সম্পাদকীয়

বাংলা ছোটগল্প রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন জীবনের বহুবিচিত্র অনুষঙ্গকে প্রতিফলিত করে। গল্পগুচ্ছের অবিস্মরণীয় সব গল্পে জীবনের জটিলতা, প্রেম, প্রীতি, দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে এমন কিছু দিকের উন্মোচন করেছিলেন যা ছিল বাংলা কথাসাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন। রবীন্দ্রনাথের কাছে সেজন্য আমাদের ঋণের শেষ নেই। বিশ্বজগৎ এবং জীবনকে সম্পূর্ণভাবে দেখবার চোখ তিনি খুলে দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী সৃজনের এই ধারায় অবগাহন করেই পরবর্তীকালে বাংলা ছোটগল্প বিচিত্রমুখী, নিরীক্ষাপ্রবণ ও জীবনের নানাদিক প্রতিফলনে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিল।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই বিশ ও তিরিশ দশকের কথাসাহিত্যিকেরা বাংলা ছোটগল্পে নিুবর্গের মানুষের জীবনযাত্রা এবং নবলব্ধ যৌনচেতনার পরিচয় তুলে ধরেন। চল্লিশের দশকে ফ্রয়েডীয় এবং মার্কসবাদী শিল্পচৈতন্য ছোটগল্পে জীবন রূপায়ণে ও সংগ্রাম প্রতিফলনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। ছোটগল্পে মানবমনের অবচেতন দিকগুলো প্রতিফলিত হতে থাকে। একই সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যে মার্কসবাদী ধারাও প্রবল হয়ে ওঠে। এই সৃষ্টিগুচ্ছ মানুষের সংগ্রামী চেতনাকেও উদ্দীপিত করে। বাংলা ছোটগল্প মার্কসবাদী কথাসাহিত্যিকদের সৃজন, অঙ্গীকার ও বাস্তবজীবনের প্রতিফলনে হয়ে ওঠে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু ও জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী প্রমুখ সাহিত্যস্রষ্টা প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার আর্তি ও জীবনচেতনাকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রতিফলন করায় জীবনচেতনায় নব-উপলব্ধির জন্ম দেয়।
পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলাদেশের ছোটগল্পও নানাভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে। বৈরী রাজনৈতিক বাস্তবতা এই সৃজনধারাকে ব্যাহত করতে পারেনি। এ-অঞ্চলের নদী, মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছোটগল্পকারদের নিবিড় সংযোগের ফলে এবং বোধ ও বুদ্ধির প্রয়োগে ছোটগল্প তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল হতে থাকে।
গ্রামজীবন ও শহরজীবনের নানা অনুষঙ্গ, মনের জটিল আবর্তের প্রতিফলন ছোটগল্পের ভুবনকে সমৃদ্ধ করে। ষাটের দশকে এই অঞ্চলের বাঙালির সংগ্রামী চেতনা ও বাঙালিত্বের সাধনা যখন স্বদেশনির্মাণের আকাক্সক্ষায় উদ্বেল, তখন থেকে ছোটগল্পের স্বরূপও পালটাতে থাকে। অঙ্গীকার ও জীবনের নানা সূক্ষ্ম সংবেদনশীল দিকের উন্মোচন পাঠকের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করে। মনন ও শিল্পের দিক থেকে নতুন বেগ সঞ্চারিত হয় ছোটগল্পে। ছোটগল্পের সৃজনভূমি হয়ে ওঠে জীবন-অভিজ্ঞতার মনোগ্রাহী দলিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশের ছোটগল্পকারদের মানসভুবনকে নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ করে।
কালি ও কলম জন্মলগ্ন থেকে যতেœর সঙ্গে নানাধারার ছোটগল্পের পরিচর্যা করে আসছে। বিশেষত বাংলাদেশের নবীন গল্পকারদের রচনায় জীবনের নানাদিক রূপায়ণের প্রয়াস আমাদের সত্যিকার অর্থেই আশান্বিত করেছে। আমরা ভালো বোধ করেছি এদেশের ছোটগল্পে উজ্জ্বল শিল্পচৈতন্য ও জনজীবনের নানাদিক প্রতিফলনের প্রয়াস দেখে। এ-সংখ্যায় আমরা বাংলাদেশের ছোটগল্পের সেই সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনাকেই ধরে রাখতে চেয়েছি। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা চেষ্টা করেছি এ-সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করতে। এ-গল্পসংখ্যায় যা আছে তা এদেশের ছোটগল্পের নানা প্রবণতার তাৎপর্যসঞ্চারী পরিচয় বহন করছে, এ-ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ নেই। আমরা এ-সংখ্যাতে বিশেষ গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়েছি নবীন ছোটগল্পকারদের রচনার প্রতি।