সময় যখন কান্দনের

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
পাহাড়তলীর মেইন রাস্তার পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা বয়ে যায়, সে-রাস্তার পাশে যে একটা ভাঙা ব্রিজ আছে, সেই ব্রিজের উত্তর সাইডে যে-সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নির্মিত তিনতলা দালান আছে, সেখানে যে-রাত নামে, তা থেকেই একটা মাইয়ালোকের কান্দন শোনা যায়। এই কান্দন বয়ে নেওয়া নিয়ে যেমন নানান কিচ্ছা জমা হয়, অনেক কথা চালাচালি হয়। কান্দন-সৃষ্টি-করা নারী নিয়ে নানান কথা চলে। সেই কথা নিয়ে নিজেদের ভেতর বাজাবাজিও হয়। মানুষের কাজ তো কেবল কথাকে ঝিম ধরিরে রাখা নয়। মানুষ তার জীবন-চলাচলের সঙ্গে সঙ্গে কথারও চলাচল চায়। তারা কথাকে তাদের জীবনের একটা সম্পদ মনে করে। মানুষ হওয়ার বড়ো মজা হচ্ছে, কথার পিঠে কথা দিয়ে কথাকে অনেক লম্বা করতে চায় তারা। এই
যে গহিন রাতের একটা ক্রন্দনধ্বনি আমরা শুনি, মানে এখানকার লোক মারফত আমাদেরও কানে আসে, আমরা সেই কথাকে কানাকানির পর্যায়ে নিয়ে কথার চাষাবাদ করি। এই কান্দন নিয়ে যে সবচেয়ে চুপচাপ থাকে তার নাম নাহার বানু। তার এই চুপচাপ থাকাকে অত্র এলাকার পাবলিক শুভ কাজ হিসেবে নেয় না। তারা এর ভেতর কিছু একটা আন্দাজ করে। আন্দাজ এমন এক জিনিস, আন্দাজের ওপরে আর কারো কথা না থাকলে সে-আন্দাজই একটা বাস্তবতার চরিত্র পায়। আমরা তাই নাহার বানুর জীবনবৃত্তান্ত জানতে আগ্রহী হই। সেই আগ্রহের সঙ্গে গহিন রাতের কান্দনের সখ্যের কথা তো আমরা স্বীকারই করছি। আচ্ছা, নাহার বানু নিজেই কি গায়েবি কায়দাই এই ক্রন্দন পয়দা করে? এ নিয়ে কয়েকদিন কেবল বচনই খরচ করে মানুষগুলো। অবশেষে তারা জানায়, Ñ না, তা মনে হয় না। তার কান্দনের কোনো আলামত তারা পায় না। তার মানে হচ্ছে, তাদের আশেপাশের বাসার কেউ তা সত্যি বলে মানতেও নারাজ। এইখানে তাদের কান্দনের আন্দাজও ফেইল মারছে। কারণ সদা হাস্যব্যাকুল এই নারী কান্দনের কোনো অবস্থায়ই নেই। তার কি গোপন কোনো কষ্ট বা যন্ত্রণা থাকতে পারে না? হ্যাঁ, তাও তো কথা। নারীর জীবনের সঙ্গে গোপনতার একটা সম্পর্ক যে আছে তা অতি বেকুব পাবলিকও স্বীকার করবে। তাই এই বিল্ডিং কিংবা তার আশেপাশের মানুষজন নাহার বানুর গোপনতার দিকে নজর দেয়। তারা অত্র সাবজেক্ট নিয়ে ক্রমাগত কথাবার্তা বলে। তারা ওই হাস্যমুখর কাঁঠালিচাঁপা-গাত্র-বর্ণের মাইয়ামানুষটার সংসারের খবর নেয়। মোবাইল ফোনের এই যুগে গোপন বলে কিছু মানতেও তো মন চায় না। কবরের খবর বিনে এখন তো সবই যেন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। তাই তো নাহার বানুর বাপের বাড়ির সমুদয় খবর আমরা সহজেই পেয়ে যাই। তার শ্বশুরকুলের এই অবস্থা সেই অবস্থার আমরা বৃত্তান্তও জেনে নিই। তাতে আমরা অবাকই হই, কারণ পাবলিকের খোঁজখবর আর তার চালচলনের ভেতর তার কান্দনের কোনো আলামত পাওয়া যায় না। তবে নাহার বানুর মেজাজে একটা থমথমে-থিকথিকে ভাব পয়দা হয়েছে। তার সেই ভাব আরো কিছু ভাবকে টেনে আনে। আমরা অতি অল্প সময়ের ভেতর নাহার বানুর স্বামীকে দেখব। তা দেখার দরকারও আছে। নয়টা-পাঁচটা অফিস করা গণপূর্ত বিভাগের একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সম্পর্কে বারোজাতের খবর নিতেও আমাদের বেগ পেতে হয় না। তাছাড়া প্রকৌশলী সাহেব এমনই সদাতৎপর মানুষ যে, নিজের কথা নিজের অজান্তেই বাইরে গড়গড় করে প্রকাশ করে দেয়। এমন প্রকাশমুখর মানুষ অত্র এলাকায় কমই আছে। আমরা তার এই প্রকাশময়তা এই সময়ে ভালো চোখে দেখি না। তার জীবনের কিছু আড়াল থাকলে আড়ালের আসল জায়গাটা বের করা যেত। তবে কথা হচ্ছে, সেলফোন, ফেসবুক, টুইটার আর ক্যাবল টিভির যুগে মানুষ আর কত নিজেকে আড়াল করে রাখে? তবু আমরা ক্রন্দনের বিষয়টা নিয়ে দারুণ পেরেশানিতেই থাকি।
আচ্ছা, আমরা যেই নাহার বানুকে চিনি, মানে সামনে যেই নাহার বানু জলজ্যান্ত আছে, তিনি কি তাই ছিলেন? আরে ধুর, মানুষ কি আজীবন একই থাকে! বয়স কি তার জীবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়নি? তা খুব হয়েছে। মানুষটা তার মনের ভেতর দিয়ে জীবনটাকে হয়তো যথাক্রমে একই জায়গায় রাখতে চেয়েছে, কিন্তু বয়সের বাঁক আর জীবনের নানান ঘটনা, উপঘটনা কি তাকে এক থাকতে দেয়? তা তো দেয় না। মানুষ তো কেবল তার দৃশ্যমান জগতেই বাঁচে না, দেখার বাইরে তো মানুষের জীবন থাকে। এই যে ৫০-এর বেশি বয়সের মানুষটা, সে তো একাত্তরের যুদ্ধের ভেতর দিয়েও জীবন পার করেছে! সেই জীবনের ক্ষত কি তাকে ভেজা থকথকে আর রক্তাক্ত করেনি? এই বয়সের, এই মাটির, এই জলের, এই নদীর এমন একজন মানুষও কি আছে যার জীবনে কোনো না কোনো ভাবে একাত্তর নেই? যুদ্ধ কি তাকে তছনছ করেনি? তা নাহার বানুকে করেছে আরো বেশি।
যখন তার দেহে যৌবন সেইভাবে আসেনি, যৌনতার øিগ্ধ-মায়াময় রূপ যার চেনা হয়নি, তখনই তার জীবনে এক ভয়ানক ঘটনা নেমে আসে। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়েমানুষটি আর্মিদের ক্যাম্পে কালযাপন করতে বাধ্য হয় তখন। তার জীবন অকালেই যেন কেয়ামতের ভয়াবহ রূপ দেখে। একসময় যুদ্ধ শেষ হলেও তার জীবনের আরেক যুদ্ধ শুরু হয়। আত্মীয়-পরিজন আর প্রতিবেশীর নানান বাঁকাতেড়া কথার জের থেকে বাঁচার জন্য তাকে শাদা-চামড়ার এক সাহেবের কেয়ারে এক আশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়। তবে তার ব্রেইনই হয়তো তাকে এই অন্ধকার থেকে কিঞ্চিৎ আলোর পথে নিয়ে আসে। সময় যায়, তার জীবনের বাঁকে মন্তাজ মিয়া নামের এক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ওর প্রতি লোকটার মায়া হয়, এবং তাদের বিয়েও হয়ে যায়।
কিন্তু জীবনের অনেক রূপ তাকে মোকাবিলা করতে হয়। কারণ পাক-আর্মি কর্তৃক নিপীড়নের ফলে তার যৌনব্যবস্থার যে পরিবর্তন ঘটে, মরা রক্তের যে ক্ষীণ স্রোত তার জরায়ু থেকে নিঃসৃত হয়, তা-ই তার জীবনকে এক দগদগে ঘায়ের ভেতর নিমজ্জন করে। তার আর বাচ্চা হয় না। কিন্তু নাহার বানু বসে থাকার বান্দা নয়। সে মাদার তেরেসার গায়েবি আহ্বানে যেন সাড়া দেয়। সে তার জীবনকে সঁপে দেয় সর্বজনীন মানুষতার আনন্দে। ও খ্রিষ্টান হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে পাক্কা দেড় বছরের মিডওইয়াফের ট্রেনিং নেয়। বাচ্চার হৃদকম্পন, ডেলিভারির টাইম, মাসিক বন্ধের হিসাব, বাচ্চার নড়াচড়া, গা-হাত-পা ফোলা, খিঁচুনি, দুর্বলতা, একস্ট্রা রক্তপাতের হিসাব কি সে নেয়নি! বাচ্চার পজিশন তার মতো কে আর আন্দাজ করতে পারত? মায়ের যতœ নিয়ে প্রসূতির খবরাখবরও তো সে কত যে নিয়েছে। ওই সময় কমপক্ষে ৫০টি ডেলিভারি নিজের হাতে কন্ট্যাক্ট করে। ডাক্তার-নার্স-অফিস সুপারভাইজারের আন্ডারে ধুমসে ট্রেনিং করে। কে কী বলল, তা শোনার মানুষ সে নয়। যখন-তখন সে পাড়ায়-মহল্লায় ডেলিভারির কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায়। কী এক নেশায় তাকে আচ্ছন্ন করতে থাকে। সময়ের সবটুকু মানবজন্মের কাজে সে নিজেকে দিয়ে রাখে। তেমনই এক ঘটনার ভেতর দিয়ে আমরা ভিন্ন এক জীবনের দেখা পাই। আমরা এও স্বীকার করতে বাধ্য হই, জীবন এক বিচিত্র ঘটনার সমাহার ছাড়া কিছু নয়। ভালোবাসার ভেতর দিয়ে ভালোবাসার এক লেনদেন হতে পারে, রক্তের ভেতর দিয়ে আরো এক রক্তপাতের নানান গল্প আমরা শুনতে থাকি।
জ্যৈষ্ঠের প্রথম বুধবার সেদিন। সারারাতের বৃষ্টির পর সেই দিনটাও ছিল বৃষ্টিকাতর Ñ আকাশ একসময়ের জন্যও সূর্যের নাগাল পায়নি। কী যে তুমুল বৃষ্টির ভেতর দিয়ে সময় পার হয় আমাদের। সেইদিন তার পার্টনার সাথি বড়–য়া ছিল ছুটিতে। তিন সন্তানের জননী স্বামীর পরিবারের সেবাতেই জীবন কোরবানি করল বেচারী। সেদিন তাই তো তার দম ফেলানোর সময়ও যেন ছিল না। নাহার বানু সেইদিন তার ডিউটি প্রায় শেষ করে এনেছে। একেবারে শেষের দিকে ডেলিভারি কন্ট্যাক্ট করার পর রোগীর স্বামীর হাতে প্রেসক্রিপশনটি বুঝিয়ে দিয়ে জানাতে থাকে আগামী মাস দুয়েক স্বামী-স্ত্রীর কী করণীয়, বাচ্চার জন্যই বা তাদের কী কী করা দরকার। ডিউটি একেবারে শেষ করে আনার সময় একটা রমণীর দিকে তার নজর পড়ে। একেবারে সাদামাটা গ্রামীণ সহজতায় পরিপূর্ণ এক রমণী; পরনে ময়লা সিম্পল সুতি শাড়ি, পায়ের স্যান্ডেলও ঘষা খেয়ে খেয়ে যেন মাটির সঙ্গে মিশেই যাচ্ছে, চামড়ার শ্যামল রঙের লাবণ্যও ঝরে গেছে, মাথার চুলসমূহ ছেঁড়াখোঁড়া পাটের মতো ঝুলঝুলে হয়ে আছে। হঠাৎই নাহার বানুর চোখ পড়ে তার ওপর। মেয়েটা তাকে অনেকক্ষণ ধরেই মনে হয় ফলো করছে। তাকে তো দেখছে না, সে যেন তার জীবনের ব্যাকুল এক প্রার্থনা প্রকাশ করছে। ঘটনা কী? কী যে ঘটনা তা তো তার তলপেটের উঁচা অংশ দেখেই কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে সে। কিছু একটা তো মহিলাটি করতেই চায়। পেটখালাসের মামলা নাকি? নাহার বানু তার দিকে এগিয়ে যেতেই সেই মহিলাই কান্নাব্যাকুল স্বরে বলেই ফেলে, দিদিগো আমারে বাঁচাইন! ‘কী বিষয়’ নাহার বানুর এমন একধরনের দৃষ্টিকে ফলো করতে করতে সে তার কথাকে অনেক ম্লান আর ক্ষীণ করে আনে। সে তো কথা বলছে না যেন জীবনের ছিঁড়ে যাওয়া স্মৃতিকে জোড়াতালি দিচ্ছে। তা এমনই শুকনা আর খসখসে যে, এর মর্মার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে নাহার বানুর সমস্ত মনোযোগ তার কথার ওপরই রাখতে হচ্ছে। ঘটনা হচ্ছে সেই একই প্রেমের ব্যাপার। বছরখানেক ধরে শমলা খাতুন নামের এই মহিলার সঙ্গে কেরামত মিয়া নামের সুপারভাইজারের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অচিরেই তাদের সেই সম্পর্ক দেহের দিকে মোড় দেয়। ইস্ত্রি সেকশনের কেরামত মিয়া যখন-তখন সুইং সেকশনের শমলা খাতুনের দিকে ধাবিত হয়। সেই নিয়ে ছোটখাটো এই গার্মেন্টসে গুনগুনানিও শুরু হয়। শমলা খাতুনের সহকর্মীরা তাকে নানান কথা কয়, হিহিহি করে, বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে ঢলাঢলি করার পরিণতি যে কী হবে তা নিয়ে আগাম সংকেতও জানায় তারা। তাদের আলাপে কেরামত মিয়ার রমণীঘেঁষা স্বভাবের স্বভাবজাত দৌড়ানিও বাদ যায় না। কিন্তু শমলা খাতুন তখন নিজের ওপর সমস্ত কন্ট্রোল হারায়। তার অনেক কিছুই কেরামত মিয়ার শরীর, কথা, রংঢঙের কাছে বন্ধক পড়ে। তারা অনেকভাবে মজে যাওয়ায় নিজেদের সঁপে দেয়। অবশেষে শমলা যে-বাচ্চা বহন করা শুরু করে তার বয়স হয়ে যায় পাঁচ মাস। তার মাসিক বন্ধ হওয়ার শুরু থেকেই শমলা খাতুন তাকে বিষয়টা নিয়ে চাপাচাপি করে, তাদের বিয়েটা কমপ্লিট করার কথা বলে। কিন্তু কেরামত আলী তা আমলে আনে না; সে নানাভাবে সময় পাস করে। ‘দেখি কী করি, এই তো ব্যবস্থা একটা করে ফেলছি, এই তো কিছু একটা করব’, Ñ এইভাবেই সময় পার করার পর একসময় কেরামত আলী তার বউয়ের জন্য দেওয়ানা ভাব দেখায়, বাচ্চাদের প্রতি দায়িত্বের কথা বলে, সমাজে তার পজিশন নিয়ে তার কথা শেষ করতে চায়। কিন্তু শমলা খাতুনের জীবন তো থেমে যায় না। তার জীবন তো সামনে এগোয়। তলপেট ভারী হতে থাকে, তার খাওয়ার রুচি কমে, বমি বমি লাগে, পেশাব ঘন ঘন হয়। তার দুনিয়া আন্ধার হতে থাকে। তার সহকর্মীরা তার বেকুবপনা নিয়ে তাকে হেনতেন বলে। এরই ফলে তাকে এখানে মানে নাহার বানুর কাছে আসতে হয়।
কিন্তু নাহার বানু সেদিন তার সব কথাকে আমলে আনে না। শমলাকে সে বিশ্বাসও করতে চায় না। এ-গল্প তার অনেক শোনা আছে। নিজেদের রংঢং আর বাড়তি আয়-রোজগারকে এই টাইপের মেয়েগুলো প্রেমের খাতে খরচ দেখাতে চায়। তারা লম্বা কাহিনি শোনায়, হা-হুতাশে সব ভরাট করতে থাকে, প্রেমিক নামের এক সত্তার ডাটফাট নিয়েও তাদেরকে অনেক বুদ্ধি খরচ করতে দেখে। তাই সেদিন নাহার বানু তাকে ধমকায়। মাগি টাইপের ছিনালি কান্না বন্ধ করতে বলে, Ñ অতই যদি কথা থাকে তবে তার সাধের ভাবের লোককে যেন এখানে নিয়ে আসে। শমলা খাতুন সেদিন ফিরে যায়। তার যাওয়ার দিকে নাহার বানু তাকায়ও না। এ শহর যেন মাগিখানা হয়ে যাচ্ছে। ওপরে চামড়ার শু দেখলেও ভেতরটা যেন তার ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। কখন না জানি ছাদ থেকে তলানি খসে পড়ে!
তবে সেই দিনের ঘটনা সে নিজের কাছেই কেবল রাখে না, স্বামীকে জানায়। সেইদিন আবারো নাহার বানুর কান্দন আসে। হায় জীবন, কত তার রূপ, কত তার আচরণ। তারা এগারো বছর সাত দিনের বিয়ের জীবনে একটা বাচ্চা পেল না, অথচ মানুষ নিজের পেটকে কীভাবে যে খালাস করতে চায়! সেই ইতিহাস, সেই জীবনসমূহ স্মরণ করে আবারো তার কান্না আসে। নিজের ভেতর নিজেই যেন ক্ষয় হয়ে যায়। জীবনের যাবতীয় ক্রন্দন কি তার ভেতরই পথ হারাবে? তাকে কি কান্নাকাটির ভেতরই জীবন সঁপে দিয়ে রাখতে হবে? তবে তার ভেতর শমলা নামের সেই নারীর সঙ্গে হঠাৎই কেমন একটা বান্ধা পড়ার ভাব দেখা যায়। কারণ সেই নারী দুইদিন পরই তার কাছে আবার আসে। এবার তার সঙ্গে কেরামত আলী থাকলেও সেই লোক নাহার বানুর সঙ্গে একটা কথাই বলে, তার সংসার আছে, সমাজ আছে, বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ আছে। নাহার বানু সেদিন পাগলা কুত্তার মতো হয়ে যায় যেন, তাকে বলে, তবে মেয়েমানুষের সঙ্গে এমন ফষ্টিনষ্টির মানে কী? কেরামত আলীও নাহার বানুর কথাকে এক আনা পাত্তা দেয় না। সে যেন ঠোঁটের কোনায় হাসি জিইয়ে রাখে। সেই হাসিকে কিঞ্চিৎ দৃশ্যমানও করে সে। সেই অবস্থায় সে নাহার বানুর শরীরের দিকে চোখ ফেলে কয়, ‘ভালোবাসা কি বইলা-কইয়া আহে। কথা কমান ম্যাডাম। খরচাপাতি আলাদা কইরা চাইলে দিমুনে। খালাস কইরা দেন।’ ‘আরে কী বলেন আপনি’ নাহার বানুর এমন ভাবকে হিসাবে আনে না কেরামত আলী। বরং নাহার বানুর কথাকে নিজের শরীরে লেপ্টে নিয়ে কিঞ্চিৎ হাসির ঝোঁকের ভেতর ছেড়ে দিয়ে ম্যাটারনিটি সেন্টার থেকে নিজেকে গায়েব করে ফেলে।
তারও পর আমরা শমলা খাতুনের কান্দনের সাক্ষী হই। তারা, মানে শমলা খাতুন আর নাহার বানু সেদিন অনেক কথা বলে। শমলা খাতুনের একটাই দাবি, এই গ্যাঞ্জাম থেকে তাকে বাঁচানো হোক। কিন্তু সেইদিন বা তার পরদিন বা তারও পরদিন সেই ঘটনাই নাহার বানুর জীবনে আলাদা এক মোড় নেয়। সে সেদিন শমলা খাতুনকে একরকম জোর করেই তাদের বাসায় নিয়ে আসে। মনের খায়েস মিটায়ে তাকে খাওয়ায়, তার স্বামীর সঙ্গেও তাকে কথা বলায়ে দেয়। বাচ্চাহীন জীবন যে কত রক্তক্ষরণের তা যাদের নাই, কেবল তারাই বুঝবে। স্বামী-স্ত্রীতে কত কথাই যে শুনছে। তাদের মরতে সময় লাগবে, কিন্তু তার আগেই তো তাদের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে শেয়াল-কুত্তার মতো টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। কয়েকজন একেবারে ওঁৎ পেতে আছে। নাহার বানুর কথা একটাই এই বাচ্চাটা তার চাই। কীভাবে নেবে, কীভাবে রাখবে সেই বিষয়েই তাদের কথা হয়। বাচ্চা বিয়ানো পর্যন্ত শমলা খাতুনকে সে যাবতীয় বিষয়ে হেল্প করবে। ডেলিভারির আগে এবং পরের বেকার সময়ের ব্যয়ভার সে নেবে। তার স্বামী আর তার জীবনের যাবতীয় সুনাম আর সততাকে সাক্ষী হিসেবে ধরার জন্য শমলাকে তারা পীড়াপীড়ি করে। এই ছোট্ট জেলা-শহরে নাহার বানুকে তো অনেকেই চেনে এবং জানে। শমলারাও তো তাকে নানাভাবেই জানে। কত জনের যে সে উপকার করেছে, তা কি তারা জানে না। এমনভাবেই তাদের ভেতর কথার আলাদা এক হিসাব হয়। তাদের ভেতর এমনসব কথা হয়, যা কেবল তারাই জানে। সেই কথা তাদের বাকি জীবনের সঙ্গে একেবারে যুক্ত হয়ে যায়। এবং তাদের কথাবার্তার ভেতরই নাহার বানু এমন ব্যবস্থা করে যে তার স্বামীকে সেই শহর থেকে অন্য শহরে বদলি করায়। ফাদার বেনুয়া গোমেজ এ-ব্যাপারে তাকে কত যে সাহায্য করেছে! তারা দুজন মানে নাহার বানু আর শমলা খাতুন সেই শহরে থাকলেও তাদের আলাদা বাসা হয়। জীবন তাদের অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা হয়।
ক্রমে ক্রমে ভ্রƒণ বড় হয়। তাদের যৌথ জীবনযাপনের ভেতর দিয়ে তৃতীয় এক সত্তা ধীরে ধীরে বেড়ে যেতে থাকে। নাহার বানু তার কর্মক্ষেত্রে গেলেও সে জানায় যে তার শরীরে কী যেন এক পরিবর্তন আসছে। তার শরীর নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। তার মানে হচ্ছে তার মাসিক আর হচ্ছে না। এই নিয়ে তার অফিসে কথা হয়। সে তার বিশ্রামের দরকারের কথা জানায়। এমনকি লম্বা ছুটি নিয়ে সেখান থেকে সে চলে আসে। তার চলে আসার ভেতর এমনই অনেকে বলে যে, সে হয়তো এখানে আর আসবে না। প্রাইভেট চাকরিই হয়তো সে করবে। যে-কাজ সে জানে, তার হাত এত চালু যে চাকরিরও তার প্রয়োজন হবে না।
অবশেষে তারা মানে শমলা-নাহাররা, এমন এক শহরে আসে, যেখানে তাদের কেউ চেনে না। এই শহরের নিয়মও এমন যে, যে যার মনের খেয়ালে থাকলেও কেউ কারো খবর রাখে না। এই শহরে বিদেশি টাকার খেলা চলে, Ñ তাদের ভাবে, চলনে, ফিরনে, সেই টাকার একটা ছাপ পড়ে। এমনই এক শহরে শমলা আর নাহার বানু এক সংসারে থাকে। নাহার বানু তার অন্তর্জগতে কী এক মায়া যেন টের পায়। যেই সময়টুকু সে একটা ম্যাটারনিটি ক্লিনিকে কাজ করে তো করেই; বাকি সময়টা সে শমলার জন্য রাখে। শমলার জন্য না বলে তার পেটের বাচ্চাটার জন্যই খরচ করে বলতে হয়। সে যদি পারত বাচ্চাটার অবস্থানের জায়গা বদল করে ফেলত, শমলার পেটের বাচ্চা তার পেটে নিয়ে আসত। সে যখন শমলাকে জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে শুয়ে থাকে, তখন যেন তার ভেতরে কী একটা বিষয় ঘটে। মনে হয়, তারই পেটে কী একটা নড়ছে। কেমন একটা মা মা ভাব আসে তার মনোজগতে। তার শরীরেও যেন পরিবর্তন হচ্ছে। তার ব্লাউজ কি টাইট হয়ে যাচ্ছে? দুধ নেমে আসছে বুকে! তা এমন টনটন কেন করে? বমি বমি কেন লাগে তার। সারা শরীর যেন তার ভার ভার লাগে। তার ঘুম তো কবেই শেষ হয়ে গেছে। যেন তার আর কোনো কাজ নাই, হিসাব নাই, জীবন নাই, তার আছে কেবলই বাচ্চার জন্য অপেক্ষা।
অবশেষে একটা বাচ্চা আসে, যেন পৃথিবীর বুকে একটা চিৎকার হয়ে সে কোত্থেকে নেমে আসে। বাচ্চা হওয়ার দিনই সন্ধ্যায় তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসে। নাহার বানু সেদিন থেকে আর বাইরে যেতে চায় না। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সাতদিনের মাথায়ই বাচ্চাটাকে নিয়ে স্বামীর শহরে আসে। শমলা এই শহরে এলেও, তার টাকা-পয়সার অভাব হয় না। নাহার বানু কোনো কথারই বরখেলাপ করে না। বরং শমলাকে হিসাবের চেয়েও বেশি টাকাকড়ি দিয়ে বিদায় দেওয়া হয়। তারপর আমরা দেখি নাহার বানুর নতুন জীবন; যেন সবকিছুরই সে মালিক। বাচ্চার কালো বরণও তাকে কোনো সমস্যার মধ্যে ফেলে না। বরং বাচ্চাটার ভেতর দুনিয়ার সব আরাম সে পায়।
সময় যেতে থাকে। তবে সময়ের ভেতর আরো এক বিষয় হয়তো তার থাকে। তার ভেতর আচানক সব রূপান্তর দেখে। তার বুক ভারী হয়। এবং তা থেকে কী ধরনের এক হালকা শাদা রস যেন বেয়ে বেয়ে পড়ে! তাই সে পরম যতেœ মেয়ের মুখে তুলে দেয়। বাচ্চা মেয়েও তা চুষে চুষে নেয়। দুধের সাধ কী সে পায়? হয়তো তা পায়ই, নতুবা এই রসের টানে বাচ্চা ব্যাকুল হয় কেন? যেন দুনিয়ার সঙ্গে তার এক সম্পর্ক তৈরি হয়। নাহার বানুর জীবনের সঙ্গে তার এমন এক বন্ধন আসে যা দুটি মানুষকে একসূত্রে গেঁথে ফেলে। তা দেখে নাহার বানুর স্বামী বড়োই অবাক হয়। সেও বাচ্চার মায়ায় হয়তো বন্দি হয়। কিন্তু সে এও জানায় যে, এইভাবে বাচ্চা লালন-পালন কখনো সুখের হয় না। তারা কোনো না কোনো ভাবে তা জেনেই যায়। তখন হয়তো সে দিগ্দারি করে। সে বলে যায়, ধরো, এখন শমলা না আসুক, কেরামত যদি আসে; কিংবা আসতেও তো পারে। রক্তের দাবি বলে কথা আছে না! নাহার বানু তাতে প্রবল আপত্তি জানায়, সে শিওর যে শমলা খাতুন বা কেরামত মিয়া আসবে না। কেরামত কোন মুখে আসবে? আর তাছাড়া তারা কি এখন আর জানে যে এরা দুজন বা তাদের মেয়েটা কোথায় আছে! তবে আমরা এইটুকু বুঝতে পারি, বাচ্চাটার সঙ্গে নাহার বানু রক্তের চেয়েও গভীর এক বন্ধনে আবন্ধ হয়েছে।
এইভাবে তাদের সময় চলে যেতে পারত, নাহার বানুও তার জীবন হয়তো এভাবে পারও করতে পারত। কিন্তু সেই কান্দনই যেন তাদের ভেতর নতুন এক ইশারা দিয়ে যাচ্ছে। কে কাঁদে গো! প্রলম্বিত কোনো দুঃসময় কী মানুষের কপালে যোগ হবে। এটা কোনো গায়েবি ইশারা নয় তো? সেই কান্দনের খবর পুলিশের খাতেও যায়। দুজন পুলিশ কান্ধে বন্দুক আর হাতে ঘূর্ণায়মান লাঠি নিয়ে নাহার বানুর বাসায় হানা দেয়। তারা শুধায়, আপনাদের বাসায় কান্দে কে? তারা তখন প্রশ্নকারী পুলিশকে দেখে। এবং এই স্বামী-স্ত্রী কিছু জানে না বলে জানায়।
আরে কী বলেন? কিছুই জানেন না আপনেরা! এইটা কোনো কথা অইলো, Ñ কন তো!
কী বলবো?
দ্যাখেন, আপনেরাও সরকারের লুক, সত্যি বলেন।
তাই তো বলছি জনাব, Ñ কই, কেডায় কান্দে!
কান্দনের ঘটনা একটা আছে তো। আপনেরা এলাকার শান্তি নষ্ট কইত্তেছেন। কান্দনে মানুষের ঘুম নষ্ট কত্তেছেন।
আরে কী যে বলতেছেন!
ঠিকই তো বলি। বলেন, কে কান্দে?
এবার নাহার বানু বলে যে, আপনারাই বের করেন কে কান্দে।
আর কথা কয়েন না, হয় কেউ গুম হইছে, না হয় আপনেরা গুম কচ্ছেন। ঠিক না?
আরে কী বলেন ভাইসাহেব। নাহার বানুর স্বামীর এমন ভালোমানুষি কথাকে তছনছ করার মতো করেই তারা বলে, ‘আমাগো টাউন দারোগার সঙ্গে কথা কয়েন, নাইলে খবর আছে।’ অতঃপর এই এলাকায় পুলিশের ‘খবর আছে’ বলা নিয়ে অনেক কথা হয়। রাস্তার শিস-মারা-পোলাপান এ নিয়ে আরো জোরে শিস বাজায়। তারা গলা ছাইড়া গান গায়। শত শত করতালিতে আকাশ-বাতাসে যেন খই ফোটায় তারা।
সময় যায়, তা আসে, কিন্তু গহিন রাতের একটা কান্দন থাকেই। আমরা আবারো কান্নার কথা মনে করতে বাধ্য হবো। কান্নাটা প্রথম শোনে তো নাহার বানুই। তা শোনার কারণও আছে, তার ইদানীং ঘুমই আসে না। কী যেন কিসের এক কান্নার মতোই বুকের ভেতর অনবরত বাজে। যেন তা ম্লান-সন্ধ্যার সময় কোনো এক শিস দেওয়া সময় তার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। কিংবা বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে বাতাসের স্রোতই যেন কান্নার মতো করে সমস্ত পাহাড়তলীকে কাঁদিয়ে দিয়ে যায়। এই কান্না তার ভেতর হয়তো তার মেয়েটিই দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি হঠাৎই কাঁদে, এমন কান্না নাহার বানু তার জীবনে শোনে নাই। কেন মেয়েটা কাঁদে? তবে কি তার পরিচয়ের ব্যাপারে কেউ কুটনামি করেছে? তাকে কেউ মূল কাহিনি শুনিয়ে দিয়েছে? আসল কথাটা তাকে প্রকাশ করে দিয়েছে কেউ! কিন্তু নাহার বানুর স্বামীটা বারবার বলে, তোমার এই লুকোচুরির মানে হয় না। তার জীবনের এত বড়ো ঘটনা বুঝি কেউ তাকে বলে নাই? এটাও তুমি বিশ্বাস করো!
তবু কথা থেকে যায়। এতদিন পর এমন কান্দনের মানে কী? নাহার বানু তা ভেবে পায় না। মিতু নামের তাদের এ মেয়েটা কি তার শরীরের কোনো পরিবর্তনের হাহাকারে কান্দে? কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়াতে তার মনে কোনো লাঞ্ছনা জমা হয়? তার জীবন-যৌবন কোনো সংশয়ের কবলে পড়েছে নাকি? নাহার বানুর জীবনের কোনো বিষয় কি সে জানে? সে কি জানে যে নারীর জীবনে লাঞ্ছনার হিসাব থাকেই? নাকি মেয়েটার গাত্র বর্ণের জন্য তার কান্দন আসে? তার দৃশ্যমান বাবা-মায়ের সঙ্গে তার তো তেমন মিল নাই। নাকি আছে তা! নাহার বানু তো বারবার বলে, দেখ, দেখ মিতু, তুই আর আমি কেমন একরকম হয়া যাইতাছি হিহিহি। নাকি তার মায়ের সঙ্গে তার এমন মিল-মিল খেলার জন্যই তার কান্দন হয়! অথবা, এমন কথা তার মনে আসা-যাওয়া করে যা সে কাউকেই বলতে পারে না। সেই তার না-বলা কথা, সেই তার জীবনের হাহাকার হয়তো প্রতি মুহূর্তে কান্দনের কাছেই বন্ধক রাখে। হয়তো তাই হয়, মানবজীবন আসলে বন্ধক দিয়েথুয়ে চলারই তো এক কারসাজিগো।
এই ঘটনার পর অনেক ঘটনা ঘটে। নাহার বানু বা তার স্বামী বা তাদের মেয়েটার জীবন বয়ে যায়। কীভাবে যায়, তা তো সব বলা যায় না। মানুষ মানুষের ভেতরে থেকেও আর কতটুকু জানতে পারে? তবে নাহার বানু নিজেকে নিজের জায়গায় দেখে, তার বুকের ভেতর হাহাকার থাকে, আবার থাকেও না। সে ভাবে, তার মেয়েটাকে একদিন না হয় সবই বলবে Ñ কী হবে আর তা না বলে। রক্তের দাবিই সব নাকি? সব কথা তাকে বললেই কী এমন হয়ে যাবে!