সহমরণ

সুশান্ত মজুমদার

 রোজ একঘেয়ে কয়েক কিসিমের কাজ সেরে ঘুণ-জর্জর শরীর টেনে ছলেমান টিনের ছাপরায় যখন ফেরে, হাঁটুর জোর তখন নস্যাৎ হওয়ার উপক্রম। পেরেশানের চাপে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মুহূর্তে যেন গুঁড়ো হবে সে। কাঁহাতক আর সহ্য হয়, দুদন্ড জিরিয়ে নেওয়ার ফুরসত কই! সময়-অসময় নেই, দৌড়াও বাজারে, ব্যাপার কী, মাছ-গোশত-তরকারি হেন কিছু বাকি নেই, সদ্য সে কিনে ফিরেছে, আবার কেন? সালাদের জন্য ক্যাপসিকাম, লেটুস পাতা দরকার, সাহেবের বিদেশ-ফেরত মেদ-মোটকু ছেলেটা দুপুরে খাবে। কোনো কোনো দিন বাজারের ব্যাগটা ফ্লোরে কেবল নামিয়েছে, বেগম সাহেবার চোঙা-ফুকানো নীরস স্বরের নির্দেশ – কোলেসটেরলমুক্ত সয়াবিন তেল চাই। বাজার নয়, এবার ডিপার্টমেন্টাল সেন্টারে ঢোকে। কাচের দরজা টেনে টাইলসের ঝকঝকে স্টোরে ঢুকতেই ঠান্ডা, আহ, আরামে শরীর জুড়িয়ে আসে। কিসের শরীর – পোড়া কালচে খোসার হাড্ডি-কাঠামোকে খাটুয়ে গতর বলা যায়। রোদের দাহ নিয়ে ক্ষয় পায়ে ফিরে আসার পর এবার কী কাজ – ফুলগাছের পাতা মোছা হয়নি, বাইরের ধুলো এসে পড়ে সব সবুজ নোংরা হয়ে আছে। তারপর – কোনো শেষ নেই এর, দুপুরের খাড়া সূর্য খুলির ওপর ধরে সাহেবের অফিসে পৌঁছে টুকরো টুকরো হুকুম পালন তো আছে। তাহলে দাঁড়ালো কী : ছলেমান একাধারে বাসার দৈনন্দিন ঘরকন্নার চাকর, কাজের ফাঁক ভরাটে কখনো ঝাড়ুদার, কখনো মালি, আবার সাহেবের অফিস খাদিম। মানুষ একটা, দুহাত-পা নিয়ে কত আর খাটতে পারে!

খুব সকালে সাহেবের খরিদ-করা ফেলনা জমিনের একটা নিকৃষ্ট টিনের ছাপরা থেকে বেরিয়ে ছলেমানকে আসতে হয় ইস্কাটনের বাসায়। কোনো কোনো সকালে বাসার গেট খোলার অপেক্ষায় ঠাঁয় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তখন ইচ্ছা হয় ভোরের পরিষ্কার স্নেহের বাতাসে ঢাকা ছেড়ে উড়াল দিতে। দিতেও হবে। চারপাশে এখন তুমুল বলাবলি – এই দুনিয়া সামনের পাঁচ তারিখে নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে। হোক, সব ভেঙেচুরে চিরকালের জন্য শেষ হয়ে যাক, তাঁর আর ভালো লাগে না, তবে -। এখানে এসে ছলেমানের ইচ্ছা বলো ভাবনা বলো সব আটকে যায়। তার বউ, ছেলে দুটো পড়ে আছে সেই নোনারাজ্য হুলারহাটের বানেশ্বরে। সরু খালপাড়ের পানি-কাদা-হেজিপেজি লতাপাতার ঘেরাও এক প্রস্থের ওপর খসে খসে পড়া পচা ছাউনির নিচে তিন-তিনটে নিজস্ব মানুষ ফেলে কোন সুখে একলা মরণ সে সমর্থন করে! ধুর, দূর দক্ষিণে বউ-বাচ্চা রেখে আত্মীয়-স্বজনশূন্য ঢাকায় ইট-পাথরের এই জটিল রাজনগরে একা মরবে – অসম্ভব! গোটা দুনিয়ার তামাম ঘরবাড়ি-দালান,  পশু-পাখি-গাছপালা, নদী-সমুদ্র আর মানুষ একসঙ্গে এক মুহূর্তে যদি শেষ হয় তাহলে বউ মোমেনা, দুই ছেলে – পিরু আর নিরুকে নিয়ে জড়াজড়ি করে চারজন একত্রে মরা ভালো। এমন আনন্দের সহমরণের জন্য ছুটি নিয়ে একটানা নদীপথে লঞ্চে এক বিকেল এক রাত খরচ করে ছলেমানকে যেতে হবে হুলারহাট। ছুটি! ভাবতেই, ছলেমানের ভেতর ধস নেমে আসে। কঠিন স্বরের হুঙ্কার দিয়ে সাহেব ছুটির আবেদন উড়িয়ে দেবেন।

ছলেমান আর ভাবতে পারে না – বাসার অতিরিক্ত ভারী গেটটা খুলে খালেক লম্বা লম্বা হাই তুলছে। ভাবখানা, মুফতে পাওয়া খানাদানা পেটের খোড়লে পড়ার পর রাতের জমাট স্বপ্ন থেকে ছিঁড়ে আসায় এখন তাঁর ঘুমে কমতি পড়ে গেছে। ছলেমানের মতো একটা যাচ্ছেতাই আপদের কারণে প্রায় এক ঘণ্টা ঘুমের বিস্তার তার পুরো বরবাদ। কাল মধ্যরাত অবধি সাহেব-বিবি, তাদের সুপুত্রের আমোদে মিনারেল ওয়াটার-বরফ-কাবাবের জোগান দিয়ে গেছে সে। সকালের পরিচ্ছন্ন চেহারা দেখতে যাবে তারা কোন দুঃখে! যে যার বিছানায় তারা গাঢ় ঘুমে আটকে আছে। এই ইতর ব্যাটা ছলেমান, খামোখা কাজ দেখানোর কী দরকার, আলো-ফোটা কচি সকালে অমন ময়লা হীন মূর্তি নিয়ে হাজির।

খালেককে সামনে দেখে সহসা অস্বস্তিতে পড়ে ছলেমান। সাফ বোঝে সে, এই ইঁচড়েপাকা ছেলে কেন জানি তাকে ঘোর অপছন্দ করে। তুই আছিস অন্দরমহলে, আমি থাকি সদরে, দুজনেরই ঘাড়ে জোয়াল, তোর অতো কেন দাঁত ফুটানি, শালা, তুই আমারে দিস কাজের হুকুম! খালেকের হঠাৎ হঠাৎ মাতববরি স্বভাবে ছলেমানের অতিষ্ঠ মেজাজ তেতে ওঠে। গরমে গরম ফেলে ছেলেটার দুই গাল চড়াতে হাত তার নিশপিশ করে। ওই পর্যন্ত, ছলেমান কোনো গোলযোগে জড়াতে চায় না। মাঠে-ঘাটে রাস্তায়-জনজটে কোথাও জোর হইচই শুনলেই কেটে পড়ে সে। কতবার কতজন কী বাজারে, কী ফুটপাতের ভয়ংকর ভিড়ে তার পা চটকে গা মটকে জোর ঢিলা করে দিয়েছে, কই, সে তো তেড়েমেড়ে ওঠেনি। তার টিনের ছাপরার সামনের রাস্তার দেয়ালের ওপাশে ইয়ারদোস্ত নিয়ে প্রায় রাতে কারা যেন ফুর্তি-ফার্তা করে। একবারও ঝোঁকের বশে সে উঁকি মারেনি।

আরে, দিন-দুনিয়া ধ্বংস হলে পর দুই ঠ্যাং নাচানো ভোগের আমোদ-আল্লাদ, গলার খাঁজে লেপানো জংলি রস নিমিষে বরবাদ সব। কারো দম নেই, সবার আয়ু খতম। বারামখানা বলো, কি লুটের তালুক বলো – এতো জমিজমা, টাকা-পয়সা, সোনাদানা, দালানকোঠা সব মুছে যাবে, কিছুই স্থায়ী না। – শেষ ঠিকানা তখন মাটির ঘর মাটির বিছানা। ধনী-গরিব, সাহেব-মিসকিন, নারী-পুরুষ, বুড়া-গুঁড়া সবার বিচার হবে একদন্ডে। কোথায় থাকবে এতো মাতামাতি আর মোড়লিপনা। খোদার ওপর খোদকারী, উহু, কিছুই খাটবে না – আসল মীমাংসার মালিক হলো সে। দুঃখ দেখো, সৃষ্টিকর্তাকে সেজদা দিতে আকুল হৃদয়ে গেল জুমার নামাজের জন্য সাধ্যমতো সে প্রস্ত্তত, হাতে সময় নেই, জামাত ধরতে হবে, তড়িঘড়ি বেরিয়ে যাওয়ার মুখে পেছন থেকে সাহেবের পাথুরে আদেশ এসে তাকে চুরচুর করে দেয় । – ‘ছলেমান, এখুনি তোকে নিউমার্কেট যেতে হেবে।’

অক্ষম রাগের আঁচে নিজের ভেতরটা উষ্ণ হলেও ছলেমান নিভন্ত মুখে স্থির থাকে। এই চরম অবেলায় এখান থেকে নিউমার্কেট, অতো দূর মানে উপলক্ষ একটাই – ফুলগাছের মাটি আনা। চালচলনে আজগুবি ছাঁচের বেগম সাহেবা তার চির খামখেয়ালে ফুলের টব দিয়ে বারান্দার সামনের অংশ সাজিয়েছেন। টবে কত রকমের ফুল, কত রং, গন্ধশূন্য পরদেশি এই ফুলের খটরমটর নাম ছলেমান জিন্দিগিতে শোনেনি। খরচে সময় পেলে, এমন মানবজনম আর কী হবে, নিজের মনে গুনগুন করতে করতে ছলেমান খুরপি দিয়ে গোড়ার মাটি আলগা করে ফের মাটিতে শ্রী-শৃঙ্খলা এনে রাখে – গাছেরও তো শ্বাস নেওয়া লাগে। ব্যস, গায়ে পড়ে কাজ দেখানো, এখন বোঝো, নিজের জন্য সে বিপদ ডেকে এনেছে। খাটো এখন – একটা বাড়তি খাটুনি তার ঘাড়ে চেপে গেল। তাই বলে কাজটা স্থায়ী হয়ে যাবে, সময় নেই ক্ষণ নেই – নামাজের সময়ও পাবে না, এটা কী উচিত হলো! দুনিয়া ধ্বংস হোক বা না হোক একসময় তো দিন-দুনিয়ার মালিকের কাছেই তো ফিরতে হচ্ছে। ফরজ কাজ, নামাজ মুলতুবি করে ফুলগাছের জন্য নিষ্ফল দৌড়ঝাঁপ বড় হলো কী! সাহেবের দুর্মতি গুনাহ কাজবাজে জড়াতে কার ভালো লাগে। কোত্থেকে বিলাস-ব্যাসনের এতো আমদানি তার মাথায় খেলে না। কেন খেলাতে হবে? প্রয়োজন কি? ছলেমান নিজেকে নিজে জবর ধমক দেয় – তুই হলি গিয়ে নখেরও অযোগ্য, সাহেবের জো-আজ্ঞায় ঘাড় গড় করা রুগ্ণ চাকর, তুচ্ছ ছোটলোক, সাহেবের দয়া-দাক্ষিণ্যে ভাগ্যগুণে কাজ জুটেছে, এটাই তোর বিরাট নসিব। তুই নিতে চাস সাহেবের খোঁজ, কী দুঃসাহস! আরে, অমন দয়ালু মনিবের স্বভাব-চরিত্তির, তার পুঁজিপাট্টার খবরাখবর, কি সাধু-অসাধু আয়-রোজগারের তত্ত্ব-তালাশে তার কী ফায়দা? কোথাকার পচাগলা নুন অঞ্চলের এক গন্ডমূর্খ কাদাপ্যাঁক ঘেঁটে এই সরস রাজধানীতে এসে দানাপানি পাচ্ছে, সামান্য হলেও মাসে মাসে পাওয়া হাতখরচের টাকা, বাড়িতে পাঠাচ্ছে – এমন উপায় কী সহজে জোটে!

ইস্কাটনের বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে কারওয়ান বাজারের তুমুল হই-হট্টগোল কানে নিয়ে একটা লম্বা দালানের পাঁচতলায় সাহেবের অফিসে পৌঁছতে ছলেমানের দুপুর এগারো-সাড়ে এগারোটা হয়। সাহেব জানেন, কী আন্দাজ আছে তার, সেই সকাল থেকে দৌড়ঝাঁপ, অতো ফাই-ফরমাশ খেটে একটা মানুষের পক্ষে অফিসে আসতে বেলা তো হবেই। প্রথম প্রথম রাস্তা বুক ফেঁড়ে আবার রাস্তা, ছোট-বড়, চওড়া-খাটো কত রাস্তা, অতো রাস্তা থেকে অফিসের রাস্তা খুঁজে পেতে তার দম শেষ। এখন গাড়ি-রিকশা-মানুষের জটের মধ্য দিয়ে সে সই-সালামতে অফিসে পৌঁছতে পারে। ফুটপাতের কোথায়, কোন বিল্ডিংয়ের নিচের কোন কোনায় হকার বসে ফলমূলকলা বেচে, পরিষ্কার সে বলে দিতে পারে। পারবে না কেন – মায়ের পেট থেকে পড়ে জগতের দশদিক, কোনা-ঘুপচি, প্রতি ইঞ্চি-ছটাক জায়গাজমি মেহনত দিয়ে তাকে মুখস্থ করে নিতে হয়েছে। আশপাশের জড়াজড়ি তার মতো অন্য অফিসের নগণ্য দু-চারটা পিয়ন-বয়ের সঙ্গে প্রতিদিনের মুখ চেনাচিনির সুবাদে সুখ-দুঃখের আলাপসালাপও হয়। কিন্তু এতোদিনেও তার সাহেবের নামটা ছলেমান সঠিকভাবে বলতে পারে না – ভুলের গিঁটে নাম আর একটা থাকে না। হাসান আলী, কখনো হোসেন আলী, কিংবা আহসান আলী বলে সাহেবকে নিয়ে সে গোলমালে পড়ে যায়।

অফিসে তার কাজ কঠিন কিছু নয়; চা-কফি বানানো, পানি খেতে দেওয়া, দরকার হলে কাগজপত্রের ফটোকপির জন্য নিচে নামা। শোনা যাচ্ছে : অচিরেই অফিসে ফটোকপির মেশিন বসছে। তখন ফটোকপির কাজে তাদের ওঠার-নামার জন্য বরাদ্দ সিঁড়ি আর ব্যবহার করতে হবে না। বাকি যে দুই পিয়ন, বয়সে তার কাছাকাছি, দুজনই ফাঁকিবাজিতে ওস্তাদ। সুযোগ পেলে হয়, গুলতানিতে তারা মশগুল, ছলেমানের কথা কানেই তোলে না। এরাই বেলের বিরক্তিকর ঘ্যা-ঘ্যা আওয়াজ হলে কখনো-সখনো সাহেবের রুমে তাকে ঠেলে দেয়। একবার ঢুকেই ছলেমান তাজ্জব। দেখা গেল, রুমে পাতলা-লম্বা-ফর্সা এক মেয়ে, গদগদ হয়ে সাহেব তার হাত ধরে আছেন। – ‘তুই, তুই কেন?’ সাহেবের কণ্ঠ যেন তরাসে কেঁপে উঠলো। আরে, সাহেবের এই গোপন কামজ্বর কি বেগম সাহেবার কানে সে তুলতে যাচ্ছে? দেখো, কী জঘন্য, রুম থেকে ইতরজ্ঞান করে তাকে খেদিয়ে দিলো! বেলের আওয়াজ পেয়েই তো ঢুকেছে সে। নাকি পিয়ন দুটো সাহেবের এমন নষ্ট ছলকলা জানতো, এখন তুই বাসার লোক জানাজানির ভাগিদার হ। না, সাহেবের রুমে ছুটকা-ছাটকা কাজে বা কারো উসকানিতেও আর যাবে না সে। তারচেয়ে অফিসের উত্তরে জানালা বরাবর বসা নেকবন্দ গোছের টাইপিস্ট যুবক, যে ফুরসত পেলে তাকে দোজাহানের নেকি হাসিলের জরুরি এলেম দেয়, এই তার থেকে খোদার নিষ্কলুষ জীব হয়ে ওঠার সবক নেওয়া উত্তম। কথায় কথায় এই পরহেজগার থেকেই বিনাশের বার্তা ছলেমান জানতে পারে – ইংরেজি মে মাসের পাঁচ তারিখে আর দুনিয়া থাকছে না। তখন আরবি চান্দ্রমাসের প্রথম মাস মহররম, এই মাসের এক শুক্রবারে সব ধ্বংস। অমন শেষ খতমের সেই মে মাসের পাঁচ তারিখ হচ্ছে এবার মহররম মাসের আগামী শুক্রবার। অন্তিম দিন – কিছুই বেঁচে থাকবে না। শুনে ছলেমানর হাত-পা ঠান্ডায় প্রায় অবশ হওয়ার উপক্রম। সবাই মরে যাবে, সেও,          হায়াত-মউত হচ্ছে সর্বজীব ও জগতের পরমপতি আল্লাহর হাতে, কিন্তু -। এই দুনিয়ায় আপন বলতে তার বউ আর দুই বাচ্চা, তাদের ফেলে আলাদা মরে গেলে আফসোসের সীমা থাকবে না। চাল নেই, চুলো নেই, বাপ-মা কেউ নেই, জমি-জিরেত করেই ফৌত, সহায়-সম্বলহীন এই মানুষটা আপনজন থেকে দূর পরের জমিনে মরে যাবে। হায় হায় -। পরের জমিন মানে; দুপাশভর্তি গাছ, ইস্কাটনের চওড়া নিরিবিলি রাস্তা, ডানে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, সামনে গেলে পড়ো মাঠ, তার ওধারে পাঁচ-ছয় বছর হলো সাহেবের খরিদ করা চার কাঠা চৌকো জায়গা। এতোদিনে আশপাশের আবাদ অযোগ্য মাটিতে সবে শুরু দালানকোঠার কাজ। পয়সাওয়ালা গাবদা সাহেবটা গড়িমসি ছেড়ে এখানে ঘরদরজা বা অন্যকিছু কবে করবেন আদৌ তার নামগন্ধ নেই। ট্রাক দুই ইট সেই পয়লাকালে আনা, এখন ওই ইট শেওলা ধরে পিচ্ছিল, তার ফাঁকে লকলক করে উলুঘাস – পুরো জায়গাজুড়ে ওই ঘাসের বিস্তার। সীমানার দখল রাখতে জংধরা টিনের দুর্বল ছাপরায় ক্লান্ত শরীর টানতে টানতে ছলেমানের বুঝি দন্ডভোগের জন্য আসা। দেখো, চোখভর্তি ঘুম, অথচ জনশূন্য ভূঁইয়ে এসে রাতটা চলে যায় নির্ঘুম। প্রথমদিকে ভয়ে কাতর হয়ে কখনো হারিকেন, কখনো মোমবাতির আলোয় নিজের হাত-পা নিজেকেই খুঁজতে হতো। অন্ধকারময় আকাশটা হুড়মুড় করে তার ওপরেই হয়তো ভেঙে পড়বে। ঝড়ো বাতাস এলে তার প্রতাপে ছাপরার ছাউনির সঙ্গে সেও মহাশূন্যে উড়ে যাবে। কিটির কিটির আওয়াজ তোলা দাঁত শানানো পোকামাকড় ধেই ধেই নাচতে নাচতে, কখনো লাফিয়ে ছাপরায় ঢোকে। বাধ্য হয়ে ছলেমান ছাপরার ভেতরে ইট পেতে নিয়েছে। লাভ কী, বৃষ্টি হলে ময়লা পানি গড়িয়ে ইটের নিচে এসে জমে। নড়লে-চড়লে চপচপ শব্দ তাকে জব্দ করার জন্য যথেষ্ট। অনেকদিন বাদে, তা চার-পাঁচ মাসের মাথায় সাহেবের সামনে কেঁদে-কেটে থাকার সমস্যার ব্যাখ্যা দিয়ে পাতলা চৌকিখাট একটা জোটাতে পেরেছে বলে রক্ষে, নচেৎ ভেজা কাঁথা-বালিশ নিয়ে সারারাত পানিতে পড়া ইঁদুরের মতো তাকে ভেসে থাকতে হতো। একটা মাটির কলস, ঘষা কাচের আয়না, প্লাস্টিকের বদনা, সাহেবের বাতিল তিনজোড়া পুরনো প্যান্ট কারওয়ান বাজারের এক দর্জি থেকে নিজের মাপে উপযোগী করে; আর জ্যালজ্যালে দুটো লুঙি নিয়ে ছলেমানের ছাপরাজীবন।

এক মেঘলা বিকেলে হঠাৎ কী খেয়ালে সাহেব পেছনে ছলেমানকে রেখে জায়গা দেখতে এসে ভীষণ অসন্তুষ্টি নিয়ে শুধু তার অংশ নয়, গোটা দেশটাকে যারপরনাই নোংরা মনে করেন। তাহলে? সব দোষ ছলেমানের। দারুণ ধমক দিয়ে তার অপছন্দ ও রুচিবিরুদ্ধ কার্যকলাপ নিয়ে মনের রুষ্ট ভার তিনি লাঘব করতে চান – ‘কিচ্ছু হবে না, এই দেশেই হবে না, উঃ-হু-হু, হেগেমুতে চারপাশ আস্ত দোজখ বানিয়েছিস।’ ঘোর ধমক ছলেমানকে হজম করতেই হয়, কিন্তু ভেতরের চাপা গুমোট কিছুতেই কাটে না বলে পাতলা রাগ বারবার লতিয়ে ওঠে – তাইলে হাগমু-মুতমু কই? সাহেবের দলানে যাইয়া। তা একবার সাহেবের বাসায় কাজ করতে করতে পেচ্ছাপের চাপে সে সার্ভেন্ট বাথরুমে ঢুকেছিল। চুপচাপ হালকা হয়ে ফুলগাছের সেবাযত্নে ফের বিভোর হয় সে। গাছপালার কাজে নির্ঘাৎ আলাদা কোনো মানে আছে, নইলে তার মধ্যে মারফতি সুর ধীরে ধীরে কেন জেগে ওঠে। ওই যে তাঁর তৃপ্তির ভালোলাগার গান – ‘মন যা করো তরাই করো এই ভবে’, কেবল ভেতরে গুনগুন করে উঠেছে, তখুনি কোন আড়াল থেকে খালেক লাফিয়ে এসে ঘাড় মুঠ করে ধরে। – ‘হারামজাদা মুইত্যা পানি দ্যাস নাই। গন্ধে গোটা বাড়ি ম ম করতাছে। ব্যাগম সাহেবার নাকেও গন্ধো ঢুকচে।’ ছলেমান বোঝে তার ভুল হয়ে গেছে। চাকর-বাকরদের বাথরুম আলাদা। ওই বাথরুম গোটা বাড়ির অংশ হিসেবেও যে মানমর্যাদার দাবি রাখে ছলেমান তা বুঝতে পারেনি। হ্যঁা, তাড়াহুড়ায় পানি ঢালার ব্যাপারটা তার খেয়ালে ছিল না। কিন্তু বেগম সাহেবার নাকে কেমনে গন্ধ যায়? সে কি সার্ভেন্ট বাথরুমে ঢোকে, না বাথরুমের সামনে দিয়ে হাঁটাচলা করে? যত্তসব!

ছলেমান মনে মনে অবিচল ওয়াদা করে, লজ্জা-শরমের বালাই না করে রাস্তায় হাগবে-মুতবে তো সাহেবের পুষ্প-চন্দনের গন্ধময় বাড়িতে আর না। তাড়া না থাকলে হাঁটতে হাঁটতে কাছেই মতিনের ওখানে যাবে। গাঁও গ্রামের খবরাখবর, উভয়ের দু-চারটা সুখ-দুঃখের আলাপ সেরে সে পেট হালকা করে আসবে। অমন পুরনো প্রতিজ্ঞার সঙ্গে হুট করে মতিনের মুখটা মনে পড়তেই ছলেমানের খেয়াল হয়, তাইতো গ্রাম সম্পর্কে পাতানো এই ভাইটা একপাক বাড়ি ঘুরে আসার কথা বলেছিল। সত্যি, মতিন যদি যায়, ফেরার কালে তার বউ-বাচ্চা দুটো সঙ্গে করে ঢাকায় আনার অনুরোধ করলে কেমন হয়। এক রাত লঞ্চে কাটিয়ে পর সকালে সদরঘাট – ব্যস, হোক তুচ্ছ, রিকশা নিয়ে সোজা ইস্কাটনের টিনের ছাপরায়, কী আনন্দ! তাঁর এমন ইচ্ছা কি মতিন অগ্রাহ্য করবে? অসম্ভব, ছেলেটা তার থেকে খানিক ছোট, সেই সুবাদে সে মুরুবিব, উপরন্তু একই অঞ্চলের মানুষ, কতইবা বানেশ্বর থেকে হুলারহাট, মাত্র এক নিশ্বাসের দূর। ঢাকায় এক গাড়ির গ্যারেজে মতিন মিস্ত্রির কাজ করে, ওই গ্যারেজ সে চেনে – মগবাজারের সোজা রাস্তা ছেড়ে ডানে ভেতরের আরেক রাস্তায়। ধুস, এতো ভাবাভাবির কি, সামনে পেছনে না তাকিয়ে অফিস ছেড়ে নিচে মাথার ভিড়ে সে আগুয়ান কদমে মিলে যায়। নিকুচি করি তোর কাজের, কিসের কি সাহেব, তামাম দুনিয়াই ধ্বংস হচ্ছে, সেখানে মানুষের এতো কি সাধ্য আল্লাহর ইচ্ছাকে ছোট করে দেখা। চাকরি-বাকরি, ফুঁ, কোনো প্রাণীই জ্যান্ত থাকবে না। অফিস-বাসা-বাজারঘাট কিছুই কি আর খাড়া থাকবে – সব বরবাদ, ধুলো হয়ে যাবে।

 

পাঁচ তারিখ শুক্রবার, অতিনিকটের সৃষ্টিবিনাশের ঠিক আগের দিন মাথার ওপর সূর্য ধরে গরম দুপুরে বউ মোমেনা, দুই ছেলে – পিরু, সিরু পৌঁছে গেল ঢাকায়। নদীপথে চলতে চলতে লঞ্চ কোন চরে এসে আটকে যায়। থাকো ডেকে দলামোচা হয়ে। শেষে মধ্যরাতের ছলাৎ নতুন জোয়ারে লঞ্চটা ছাড়া পেলে সদরঘাটে এসে পৌঁছতে দেরি করে ফেলে। ছলেমান যথারীতি বাসার যাবতীয় কাজ সেরে অফিসে তার টুলের ওপর বসে আছে। পয়লা ঢাকা দেখার বিস্ময়ভরা তিনজোড়া অবুঝ চোখ ইস্কাটনের ছাপরায় রেখে মতিন চলে এলো কারওয়ান বাজারের অফিসে। পাঁচ রাত হলো ছলেমানের ঘুম পাতলা, আজেবাজে দুশ্চিন্তায় মাথার পাশে চিড়িক মেরে ওঠে ব্যথা, একগলা অন্ধকারে উঠে বসে খাবি খায় সে – দিন চলে এলো, বউ-বাচ্চার খবর নেই, মতিন আসে না, বুঝি একসঙ্গে মরার সাধ অপূর্ণই থেকে যায়। এই মিসকিন গরিবকে কি আল্লাহ দয়া করবেন না? ধনদৌলত, জমিজমা, আহার-বিহার কিছুই চায় না, কেবল মরার মহামিলন থেকে কি বঞ্চিত হবে সে? তার মনোবাসনার কি সিদ্ধি নেই? দুর্ভাগার মুশকিল আসান করো আল্লাহ। হঠাৎ কাবু-ক্লান্ত মতিনের মুখ সামনে দেখে ছলেমান উঠে দাঁড়ানো ভুলে যায়। মতিন ইঞ্জিনের লোহালক্কড় তেলমবিল ঘাঁটা বুঝপড় লোক। খুশিতে তার তো গলে পড়ার কিছু নেই। মগবাজারে তাঁর গ্যারেজের উদ্দেশে সে রওনা দিলে প্রায় উড়াল দিয়ে ছলেমান ছাপরায় চলে আসে।

সাত মাস এগারো দিন বাদে দৃষ্টির সামনে তার হাতের নাগালের কাছে মোমেনা। এবারের লম্বা বিচ্ছেদে নতুন বউয়ের মুখ দেখার মতো লজ্জা-জড়তা বুঝি ছলেমানকে আটখানা হতে দেয় না। তার খুশির নিরীহ নজর বউয়ের মুখঢাকা ঘোমটার ওপর পড়ে ফিরে ফিরে আসে। চোয়ালভাঙা বাপের পরনে সাহেবি প্যান্ট দেখে পিরু-সিরু ফিকফিক হাসে, নাকি বড্ড বেমানান, তাকে কাকতাড়ুয়ার মতো দেখাচ্ছে – কোনটা? মাখামাখি অস্বস্তি থেকে রেহাই পেতে ছেলেদেরই সে উপলক্ষ করে – ‘তোরা অত্তো শুকাইছোস ক্যা? ঘ্যানাঘ্যানা লাগে।’ ঘোমটার আড়াল থেকে চিল স্বরে মোমেনার জবাব উড়ে আসে – ‘শুকাইবে না? খাওন কই? অ্যাকবেলার খাওন তিন ফির খাইলে শরীল ক্যামনে থাহে? বাপে কি খোঁজ রাখচে?’

খাওন, তিন-তিনটি খিদে-ভর্তি মুখের জন্য মোটা একরাশ ভাতের খোলা ছবি সামনে এলে মুহূর্তে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় ছলেমান। নিজের খাওয়া তো সাহেবের বাসায় সারে। রান্নাঘর, কী যেন নাম – কিচেন না ফিচেন, দেয়াল ঘেঁষে তার এককোণে টাইলসের পরিচ্ছন্ন মেঝেতে দুই হাঁটু ভাঁজ করে ঘ্যাট হয়ে বসে ছলেমান প্লেট চেটেপুটে খায়। অমন নিখাকি মলিন মুখ ধরে ফেলে বেলুনি। কাজের এই অল্পবয়সী বুয়ার তন্নতন্ন চাহনির সামনে সে ভাঁজ হতে থাকে। – ‘ভাইজান, আর চাইরডা ভাত দ্যাই’, বলে মেয়েটা যখন উপরি সাধাসাধি করে, ছলেমান না করে না। চোখে পানি এসে যায়। মায়ের জাত এই দয়াবতী মেয়েটা পরিষ্কার বোঝে – মানুষটার পেট আরো কিছু দানাপানি চায়। ওই মিহিকণ্ঠের দরদভর্তি ভাইজান ডাকে ভালো লাগার শান্তিতে মন জুড়িয়ে আসে। নির্জীব ঢাকা শহরে সাহেবের দামি পাকা বাড়ির গেটের ওপাশে বুঝি একটা আস্ত গ্রাম এসে দাঁড়িয়েছে, ওই গ্রামের গাছপালা-শস্যক্ষেত থেকে ঘন সবুজ মেখে যেন বেলুনি উঠে এসেছে। আচ্ছা, ঢাকায় বউ-বাচ্চার আনার কারণ খোলাখুলি বেলুনিকে জানিয়ে কিছু ভাত-তরকারি গামছায় বেঁধে কি নিয়ে আসতে পারে না? ঘরের বাড়তি কত খাদ্য ফেলনা যায়, রোজ আবর্জনা হচ্ছে। না, মাথা নেড়ে ভাবনাটা খারিজ করে ছলেমান। গোপনে এমন ভাত আনার ব্যাপারকে কেউ যদি হাত-সাফাই বলে – তখন? অসম্ভব। তার চেয়ে বেগম সাহেবাকে একত্রে মরার উদ্দেশ্য সবিস্তারে বলে তার মন আদায়ের চেষ্টা করলে কেমন হয়। না, এখানেও বিপত্তি, ট্যাটন খালেক বাগড়া দিতে পারে, চাই কি, ভাত-তরকারি বেলুনি প্রকাশ্যেও যদি দেয়, তবু বেগম সাহেবার কানে ভালো মেয়েটার নামে নানাখানা বিষকথা ঢালতে পারে। ঢিলা মাথার বেগম সাহেবা তার পাশে ঘুরঘুর করা এই চাটুকারের ফিসফাস কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই পাত্তা দেন। বরং খালেকেরই হাতটা ধরে মিনতি করলে ভাতের সমাধা হতে পারে। ছেলেটার জটিল মন নরম হয়ে তার দিকে ঘুরলেই সব সমাধা। উহু, খোদ সাহেবকে জানানো ভালো, তার জমিনের ওপর তৈরি ছাপরায় গ্রাম থেকে পরিবার এনেছে সে, এই সংবাদ না জানালে আখেরে সাহেব বিগড়ে যদি যান।

প্রবল টানাহেঁচড়ার কামড় মনে ধরে ছলেমান কারওয়ান বাজারের অফিসের উদ্দেশে ফের হনহন পায়ে হাঁটে। থাকুক, বউ-বাচ্চা ছাপরায় – জিরিয়ে নিক। কপাল ভালো, বাইরে কোথাও গিয়ে সাহেব সবেমাত্র ফিরছেন। রুমের দরজায় আঠার মতো ছলেমান লেগে আছে দেখে তিনি প্রশ্নসহ দুই ভুরু বাঁকা করেন – ‘ব্যাপার কী তোর?’ এই প্রথম সাহেবের পেছন পেছন কোনো এক ঘোরের মধ্যে আটকে সেও রুমে ঢুকে যায়। চেয়ারে শরীর ছেড়ে সাহেব থুঁতনি তুলে তার জ্বলজ্বলে দৃষ্টি দিলে ছলেমানের ভেড়িভাঙা স্বরখালি খলবল করে – দুনিয়া মরে যাবে, তারাও মরবে বলে একসঙ্গে থাকবে। শুনে সাহেব নিজেই যেন অবোধ হয়ে তার নির্বোধ মানুষটার মুখে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকেন। চুরমার করা বা অবুঝ ওই নজরের সামনে নিজের সিদ্ধান্ত বজায় রাখতে ছলেমান নিজেকেই খোড়ল করতে থাকে। তার গলা দিয়ে কি কোনো আওয়াজ আসছে না? ওই তো নিজের ঘ্যানঘ্যানানি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে সে – ‘স্যর, খুবসে ওজু সাইরা রেকাতের পর রেকাত নমাজ পইড়েন, আর হায়াত নাই, বেবাক শ্যাষ, আপনের ধনদৌলত, বউ-পোলা, দলান-অপিসও শ্যাষ, আপনি আমি কেউ নাই। আল্লা আল্লা, সেজদা দ্যান, পারলে দিলের থেইকা জিকির করেন। কাইন্দা কাইটা ত্যানা হইয়া যান।’ আখেরি পরিণাম নিয়ে সাহেবের কানে তার এমন পরামর্শ আদৌ কি পৌঁছেছে? ছলেমান বুঝতে পারে না। ওমা, তাচ্ছিল্যের ভারে সাহেবের সিগারেট টানা নিচের ঠোঁট দেখি ঝুলে পড়েছে। রোদের মধ্যে দৌড়-ঝাঁপের গরমে, কি কাজের চাপে কিংবা ঢাকায় হঠাৎ হাজির বউ-বাচ্চার অসাধ্য কোনো আবদারে ছলেমানের মাথাটা বুঝি গেছে। বেগারখাটা ভূতের এই ফাজলামোর মধ্যে তিনি খুঁত ধরেন না। দামের বাজারে অল্পতে তুষ্ট এমন সস্তা মানুষ পাবেন কোথায়। টেবিলের এ-পাশ অবধি পৌঁছে ছলেমানের নজর খসে খসে পড়ে। এবার টালুরটুলুর শিশু চোখে অফিস দেখে যেন পয়লা রুমে ঢুকেছে সে। সাহেব দুটো একশ টাকার নোট এগিয়ে স্বরে যথাসম্ভব গরম চড়িয়ে দেন – ‘ভাগ এখন। তোর বউ-বাচ্চা কাল-পরশু ফেরত পাঠিয়ে দে।’ হু, বললেই হলো, ছলেমানের ভেতর শাঁই শাঁই দেয়াল উঠে যায়। একসঙ্গে মরার মহাসুযোগ সাহেবের হুকুমে ছাড়বে কেন সে?

রাতে রমনা থানার উলটোপাশে কম দামের এক হোটেল থেকে ভাত গরুর গোশত, ডাল কিনে ওই ছাপরার ভেতর ছলেমান উৎসব তৈরি করে ফেলে। রোজ রাতে খাটুনি কাতর খসখসে শরীরে চৌহদ্দিতে ফিরে এসে সামান্যক্ষণ মোমবাতি জ্বেলেই ফুঁ উড়িয়ে নিভিয়ে টানটান সে শুয়ে যায়। দ্রুতই ঘুমে সে কাদা। কোনো কোনো রাতে বাইরের হটকা হল্লা, ঘন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে পোকামাকড়ের খরখরে গলার নির্যাতনে ঘুমে ফাটল ধরে। ওই ঘুম ফের জোড়া দিতে কম কসরত হয়। আজ বহুদিন পর একত্রে বউ-বাচ্চা নিয়ে খাবে বলে সাহেবের বাসায় রাতে সে খেতে যায়নি। হোটেলঅলার কাছে নিচু গরিবি কণ্ঠে গ্লাস-প্লেট চেয়েছিল – সকালে হোটেল চালুর আগেই সে ফিরিয়ে দেবে। কিসের সহায়তা, কুৎসিত কোনো জন্তু দেখার অদ্ভুত চাহনি দিয়ে হোটেলঅলা খেঁকিয়ে ওঠে – ‘গোয়ায় চাম নাইক্কা, হেও করে মামুর আবদার। খাওন তো বাকসে দিছে, আর কি, বাকসো পাওনই তো খোশনসিব।’ না, আজকে কিছুতেই সে মন খারাপ করবে না। কেউ যদি তাকে গালমন্দও করে, মুখ সে মুখের মতো রাখবে। শেষে ছাপরায় জমানো আলতু-ফালতু মালামালের বোঁচকা খুলে টোলখাওয়া টিনের গ্লাস, একটা পুরনো থালা পেলে সত্যি সয়লাব খুশি ছলেমানের বুক ভরে ছলকে ছলকে ওঠে। কুড়িয়ে আনা বাতিলমালের বৃত্তান্ত সে ভুলেই ছিল।

মোমবাতি, কিসের ওই ভীরু আলো, দরকারে সারারাত ফিতা পুড়িয়ে হারিকেন জ্বলবে, কোনো দস্যু পোকামাকড়ের সাহস কী হয় লাফালাফি করে। একজনের পর একজন, দুই ছেলের খাওয়া হলে হলদে আলোর খন্ডাংশে ছলেমান তোফা খানার তুষ্টি তাদের              চোখে-মুখে খুঁজে পায়। এবার বউকে সাধাসাধি করে তার আগে সে খেতে বসায়। লঞ্চে সরু পেটের খোন্দলে কখন কী গেছে তার কোনো নিশানা আছে। শুকনো মুখ দেখেই তো ধরা যায় খিদেয় প্রাণী তিনটি নিস্তেজ প্রায়।

মোমেনার পাটখড়ি আঙুল কি কাঁপছে, না থেকে থেকে ছায়ার কোনো কারসাজি – ধরা যায় না। বউ ভাতে ডাল ঢেলে নেওয়ার পর ছলেমান ফরফর করে তার সেলাই খোলা কথা জুড়ে দেয়। প্রচুর কথার খই ফুটলে আজ কিসের অপচয়!

সে যে ছাপরার নিচে আছে তার চারদিকের সীমানা, এই জায়গার দাম, হিসেবে গেলে মগজে মোচড় পড়ে – সোনা, ধুর, মণিমানিক্যের চেয়েও দামি, এর নাম ঢাকার মাটি। এমন মহামূল্যবান জায়গায় সাহেব তাড়াতাড়ি দালান তুলবেন, পাঁচ-সাত-দশতলা হতে পারে, বিশাল পাকাবাড়ি একটা উঠবে। এ-নিয়ে সাহেব প্রায় তাড়া দেওয়ার মতো করে তাকে বলেছেন : ছলেমান, জায়গাটা কদিন আর ফেলে রাখা, একটা কিছু ব্যবস্থা কর। দেখো, চিনি দিয়ে কী ঘষামাজা আপন স্বর, সাহেব এমনভাবে বলেন যেন ছলেমান হেলাফেলায় জায়গাটা তার ফেলে রেখেছে, এখন ছলেমানই পারে কার্যোদ্ধারে উদ্যোগ নিতে। আবার দেখো, যাবতীয় গুরুদায়িত্ব তার ঘাড়ে তুলে দিয়ে সাহেব খুব নিশ্চিন্ত, কি বাসা, কি অফিস – সব জায়গায় একাই ছোটাছুটি করে কুশল দুহাত চালিয়ে সে সামাল দেয়। বেগম সাহেবা তার মধুর খোশবু ভরা ম-ম করা বেডরুমে কাউকে ঢুকতে দেন না, দোপেয়ে সবাইকে তার জঞ্জাল মনে হয়, কেবল ছলেমানের প্রবেশ অবাধ। ছুটির কোনো কোনো দিনে সাহেব-বেগম দুজনই গাড়ি চড়ে হাওয়া খেতে বের হন, তাদের ওই ফুর্তি-ভ্রমণে ছলেমানকে সঙ্গে নেওয়া চাই। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে সাহেবের গুণপনা ও মহিমা নিয়ে কিছু বললেই বেগম সাহেবা শুনে হাসতে হাসতে তার চূড়ো করে বাঁধা খোঁপা মাথাটা সাহেবের কাঁধে ছেড়ে দেন। তার সঙ্গে খোশালাপের এক ফাঁকে সাহেব ফাইনাল তাকে জানিয়ে দিয়েছেন, এখানে বাড়ি করে কয়েকটা রুম ছলেমানকে সে স্থায়ীভাবে দেবে। অনেক দিনের পুরনো বিশ্বস্ত নিষ্কলঙ্ক মানুষ, অনেক কিছু তো সাহেবের জন্য সে করেছে, এবার সাহেব তার জন্য কিছু করলে ছলেমান যেন না করে না। আপন রক্ত সম্পর্কের জন্যও এই শেষ জামানায় উপকার বলো, কল্যাণ বলো, স্বার্থছাড়া কোনো কাজ করে না, ঈমানদার বান্দার অভাব তাই চতুর্দিকে। শুনে মোমেনার মাথায় টানা ঘোমটা সহসা খাটো হয়ে আসে। ছাপরার ফিকে আলোর ভেতর এবার তীব্র আলো হয়ে সে ফুটে ওঠে। ভাতের থালায় হাত তার জমে গেছে। ওই তো পরিষ্কার, স্বামীর পায়ের নিচে যে বেহেশত, ওই বেহেশতের পথ এতোদিনে চর্মচক্ষে সে দেখতে পাচ্ছে।

 

আজ সেই শুক্রবার, পৃথিবীর আখেরি দিন। পরম খোদাতালা ছাড়া চূড়ান্ত প্রলয় রুখার কেরামতি, বুজুর্গি কি বাহাদুরি কারো নাই। বড় বড় আলেম-মাওলানার বরাত দিয়ে মানুষজন তুমুল বলাবলি করছে, আন্দাজ দুপুর দুটা কি আড়াইটার মধ্যে সব খতম। সামনে বউকে বসিয়ে ছলেমান নিজের সমঝ, আসন্ন ধ্বংসের আদ্যোপান্ত বয়ান করে : চাঁদ-সূর্য-পৃথিবী এ-ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে ভয়ানক প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলবে। ওই আছাড়ে কোনো কিছু কোনোক্রমেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। সূর্যের অতিরিক্ত আগুন পৃথিবীর বুকে ছিটকে এসে পড়বে, অমন আগুনে সব ছাই হওয়ার আগেই জন্তু-জানোয়ার কও আর  লতাগাছপালা কও, ভয়ে দলামোচা হয়ে বেবাক নিষ্প্রাণ। শুনে তরাসে কাঠ হবে কি, মোমেনা অবাক হতেও বুঝি ভুলে যায়। দিনের দুই বেলা পুরো এক রাত, অতো দূরের দক্ষিণের বানেশ্বর থেকে তাদের ঢাকায় এনে দুনিয়া ধ্বংসের সঙ্গে সবাইকে নিয়ে স্বামীর মরার ইচ্ছা তাকে বরং ধন্দে ফেলে দেয়,  আর তা স্বরের সঙ্গে ছিটকে আসে – ‘কাইল যে কইলা সাহেবে বাড়ি বানাইবে? তোমারে -।’ বউয়ের কথা শেষ হয় না, ছলেমান পায়ে চাকা ফিট করে ছাপরা থেকে দ্রুত উধাও হয়ে যায়।

কোথায় যাবে সে? শুক্রবারের ছুটিছাটা, উপরন্তু মরণের সঙ্গে আজ মোলাকাত। ফুটপাত রাস্তায় দিনমজুর থেকে জনজৌলুস রিকশা গাড়ি ভিড়ভাট্টা কম। গত রাত থেকে পুরো দিন আজ ইস্কাটন, মগবাজার, বাংলামটর, অভ্যাসে কারওয়ান বাজার কোথাও কদম তার রাখবে না। হ্যাঁ, সময় সুযোগ হলে বরাবর সে জুমার নামাজ মসজিদে আদায় করে। আজো ইচ্ছা আছে, জুমার জামাতের নামাজে শরিক হয়ে সওয়াব কায়েমে। ভাবতেই, ছলেমানের ইচ্ছার ওপর সমস্যার ছায়া নেমে আসে। বউ-বাচ্চা ছাপরায় ফেলে জুমার নামাজে গেলে ঠিক ওই সময় পৃথিবী যদি ধ্বংস হয় তবে একসঙ্গে আর মরা হলো না।

তাহলে এতো কষ্ট  জড়াজড়ি, পেটে গোঁজামিল দিয়ে চার-চারটা প্রাণীর অতটুকু ছাপরার ভেতর রাত কাটানো কেন?  ধুর, নামাজই আজ পড়বে না। কী? মুহূর্তে ধমক তুলে নিজেকে শাসন করে ছলেমান। নামাজ হচ্ছে ফরজ, না-পড়ার মানে পরহেজগারি বরকত থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা। কখন কোথায় মনের অজান্তে সে গুনাহ করেছে তা থেকে কীভাবে রেহাই! নেকবখ্ত খতিব, কামেলজন যে বলেন, নামাজ পড়তে পড়তে যদি কেউ ইন্তেকাল করে তবে ওই বান্দা অবশ্যই সহজে খোদার করুণা লাভ করবে। এমন মওকা তবে সে ছাড়তে যাবে কেন? ভাবতেই, ছলেমানের মাথায় খুব ভেতরের খুপরিতে নতুন চিন্তার উদয় হয়। নামাজ বা সেজদাকালে মৃত্যু উত্তম হলে তার টিনের ছাপরায় বউ-বাচ্চা মিলে নামাজ তো হাসিল করা যায়। উহু, মাথা নেড়ে সিদ্ধান্ত নাকচ করে সে।

জায়গার ভেতরে গু-মুতভর্তি, গোপনে সামনের অংশে কেউ কেউ ময়লা ফেলে হাওয়া – কিছুতেই কিছু ধরা যায় না। ছড়ানো এতো নোংরার ভেতর ওজু করা থেকে ডানে-বাঁয়ে সালাম ফেরানো – অসম্ভব। তাহলে? কার্যসিদ্ধির উপায় খোঁজাখুঁজির ফাঁকে ঝাল ঝাল ঢেঁকুর বুকের মধ্যে লতিয়ে উঠে তার শ্বাসনালি বেয়ে নেমে যায়। এই ঝাল ঢেঁকুরে গতকালের গরুর গোশতের সুরুয়ামাখা। এখন একটু টক-টকও লাগে। গোশত গরুর না মোষের, মরা না জ্যান্ত – কিছুই তার জানা নেই। আরে রাখো তোমার বাছাবাছি!

অনেকদিন বাদে বউ-বাচ্চা নিয়ে ভাত-গোশত খাওয়া গেছে – কী এলাহি কান্ড। পরক্ষণে ছলেমান দ্রুত জমে যায়। তার দুপায়ে কেউ পেরেক মেরেছে, নড়াচড়ার কায়দা নেই কোনো। তার চোখের সামনের ঝলমলে আলো ফিকে হয়ে আসে। সাহেবের টাকায় ডাঁটের  অতো আস্বাদে খাওয়ায় খরচা গেছে, বাকি টাকায় দুবেলা ফের মাছ-গোশত দূর, কোনো সিদ্ধ-ভর্তা, তরকারিও হবে না। সাহেব একবার না-চাইতেই দিয়েছেন। এবার চাইলে দূর দূর করে দেবে সে। তোর বউ-বাচ্চা এখনো ঢাকায়? জবাব চেয়ে তাকেও ছাপরা থেকে উৎখাত করে দিতে পারে। কী করা? দুশ্চিন্তা উঁকিঝুঁকি দেওয়ার আগেই নিজের থেকে সে রুখে ওঠে – নিকুচি করি তোর খাওয়া-খাওয়ির। আখেরি খাওয়ার সময় মেলে কিনা সন্দেহ, টাকা পয়সা, হোটেল-টোটেল, ভাত-টাত, জমি-জায়গা এক লহমায় সব নিশ্চিহ্ন, সেখানে অতো খাই খাই কিসের!

জুমার নামাজ শেষ। আলাদা দিন আজ – নিচুকণ্ঠে সবার কথা চালাচালি, কারো হাতে জায়নামাজ, গায়ে যথারীতি কোনো ঝুলানো পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, নামাজি সবাই মসজিদ থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। অন্য জুমাবার মসজিদের কোল-কাছের বড় রাস্তায় ফলমূল-শাকলতা-তরিতরকারি-মাছ-মশলা হরেক টুকিটাকি নিয়ে হকার বসে – আজ তারা অদৃশ্য। কোথাও কোনো জটলা নেই। নিশ্চয় আশরাফুল মাখলুকাত সব নিশ্চিত মিসমারের সম্ভাবনায় যার যার ছাউনিতে নিজের মতো করে আয়াত কালামুল্লাহ দোয়া-দরুদ পড়ছে। আচ্ছা, ইসরাফিল ফেরেশতার শিঙার আওয়াজ কি শোনা যাবে? ইস্, প্রশ্নটা আগে মনে এলে তো উত্তর তার জানা হয়ে যেত। অফিসের খোদাভক্ত টাইপিস্ট ছেলেটা বিশদ বলেছে : চাঁদ-সূর্য-পৃথিবী-তারার সংঘর্ষের আগাম খবর কাগজে কাগজে সবিস্তারে ফলাও ছাপা হয়েছে। সেই থেকে খোঁড়াখুঁড়ি, বহু জানাজানি, আলাপ-সালাপ, মুখে মুখে  ইচ্ছাময় সৃষ্টিকর্তার চরম সিদ্ধান্ত আরো ছড়িয়েছে। হায়, তার মনের গোপন গহিনে পাকাপোক্ত খেদ থেকে গেল – ইহজনমে কোনো অক্ষরজ্ঞান বিন্দুমাত্র তার জানা হলো না। আহাম্মক থেকে গেল, চির নির্বোধ দশায় এই জাহানে সে নিশ্বাস হারাবে। নসিব ঘোর মন্দ তার, নচেৎ ষোলো আনা কষ্ট-অনটন-নষ্ট সংসারে জন্ম হলো কেন? তা কাদায়, কি বুনো ডাঙ্গায়, কি জঙ্গুলে ঝোপঝাড়ে জন্মের কারণে তার তকদির যতই মন্দ হোক, দুনিয়া ধ্বংসের মুহূর্তে কে খানদানি কে আশরাফ-আতরাফ কোনো বাছবিচার, বাটোয়ারা নেই – সব সমান। এই যে তার সঙ্গে খামোখা দুশমনি চালু রাখা খালেকেরও দালানের আরামে আর বাঁচা হবে না। আঃ হা, দশে মিলে একই সময়ে মরার কী দারুণ তৃপ্তি! কিন্তু মনে তো খটকা জেগে উঠছে – আল্লাহ গরিবের খুশি কি সত্যি সত্যি মঞ্জুর করবেন? তাকে কি তার পছন্দ না? পুরোদস্ত্তর দুনিয়া এখনো আছে : চতুর্দিকে বাইরে মানুষ, দালানকোঠা, দোকানপাট, গাড়ি-রিকশা, হল্লাচিল্লা ঠিকঠাক সবই বহাল। তাহলে ধ্বংসের দেরি কেন? সামনে-পেছনে, ডানে-বামে আতিপাতি তার ছোটাছুটি নজরে ধ্বংসের বিন্দুমাত্র চিহ্ন, কোনো মুখে অস্থিরতা-ভয়-দুশ্চিন্তার কিছুই দেখে না। বরং তার গা-ঘেঁষে যাওয়া ভবঘুরে গোছের আধবুড়োর একহাতে মোয়া, আরেক হাতে কলা দেখে ধাঁ করে সে ধীরহারা হয়। এতোক্ষণের আক্ষেপের মধ্যে উপোসি চারমুখের আরেক বেলা খাওয়ার চাপ টের পেলে তার চোপসা শরীরের কলকব্জা বুঝি ঢিলা হয়ে যায়।

ধীরে ধীরে দুপুর রোদের তেজ হারিয়ে বিকেলে গেল, বিকেল মরে সন্ধ্যা, এখন রাতের কালো রাজত্ব। ছাপরার অন্ধকার বেশ গাঢ়। আলো জ্বালেনি ছলেমান – ইচ্ছা করে না। ক্ষান্তি দিয়ে মোমেনার লম্বা শ্বাস শুনে মনে মনে বিপদ গোনে সে, এই বুঝি বউটা ঠেসবাক্যে তাকে আউলা করে দেয়। বাঁচোয়া, অমন কিছু হয়নি। এই ভালো, নিকষ অন্ধকারে যেন চারটা জন্তু ডুবে আছে, কারো মুখ কেউ দেখছে না। বেলা থাকতে থাকতে খাওয়ার পাট তো চুকেছে, ফাঁকিঝুঁকি ওই এক খাওয়ায় কালকের বেলা অবধি গিয়ে ঠেকলে হয়। পেট দমনে রাখার অভ্যাস আয়ত্তে আছে। ছেলে দুটো কী পাজি, বুঝি একদিনেই ঢাকার বাতাস গায়ে মেখেছে, কী তাদের মাথা ভাঙাভাঙি, রুটি-আলুভাজি খাবে না। জবান বন্ধ রাখলে কী, মুখ দেখে সাফ বোঝা যায়। বউটাও ছেলেদের দলে। ভাবখানা : ঢাকায় স্বামীর কাছে আসা মানে বহুদিনের জমানো খিদের বিরুদ্ধে স্বাদের খানা খেয়ে বাসনা পূরণ করা। তাবাদে, খরচার ভাবনা কী, দিলদরিয়া সাহেব তার হাত উপুড় করে ধরে আছেন – তাহলে? উহ্, কেন যে কালরাতে ঠোঁটে তুফান তুলে সে চালবাজি করতে গেল! এর চেয়ে ঝপ করে মরে গেলে ল্যাঠা শেষ। চুরমার ভাবনায় ফের মরণ ফিরে এলে ধ্বংসের দেরি নিয়ে তার হতাশা বেড়ে যায়। – তাহলে দাঁড়ালো কী, মরা আর বুঝি হলো না। গরিব-গুরবো, কাঙাল-ফকির মোমিন হলেও তাদের ইচ্ছা চাওয়া-পাওয়ায় – মোনাজাত কিছুই কবুল হচ্ছে না। অথচ, দুষ্টু-ঠক-মুনাফেক সব শয়তান-বিটলে মোটাতাজা হয়ে গালের পর গাল তুলে উৎপাতশূন্য শান্তিতে আছে, দৌলতের গরমে তাদের পাকা বাড়ির দরজা জানালা-ছাদ পর্যন্ত ভেংচি দেয়। কী তাচ্ছিল্য, ধ্বংস নিয়ে সামান্য মাত্র তাদের পরোয়া নেই। কিন্তু ধ্বংসের দিনক্ষণ নিয়ে এতো ময়-মুরুবিব, আলেম-উলেমা, আখেরাত বিশ্বাসীরা বলাবলি করলেন, সারা জাহান আর থাকছে না, তাদের অমন হিসাবে কি কোনো গরমিল ভুলচুক হয়েছে? অন্ধকারে ছলেমানের খোল অকেজো মাথা যখন কিছুতেই বাঁচা-মরার ঠেলাঠেলি বুঝে উঠতে পারছে না, ঠিক তখনি দুইজন অস্পষ্ট ষন্ডা আজরাইল যেন মাটি ফুঁড়ে সামনে খাড়া হয়, পেছনে আরো পেটাই শক্ত চোয়ালের ছায়া। ভয়ংকর কঠোর লাথি পড়ে পুরনো টিনের পুরো ছাপরাটা ঝনঝন বেজে ওঠে। খোলামকুচি ছাপরাটা কি উড়ে গেল? গুঙিয়ে ওঠে বউ-বাচ্চা। গেল, দুনিয়ার হায়াত বুঝি গেল, মেয়াদ শেষ। ছলেমান ছাপরার খোলা মাটিতে টানটান শুয়ে যায়। ওপরের আসমান-চাঁদ-তারা-এই নড়বড়ে ছাউনি একত্র হয়ে তাদের উপর ভেঙে পড়ুক। ভাংচুরের ওই চাপে সবাই মাটির তলে চলে যাক – শেষ বিশ্রাম। দিনে-দুপুরে ধ্বংসের ভয়াবহ অবস্থা সচক্ষে বান্দাদের দেখাবে না বলে আল্লাহ নিশ্চিত রাত বেছে নিয়েছেন। ধ্বংসের আরম্ভ মালুম করার আগেই ছলেমান টের পায় আজরাইল তার ডানা ধরে তাকে ছাপরার বাইরে ছুড়ে ফেলেছে। পেছনে পেছনে মোমেনা, পিরু-সিরু উড়ে এসে বুকের খাঁচা ভাঙা কান্না শুরু করেছে। তার পাছার দুই অাঁটির হাড্ডি কি আস্ত আছে? সেঁতলাপড়া ইটের পাঁজার ওপর পড়ে সে কেন উঠতে পারছে না? ভীষণ ব্যথার চিক্কুর দ্রুত খুলির মধ্যে পৌঁছে গেছে। এক আজরাইল মউজের আনন্দে ম্যাচকাঠি জ্বেলে সিগারেট ধরায়। ওই আলোয় দেখা গেল, পাহাড় চেহারার এক কাল্লু ছুরিস্বর টেনে যাচ্ছে – ‘চোপ, চিল্লাইবি তো শ্যাষ। কাইট্টা-ছিল্লা, বুঝছোস -। অক্ষণ ছাপরায় মজমা হইবে।’ মানুষ চরানো অভ্যস্ত হাত নেড়ে আজরাইলটা সামনে থেকে মুছে যেতে যেতে সোল্লাস কণ্ঠ নিয়ে ফের চড়াও হয় – ‘ওস্তাদ, মাল তো আছিলোই, খামোকা ভাড়া করছি ক্যান?’ টিপেটুপে শক্ত মোটা আঙুল মোমেনার ঢ্যাঙ্গা শরীর ত্যাজ্য করে যায় – ‘ধুর, হুধাই হাড্ডি। ছিনার চাপেই খাঁচা-উচা গুঁড়া।’ এবার অন্ধকারের আড়াল থেকে ওস্তাদের ভারিক্কি কণ্ঠে রুক্ষ নির্দেশ ছুটে আসে – ‘গ্যানজাম করোস না। কামে আইছি, কাম ফিনিশ আগে। দিইনকাল ভালা না। হনুফা কই?’ মোটা বপু এক নারীর হাত টেনে ওই ইজ্জতয়ালা ওস্তাদ তার বাহাদুর পায়ে ছাপরায় ঢুকে যায়। ছলেমান এখনো পড়ে চরম ব্যথার সঙ্গে জমে আছে। পৃথিবী কি ভাঙতে ভাঙতে সামনে আসছে? মাখলুকাত যদি নাই ভাঙে সে ভাঙলো কেমনে। মোমেনা দলামোচা হয়ে তার পাশে, হাড় নেই, আকার-প্রকার নেই। খুব চাপবাঁধা অন্ধকারে থ্যাঁতলানো পোকা ছেলে দুটো এখনো হাউমাউ কাঁদছে। বাপ-মার সঙ্গে মরার জন্য তারা বুঝি প্রস্ত্তত।