতোই অপ্রতিরোধ্য।
ফরিদপুর জেলার চরাঞ্চলগুলোর মধ্যে বিখ্যাত ছিল পুরোন বসতি – মাতবরের চর। ধন-সম্পদ এবং ক্ষমতায় মাতবর চরের মিয়ারা ছিলেন সেরা।
ফরিদপুর থেকে নানাবাড়ি-শাইনপুকুরে আসতে আমাদের নামতে হতো ভাগ্যকূল ঘাটে। স্টিমার ভাগ্যকূলের কাছাকাছি এসে গেলে নদীর ওপারে নীলাভ সবুজ মেঘের মতো রেখাটি দেখিয়ে মা বলতেন – ওই যে দেখ, মাতবরের চর দেখা যাচ্ছে। ওইখানে তোমাদের মিনামায়ের শ্বশুরবাড়ি।
মিনামা অর্থাৎ কনক খালা ছিলেন আমার মায়ের ছোট চাচার মেয়ে, বয়সে মায়ের চেয়ে অনেক ছোট। মাতবরের চরে মিনামায়ের শ্বশুরবাড়ি হওয়াটা বড় হয়ে আমাকে অবাক করেছে। আমার নানারা, অর্থাৎ শাইনপুকুরের জমিদারেরা ছিলেন নিজেদের বংশের আভিজাত্য সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন। সেই নিগড় ভেঙে চরের মাতবর বাড়িতে কী করে যে মিনামায়ের বিয়ে হলো, সেটা রহস্যই রয়ে গেছে। তবু স্বচ্ছতা কিছু খুঁজে পাওয়া যায়, কনক খালার শ্বশুর চরের নামি মাতবর হলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন। ছেলেদের তিনি চরের প্রবহমান জীবনধারা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, ঢাকা-কলকাতায় পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষিত করেছিলেন। সম্ভবত শিক্ষা আর সম্পদের শক্তিতে শাইনপুকুরের নীল রক্তের সাবেকি গর্বকে খর্ব করেছিলেন। মাতবরের চরের খালু, অর্থাৎ কনক খালার স্বামীকে দেখেছি অনেক পরে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধের জন্য তিনি যখন সপরিবারে ফরিদপুর শহরে বসবাস শুরু করলেন, প্রায়ই আমরা বেড়াতে যেতাম জেলা ইসকুলের কাছে তাদের নিজস্ব একতলা বাড়িটিতে। খালুকে ভীষণ পছন্দ ছিল আমাদের। ভদ্র-মার্জিত, স্নেহপ্রবণ মানুষটিকে মা-বাবাও খুব পছন্দ করতেন। বংশমর্যাদা নিয়ে আমার বাবা কখনোই মাথা ঘামাতেন না। তার প্রভাব আমার মায়ের মানসিকতাকেও প্রভাবিত করেছিল, মা কখনো তার বাপের বাড়ির গর্বে গর্বিত হতেন না। (যে-গর্ব আমার নানাবাড়ির অনেকের মাঝে বড় হয়েও আমি দেখেছি।) মা-বাবার জন্যই সামন্ত প্রথার কুফল, শ্রেণিবৈষম্যের অসার গরিমা (নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করা) কখনোই আমাদের প্রভাবিত করতে পারে নি। এ ব্যাপারে মায়ের, বিশেষ করে বাবার দেওয়া শিক্ষা এখনো ভুলি নি।
তখন বোধহয় ক্লাস সেভেনে পড়ি, হাসপাতালে যাওয়ার আগে, নাশতার টেবিলে বসে বাবা আমাকে ডাকলেন, বললেন – বসো, আমার সঙ্গে খাও।
খাওয়া নিয়ে আমার ঝামেলা করবার ব্যাপারটি বাবা ভালো করেই জানতেন। মাঝে মাঝেই রাতে না খেয়ে শুয়ে পড়তাম। অনেক রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে বাবা আমাকে ডেকে তুলতেন, খাবার টেবিলে তার সঙ্গে খেতে বসাতেন, খেতে খেতে নানা গল্প করতেন। মা হাসতেন, অনেক সময় বলতেন, মেয়েকে ছাড়া খেতে পারো না, বড় হয়ে তোমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলে তখন কী করবে? বাবাও হাসতেন, – ওকে আমি বিয়েই দেব না। এত নরম মেয়েটা আমার, বই ছাড়া আর কিছু বোঝে না, ও কেমন করে পরের বাড়িতে থাকবে!
কিন্তু সেদিন নাশতার টেবিলে বাবা একেবারেই অন্যরকম কথা বললেন। জিজ্ঞেস করলেন – ধানক্ষেতে আল থাকে দেখেছ? অবাক হলাম। ধানক্ষেতের আল তো জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছি। শহরে বড় হলেও আমার দাদার দেশে আর নানার বাড়িতে বিস্তর ধানক্ষেত আমার দেখা। ধানক্ষেতে আলের ওপর হেঁটে হেঁটে কতবার কতদূর পর্যন্ত চলে গেছি। ধানক্ষেতে ঘুরে বেড়াতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। এতসব কথা বাবাকে বলি না। শুধু বলি, আল তো দেখেছি, দেশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ধানক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে কত হেঁটেছি।
বাবা আবার প্রশ্ন করেন – ধানক্ষেতে আল কেন থাকে জানো?
হেসে ফেলি – জানব না কেন! ধানক্ষেতে আল থাকে তো ক্ষেতে হাঁটবার জন্য।
নাশতা খেতে খেতে মৃদু হাসলেন বাবা – এই তো ভুল করলে, আল কিন্তু কেবল মানুষের পায়ে হাঁটবার সুবিধার জন্য তৈরি করা হয় না। আল তৈরি করা হয় জমিকে ভাগ করবার জন্য। ধানক্ষেতে হাঁটতে গেলে দেখবে, বড় ক্ষেতকে আল দিয়ে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়।
অবাকই হচ্ছিলাম, কোথায় ধানক্ষেত, কোথায় আল! বাবার সঙ্গে আমি তো নাশতার প্লেট নিয়ে বসে আছি। আমাদের তো ধান চাষ করতে হয় না, বাবা কেন আমাকে ডেকে ধানক্ষেতের আল নিয়ে আলাপ করছেন!
আমার মনের কথা বাবা বোধহয় বুঝলেন, বললেন – শোন, বড় হয়ে তুমি যদি কোনো উঁচু পাহাড়ের ওপরে ওঠো বা প্লেনে চড়ে ওপরে উঠে যাও, তখন অনেক ওপর থেকে তাকালে তুমি আর আলগুলো দেখতে পাবে না, দেখবে সব সমান।
বাবার গভীর অর্থব্যঞ্জক কথার মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করবার ক্ষমতা তখনো সৃষ্টি হয় নি আমার মাঝে; বরং ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে ভেবে বসেছিলাম – ইশ্, কবে যে পাহাড়ে উঠতে পারব, প্লেনে চড়ব! পাহাড়ে ওঠা, প্লেনে চড়ে আকাশে উড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই খুব মজার অভিজ্ঞতা। এখন বুঝতে অসুবিধে হয় না, সেদিন বাবা আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন। হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, ধর্মান্ধতা, স্বার্থপরতা, বংশ-আভিজাত্য, সম্পদ আর ক্ষমতার দম্ভ ইত্যাদির সংকীর্ণতায় মানুষ প্রতিনিয়তই নিজের মাঝে, সমাজে ও পৃথিবীতে ক্রমাগত আল তৈরি করে চলেছে। আবদ্ধ কূপমন্ডূকতার ঊর্ধ্বে, অনেক ওপরের স্তরে উঠতে না পারলে বিস্তৃত দৃষ্টি লাভ করা যায় না। বিভেদ-বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, উদার পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা সম্ভব হয় না।
জানি না, কেন সব ভাইবোনের মধ্যে আমাকেই উদার, সামাজিক চেতনার শিক্ষার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন আমার বাবা।
এ প্রসঙ্গে আরো একটি ঘটনা আমার মনে আছে। বিশেষ কোনো কাজে বাবাকে কলকাতায় যেতে হয়েছিল। সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। ফেরার পথে রাজবাড়ীতে ফরিদপুরগামী ট্রেনের অপেক্ষায় বেশ কয়েক ঘণ্টা থাকতে হয়েছিল। বাবা বললেন, স্টেশানে বসে থাকবার দরকার নেই। বরং চলো, আমরা শহরটা ঘুরে দেখি। স্টেশানের পেছনে যাত্রীদের জন্য কয়েকটি রিকশা অপেক্ষা করছিল। রিকশা নিলেন না বাবা, বললেন – রিকশার দরকার নেই, চলো পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াই। হেঁটে হেঁটে ঘুরলেই সবকিছু ভালোভাবে দেখতে পাবে।
– কী হবে দেখে?
আমার প্রশ্নে বাবা হেসে ফেললেন – মানুষকে না দেখলে, না জানলে তো কিছুই শিখলে না। সবকিছু চিনতে-জানতে হলে হাঁটতেই হবে। বাবার সঙ্গে পায়ে হেঁটেই ঘুরে বেড়ালাম। আমার জীবনে সেই প্রথম কোনো অচেনা শহরে শুধু ঘুরে বেড়াবার আনন্দ নিয়েই বেড়ানো। ছোট শহরটি, খুব বেশি সময় লাগে নি, উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করতে। কিন্তু সেই কম সময়েই অনেক বেশি যেন দেখা হয়ে গিয়েছিল। বাবার হঠাৎ মনে পড়ল, রাজবাড়ীতে তার পুরোন চেনা এক ডাক্তার আছেন। বললেন – চল, এবার অন্য এক জায়গায় যাওয়া যাক। পরিচিত ডাক্তারের বাড়িটা বাবার চেনাই ছিল, তবু বাড়ি খুঁজতে গিয়ে বার কয়েক পথ ভুল হলো, আর তাতেই যেন মজা হলো, আমি আর বাবা দুজনেই হাসছিলাম। বাবা যেন হয়ে গিয়েছিলেন আমার সমবয়সী বন্ধু। হাঁটতে হাঁটতে অনেক গল্প করছিলেন। বাড়িটা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল। সন্ধ্যা অবধি থাকলাম সেখানে, বাবার পাশে বসে অবাক হয়ে শুনছিলাম দুই ডাক্তারের আলাপ। রোগী বা রোগ নিয়ে মোটেই কথা বলেন নি তারা। রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ ভাগ আর সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে এমন উৎসাহী আলোচনা করতে বাবাকে দেখি নি আগে। তাদের আলোচনায় অংশ নেওয়ার মতো বিদ্যা-বুদ্ধি আমার তখনো অর্জিত হয়নি, কিন্তু বাবাকে যেন নতুন মানুষই মনে হচ্ছিল। স্টেশানে যখন ফিরে এলাম, সন্ধ্যা হতে চলেছে, ফরিদপুরগামী ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে গেছে প্ল্যাটফর্মের ধারে। ট্রেনে উঠবার আগে বাবা বলে বসলেন – চল, আমরা থার্ড ক্লাসে উঠি। আমাদের টিকিট ছিল প্রথম শ্রেণির। কলকাতার শেয়ালদা থেকে রাজবাড়ী পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির কম্পার্টমেন্টেই এসেছি। অবাক হয়ে প্রশ্ন করি – আমরা তো ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট নিয়েছি। থার্ড ক্লাসের কামরায় কেন উঠব?
বাবা হাসেন – ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট আছে বলে থার্ড ক্লাসে কি বসা যায় না?
বাবার প্রস্তাব মনঃপূত হয় না আমার, বলি – থার্ড ক্লাসে তো আমরা কখনো চড়ি না।
মত পাল্টান না বাবা, আমাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই যেন বলেন – তাই কী! আজ না হয় থার্ড ক্লাসেই চড়লে, দেখবে কত রকমের মানুষ! ভালো লাগবে তোমার। বাবার সঙ্গে থার্ড ক্লাসেই উঠে বসতে হয়। কামরায় ভিড় তেমন ছিল না। আমাদের মতো ধোপদুরস্ত যাত্রী একেবারেই ছিল না। যাত্রীরা সবাই গরিব গ্রামীণ মানুষ, ঝাঁকা-পোঁটলা বস্তা নিয়ে উঠেছে, কারো পায়েই জুতো নেই, পরনে ময়লা লুঙ্গি, ধুতি। সম্ভবত শীতের সন্ধ্যা ছিল সেটা। ট্রেনে চলতে শুরু করলে বাবা তার শালটি ঠিক অন্য যাত্রীদের মতো করেই জড়িয়ে নিলেন শরীরে, তারপর সেইসব গ্রাম্য হাটুরে, জেলে, কৃষক, ফেরিওয়ালা, দোকানদার, যাত্রীদের সঙ্গে নানা গল্প জুড়ে দিলেন ধান-পানের খবর, মাছের খবর, খেজুরের রসের গুড়ের দর ইত্যাদি আলাপে বাবা খুব সহজেই হয়ে গেলেন অতি সাধারণ মানুষদের একজন। প্রথম দিকে আমার ভালো লাগছিল না মোটেই, ক্রমে আমিও আগ্রহী শ্রোতা হয়ে গেলাম। কত রকমের গল্প যে চলল, ধান-কাটা থেকে শুরু করে বাঘের গল্প, ভূতের গল্প কিছুই বাদ গেল না। দেশে, বিদেশে অনেক রেল-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার এখন আছে, কিন্তু শীতের সন্ধ্যায় রাজবাড়ী থেকে ফরিদপুরের সেই রেলযাত্রাটির মতো আনন্দময় ট্রেন-ভ্রমণ জীবনে আর আসে নি। আজ ভাবতে দ্বিধাবোধ করি না, সেই যাত্রাটির সূচনা করে বাবা যেন বলতে চেয়েছিলেন, ‘বেরিয়ে এসো আল ভেঙে, সবার সঙ্গে একই সমতলে এসে দাঁড়াও।’
বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সব মানুষ একই সমতলের বাসিন্দা। সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় বৈষম্যের কারণেই মানুষের মাঝে বিভক্তির ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় শ্রেণিবৈষম্যের। আমার বাবা মার্কস অ্যাঞ্জেলস পড়েছিলেন কি না জানি না। তবে বড় হয়ে পরীক্ষায় পাশ করবার জন্য আমাকে পড়তে হয়েছে মার্কসের ডাস্ ক্যাপিটাল, পড়তে হয়েছে ক্লাস স্ট্রাগল, শ্রেণিবৈষম্য আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির অসংখ্য ‘আল’ সৃষ্টির ইতিহাস। বাবা আমার মাঝে ‘সমাজতন্ত্রের’ প্রভাব সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন কি না তা-ও জানি না। তবে নিশ্চিত করে এখন জানি, তিনি আমাকে মানুষ হিসেবে ওপরে ওঠার একটি প্রতীক উপহার দিয়েছিলেন।
মানুষ হিসেবে ওপরে উঠতে পেরেছি কি না জানি না, তবে দ্বিধাহীনভাবে উপলব্ধি করতে পারি, বাবার সেই শিক্ষাটিই হয়তো আমার প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার অবিরাম চেষ্টার উৎস। একবার একটা কবিতা লিখেছিলাম। কোনো এক পত্রিকায় সেটা ছাপাও হয়েছিল, লিখেছিলাম,
আমার বাবা বলেছিলেন,
তোমাকে পাহাড় দেখাব,
আমি তুমি, আমরা সবাই
একদিন হেঁটে হেঁটে
হিমালয়ের চূড়ায়
উঠে যাব।
তারপর থেকে হাঁটছি
পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে
কেবলি হাঁটছি অবিরাম…
পর্বত-চূড়ায় উঠবার অদম্য স্পৃহায় হয়তো জীবনের পথে হাঁটতে হয় অবিশ্রান্ত, সংগ্রাম করতে হয় আল ভেঙে বেরিয়ে আসবার জন্য। তবুও তো দুর্লঙ্ঘনীয় আলগুলো দাঁড়িয়ে যায় চারপাশে।

চার
চাঁদপুরে এসেই জীবনে প্রথম আলের বাধার সম্মুখীন হলাম। কৈশোরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে জানলাম, জীবনটা শৈশবের অবারিত প্রকৃতির অপার স্বাধীনতা উপভোগের অধিকার হারিয়েছে। তখনো বয়স তেরো বছরের ঘর ছাড়ায়নি, ছোট মামা তেপান্ন সনের শেষের এক সকালে ডেকে বললেন – মা, তোকে তো বোরকা পরে ইসকুলে যেতে হবে। এখানে বড় মেয়েরা বোরকা না পরে রাস্তায় বের হলে লোকে খারাপ বলে, বদনাম দেয়।
আমি হতবাক। আমাদের পরিবারে কেউ বোরকা পরে না। তা ছাড়া মাত্র তেরো বছর কয়েক মাস বয়সে যে আমি বড় হয়ে গেছি, এ কথাও কেউ কখনো ভাবে নি। কেউ চিন্তাও করে নি আমাকে বোরকায় ঢেকে ইসকুলে পাঠাতে হবে।
ছোট মামা আবার বললেন – শোন মা, এ শহরে সবাই আমাকে চেনে, আমার ভাগ্নি যদি বোরকা না পরে ইসকুলের রাস্তায় হেঁটে যায়, সবাই আমাকে নিয়ে পেছনে হাসাহাসি করবে।
সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে মা আর বাবার জন্য অনেক কেঁদেছিলাম। কেঁদেছিলাম ফরিদপুরের জীবনের জন্য। তবু বুঝেছিলাম, ছোট মামা নিরুপায়। বলতে পারতাম – ‘আমি চাঁদপুরের ইসকুলে পড়ব না, আমাকে ঢাকায় মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিন, ওখানেই ইসকুলে যাব।’
মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, মা নিশ্চয়ই তার মেয়েকে বোরকা পরিয়ে ইসকুলে পাঠাবেন না। মা নিজেও বোরকা পরেন না। তবু ভীষণ অভিমান হয়েছিল মায়ের ওপরে। কেন, মা তখন আমাকে ছোট মামার সঙ্গে চাঁদপুরে পাঠিয়ে দিলেন। ছোট মামা আমাকে যখন এখানকার ইসকুলে ভর্তি করতে চাইলেন, মা কেন রাজি হলেন। মা তো তখন এখানেই ছিলেন।
আমি চাঁদপুরে আসবার কিছুদিন পরেই মা-ও সবাইকে নিয়ে চাঁদপুরে চলে এসেছিলেন।
ফরিদপুরের ডাক্তারের বাংলো তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল, সেখানে নতুন ডাক্তার এসেছে। ছোট মামার অনুরোধেই মা তার ভাইয়ের বাসায় এলেন। আমাদের ঢাকার বাড়িটিতে ভাড়াটে বসবাস করছে। তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কয়েক মাস সময় নিয়েছে তারা। তা ছাড়া আমার মা তখন আসন্নপ্রসবা। আমাদের সবার ছোট বোনটির জন্ম হলো ছোট মামার বাসাতেই। নাম রাখা হলো তার দোদুল। দোদুলের বয়স দুমাস না পুরতেই ঢাকা থেকে বড় আম্মা খবর পাঠালেন, মাকে তার কাছে গিয়ে থাকতে।
ঢাকায় চলে যাওয়াই মনস্থির করে ফেললেন মা। বাবা মারা যাওয়ার চারদিন পরেই ছোট মামা আমাকে ফরিদপুর থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তখনো বুঝি নি সদ্য পিতৃহীন ভাগ্নির ভরণপোষণ দায়িত্ব নিয়ে, বিধবা ছোট বোনটির বোঝা কিছুটা লাঘবের ইচ্ছা ছিল তার। (যদিও এটা না করলেও চলত। বাবা আমাদের একেবারে পথে বসিয়ে দিয়ে যান নি।)
মা ঢাকায় চলে যাওয়ার আগেই আমাকে ইসকুলে ভর্তি করা হয়েছিল, নতুন বছর তখন শুরু হয়ে গেছে। ফরিদপুরে ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা আমি দিয়ে আসতে পারি নি। তাই পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। মা চলে যাওয়ার পর খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। মন খারাপ হতো ছোট্ট ভাইটি মানু আর অসুস্থ ছোট বোন কুটুর জন্য। কুটুর জন্মের আগে মা খুব অসুস্থ ছিলেন। ফলে কুটুর জন্ম হয়েছিল অপূর্ণাঙ্গ শিশু হয়েই। ওর শরীরে অপূর্ণাঙ্গতার জন্য বাবার দেওয়া চিকিৎসা চলছিল। দুর্ভাগ্যই ওর, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই বাবা চলে গেলেন। দোদুলের জন্মের পর কুটুকে আমিই দেখাশোনা করতাম। দুবছর বয়স হয়ে গেলেও ও অন্যসব স্বাভাবিক শিশুর মতো বেড়ে উঠছিল না। বসিয়ে দিলে পড়ে যেত। হামা দিতে পারত না, কাঁদত খুব দুর্বল শব্দে। সবাই বলত, ওকে বাঁচানো যাবে না।
জাহাঙ্গীর আর বীথিকে চাঁদপুরে রেখে গিয়েছিলেন মা। এক মাস পরে ওরাও ঢাকায় চলে গেল। ঢাকার ইসকুলে ভর্তি হলো। রয়ে গেলাম আমি একা। ছোট মামার সঙ্গে আমার সম্পর্কে মায়ের কী কথা হয়েছিল, জানি না। তবে জেনে গেলাম, আমাকে ছোট মামার বাড়িতেই থাকতে হবে। মামা হয়তো ভেবেছিলেন, বোনের মেয়েটি আরো একটু বড় হলে ভালো ছেলে দেখে নিজের খরচে পাত্রস্থ করে দেবেন। শুরু হলো আমার চাঁদপুরের জীবন। ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করেই নবম শ্রেণির ছাত্রী হয়ে গেছি। ভাগ্যের নাটকীয় পরিবর্তনে এবং পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিকতার চাপে তখন লেখাপড়ায় অত্যন্ত মন দিয়েছি। মনে মনে সংকল্প – ফরিদপুরের ইসকুলে যেমন ভালো ছাত্রী ছিলাম, এখানেও সে আসনটি দখলে আনব। আমার মতো জীবন অনভিজ্ঞের বুঝে ওঠা সম্ভব হয় নি, একটি নয়, অসংখ্য আলের বাধায় কণ্টকিত আমার জীবন, প্রতিবন্ধকতার দেয়ালে ঘেরা হিমালয়ের চূড়া অভিমুখী যাত্রাপথ।
চাঁদপুরের সেই উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও তার পরিবেশ আমাকে যথেষ্ট হতাশ করেছিল। উঁচু দেয়াল ঘেরা ইসকুলটিতে ছিল টিনের চাল দেওয়া ব্যারাকের মতো লম্বা দুটি বেড়ার ঘর। মেঝে মাটির। পাঠশালার মতো লম্বা টুল আর বেঞ্চে ছাত্রীরা গাদাগাদি করে বসে। বেড়ায় ঝুলানো ব্ল্যাক বোর্ডের সামনেই বিবর্ণ একটি কাঠের টেবিল ও চেয়ার। শিক্ষিকারা সেখানে বসে পাঠদান করেন। ইসকুলের ছাত্রীরা সবাই কথা বলে চাঁদপুরের ভাষায়, কুমিল্লা জেলার টানে। ক্লাসটিচার শৈলদি অঙ্ক আর ঐচ্ছিক স্বাস্থ্য পড়ান। নতুন ছাত্রীটি অপেক্ষা পুরোন ভালো ছাত্রীর দিকেই তার পক্ষপাত বেশি। আমার প্রতি তার বিরূপতায় মনে হতো যেন আমাকে তিনি কিছুতেই সেরা ছাত্রী হতে দেবেন না। অবশ্য সবাই শৈলদির মতো ছিলেন না। ইসকুলের প্রধান শিক্ষিকা মণিকাদি পড়াতেন ইংরেজি আর ইতিহাস। দিন কয়েকের মধ্যেই তিনি আমাকে প্রিয় ছাত্রীর তালিকায় নিয়ে ফেললেন। ছাত্রীরা যারা আমার পশ্চিমবঙ্গের উচ্চারণে কথা বলার জন্য পেছন থেকে টিপ্পনী কাটত, হাসাহাসি করত, তাদের মধ্যেও দু-একজন বন্ধু হয়ে গেল। এদের মধ্যে রেণুকা ঘোষালের নামটা আজো মনে আছে। রেণুকা বয়সে আমার চাইতে বড় ছিল। তবু ওকে আমি পছন্দ করতাম। ব্যবহার ছিল ওর মার্জিত, তা ছাড়া প্রচুর বই পড়বার অভ্যাস ছিল, খুব চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গাইত। রেণুকার ছোট বোনটি আমাদের সহপাঠী ছিল। রেণুকা হঠাৎ একদিন বলল, রিজিয়া, আয় না আমাদের বাড়িতে বেড়াতে। তোর কথা আমার দিদিকে বলেছি, দিদি তোকে দেখতে চান। খুব খুশি হবেন তুই এলে। আয় আজ বিকেলেই, তোকে নেমতন্ন করলাম। ফরিদপুর থেকে চলে আসবার পর এখানে আমার কোনো বন্ধু পাই নি। বাড়ির বাইরেও কোথাও তেমন যাওয়া হয় না। দু-একদিন ছোট মামানির সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি, পাড়ার দু-একটি বাড়িতে। ছোট মামানি সাধারণত রাতেই বাইরে যান। দিনে বের হন না। দিনে বাইরে গেলে বোরকা পরে নেন। আমার এই মামিকে কলকাতায় থাকতে কখনো বোরকা পরতে দেখি নি। রীতিমতো আধুনিকাই ছিলেন। ছোট মামাকে বললাম – মামা, আমার ইসকুলের বন্ধু রেণুকা ওদের বাড়িতে বিকেলে আমাকে দাওয়াত দিয়েছে। যাব? ছোট মামা কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকলেন। রেণুকাদের পরিবার সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করলেন। বলা বাহুল্য, সঠিক তেমন তথ্য দিতে পারলাম না। শুধু জানালাম, ওর মা-বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। ওরা এখানে বোনের বাড়িতে থেকে ইসকুলে পড়ে। ওর জামাইবাবুর নাম রক্ষিত বাবু। তিনি সরকারি চাকরি করেন। ওদের বোনের পাঁচ বছরের মেয়েটির নাম কস্ত্তরি।
ছোট মামার গাম্ভীর্যে ফাটল ধরল, হাসলেন – বোকা মেয়ে। রক্ষিত বাবু আর কস্ত্তরির নাম বললেই একটা পরিবারের সব জানা হয়ে গেল। কেমন মানুষ, কী বৃত্তান্ত… কিছুই তো বলতে পারিস না।
এরপর ছোট মামা অবশ্য রেণুকাদের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। সঙ্গে বাড়ির পুরোন বাবুর্চি বলাই ভাইকে দিয়েছিলেন আমার পাহারাদার অভিভাবক হিসেবে। রেণুকাদের বাড়িতে হাসি-গল্প-গান শোনা, চা-পর্ব শেষ করে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়েছিল। মামা-মামি দুজনেই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, বলেছিলেন, বড় হয়েছ, এমন ঘুরে বেড়ালে লোকে বদনাম দেবে। যাবে না আর কোথাও।
এরপর আর যাওয়া হয় নি রেণুকাদের বাড়িতে। আমাদের ক্লাসের সেরা ছাত্রী ছিল রহিমা, সবাই ডাকত মিনু বলে। মিনু বরাবর পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করে এসেছে। আমি আসবার পর ক্লাসের সেরা ছাত্রীটিকে হয়তো সেই প্রথম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হলো, ক্লাসের সাপ্তাহিক পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার যখন আমিই পেলাম, মিনুর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করলাম। ও আমার সঙ্গে সহজ হতে পারে না, এড়িয়ে চলে। ক্লাসের মেয়েরা অনেকে বলতে শুরু করল – এবার আর মিনু বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হতে পারবে না।
ফলে আমার সঙ্গে মিনুর দূরত্ব আরো বাড়ল। দুঃখ পেতাম খুব। তখন আমার খালেদাকেই খুব মনে পড়ত। ফরিদপুরের বন্ধুদের জন্য মন খারাপ হতো। এতিমন আপা, সুনীলাদির স্নেহময় স্মৃতি চোখে জল এনে দিত। এখানে শৈলদি ইচ্ছে করে আমার খাতায় মিনুর চেয়ে কম নম্বর দেন। সুনীলাদি বা এতিমন আপা হলে কখনোই এমন করতে পারতেন না। সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা আমি দিই নি। আমার প্রিয় শিক্ষকেরা আমার জন্য পরে একা পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, সে পরীক্ষায় আমার প্রাপ্ত নম্বর ক্লাসের সবার চাইতে বেশি ছিল।
আমাদের ফরিদপুরের ইসকুলে অষ্টম শ্রেণিতে এসে ভর্তি হলো খালেদা, ছোটখাটো শান্ত-ভদ্র মেয়েটি লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভালো। ভীষণ ভালো অঙ্কে। চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারে, অল্প কয়েকদিনে সব শিক্ষিকার প্রিয় ছাত্রী হয়ে গেল। আর হয়ে উঠল আমার প্রিয় বন্ধু। ফরিদপুরে ক্লাস সেভেন থেকে এইট পর্যন্ত প্রিয় বন্ধু ছিল মাহবুবা। কলকাতার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার অভিজ্ঞতা নিয়ে ওরা প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় চলে এসেছিল ফরিদপুরে। কিন্তু অন্তরে ছিল সে সমৃদ্ধ। অত্যন্ত নম্র-স্নিগ্ধ মাহবুবাকে আজো ভুলি নি আমি। খালেদা, মাহবুবা আর আমি মিলে গড়েছিলাম ত্রয়ী বন্ধুচক্র। ক্লাসে লেখাপড়া নিয়ে আমার আর খালেদার মধ্যে ছিল প্রচন্ড প্রতিযোগিতা, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বে কখনো ফাটল ধরে নি। ক্লাসের ছাত্রীরা দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল।
খালেদার সমর্থকরা বলত – রিজিয়া কখনো খালেদার সঙ্গে অঙ্কে পারবে না। আমার সমর্থকরা প্রতিবাদ করে জানিয়ে দিত – খালেদাও কখনো রিজিয়ার সঙ্গে বাংলায় পারবে না। ওদের তর্ক-বিতর্কে আমি আর খালেদা হাসতাম। হাসত মাহবুবাও। মাহবুবা খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারত, বলত – ওরা দুজনে তো এক ডালে দুই ফুল। গুণে কেউ কম নয়। খালেদার সঙ্গে বন্ধুত্ব আমার এখনো অটুট আছে। মাহবুবাকে হারিয়ে ফেলেছি, জানি না কোথায় সে আছে! কেমন আছে? আমি আর খালেদা এখনো ওকে মনে করি। এখন তার সঙ্গে দেখা হলে সে নিশ্চয়ই বলত – ওরা দুজন তো এক ডালে দুই ফুল – গুণে কেউ কম নয়। অঙ্ক-বিশারদ খালেদা ইয়োরোপের এক নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে পড়ে এসেছে। আর বাংলা সাহিত্যবিশারদ রিজিয়া নিজেই বাংলা ভাষায় সাহিত্যিক হয়ে গেছে।
চাঁদপুরের ইসকুলের সহপাঠী মিনু পরে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ করে সরকারি কলেজে ইংরেজির প্রভাষিকা হয়েছিল। কিন্তু অল্পদিনের সহপাঠী মিনুর সঙ্গে নির্মল বন্ধুত্ব আমার কখনো তৈরি হয় নি। তবু ওকে নিয়ে খুব মজার একটা স্মৃতি রয়ে গেছে। ফরিদপুরের ইসকুলে শিক্ষক এবং ছাত্রীমহলে আমার যে প্রতিষ্ঠা ছিল, চাঁদপুরের ইসকুলে প্রথমদিকে নতুন ছাত্রী আমি ছিলাম একেবারেই নগণ্য। হয়তো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই লেখাপড়ায় অত্যন্ত মনোযোগ দিয়েছিলাম। তবুও সবার মাঝে বিশেষ একজন হয়ে উঠতে পারি নি। তখনই বাবার প্রেরণায় অন্তর্নিহিত শক্তিটি আমার মাঝে জেগে উঠছিল হয়তো; হয়তো তৈরি হচ্ছিলাম পর্বতারোহীর মতোই উদ্যমে।
ইসকুলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে। শৈলদির তত্ত্বাবধানেই রয়েছে ছাত্রীদের মধ্য থেকে শিল্পী নির্বাচন করা। তাকে জানালাম, আমিও অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চাই।
শৈলদি জিজ্ঞেস করলেন – কোনটাতে অংশ নেবে তুমি? নাচ, গান, আবৃত্তি, না নাটকে? জানি না কেন, কিংবা হতে পারে ঝোঁকের বশেই বলে ফেললাম – সব কটাতেই অংশ নেব আমি। শৈলদি কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে দেখলেন আমাকে, তারপর বললেন – এত সব পারবে তুমি? নাচতে-গাইতে পারো তো?
বললাম – পারব। আগের ইসকুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনেকবার অংশ নিয়েছি।
শৈলদিকে বললাম না, আমি প্রথম শ্রেণিতে পড়বার সময়েই কণাদির কাছে কবিতা আবৃত্তি করতে শিখেছি, পরে এতিমন আপার তত্ত্বাবধানে নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে পুরস্কার পেয়েছি। ক্লাস ফাইভের ছাত্রী থাকাকালে দলীয় নৃত্যেও অংশ নিয়েছি।
শৈলদি হয়তো আমার কথায় আস্থা পান নি। সেদিনই আমার নির্বাচনী পরীক্ষার ব্যবস্থা করে ফেললেন। নির্বাচিত হয়ে গেলাম। আমার আবৃত্তির ঢঙটি তিনি পছন্দ করলেন না, রবিঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করতে শিখেছিলাম এতিমন আপার কাছে, আবৃত্তির সেই স্টাইল নাকচ করে দিলেন শৈলদি। ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে/ দয়াহীন সংসারে। তাঁরা বলে গেল, বলে সবে মানুষেরে ভালোবাস। অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশ…।’
আমার একান্ত প্রিয় এই কবিতার চরণগুলো শৈলদি যখন যাত্রার ঢঙে কেঁদে কেঁদে আমাকে আবৃত্তি করাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তখন আমিও ইচ্ছে করেই সেটা নাকচ করছিলাম। আমার মতো করেই আবৃত্তি করে চলেছিলাম। বলা বাহুল্য, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বাদ পড়লাম। নাচের পরীক্ষাটি নিলেন মণিকাদি নিজে। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর আমি কখনো আর স্টেজে নাচি নি। সুতরাং, পরীক্ষাটি ছিল আমার জন্য শংসয়েরই ব্যাপার। মণিকদিকে বললাম – আমি রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে নাচতে চাই। রাজি হলেন মণিকাদি। জিজ্ঞেস করলেন – রবিঠাকুরের ‘আমার খোলা হাওয়ায়’ গানটির সঙ্গে এখন নাচতে পারবে?
বলে দিলাম – পারব।
জানি না, কোন আত্মবিশ্বাসে সেদিন গানের সুর ও কথার অর্থের সঙ্গে সংগতি রেখে নাচের মুদ্রাগুলো নিজেই আবিষ্কার করেছিলাম। তবলার তাল ছাড়া ঘুঙুরহীন পা ফেলে সেই আমার নাচ মণিকাদি পছন্দ করে ফেললেন। বললেন – চলবে, একটু প্র্যাকটিস করে নিলেই হবে। নাটকেও আমি অংশ নিতে চাই শুনে মণিকাদি শৈলদিকে ডেকে বলে দিলেন – রিজিয়াকে নাটকে অভিনয় করতে নিয়ে নিন।
মণিকাদির অনুরোধে অনিচ্ছাতেই শৈলদি আমাকে নাটকে অভিনয় করতে নিলেন। তখনকার বহুপ্রচারিত শাহজাহান নাটকটিই মঞ্চস্থ করবার আয়োজন চলছিল। পরিচালক শৈলদি নিজেই। আমাকে তিনি, মুরাদ, যশোবন্ত সিং এবং শাহজাহান চরিত্রের সংলাপ পড়িয়ে পরীক্ষা নিলেন, পরে বললেন – তুমি শাহজাদা মুরাদের মোসাহেবের চরিত্রে অভিনয় করবে। ভীষণ ক্ষুণ্ণ হলাম। মোসাহেব মানে তো ভাঁড়, আমাকে ভাঁড়ামির পার্ট করতে কেন যে দিলেন শৈলদি, বুঝে উঠলাম না। যেহেতু মণিকাদি আমাকে নাটকে অভিনয় করবার সুপারিশ করেছেন, অতএব ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করবার প্রস্তাব মেনে নিতেই হলো।
ইসকুলের পুরোন ছাত্রীরা, যারা সব সময় বার্ষিক নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে থাকে, তারাই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোতে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হলো। মিনুকে দেওয়া হলো শাহজাদা মুরাদের পার্ট। মিনু ছিল বই অন্তপ্রাণ। ওর পৃথিবীতে লেখাপড়া ছাড়া যেন আর কিছুই ছিল না। পরীক্ষায় ভালো ফল করাই ছিল ওর দিন-রাতের একমাত্র স্বপ্ন। ক্লাসে সবাই যখন হইচই-হুড়োহুড়ি-হাসাহাসি করত, ও তখন একটা বই খুলে পড়ায় নিমগ্ন হয়ে থাকত। এমন সর্বক্ষণপড়ুয়া ছাত্রীটিকে করতে হবে মদ্যপ মুরাদের চরিত্রে অভিনয়, আর আমাকে করতে হবে তার মোসাহেবি! ক্লাসের মেয়েরা অনেকে আমাকে মিনুর মোসাহেব বলে ঠাট্টা-মশকরা করতে শুরু করল। রীতিমতো অপমানজনক ব্যাপার আমার জন্য। তবুও রোজই রিহার্সেলে মিনু, অর্থাৎ মুরাদের মোসাহেবি করতে হয় আমাকে। মুরাদ গম্ভীর হুকুম দেন, ‘শরাব দাও।’ আর আমি ‘জে জাহাঁপনা, এখুনি দিচ্ছি’ বলে বোতল থেকে গ্লাসে শরাব ঢেলে দিই। (হাতের ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে হয়, শরাব ঢালছি।) রিহার্সেলকে নিয়েই আমার আর মিনুর মাঝে আড়ষ্টতা কেটে যায়। ক্লাসেও ও মাঝে মাঝে মজা করে আমাকে বলে – গুলাম, শরাব লাও!
আমি হাসতে হাসতে লেখার কলম বা পেনসিল মুঠোয় পুরে বিনীত বশংবদের মতো বলি, এই যে শরাব নিন, জাহাঁপনা। তারপর দুজনেই হাসতে থাকি। রিহার্সেলের সময় শৈলদি একদিন হুকুম জারি করলেন – খালি হাতে শরাব ঢালবার ভঙ্গি দেখালে চলবে না, একটা বোতল নাও হাতে।
শৈলদির হুকুমেই ইসকুলের দপ্তরি কোথা থেকে একটা পেটমোটা ধুলোভরা বোতল এনে হাজির করল। সেটা নিয়েই শাহজাহাকে মদ ঢেলে দেওয়ার রিহার্সেল দিতে হলো, বোতলটিতে ছিল লাল পিঁপড়ের বাসা, পলকে পিঁপড়ের কামড়ে হাত ফুলে গেল আমার।
নিজের সংলাপ ভুলে পিঁপড়ে ঝাড়তে শুরু করায় বকুনি খেতে হলো শৈলদির কাছে। আমার দুরবস্থায় মজা পেয়ে মিনু মুখ ফিরিয়ে হাসতে থাকে। পরে অবশ্য শৈলদির হুকুমে একটি ধোয়া বোতল এনে দেওয়া হয়েছিল। সেই শূন্য বোতল থেকেই শরাব ঢালবার রিহার্সেল দিতাম। মিনুর ওপর রাগটা কিন্তু আমার থেকেই যায়। মিনুকে জব্দ করবার সুযোগও এসে গেল। আমাদের নাটক স্টেজে উঠল। এবার আর শূন্য বোতল নয়, লেমোনেডজাতীয় কোনো কোমল পানীয় ভরা বোতল দেওয়া হলো আমাকে। ত্রিপয়ায় রাখা হলো সুদৃশ্য দুটি কাচের গ্লাস। যথাসময়ে শাহজাদা মুরাদ হাঁকলেন – শরাব দাও। বোতল থেকে সামান্য পানীয় ঢেলে দিলাম মিনুকে, নিজের জন্য বেশি ঢেলে নিলাম। যতবারই মিনু হাঁকে – আরো শরাব, ততবারই ওকে অল্প দিয়ে নিজের গ্লাসে বেশি ঢেলে খেতে থাকি।
ব্যাপারটা বুঝে ফেলে মিনু, চোখ পাকিয়ে চাপা স্বরে বলে – এই! তুই অতটা নিয়ে আমাকে অল্প অল্প করে দিচ্ছিস কেন? আরো দে। ওর কথা আমলেই আনি না। রেগে যায় মিনু, একটু জোরেই বলে ফেলে – তুই একাই সব খেয়ে ফেলবি নাকি, আমাকে দিবি না? দর্শকরা কথাগুলো ভালো করে শুনতে পায় না বটে, তবে পর্দার পেছনে দাঁড়ানো শৈলদি ভাবেন, মিনু বোধহয় নিজের সংলাপ ভুলে গেছ। ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ জোরেই প্রম্পট করতে থাকেন, বলেন – রহিমা, রহিমা। বল, শরাব লাও, আরো শরাব ঢাল।
নাটক শেষ হলে মিনু আমাকে পাকড়াও করে – এই রিজিয়া, এক বোতল শরবত তুই একাই খেলি? নির্বিকারে বলি – পিঁপড়ের কামড় তো তুই খাস নি, আমি একাই খেয়েছিলাম। ক্লাসের অনেকেই এসে আমাদের ঘিরে ধরে, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে – রিজিয়া, তোর অভিনয় খুব ভালো হয়েছে। এত চমৎকার মদ খাওয়ার অভিনয় করেছিস, মিনু তো ওর পার্টই ভুলে গিয়েছিল। মিনু রেগেই বলে – মদ নাকি শরবত। মজা করে ও একাই খেয়েছে। আমাকে দেয় নি। ভালো অভিনয় করবার জন্য পুরস্কার পেলাম। শুধু অভিনয়েই নয়, নাচের জন্যও পেয়ে গেলাম পুরস্কার। ছাত্রীরা ছাড়া শিক্ষকেরাও অনেক প্রশংসা করলেন। বুঝে নিলাম, এই ইসকুলেও সেরা আসনটি জয় করতে চলেছি। ভুল হয়েছিল আমার, সেরা হওয়ার আগেই আবার ইসকুলে যাওয়া ছাড়লাম। বাধ্যতামূলক উর্দু পড়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ফরিদপুরের ক্লাস সেভেনের ছাত্রী আমি একবার ইসকুল ছেড়েছিলাম। চাঁদপুরে এসে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে উর্দু পড়ি নি আর। নিয়েছি ঐচ্ছিক এলিমেন্টরি হাইজিন। বীজগণিতের অঙ্কের বদলে নিয়েছি গার্হস্থ্য বিজ্ঞান (হোম ইকোনমিক্স)। গার্হস্থ্য বিজ্ঞান তত ভালো না লাগলেও এলিমেন্টরি হাইজিন ছিল ভীষণ পছন্দ আমার। বিষয়টিতে রয়েছে বহু ছবি ও ডায়াগ্রাম অাঁকার কাজ, যেটি আমার অত্যন্ত মনের মতো। ক্লাসের পরীক্ষায়, ইংরেজি, বাংলা ইতিহাসে, ভূগোলে নম্বর আমার সর্বোচ্চ, কিন্তু হাইজিনে শৈলদি আমাকে বেশি নম্বর দিতে অজ্ঞাত কারণেই নারাজ। বিন্দুমাত্র ভুল না থাকলেও নম্বর পেতে থাকলাম অবিশ্বাস্য রকমের কম। শৈলদিকে একদিন প্রশ্ন করে বসলাম, এত কম নম্বর কেন হলো আমার? আমার লেখায় তো একটুও ভুল নেই, ছবিগুলোও ঠিক বইয়ের মতোই একেছি।
ক্ষেপে গেলেন শৈলদি – তোমাকে জিজ্ঞেস করে নম্বর দিতে হবে নাকি? এ নিয়ে আর কথা বলতে আসবে না। ভীষণ মর্মাহত আর অপমানিত বোধ করেছিলাম। পরপর কদিন ইসকুলে গেলাম না। মামা-মামি দুজনেই উদ্বিগ্ন হলেন, বারবার ইসকুলে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। আমার ইসকুল-বিরাগের আসল ঘটনাটি তাদের বললাম না। শুধু বললাম – ইসকুল ভালো লাগে না।
রাগ করে ছোট মামা শেষে বললেন – লেখাপড়া না শিখে কি ঘরে বসে ঘোড়ার ঘাস কাটবি?
বাবা নেই, মায়ের ওপর এখন বিরাট দায়িত্বের বোঝা, অথচ বড় হয়েও আমি এসব বুঝতে চাই না… ইত্যাদি বলে ছোট মামা আমাকে ইসকুলে পাঠাতে চাইলেন। শেষে মামিই আমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠালেন ইসকুলে। কিন্তু সে ইসকুলের ছাত্রী হওয়ার সুযোগ হয়তো আমার ভাগ্যে ছিল না, দিন কয়েক ইসকুলে যাওয়া-আসা করবার পর পাকাপাকিই ইসকুল ছাড়লাম। এবারে ইসকুল ছেড়ে দেওয়ার কারণ শৈলদি নন, বোরকা।
এতদিন ছোট মামার সম্মান রাখবার জন্য বোরকা পরেই ইসকুলে যাচ্ছিলাম। প্রথমদিকে অসুবিধে হতো। কষ্ট হতো বোরকা চাপিয়ে হাঁটতে, পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া দেখেছি, চাঁদপুরে মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারের মেয়েরা বোরকা ছাড়া ঘরের বাইরে বের হন না। তারা মনে করেন, বোরকা সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের পোশাক। নিম্নবিত্ত ঘরের মহিলারাও বোরকা ব্যবহার করতে চেষ্টা করেন। অনেকে পথ চলবার সময় পর্দা করার জন্য ছাতা ব্যবহার করেন। শহরের সামাজিক নিয়ম মেনেই বোরকায় অভ্যস্ত হয়েছিলাম। তবু বোরকা এক অঘটন ঘটিয়ে বসল।
ইসকুলে যাওয়ার সময় একদিন বোরকা সামলাতে না পেরে বইখাতাসমেত পড়লাম রেললাইনের ওপরেই। পায়ে ব্যথা পেলাম প্রচন্ড। স্টো সারতে সময় লাগল। বোরকাই যে এর জন্য দায়ী, এমন ধারণাই বদ্ধমূল হয়ে গেল মনে। এরপর বোরকার সঙ্গে ইসকুলও ছাড়লাম। বললাম, বোরকা আর পরব না। বোরকা পরে যদি ইসকুলে যেতে হয়, তাহলে ইসকুলেও যাব না। মামা-মামি সমস্যায় পড়লেন আমাকে নিয়ে। ভাবলেন, ঢাকাতেই পাঠিয়ে দেবেন আমাকে, ঢাকায় যাওয়া কিন্তু আমার হলো না। হঠাৎ করেই একটা নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।

পাঁচ
জেনি খালার ছেলে মুন্নু ভাই এসেছিলেন চাঁদপুরে বেড়াতে। আমাকে বললেন – এক কাজ কর, সামনের বছরই তুই ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা প্রাইভেটে দিয়ে দে। হেনুও দেবে।
হেনু জেনি খালারই ছেলে, বয়সে আমার কাছাকাছি, সেন্ট গ্রেগরী ইসকুলে নবম শ্রেণির ছাত্র। হেনুর নাকি মাথায় ঢুকেছে, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে দুবছর পড়ার দরকার নেই, ক্লাস নাইন থেকেই সে সরাসরি ম্যাট্রিক দিয়ে ফেলবে। সংশয় কাটে না আমার তবু। জেনি খালার ছেলেরা সবাই মেধাবী, হেনু যা পারে, আমি কি তা পারি! সাহস দিলেন মুন্নু ভাই – পারবি না কেন! লেখাপড়ায় মাথাটা তোরও তো যথেষ্ট ভালো। এত ছোটকাল থেকে কবিতা লিখতে শিখে ফেললি! পরীক্ষায় পাশ করতে পারবি না কেন। নিশ্চয়ই পারবি।
মুন্নু ভাইয়ের উৎসাহেই হয়তো অসাধ্য সাধনে ব্রতী হয়ে গেলাম। ছোট মামার কাছে প্রস্তাব গেল। মামা তো আমার কথাতে প্রথমে আমলই দিলেন না, পরে মত বদলালেন। বললেন – দেখুক চেষ্টা করে। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকার চেয়ে অন্তত ভালো হবে।
আসলে ছোট মামা হয়তো খুশিই হয়েছিলেন, আমাকে নিয়ে চিন্তিতই ছিলেন তিনি। আমার তখন আল ভেঙে বেরিয়ে পড়ার সংগ্রামের শুরু। নতুন করেই উদ্যম সঞ্চার হলো মনে। মুখচোরা অন্তর্মুখী আমি প্রতিকূল পরিবেশে এসেই হয়তো হয়ে উঠেছিলাম আত্মবিশ্বাসী আর নিজেকে প্রকাশ করবার মতো উদ্যমী। ইসকুল বাদ দিয়ে এক বছর আগে ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ছিল হয়তো সেই বয়সে আমার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ অথবা হঠকারিতা। নিজের ওপর বিশ্বাস তাই যথেষ্ট। ছোট মামাকে বললাম – সব সাবজেক্ট আমি নিজেই পড়তে পারব, শুধু অঙ্কের জন্য একজন মাস্টার পেলে ভালো হয়।
মামা রাজি হয়ে গেলেন, মাস্টার জোগাড় হলো। মামার ইচ্ছাতেই সব সাবজেক্ট পড়াবার ভার নিয়ে নিলেন আমার নতুন মাস্টার মশাই, যাঁকে আমি আজো ভুলতে পারি নি। অভিজ্ঞ শিক্ষক ছিলেন তিনি। সিলেবাস, টেস্ট পেপার, বইপত্র – সব নিজেই কিনে আনলেন। বয়স্ক হিন্দু সেই ভদ্রলোক দীর্ঘদিন একটি ইসকুলে শিক্ষকতা করে আসছেন। এখনো স্বীকার করি, আমার জীবনে তাঁর অবদান যথেষ্ট। তিনি আমাকে কেবল এক বছর আগেই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করেন নি, আমার মননশীলতা বৃদ্ধিতেও তাঁর দান ছিল অপরিসীম। আমার পড়ার নেশার খবরটি কেউ তাঁকে দেয় নি, নিজেই বুঝেছিলেন। পাঠ্যতালিকা অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকেই পড়তাম অপাঠ্য। চাঁদপুরে এসে বই পাওয়ার সুযোগ কমে গিয়েছিল। ইসকুলের লাইব্রেরিতে বইয়ের সঞ্চয় ছিল কম, ক্লাসের সহপাঠীদের কাছেও গল্পের বই তেমন পাওয়া যেত না। ক্লাসের সবচেয়ে বড় একটি মেয়েই দিত গল্পের বই, মেয়েটির নাম সম্ভবত ছিল অরুণা। ও আমাকে একটা বই দিয়েছিল পড়তে, বইটির নামটি এখনো মনে আছে। দোলা নামের সেই মোটা উপন্যাসটি সম্ভবত লিখেছিলেন দিলীপ কুমার রায় নামের এক প্যারিসে প্রবাসী বাঙালি লেখক। অরুণা খুব গোপনে বলেছিল, ‘বড়দের কিন্তু দেখাবি না বইটা।’ দোলা উপন্যাস প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ছিল কি না জানি না, তবে সে বইতে নারী-পুরুষের সম্পর্কের খোলাখুলি বর্ণনা সম্ভবত ছিল। প্রচুর পড়ুয়া আমি সে উপন্যাস পড়ে কিন্তু খুব একটা আনন্দ পাই নি। বইটি পড়ে শেষ করবার আগেই ইসকুল ছাড়লাম। অরুণা বলে দিয়েছিল – ‘বইটা থাক তোর কাছে, একসময় তোদের বাড়িতে গিয়ে নিয়ে আসব।’ যথেষ্ট মোটা উপন্যাসটি আমার পড়ার টেবিলেই ছিল। মাস্টার মশাই সেটি দেখে ফেললেন একদিন। হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখে বললেন – বই পড়তে ভালোবাসো বুঝি?
নিঃশব্দে মাথা নাড়ি। মাস্টার মশাই বলেন – এ বই পড়বার বয়স তোমার হয় নি, আমি তোমাকে অন্য বই এনে দেব।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো আমার পাঠ্যতালিকার বাইরের পাঠ। মাস্টার মশাই আমার জন্য বই আনতে শুরু করলেন। লাইব্রেরি থেকেই আনতেন বই। এখন ভাবলে অবাক হই, চাঁদপুরের মতো ছোট একটি মহকুমা শহরেও তখন ছিল কত ভালো ভালো পাঠাগার। শেক্সপিয়ারের ইংরেজি নাটকগুলো মাস্টার মশাই এনে দিলেন পড়তে। ‘এলিজাবেথিয়ান ইংলিশ’ বুঝে উঠবার দক্ষতা তখনো অর্জন করি নি, সাহায্য করলেন মাস্টার মশাই নিজেই। অল্প দিনেই সেই সাবেকি ইংরেজি সাহিত্যের ভাষা বুঝতে শিখে গেলাম। এই সঙ্গেই পড়ে শেষ করলাম পৃথিবী-বিখ্যাত মানুষদের জীবনী এবং পৃথিবীতে সাড়া জাগানো লেখকদের উপন্যাস, গল্পের অনুবাদ। পড়লাম প্রবন্ধের বই। বলা বাহুল্য, জ্ঞানের পরিধি যেমন বাড়ছিল, তেমনি দক্ষতা এসে গেল বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। মাস্টার মশাই এরপর যে-কাজটি করলেন, তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, কত দূরদর্শী মানুষ ছিলেন তিনি। যেন কমলাদি, সুনীলাদি, এতিমন আপার পরে পেলাম মানুষ গড়ার আরেক প্রকৃত কারিগর। পেলাম প্রকৃত শিক্ষক। চাঁদপুর কলেজের অধ্যক্ষ (নাকি অধ্যাপক ঠিক মনে নেই) ছিলেন, অত্যন্ত জ্ঞানী পন্ডিত প্রবীণ এক ভদ্রলোক, মাস্টার মশাইয়ের পরিচিত। মাস্টার মশাই তার কাছে গিয়ে বললেন – আমার ছাত্রীটি বই পড়তে ভালোবাসে খুব, আপনার কাছে ওর জন্য কিছু বই চাইতে এসেছি।
আমার সম্পর্কে সম্ভবত অনেক আশাব্যঞ্জক প্রশংসা করেছিলেন তিনি। কলেজের বই বাইরের পাঠককে দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও বৃদ্ধ সেই ভদ্রলোক নিজের নামে বই ইস্যু করে পাঠাতে শুরু করলেন আমাকে। শুরু হলো আমার রবীন্দ্রসাহিত্যের বিশ্লেষণমূলক পাঠ। এতদিন রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, কবিতাই পড়েছি; রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রাজ্ঞ আলোচনা পড়বার সুযোগ বা দক্ষতা গড়ে ওঠে নি। মাস্টার মশাইয়ের সহায়তায় সে-জ্ঞান অর্জিত হতে লাগল। রবি রশ্মি দুই খন্ড পড়ে শেষ করলাম; পড়ে শেষ করলাম প্রমথনাথ বিশী, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র ও আরো বিজ্ঞ রবীন্দ্র-আলোচকদের সমৃদ্ধ সব ভারী গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ, শেলি, ওয়ার্ডসওয়ার্থের তুলনামূলক আলোচনা বোধগম্য হতে অসুবিধা হলো না আর। হয়ে উঠলাম ছোট বৃত্তের এক রবীন্দ্র-বিশারদ।
ভাবতে অবাক লাগে এখন, নবম শ্রেণি ডিঙিয়ে দশম শ্রেণির বেড়া এড়িয়ে, দুবছরের পড়া মাত্র দশ মাসে শেষ করবার দুরূহ কাজটি করতে করতে কেমন করে আমি বাইরের এতো বই পড়বার সময় পেয়েছিলাম। এ-ব্যাপারেও কৃতিত্ব ছিল মাস্টার মশাইয়েরই। তিনি এমনভাবে আমাকে রুটিন করে দিয়েছিলেন যে সারাদিন আমাকে পরীক্ষার পড়ায় মুখ গুঁজে থাকতে হতো না, কিছুটা স্বাধীনতা আমার ছিল; বাড়তি অধ্যয়নটির সময়ের সংকুলান হয়ে যেত অনায়াসে। আরো আশ্চর্যের বিষয়, এরই মধ্যে আমি ছবি অাঁকতাম, ছোট মামানিকে টুকটাক কাজে সাহায্য করতাম।
মাস্টার মশাই, তখনকার দিনের ইসকুলের শিক্ষকদের মতোই স্ফীত অঙ্কের বেতন পেতেন না, যা পেতেন তাতে সেই সস্তার দিনেও হিসাব করে চলতে হতো। এটা নিয়ে কোনো অভিযোগ তাঁর ছিল না। আমাকে পড়িয়ে পেতেন তিনি মাসে মাত্র ২০ টাকা। প্রতিদিনই পড়াতে আসতেন, ঘড়ি দেখে সময় মেপে পড়াতেন না। পড়াতে পড়াতে অনেক সময় দুই ঘণ্টা-আড়াই ঘণ্টাও কাটিয়ে দিতেন। নিয়ম ভেঙে যে-চ্যালেঞ্জ আমি নিয়েছিলাম, সেটা যেন শুধু আমার একার ছিল না, ছিল তাঁরও। চাঁদপুরে এসে আমার মাঝে যে জেদি, একগুঁয়ে স্বভাবটি আসন নিয়েছিল, ধীরে ধীরে সেটা কেমন করে যেন ঝরে গেল; হয়ে উঠলাম সহজ, প্রফুল্ল, আমার বয়সী আর দশটি মেয়ের মতোই স্বাভাবিক। ছোট মামার ছোট তিনটি মেয়ে – সাত বছরের রিনা, পাঁচ বছরের ফরিদা আর সবে গুট গুট করে হাঁটতে শেখা ভীনার প্রিয় বোন হয়ে গেলাম। ওরা আমাকে ডাকত রাঙা আপা। ফরিদা আমার এতা বাধ্য হলো, আমাকে ছেড়ে একেবারেই থাকত না। আমার পড়ার সময় পাশেই আরেকটি চেয়ারে বই খুলে বসে থাকত। সবাইকে বলত, রাঙা আপা আমার বন্ধু। বন্ধু বলেই ডাকতে শুরু করল। আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের অংশীদার কেবল মাস্টার মশাই একাই হলেন না, ছোট মামা, মামানিও উৎসাহী হয়ে উঠলেন। প্রথমদিকে আমার উদ্ভট খেয়ালে বাধা না দিলেও এ ব্যাপারে ছোট মামার খুব একটা আস্থা ছিল না। মাস্টার মশাইয়ের কাছে আমার লেখাপড়ার অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে মামাও ক্রমে আশাবাদী হতে শুরু করলেন, তার ভাগ্নি যেন বিরাট একটা কাজ করতে চলেছে, এমনভাবেই গল্প করতেন সহকর্মী বন্ধুদের কাছে।
মামার কয়েকজন বন্ধু ছিলেন, এরা প্রত্যেক সন্ধ্যার পরে এসে যেতেন। বাংলোর সামনে লনে গার্ডেন-চেয়ার পেতে বসত তাদের গল্পের আসর। চা-নাশতার ট্রে যাওয়া-আসা করত বার কয়েক। একদিন শুনতে পেলাম, তার অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বাকাউল মামার কাছে ছোট মামা বলছেন – ওর মাথা খুব ভালো। আমার বিশ্বাস, ও ঠিকই পাশ করে যাবে পরীক্ষায়। বুঝলাম, মামা আমার প্রশংসাই করছেন। আমাকে নিয়ে যে মামা গর্বিত, সেটাও বুঝতে অসুবিধে হলো না।
ছোট মামানির উৎসাহ ছিল আরো বেশি। আমার নিজের ঘরে পড়ার টেবিল তো ছিলই, খাওয়ার ঘরের পাশে ছোট্ট রুমটিতে আরেকটি টেবিল পেতে বললেন – দিনে তুই এই ঘরটাতে পড়তে বসবি, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে নিলে কোনো ডিসটার্ব হবে না। মামিকে কোনো কাজে সাহায্য করতে গেলে বলতেন – তুই যা তো। এসব তোকে করতে হবে না। যা, পড়াব টেবিলে যা। পড়া ফেলে উঠবি না একদম।
মামি আমার জন্য রোজ এক গ্লাস গরম দুধ এনে রাখতেন আমার পড়ার টেবিলে। বলে যেতেন – দুধটা খেয়ে নিবি তাড়াতাড়ি। দুধ খেতে ভীষণ আপত্তি ছিল আমার। মামি ধমক দিতেন – না খেলে এত পড়া পড়বি কেমন করে, শরীরটা তো ভালো রাখতে হবে।
আমার ছোট মামানি ছিলেন খুবই গোছানো, কর্মপটু মানুষ। বাড়িতে রান্নার বাবুর্চি ছাড়াও আরো কয়েকজন কাজের মানুষ আছে। তবু মামি সারাক্ষণই কাজে ব্যস্ত থাকেন। খুব নিয়মানুবর্তিতা মানা মানুষ ছিলেন তিনি, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলত তার সব কাজ। ওঠেন ভোর না-হতেই, ঠিক সাতটায় খাবার টেবিলে এসে যায় নাশতা। নাশতার আগেই গোসল সেরে নেন, সাড়ে ন’টার মধ্যে রান্নার পাট চুকে যায়। তারপর ব্যস্ত থাকেন ঘরবাড়ি গোছানো আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করানোর কাজে। বসার ঘর, খাওয়ার ঘর ছাড়াও বেডরুমগুলো এমনি গোছানো-পরিপাটি রাখতেন ছোট মামি, আজকের দিনে যে-কেউ বাড়িটাকে নামি হোটেল, মোটেল অথবা কটেজ ভেবে নিতে পারত। গোছগাছের কাজ শেষ হলেই বসতেন হালুয়া, মোরববা, জ্যাম, জেলি, আচার ইত্যাদি তৈরি করতে। দুপুরে নিয়মমাফিক ঠিক একটার মধ্যে খাওয়ার টেবিলে বসতে হতো সবাইকে। দ্বিপ্রাহরিক অবসরের সময়টি ছিল মামির পড়ার সময়। দৈনিক খবরের কাগজ, বেগম পত্রিকা ও অন্যান্য বইপত্র পড়তেন রোজ। পাঁচটার আগেই রেডি করতেন বৈকালিক চা-নাশতা। তারপর চলে যেতেন বাগানে। বাংলোর সামনে লন পেরিয়েই ছিল ফুলের বাগান। গোলাপ, জুঁই, বেলি তো ছিলই, শীতের মৌসুমে ফুটত মৌসুমি ফুলের দল – কসমস, ডালিয়া, সূর্যমুখী, রাজগাঁদা, আরো নানা ফুলের বাহারে ঝলমল করত বাগান। মামা-মামি দুজনেরই ছিল বাগান করবার হবি। ছোট মামা অফিস থেকে ফিরেই লুঙ্গি, গেঞ্জি পরে নেমে যেতেন বাগান পরিচর্যায়। রান্নাঘরের পেছনে ছিল কিচেন গার্ডেন। সেখানে নানা শাকসবজির চাষ হতো। এ ছাড়া ছিল হাঁস-মুরগির দল। বাড়ির বিরাট উঠোনের ধারে ধারে ছিল নানা রকম ফলের গাছ, এসবই তদারক করতেন ছোট মামানি নিজে। ছোট মামি সব সময় থাকতেন ফিটফাট। সন্ধ্যার আগে মুখ-হাত ধুয়ে আয়নার সামনে বসে বিনুনি করে বাঁধতেন খুব সুন্দর খোঁপা। খুব যত্নের তার এই কেশ-প্রসাধন পর্বটি খুব ভালো লাগত আমার। যেমন নিমগ্নতায় তিনি, ফ্রেমে অাঁটা কাপড়ে নানা রঙের রেশমের সুতোয় এমব্রয়ডারি সেলাই করেন। কিংবা রিনা, ফরিদাদের জন্য বোনেন উলের সোয়েটার; তেমনি অভিনিবেশে খোঁপা তৈরি করতেন, খোঁপায় গুঁজে দিতেন বাহারি চুলের কাঁটা। মুখে স্নো বা ক্রিম মাখতেন, চোখে কাজলের রেখা টেনে দিতেন। আমার মনে হতো, ছোট মামানি বুঝি নিপুণ হাতে কোনো শিল্পকর্ম করছেন। সন্ধ্যার পর প্রায়ই মেহমান আসত, মামি ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তাদের আপ্যায়নে। এখন মাঝেমধ্যে তার সেই নিপুণ গৃহিণীপনার দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়।
ছোট মামার মতো মামিও হয়তো আমাকে নিয়ে গর্বিতই হতেন। বাড়িতে অতিথি এলে, নাচে, অভিনয়ে পাওয়া আমার পুরস্কারগুলো কাচের শোকেস থেকে এনে মেহমানদের দেখাতে মামি কখনো ভুলতেন না। এমনকি পড়ার টেবিলে রাখা আমার অাঁকা রবীন্দ্রনাথের স্কেচটিও দেখিয়ে দিতেন। সবাই যখন প্রশংসা করত, ছোট মামির হাসি উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

ছয়
শৈশবের ফরিদপুর শহর আমার স্মৃতির ভুবনে একান্ত আপনজনের মতো যে ঘনিষ্ঠ আসনটিতে আসীন হয়ে আছে আজো, চাঁদপুর ততখানি প্রভাব ফেলতে পারেনি। হতে পারে চাঁদপুরে আমার স্বল্পমেয়াদি অবস্থানে ভালো করে চিনে উঠতে পারিনি শহরটিকে। তেপান্ন আর চুয়ান্ন সনের হাতেগোনা কয়েকটি মাসে চাঁদপুর শহরটিকে ভালো করে দেখবার সুযোগই হয় নি। অবশ্য উত্তাল মেঘনা আর উদ্দাম ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গমে লক্ষ ঢেউয়ের মাথায় অবারিত সূর্যালোকের হিরণ্ময় ঝলকটি অমলিনভাবেই মনে আছে। মনে আছে, শহরে যাওয়ার পথটির এক ধারে ছিল ব্রিটিশ আমলের তৈরি রেলওয়ের বাংলো আর লাল ইটের কোয়ার্টারগুলোর কথা। নদীই শহরটিকে দুভাগে ভাগ করে রেখেছিল। নদীর ওপারে পুরান বাজার, আর এপারে নতুন বাজার। নতুন বাজারেই কোর্ট-কাচারি, ইসকুল-কলেজ, খেলার মাঠ, দোকানপাট, আবাসিক এলাকা। ও পারটি একান্তভাবেই ছিল বাণিজ্যকেন্দ্র। একবারই ছোট মামার অফিসের ডাক্তার সাহেবের পুরান বাজারের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম মামির সঙ্গে। নতুন বাজারের ঘাট থেকে নৌকায় নদী পেরিয়ে পুরান বাজারের ঘাটে নামতে হয়েছিল। পুরান বাজারের স্মৃতিতে তেমন কিছু সঞ্চয় নেই। শুধু মনে করতে পারি, টিনের বড় বড় বিরাট আকারের গুদামঘর, কর্দমাক্ত সরু রাস্তা আর মাছের অাঁশটে গন্ধভরা ভারী বাতাসের সঙ্গে ব্যাপারীদের ডাকাডাকি-হাকাহাকি হল্লার কথা। ডাক্তার মামার বাসাটি ছিল কাঠের পাটাতনের টিনের ছাউনি দেওয়া বড় একটি চৌকো ঘর। তিনি ছিলেন ভ্যাগ্রান্টস হোম বা ভবঘুরে কেন্দ্রের ডাক্তার। ভ্যাগ্রান্টস হোম ছিল পুরান বাজারেই। ছোট মামা ছিলেন সেই ভ্যাগ্রান্টস হোমের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। ভবঘুরে কেন্দ্রটি অবিভক্ত ভারতের কলকাতার মানিকতলাতে ছিল। ’৪৭-এর দেশভাগের পর ভবঘুরেদেরও ভাগ করে ফেলা হয়, হিন্দু ভবঘুরেরা থেকে যায় মানিকতলাতেই। মুসলমান ভবঘুরেদের নিয়ে, অফিসের অন্যান্য সম্পত্তিসহ তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে চলে আসতে হয় চাঁদপুরে।
নতুন বাজারের (অর্থাৎ মূল শহরের) স্মৃতিও খুব বিস্তৃত কিছু নয়। শহরে ঘুরে বেড়াবার সুযোগ (পর্দা করার কারণে) খুব একটা হয় নি। বাজারের ভেতর দিয়ে হেঁটেই ইসকুলে যেতাম। খুব সতর্ক হয়েই হাঁটতাম, রাস্তার ধুলোবালি ও কাদা থেকে বোরকার ঝুল বাঁচাবার জন্যই। মুখের ওপর নেকাবের জালি ঢাকা থাকায় রাস্তার দুধারের দোকানপাট ভালো দেখা যেত না। তবে চাঁদপুর কলেজে দোতলা দালানটির কথা বেশ মনে আছে, সেখানেই আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার ‘সিট’ পড়েছিল। তখনকার চাঁদপুর বলতে কেবল শহরের অভিজাত ‘মুন্সেফ কোয়ার্টার’ আর তার আশপাশের পরিবেশটুকুই আমার স্মৃতিতে অবস্থান নিয়ে আছে।
রেলস্টেশানের খুব কাছেই মুন্সেফ কোয়ার্টারে ছোট মামার বাংলো। বাংলোর গেটের সামনের রাস্তাটির ওপারেই ছিল কিছু দোকানপাট আর ‘তারা কুটির’ নামের একটি পুরোন একতলা বাড়ি। তার পেছনেই ছিল নিচু টানা রেলওয়ের একখন্ড জমি। পানি জমে থাকত, তার পরই ছিল গমগমে সেই রেলস্টেশান। খুব জাঁকজমকের চেহারা না থাকলেও ব্যস্ত স্টেশানটি ছিল সারাদিনই রেলগাড়ির আসা-যাওয়ার কোলাহলে জমজমাট। সে সময়ে চাঁদপুর জাহাজঘাটাও ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। স্টিমার ঘাট থেকে চাঁদপুর শহরের সেই স্টেশান হয়ে রেলগাড়ি যেত চট্টগ্রাম, সিলেট, আখাউড়ায়। আরো যে কোথায় যেত, জানা ছিল না। শুনেছিলাম, অভিভক্ত বাংলার কালে আসাম বা পার্বত্য ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় যেতে হলে রেলগাড়িতে চাঁদপুরেই আসতে হতো, এখান থেকে স্টিমারে গোয়ালন্দ হয়ে ট্রেনে শেয়ালদা। তখন চাঁদপুর ছিল ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত। মনে আছে, চুয়ান্ন সনে একবার আগরতলার রাজা-রানীকে দেখেছিলাম, চাঁদপুর থেকে আখাউড়াগামী ট্রেনে নিজ রাজ্যে যাচ্ছিলেন তারা।
ছোট মামার সঙ্গে চলেছি ঢাকায়, আমাদের ঢাকাগামী স্টিমার জেটিতে লাগতে বিলম্ব হলো। শোনা গেল, আগরতলার রাজপরিবারকে নিয়ে একটি বিশেষ স্টিমার এখনই চাঁদপুর ঘাটে ভিড়বে। একদল পুলিশ আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের দাঁড় করিয়ে দিল, নিরাপত্তা ব্যুহের বাইরে। খুবই উৎসাহিত হয়েছিলাম। রাজা-রানীদের সঙ্গে পরিচয় আমার রূপকথার গল্পে। বাস্তবে কখনো কোনো রাজা-রানী দেখবার সুযোগ হয় নি। অল্প সময়েই সেই বিশেষ স্টিমার এসে ভিড়ল জেটিতে। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ভিড়ে দাঁড়িয়েও স্পষ্টই দেখতে পেলাম প্রথম শ্রেণির ডেকের রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন তারা – পার্বত্য ত্রিপুরার, অর্থাৎ আগরতলার রাজা-রানী ও দুটি তরুণ-তরুণী। মামার কাছেই শুনলাম, তারা হচ্ছেন রাজপুত্র ও রাজকন্যা। রূপকথার রাজা-রানীদের মতো জমকালো নয়, আধুনিক সাজ-পোশাক তাদের। রানীর সবুজ সিল্কের শাড়ির ঘোমটা উড়ছে নদীর বাতাসে। চোখে তার কালো সানগ্লাস। বব ছাঁটা চুল উড়ে পড়ছে কপালে। অত্যন্ত ফরসা সুশ্রী, ছিপছিপে গড়নের রানী যখন নেমে আসছিলেন, তাকে আমার তখনকার সিনেমার বিখ্যাত এক সুন্দরী নায়িকার মতোই লাগছিল। ঘাটের ঢালু পাড় বেয়ে উঠে এলেন তারা। পুলিশের ঘেরাওয়ের মাঝে, আমাদের সামনে দিয়েই হেঁটে, উঠে গেলেন তাদের জন্য অপেক্ষায় থাকা আখাউড়ার রেলগাড়ির কামরাটিতে। একসময়ে আসাম-বেঙ্গল রেলপথের রেলগাড়ি চাঁদপুর থেকে যাত্রা করত, কিন্তু সে-সময় চাঁদপুর থেকে আখাউড়া হয়ে কোনো রেলগাড়ি আগরতলায় যেত কি না, জানা ছিল না। আখাউড়া থেকে কী ধরনের বাহনে তারা আগরতলায় পৌঁছেছিলেন, সেটা জানাও সম্ভব হয় নি। তবু তাদের সেই রাজকীয় অবতরণ এবং অভিজাত ভঙ্গিতে হেঁটে ট্রেনের সুসজ্জিত কম্পার্টমেন্টে উঠে যাওয়ার দৃশ্যটি অনেকদিন পর্যন্ত আমার মনে ছিল।
প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ছোট মামা চাঁদপুরে মুনসেফ কোয়ার্টারের যে-বাংলোটি পেয়েছিলেন, তার পাশেই ছিল আয়তক্ষেত্রের আকারের বিরাট এক পুকুর বা দিঘি। এই পুকুরের তিন পাশে ছিল একই রকম তিনটি বাংলো। একটিতে থাকতেন মুনসেফ সাহেব সপরিবারে। আরেকটিতে থাকতেন আরেক সরকারি কর্মকর্তা। প্রায় এক বিঘার ওপর এক-একটি বাংলোর চৌহদ্দি নিয়ে ‘হর্স স্যু’ আকারের ‘মুনসেফ কোয়ার্টার’ কথিত পাড়াটি ছিল তখন শহরের মধ্যে সবচেয়ে অভিজাত আবাসিক এলাকা। ইংরেজ শাসনকালে, ইংরেজ সিভিলিয়ান অফিসারদের বসবাসের জন্য তাদের পছন্দসই করেই বাড়ি তিনটি তৈরি করা হয়েছিল। বড় মুনসেফ নামে পরিচিত যে ভদ্রলোক মুনসেফ কোয়ার্টারে থাকতেন, তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র-শান্ত মানুষ। তার স্ত্রীও ছিলেন চমৎকার মহিলা। আমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাদের বাড়ির ভেতরে ছিল একটি টেনিস কোর্ট। সেখানে মুনসেফ সাহেবের স্ত্রী আমার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। প্রায়ই বিকেলে সেখানে খেলতে যেতাম। অবশ্য মামা-মামির অনুমতি নিয়েই। ততদিনে বোরকা ছাড়া বাইরে যাওয়ার দোষে আমাকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো না আর। মামা-মামির মানসিকতারও বোধহয় পরিবর্তন ঘটেছিল। আর সেটি সম্ভবত আমিই ঘটিয়েছিলাম।
ভেঙে দিয়েছিলাম হয়তো কূপমন্ডূকতার ‘আল’। (ততদিনে বুঝে ফেলেছিলাম, চাঁদপুর আসলে ধর্মান্ধতার গোঁড়ামিতে আবদ্ধ শহর।) ছোট মামা ছিলেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, কলকাতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কারমাইকেল হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছেন। চাকরি জীবনের প্রথমার্ধ কেটেছে কলকাতাতেই। ছোট মামিও ছিলেন আমার মায়ের মতোই কলকাতা শহরের আধুনিকা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাজ-পোশাক তৈরি করতেন, ট্রামে-বাসে চড়ে বেড়াতেন। বোরকা পরার চিন্তা হয়তো তখন তার স্বপ্নেও ছিল না। চাঁদপুরের মতো গোড়া ধর্মান্ধতার শহরই কি তাদের মানসিকতাকে আবদ্ধ করে ফেলেছিল! নাকি এর পেছনে ছিল সদ্য ইসলামি রাষ্ট্রের লেবাস অাঁটা পূর্ববঙ্গের মানুষের আদর্শ পাকিস্তানি হয়ে ওঠার প্রয়াস! এসব বিশ্লেষণ তখন করবার যোগ্যতা আমার ছিল না, শুধু খুশি হয়েছিলাম ছোট বৃত্তের আল ভেঙে আবার তাদের উদারতায় প্রত্যাবর্তনে।
স্বেচ্ছায় এক দুর্লঙ্ঘনীয় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েও চাঁদপুরের জীবনযাপন ক্রমে আমার জন্য অনেক সহনীয় আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। এ-প্রসঙ্গে একজন প্রেরণাদাতা মানুষের কথা উল্লেখ করতেই হয়, তিনি রায়পুরার নানাভাই। রায়পুরার নানা ছিলেন ছোট মামানির ফুফা। তিনি ছিলেন তখন সম্ভবত অবসরপ্রাপ্ত সাব-ডেপুটি। মাঝেমধ্যে নানা প্রয়োজনীয় কাজে আসতেন চাঁদপুরে। দু-চারদিন থেকে যেতেন। সারা বাড়িতে আনন্দের আলো ছড়িয়ে দিতেন। যতক্ষণ বাড়িতে থাকতেন, হাসি-গল্প, ঠাট্টা-মশকরায় সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। রায়পুরা নামক বিখ্যাত স্থানটি নোয়াখালী নাকি কুমিল্লা জেলাতে ছিল, জানতাম না। নানাকে আমরা রায়পুরার নানাভাই বলেই ডাকতাম। যেন স্থানের মাহাত্ম্যেই তার পরিচিতি। অকৃত্রিম স্নেহ ছিল তার আমার প্রতি। আমার কবিতাগুলো পড়তেন আগ্রহ নিয়ে, অাঁকা ছবি খুব উৎসাহে দেখতেন, আর শেলি, বায়রন, কিটসের কবিতা চমৎকার উচ্চারণে আবৃত্তি করে শোনাতেন; শেক্সপিয়রের অনেক নাটকের সংলাপ ছিল তার মুখস্থ। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তিনি দু-চারদিন ইংরেজি পড়িয়েছেন আমাকে, তার মাঝে আমি একজন বিদগ্ধ সাহিত্যপ্রেমী ও দক্ষ শিক্ষককে দেখেছিলাম। রায়পুরার নানিও এসেছিলেন একবার; সঙ্গে এনেছিলেন নানা ধরনের পিঠা, ফলমূল, আর তার দুই মেয়েকে। তার বড় মেয়ে আমাদের নিলু খালা ছিলেন আমার চেয়ে বয়সে অল্প বড়। ছিলেন তার বাবার মতোই প্রাণবন্ত, উচ্ছল, আনন্দ সৃষ্টি করবার অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারিণী। নিলু খালার বড় চাচা ব্যারিস্টার লুৎফে আলীর ব্রিটিশ স্ত্রী কীভাবে ব্রিটিশ উচ্চারণের টানে নোয়াখালীর ভাষায় শরিকদের সঙ্গে ঝগড়া করেন – অনুকরণ করে দেখাত নিলু খালা, হেসে গড়িয়ে পড়তাম।
রায়পুরার নানাভাইয়ের ভাই ব্যারিস্টার লুৎফে আলী আর তার ব্রিটিশ স্ত্রীকেও দেখেছিলাম, ইংল্যান্ডে বেড়াতে যাওয়ার পথে একবার তারা এসেছিলেন চাঁদপুরে। রায়পুরার জমিদারেরা এককালে শুধু ধনীই ছিলেন না, শিক্ষাদীক্ষায়ও ছিলেন অগ্রগামী। লুৎফে আলীর বাবা তাকে ব্যারিস্টারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন বিলেতে। লিঙ্কন ইন’স থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরলেন লুৎফে আলী, সঙ্গে এলেন তার ব্রিটিশ স্ত্রী। ভাবতে এখন অবাক লাগে, রায়পুরা গ্রামে কীভাবে খাঁটি একজন ব্রিটিশ মহিলা জীবন কাটিয়ে গেলেন। লুৎফে আলী সাহেব জীবনে কোনোদিন কোর্টের চৌহদ্দিতে পা রাখেন নি। ব্রিটেনের শিক্ষা, ব্রিটিশ স্ত্রী আর একজন অভিজাত ইংরেজের মতো জীবনাচার নিয়ে তিনি জমিদারির আয়ে দিব্যি জীবনযাপন করে গেছেন। নির্ভেজাল ইংরেজি পোশাক পরা, মাথায় ব্রিটিশ টুপি, হাতে ছড়ি আর মুখে চুরুট নিয়ে তিনি যখন গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলেন, অবাকই হয়েছিলাম। ছোট বয়সে কলকাতার চৌরঙ্গীতে এমন ইংরেজ ভদ্রলোকদের দেখেছি, কিন্তু চাঁদপুরের মতো একটি শহরে তখন এমন কারো সাক্ষাৎ পাওয়া অভাবনীয়ই। তার দীর্ঘাঙ্গিনী ব্রিটিশ স্ত্রী অবশ্য শাড়ি পরেই এসেছিলেন। আমি যখন তাদের দেখেছি, বয়স তাদের প্রৌঢ়ত্বের সীমানা ছুঁয়েছে, যুবক বয়সেই তারা ইংল্যান্ড ছেড়ে এসেছেন, তার পর থেকে তারা রায়পুরা গ্রামেরই বাসিন্দা। তখনো লুৎফে আলী নানা কাঁটাচামচ, ছুরি, ন্যাপকিন ব্যবহার করেন খাওয়ার টেবিলে; স্লিপিং স্যুট না পরে ঘুমুতে যান না। মাথায় হ্যাট আর হাতে ছড়ি না নিয়ে বাইরে বের হন না কখনো। দাঁতে তামাকের পাইপ কামড়ে ধরে, ড্রেসিং গাউন পরে বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে ইংরেজি খবরের কাগজ পড়েন। শুনেছিলাম, তার মেয়েরা গ্রামে থাকেন না, লেখাপড়া করেন বাইরে, দার্জিলিংয়ে, নাকি কলকাতার লরেটোতে বা খোদ ইংল্যান্ডেই কি না, এখন আর স্পষ্ট মনে করতে পারি না। তবে খাস ইংরেজ আমাদের সেই নানির মুখে অনর্গল নোয়াখালীর ভাষা শুনে মজা পেয়েছিলাম নিঃসন্দেহে। সেই ভাষাতেই তিনি আমার সঙ্গে গল্প করেছিলেন অনেক।
চাঁদপুরে থাকতেই দেখা পেলাম আরেক স্নেহময়ী আত্মীয়ার। চাঁদপুরের আমিরাবাজ চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল আমার মায়ের চাচাতো বোন বাদশা খালার। মায়ের মুখে তার বাদশা বুজির গল্প শুনেছি অনেক, তাকে দেখি নি কখনো! সেই বাদশা খালাই স্বামীসহ বেড়াতে এলেন চাঁদপুরে ছোট মামার বাসায়। থাকলেন সপ্তাহ খানেক। আর সেই সাতদিনে তিনি আমাকে এতখানি স্নেহ দিলেন যে তিনি চলে যাওয়ার পরে রাতে শুয়ে আমি চোখের পানি ফেলেছিলাম। এখনো বুঝি না, বাদশা খালা কেন আমাকে অবিশ্বাস্যভাবে ভালোবাসা দিয়েছিলেন, আমি তার আদরের ছোট বোন মরিয়মের মেয়ে বলেই কি! নাকি তখনকার দিনের মানুষের অন্তর ছিল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। ভালোবাসা দেওয়াই বুঝি ছিল তাদের স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাব!
আজকের দিনে যখন স্বার্থবন্দি মানুষেরা ক্রমাগত সংকীর্ণতায় আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্কগুলো আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব অসার হতে চলেছে, তখন আমার শৈশব- কৈশোরে দেখা মানুষগুলোকে ভুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভবই হয়ে পড়ে।
মনে পড়ে যায় আলেকজান বুড়িকেও। আলেকজান দেশ ভাগ হওয়ার পর কলকাতার মানিকতলা ভ্যাগ্রান্টসে হোম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। ‘ভবঘুরে’ দলেরই সদস্য হয়ে। কিছুদিন ছিল চাঁদপুরের ভ্যাগ্রান্টস হোমে। ছোট মামা বন্ড দিয়ে তাকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের বাড়িতে। আলেকজানের মাথার সব চুল সাদা হয়ে গেলেও বয়সের তুলনায় ছিল পোক্ত। সারাদিন এটা-ওটা কাজ খুঁজে বের করত, আর তাই নিয়েই থাকত মহাব্যস্ত। আলেকজানের দেশ কোথায়, কেমন করেই বা ভবঘুরে হোমে এসে পড়েছিল, বলতে পারত না সে। মাথায় কিছুটা গন্ডগোল ছিল তার। মাঝে মাঝেই শূন্যে তাকিয়ে কার সঙ্গে যেন ঝগড়া করত, নানা রকম বিচার-আচারও দাবি করত, অচেনা মানুষদের অচেনা নামগুলো তার মুখে শুনতে শুনতে আমাদের মুখস্থই হয়ে গিয়েছিল। তার এই পাগলামির সময়টুকু ছাড়া অন্য সময় স্বাভাবিক মানুষই ছিল আলেকজান। কাজ করত খুব মন দিয়ে, শুচিবায়ুগ্রস্ত ছিল কিছুটা, ধোয়াধুয়ি, ঝাটপাট একবারের জায়গায় দশবার করেও সন্তুষ্ট হতো না।
আলেকজান বুড়ির মাথা খারাপ হয়েছিল কবে, কেউ জানে না। তবে তার কর্মকান্ড দেখে মনে হতো বহু বছর আগে, যখন এক পয়সা দিয়ে এক থলে সওদা বাজার থেকে আনা যেত, তখনই হারিয়েছে সে মানসিক সুস্থতা। রোজ সকালে বাবুর্চি বলা ভাই যখন কাঁচা বাজার নিয়ে ফিরত, তখনই আলেকজান বুড়ি শুরু করত তার সঙ্গে ঝগড়া-চেঁচামেচি। আলেকজান কথা বলত পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরী উচ্চারণে। সুরেলা টানে বলতে থাকত – ওরে ও বলাই, তুই কি আমাকে বোকা পেয়েছিস অ্যাঁ? দুটো পয়সা তোকে আমি দিলুম আর তুই কি না আনলি শুধু পান আর সুপুরি! আমার কুসুম-তেল, কাপড়ধোয়া সোডা, মিছরি, আফিম বড়ি – সেসব গেল কোথায়? রেড়ির তেল কই? সোনামুখী সুই আনতে বলেছি, তা-ও আনিস নি…
আমরা হাসতাম, বলা ভাই আলেকজানের দেওয়া দাগ ধরা দুপয়সার রেজকিটি তুলে দিত আলেকজানের হাতেই – এই যে নানি, নেও তোমার পয়সা। দুই পয়সায় বাজারে এত জিনিস কে দিব তোমারে? বলাইয়ের কথা মানে না আলেকজান, তারস্বরে ঝগড়া শুরু করে – ওরে পোড়া কপালে হতচ্ছাড়া, তুই আমাকে কী পেয়েছিস? বাজারের জিনিসের দর বুঝি আমি জানিনে ভেবিছিস?
দুই পয়সা অাঁচলে বেঁধে বকর বকর করেই চলে আলেকজান। বলাভাই হাসতে হাসতে বাজার গোছাতে বসে। ভালোমানুষের মতো বলে – নানি, কাইল বাজার থিকা তোমারে সব আইনা দিমু। অহন আস, মাছডি কুইট্যা দেও।
মাছ কুটতে কুটতেই আলেকজান বলে চলে – কবে থেকে তোকে বলছি এক বোতল কুসুম-তেল আনবি… বলছি – দুটো আফিমের বড়ি এনে দে, তা কানে গেলে তো! আমরা আলেকজানের ঘটনায় হাসাহাসি করতাম। ধরে নিতাম, কোনো একসময় হয়তো আলেকজানের আফিমের নেশা করার অভ্যাস ছিল। হয়তো যে-যুগে আলেকজানের মাথা খারাপ হয়েছে, সে-যুগে এক-আধ পয়সায় ঝাঁকা বোঝাই সওদা কেনা যেত। হয়তো তখন কুসুম-তেল নামের শৌখিন সুবাসিত তেলও কিনত কেশ-বিলাসিনীরা।
এই আলেকজানই আমাকে তার এক চেনা পছন্দের চরিত্র করে নিয়েছিল। আমার খাওয়া-নাওয়া, লেখাপড়া সবকিছু নিয়ে সে ছিল যেন অভিভাবকের ভূমিকায়। জানি না কেন আমাকে ডাকত সে লীলু নামে! লীলু নামে তার কোনো ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল কি না, জানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যতদিন চাঁদপুরে ছিলাম, আলেকজান লীলু ছাড়া অন্য কোনো নামে আমাকে ডাকে নি। আমার সুখ-সুবিধার ব্যাপারে তার ছিল সতর্ক দৃষ্টি। রাতে হয়তো পরীক্ষার পড়া পড়ছি বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেছে। দরজায় মৃদু টোকা, বুঝে ফেলি আলেকজান ছাড়া আর কেউ নয়। রাত জেগে পড়লে কী করে যেন বুঝে যেত আলেকজান। বন্ধ দরজার সামনে এসে নিচু কণ্ঠে ডাকত, – ও লীলু। তুই এখনো জেগে আছিস! ঘুমিয়ে পড়। রাত জাগলে যে অসুখ করবে রে সোনা। অনেক বুঝিয়ে আলেকজানকে ওর ঘরে ফেরত পাঠাতে হতো।
পরীক্ষার কিছুদিন আগে জ্বরে ভুগেছিলাম কদিন। কাজ শেষ করে এসে প্রতি রাতেই আমার মাথার কাছে বসে থাকত আলেকজান। কপালে হাত বুলিয়ে দিত, মাথা টিপত। বিড়বিড় করে কীসব দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁক দিত। নরম আদুরে স্বরে ফিসফিস করে সান্ত্বনা দিত – আল্লাহ ভালো করে দেবে আমার সোনাকে। চিন্তা করিস না, কালই তোকে শিং মাছের ঝোল রেঁধে ভাত দেব। মনে আছে, মাঝরাতে একদিন জ্বর ছাড়ার কারণে প্রচন্ড ঘামে ভিজে জেগে উঠেছিলাম, বিস্মিত হয়ে দেখেছিলাম বিনিদ্র আলেকজান বসে আছে আমার মাথার কাছেই। অবিশ্রান্ত মাথা টিপে চলেছে।
আলেকজান বুড়ি মারা গেছে অনেক বছর আগে, চাঁদপুরেই। গৃহ-পরিজন হারানো আধপাগল সেই বৃদ্ধাটিকে আজো আমার মনে পড়ে। এখন ভেবে নিই, হয়তো লীলু নামের আমারই বয়সী তার একটি মেয়ে ছিল, আমার মাঝে লীলুকে সৃষ্টি করে আলেকজানের মাতৃহৃদয় পরিতৃপ্তি খুঁজে পেত হয়তো।

সাত
অবশেষে আমার সেই চ্যালেঞ্জের বৈতরণী পার হলাম, অর্থাৎ শেষ হলো ম্যাট্রিক পরীক্ষা। ছোট মামা-মামি আর মাস্টার মশাইয়ের উৎসাহ-উদ্দীপনায় যেন ঘোরের মধ্যেই কেটে গেল পরীক্ষার দিনগুলো। আর তার পরই ঘরের সবগুলো আলো একসঙ্গে নিভে যাওয়ার মতো দপ করে নিভে গেল এতদিনের যত উদ্দীপনা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের উদ্যম। অদ্ভুত এক সংশয় কুয়াশার মতো ঘিরে ফেলল আমাকে। কেবলই মনে হতে থাকল, ভুল করেছি, ভীষণ ভুল করে ফেলেছি। এমন জ্ঞানহীনের মতো ঝুঁকি নেওয়াটা একেবারেই ঠিক হয় নি। মাস্টার মশাইয়ের ধারণা, আমি ভালো পরীক্ষা দিয়েছি। তার সেই বিশ্বাসে আস্থা আমার ক্রমেই কমতে শুরু করল। হয়ে উঠলাম বিষণ্ণ, হতাশ। বুকের ভেতরে আজন্মের যে বিষণ্ণতাবোধটিকে এতদিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম, প্রচন্ড শক্তিতে জেগে উঠল সে। আমার পরিবর্তন ছোট মামির দৃষ্টি এড়ায় নি, বললেন একদিন – তুই এমন মনমরা হয়ে থাকিস কেন রে? কী হয়েছে তোর?
জবাব দিতে ইচ্ছে করে না, শুধু বলি – কোথায়? আমি তো ঠিকই আছি।
ছোট মামি আমাকে ছবি অাঁকতে বলেন, কবিতা লিখতে বলেন। মাস্টার মশাই আমার জন্য ভালো ভালো বই এনে দেন। পড়তে বলে যান। উৎসাহ পাই না। মন বসে না লেখায়, পড়ায়, ছবি অাঁকায়। ভয়ই আমাকে সারাক্ষণ চাবুক হাতে নির্দয় হাবসীর মতো তাড়িয়ে ফেরে। কেবলই মনে হয়, পরীক্ষায় পাশ করতে পারব না। সহপাঠী বন্ধুদের মুখগুলো যেন দেখতে পাই, যেন ওরা বলছে – খুব তো বাহাদুরি দেখাতে গিয়েছিলে, এখন কেমন হলো!
মণিকাদি ক্লাস নাইনের ত্রৈমাসিক পরীক্ষার নম্বর দেখে বলেছিলেন – পরীক্ষার ফল তোমার খুবই ভালো, আরো ভালো করতে হবে। আমার বিশ্বাস, তুমি ফার্স্ট ডিভিশানে পাশ তো করবেই, পরিশ্রম করলে স্টার মার্ক পেয়ে যাবে। আমি চাই, তুমি আমাদের ইসকুলের নাম উজ্জ্বল করো।
এতিমন আপাও এই কথাই বলতেন। বলতেন, তুমি আর খালেদাই আমাদের আশা। ম্যাট্রিকে আমাদের ইসকুলের নাম রাখবে তোমরা। এখন থেকেই তৈরি হও। মনে হয়, শিক্ষকদের আশাকে ধূলিসাৎ করেছি আমি। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে উপেক্ষা করেছি। নেহাত জেদ আর একগুঁয়েমির বশে ব্যর্থতার পথটাই বেছে নিয়ে জীবনের বড় ভুলটি যে করে ফেলেছি, সন্দেহ থাকে না আর। অনুশোচনা আমাকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলল। ক্রমে গুটিয়ে নিতে থাকলাম নিজেকে। বর্তমানকে নির্মম হাতে মুছে দিয়ে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিলাম নিঃসঙ্গতায়। আমার পড়ার জন্য নির্ধারিত ছোট কামরাটিতেই সারাদিন একা বসে থাকি। সামনে খোলা জানালা। জানালার বাইরে থাকে অর্থহীন পৃথিবী।
বাংলোর বাগানে ফুটে থাকে অজস্র ফুল, স্টেশানে সারাদিন রেলগাড়ি আসে-যায়। যাত্রীরা ওঠে-নামে। রাস্তায় লোকজনের চলাচল, ফেরিওয়ালাদের ডেকে যাওয়া, বাড়ির কাছের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কোরাসে সুর করে নামতা পড়া – কিছুই স্পর্শ করে না আমাকে। অদ্ভুতভাবে মনে হয়, চাঁদপুরের এই জীবনটি সত্য নয়, অবাস্তব কোনো কল্পনা। এমন জীবন কখনো আমার আসে নি। দিগন্তে ঝিকমিক করে জ্বলে ওঠে রৌদ্রছায়ার রেখা। সেখানে প্রাণ পেয়ে যায় আমার শৈশব-কৈশোর। যেন সেটাই আমার আসল জীবন।
ফেলে আসা জীবনেই যেন খুঁজে ফিরছিলাম নিজেকে।
ওই তো আমি! মাকে বলছি – আজ আমার খালেদাদের বাড়িতে দাওয়াত। সারাদিন ওদের ওখানে থাকব, ফিরতে দেরি হবে।
মা আপত্তি করবেন না জানি, করেনও না। খালেদা আর ওর বড় বোন লতিফাকে মা পছন্দ করেন খুব। বলেন – ওরা খুব লক্ষ্মী মেয়ে, যেমন লেখাপড়ায় ভালো, তেমনি ভদ্র।
জজকোর্ট ছাড়িয়ে ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ির দিকে যে-রাস্তা গেছে, সেই রাস্তার ধারেই খালেদাদের বাসা। ওর বাবা প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। কাঁটাতারে ঘেরা মাঠের মাঝে চমৎকার একতলা সরকারি বাড়িতে থাকেন। লতিফা আমাদের এক ক্লাস ওপরের ছাত্রী। ওর সঙ্গেই বন্ধুত্বটা আমার বেশি। ওদের স্নিগ্ধ চেহারার মায়ের রান্না খেতে বসে আমরা অনর্গল গল্প করি।
চমৎকার দিন কাটে। বিকেলে একরাশ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। এটাই তো আমার শৈশবের শহর, ফরিদপুর। এখানেই রয়েছে আমার বন্ধুরা, ছেলেবেলার আনন্দময় নির্বিঘ্ন জীবনের সাথিরা। এখানে মেয়েরা বোরকা পরে ইসকুলে যায় না। এখানে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেলে কেউ নিন্দা করে না। এখানে কেউ বলে না, ‘তুমি বড় হয়ে গেছ। এখন পর্দা করতে হবে।’
ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজে স্টেশানে, ঝমঝম শব্দে প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে এসে যায় দূরের যাত্রী বয়ে আনা রেলগাড়ি। মানুষের ব্যস্ততার কোলাহলে স্টেশান গমগম করে।
অতিপরিচিত এই দৃশ্য আর শব্দগুলো আমাকে স্পর্শ করে না বিন্দুমাত্র। ফরিদপুরে ফেলে আসা আমার প্রিয় বন্ধু মাহবুবাকেই শুধু মনে পড়ে। শ্যামলা রঙের মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে মাহবুবা। আমাদের ইসকুলে ক্লাস সেভেনে এসে ভর্তি হয়েছিল। আমাকে কী কারণে জানি না – প্রিন্সেস বলে ডাকত। রাগ করে একদিন বলেছিলাম – তুই আমাকে প্রিন্সেস বলিস কেন রে? আমি কি রাজকন্যা? আমি কি রাজার মেয়ে?
মাহবুবা গম্ভীর হয় – প্রিন্সেস বুঝি রাজার মেয়ে না হলে হওয়া যায় না! মনে কর, আমাদের ক্লাসটাই একটা রাজত্ব, সে-রাজ্যে গুণে সেরা মেয়ে তুই। প্রিন্সেস নয়তো কী? বলতে বলতে হেসে ফেলে মাহবুবা, আমার গলা জড়িয়ে ধরে – প্রিন্সেস, তুই কি জাদু জানিস ভাই? যেখানেই যাস, তোকে সবাই ভালোবাসে। আমার বুবু তো তোর কথা ভুলতেই পারে না।
মাহবুবাদের বাড়িতে বার দুয়েক বোধহয় গিয়েছি, ইসকুলের বেশ কাছের পাড়ায় ছোট্ট একটি বেড়ার ঘরে ওরা কভাইবোন আর বাবা থাকেন। ওর বাবার বয়স তেমন না হলেও দেখতে যথেষ্ট বয়সীই মনে হয়। কী এক কঠিন রোগে তিনি শয্যাশায়ী। মা নেই মাহবুবার, বুবু অর্থাৎ ওর বড় বোনই সংসার দেখাশোনা করেন। ওদের সেই দীনহীন বসবাসে ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলাম। বুঝতে অসুবিধে হয় নি, নিজ জন্মভূমি ছেড়ে নতুন দেশে এসে প্রায় নিঃস্ব সহায়সম্বলহীন রিফিউজি পরিবারটি চরম অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছে। অথচ ইসকুলে মাহবুবাকে দেখে ওদের দুর্দশার কথা আমরা অনুমানও করতে পারি নি। সব সময় হাসিমুখ মাহবুবার চেহারায় ক্লিষ্টতার কোনো ছাপই ছিল না। কোনোরকমে মাথা গুঁজে থাকা ওদের সেই ঘরে পাটি পেতে আমাকে বসিয়েছিলেন বুবু। রান্না করে খাইয়েছিলেন, চলে আসবার সময় বুকে জড়িয়ে ধরে আপনজনের আন্তরিকতায় বলেছিলেন – আবার কিন্তু আসতে হবে। তুমি এলে খুব ভালো লাগে।
দরজার বাইরে আলেকজানের কণ্ঠ – ও লীলু, বেলা কত হলো, নাওয়া-খাওয়া নেই তোর? আয়, বাইরে আয়। আলেকজান ডেকেই চলে। দরজা খুলি না, যেন দরজা খুললেই আমি আমার আনন্দের ভুবনটিকে হারিয়ে ফেলব, নিরানন্দে ডুবে যাব।
শুধু নিরানন্দই নয়, অচেনা এক ভয়ও ধীরে ধীরে আমাকে দখল করল। বাবুর্চি – বলা ভাইয়ের ভূত-প্রেতে ছিল দৃঢ় বিশ্বাস। প্রায়ই সে-বাড়ির এখানে-সেখানে ভূতের সাক্ষাৎ পেত। মামা-মামি এই ভূত-দর্শনের ব্যাপারটিকে মোটেই আমল দিতেন না। আমি কিন্তু বলা ভাইয়ের ভূতের গল্পগুলো যথেষ্ট উপভোগ করতাম। ভূতের ভয় অবশ্য আমার ছিল না। খুব অল্প বয়স থেকেই শিখেছিলাম, ভূত বলে কোনো অশরীরী অস্তিত্ব এ-পৃথিবীতে নেই। সেই আমিই রাতে ভয় পেতে শুরু করলাম। ভয়টা ভূতের নয়। তবে কিসের, কিছুতেই শনাক্ত করতে পারতাম না। যে-ঘরটিতে আমি থাকতাম, সে-ঘরে ছিল দরজা আকৃতির বড় বড় জানালা। একটি জানালা ছিল আমার বিছানার কাছেই। রাতে একদিন আচমকাই ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম। পায়ের কাছের জানালাটি খোলাই থাকে রাতে। পূর্ণিমার রাত ছিল সেটা। দেখলাম, অদ্ভুত জ্যোৎস্না জ্বলজ্বল করছে জানালার বাইরে। ধারালো তীব্র আলোয় নিথর হয়ে থমকে আছে বাইরে বারান্দার পিলার, মামার শখের বাগান, বাগানের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া ইট-বাঁধানো রাস্তা, রাস্তার শেষ মাথায় সাদা রঙের কাঠের গেটটিও। অলৌকিক নৈঃশব্দ্যে ডুবে আছে বড় রাস্তার ওপারের বন্ধ দোকানগুলো, এমনকি ‘তারা কুটির’ নামের সাদা একতলা দালানটিও।
থমথমে আলোয় সবকিছু যেন পাষাণের মতো সংজ্ঞাহীন অসাড়। মধ্যরাতের অস্বাভাবিক জ্যোৎস্না সেই মুহূর্তে আমার বাবার নিঃসাড় শীতল দেহে মোড়া কাফনের মতো অসহনীয় হয়ে কাঁপিয়ে দিল আমাকে। ঘামে ভিজে উঠল শরীর, গলা-বুক শুকিয়ে গেল। শব্দ করবার শক্তি হারানো আমি অনুভব করলাম, বিশাল এক সাদা কাফন আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে যেন।
আমার অস্ফুট গোঙানির শব্দে পাশের ঘরে ছোট মামার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ‘কী হয়েছে রে? কী হলো?’ বলতে বলতে দরজা খুলে ছোট মামা এ-ঘরে চলে এসেছিলেন। নিভে যাওয়া কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিয়ে বারবার জানতে চেয়েছিলেন, কী হয়েছে আমার! কেন ভয় পেয়েছি। ছোট মামিও উঠে এসেছিলেন। ঘুমন্ত রিনাকে আমার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মামি বললেন – রিনা এ ঘরেই ঘুমোক। আলেকজান বুড়িকেও ডেকে আনলেন। আমার ঘরেরই মেঝেতে বিছানা পাতল আলেকজান।
সারারাত জেগেই ছিল সে। বিছানায় বসে মিহি বিলাপের সুরে দুর্বোধ্য শব্দে গান গাইছিল। মাঝেমধ্যে এসে আমার পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। পায়ের কাছের জানালাটি বন্ধ করে দেওয়ার পরও ঘুম আসে নি আমার। মায়ের জন্য ব্যাকুলতা অনুভব করছিলাম ভীষণ। বাবার শোক নতুন করেই ফিরে এসেছিল।
জানি না, সে রাতে সেই হিংস্র সাদা জ্যোৎস্নাকে আমি কেন ভয় পেয়েছিলাম! সেই বয়সে বোঝা সম্ভব ছিল না ভয়ের উৎসটি আসলে ছিল মনের গভীরেই।
এখন পরিণত বয়সের বিশ্লেষণে বুঝতে অসুবিধা হয় না আমাকে ভয় দেখিয়েছিল নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত কোনো ভবিষ্যৎ, বাবার অকালমৃত্যুই ছিল যার কারণ। সম্ভবত বাবার মৃত্যুর প্রতীক সাদা কাফন আমার অবচেতন মনে ভীষণ ছাপ ফেলেছিল। বাবাকে কাফনে ঢেকে দেওয়ার দৃশ্যটি বহুদিন পর্যন্ত আমি ভুলতে পারিনি। বাবার মৃত্যুর পর অনেকদিন পর্যন্ত বিছানায় বা টেবিলের সাদা চাদর আমি সহ্য করতে পারতাম না, তুলে ফেলে দিতাম। মৃত্যুশোক যেন আমার মনে বিশাল এক সাদা চাদর হয়েই সারাক্ষণ দুলতে থাকত। শোক আর ভয় তখন একাকার হয়ে যেত। ক্রমে সাদা রংটিই হয়ে উঠেছিল আমার জন্য হিংস্র-নিষ্ঠুর এক ভয়াবহ অস্তিত্ব। অনেক বছর লেগেছে এই অস্বাভাবিকতা কাটিয়ে উঠতে।

আট
বাবাকে হারিয়েছি আমরা কম বয়সে, মানুষটিকে চিনে ওঠা তাই সম্ভব হয় নি। বাবা ছিলেন আমাদের কাছে বাবাই। একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে তার চিন্তাভাবনা, জীবনাদর্শ ইত্যাদি জানবার সুযোগ আমরা পাই নি। আত্মীয়স্বজন মহলে, বাড়িতে এবং তার পেশার ক্ষেত্রে তিনি পরিচিত ছিলেন ভদ্র, বিনয়ী, স্নেহপ্রবণ এবং কর্তব্যপরায়ণ মানুষ হিসেবে। কিন্তু তার অন্তর্গত মানুষটিকে কি কেউ চিনেছিল! আমি বা দাদা এবং জাহাঙ্গীর ও বীথি – আমরা বাবাকে যতটুকু পেয়েছি, ছোট ভাইবোনগুলো সে-সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতই হয়েছিল। ভাইবোনদের মধ্যে একমাত্র আমিই বোধহয় বাবাকে নিয়ে ভাবতাম, এখনো ভাবি। এই ভাবনার মধ্যেই রয়েছে অন্য একজন মানুষকে খুঁজে পাওয়ার প্রয়াস। নিজের স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতার সঙ্গে বাবা সম্পর্কে শোনা তথ্যগুলোই আমার অনুসন্ধানের সূত্র।
বাবা শুধু কৃতী ছাত্রই ছিলেন না, ভালো চিকিৎসকও ছিলেন, এ সত্য আমাদের বহু-শ্রুত। কিন্তু জানতাম না, বাবা একজন শিল্পবোধসম্পন্ন জীবন অনুসন্ধানী মানুষ ছিলেন। তার মানস-দৃষ্টি এত অগ্রগামী ছিল যে তার সমসাময়িক মানুষদের সঙ্গে চিন্তাশীলতার আদান-প্রদানের সুযোগ সব সময় তার হতো না, প্রথমত পেশার কারণে, দ্বিতীয়ত সমমনা মানুষের অভাবে। আমার ধারণা, অনেক মানুষের মাঝে থেকেও বাবা ছিলেন বান্ধবহীন নিঃসঙ্গ।
মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা একসময় বাঁশি বাজাতেন, এস্রাজ বাজাবার পারদর্শিতাও ছিল তাঁর। বই পড়বার অভ্যাসও ছিল। তাঁর গান শোনার ব্যাপারটি জানি। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল সংগীত পছন্দ করতেন। অনেক সময় হাসপাতাল থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে গ্রামোফোনে রেকর্ড চড়াতেন। মধ্যরাত অবধি চলতে থাকত কমলা ঝরিয়া বা অন্য কোনো গায়কের উচ্চাঙ্গ খেয়াল, ঠুংরি।
এই মানুষটি ক্রমে কাজের চাপে হয়ে উঠেছিলেন যেন যান্ত্রিক একটি মানুষ। যেন রোগী আর রোগের চিকিৎসাই তার দিন-রাতকে বন্দি করে ফেলেছিল। শেষের দিকে বাবাকে আমার মনে হতো, ভীষণ ক্লান্ত একজন মানুষ। নির্দয় ডায়াবেটিস আর অশেষ কাজের বোঝা যেন তার জীবনীশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল। বাবার জন্য কষ্ট হতো। বুঝে উঠতাম না, কী করে বাবার কষ্টের বোঝা লাঘব করা যায়। এই সময়েই বাবার কর্মবন্দি জীবনের একটি জানালা যেন হঠাৎ খুলে গেল। একঝলক সুবাতাস তাকে উৎফুল্ল করে তুলল। তিনি একজন মনের মতো বন্ধু পেলেন।
ফরিদপুরে সিদ্দিকী সাহেব নামে চট্টগ্রামের এক ভদ্রলোক এসে সরকারি ‘ল’ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেটের’ পদে যোগ দিলেন। অভিজাত পরিবারের সন্তান আমাদের সেই সিদ্দিকী চাচা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, ভদ্র ও মার্জিত এবং সংস্কৃতিমনা মানুষ। আমার বাবার সঙ্গে অল্পদিনেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল তার।
ছোটবেলা থেকে বাবার বন্ধুবান্ধব খুব একটা দেখি নি। দু-চারজন ডাক্তার বন্ধু ছিল তার, তাদেরও কমই দেখেছি। বাবার বন্ধুদের মধ্যে রেডিওলজিস্ট ডা. সোবহানের নাম মায়ের কাছে অনেক শুনেছি। কলকাতার ক্যাম্পবেল হাসপাতালে আমার বাবার সহকর্মী ছিলেন তিনি। কালেভদ্রে এসব ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতো আমার বাবার। পেশার কারণে থাকতেন তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায়। বাবাও ফরিদপুরে এসে হাসপাতাল আর রোগী নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে গেলেন, বন্ধুবান্ধববিহীনই হয়ে যেতে হলো তাকে।
আশ্চর্যভাবেই জীবনের শেষ সময়ে সিদ্দিকী চাচাকে বন্ধু হিসেবে পেলেন। সিদ্দিকী চাচা এলে বাবা বিকেলের রাউন্ড তাড়াতাড়ি শেষ করে চলে আসতেন বাড়িতে, বাইরের ঘরের বারান্দায় বসে একটানা গল্প চলত দুজনের। বাবা খুব হৈ-হুল্লোড় করা মানুষ ছিলেন না। কিন্তু সিদ্দিকী চাচার সঙ্গে গল্প করার সময় তাদের মিলিত হাসি শুনতে পেতাম, বাড়ির ভেতর থেকেই। তাদের বন্ধুত্বের সুবাদে তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারেরও গড়ে উঠল ঘনিষ্ঠতা। আসা-যাওয়া, আদান-প্রদানের সূত্রে সিদ্দিকী চাচার বড় মেয়ে হাসিনার সঙ্গে আমারও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মায়ের সঙ্গে সখ্যের সুবাদে সিদ্দিকী চাচার স্ত্রী হলেন আমাদের প্রিয় খালাম্মা।
ফরিদপুর ছেড়ে আসবার আগে হাসিনাই ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার দুক্লাস ওপরের ছাত্রী ছিল সে। আমার চেয়ে বয়সে ছিল কিছুটা বড়। স্বভাবটি ছিল একেবারেই বারো-তেরো বছরের কিশোরীর মতো। সারাক্ষণ হাসাহাসি, হৈ-হুল্লোড়ে উচ্ছল হাসিনা ছিল ভীষণ প্রাণবন্ত। আমার স্বভাবটি ছিল ওর বিপরীত। ছিলাম মৃদুভাষী, শান্ত স্বভাবের, আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা চাপা ছিলাম বলেই হয়তো উচ্ছলতা আমার মাঝে ছিলই না। অন্তর্মুখী খোলসের ভেতর থেকে হাসিনাই আমাকে বের করে নিয়ে এলো। অবশ্য এর আগে আরো একজন আমার নিজের তৈরি বেষ্টনীটি ভাঙতে চেষ্টা করেছিলেন – তিনি ছিলেন আমাদের গুলে বুবু। গুলে বুবু ছিলেন আমার ছোট ফুফুর খালাতো দেবর বিখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ছোট মেয়ে। ফরিদপুর জেলা ইসকুলের হেডমাস্টার হয়ে এসেছিলেন গুলে বুবুর স্বামী। একমাত্র মেয়ে ছোট্ট মণিকে নিয়ে তারা আলিপুরের চমৎকার একটি দোতলা বাড়িতে থাকতেন। গুলে বুবু তার চাচি, অর্থাৎ আমার ছোট ফুফুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন প্রথমে, তারপর প্রায়ই আসতেন, ভীষণ আসর-জমানো রসিক মানুষ ছিলেন তিনি। ক্রমে হয়ে গেলেন আমাদের প্রিয় ‘গুলেবু’, আমার মা-বাবার প্রিয় পাত্রী। বাবা খুব স্নেহ করতেন গুলে বুবুকে। বাবা টেবিলে খেতে বসলে গুলেবু তার পাশে বসে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিতেন, কথায় কথায় হাসতেন। গুলেবু যেমন হাসতেন, হাসাতেও পারতেন অন্যদের। গুলেবুর মজার গল্পে বাবাও হাসতেন। গুলে বুবুই একদিন পাকড়াও করলেন আমাকে, চোখ পাকিয়ে বললেন – এই তুই হাসিস না কেন রে? সারাক্ষণ ঘরের কোণে বসে পন্ডিত মশাইদের মতো নাকে চশমা এঁটে বই পড়িস। (তখন চোখের অসুবিধার কারণে চশমা পরতে হতো।) আমার কবি-খ্যাতি ততদিনে গুলে বুবুর কর্ণগোচর হয়েছে, আমার ওপর তার হুকুম জারি হলো – যারা কবিতা লেখে, তারা বুঝি সারাক্ষণ মুখ বাংলা পাঁচ করে রাখে। এইটুকু মেয়ে – কোথায় লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে বেড়াবে তা না, সারাক্ষণ বুড়ি হয়ে আছে। মাকে বললেন – চাচি, কাল থেকে ওকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন রোজ।
আমাকে হুকুম দিলেন – বিকেলে আমাদের বাড়িতে যাবি, ব্যাডমিন্টন খেলবি, মনে থাকে যেন।
গুলেবুদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দূরে নয়। খালের কাঠের পুল পেরোলেই কবি হুমায়ুন কবীরদের দেয়ালঘেরা বিরাট এলাকার বাড়ি, পুকুর-বাগান নিয়ে বিশাল জমিদার বাড়ির মতোই। হুমায়ুন কবীরের ভাই জাহাঙ্গীর কবীর সপরিবারে থাকেন সে-বাড়িতে। কিছুদিন পরে তাদের আরেক ভাই আকবর কবীরও এলেন। তাদের বাড়ির ফুটফুটে দুটি মেয়ে আমাদের ইসকুলে এসে ভর্তি হয়েছিল। (নামি আইনজ্ঞ সিগমা হুদা ও সমাজকর্মী খুশি কবীর ওই বাড়িরই মেয়ে।) মায়ের কেমন যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল কবীর পরিবারের এক প্রবীণ সদস্যার সঙ্গে। সেই সুবাদে মা যেতেন ওখানে। মায়ের সঙ্গে বার কয়েক গিয়েছি আমিও।
ওদের বাড়ির শান-বাঁধানো পুকুরঘাট আর ঝাপড়ানো কাঁঠালচাঁপা ফুলগাছটির কথা এখনো মনে আছে। হুমায়ুন কবীরদের বাড়ির সামনের রাস্তার উলটো দিকেই গুলে বুবুদের বাড়িটিও ছিল সুন্দর একটি দোতলা, বড় বড় গাছপালায় ঘেরা। ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য মাঠও ছিল।
গুলে বুবুদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতে করতেই স্বতঃস্ফূর্ত সহজ মানুষ হয়ে উঠলাম। সেই সঙ্গে ক্রমে আর এক গুলেবুকেই যেন পেলাম। বইপত্র ছিল সে-বাড়িতে যথেষ্ট। দুলাভাইয়ের তো বটেই, সুরসিকা, সহজ আলাপী আমাদের গুলে বুবুরও পড়ালেখার পরিধিটি যে বিস্তৃত, ধারণা করি নি। বই নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে তুমুল আলোচনা চলত। সে আলোচনায় আমিও হয়ে উঠলাম মুক্ত কণ্ঠ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ একবার দিন কয়েকের জন্য এসেছিলেন ফরিদপুরে, গুলে বুবুদের বাড়িতে বেড়াতে। ছোটখাটো মানুষটিকে দেখতাম, সারাক্ষণই। মগ্ন থাকতেন পড়ায়, নয়তো নামাজে। গুলে বুবু আমাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন – এটা ডাক্তার চাচার বড় মেয়ে। বাবাকে চিনতেন শহীদুল্লাহ্ সাহেব, জিজ্ঞেস করলেন – আমাদের আবুল খায়েরের মেয়ে?
আমার বাবার নাম আবুল খায়ের মোহাম্মদ সিদ্দিক। বাইরে তিনি ডা. সিদ্দিক নামেই পরিচিত ছিলেন, আত্মীয়-মহলের গুরুজনেরা তাকে আবুল খায়েরই বলতেন। গুলে বুবু তার বাবাকে জানিয়ে দিলেন – ও কিন্তু খুব ভালো কবিতা লেখে। লেখাপড়ায়ও খুব ভালো। বিদগ্ধ মানুষটি বই থেকে মুখ তুলে মৃদু হাসলেন – কবিতা লেখো? খুব ভালো।
এর পরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ি কি না।
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির সব কবিতা প্রায় মুখস্থই আমার। তার গল্প-উপন্যাসও অনেক পড়ে ফেলেছি। এসব কিছুই বলতে পারি নি। বলেছিলাম – পড়ি।
গুলে বুবুই অগ্রণী হয়ে আমার বইপড়ার বিবরণ দিতে শুরু করেছিলেন। বলা বাহুল্য, খুবই সংকোচ বোধ করেছিলাম।
গুলে বুবু খুব কাছের আত্মীয় না হলেও তাকে অত্যন্ত আপনই মনে করতাম। চিন্তাশীলতার বিকাশে আমাকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতে গুলে বুবুর ভূমিকাটি আজো ভুলি নি।
গুলে বুবুর শ্বশুরবাড়ি ছিল চট্টগ্রামে, পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনার মেয়ে হয়েও তার বাবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির সুবাদে ঢাকাতে কাটিয়েছেন অনেক দিন। কিন্তু ঢাকার ভাষা নয়, গুলে ববুর মুখেই চট্টগ্রামের ভাষা প্রথম শুনেছিলাম। অত্যন্ত ভালো মানুষ তার স্বামী কিন্তু চট্টগ্রামের বাংলা ভাষা বলতেন না, শুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয় উচ্চারণে কথা বলতেন।
সিদ্দিকী চাচার বাড়িতেও চট্টগ্রামের বাংলাতেই কথা বলত সবাই। কিন্তু যখন তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলত, কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা ভাষাই বলত। ওদের সঙ্গে মেলামেশার কারণে চাটগাঁয়ের বাংলা ভাষা বেশ বুঝতে পারতাম। কিছু কিছু বলতেও শিখে ফেলেছিলাম। সিদ্দিকী চাচার পরিবারটিও ছিল তখনকার অন্যান্য আলোকপ্রাপ্ত মুসলমান মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই, জীবনযাপনে সাধারণ কিন্তু মননচর্চায় ঊর্ধ্বগামী। এখন নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সে-সময়ে যেসব মুসলমান মধ্যবিত্ত পরিবারবলয়ে আমার বিচরণ ছিল, যেমন – খালেদাদের পরিবার, গুলে বুবুরা কিংবা সিদ্দিকী চাচার পরিবার এবং আমরা, আমাদের সবারই অবস্থান ছিল একই স্তরে। এমন পরিবারগুলোই উচ্চশিক্ষাপ্রসূত আধুনিকতা এবং নিজস্ব ঐতিহ্যের সমন্বয়েই গড়ে তুলছিল পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) আলোকিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শিক্ষাকেই এসব পরিবারে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। অথচ জীবনযাপন ছিল অনাড়ম্বর। জাঁকজমক বা বিলাসিতাকে এই উঠতি মধ্যবিত্ত পরিবারে একেবারেই স্থান দেওয়া হতো না। ‘সিম্পল লিভিং হাই থিঙ্কিং’ – এ শিক্ষাই সন্তান-সন্ততিকে দেওয়া কর্তব্য মনে করা হতো।
আমাদের জীবন তাই গড়ে উঠছিল বিলাসবর্জিত, আড়ম্বরহীন, অথচ শিক্ষা অনুরাগী হয়েই।
উচ্চশিক্ষা এবং সাধারণ জীবনযাপনই ছিল মধ্যবিত্তের অহংকার। পরবর্তী কয়েকটি দশকে এর পরিবর্তন ঘটে নি। অস্বীকার করা যায় না, এই অহংবোধই ভোগবাদের অবক্ষয় থেকে মধ্যবিত্তকে রক্ষা করেছিল; দেশের, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তো বটেই, নিজস্ব জাতীয়তা বোধ সৃষ্টিতেও বলিষ্ঠ অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছিল এদেশের মধ্যবিত্তরাই।
আজকের দিনে মধ্যবিত্তের সেই অহংকারকে বিলাস ও আড়ম্বরপ্রয়াসী জীবনাদর্শে অর্থহীনই মনে হয়। হয়তো সেই কারণেই মধ্যবিত্তরা এ যুগের অগ্রগতিতে প্রতিনিধিত্বে ব্যর্থ হচ্ছে।
কিন্তু সেই বায়ান্ন-তেপান্নতে সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, চিকিৎসক বা আইনজ্ঞ – সবারই জীবনযাত্রার ধরন ছিল একই রকম, খুবই সহজ ও সাধারণ।
সিদ্দিকী চাচারা ফরিদপুরে এসে প্রথমে যে-বাড়িতে ছিলেন, সে-বাড়ি তার পরিবারের সদস্য সংখ্যার জন্য বেশ ছোটই ছিল, তিনটি মাত্র কক্ষের এক ঘরে থাকতেন চাচা ও চাচি, আর একটিতে তার বড় তিন ছেলে – হাসান ভাই, মোহসীন ভাই ও হোসেন ভাই। অন্যটিতে হাসিনা, আবু, মাসুদ ও শিরি। সিদ্দিকী চাচার ছেলেরা সবাই ছিল অত্যন্ত মেধাবী।
মোহসীন ভাই তখন বোম্বাইয়ের মেরিন একাডেমিতে পড়ছেন। থাকতেন ‘ডাফরিন’ নামের ব্রিটিশ জাহাজে, পাশ করে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মেরিন কর্মকর্তা হয়েছিলেন। হোসেন ভাই ম্যাট্রিকে মেধাতালিকায় প্রথম পাঁচজনের মধ্যে স্থান পেয়েছিলেন। পরে সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, হয়েছিলেন আমলা। আবুও ছিল কৃতী ছাত্র। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গেই পাশ করেছিল। পরে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রীও হয়। এল কে সিদ্দিকী নামেই সে পরিচিত। মাসুদ আর সবার ছোট বোরহানও ছিল ভালো ছাত্র। বোরহানও কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়। ভাবলে অবাক হতে হয়, ফরিদপুরে তাদের বাড়ির এক ঘরেই থেকে সব কটি ভাই পড়ালেখা করত। পরীক্ষায় ভালো ফল করবার জন্য তাদের ভিন্ন ভিন্ন ঘর, পড়ার টেবিল ইত্যাদির দরকার হয় নি। বিভিন্ন বিষয়ে গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন বা এখনকার মতো অভিজ্ঞ কোচিং সেন্টারে যেতে হয় নি।
আমাদের সেই সব দিনে, আমরা ভাইবোনেরা একই ঘরে বসে লেখাপড়া করতাম। আলাদা পড়ার ঘর আমাদেরও ছিল না। প্রায় সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা এভাবেই লেখাপড়া করে পরীক্ষার দেয়াল পার হয়ে যেত। সিদ্দিকী চাচার পরিবারও ছিল এমনি সহজ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। অনেক বছর পরে সীতাকুন্ডের বাড়বকুন্ডে চাচার গ্রামের বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম। সিদ্দিকী চাচা তখন আর বেঁচে নেই। খালাম্মা একাই থাকেন এলাকার দেশের বাড়িতে। বাড়বকুন্ডে চাচার সেই বিশাল এলাকার বাড়ি অবাক করেছিল আমাকে। ভাবতে হয়েছিল, এমন সম্পদশালী পরিবারের সন্তান সিদ্দিকী চাচা ফরিদপুরে কত সাধারণ অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন। আজকের দিনের প্রাজ্ঞজনেরা কেউ হয়তো বলতে পারেন, সদ্য জন্ম নেওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের জীবনযাত্রা তখন উচ্চ মান অর্জন করতে পারে নি, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল তখনো তাদের নাগালের বাইরেই ছিল, সুতরাং অতিসাধারণ জীবনযাপন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এমন ধারণা অন্যদের প্রভাবিত করলেও করতে পারে, তবে আমি জানি এবং আমার সমসাময়িক যারা, তারাও জানেন, সে-সময়ে শিক্ষা এবং নৈতিকতার মান এখনকার মানের চেয়ে নিঃসন্দেহে ওপরে ছিল। ধারণা করলে ভুল হবে না হয়তো, মধ্যবিত্তের জীবনের নৈতিকতা ও শিক্ষার মানটি সর্বদেশে-সর্বকালে একই হয়ে থাকে। আত্মবিশ্বাসী আদর্শ খুব সহজে অবক্ষয়ে নষ্ট হয়ে যায় না। সিদ্দিকী চাচা ও আমার বাবার বন্ধুত্বের মূলে হয়তো ছিল একই আদর্শে বিশ্বাস, ছিল নৈতিকতার একাত্মতা। সিদ্দিকী চাচার ছেলেমেয়ের সবাই গান গাইতে পারার গুণটি ছিল। চাচির কাছে শুনেছি, চাচা নিজেও একসময় ভালো গান গাইতেন। হাসিনারও গানের গলা ভালো ছিল। ভাইদের মতো বই অন্তপ্রাণ সে ছিল না। লেখাপড়ায় মন বিশেষ দিত না, তবে খারাপ ছাত্রীও ছিল না। বছর বছর ঠিকই পাশ করে যেত। তাকে নিয়ে তবু তার মায়ের বিশেষ দুশ্চিন্তা ছিল, প্রায়ই বলতেন – এই মেয়েকে নিয়ে যে কী করি, সারাক্ষণ হাসাহাসি আর আড্ডা – ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ও যে কী করে পাশ করবে!
খালাম্মা ওকে রান্না শেখানোর চেষ্টাও করছিলেন। হাসিনার জন্য সেটাও খুব একটা পছন্দসই কাজ ছিল না। সিদ্দিকী চাচার সবার ছোট মেয়েটি কচি হঠাৎ মারা যাওয়ার পর থেকে খালাম্মার শরীর একেবারেই ভালো যাচ্ছিল না। ছোট ভাইবোনগুলোর দেখাশোনা, রান্না করে খাওয়ানো হাসিনাকেই করতে হচ্ছিল। এত দায়িত্ব নিয়েও হাসিনা ছিল হাসিনাই। এর মধ্যে একদিন সে আমাকে চিরকুট পাঠাল – ‘তাড়াতাড়ি চলে এসো। আজ একটা মজা হবে।’
চিরকুট বাহক আবু। বয়সে আমার চেয়ে কিছু ছোট, পড়ত আমার ক্লাসেই, রোগা-পটকা বারো বছরের আবুর কণ্ঠস্বর ছিল মেয়েদের মতো। গান সে ভালো গাইত, তবে ওর কণ্ঠস্বরের জন্য আমি ওকে ঠাট্টা করতাম। রেগে গিয়ে ও আমাকে একদিন বলল – তুমি তো বুড়ি দাদি। এর পর থেকে ও আমাকে দাদি বলেই ডাকত। চিরকুট আমার হাতে দিয়ে আবু বলল – তোমাকে এখনই যেতে হবে দাদি। আপা বলে দিয়েছে। আবুর সঙ্গেই গেলাম ওদের বাড়িতে। হাসিনা তখন রান্না করছে। দিনটা ছিল ছুটির দিন। সবার ইসকুল বন্ধ। ছুটির দিনে রান্নাঘরে বন্দি হয়ে থাকাটা হাসিনার জন্য ছিল প্রচন্ড নিরানন্দের ব্যাপার।
আমাকে বলল – একটু দাঁড়াও, একটা রান্না বাকি আছে, এটা চুলোয় চাপিয়েই তোমাকে খুব মজার জিনিস দেখাব।
রান্না চুলোয় চাপিয়েই হাসিনা আমাকে মজার জিনিস দেখাতে নিয়ে গেল। যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে খালাম্মার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিল, তিনি তখন ঘুমুচ্ছিলেন।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ সাবধানেই বাড়ির বাইরে এলো হাসিনা। অবশেষে মজার ব্যাপারটি উদ্ঘাটিত হলো। বাড়ির কাছেই বিরাট এক কুলগাছ। পাকা কুলে ভরা গাছটিই হলো সেই বিশেষ ঘটনা। গাছে উঠে ডাল ঝাঁকিয়ে কুল পাড়তে শুরু করল হাসিনা। গাছে উঠবার দক্ষতা আমার নেই। হাসিনার হুকুমেই দুহাতে কুল কুড়িয়ে জমা করছি। সেই চরমক্ষণে খালাম্মা বেরিয়ে এলেন বাইরের বারান্দায়, মজার ঘটনার যবনিকাপাত হলো। ওদিকে চুলোয় চাপান তরকারি পুড়ে কয়লা। লাঞ্ছনা-গঞ্ছনা কম জুটল না হাসিনার কপালে। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি-কান্নাকাটি করবার পর হাসিনা বসে গেল কুলের চাটনি তৈরি করতে। তার হাসাহাসিতে বাড়ি সরগরম। খালাম্মা হোসেন ভাইয়ের কাছেই নালিশ দিলেন – এত বড় মেয়ে যদি কুলগাছে উঠে বানরের মতো ঝাঁপাঝাঁপি করে, লোকে কী বলে? লোকে কী বলে বা না বলে, এসব নিয়ে হাসিনার মোটেই মাথাব্যথা নেই, সে তখন কুলের চাটনির স্বাদ নিতে ব্যস্ত।
হাসিনা যতই উচ্ছল, তরলমতি হোক, সে ছিল আমার লেখার মনোযোগী পাঠিকা। তা ছাড়া আমার গল্পের বইয়ের জোগানদাতাও। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলো তার কাছ থেকে নিয়েই পড়েছি।
নতুন কিছু করে সবাইকে চমক দেওয়ার প্রবণতাও হাসিনার যথেষ্ট ছিল।
আমাকে সে অকৃত্রিম বন্ধুই করে নিয়েছিল, আর সে-কারণেই হয়তো তার সদা-উদ্ভাবিত নতুন চমকগুলোতে আমাকে সঙ্গী করে নিতে ভুল হতো না হাসিনার।
হাসিনার সাংগঠনিক ক্ষমতাকে এখনো প্রশংসা করি আমি। সে আমাকে বইয়ের জগৎ থেকে বাইরে নিয়ে এসেছিল। আমাকে সে শুধু প্রাণপ্রাচুর্যের আনন্দই উপভোগ করতে শেখায়নি, তার কাছেই আমি লেখাপড়ার জগতের বাইরে আরো যে কিছু সৃজনশীল কাজ রয়েছে, সেটা জেনেছিলাম; অনুশীলনও করেছিলাম। হঠাৎ করে একটি ‘চড়ুইভাতির’ আয়োজন করা বা ওদের বাড়ির সামনের শুকিয়ে যাওয়া বিলে নেমে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যাওয়া, পায়ের পাতা ডোবা বিলের জল থেকে কচুরিপানার ফুল বা লাল শাপলা ফুলের গুচ্ছ নিয়ে ফিরে আসার মধ্যে শুধু বন্ধনহীন আনন্দই ছিল না, আত্মবিশ্বাসের ভিত তৈরির প্রেরণাও যথেষ্ট ছিল।
হঠাৎ একদিন হাসিনা একটা নতুন পরিকল্পনার খবর দিল, চিরকুট পাঠিয়ে নয়, নিজেই এসে গেল, বলল – একটা বিচিত্রানুষ্ঠান করব। তার প্রস্তাবে আস্থা রাখতে পারি না, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো আর কুলগাছে লাফিয়ে উঠে কুল পাড়া নয়, কিংবা জ্যোৎস্নারাতে বারান্দায় বসে পছন্দের গানগুলো একটার পর একটা গেয়ে চলা নয়। রীতিমতো বড় দায়িত্বের ব্যাপার। বলি – কী যে বলো, বিচিত্রানুষ্ঠান কি মুখের কথা? কত কী দরকার, ওসব আমরা পারব না।
আমার আপত্তি আমলেই আনে না হাসিনা। একাই সব পরিকল্পনার ছক তৈরি করে ফেলে। অনুষ্ঠান হবে আমাদের দুই বাড়ির ছোটদের নিয়ে। নাচ-গান, কবিতা আবৃত্তি ওরাই করবে। স্টেজ তৈরি হবে হাসিনাদের বাড়ির বারান্দায়। দর্শক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হবে আমাদের দুই বাড়ির বড়দের। পাড়ার ছোটরাও আসবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রযোজক-পরিচালক আমরাই – আমি আর হাসিনা।
বিচিত্রানুষ্ঠান পরিচালনার মতো যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা আমার একেবারেই নেই। হাসিনারও সম্ভবত ছিল না। ধরে নিলাম, হাসিনা আসলে একটা মজার ঠাট্টাই করছে আমার সঙ্গে।
হাসিনা তার সিদ্ধান্তে অটলই থেকে যায়। শুরু হয় আয়োজন। ইসকুলে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। সুতরাং, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে রিহার্সাল করাতে কোনো অসুবিধে নেই। মাত্র কয়েকদিনের রিহার্সালেই সবাইকে তৈরি করে ফেলল হাসিনা।
সিদ্দিকী চাচারা তখন জেলা ইসকুলের কাছে বেশ বড় একটি বাড়ি পেয়েছেন, মালপত্তর নেওয়া হচ্ছে অল্প অল্প করে। সেই খালি বাড়িতেই চলল রিহার্সাল। অনুষ্ঠানটি সেখানেই মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থা হলো। ও-বাড়ি থেকে আনা চৌকি বারান্দায় টেনে এনে তৈরি করা হলো স্টেজ। বারান্দার সামনের পিলার দুটিতে দড়ি বেঁধে শাড়ি ঝুলিয়ে পর্দার ব্যবস্থা হয়ে গেল। শিরি নাচতে পারত ভালো। তবু কদিন ধরে তাকে নাচের তালিম দেওয়া হলো। ফাংশনের দিন সকালেই বোরহান হঠাৎ বায়না ধরল – শিরির সঙ্গে সেও নাচবে। তাকে যতই বলা হয় – তুমি ছেলে, ছেলেরা নাচে না। বোরহান ততোই নাছোড়বান্দা – নাচবেই সে। বোরহান সেই ছোট্ট বয়সেই সুন্দর গান গাইত। হাসিনা তাকে বলল – তুমি তো গান করবে। নাচতে তুমি পারবে না। নাচ অনেক কঠিন। শুরু হলো বোরহানের কান্না। শেষ পর্যন্ত তাকে নেওয়া হলো নাচে।
বিচিত্রানুষ্ঠান ভালোই জমল। সমবেত সংগীত, কবিতা আবৃত্তি, ক্যারিকেচর, নাচ নিয়ে জমজমাট ফাংশান। বারান্দার সামনে মাঠে গোটা কয়েক চেয়ার দিয়ে দর্শকদের বসবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। (ভিড় অবশ্য জমে নি।) শিরি ও বোরহানের যুগল নাচ ছাড়াও বোরহানের একক নৃত্য সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। বোরহানকে আমি আর হাসিনা সাজিয়ে দিয়েছি। শিরির ফ্রক আর হাসিনার ওড়নার ঘাঘরা পরা ছোট্ট বোরহানকে ফুটফুটে একটা মেয়ের মতোই লাগছিল দেখতে। মাথায় বাঁধা লাল রুমাল উড়িয়ে ঘুঙুরের শব্দ তুলে বোরহান মঞ্চে এলে ওকে চেনাই যাচ্ছিল না, পর্দার পেছনে হারমোনিয়াম বাজাল হাসিনা। আমি, শিরি, আবু আর হাসিনা গাইলাম – নাচে ইরানি মেয়ে… গানের সঙ্গে চমৎকার তাল ফেলে স্টেজে নাচল বোরহান। বোরহান যে এত ভালো নাচবে, আমরা ভাবতেই পারি নি।
বেশ সুশৃঙ্খলভাবেই শেষ হলো বিচিত্রানুষ্ঠান। খালাম্মা বোধহয় জানতেন না, বোরহানকে আমরা মেয়ে সাজিয়ে নাচতে নামিয়েছি, অনুষ্ঠানে অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারেন নি, কিন্তু বোরহানের নাচের খবর পৌঁছেছে তার কাছে। সফল পরিচালক-প্রযোজক বাড়িতে পা রাখতেই খালাম্মা তাকে পাকড়াও করলেন – কোন সাহসে তুই বোরহানকে মেয়ে সাজিয়ে নাচিয়েছিস? জানিস না, ছেলেদের মেয়ে সাজানো গুনাহর কাজ। এত বড় নাদান মেয়ে হয়েছিস তুই। মনে আল্লাহর ভয়ও নাই? ইত্যাদি বকাবকি চলল।
খালাম্মা ছিলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নামকরা পীর বাড়ির মেয়ে, ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলায় নির্ভুল। অনুষ্ঠানের সফল সংগঠকের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো যুক্তিই হালে পানি পেল না। খালাম্মার বকাবকিতে কেঁদে ভাসাল হাসিনা। শেষ পর্যন্ত সিদ্দিকী খালাম্মার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতির শান্ত হলো।
অনুষ্ঠান পরিচালনায় হাসিনার অধীনে শিক্ষানবিশিটা কিন্তু আমার বিফলে যায় নি। চাঁদপুরে ইসকুলের বার্ষিক বিচিত্রানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সাহস হয়তো হাসিনার দেওয়া শিক্ষা থেকেই পেয়েছিলাম। বড় হয়ে আমাদের কাকরাইলের বাড়ির বারান্দায় ছোট ভাইবোনদের দিয়ে টুনটুনি পাখি ও নাক কাটা রাজার (গল্পের নাট্যরূপ আমারই দেওয়া) নাটক মঞ্চস্থ করেছিলাম, ইডেন ডিগ্রি কলেজে পড়বার সময়। ‘কালচারাল উইকে’ মঞ্চস্থ আমার লেখা নাটক সয়ম্বরার পরিচালনা আমিই করেছিলাম।
এসবের নেপথ্যে হয়তো ছিল আমার কৈশোরের বন্ধু হাসিনাই। চাচির প্রবল বিরোধের কারণে নাচে পারদর্শিতা দেখানো বোরহান হয়তো আর কোনো অনুষ্ঠানে নাচবার সুযোগ পায় নি। বড় হয়ে সে সংগীতশিল্পী হিসেবে সুনাম অর্জন করে। টিভি, রেডিওতে তার গান শুধু আমাকেই নয়, অন্য শ্রোতাদেরও মুগ্ধ করেছে।
আর হাসিনা তার মায়ের আশঙ্কাকে ব্যর্থ করে ম্যাট্রিকে ভালোভাবেই পাশ করে গিয়েছিল। চঞ্চল দুরন্তপনায় পটু মেয়েটিকে কিন্তু কলেজের জীবন শেষ করবার সুযোগ না দিয়েই স্বামীর ঘর করতে পাঠানো হলো। তবু সে আমাকে যে উচ্ছল কৈশোরের দিনগুলো উপহার দিয়েছিল, আমার জীবনের স্মরণীয় স্মৃতি হয়েই আছে সেগুলো।

নয়
ফরিদপুরে আনন্দময় সেই সব দিনগুলোর পরিসমাপ্তি ঘটতে দেরি হলো না, সিদ্দিকী চাচারা বদলি হয়ে চলে গেলেন ফরিদপুর থেকে। আমি হারালাম প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা আমার বন্ধুটিকে, বাবাও বন্ধুহীন হলেন, হাসপাতাল আর রোগী নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আবার।
এর কিছুদিন পর থেকেই বাবার শরীরটা খারাপ হতে শুরু করল।
বিকেলে রাউন্ডে গিয়ে ফিরে আসেন তাড়াতাড়ি। বলেন, আজ কাজ কম, তাই তাড়াতাড়িই আসতে পারলাম।
বলেই বিছানায় শুয়ে পড়েন। মা কিন্তু বাবার অবস্থা বুঝতে পারছিলেন, খুব চিন্তিতও হচ্ছিলেন। মা তাকে বলতে শুরু করলেন – এবার কদিন ছুটি নিয়ে বাড়িতেই বিশ্রাম করো না হয়।
বাবা নীরব থাকেন এবং যথারীতি দুবেলাই হাসপাতালে যান। অবশ্য বাইরে রোগী দেখতে যাওয়াটা বন্ধ করেছিলেন। এই সময় থেকেই বাবার মাঝে কেমন পরিবর্তন দেখা দিল। দুপুরে স্বল্পকালীন বিশ্রামটি বাদ দিয়ে একাকী বসে থাকেন বাইরের বারান্দায়। একটার পর একটা সিগারেট খান। (বাবার সিগারেট খাওয়া কবে থেকে শুরু হয়েছিল, ঠিক মনে পড়ে না।)
কী যেন ভাবনায় ডুবে থাকেন। বাবার এই উদাস আত্মমগ্নতা অন্যের দৃষ্টিতে ধরা পড়লেও এটা নিয়ে তেমন করে ভাবেন নি হয়তো কেউ। আমি কিন্তু বিচলিত হয়েছিলাম। ছোট থেকেই আমি কোনো কিছুর দরকার হলে বাবাকেই বলতাম, এমনকি পেনসিলের সিস ভেঙে গেলেও বাবাকেই জানাতাম। আমার নতুন অঙ্ক খাতার দরকারের কথা বলতেই বারান্দায় গেলাম, গভীর আত্মমগ্ন ভঙ্গিতে বাবা বসে আছেন চেয়ারে। হাতে ধরা সিগারেট জ্বলে যাচ্ছে অনর্থকই। দুবার ডেকেও সাড়া পেলাম না। তৃতীয়বারের ডাকটি শুনলেন বাবা। ঘুম ভাঙা ঘোর নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। জানি না কেন, বাবার সেই অন্যমনস্ক উদাস দৃষ্টি আমাকে কষ্ট দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, বাবা যেন অনেক দূরে চলে গেছেন, চোখে পানি এসে গিয়েছিল আমার।
খুব আস্তে বাবা জিজ্ঞেস করলেন – কী মা! কিছু বলবে?
কান্না লুকিয়ে কোনোরকমে বললাম – আমার অ্যালজেব্রা খাতা শেষ হয়েছে, নতুন খাতা কিনতে হবে। বাবা মৃদু মাথা নাড়লেন – ঠিক আছে। খাতা আনিয়ে দেব। যাও।
ছুটে চলে এসেছিলাম। একা ঘরে কেঁদেছিলাম অনেকক্ষণ। কেবলই মনে হয়েছিল, আমার চেনা বাবা বুঝি হারিয়ে গেছেন, তাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। ইচ্ছে হয়েছিল, বিষণ্ণতার দেয়াল ভেঙে বাবাকে আগের বাবা করে তুলি।
বাবার বিষণ্ণ ভঙ্গি, চিন্তামগ্নতার কারণ সেদিন আমি বুঝি নি। ডাক্তার ছিলেন বলেই বাবা হয়তো বুঝেছিলেন, তার জীবনের সময় সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। বাবার পৈতৃক সহায়-সম্পত্তি সবই রয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। ঢাকার কাকরাইলে কেনা বাড়িটি ছাড়া এদেশে তার আর কিছু নেই। এতগুলো ছেলেমেয়ের দায়িত্ব তিনি কার কাছে দিয়ে যাবেন। হয়তো সেই অনিশ্চয়তায় বিভ্রান্ত হচ্ছিলেন। হতে পারে, এসব নিয়েও বাবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন না, হয়তো তিনি তার ছেলেবেলা, ছাত্রজীবন, তার মা-বাবা বা অন্যদের সঙ্গে কাটানো স্মৃতির রোমন্থন করছিলেন মনে মনে। অথবা কোনো জটিল রোগীর রোগনির্ণয়ের সঠিক চিকিৎসার সম্ভাবনা খুঁজে চলেছিলেন।
তবু সেই সময়ে সিদ্দিকী চাচাকে মনে পড়েছিল। ভেবে নিয়েছিলাম, সিদ্দিকী চাচা থাকলে বাবা এমন হতে পারতেন না। বাবা সুস্থ থাকতেন। আগের মতোই হাসতেন, গল্প করতেন। রাতে রেকর্ড বাজিয়ে গান শুনতেন। আমি আমার চেনা বাবাকে ফিরে পেতাম।
আমি মা বা আমাদের পরিবারের কেউ তখন ভাবি নি, মাত্র অল্প কটি দিন পরেই মাত্র মধ্য চল্লিশ বয়সে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।
বাবার মৃত্যুঘটনার সঙ্গে এমন এক ঘটনার যোগাযোগ রয়েছে, যেটি আমি আজো বিস্ময়ের সঙ্গেই স্মরণ করি, নিজেকেই প্রশ্ন করি – এমন মৃত্যু কি সবার জন্য আসে?
বাবা আমাকে আবদ্ধতার ‘আল’ ভেঙে জীবনের বিস্তৃত বিশাল ব্যাপ্তির পথ চিনিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাবা তো কখনো বলেন নি, মহৎ কাজ মানুষের মৃত্যুকেও মহৎ করে তুলতে পারে। তবু আজো আমার বাবার মৃত্যু আমার কাছে মহৎ মৃত্যুই হয়ে আছে।

কদিন পরেই জ্বর নিয়ে বাবা হাসপাতাল থেকে ফিরলেন, বুকে বোধহয় ব্যথাও ছিল। এতদিন নিজের চিকিৎসা নিজেই করছিলেন, এবারই সম্ভবত উপলব্ধি করলেন, বিশ্রাম নেওয়াটা তার জন্য অবধারিত। মাকে বললেন – অনেক দেরি করে ফেলেছি। এ মাসেই ছুটির দরখাস্ত দেব।
বাড়িতেই ছিলেন বাবা, বিছানায় শুয়ে বইপত্র পড়ে দিন কাটাচ্ছিলেন।
এই সময়েই দূরের গ্রাম থেকে মরণাপন্ন অবস্থায় এক রোগী এলো হাসপাতালে। বাবা তার অসুস্থতার বিষয়ে শুনলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাক্তারের কাছে, বুঝলেন রোগীটিকে বাঁচাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে তখনই অপারেশান করা দরকার। জুনিয়র সার্জেনকে ডেকে বলে দিলেন – তোমরা ও.টি. রেডি করো, আমি এখনই আসছি।
বাবা বিছানা ছেড়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। মা তাকে নিরস্ত করবার অনেক চেষ্টা করলেন, বারবার বললেন – তোমার শরীরের এই অবস্থা, বুকে ব্যথা হচ্ছে, এ অবস্থায় কী করে তুমি অপারেশান করবে?
বাবা শুধু বললেন – তাড়াতাড়ি অপারেশান না হলে রোগীকে বাঁচানো যাবে না।
মা তবু বাধা দেন – তুমি ছাড়া কি আর কেউ নেই অপারেশান করবার জন্য? হাসপাতালে তো আরো ডাক্তার রয়েছে। বাবা অটল, বললেন, ওরা পারবে না, আমাকেই করতে হবে অপারেশানটা।
কোনো কথাই বাবা শোনেন না, সবার নিষেধ উপেক্ষা করে চলে যান হাসপাতালে।
অপারেশানটা ছিল বেশ জটিল। সময় লেগেছিল শেষ করতে। সার্থক অপারেশানের শেষে বাড়ি ফিরেই বিছানা নিলেন বাবা। এর পরই তার হার্টে শেষ স্ট্রোকটি হয়েছিল। তখনো নিজের চিকিৎসা নিজেই করছেন। হাসপাতালের এক ডাক্তার সারাক্ষণ ছিল তার পাশে। বাবার নির্দেশেই বাবাকে ইনজেকশন দিয়েছিল, পালস আর প্রেসার চেক করছিল। অনেক রাতে বাবার অবস্থার অবনিত হলো, জ্ঞান হারান নি তিনি। ডাক্তারকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন তার পালস কত, প্রেসার কতটা নেমেছে? একসময় নিজেই বলে দিলেন – হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এসো, আমাকে অক্সিজেন দাও।
নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল যথেষ্ট। পরদিন সকালে বাবা তার শেষ নিশ্বাসটি নিয়ে চলে গেলেন চিরদিনের মতো।
নিজের জীবনের বিনিময়ে যে রোগীটির জীবন বাঁচালেন বাবা, সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। হাসপাতালের স্টাফ নার্স মায়াদি এসে বলেছিলেন – মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা রোগীটি নাকি খুব কান্নাকাটি করেছিল আমার বাবার জন্য। কাঁদতে কাঁদতেই বলছিল – ‘ডাক্তার সাহেব তো ফেরেশতা আছিল। আল্লায় ফেরেশতারে পাঠাইছিল আমার লাইগ্যা। আল্লাহ আমারে ফেরশেতা দেখাইছে।’
মায়াদির দেওয়া এসব খবর সেদিন আমাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করে নি। জীবনে প্রথম প্রিয়জন বিচ্ছেদের শোকে আমি তখন বোধশক্তি হারিয়েছিলাম। সারাক্ষণ বাবাকেই দেখছিলাম, দেখছিলাম বাবা শুয়ে আছেন খাটে, যেন অপার শান্তিতে ঘুমিয়ে গেছেন, বাবার অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেওয়া হচ্ছে। দেখছি, বাবাকে কাফনে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বাবা চলে যাচ্ছেন সাদা কাফনের আড়ালে। আমার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে কেবলই দুলছে বাবার কাফন। আমার ছোট পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে বিশাল সাদা এক কাফন।
সেদিন বাবার মৃত্যুই কেবল দেখেছি, আমি, দেখতে পাই নি একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসকের মহান মৃত্যু। বুঝি নি, সেটাই হবে আমার জীবন-নদীতে ভাসমান খেয়ার শেষ পারানির কড়ি। তাকে মুঠোয় নিয়ে আমাকে পেরিয়ে যেতে হবে ঢেউসংক্ষুব্ধ সময়ের কাল নদী।

– ও মাইয়া। আর কত ঘুমাইবা? জাহাজ তো নারায়ণগঞ্জে ঘাটে ভিড়া যাইতাছে!
প্রৌঢ়া সহযাত্রিণী ডেকে তুললেন আমাকে। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! উঠে বসলাম। স্টিমার এখন শীতলক্ষ্যা নদীতে। ঘোর কেটে গেছে। মনে করতে পারলাম, সকালে চাঁদপুর ছেড়ে এসেছি; চলেছি ঢাকায়, মায়ের কাছে। মা ছোট মামাকে চিঠিতে জানিয়েছেন, আমাকে ঢাকায় পৌঁছে দিতে। মায়ের ইচ্ছে, পাশ করে আমি চাঁদপুর কলেজে নয়, ঢাকার ইডেন কলেজে পড়ব।
পাশ করবার পরে মা আমাকে ইডেন কলেজেই ভর্তি করে দিয়েছিলেন। অঙ্কে খারাপ করবার ফলে অন্য বিষয়গুলোতে প্রথম বিভাগের নম্বর পেলেও, প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হতে পারি নি আমি।
জাহাজ জেটিতে ভিড়ে গেল। ছোট মামার সঙ্গে নেমে এলাম ঘাটে। উঠে বসলাম ভাড়ার ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি উড়ে চলেছে ঢাকার পথে। চলেছি আমার শেষ অভিবাসন – কাকরাইলের মাঠের ধারে সেই বাড়িটির দিকে, চলেছি বিষণ্ণ ধূসর নগরীটির কাছে। যে-নগরী ক্রমাগতই ইতিহাস তৈরি করে চলে, হয়তো আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে অজানা কোনো ইতিহাস, যেন ইতিহাসের এক নগরীতেই এই যাত্রা আমার। তখন কি সে-কবিতাটা তৈরি হচ্ছিল মনে!
… আমরা সবাই একদিন
হেঁটে হেঁটে হিমালয়ের
চূড়ায় উঠে যাব।
তারপর কোনো
প্রাচীন নগরীর অন্ধকার গর্ভে
আমি, তুমি
আমাদের ইতিহাস
খুঁজে পাব।