একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ায় দাঁড়িয়ে যখন পেছনের দিকে তাকাই – দেখি কী বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি নবীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের কাছে সেদিন পরাস্ত হয়েছিল সব অসুন্দর। স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়ে আমাদের সৃজনশিল্পের চর্চা গতি পেয়েছিল। শিক্ষার্থী-শিল্পীদের মধ্যেও নতুন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ অবারিত হয়। ওই সময়ের সাত সহপাঠী শিল্পীর একটি দলীয় প্রদর্শনী সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো ঢাকার ধানমণ্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে। ২২ মার্চ শুক্রবার থেকে ৩০ মার্চ শনিবার পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ-প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন শিল্পী আলমগীর হক, ড. ফরিদা জামান, নাঈমা হক, নাসিম আহমেদ নাদভী, সাধনা ইসলাম, টিএ কামাল কবির এবং অকালপ্রয়াত শিল্পী শওকাতুজ্জামান।
দলীয় এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘সত্তরের সাত’। সত্তর বলতে সত্তরের দশক। শিল্পকলা, নাটক ও সাহিত্যের বহুমুখী চর্চার এক দুরন্ত সময়। এ সময়ে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিল্পীরা পরিণত হয়েছেন – তাঁদের চেতনা ও শিক্ষার আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে যাচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে। সম্প্রতি প্রয়াত পঞ্চাশের দশকের আমিনুল ইসলাম তাঁর অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী-শিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন, যিনি নানা নিরীক্ষায় ও শিল্পদীক্ষায় সমৃদ্ধ করেছেন নবীনদের। সেদিনের নবীনরাই আজ পরিণত, আমাদের সমকালীন আধুনিক চারুশিল্পের কৃতী সৃজনশিল্পী। এই সাতজন ওই দলেরই অন্যতম। এঁদের জন্ম ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে।
আলমগীর হক বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী। ঢাকার তৎকালীন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের স্নাতক। ভারতের গুজরাটের মহারাজ সোয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। তাঁর এযাবৎকালে ১৮টি একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছে বাংলাদেশসহ ভারত, কানাডা, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৯ সাল থেকে এ-বছর পর্যন্ত ৮২টি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চারুকলা প্রদর্শনীতে তিনি অংশ নিয়েছেন। পুরস্কৃত হয়েছেন ২০০০ সালে সাসকাচিউয়ান আর্টস বোর্ড থেকে। পেয়েছেন ইন্ডিভিজুয়াল অ্যাসিসট্যান্ট গ্রান্ট। ১৯৯৫ সালে যিনি প্রিন্টস ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন স্পেনের বার্সেলোনায়।
আলমগীর হক ছাপচিত্রশিল্পী হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর এচিং ও এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট ছাপচিত্র টেকনিক ও সৃজনশীলতায় উচ্চমানের। ছাপচিত্রকলার টেকনিক ও এ-বিষয়ে তাঁর লব্ধজ্ঞান তিনি ছড়িয়ে দিতে চান শিল্পীদের মধ্যে। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত এক এচিং কর্মশালায় তাঁর অধীনে আমি এচিং বিষয়ে পাঠ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কাছ থেকে দেখেছি – আগ্রহী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাপচিত্রকলায় তাঁর অর্জিত জ্ঞান তিনি দ্বিধাহীনভাবে বিলিয়ে দিয়েছেন। ছাপচিত্রীদের আন্তর্জাতিক ডাইরেক্টরিতে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে ১৯৯৭ সালে। এটি পোল্যান্ডের প্রিন্ট সোসাইটি-প্রকাশিত গ্রন্থ।
প্রদর্শনীতে আলমগীর হকের কাজগুলো ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা। শিরোনামহীন। প্রকাশবাদী বিমূর্ত ধারার কাজ। চিত্রতলে কিছু রেখা ও ফর্ম প্রয়োগ করে সাদা রঙের ভারী আস্তরণ দিয়ে কিছু কিছু রং মুছে ঢেকে দেওয়া হয়েছে – এভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে চিত্রপট। কাজের এমন ধরন এখানে অনেকেই পছন্দ করেন। নৈর্ব্যক্তিকতার এ-রীতির ভেতরে কিন্তু মানুষের স্বপ্ন আর অবচেতনার একটা গীতল রূপ আমরা অবলোকন করতে পারি। আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে শিল্পীর রং আর ফর্মের দ্যোতনা।
সত্তরের সাতের অন্যতম সৃজনশিল্পী ফরিদা জামান। মাছধরার জাল ও জলের সখ্য বা বিরোধ যাই বলি না কেন, এসব চিত্রকর্ম তাঁকে আমাদের শিল্পভুবনে উচ্চতর এক জায়গায় অধিষ্ঠিত করেছে। জলের বুকে জাল ফেলার জলের বুদ্বুদ আর আলোর রেখা মিলে অনির্বচনীয় একটি রূপ তৈরি হয়, যাকে তুলে এনেছেন সত্তরের দশকের অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ চিত্রকর। ঢাকায় চারুকলায় ১৯৭৪ সালে স্নাতক করে স্নাতকোত্তর করতে বৃত্তি নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। সেখানকার বরোদার মহারাজা সোয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে তিনি যোগ দেন তাঁর প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক। ১৯৯৫ সালে তিনি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী থেকে পিএইচ-ডি করেছেন। সম্প্রতি বেঙ্গল শিল্পালয়ে তাঁর একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলো।
শিক্ষা ও শিল্পীজীবনে অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন ফরিদা জামান। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত শিল্পকলা একাডেমীর নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীতে তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে পঞ্চম ভারতীয় ত্রিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে বিশেষভাবে পুরস্কৃত হন। ছোটদের বইয়ের অঙ্গসজ্জার জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে শ্রেষ্ঠশিল্পীর পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
ইদানীং তিনি আঁকছেন জমি আর জলাধার নিয়ে। পরিবেশ বিনষ্টের এই যুগে পরিবেশের বিপর্যয়, জল ও জীবন নিয়ে তিনি এখন আঁকছেন। এ প্রদর্শনীর দুটি কাজ দুটি সময়ের আলো আর বর্ণের ভিন্ন দুটি রূপ তুলে ধরেছে। এর একটি সকাল, অন্যটি সন্ধ্যা। সকাল যেন কিছুটা কুয়াশাময়, ধূসর – কেমন একটু ভেজা-ভেজা ভাব। আর সন্ধ্যা বর্ণিল। সূর্য অস্তমিত হওয়ার সময় যে-আলোর আলিম্পন রেখে যায় প্রকৃতি ও আকাশে, সে বিশেষ সময়টি তুলে ধরেছেন শিল্পী।
ফরিদা জামান আঁকেন বাস্তব বিষয়কে নিয়ে প্রায় বিমূর্ততার কাছাকাছি গিয়ে। অর্থাৎ মানুষের সাধারণ দেখার ভাষায় নয়, তিনি আঁকেন নিজের আবিষ্কৃত একটি বিশেষ রীতিতে, যেখানে বাস্তবতা রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন। কিংবা অন্যভাবে দেখলে এভাবেও বলা যায় – তাঁর এখনকার কাজ যেন আমাদের ভবিতব্যের অশনিসংকেতের ইঙ্গিতবাহী। পৃথিবীর উপরিভাগে জলাধার শুকিয়ে যাচ্ছে, খানাখন্দে জল নেই, নেই প্রাণের অস্তিত্ব। এই কঠিন সত্যটি আমাদের পীড়িত করলেও ফরিদা জামানের কাজের গুণে কম্পোজিশনে সে-রূঢ়তা নেই, সেই রুক্ষতা নেই।
নাইমা হক কখনো মূর্ত, কখনো বিমূর্ত পথের যাত্রী। ফিগারেটিভ যেসব কাজ করেন, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় কামরুল হাসানের ললনাদের কথা। যেমন কাগজে মিশ্রমাধ্যমে আঁকা আদুলগায়ে পেছন ফিরে বসা এক নারীর মাথা নিচু অবয়ব নারীর রূপমাধুর্যকে সার্থকভাবে তুলে ধরেছে। এই উপবেশনের মধ্যে এমন পেলবতা আছে, যা গীতিকবিতার মতো ঐশ্বর্যময়। শিরোনামহীন তাঁর আরেকটি পেইন্টিং, যেটি ক্যানভাসে মিশ্রমাধ্যমে আঁকা – সেটি বিমূর্ত ধাঁচের হয়েও যেন ঠিক বিমূর্ত নয়। তাতে যেন কাগজ কুঁচকানোয় অবয়বরূপ আছে। এর নিচে কালচে বর্ণের গায়ে ছাইরঙে নানা অক্ষর আর সংকেত। নাইমা হক প্রচুর কোলাজ ধরনের কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ঢাকা চারুকলা থেকে স্নাতক করে বরোদা এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন পিকচার বুক ইলাস্ট্রেশনে। গ্রাফিক ডিজাইনে নেদারল্যান্ডস সরকারের ফেলোশিপ পেয়েছেন ১৯৯৬ সালে। তিনি বর্তমানে চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক।
নাসিম আহমেদ নাদভী বহুরঙের ভিড়ে বসবাস করেও ছবি আঁকেন সাদা-কালোয়। এই বিশেষ ধারায় নিজের জাতকে তিনি ঠিকই চেনান আমাদের। সাধারণ কালি দিয়ে কাগজে ওয়াশ দিয়ে আঁকেন বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপমাধুর্য। আঁকেন সমুদ্রের বালিয়াড়ি, নদীর চর, এমনকি জড়জীবন। কালোরঙের আবহের তীব্রতায় অকস্মাৎ ফুলের রূপ একটি পটের বক্ষ ভেদ করে এসেছে। মিনিমাইজেশনের এ-সৌন্দর্য অসাধারণ! তাঁর নিসর্গচিত্রেও ওই সুর ওই তাল বিদ্যমান। মনে হয় সকালবেলায় প্রায় আলো ফোটার আগে কিংবা সান্ধ্য অন্ধকার জাঁকিয়ে কথার আগে প্রকৃতির যে মৃদুল সৌন্দর্য, তাকে তিনি দারুণ মমতায় মুগ্ধজাগানিয়া দক্ষতায় তুলে ধরেন।
তিনিও ঢাকা চারুকলার স্নাতক এবং বরোদার এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিউজিয়াম ও প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে। এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা।
সাধনা ইসলাম ঢাকা চারুকলার স্নাতক। শিশুর সরলতায় কিংবা লোকশিল্পীর সহজ অঙ্কনে তিনি ছবি এঁকে সুনাম অর্জন করেছেন। চারুকলার পঁচিশ বছর পূর্তির প্রদর্শনীতে (১৯৭৪) পেইন্টিংয়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন ছাত্রাবস্থায়।
নকশিকাঁথার শিল্পীদের মতো করে বিষয়বস্তু ও বর্ণবিন্যাস করেন সাধনা ইসলাম। তার আঁকার সারল্য আমাদের মনে স্নিগ্ধ অনুভূতি এনে দেয়। ‘গ্রামীণ বাংলাদেশ’ শীর্ষক দুটি চিত্রের প্রথমটিতে আমরা দেখি কাস্তে-হাতে কৃষক ও কলসিকাঁখে রমণীকে। কৃষক এখানে শ্রীকৃষ্ণের মতো, আর রমণী যেন রাধার মতো। তাদের পেছনে দুটি ঘরের সাজেশন। আর চিত্রতলজুড়ে নকশা করা পাখি, হাতি, ফুল ইত্যাদি ফর্মের বিস্তার।
শিল্পী শওকাতুজ্জামানের জন্ম ১৯৫৩ সালে ফরিদপুরে। ২০০৫ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে তাঁর অকালমৃত্যু আমাদের চারুশিল্পাঙ্গনের জন্য বয়ে এনেছে শোক। তিনি ঢাকা চারুকলা থেকে স্নাতক করে স্নাতকোত্তর করেছেন বিশ্বভারতী থেকে ম্যুরাল পেইন্টিংয়ে। প্রথম জীবনে শিশু একাডেমীতে শিল্পী হিসেবে কাজ করেন (১৯৭৮-৯৩)। ১৯৯৩ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটে যোগ দেন শিক্ষকতার পেশায়। অসাধারণ প্রাণবান ও বন্ধুবৎসল এ-মানুষটি শিল্পীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিলেন।
ম্যুরাল পেইন্টিংয়ে তাঁর বিশেষ দক্ষতা থাকলেও এ-বিষয়ে তেমন কাজ করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাঁর ¬পেশাগত নানা ব্যস্ততায়। ফলে তিনি একসময় কাগজে-ক্যানভাসে ছবি আঁকতে ধরলেন। স্বচ্ছ ওয়াশে জলরঙে-অ্যাক্রিলিকে তিনি এঁকেছেন প্রকৃতির মিষ্টিরূপ। যেমন তাঁর ‘ফুল ও জীবন’ শীর্ষক দুটি চিত্রকর্মে সেই সাবলীল বর্ণিল প্রকৃতির সহজপাঠ পেয়ে যাই আমরা।
টিএ কামাল কবির অনেকদিন থেকেই আঁকছেন জলজগতের ছবি। সেই জলজগতে আছে নানা বর্ণের, নানা ধরনের মাছ, আছে জলতলের গাছ, শ্যাওলা, জলের বুদ্বুদ। সেই রূপের জগতের রূপ ভিন্ন – পৃথিবীর উপবিভাগের রূপ হতে। কবিরের বর্ণপ্রয়োগ ও কম্পোজিশনে দক্ষতা আছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব আঁকার সময় দেওয়ায় তিনি এ-বিশেষত্ব অর্জন করেছেন।
কামাল কবির এই শিল্পী দলটির মধ্যে সবচেয়ে বর্ষীয়ান। জন্ম ঢাকায় ১৯৫১ সালে। তিনিও ১৯৭৪ সালে ঢাকার চারুকলার স্নাতক। ১৯৭৪ সালেই ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে তাঁর প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়। ১৯৭৩ সালে চারুকলার বার্ষিক প্রদর্শনীতে তেলরঙে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী-শিল্পীর পুরস্কার জয়ী হয়েছিলেন। ‘সত্তরের সাত’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় – ওই সময়ে একসঙ্গে অনেক সৃজনশিল্পীর আবির্ভাব হয়েছিল আমাদেরা শিল্প-আঙিনায়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.