শ্মশানবন্ধু

মণীশ রায়

সহসা চারপাশের শব্দগুলো থমকে দাঁড়ায়।

কতগুলো পরিচিত-অপরিচিত মুখাবয়বের অন্তহীন পুতুলনাচ মুখ থুবড়ে পড়ে; শব্দহীন।

কালো ভূতের মতো ঠ্যাং-ওলা ক্যামেরাকটি হঠাৎ স্থির হয়ে যায়; মাথার ওপর চুন-সুড়কির ছাদ ফুঁড়ে যে-রংচটা ফ্যানটা ঘরঘর শব্দে অবিরাম ঘুরছিল একটু আগে, আপাতত সেটিও মুখবন্ধ কয়েদির মতো বাতাসে কিছু নিঃশব্দ আঁকিবুকি ছাড়া আর কিছুই করছে না; চারপাশ জুড়ে এবড়ো-খেবড়ো ফ্যাকাশে যে-দেয়াল সফেদ গজকাপড়ে জড়ানো পা-ভাঙা রোগী হয়ে গা এলিয়ে রেখেছিল; এখন রা-হীন মমি।

নিরুপমার দৃষ্টি ঘুরে রয়েছে মেয়ের দিকে। অন্ধকার ঘরে সেলুলয়েডের পৃষ্ঠায় তৃষ্ণার্তের মতো মেয়েটাকেই কেবল দেখতে চাইছে সে। মাঝে মাঝে খুব স্পষ্ট; আবার মাঝে মাঝে দূরে সরে যাচ্ছে জলছবি হয়ে!

একটু আগেও শিউলির চেহারাটা চোখের সামনেই ছিল।

চোখ বেয়ে জল গড়ানোর সময় ওরই নিষ্পাপ মুখখানা ভেসে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে।

শিউলি কলেজে যাচ্ছে, ‘মা, কলেজে গেলাম। বড় ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দাও।’ ঠিক শুনতে পাচ্ছে নিরুপমা।

‘মা, বন্ধুদের খাওয়াবো। কটা টাকা দাও বাবার কাছ থেকে চেয়ে।’ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেয়েটাকে।

অথচ হঠাৎ হঠাৎ কী যে হয় – মেয়েটা একটা ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে দূর থেকে নিরুপমাকে ডাক দেয় ওর সুরেলা গলায়, ‘মা আমি এখানে। এই তো…’

এ-সময় চোখের সামনের সব মুখ স্থির আর নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। কেউ কথা বলছে না। অথচ সবার ঠোঁট অবিরাম নড়ছে। সিঁদুর দেওয়া বয়স্ক পাড়া রমণীকুলের বিষণ্ণ চেহারায় ভেসে বেড়ানো নিষ্পলক চাহনি কিংবা এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অজস্র কৌতূহলী মুখ নিরুপমার চোখের মণিজোড়ায় কোনো ছায়াই ফেলতে পারছে না।

বোবা সিনেমার মতো হাত-পা নেড়ে ওরা যখন কিছু বলতে চাইছে, তখন নিরুপমা তাকিয়ে রয়েছে কেবল মেয়েটার দিকে।

শিউলি কি আবার ওকে মা বলে ডাকছে?

ওহ্! এত হট্টগোল ঘরের ভেতর! একটু নিরিবিলি প্রশান্তি নেই কোনোখানে?

মেয়েটা ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মাকে কাছে পাওয়ার আর ঘরভর্তি লোকগুলো একটা খাঁচা তৈরি করে ওকে ঘিরে রেখেছে। সে না পারছে নড়তে, না পারছে দুদন্ড শান্তিতে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে।

ওর স্বামী শ্যামল ওকে চেপে রেখেছে একপাশ থেকে। অন্যপাশে ছেলে অর্জুন মুখের পাশে মুখ রেখে বারবার করে বলছে, ‘মা শান্ত হও। শান্ত হও মা!’

হিংস্রভাবে একবার তাকাল নিরুপমা বারো বছরের ছেলেটার মুখের দিকে। জল আর ধুলা মিশে ফর্সা গাল দুটো ওর চটচটে; চোখে অসহায়-অপারগ দৃষ্টির রূঢ় স্পর্শ।

ছেলের দিকে তাকিয়ে নিরুপমা বলতে চাইল, ‘দেখছিস না, তোর দিদি আমাকে ডাকছে? শুনতে পাস না? মেয়ে ডাকলে মা শান্ত থাকতে পারে নাকি গাধা?’

কিন্তু জিহবা শুকনো, তালুর সঙ্গে একেবারে সেঁটে রয়েছে। ঠোঁট দুটো ওদের চুন-সুড়কির বাড়ির ছাদের মতো খসখসে।

কথা বলতে পারল না নিরুপমা। শুধু বুকচেরা ওহ্ ওহ্ করে একধরনের শব্দ বেরোচ্ছে মুখ থেকে।

‘ঘটনাটা কী করে ঘটল? একটুও টের পায়নি?’ উসখো-খুসকো দাড়ি আর চুলে ঢাকা কমবয়েসি লম্বাটে একটি মুখ ওর কাছে জানতে চাইল।

‘শেষ কথা কী বলেছিল সেটা মনে করতে পারেন?’ পাশেই একটি মেয়ের মুখ। খনখনে গলার স্বর – কানে ধাক্কা লাগে।

‘বলুন, কিছু বলুন মা হিসেবে?’ একজন মাঝবয়েসির মুখে উদগ্র কৌতূহল।

অপরিচিত মুখগুলোর সঙ্গে পালা দিয়ে চলছে ওদের আঙুলগুলো – ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক। থামতেই চায় না; যেন অনন্তকাল ধরে পুরো ঘরজুড়ে একটা বিশাল টাইপরাইটার অবিরাম খটখট করে যাচ্ছে।

কে একজন এসে নিরুপমার চুলগুলো এলোমেলো করে ছড়িয়ে দিলো মুখের চারপাশে। নারকেলের চিরল পাতায় ঢাকা আবছায়া অন্ধকার নিরুপমার দৃষ্টির সামনে; লোকটি বলে উঠল, ‘চুল সরাবেন না, প্লিজ। কটা ছবি নিতে দিন।’

শ্যামলবাবু স্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো, প্রথমদিকে মিডিয়াকে সহযোগিতা করলেও ক্রমে তার ভেতর এক ধরনের উষ্মা জমা হতে শুরু করে। হতাশা আর নিঃস্বতাবোধ ওকে বারবার কামড়ে ধরছে।

নিজেকে শক্ত রাখতে চাইলেও মেয়েটা হঠাৎ হঠাৎ চোখের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, ‘প্রেশারের ওষুধটা খাইছো ঠিকমতো?’ নিজের ভেতর প্রবলভাবে শ্যামল টের পায় আদরমাখা সেই অনুভব।

‘আবার সিগারেট খাইছো? কই, প্যাকেটটা কই? দাও, দাও বলছি?’

বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হলেও নিজেকে শক্ত রাখার প্রতিজ্ঞা করেছে সে। কাউকে বুঝতে দেবে না, সে কতটা ভাঙছে ভেতরে ভেতরে।

পাড়ভাঙার কষ্ট কি কেবল মানুষেরই হয়, নদীর হয় না? গিজগিজ করা মনুষ্য-ব্যূহের ভেতর যে-শূন্যতা তা কি কেবল নিরুপমাকেই গ্রাস করছে, পাশে বসা বাবা নামের এই মানুষটির বুকে কী চলছে তার খবর কে রাখবে?

ছেলে অর্জুন ভ্যাবাচেকা; ওর দৃষ্টি একবার মাকে, একবার বাবাকে এবং আরেকবার ঘরভর্তি বিচিত্রসব লোকজনকে ধাওয়া করে শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছেই ফিরে আসে।

কাল থেকে সবকিছু চলছে এলোমেলো-অনিয়মিত। যে-বোনটি ওকে কপালে চুমু এঁকে কলেজে যেত, তাকে আর সে দেখতে পাচ্ছে না।

‘দাদা, তুই আজ খাবি না। কলেজে বাৎসরিক খাওয়া আছে।’ ছোট হলেও এভাবেই অর্জুন সম্বোধিত হতো বোনের কাছে।

নিরুপমার প্রতিবাদ সঙ্গে সঙ্গে, ‘তুই খাবি কী?’

‘ভাগ করে খাবো। এটা আমার আর অর্জুনের ব্যাপার মা। নাক গলাবা না।’ একটা দাদা পাওয়ার অহংকার মিশে থাকে কথায়।

সেই দিদিটাকে অর্জুন খুঁজে পাচ্ছে না কাল থেকে। সাদা সালোয়ার-কামিজ পরে দিদি পরশুদিন কলেজে যাবে বলে বেরিয়ে গেল, যাওয়ার আগে ঝগড়া করল কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে, ‘আমার কলম তুই নিবি কেন?’

‘ইচ্ছা?’

‘মাইর খাবি কিন্তু।’

‘মার।’

হাতটা ওর মুখের কাছে এনে চকাশ করে একটা চুমু দিয়ে দিলো ওর গালে, ‘দুষ্টুমি করবি না। খবরদার!’ বলে বেরিয়ে গেল দিদিটা।

সেই দিদি লাপাত্তা। তাকে নাকি হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। ভালো হলেই সে ফিরে আসবে – আত্মীয়-পরিজনরা এই এক কথা বারবার করে ওর কানের কাছে মুখ এনে বলে চলেছে।

কিন্তু অর্জুন স্পষ্ট বুঝতে পারছে – দিদিটা আর ফিরবে না।

এ-কথা ভাবতেই ওর কান্না পাচ্ছে বড়। সে তাহলে ঝগড়া বাধাবে কার সঙ্গে? দিদি? ও দিদি?

কিছুক্ষণ আগেও অঝোরে কেঁদেছে সে। যতবার দিদির কথা ভেবেছে, ততবারই কান্নায় ভেসে গেছে চোখ। এখন কষ্ট বুকে চেপে থেমে থেমে ও কেবল তাকাচ্ছে এদিক-সেদিক। বুঝেও বুঝতে পারছে না কিছু!

‘ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে আপনাদের মেয়ে। তাই কলেজে গিয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। কারা এর পেছনে রয়েছে বলে আপনাদের ধারণা? ওদের ভয়ে কি মুখ খুলতে চাইছেন না?’

শ্যামলবাবু আর নিরুপমাকে তাক করে রয়েছে একটি চ্যানেল। ক্যামেরাটি ওদের মুখের একেবারে কাছে এসে কিঞ্চিৎ দূরে পিছিয়ে যাচ্ছে।

‘কাদের ভয়ে আপনারা মুখ খুলছেন না? তারা কি এই মহল্লার প্রভাবশালী কেউ?’ একটি মেয়ে ওর কমবয়েসি চেহারায় ভারিক্কিয়ানা মিশিয়ে হাতে ধরা মাইক্রোফোনটি এগিয়ে দেয় ওদের মুখের সামনে।

পেছনে দাঁড়ানো ক্যামেরা-ক্রু ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘একটু আগে তো বেশ কাঁদছিল। এখন আরেকটু কাঁদতে ক তো লিজা। রিকোয়েস্ট করে দ্যাখ।’

মেয়েটি পেছনে তাকিয়ে চাপা গলায় উত্তর দেয়, ‘তুই আদতেই একটা বলদা, এভাবে কি বলা যায়?’

শ্যামলবাবুর রাগ হলো। সকাল থেকে হুড়োহুড়ি – চিল্লাচিল্লি। কখনো পুলিশের জেরা, কখনো সাংবাদিকদের উল্টাসিদা প্রশ্ন – মেয়ের আত্মহত্যার কারণে ওদের পুরনো ঢাকার বাড়িটা যেন একটা রঙ্গশালায় পরিণত হয়েছে; সবাই ভিড় করছে একধরনের মজা লুটতে।

‘মাইয়াডার কি রেইপ হইছিল? ক্যামনে? আহা রে!’

‘আত্মহত্যার সময় নাকি কয় মাসের পোয়াতি আছিল? জানেন কিছু? আইজকাল মাইয়াগুলান যে কী অইছে, হিন্দি ছবি দেইক্যা দেইক্যা এক্কেরে শেষ!’

‘দেহেন আমারও মাইয়া আছে। পোলাপানের কলেজে দিই নাইকা। যা পড়নের এইখানেই পড়বি। বেশি আধুনিক অইতে গিয়া মাইয়াডারেই হারাইল। আহা!!’

ছেঁড়া-ছেঁড়া এসব কথার বিষ যত কান দিয়ে মরমে প্রবেশ করছে, শ্যামল তত উদ্ভ্রান্ত আর শূন্য-মাথা হয়ে পড়ছে।

ওর চোখের সামনে থেকে যা কিছু সুন্দর আর লাবণ্যময় তা অনেক আগেই ওকে ছেড়ে অনেক দূরে সরে গেছে। এখন সে কেবল এক বোধহীন সত্তা – মৃত্যুর ভেতরে যেন আরেক মৃত্যু!

একটু বাদে ওর ভেতর এক অদ্ভুত অশরীরী অনুভবের জন্ম হয়। চারপাশে তাকিয়ে আত্মজার অদৃশ্য প্রেতাত্মাকে খুঁজে ফেরে সে।

মেয়েটি ওদের এত ন্যাওটা, সে কীভাবে হুটহাট হাওয়া হয়ে যায়? সে নিশ্চয়ই কোথাও ঘাপটি মেরে ওদের দেখছে; তাইলে শ্যামল কেন দেখতে পাচ্ছে না ওকে?

সামান্য হাওয়ার দাপট ওকে বিভ্রান্ত করে, হরেক রকমের শব্দের ভেতর সহসা একটি-দুটি গায়েবি শব্দ ওর ভেতর চমক তৈরি করে দিয়ে যায়।

কোনো ইশারা, কোনো অদৃশ্য স্পন্দন ওর হৃদয়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। নির্বাক নিষ্প্রভ চোখজোড়া চারপাশে ঘুরে বেড়ায়; যা দেখতে পাচ্ছে তা যেমন ওর দৃষ্টি এড়ায় না, যা দেখতে পাচ্ছে না, তা আরো উদ্গ্রীব আর কৌতূহলী করে তোলে ওকে। অসহায় মেয়েটার            অস্তিত্বকে একটুখানি অনুভবের আশায় সে এক গভীর উচাটন বোধ করে নিজের মাঝে।

একসময় হতাশা ওকে কামড়ে ধরে; কিস্যু ভালো লাগে না; তারপর তীব্র রাগ আর ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে, ‘আপনারা কী পাইছেন? মাইয়াডা হারাইছি, তাও নিষ্কৃতি নাই?’ বলে শ্যামল ওর স্ত্রী নিরুপমাকে হাত ধরে টেনে ভেতরঘরে নিয়ে যায়।

‘আপনারা একটা কিছু বলেন? কেন আপনাদের মেয়ে আত্মহত্যা করল, কিছু বলেন?’ শেষ চেষ্টা জনৈক রিপোর্টারের।

‘না জানলে বলমু ক্যামতে? বড় হওনের পর আপনে আপনার মাইয়ার সব খবর জানেন? কন জানেন?’ শ্যামল জেদ আর ক্ষোভ ঝাড়ে লোকটির ওপর।

‘তবু আন্দাজ তো করা যায়? আমরা ধরে নিয়েছি এটা ইভটিজারদের কাজ। পাড়ার কিছু উঠতি যুবক আপনার মেয়েকে কলেজে যেতে-আসতে উত্ত্যক্ত করত। সেসব সহ্য করতে না পেরে আপনাদের মেয়ে ইঁদুর মারার ওষুধ খেয়ে কলেজে আত্মহত্যা করেছে। এর চেয়ে বেশি কি জানেন আপনারা?’ লোকটি থামে।

‘আমরার মাইয়াডা আর নাই, এইটুকুনই জানি। আর কিছু জানি না।’ কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠ পিতা শ্যামলের।

পাশ থেকে চ্যানেলের এক কমবয়েসি মেয়ে প্রশ্ন করল, ‘মেয়ের লাশটা দেখেছেন?’

‘না।’ এবার আর নিজেকে সামাল দিতে পারে না শ্যামল। হু-হু করে সবার সামনে কেঁদে ফেলে।

মিডিয়ার সমবেত মানুষগুলো থমকে দাঁড়ায়। এর চেয়ে বেশিকিছু বলা আদৌ শোভন হবে কিনা তা-ই ভাবছে। শ্যামল ওর স্ত্রীর হাত ধরে ভেতরঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও শরীরটা এলিয়ে দেয়।

অর্জুন ঘরে এসে ঢুকতেই রাতজাগা ঢুলু-ঢুলু চোখে শ্যামল ছেলেকে বলে উঠল, ‘ছিটকিনিটা দিয়া আয়। নইলে সাংবাদিকগুলা ডুইক্যা পড়ব ভিত্রে।’

ওরা তিনজন লাশ হয়ে শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চোখ বোজা, ভেতরে শোকের মাতম। কখনো আগুন হাওয়া, কখনো পলকা বৃষ্টির ধারা হয়ে ভেজাচ্ছে কিংবা তপ্ত করে তুলছে। মাছিরা শরীরের ওপর ভোঁ-ভোঁ করছে। মশারা রক্তভোজনের পর পেট নিয়ে নড়তে পারছে না। তবু ওদের নড়াচড়া নেই।

ঘণ্টাখানেক পর শ্যামলের মোবাইলটা ইলেকট্রিক গিটারের পুরনো কর্কশ শব্দে ডেকে ওঠায় নিষ্প্রাণ মানুষগুলো নড়েচড়ে উঠল।

‘হ্যালো?’ ম্রিয়মাণ কণ্ঠ শ্যামলের।

‘জামাইবাবু, ময়নাতদন্ত কমপ্লিট। লাশটা সরাসরি পোস্তগোলায় নিবার চাই। বাড়িত আনতাম চাই না। কী কন?’

নিমিষে চোখের সামনে রক্তমাখা গোলাপকুঁড়ির মতো নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক একখানা মুখ ভেসে উঠল। ইঁদুরের ওষুধ খেয়ে ছটফট করতে করতে যে-কোমলমতির প্রাণ গেছে, তাকে এই কাটাছেঁড়ার তীব্র কষ্ট কেন মৃত্যুর পরও পিছু ছাড়ে না, তা সে বুঝতে পারে না।

মড়া খুলির মতো ওর প্রাণের এদিক-ওদিক কষ্টের তুফান বয়ে যাচ্ছে। তবু সে কাঁদতে পারে না।

‘ঠিকাছে।’ কণ্ঠ বুজে আসে। শ্যালকের ওপর দিয়ে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা যাচ্ছে বলে সে মনে মনে কৃতজ্ঞতা বোধ করে।

‘কিন্তু মুখাগ্নিটা কে করব?’ প্রশ্ন শ্যালক অতনুর।

এরই ভেতর নিরুপমার ঘুম ভেঙে গেছে। সে ভাবলেশহীন রক্তাভ চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

শ্যামল কোমল করে বলে, ‘অতনুর ফোন।’

‘কী কইল হে? আমার মাইয়া কই?’ চোখ বিস্ফারিত, একগাদা প্রশ্ন ঠোঁটের ডগায়।

‘মেয়েকে সরাসরি পোস্তাগোলায় নিয়া যাইতে চায় ও। আচ্ছা মুখাগ্নিটা কে করব ওর?’ সাধু-সন্ন্যাসীর মতো নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও সে বুঝতে পারে, বুকের মাঝখানে বিষ-মাখানো একটা ছুরি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে।

‘অ মাগো’ বলে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে – পারছে না।  তীব্র ব্যথা – মাছের মতো কেবলি তড়পাতে চাইছে মন – পারছে না।

হার্ডওয়ারের ছোটখাটো দোকান নবাবপুরে আর বুড়িগঙ্গার পাড়-ঘেঁষা বাপদাদার শত হিস্যায় ভরা চুন-সুড়কি খসা ভাঙাচোরা বাড়ির এক কোণ ওদের। এই সামান্য অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্ব কীভাবে এই গভীর যাতনা সহ্য করে?

নিরুপমা ওর দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করা শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা এলিয়ে দেয় বিছানায়। হয়তো সংজ্ঞা হারিয়েছে।

মোবাইলে ওপাশ থেকে ভেসে আসে অতনুর প্রশ্ন, পাশে  সম্ভবত ওর স্ত্রী রূপা, কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, ‘দাদা, শক্ত হউন। আমরা পিক-আপ নিয়ে সোজা পোস্তগোলা চলে যাচ্ছি। আপনি, দিদি আর  অর্জুনকে নিয়ে চলে আসুন।’

‘মুখাগ্নি কে করব?’ শ্যামল শিশুর সারল্য নিয়ে জিজ্ঞাসা করে অতনুকে।

‘কেন, আপনি।’

লাইনটা কেটে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে ঘন কুয়াশার মতো কষ্ট শ্যামলকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য অনুভবহীন এক অস্তিত্বের মতো নিথর করে দেয়।

সামনে দাঁড়ানো অর্জুনের দিকে এমনভাবে সে তাকিয়ে থাকে যে, মনে হয় সে তার নিজের ছেলেকে দেখতে পাচ্ছে না। এমন কিছু ওর চোখের মণিদুটোয় ছায়া ফেলছে, যা ওর নিজেরও বোধগম্য নয়।

বাবার এই বোবা ও ভয়ংকর রকমের স্তব্ধ দৃষ্টির সামনে অর্জুন বড় অসহায়বোধ করে। মা বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে রয়েছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাবার পাথর-চোখ – কী বললে যে ওদের মন গলানো যাবে, তা সে জানে না। তবে এটুকু ওর মাথায় রয়েছে যে, দিদি সম্পর্কে একটা কিছু বলতে পারলেই ওরা নড়েচড়ে বসবে।

কী এমন কথা যে, বলার সঙ্গে সঙ্গে ওরা অর্জুনের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাবে?

সে ভাবতে থাকে। সহসা সৌম্যদার কথা মনে পড়ল। যতবার দেখা হয়েছে ততবার দিদি ওকে বলেছে, ‘খবরদার, ওর কথা বাড়ির কাউরে বলবি না।’

অর্জুন মাথা নেড়ে সায় জানায়।

‘মাথা নাড়লে চলবে না। প্রমিজ করো।’ দিদি ওকে আদর দিয়ে বলে।

‘প্রমিজ।’

দিদিকে ঠিকই কথা দেয় অর্জুন; এবং এ-কথা মা-বাবাকে কখনো বলেনি।

সৌম্যদা ওকে হাতে চকোলেট গুঁজে দিত। মা-বাবাকে কিছু বলে দিলে যদি সেই চকোলেট-প্রাপ্তি আর না ঘটে, সেই শঙ্কায় সে চুপচাপ থাকত।

আজ মনে হচ্ছে কথাটা বলে দেওয়া উচিত মা-বাবাকে। কোনো কারণ নেই; তবু বারবার মনে হচ্ছে এই জমানো কথাটা বলে দিলে হয়তো মা-বাবা একটু হলেও স্বস্তি ফিরে পাবে।

‘বাবা, দিদি না সৌম্যদার সঙ্গে দেখা করত। আমাকে মানা করেছিল তোমাদের বলতে।’ বলেই মনে মনে জিভ কাটে। যদি দিদি ফিরে এসে টের পেয়ে যায় যে, সে এ-কথাটা বলে দিয়েছে তবে কানমলা খেতে হবে।

ওর এখনো কেন যেন বিশ্বাস হয় না – দিদি আর ফিরবে না। মনে হচেছ কেউ বুঝতে পারছে না; নিশ্চয়ই সৌম্যদাকে নিয়ে সে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে।

হয়তো মা-বাবার বকুনি খাবে বলে লুকোচুরি খেলছে। ওহ্, অর্জুন যদি আগাম জানতে পারত মূল ব্যাপারটা, তাহলে অবশ্যই মা-বাবাকে বলে দিত; তখন নিশ্চয়ই ওরা না হেসে থাকতে পারবে না; মুখে বলবে, ‘তুই অত পাকনা অইছিস কেমনে?’

ভাবতেই অর্জুনের মনটা চিরন্তর চিনচিনে ব্যথার ভেতর এক টুকরো রংধনুর মতো হেসে উঠতে চাইল।

তার আগেই শ্যামল অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকাল। অস্ত্রোপচারের পর প্রথম জ্ঞান ফিরে পেলে মানুষ যেভাবে সবকিছুর দিকে তাকায়, ওর চোখ জোড়ায় প্রথমবার পৃথিবী দেখতে পাওয়ার তেমনি রকম বিস্ফারিত বিস্ময়।

‘সৌম্য কেডা?’ ছেলেকে নয়, নিরুপমার কাত হওয়া অর্ধচেতন মুখের ওপর শ্যামলের উপুড় হওয়া দৃষ্টি।

অনেক কষ্টে নিরুপমার চোখের ভারী পালা খুলতে শুরু করে। কথা বলার জন্য কেঁপে ওঠে ওর ঠোঁটজোড়া।

‘সৌম্য কেডা?’ ফের প্রশ্ন শ্যামলের।

‘জানি না।’ শুকনো খড়খড়ে ঠোঁট আর জিহবা কথা বলায় মরিয়া হয়ে ওঠে।

‘তুমি সব জানো। তোমার লাইগ্যাই মাইয়াডার এই অবস্থা। তুমি দায়ী।’ চেঁচিয়ে ওঠে শ্যামল। ওর চোখেমুখে নিষ্ফলা মাঠের ওপর খররোদ আছড়ে পড়ার মতো ক্ষোভ আর রাগ।

‘আমি জানি না। কিছু জানি না। বিশ্বাস করো! ’ নিরুপমা ডুকরে কেঁদে উঠে ফের মাথা এলিয়ে দেয় বিছানায়।

শ্যামল ছেলের দিকে তাকিয়ে একই প্রশ্ন করে, ‘সৌম্য কেডা?’ কঠোর কাঠিন্য দৃষ্টিতে।

অর্জুন ভয় পেয়ে যায়। ভয় পেলে তোতলাতে শুরু করে দেয় সে, ‘সৌম্যদা থাকে ঢালকানগরে। ভার্সিটির ছাত্র। দিদি কইছে ওনার কাছে নাকি অনেক বই আছে। ভালো রেজাল্টের লাইগা দিদি তার কাছ থেইক্যা বই ধার নিত।’ এটুকু বলে সে থামে। কিন্তু চকোলেট প্রাপ্তির কথা সে বেমালুম চেপে যায়। ওর ক্ষুদে বুদ্ধি প্রয়োগ করে সে বুঝতে পারে – এ-কথা বললে বাবা হয়তো আরো ক্ষেপে যেতে পারে।

শ্যামল আর কথা বলে না। দাউ-দাউ করা আগুনের শিখা লকলকিয়ে ওঠে চোখের সামনে। প্রেতিনীর আগুন-মাথা যত দপদপ করে জ্বলছে, তত সে উদ্ভ্রান্ত মাতালের মতো অসংলগ্ন হয়ে পড়ছে। ওর বোধ-বুদ্ধি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারে – শেষ পর্যন্ত মেয়ের মুখাগ্নিটা ওকেই করতে হবে!

কিন্তু যে-মেয়ের মৃত্যুর কারণ ওর কাছে মোটেই স্পষ্ট নয়, সে কেন নিজের হাতে তাকে নিঃশেষ করে দেবে? মেয়েটার শেষ পরিণামের জন্য তাহলে কে দায়ী?

প্রশ্নটা যতবার ছিনতাইকারীর ছোরার মতো ওর রক্ত ঝরাচ্ছে, তত সে আকুল-ব্যাকুল হয়ে উত্তর পেতে চাইছে।

কাউকে ওর বিশ্বাস হয় না। কাকে এ-প্রশ্নটা করলে যে সে সঠিক উত্তরটি পাবে তা! সে জানে না। আঁতিপাঁতি করে খুঁজে চলেছে এর উত্তর; কিন্তু প্রশ্ন কেবল প্রশ্নই থেকে যায় নিজের কাছে।

মেয়েটাকে যখন ধোয়ামোছা করে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে শুকনো লাকড়ির ওপর দখিনমুখো করে শোয়ানো হলো, তখনো শ্যামল জানে না মেয়ের সংগোপন অভিমানের কথা।

যখন কেরোসিন ঢেলে শুকনো সব লাকড়ি আর এক টুকরো আদুরে মেয়েটাকে দাহযোগ্য করে তোলা হলো, তখনো সে জানে না মেয়ের মনের কথা।

লাকড়ির ভেতর মুখ-লুকানো শিউলি। সে কাঁদছে না, রাগছে না, অভিমান করছে না, ডাকছে না, ‘বাবা, ওরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। বাবা, ওরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে!’

‘নাম বল মা। কারা তোকে কষ্ট দিচ্ছে মা?’

‘বাবা, ওরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। বাবা, ওরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে!’

‘নাম বল মা। ওদের নাম বল। আমি থানা করব। পুলিশ করব। র‌্যাবে যাব। আর্মিকে ডাকব। নাম বল মা? মা গো, নাম বল?’

‘বাবা, ওরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। বাবা, ওরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে!’

বহুদূরের একটা নদী থেকে এক পশলা হিম-হাওয়া বয়ে এসে শ্যামলের মাথার ওপর অশ্বত্থ গাছটার পাতাগুলোয় শিরশিরানি ধরায়; সেই শিরশিরানি ওর কানে মেয়ের আর্তি হয়ে যখন ধরা দেয়, তখন বাহ্যজ্ঞান লোপ পায় ওর। চোখের সামনে মেয়েটা কেবল তার যন্ত্রণার কথা কঁকিয়ে বলতে থাকে।

শিউলির পরনে সফেদ থান কাপড়; সদ্য স্নান সেরে মেয়েটি এবার চিতাভস্ম হতে চলেছে।

ওর নিষ্প্রভ চোখেমুখে জল, হলুদ আর চন্দনের করুণ দাগ। মেয়েটা সাজগোজ পছন্দ করত না; তবু একটি লকেট কাঁদতে কাঁদতে নিরুপমা গলায় পরিয়ে দিয়েছে।

ওর শরীর মন্ত্রপূত পবিত্রতায় ঢাকা; বেদনার চিহ্নগুলো এখন আর চোখে পড়ে না।

শ্যামল স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চিতার সামনে। ওর ঊর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত, পরনে দুভাঁজ করা ধুতি। মেয়েকে পোড়াবে বলে হাতে ধরে রয়েছে কাপড়-জড়ানো কেরোসিন-ভেজা মশাল। কাঁধে জলভরা কলসি; অন্তিম শয়ানে রেখে বাবা মেয়েকে প্রদক্ষিণ করবে বারবার তিনবার; প্রতিবার জীবন-কলসির গায় ফুটো করে ছড়িয়ে দেবে মেয়ের অসহায় প্রাণতরঙ্গ।

পাশেই ডিসেম্বরের নিভু-নিভু বাতাসে কুপি জ্বলছে, মশালটি বাড়িয়ে দিলেই দপ করে জ্বলে উঠবে সেটি।

কিন্তু যে-মশাল ওর ভেতর দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠতে চাইছে তাকে কে আগুন দেবে?

‘মুখাগ্নি করেন? দেরি করবেন না।’ পুরোহিত আর শ্যালক অতনু একসঙ্গে কথা কয়ে ওঠে। পেছনে ‘মা, মা গো ওরে পুড়াইও না’ বলে নিরুপমার আর্তনাদ জড়ো হওয়া শ্মশানবন্ধুদের বিহবল করে দেয়।

সদ্য সূক্ষ্ম দেহধারিণী মেয়েটিকে উদ্দেশ করে কলাপাতায় চাল-কলার যে-পিন্ড দেওয়া হয়েছে, একটি পাতিকাক সেটির দিকে ভয়ে-ভয়ে এগিয়ে এসে সবে একটি ঠোকর বসিয়েছে কি বসায়নি, অমনি নিরুপমার চিৎকার শুনে সেই কাক উড়ে পালিয়ে যায়।

পুরোহিত উড়ন্ত কাকটির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আহ্! কান্নাকাটি বন্ধ করেন। আত্মা অশান্ত হবে। দেখছেন না?’ কাকটি তখন একটি স্মৃতিফলকের ডগায় বসে লোভাতুর চোখে চাল-কলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পুরোহিত আহবান করছে ছদ্মবেশধারী কাকটিকে, ‘আয়, আয়। কোনো ভয় নাই। কান্না থামান।’

নিরুপমার কান্না থেমে গেল। হিমেল বাতাসমাখা সুনসান স্তব্ধতার মাঝখানে যখন পাতিকাকটি কলাপাতায় ঠোকর বসাল, অমনি পুরোহিত বলে উঠল, ‘মুখাগ্নি করেন।’

আগুন জ্বলে উঠল মশালের ঠোঁটে। একটু পর দাউ-দাউ করে চিতা জ্বলতে শুরু করে।

মটমট করে হাড় ভাঙছে। চিড়চিড় করে ভ্রমর-কালো চুল পুড়ছে। মন্ত্রের সঙ্গে ঘি পড়ছে মেয়ের শরীরে; মাথার খুলিটা খটাস করে ফেটে গেল। চামড়া-চুল পোড়া উটকো গন্ধটা শ্যামলের পেটের নাড়িভুঁড়িতে নাড়া দিতেই ওয়াক করে উঠল সে।

শ্যামল চোখ বুজে চিতা প্রদক্ষিণ করতে থাকে। একটা সময় সে স্থির হয়ে দাঁড়াতেই দূর থেকে পড়ন্ত বিকেলবেলার সুচ-ফুটানো ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসে মেয়ের পরিচিত গলা – ‘বাবা, ওরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। বাবা, ওরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে!’

ও চমকে উঠে চারপাশে তাকায়; দূরের পাতিকাকটিকে কেন যেন এ-সময় বড় আপন বলে মনে হয়। স্নেহার্দ্র চোখ আর উতলা মন নিয়ে কাকটিকে সে বিড়বিড় করে জিজ্ঞাস করে, ‘তুই কি শিউলি? বল না, কিসের কষ্ট তোর? কারা তোকে কষ্ট দিয়ে মাইরা ফেলল? বল মা?’

শ্যামলের চোখের ওপর পাতিকাকের চোখ। গভীর নিবিষ্ট দৃষ্টি দিয়ে সে চিরচেনা এদিক-ওদিক করা চঞ্চল কাকচক্ষুকে পরখ করতে থাকে। যদি কোনো আভাস বা ইশারায় সে জেনে ফেলে অবলা মেয়ের দুঃখগাথা!

সহসা কতগুলো আবছা ছায়ামূর্তি ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মেয়েটা মাথা নুয়ে হেঁটে যাচ্ছে গলির রাস্তা ধরে আর কালো কতগুলো কাঠ-পুতুল ওর রাস্তা আগলে কখনো অশ্লীল হাসি হাসছে, কখনো নেচে-কুঁদে রঙ্গ করছে নিজেদের ভেতর, কখনোবা মেয়েটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গির মহড়া দিচ্ছে; ওড়না ধরে হ্যাঁচকা এক টান দিয়ে একটা কেউটেমুখো নাকি সুরে বলে উঠল, ‘যাবি আমগো লগে?’

আর সহ্য করতে পারে না শ্যামল। লজ্জা আর অপমানে দুহাতের তালু দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো মাথা ঝাঁকায় কিছুক্ষণ।

পিন্ডদানের লোভনীয় খাওয়া খেতে আসা তক্কে-তক্কে থাকা পাতিকাকটি ওকেই এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিল; এবার ওর মাথা-ঝাঁকুনির অস্থিরতা টের পেয়ে ভয়ে একছুটে উড়ে যায় দূরে।

পেছন থেকে পুরোহিত হায়-হায় করে ওঠে – ‘আহা! কী করতাছ শ্যামল? তোমার মাইয়াডা যে স্বস্তি পাইতাছে না, একটুখানি সুস্থির হও?’ পুরোহিতের বুড়ো চোখ পাতিকাকের ওপর।

এ-সময় ছেলে অর্জুন এসে শ্যামলের পাশে দাঁড়াল।

ফিসফিস করে বাবার কানে-কানে বলে উঠল, ‘বাবা! সৌম্যদা!’

ছেলের কণ্ঠ ওকে মাটিতে এনে দাঁড় করায়।

সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলের দৃষ্টি ভিড়ের ওপর আছড়ে পড়ে খুঁজে নেয় সৌম্যকে। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি দিয়ে ঢাকা নিষ্পাপ এক মুখাবয়ব। চোখে চশমা; তাও দৃষ্টির সারল্য এতদূর থেকে ওকে স্পর্শ করছে।

অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুর ওসব কাঠ-পুতুলগুলোর সঙ্গে কোনোই মিল নেই এ-মুখের। এ যেন শিশিরসিক্ত সাদা ঘাসফুল; শিউলিকে কি সত্যি-সত্যি ভালোবাসত এ-ছেলেটা?

অপমৃত্যু যাদের হয়, তাদের শ্মশানবন্ধু পারতপক্ষে কেউ হতে চায় না; নানা অজুহাতে এড়িয়ে চলে। অথচ নির্নিমেষ নয়নে এই যুবক সুলেখার জ্বলন্ত চিতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে!

সবার অলক্ষে, সবার পেছনে দাঁড়িয়ে এ-ছেলেটি আসলে কিসের খোঁজ করছে?

শ্যামলের শুকনো খড়খড়ে ঠোঁটদুটো এবার নড়ে ওঠে, ‘ও নিশ্চয়ই জানে, আমার মেয়েটা কেন আত্মহত্যা করল। ওর নিশ্চয় অজানা নয়!’

‘বাবা, কিছু কইলা?’ অর্জুন প্রশ্ন করে বাবাকে।

শ্যামল ফ্যালফ্যাল করে একবার সৌম্যকে আরেকবার নিজের ছেলেকে দেখতে থাকে।

ওর পেছনে একটানা বিলাপ করছে নিরুপমা; বেচারার চোখের জল শুকিয়ে গেছে; ভাঙা গলায় এখন কেবল আর্তনাদ আর আহাজারি; কষ্টগুলো পেঁজা তুলোর মতো ক্ষণে-ক্ষণে বাতাস ভারি করে তুলছে।

কুয়াশার অন্ধকার গায়ে মাখার আগে শীতের বিকেলবেলাটা শেষবারের মতো মুখ তুলে সবার দিকে এক ঝলক তাকাতে চেয়েও কেমন যেন বিমর্ষ আর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল!