নলিনী দাশ
মাণিকের, মানে সত্যজিৎ রায়ের ছেলেবেলার কথা সুসংবদ্ধভাবে লেখা আমার পক্ষে কঠিন, কারণ আমার নিজের সুমধুর বাল্যস্মৃতির সঙ্গে তা মিলেমিশে গেছে। আমার মা পুণ্যলতা চক্রবর্তী ছিলেন মাণিকের বাবা সুকুমার রায়ের পিঠোপিঠি ছোটবোন। একশ নম্বর গড়পার রোডের যে-বাড়িতে ১৯২১ সালের মে মাসে মাণিকের জন্ম হয়েছিল, আমারও জন্ম হয়েছিল সেই একই বাড়িতে, তার প্রায় পাঁচ বছর আগে। দাদামশাই মানে মাণিকের ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নিজে নকশা করে এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন। তার মাত্র তিন বছর পরে ১৯১৫ সালে তিনি এই বাড়িতেই চোখ বুজেছিলেন।
গড়পার রোডের এই আশ্চর্য বাড়িটার সামনের অংশে ছিল ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয়। একতলায় অফিস ও ছাপাখানা আর দোতলায় স্টুডিও ও ব্লক তৈরির ব্যবস্থা। উত্তরমুখী হলঘরের বড় বড় কাচের জানালাগুলি মনে পড়ে। বাইরের দেয়ালে সুন্দর পদ্ম-ফুলের নকশা ছিল। তার উপরে ইংরেজি হরফে সংস্থার নাম লেখা। দুঃখের কথা, এমন চমৎকার বাড়িটার একখানা ভালো ফটো কেউ তুলে রাখেননি। মাণিকের লেখা যখন ছোট ছিলাম বইয়ের প্রথম ছবিটা দেখলে মোটামুটি ধারণা করে নেওয়া যেতে পারে। কার্যালয়ের বাঁদিকের মানে পূর্বদিকের গলি দিয়ে কিছুটা ঢুকে ডানদিকে তিনতলার বসতবাড়ির দরজা। একতলা-দোতলা-তিনতলার অনেকগুলি ঘরে বসা, খাওয়া, শোয়া। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল সামনের কার্যালয়ের ওপর মস্ত বড় ছাদ আর পেছনদিকে ছোট এক টুকরো ছাদ। বাড়ির দক্ষিণে অনেকটা ঘাসজমি, কিছু ফুলগাছ, তরকারি বাগান, কলাঝাড়, আমগাছ আর পেয়ারাগাছ আমার ছোটবেলার সুখস্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
মাণিক বা আমি কেউই দাদামশাই উপেন্দ্রকিশোরকে চোখে দেখিনি। আমার ছোটবেলায় গড়পারের বাড়িতে দিদিমা আর মামা-মামিরা ছিলেন। বড়মামা সুকুমার রায় আর মামিমা সুপ্রভার ছেলে মাণিক আমার চেয়ে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট আর মেজমামা সুবিমল রায় ও মেজমামিমা পুষ্পলতার ছেলে ধন বা সরলকুমার আমার চেয়ে কয়েক মাসের বড়। নানকুমামা (ছোটমামা) সুবিমল বিয়ে করেননি। আর ছিলেন ধনদাদু (কুলদারঞ্জন রায়) আর তাঁর দুই মেয়ে বুলুমাসি আর তুতুমাসি (মাধুরীলতা ও ইলা)। মামিমা (সুখলতা রাও) মাঝে মাঝে আসতেন। আমরা প্রতি বছরই কয়েকবার মামাবাড়িতে আসতাম। পাশের বাড়িতেও অনেক খেলার সাথি ছিল। আমার ছোটবেলার মামাবাড়ির স্মৃতিতে কত যে খেলাধুলার কথা ছড়িয়ে আছে তার সীমাসংখ্যা নাই। তিনতলার বড় ছাদে কুমির কুমির, কানামাছি, এক্কা-দোক্কা আরো কত কী খেলা!
মাণিকের ছোট ট্রাইসাইকেল পাল্লা দিত ধনদাদার বড় সাইকেলের সঙ্গে। লুকোচুরি বা চোর চোর খেলতে সারাবাড়ি ছাড়িয়ে পেছনের বাগান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তাম। আমগাছ, পেয়ারাগাছের ডালে চড়তেও বাধা ছিল না।
ছাপাখানা বা স্টুডিওতে সদলবলে যাওয়া চলত না। মেশিন যখন চলত, তখন যাওয়া নিষেধ ছিল। বলা বাহুল্য, তবু আমরা ছাড়তাম না। কীভাবে একটা একটা পৃষ্ঠা ছাপা হতো, একটার পর একটা লাল, নীল, হলদে তিনটে রং পড়ে কেমন বহুরঙা ছবি ছাপা হতো, সব দেখতে ভারি মজা লাগত। বাড়তি পাওয়া ছিল ছাপা পৃষ্ঠার কপি, অথবা সামান্য খুঁতওলা রঙিন ছবি। খুব ছোটবেলার স্মৃতিতে এসব অভিযানে কেবল ধনদাদা আর আমি ছিলাম। একটু বড় হতে মাণিকও আমাদের সঙ্গে থাকত।
আমার মামাবাড়ির সমস্ত আবহাওয়াটাই ছিল ছোটদের গল্প, কবিতা, ছবি দিয়ে পূর্ণ। সন্দেশ পত্রিকা আর ছোটদের নানা বই ছেপে বেরোবার অপেক্ষায় না থেকে তার টুকরো প্রুফের ‘গ্যালি’ নাড়াচাড়া করতাম। কেউ আমাদের পড়তে শেখাবার আগেই দিব্যি পড়তে শিখে গেলাম। কত যে ছোটদের বই ছিল সেই আশ্চর্য বাড়িতে! চাবি না লাগা আলমারির বুকে, এমনকি শেলফ, টেবিলেও বোঝাই থাকত থরে থরে বই আর পত্রিকা। প্রথম থেকে সমস্ত সন্দেশ তো ছিলই, আরো কত যে ছোটদের গল্পের বই, বুক অব নলেজ, আরো কত কি! তাছাড়া, ধনদাদু থেকে শুরু করে মামারা, মামিরা সবাই ছিলেন গল্প বলার ওস্তাদ।
আমার মামাবাড়ির এই আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে সবার ছোট, সবার আদরের মাণিক ক্রমে বড় হয়ে উঠেছিল। একটা করুণ বিষাদের স্রোত যে এই আনন্দধারার পাশাপাশি বয়ে চলেছিল, সেটা আমরা, ছোটরা ভালো করে না বুঝলেও কিছুটা অনুভব করতে পারছিলাম। মাণিকের জন্মের কিছুদিন পরেই বড়মামা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরে জেনেছিলাম যে, সেটা ছিল কালাজ্বর, যার চিকিৎসাপদ্ধতি বা ওষুধ তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। যদিও বড়মামা শুয়ে শুয়েই লিখতেন, ছোটবড় সবার সঙ্গে হাসি-গল্প করতেন, তবু বুঝতাম যে, তিনি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
বড়মামাকে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো। প্রায়ই আমরাও সঙ্গী হতাম। দার্জিলিং, গিরিডি আর বিশেষভাবে সোদপুরে (পানিহাটিতে) যাবার কথা মনে আছে। তারপরে আর বড়মামাকে নিয়ে কলকাতার বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
সোদপুরে মস্ত বাগানের মধ্যে একটা বাড়িতে ছিলাম। গঙ্গার ধারের ঘরে, জানালার পাশে বিছানায় শুয়ে শুয়েই বড়মামা কত যে লিখতেন, ছবি আঁকতেন। কাছেই মাণিক বসে খেলা করত, মাঝে মাঝে বড়মামা তার সঙ্গে কথা বলতেন। সেই সময় আঁকা ‘সূর্যাস্তে গঙ্গা’ ছবিটি সম্ভবত বড়মামার অাঁকা সর্বশেষ জলরঙের বড় ছবি। পরে সন্দেশ পত্রিকায় সেটা প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে যখন বড়মামা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, তখন মাণিকের আড়াই বছরও পূর্ণ হয়নি। দু-তিন বছর পরে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্সে’র ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল, সন্দেশ পত্রিকা উঠে গেল আর বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেল। আমাদের মামাবাড়ি যাওয়া বন্ধ হলো। আত্মীয়-স্বজন ছড়িয়ে পড়লেন। মাণিককে নিয়ে মামিমা চলে গেলেন ভবানীপুরে তাঁর ছোট ভাইয়ের কাছে। এরপর থেকে আমাদের বাড়িটাই হলো সমস্ত আত্মীয়-স্বজনের ছুটি কাটাবার জায়গা।
মাণিক তার যখন ছোট ছিলাম বইতে লিখেছে যে, ছুটিতে বাইরে গিয়ে ‘সবচেয়ে বেশি স্ফূর্তি হতো মেজপিসিমার বাড়িতে।’ এটা খুবই স্বাভাবিক। আমার বাবা অরুণনাথ চক্রবর্তী বিহার সিভিল সার্ভিসে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ করতেন। যখন যেখানে বদলি হয়ে যেতেন, শহরের বাইরে বড় দেখে বাগানওলা বাড়ি ভাড়া করতেন। বাড়িতেই আমরা ছিলাম খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো মিলে পাঁচ ভাইবোন। নানকুমামা আর আমার পিসিমা প্রতি ছুটিতেই আমাদের বাড়ি আসতেন। মাণিককে নিয়ে মামিমাও বছরে অন্তত একবার বাড়ি আসতেন। তাছাড়া, ধনদাদা, তুতুমাসি, বুলুমাসি, ছোড়দাদুর (প্রমদারঞ্জন রায়) ছেলেমেয়েরা, আরো কত আত্মীয়-স্বজন যে আসতেন! ছুটিতেই সব সময় বাড়িটা গমগম করত। বাবা ছিলেন ভারি আমোদ আর স্ফূর্তিবাজ মানুষ। আর মার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল সেসব আমোদ আর স্ফূর্তির উপযুক্ত ব্যবস্থা করার। কত যে ভোজ, দূরে দূরে গাড়ি করে গিয়ে কত পিকনিক, কাছে-দূরে কত যে বেরিয়ে বেড়ানো আর বাড়িতেই কত যে খেলা, গান আর গল্প!
আমরা সবচেয়ে বেশিদিন থেকেছি হাজারিবাগে – ১৯২৪ থেকে দুইবারে মোট প্রায় ছ-বছর। স্বাস্থ্যকর আর সুন্দর জায়গা বলে এখানে আত্মীয়-স্বজন অনেকেই এসেছেন। কখনো কখনো বাড়িতে জায়গা হয়নি, আলাদা বাড়ি ভাড়া করতে হয়েছে। সেই সময় মস্তবড় দল বেঁধে কত যে বেড়িয়েছি আর পিকনিক করেছি, বলে শেষ করা যায় না।
প্রথমবার যখন মামিমারা হাজারিবাগে এলেন, তখন মাণিকের বয়স সাড়ে চার বছর। তখন থেকেই সে আমাদের সঙ্গে খেলত। সে সবচেয়ে ভালোবাসত ডাক্তার সাজতে। মস্ত বড় ব্যাগ হাতে নিয়ে, গলায় ‘স্টেথোস্কোপ’ ঝুলিয়ে সে আমাদের পরীক্ষা করে অনেক ওষুধ আর ইঞ্জেকশন দিত।
এরপর গেলাম দ্বারভাঙায়। সেখানে আমাদের বাড়িটা ছিল মস্তবড় ফলবাগানের মধ্যে। সেই বাগানে অনেক কাঁঠাল, লিচু, কালোজাম আর পেয়ারার গাছ ছিল, আর ছিল চুয়াল্লিশটা আমগাছ। খুব ভালো ভালো ল্যাংড়া, বোম্বাই, ফজলি, সিঁদুরে, পেয়ারাফুলি আরো কত যে বিচিত্র জাতের আম, যা আগে কখনো দেখিনি বা নাম শুনিনি। শুনেছি বড়মামা নাকি কোনো ফল খেতেন না। মাণিকও খেত না। মামিমার ভারি দুঃখ – এতো ভালো ভালো গাছ-পাকা আম, তার একটাও খাবে না? শেষে আমি একদিন খুব ভালো বোম্বাই আমের রস ঘন দুধের সঙ্গে গুলে, তাতে চিনি, কোচিনিল আর ভ্যানিলা মিশিয়ে তার স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ বদলে দিলাম। তখন মাণিক আম খেল – তাও খুব ভালোবেসে নয়।
ছোটবেলায় মাণিকের একটা ভারি প্রিয় খেলা ছিল – সে যখনই আমাদের বাড়ি আসত, সেটা বড়দিন, পুজো বা গরমের ছুটি, যাই হোক না কেন, ফাদার খ্রিষ্টমাসকে একদিন আসতেই হতো! কল্যাণদাই যে ফাদার খ্রিষ্টমাস সাজত, সেটা আমরা যেমন জানতাম, মাণিকও জানত। লাল জোববা, লাল টুপি আর লম্বা পাজামা পরে, তুলোর দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে, পিঠে একটা মস্ত ঝোলায় অনেক খালি টিন নিয়ে সে মাঝরাতে ঝমর ঝমর করতে করতে আসত। মাণিকের সে কি উত্তেজনা! ঘুমে চোখ জুড়ে এলেও সে ঘুমোবে না। আমাদের সবার জন্যই ছোটখাটো উপহার থাকত। মাথার কাছে ঝুলিয়ে রাখা মোজায় সেসব দেওয়া হতো। মাণিকের জন্য মা একটা ভালো কিছু উপহার কিনে দিতেন। যখন মাণিক আর ফাদার খ্রিষ্টমাসকে চাইল না, তখন বুঝলাম সে বড় হয়েছে।
মাণিক যত বড় হতে লাগল, ক্রমে সে আরো ভালোভাবে আমাদের সমস্ত কাজ আর খেলার সাথি হলো। আমরা চার বোন আর মাণিক ও কল্যাণদা দুই ভাই সে যে কত খেলা জমাতাম, তা বলে শেষ করা যায় না।
ফটো তোলা আর ডাকটিকিট জমানোর ব্যাপারে মাণিক আর কল্যাণদার মধ্যে ভারি ভাব। দশ বছর বয়স থেকেই মাণিক চমৎকার ছবি তুলত। হাজারিবাগে কোনো সুন্দর ঝরনা বা পাহাড়ের ফটো তোলার জন্য সে কখনো দাঁতে ক্যামেরা কামড়ে ধরে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে যেত। কল্যাণদা মন্তব্য করত ‘ডেসপারেডো’! ঠাট্টা-তামাশায় বিরক্ত হয়ে কল্যাণদা যখন মুখ হাঁড়ি করত, মাণিক তাকে বলত ‘ডিসগাসটেগো’। দুজনে মিলে ‘রায় চক্রবর্তী’। ভারি স্ফূর্তিবাজ খেলার সাথি ছিল মাণিক। লুডো, স্ন্যাকস অ্যান্ড ল্যাডার্স আর তাসের নানারকম খেলাও খেলতাম, কিন্তু প্রচলিত লেখায় আমাদের মন উঠত না। তাই মজার ছড়া-গল্প লেখা, ছবি আঁকা আর গান রচনায় কত যে বিচিত্র খেলা উদ্ভাবন করতাম আর রকমারি বুদ্ধির খেলা খেলতাম তার সীমাসংখ্যা নেই।
একটা ভারি মজার খেলা ছিল। সরু লম্বা একটা কাগজে প্রথমে একজন একটা ছবি আঁকত, দ্বিতীয় খেলুড়ে ছবির একটা নাম লিখে, ছবিটা মুড়ে কাগজটা তৃতীয়জনকে দিত, তৃতীয় খেলুড়ে সেই নাম দেখে একটা নতুন ছবি আঁকত; তারপর নামটা মুড়ে পরের খেলুড়েকে কাগজটা দিত, এইভাবে চলতে চলতে কোথাকার জল কোথায় গড়াত তার ঠিক নেই। একবার কে যেন আঁকল মাণিক বাছুরকে কাতুকুতু দিচ্ছে – (সত্যিই সেরকম ঘটেছিল) তারপর নাম আর ছবি বদল হতে হতে শেষ লেখাটা দাঁড়াল যখন ‘রায় চক্রবর্তী ফাইট’, তখন আমরা এমন হাসলাম যে কল্যাণদা সত্যি সত্যি ডিসগাসটেড হয়ে গেল।
এসব লেখার সঙ্গে সঙ্গে আবার চলত আমাদের যত উদ্ভট রসের মজার গান, অধিকাংশই নানকুমামার সব অদ্ভুত গল্প থেকে নেওয়া। যেমন একটা গান ছিল, ‘কেরোসিনের সুবাতাসে/ মহাপ্রাণী ভেসে আসে/ খাও খাও ভৈরে টিন/ কেরোসিন! কেরোসিন!’ আর একটা গান ছিল হনলুলু প্যাঁপ্যাঁ প্যাঁপ্যাঁ!’ পাঁচ-ছ’জনে মিলে ছবি অাঁকা, ছড়া-গল্প লেখার খেলা চলত, একজন যখন লিখত, অন্যরা তখন গান চালিয়ে যেত। নতুন নতুন পদ রচনা করে গেয়ে চলতে হতো। যেমন একজন গাইল ‘হনলুলু কুচিকুচি’, চতুর্থজনকে গাইতেই হবে ‘হনলুলু প্যাঁপ্যাঁ প্যাঁপ্যাঁ’। অর্থহীন এই গান রচনার নিয়ম কিন্তু ভারি কড়া। ঠিক পরপর পদ রচনা করে গেয়ে যেতে হবে। যেমন ‘হনলুলু বেগুনভাজা/ হনলুলু তাজা তাজা/ হনলুলু গজা খাজা/ হনলুলু প্যাঁ-প্যাঁ।’ কেউ যদি উপযুক্ত পদ ভেবে চট করে না গাইতে পারে তার নম্বর কাটা যাবে।
তামাশা করতেও ভারি ওস্তাদ ছিল মাণিক। একটা ঘটনার কথা বলি। হাজারিবাগে একবার আমরা সবাই ক্যানারি হিলে পিকনিক করতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি, ওদিকে মেঘ ঘনিয়ে আসছে। আকাশের অবস্থা দেখে মা বলছেন, ‘অমন ঝড়-জল মাথায় করে বেরিয়ে দরকার নেই, বাড়িতে বসেই খাওয়া-দাওয়া করা যাক।’ আর বাবা বলছেন, কপাল ঠুকে বেরিয়ে পড়া যাক। মাসিমার ছোট মেয়ে শীলা, মাণিকের চেয়ে মাস কয়েকের ছোট। সে তখন আমাদের বাড়িতে ছিল। সে ভারি সরল-সাদাসিধা। মানিক এসে তাকে বলল, ‘শুনলি তো, মেজ পিসেমশাই বলেছেন যে কপাল ঠুকলেই বেরিয়ে পড়া যাবে। আয়, তুই আর আমি কপাল ঠুকি।’ এই বলে মাণিক খুব আস্তে আস্তে দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকতেই তার পাশে শীলা ঠকাশ করে জোরে মাথা ঠুকেছে। আমরা হেসে অস্থির। শীলাকে বোঝাতে পারি না যে, ‘কপাল ঠোকাটা’ কথার কথা, কেবলই সে দেয়ালে মাথা ঠোকে! বাবা-মা এসে রক্ষা করলেন, বললেন, ‘এবার চল, সত্যিই বেরিয়ে পড়ি।’
কোনো মানুষের অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি কোন বয়সে প্রথম বোঝা যায়? এর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম আছে বলে জানি না। মাণিকের কথাই ধরা যাক। সুকুমার রায়ের একমাত্র সন্তান যে সাধারণ হবে না। এটা সকলেই স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিয়েছিলাম, তাই ছোটবেলা থেকেই তার কথাবার্তা, ব্যবহারে যে প্রখর বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যেত, সেটা তার পক্ষে স্বাভাবিক বলেই মনে করা হতো।
পড়াশোনায় মাণিক ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো ছিল। বয়স ও শ্রেণি অনুপাতে পড়ত বেশি, জানত অনেক বেশি। কিন্তু ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হবার দিকে আগ্রহ বা চেষ্টা ছিল না। বরঞ্চ তার আক্ষেপ ছিল যে, অন্য বাড়িতে ছেলেরা ভালোভাবে পাশ করলেই খুশি হয় আর তার বাড়িতে কিনা প্রথম বা দ্বিতীয় না হলে কেউ সন্তুষ্ট নয়।
মাণিকের মামাবাড়িতে সংগীতচর্চার আবহাওয়া ছিল। তার ছোটমাসি কণক দাস (বিশ্বাস) নামকরা গাইয়ে ছিলেন। মামিমাও চমৎকার গাইতেন।
কিন্তু মাণিকের গান শেখার উৎসাহ ছিল না। আমাদের বাড়িতে গানের চর্চা ছিল না, কিন্তু ছুটিতে মামিমা এলে আমরা গান শুনতাম। দু-একটা ভালো গান শিখে নিয়ে কোরাস গাইতাম। মাণিক আমাদের গানে যোগ দিত না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে তার সুরজ্ঞান এত ভালো ছিল যে, কোথাও খটকা লাগলে মাণিক তাকে জিজ্ঞেস করত।
ছোটবেলায় মাণিকের কোনো অসাধারণ রচনাশক্তির পরিচয় পাইনি। আমাদের মজার গান-গল্প-ছড়া রচনার খেলায় অবশ্য সে আশ্চর্য নৈপুণ্য দেখাত। ভাবতে অবাক লাগে যে, যদিও মাণিক আমাদের চেয়ে পাঁচ-ছয় বছরের ছোট ছিল, খেলার সময় সে-কথা আমাদের মনে থাকত না। কারণ সে সবার সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিতে পারত।
দশ-বারো বছর বয়সেই মাণিক চমৎকার ছবি তুলত। অবশ্য আমরা তখন ছবি তুলতাম বক্স ক্যামেরায়। সেখানে ফটোগ্রাফারের কৃতিত্ব দেখাবার সুযোগ ছিল একমাত্র বিষয় ও দৃষ্টিকোণ নির্বাচনে। এ-কাজ মাণিক খুব ভালো পারত। এখনো আমাদের পুরনো অ্যালবামে মাণিকের ছোটবেলায় তোলা হাজারিবাগের পাহাড়-ঝরনার সুন্দর কিছু দৃশ্য ধরে রাখা আছে।
খুব ছোটবেলা থেকে মাণিক ছবিও চমৎকার আঁকত। দশ-বারো বছর বয়সে সে জলরঙে, পেনসিলে ও কালি-কলমে সুন্দর প্রচ্ছদ আঁকতে পারত। কালি-কলমে সে রাজা রামমোহন রায়ের আশ্চর্য সজীব একটি প্রতিকৃতি এঁকেছিল মনে আছে। দুঃখের বিষয়, সে-ছবিটি রক্ষা করা যায়নি।
আমি যখন বিএ পড়ি, মাণিক তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসে। আমাদের এক বিদায়ী অধ্যাপকের মানপত্র মাণিককে দিয়ে সৌখিন অক্ষরে কপি করিয়ে, নকশা অাঁকিয়ে নিয়েছিলাম। আমাদের কলেজে সবার সেটা ভারি পছন্দ হয়েছিল। সকলে মনে করেছিলেন যে, সেটা বুঝি কোনো দক্ষ চিত্রকরের কাজ!
ছোটবেলা থেকেই মাণিক সিনেমা দেখতে ভালোবাসত। তখন আমরা সিনেমাকে বলতাম ‘বায়োস্কোপ’। মাণিকরা কলকাতায় থাকত। তার মামাবাড়ির সকলের নানা বিষয়ে উৎসাহ ছিল, তাই ভালো ছবি দেখার সুযোগও সে অনেক পেত। খুব ছোটবেলায় সে বলেছিল যে, বড় হয়ে ‘জার্মানি থেকে শিখে এসে’ খুব ভালো ফিল্ম তৈরি করবে। তখন অবশ্য তার সে-কথার কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নিজেও হয়তো দেয়নি।
হোস্টেলে থেকে যখন কলেজে পড়তাম, মাণিকরা তার ছোটমামার বাড়ি ভবানীপুরে থাকত। ছুটিতে মামিমারা আমাদের বাড়ি হাজারিবাগে বা ছাপরায় আসতেন। হোস্টেল থেকে ছুটির দিনে আমরাও মাঝে মাঝে ওদের বাড়ি যেতাম। নানা কথাবার্তার মধ্যে সিনেমার বিষয়েও কথা হতো। মার পিসতুতো ভাই পুতুল-মামা (নীতিন বসু) মাণিকের পুতুলকাকা এবং আরো কিছু গুণী নির্দেশক তখন নতুন ধরনের বাংলা ছবি তৈরি করে নাম করেছেন। বিজলী সিনেমায় কোনো নতুন ভালো ছবি হচ্ছে, আমরা সেটা দেখিনি – শুনলে মাণিক উৎসাহিত হয়ে নিজেই টিকিট কিনে এনে আমাদের সেই ছবি দেখিয়েছে, এমনও দু-একবার হয়েছে।
কবে থেকে মাণিকের মনে ছবি তৈরি করবার দৃঢ় সংকল্প গড়ে উঠেছে, সে-বিষয় কিন্তু জানতে পারিনি। প্রথম জানলাম, যখন পথের পাঁচালীর কাজ শুরু হয়েছে। সেসব সত্যজিৎ রায়ের ছেলেবেলার ঘটনা নয়। তাছাড়া এই নিবন্ধের বিষয়ও ভিন্ন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.