সত্য-সাধনা-বিশ্বাসের প্রতীক

মতলুব আলী
১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রীতিমতো একটা বৈরী সামাজিক পরিবেশে ঢাকায় উচ্চতর শিল্প-শিক্ষায়তন বা আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ডাকে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে একদিন এর পেছনে অক্লান্ত নিঃস্বার্থ পরিশ্রম করেছেন স্বনামখাত সৃজনশিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁদের অন্যতম। আশির দশকে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তিনি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছিলেন : ‘আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে। ডক্টর কুদরত-ই-খুদার জন্য কাজটা অনেক এগিয়ে এসেছিল। শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে কাজ চললো পেইন্টিং এবং গ্রাফিক্স পাশাপাশি।’ জন্ম ১৯২২ সালে, জন্মস্থান চবিবশ পরগণা। শিক্ষা ‘কলকাতা আর্ট স্কুলে’, সেখানেই শিক্ষক জীবনেরও শুরু। ছবি অাঁকা অর্থাৎ সৃজনশীল কর্মের জন্য প্রতিকূল সমাজ-পরিবেশ তথা মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে পারিবারিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শিল্পের জগতে তাঁর পদার্পণ এবং স্বনামে প্রতিষ্ঠালাভ বিশেষ গুরুত্ববাহী ঘটনা। এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম শিক্ষাগুরু অকালপ্রয়াত শিল্পী আবদুল মঈন যাকে তিনি সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রেখেছিলেন, তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যময় ওরিয়েন্টাল ধারার ভক্ত। কিন্তু তাঁর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় শিল্প-শিক্ষার প্রথম সোপান অতিক্রম করলেও সফিউদ্দীন গ্রহণ করেছিলেন পাশ্চাত্য ইউরোপীয় ধারার শিক্ষা-পদ্ধতি। আর জীবনভর সেই রীতি-ধারারই একনিষ্ঠ সাধক-শিল্পী ছিলেন তিনি। একজন প্রথিতযশা মহান চিত্রশিল্পীর পরিচয়ে তাঁকে আমরা সম্প্রতি হারিয়েছি।
বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশ শিল্পাঙ্গনে প্রভাবশালী আধিপত্য বিস্তারী কর্মশাখা হিসেবে ছাপচিত্রের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা ও আসন, আধুনিকতার পথে তার জয়যাত্রা আজও অব্যাহত – আর তারই বিকাশ অগ্রগতির ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকাও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে (১৯৫৮ সালে) লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস থেকে এচিং ও এনগ্রেভিংয়ে ডিস্টিংশন নিয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করে তাঁর ফিরে আসার অব্যবহিত পরই শুরু হয়েছিল এই নবতর সফিউদ্দীন-শিল্পযাত্রা। উল্লেখ্য, দেশ বিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে আসার সময় তরুণ শিক্ষক-শিল্পী ছাপাই ছবির ক্ষেত্রে কৃতিত্ব ও সাফল্যের নানা প্রমাণ সঙ্গী করে এনেছিলেন – উড-এনগ্রেভিং ‘বাঁকুড়ার সোনামুখী গ্রাম’ (১৯৪০), ‘জানালা দিয়ে দেখা’ (১৯৪২), ‘বাড়ি ফেরা’ (১৯৪৫), ‘সাঁওতাল রমণী’ (১৯৪৬), ‘বুনোপথে’ (১৯৪৭); এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট ‘পায়রা’ (১৯৪৬) এবং ড্রাই পয়েন্ট ‘বৃক্ষরাজি’ ও ‘ভিউ ফ্রম শান্তিনিকেতন’ (১৯৪৬) প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে তিনি তখনই সমাদৃত হয়েছিলেন ও সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। বলাবাহুল্য, সেই ধারাবাহিকতাতেই তাঁর গ্রাফিক্স শিল্পী হিসেবে সমধিক পরিচিতি। তাই উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য তাঁর ইউরোপযাত্রা বাংলাদেশের শিল্পান্দোলনের অগ্রসরমানতায় একটি নতুন আলোকিত পথের উন্মোচন ঘটিয়েছিল আর বলাবাহুল্য শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের ব্যক্তিগত শিল্পসাধন ক্ষেত্রে সমূহ সম্ভাবনার দ্বারোদ্ঘাটনের চেয়েও ওই ঘটনা বৃহত্তর দৈশ্বিক শিল্প-অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে ছিল অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। এ-বিষয়ে ভারতের প্রখ্যাত প্রগতিবাদী চিত্রশিল্পী সোমনাথ হোরের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। সোমনাথ হোর তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন, তিনি বলেছেন : ‘সফিউদ্দীন আহমেদের কাঠ খোদাই আমাকে প্রভাবিত করেছে। ওনার কাজের কৃৎকৌশল খুবই আকর্ষণীয়। ছাত্রদের হাতে ধরে দেখিয়ে দিতেন সমস্ত পদ্ধতি। উনি কথা কম বলতেন, কাজের প্রতি ছিল অসাধারণ ধৈর্য আর মনোযোগ। সর্বদাই কাজ নিয়ে আলোচনা করতেন আমাদের ক্লাসে। তিনি বলতে গেলে একজন আদর্শ দরদি শিক্ষকও ছিলেন।… উনি যাওয়ার আগে বাংলাদেশে ছাপচিত্র কিছুই ছিল না। সেদিক থেকে ওনাকে বাংলাদেশে ছাপচিত্রের পথিকৃৎ বলা যেতে পারে।’ সফিউদ্দীন আহমেদ প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের আধুনিক নিরীক্ষাধর্মী ছাপাই ছবির জনক। বিশিষ্ট লেখক ও শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক বুলবন ওসমান যথার্থই উল্লেখ করেছেন : ‘তাঁর কাজকে লন্ডনে যাওয়ার পূর্ব এবং পরবর্তী এই দুটো ধারায় ফেলা যায়। তাঁর বিচার বোধ শিল্পকর্মে দ্বিধাহীন। নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পবোধে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠদের সমকক্ষ।’ অথবা সুবিদিত যে, সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁর শিল্পভুবনের প্রামাণ্য উৎকর্ষ-সন্ধানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে অভিনবত্ব স্থাপিত এক ভিন্নমাত্রার নিপুণ কারিগরিতা সমৃদ্ধ সৃজন-সম্পদ রেখে গেছেন – আর তিনি শিক্ষক হিসেবেও প্রদর্শন করেছেন এক অসম-বনেদি পরিমাপের সুশৃঙ্খল মূল্যবোধসম্পন্ন যৌক্তিক মাত্রা। তাই এক নিবেদিতপ্রাণ শিল্প-শিক্ষাগুরুর সম্মান দিয়েই তাঁকে আমরা শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছি।
শিল্পী-শিক্ষক সফিউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তাঁর একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে নানা সময়ে অজস্রবার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আলাপচারিতায় অনন্যসাধারণ গুণপনা ছিল তাঁর। খুবই সুচিন্তিত মাপা ছাঁদে কথা বলতেন, সূক্ষ্ম রসবোধ প্রকাশেও সফিউদ্দীনের তুলনা ছিলেন তিনি নিজে। রাগ-অভিমানের প্রকাশও করতে দেখেছি তাঁকে। নববইয়ের দশকে একদিন অনেকটা খেদের সঙ্গেই যেন বললেন, ‘আমি যে এতোদিন ধরে একটা বিষয় নিয়ে (মাধ্যম নিয়ে) নাড়াচাড়া করছি, চেষ্টা করছি – তা নিয়ে কেউ কখনো কিছু বলেছে? কেউ আমার এনগ্রেভিং সম্পর্কে কিচ্ছু বলেনি।’ ওই কাছাকাছি সময়ে কাকতালীয়ভাবে কলকাতায় ছাপাই ছবি চর্চার অতীত গৌরব বিষয়ে একটি দীর্ঘ আলোচনা-নিবন্ধ বিখ্যাত দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল – সেখানে কলকাতার সরকারি আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস কলেজের প্রাক্তন কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সফিউদ্দীনের নামও বিশেষ গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করেছিলেন নিবন্ধকার। তাই পড়ে আমাকে অনেকটা কৌতুক করে যেন বললেন : ‘ওহে, ভালো ছাত্র যে ছিলাম কখনো, এতোদিন পর তা জানলাম।’ এরকম কথা তাঁর কাছে আমার মতো অনেকেই হয়তো শুনে থাকবেন – যাঁরা তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তার পরেও আমার বিবেক আমাকে সদা সতর্ক করে তোলে এমনতর একটা ভাবনায় যে, এমনো তো হতে পারে, এসব কথা ঠিক এভাবে হয়তো অন্য কারো কাছেই তিনি বলেননি। তাই মনে করি, আমার নোটখাতা থেকে কিছু কিছু সর্বজন সমক্ষে উপস্থাপন করাটাই বরং শ্রেয়।
‘জীবন বড় বিচিত্র – different stage-এ different life’ – একথা উচ্চারণ করলেন একদিন (০৯/১০/১৯৯২ তারিখে) তাঁর বাসার বসার ঘরে বসে। ও-কথার পরেই বললেন : ‘স্ট্রাগল্ ছাড়া কিছু হয় না।’ এ-জাতীয় কথাবার্তার উল্লেখে খুব সহজেই অাঁচ করে নেওয়া চলে তাঁর জীবনবোধ ও বাস্তববোধের মাত্রাটি ছিল গভীর অভিজ্ঞতালব্ধ চেতনার সাথে সম্পৃক্ত। আর এসবই তাঁর শিল্প-চেতনারও পরিপূরক। স্যারের কথাবার্তা শুনে অনেক সময়ই আমার মনে হয়েছে যে, ব্যক্তি-সফিউদ্দীন আর শিল্পী-সফিউদ্দীন একে অন্যকে পর্যায়ক্রমে প্রভাবিত করেছে। তারই মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছেন একজন পরিপূর্ণ সুশীল মানুষ সফিউদ্দীন, যাঁর পক্ষে কোনো ভনিতা ছাড়া অনায়াসেই বলে ওঠা সম্ভব ছিল, ‘মূল কথা হচ্ছে সত্য, সাধনা আর বিশ্বাস।’
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ একজন গবেষক-শিল্পস্রষ্টা হিসেবে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন জীবনভর। ‘নিজের কাজের fault থাকলে তা make-up করা খুব জরুরি।’ বলতেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একথা – আর এ-ব্যাপারে এতোটাই আত্মসচেতন ছিলেন যে, নিজের কাজের ভ্রম-সংশোধন করতে করতেই এগিয়ে যেতেন তাঁর শিল্প-সমস্যার সমাধানের পথে। অনেক সময় কোনো বিশেষ একটি শিল্পকর্মের একটি পর্যায়ে হয়তো বা থমকে দাঁড়িয়েও পড়তেন – কিছুতেই এগোতে পারতেন না, এমন হয়েছে। বৎসরাধিককাল পেরিয়েও শেষ করতে পারেননি। নিজের কাজের সমালোচনা নিজেই করতেন, আর চেষ্টা করতেন পরিশুদ্ধ ত্রুটিহীন রচনায়। একটি অসম্পূর্ণ তেলচিত্র স্যারের স্বামীবাগের বাসায় দেয়ালে ঝুলে থাকতে দেখেছিলাম প্রায় তিন-চার বছর। প্রতিদিন দেখতেন, আর ভাবতেন ওই চিত্রজমিনে আর কী করা যেতে পারে যার মাধ্যমে তা সমাপ্ত বলে ধরে নেওয়া যাবে। আমার কাছে কখনই মনে হয়নি কাজটি অসম্পূর্ণ – জিগ্যেস করেছিলাম, ‘স্বাক্ষর করছেন না কেন?’ – বলেছেন, ‘অনেক কাজ বাকি, ভালো করে দেখছি।’ আবার একদিন দেখালেন একটি প্রচন্ড সমস্যাসঙ্কুল চিত্র-পদক্ষেপ। আমাকে বুঝিয়ে বললেন যে, সাধারণভাবে সবাই জানে কম্পোজিশনে বা চিত্রাবয়বে কোনো অংশে লাল থাকলে দর্শক-দৃষ্টি বা চোখ সেখানেই আটকে যায়। তিনি ওই থিওরি মানতে চান না – আর চেষ্টা করছেন কিভাবে তা প্রমাণ করা যায়। তাই ক্যানভাসের বাম-ডান দুদিকে গাঢ় লালের প্রায় বর্গাকার দুটি আকৃতি বসিয়ে রেখে চিত্রপটের মাঝ বরাবর লাল-নিরপেক্ষ রঙের ব্যবহারে বর্ণ-আকার বা টেক্সচার কিংবা নকশি রূপায়ণে এমন গভীর কিছু রূপ সৃষ্টি করতে যা লালের থেকে দৃষ্টিকে টেনে ধরবে ছবির কেন্দ্রে। কঠিন অধ্যবসায় আর এহেন চ্যালেঞ্জিং নিরীক্ষা-গবেষণা একমাত্র যাঁকে শোভা পায় তিনিই হলেন সফিউদ্দীন। এ-প্রসঙ্গেই আমাকে শুনিয়ে বলে উঠেছিলেন : ‘আমার একটা খারাপ অভ্যাস হচ্ছে এক্সপেরিমেন্ট করা।’
বলেছিলেন : ‘Symbol-এর মাধ্যমে বিষয়বস্ত্ত ফুটিয়ে তোলা ভালো – representation of subject matter সরাসরি করবার দরকার নেই।’ আর আমাদের অজানা নয়, শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্প-ভুবনে এই প্রতীকী উপস্থাপনা বারংবার সংঘটিত হয়েছে। রঙে, রেখায় আর আকার-আকৃতিতে কি তেলরং, কি ক্রেয়নের কিংবা কন্টির কালো আবেশে অথবা এচিং-ড্রাই পয়েন্ট, অ্যাকুয়াটিন্ট এবং মিশ্র-মধ্যমে তার প্রমাণ অজস্র। আবার তাঁর এই নিরীক্ষা-গবেষণায় সমবিমূর্ত এবং নির্বস্ত্তক রূপাভাস যেভাবেই প্রভাবশীল থাকুক না কেন প্রকৃতি, সমাজ-পরিবেশ আর মানুষ-পশুপাখি বর্জন করবার কোনো লক্ষণ তিনি দেখাননি। জীবনবাস্তবের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টাই যেন ঘুরেফিরে করেছেন তিনি। তাই তো আমরা জানতে পারি, ২০০৮ সালে জীবনের শেষ ছবিটি তিনি এঁকেছিলেন মোরগ-মুরগির শূন্য খাঁচা – সে-সময় বার্ড ফ্লুতে মহামারিরূপে আক্রান্ত হয়েছিল গ্রামবাংলা। আমার তো মনে হয় না বাংলাদেশের আর কোনো চারুশিল্পী এভাবে আন্তরিকতাপূর্ণ উপলব্ধির সংবেদী তাৎপর্যে বাস্তব জীবনের সংকটকে মূর্তিমান করেছেন শিল্পরূপ প্রদানের মাধ্যমে। শিল্পী সফিউদ্দীনের এ-জাতীয় কাজের উদাহরণ আরো একাধিক দেওয়া যাবে।
আবহমান বাংলার চিরসঙ্গী দুর্যোগ বিশেষত বন্যার ভয়াবহ মর্মান্তিক পরিণতি এবং খরস্রোতা পানির গতিবেগ; তাতে ছুটে চলা ক্ষিপ্রগতির মাছেদের চঞ্চলতা, তাদের অবিরাম ছুটে চলা; প্রকৃতির রূপ-অন্বেষায় মাতোয়ারা শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের প্রায় যাবতীয় চিত্রকর্মে প্রতিষ্ঠিত আকৃতি-প্রকৃতির মূল উৎস ও প্রেরণার বেশ বড় একাংশ জুড়ে রয়েছে তাঁর এই বাস্তব অভিজ্ঞতার নির্যাস। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাঁর সূক্ষ্ম জীবনবোধ : ধান মাড়াই করা চাষি, জেলে আর গুণটানা মাঝি থেকে শুরু করে আধুনিক শহর ও শহরতলি এলাকার ফুটপাতের পুরনো কাপড় বিক্রেতাকে বিষয়-উপজীব্য করে অাঁকা চিত্ররাজির দিকে লক্ষ্য করলেই এ-সত্যের প্রমাণ মিলবে। মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর একাত্মতার বোধে কোনো ফাঁক ছিল না – কালোয়, কাগুজে চিত্রপটে শুধু রেখা-ছায়ে এঁকেছেন ড্রইং-কাঠামোসর্বস্ব শক্তিশালী রূপবন্ধে, আবার পরিপূর্ণ বর্ণিলতায় রঞ্জকদ্রব্যের যথাযথ মাত্রা-আরোপে সম্পন্ন করেছেন চিত্রশিল্প সুগভীর শিল্পিত ভাবনায়। তাঁর ছবি স্বভাবত ছিমছাম, পরিপাটি, নিটোল যত্নে সুনিপুণ ব্যাখ্যাধর্মী বা এক্সপ্রেশনিস্ট ধাঁচের, আর সেই শিল্পকর্ম-সম্ভারে সর্বদাই তাঁর বিনয়ী নম্র সপ্রতিভ ব্যক্তিত্বের ছাপ প্রচ্ছন্ন নয়।
আত্মকথনে বর্তমান নিবন্ধকারের কাছে বর্ণিত করেছেন : ‘পার্টিশনের আগে ছবি অাঁকতে প্রায়ই দুমকা যেতাম। সেখানে সাদাসিধে সাঁওতালরা – তখনো তাঁদের সেই আদিম অবস্থায়ই ছিল। মানুষও তাঁরা ছিল শান্ত প্রকৃতির, অনেস্ট। আমার খুব ভালো লাগত। সাঁওতাল পরগণার মাটির রং গ্রিনিশ-ব্রাউন আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। প্রথমে তাই হতো – এখানে (ঢাকায়) এসে ব্লু ও গ্রিনের প্রভাব চলে এলো। আমার ছবিতে এই ব্লু ও গ্রিন আয়ত্তে আনতে আমার খুব বেগ পেতে হয়। আমার পরিবেশটা – এই স্বামীবাগ, গ্রামের মতো – পছন্দ করেই এ-জায়গায় এলাম। সাইকেলে চড়ে ন্যাচার স্টাডি করতে যেতাম। বুড়িগঙ্গার তীর – বড় কঠিন রং। মেঘ (dark blue) – তার নিচে সবুজ মাঠ আর গ্রাম আমাকে পাগল করে তুলত। ফলে এইসব আমাকে প্রেরণা দেয় – সেই গ্রিন সেই ব্লু আমার চেনা হলো – আর আমি মনে হয় যেন কিছু পেলাম।’
কিছু পাওয়ার স্বপ্ন সফিউদ্দীনের ছিল। তবে তাঁর সামগ্রিক ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনের কর্মকান্ড পর্যালোচনায় একটি সত্য অনায়াসে উদ্ঘাটিত হয় যে, সাধারণ অর্থে খ্যাতি-যশ কিংবা আর্থিক প্রতিপত্তি আর জৌলুসপূর্ণ জীবনের ব্যক্তিক আকাঙ্ক্ষা তাঁকে কখনই উদ্বুদ্ধ করেনি। মৃত্যুর পর এই মহান শিল্পীর সমাধিস্থলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কথোপকথনকালে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের একটি চমৎকার শ্রদ্ধাপূর্ণ উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলছিলেন : ‘আমি আমার পেশাগত জীবনে নামার পর খুব অল্পদিনের মধ্যেই গাড়ি কিনলাম। কিন্তু আববাকে গাড়ি কেনার জন্য রাজি করানো যায়নি – যতবার বলেছি, সেই এক কথা তাঁর – ‘আমি গাড়ি কিনবো! আমার টাকা কোথায়?’ একথা তো সংশ্লিষ্ট মহল ও সুধীজনদের অজানা নয় যে, একজন বড় মাপের শিল্পসৃষ্টার স্বীকৃতি তাঁর ছিল – গুণমুগ্ধ ভক্তের সংখ্যাও কম ছিল না, তাঁর নিদেনপক্ষে একটি শিল্পকর্ম সংগ্রহ করবার জন্য শিল্প-সমঝদার এবং সংগ্রাহকদের প্রচেষ্টা-পদক্ষেপের ত্রুটি ছিল না, গ্যালারি-মালিকসহ কতজনকেই হন্যে হয়ে ঘুরে শেষে বিফল মনোরথ হয়ে আশা ত্যাগ করতে দেখেছি। আমাদের বিত্তবান শ্রেণিভুক্ত বিদগ্ধ সমাজে এমন মানুষও যে ছিলেন না যাঁদের কাছ থেকে ছবির বিনিময়ে তাঁর পক্ষে গাড়ি কেন নানারকম সুযোগ-সুবিধার উপঢৌকন লাভ করা অসম্ভব কিছু ছিল না। মাঝবয়স পর্যন্ত, এমনকি বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পরেও তাঁকে দেখেছি রিকশাযোগে এবং বাসে শাহবাগ এলাকা থেকে পুরনো ঢাকা এলাকায় অবস্থিত তাঁর বাসভবনে যাতায়াত করতে। ধানমন্ডি এলাকায় একখন্ড জমির ওপর তাঁর একটি বাড়ি তৈরি হয়েছিল, শুনেছি বেশ আগে; কিন্তু বার্ধক্যজনিত অসুস্থাবস্থার আগে অর্থাৎ চলৎশক্তি রহিত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁকে ওই অভিজাত এলাকায় বসবাসের জন্য আনা যায়নি। অথচ আমরা জানি তাঁর মর্যাদার আসন ওই অভিজাত শ্রেণিভুক্ত মানুষদের মধ্যেই ছিল। আটপৌরে ধাঁচের বনেদিয়ানা প্রকাশের স্থূল ভঙ্গি তাঁর ছিল না একথা সত্যি, কিন্তু ষোলো আনা বনেদি ব্যক্তিসত্তা ও শিল্পসত্তা ছিল তাঁর। আর সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁর চাওয়া-পাওয়া ও আশা-স্বপ্নের জগৎকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলেন সম্পূর্ণরূপে শিল্প-সাধনা কেন্দ্রিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও পরিচর্যার মধ্যে। নিজেকে বরাবরের মতো গুটিয়ে রেখেছিলেন আপন সত্তা-অস্তিত্বের চারপাশে এক অদৃশ্য ব্যক্তিত্বের ব্যূহ রচনা করে। সফিউদ্দীন আত্মসচেতন মানুষ ছিলেন, নিজের শিল্পভুবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন আর তাঁর ভেতরে যে প্রগাঢ় শক্তিমত্তা এক নিপুণ শিল্প-সৃষ্টির সুদক্ষ কারিগর সদা-জাগ্রত ছিল এ-বিষয়ে নিজের প্রতি তাঁর বিশ্বাসে কোনো খাদ ছিল না। আর সেটিই ছিল এই মহান শিল্পীর নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া এবং অঙ্গীকারের জায়গা – যেখানে প্রবেশাধিকার মেলেনি কারো। খর্ব হতে দেননি তিলতিল করে গড়ে তোলা জাত্যভিমানী স্বরূপ, আপস করেননি বিরূপ কিংবা অসাধু প্রয়োগ সম্বন্ধীয় কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে।
শিল্পী সফিউদ্দীন এভাবেই পৃথক ছিলেন চলমান শিল্প ও শিল্পী পরিবেশ থেকে। এখনো, তিনি যখন আমাদের মাঝে নেই – সে-সময়েও তাঁর কর্মসম্ভার স্বাতন্ত্র্যে ও গুণগত বৈশিষ্ট্য-তাৎপর্যে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিল্পাঙ্গন আলোকিত করে অভিনবত্বের সকল লক্ষণ উজাড় করে দিয়ে। অতুলনীয় তাঁর সৃজন-সম্পদ। প্রাচুর্য অঢেল বিচিত্র বর্ণী প্রকাশভঙ্গিতে, রঞ্জকের সমতল ও পুরু-আস্তরণ বিশিষ্ট শৈলী-বিন্যাসে, চিত্রতল ও স্পেস-বণ্টনের বহুভঙ্গিম উপস্থাপনায়, আবার কখনো নকশিরূপ খচিত আকর্ষণীয় আঙ্গিকে অথবা ছান্দসিক রেখায়নের গতিশীলতায়। হালকা ও ঘন মাত্রার নানা ছায় এবং বর্ণবিভার বৈচিত্র্যপূর্ণ আভাসে প্রকাশিত চিত্র ও ছাপাই ছবিতে ব্যবহৃত সফিউদ্দীনের সৃজনশীল রেখাও অসাধারণ দক্ষতার পরিপূরক। তিনি তাঁর ছবির গতিশীল রেখাসমূহ নিয়েও বিস্তর ভেবেছেন। এ-বিষয়ে আলাপচারিতায় একসময় সুস্পষ্ট উচ্চারণে উল্লেখ করলেন : ‘আমি line and faded line ব্যবহার করি।’ নিজের কাজ সম্পর্কে তাঁর আরেকটি জরুরি বক্তব্য এক্ষণে উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক মনে করি – বলেছেন : ‘অ্যাকুয়াটিন্টের এফেক্ট টেক্সচার বা গ্রেইনের মাধ্যমে পেইন্টিংয়ে আনার চেষ্টা করি। আসলে একই তো সব – অ্যাকুয়াটিন্টের ভাষায় ‘গ্রেইন’ আর পেইন্টিংয়ের ভাষায় ‘টেক্সচার’।’ গ্রেট মাস্টার সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পভুবন এরকম নানামুখী চিন্তা-চেতনার শিল্পিত পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়েই বিস্তৃত পরিসর অধিকার করেছে।
তেলচিত্র সম্পাদনে সফিউদ্দীন আহমেদ ব্যবহার করেছেন তুলি ও স্প্যাচুলা দুই-ই – সাপোর্ট হিসেবে বোর্ড আর ক্যানভাস। পেন্সিল, কার্বন-পেন্সিল, ব্ল্যাক-পেন্সিল ও কন্টি ছাড়াও ব্রাউন কন্টি এবং চারকোল ব্যবহারে মোটা বা অপেক্ষাকৃত পাতলা কাগজে তিনি সম্পন্ন করেছেন তাঁর গভীর শৈল্পিক ব্যঞ্জনাধর্মী ড্রইং-অঙ্গন। ডিমের কুসুমের লাল ব্যবহারে এক-টেম্পারায় কাজ করেছেন – সব রঙের সঙ্গে সাদা মিশিয়ে গোয়াশ মাধ্যমে এঁকেছেন ছবি। এভাবে মিনিয়েচারেও পদক্ষেপ দিতে ভোলেননি। এসব বিষয়ে তাঁর নিজের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছিলাম বিভিন্ন সময়। জলরঙের কাজের পাশাপাশি চায়নিজ ইংক ব্যবহারেও প্রমাণ রেখেছেন তাঁর মুন্শিয়ানা ও পটুত্বের। ত্রিমাতৃক ভাস্কর্যসদৃশ মডেলিংও করেছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে শিল্পীর গড়ে তোলা ছাপচিত্রের অঙ্গন প্রচন্ড প্রতাপ ও প্রভাবশালী অস্তিত্বে বাংলাদেশের শিল্পান্দোলনে যুগোপযোগী এক আলোকোজ্জ্বল চালিকাশক্তির উত্তাপ-উপাদান জুগিয়েছে। কাঠ-খোদাই (wood-cut), উড-এনগ্রেভিং, লিথোগ্রাফ, তামার পাতে মেটাল এনগ্রেভিং, এচিং (এবং কমবাইন্ড), অ্যাকুয়াটিন্ট, সফট গ্রাউন্ড, ড্রাই পয়েন্ট, সুগার অ্যাকুয়াটিন্ট আর মিশ্র (মেজোটিন্ট) প্রভৃতি ছাপচিত্রে ব্যবহৃত সকল মাধ্যমেই তাঁর দখল ছিল। বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান উচ্চতর চারুকলা শিক্ষায়তন (তৎকালীন আর্ট কলেজ নামে সুবিদিত), যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত চারুকলা অনুষদ, সেখানে ছাপচিত্র বিভাগের তিনি প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান হিসেবেই কর্মজীবন অতিবাহিত করেছিলেন (১৯৪৮-৮১)। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবেও বর্তমানের প্রিন্টমেকিং বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া অক্টোবর ১৯৮০ থেকে ০২/০১/৮১ পর্যন্ত চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ শিল্পাঙ্গনে আধুনিক নিরীক্ষাধর্মী ছাপচিত্রের বিকাশ-উন্নয়নে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁর মৌলিক অবদানের মধ্য দিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, এবং যার ধারাবাহিকতায় ওই শিল্পশাখাটি নিজস্ব গতিপথ ধরে বর্তমান সময়েও মানে-মর্যাদায় অত্যুচ্চ আসন অধিকার করে আছে – সেজন্যে তাঁর কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। চলমান বিশ্বশিল্প-পরিবেশে আমাদের আধুনিক ছাপচিত্রশিল্পীদের ক্রম অগ্রসরমানতার লক্ষণ সুস্পষ্ট। প্রজন্ম-পরম্পরায় তরুণ উদ্যোগী সৃজনকর্মীদের সাফল্য এক্ষেত্রে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতোই আশাবাদী জয়যাত্রা সুনিশ্চিত করে চলেছে। আর সেই পটভূমি রচনা করেছিলেন তিনি, আলোকিত পথ-সন্ধানও তিনিই দিয়েছিলেন। সফিউদ্দীনের জীবনাদর্শ ও শিল্প-দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমান্তরাল এক বিশুদ্ধ চেতনাশ্রয়ী পরিশীলিত মানবিক ভাবাদর্শের অনুজ্ঞাত অননুকরণীয় কর্মপথের পরিচর্যা। সুষ্ঠু শিল্পচর্চার পথ দেখিয়ে গেলেন তিনি – সেই বিচিত্র রং-রেখার আলোকোজ্জ্বল যাত্রাপথের আহবান উপেক্ষা করার সাধ্য আমাদের নেই। 