সময়ের বেদনার্ত সংরাগ

জাহিদ মুস্তাফা

হতাশ গাছ
হতাশ গাছ

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুভব করেন সৃজনশীল কবি ও চিত্রশিল্পীরা। তাঁদের অবলোকনে উঠে আসা প্রকৃতি-বর্ণনার ভেতরে মানুষের উপস্থিতি যেন প্রকৃতিকে পূর্ণাঙ্গ করে তোলে। যদি চারুশিল্পের দিকে তাকাই, সেখানে দেখি নিসর্গদৃশ্যের জয়জয়কার। প্রকৃতি ও তার অনুষঙ্গ নিয়ে সৃজনশিল্পীরা বোধকরি সবচেয়ে বেশি এঁকেছেন, বেশি লিখেছেন।
আমরাও এ নিয়ে কম আঁকিনি, লিখিনি। আমাদের সব মাস্টার শিল্পীর সৃজনকর্মের ভেতর মানুষ আর নিসর্গের অবতারণা অধিক। জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন, সুলতান, কিবরিয়া থেকে আমিনুল, কাইয়ুম, রশিদ, মুর্তজা, রাজ্জাক, বাসেত, নিতুন, দেবদাস, জাহাঙ্গীর সবাই তো নিজ-নিজ চিত্রকর্মে নিসর্গের অনুবাদ করেছেন। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে হাল আমলের শিল্পীরা প্রায় সবাই কমবেশি প্রকৃতিনির্ভর প্রচুর ছবি আঁকছেন, এঁকেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় তরুণ চিত্রশিল্পী আশরাফুল হাসান প্রকৃতিকে তাঁর চিত্রপটে তুলে এনেছেন স্বকীয় একটি ভঙ্গিতে। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ বৃক্ষ। তাতে মানুষের মতো আদল খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা আজকের নয়। আমি সেই আশির দশকেই চারুকলা অনুষদের বার্ষিক প্রদর্শনীতে কয়েকজন শিক্ষার্থী শিল্পীর চিত্রপটে বৃক্ষকে মনুষ্যরূপের সঙ্গে মিলিয়ে আঁকার প্রচেষ্টা দেখেছি। হালের খ্যাতনামা শিল্পী ও কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্যের এক তেলচিত্রে দেখেছি নৃত্যরত গাছের অবয়ব। ওই গাছগুলো যেন কোনো নৃত্যশিল্পীর নৃত্যভঙ্গিমার সঙ্গে তুলনীয়। পরে তাঁরা কেউই আর ওই স্টাইলটা নিয়ে অগ্রসর হননি।
আশরাফুল হাসান তাঁর অবলোকন ও গঠনকে ধরে রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। কর্তিত, খণ্ডিত গাছের কাণ্ডকে প্রায় মনুষ্যরূপে তুলে ধরে প্রকৃতির বেদনাকে তিনি তুলে ধরছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে স্নাকোত্তর শ্রেণিতে পড়াকালীন (২০০৪ সাল) নিরীক্ষাধর্মী কাজে প্রকৃতির নানারূপকে তিনি তুলে ধরেন। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই তাঁর এখনকার কাজের স্টাইলের সমাধান পেয়েছেন তিনি।
উত্তরার গ্যালারি কায়ায় গত ১২ থেকে ২৩ অক্টোবর ২০১২ পর্যন্ত শিল্পী আশরাফুল হাসানের তৃতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলো। প্রথম একক ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে হয়েছে ২০০৫ সালে। ২০১১ সালে তাঁর দ্বিতীয় একক অনুষ্ঠিত হয়েছে গ্যালারি কায়ায়।
এবারের প্রদর্শনীতে শিল্পী আশরাফুল হাসানের ক্যানভাসে রয়েছে তেলরং ও অ্যাক্রিলিকে আঁকা ১১টি চিত্রকর্ম, কাগজে আঁকা নয়টি কালি-কলমের ড্রয়িং এবং ১২টি লিথোগ্রাফ ছাপচিত্র। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ট্রমা অ্যান্ড টাইম’।
এক বছর আগের প্রদর্শনীতে আমরা দেখেছি তাঁর কাজগুলোয় গাছের কাণ্ডের সঙ্গে শক্ত রশির বাঁধন। এসব রশির কোনোটার রং ছিল লাল, কোনোটার নীল কিংবা সবুজ। এবারের কাজগুলোয় রশির প্রয়োগ নেই। কেটে ফেলা গাছ এবং আহত গাছের রূপকে শিল্পী মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। বৃক্ষের আহতাবস্থার সঙ্গে শূন্যে ভাসমান বৃক্ষ উপস্থাপন করেছেন স্বকীয় অবলোকন থেকে। শিল্পী মনে করেন, সময়ের পরিবর্তনে প্রকৃতির সঙ্গে মানবসম্পর্ক আগের মতো অটুট নেই। মানুষ কারণে-অকারণে ক্ষতি করছে প্রকৃতির। আবার প্রকৃতিও তার রুদ্ররূপের তাণ্ডবে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে লোকালয়ে। এসব দুঃখ-যন্ত্রণার প্রতিফলন ঘটেছে শিল্পীর চিত্রকর্মে। নগরায়ণের ফলে কেটে ফেলা গাছের আকৃতিতে মানুষের যন্ত্রণাবিদ্ধ দেহাবয়বের আকৃতি খুঁজেছেন শিল্পী।
তাঁর এবারের কাজে রয়েছে নগরস্থাপনার প্রাধান্য। নগরায়ণের ফলে প্রকৃতি অপসারিত হয়, হুমকির সম্মুখীন হয়। প্রকৃতিতে মানুষের সাম্রাজ্যবিস্তারের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে ব্যথিত শিল্পী যেন প্রকৃতির কোলে মৃত গাছের আহাজারি দেখেন বান্দরবানের প্রেক্ষাপটে। দূরপাহাড়ের গা-ঘেঁষে কুণ্ডলি পাঁকানো ধোয়াচ্ছন্ন আঁকাশে ছুটে চলেছে গাছের কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা। এখানেও গাছ মানবাকৃতির সঙ্গে সাজুয্যময়। এসব চিত্রকর্মের শিরোনাম বৃক্ষ-১ ও ২। বৃক্ষ-৩ শিরোনামের কাজটি ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা। মৃতপ্রায় গাছটি ঊর্ধ্বমুখী এক বর্ষীয়ান মানুষ যেন। ওপরে তুলে ধরা দুহাতের জমিনে একটি পাখির বাসা, তাতে দুটো পাখির ডিম। যেন নতুন সম্ভাবনাময় এক জীবনের হাতছানি।
আশরাফুল হাসানের চিত্রকর্মে ক্লাসিক্যাল ডাচ পেইন্টার রেমব্রান্টের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে আলো-ছায়ার বৈপরীত্যের প্রয়োগে। আমাদের কাছের শিল্পী এসএম সুলতানের আঁকা চিত্রকর্মের পেশিবহুল মানবাকৃতির সঙ্গে তাঁর উপস্থাপিত চিত্রকর্ম অনুপ্রাণিত। বড় খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখেন তিনি। মানুষের যন্ত্রণাবিদ্ধ বা শ্রমলব্ধ শরীরকাঠামোর প্রতিটি পেশির ভাঁজকে দারুণ দক্ষতায় তুলে আনেন চিত্রপটে।
শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর কলাভবনে ছাপচিত্রকলায় এক বছরের একটি সংক্ষিপ্ত কোর্সে ভর্তি হয়ে ২০০৯ সালে তিনি রপ্ত করেছেন ছাপচিত্র মাধ্যমের কলাকৌশল। ছাপচিত্র মাধ্যমে বেশকিছু কাজ করেছেন দেশে ফিরে, এখনো করছেন। এ-প্রদর্শনীতেই তাঁর ১৭টি ছাপচিত্র স্থান পেয়েছে। এগুলো এচিং লিথোগ্রাফ। পাথরের প্লেটে কন্টুর দিয়ে এঁকে কাগজে ছাপ নেওয়ার একধরনের পদ্ধতি লিথোগ্রাফ। এ-মাধ্যমে আঁকা একটি সিরিজের নাম ‘আহত বৃক্ষ’। এর ৪-সংখ্যক চিত্রকর্মে আমরা দেখতে পাই – কাটা গাছের টুকরো পড়ে আছে মাটিতে। জমিনে শুকনো ডালপালা-পত্রপল্লবহীন। প্রেক্ষাপটে কংক্রিটের স্থাপনা নগরায়ণের ইঙ্গিত বহন করছে।
আহত বৃক্ষ-৩ শিরোনামের ছাপচিত্রটিতে বৃক্ষ যেন এক নারীর রূপের সমার্থক। যেন সে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিভঙ্গে তার মোহিনী রূপ নিয়ে। এ নারীবৃক্ষটির বুক চেরা, আঘাতে-আঘাতে জর্জরিত। এ নামের ২-সংখ্যক কাজটিতে বৃক্ষের রূপ যেন মা ও শিশুর মতো।
‘কলম’ নামে তাঁর আরেকটি সিরিজ প্রত্যক্ষ করা গেল। নানা বর্ণের কতোগুলো কলম, কাগজ আর চিঠি দিয়ে কম্পোজিশন রচনা। কোনো কোনো কলমের নিবে মানুষের মতো চোখ। বৃক্ষকে যেমন মানবাকৃতিতে দেখার ঝোঁক শিল্পীর, তেমনি কলমকেও মানবিক রূপে দেখেছেন তিনি। এ কাজগুলো তাঁর চিত্ররীতির নতুন একটি দিক বটে, তবে তাঁর বৃক্ষবিষয়ক কাজগুলোর মজাই আলাদা।
কাগজে কালি ও কলমে আঁকা নয়টি কাজ করেছেন আশরাফুল হাসান। এর একটি সিরিজের শিরোনাম – ‘উইথ ডার্ক ইমেজ’। আলো-আঁধারিত নগরের সামনে জোড় আসনে বসার ভঙ্গিতে এক বৃক্ষ, যেটি প্রায় উন্মূল হওয়ার অবস্থায় অপেক্ষমাণ। প্রকৃতি শিরোনামে আরেকটি এচিং ছাপাই, যেটির শরীরকাঠামো নারীসদৃশ। যেন সে নিজেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ভীষণ – এমনই তার অভিব্যক্তি।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি সুপরিচিত সংগীত – ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়’। এই সংগীতচেতনার সঙ্গে মিলে যায় আশরাফুলের আঁকা ‘প্রকৃতি ও নারী’ শিরোনামের চিত্রকর্মটি। ২০০৯ সালে ক্যানভাসে তেলরং ও অ্যাক্রিলিকে আঁকা এ-কাজটিতে বান্দরবানের পাহাড়ি সৌন্দর্যের আবহে এক নারী-অবয়ব, যেন পাহাড়ে হেলান দিয়ে স্মিত হাসিমুখে শুয়ে আছে। সুররিয়ালিস্ট ধরনের কাজ। এ-ধরনের কাজ করে শিল্পী হয়তো নতুন আরেকটি বাঁকবদলের প্রয়াস নিয়েছিলেন; কিন্তু এ-ধারা নিয়ে তিনি পরে আর অগ্রসর হননি।
আশরাফুল হাসানের জন্ম ফেনীতে ১৯৭৭ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় স্নাকোত্তর করেছেন ২০০৪ সালে। ২০১১ সালে তিনি জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ফ্রিল্যান্স শিল্পী। সৃজন শিল্পীর মধ্যে তাঁর সৃজন নিয়ে নিরন্তর নানা চিন্তা, সম্ভাবনা কিংবা উদ্বেগ কাজ করে। এ হলো নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া, নিজের লড়াই। প্রদর্শনী হচ্ছে নিজের লড়াইকে দর্শক-বোদ্ধাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। এতে শিল্পীর লাভ হলো – নিজের কাজ সম্পর্কে দর্শকের অভিরুচি বা ভাবনাকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। সেসবের বিবেচনায় শিল্পী আশরাফুল হাসানের এই তৃতীয় একক প্রদর্শনী সার্থক হয়েছে বলাই বাহুল্য।