সাক্ষাৎকারে ভি এস নাইপল

অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী

লিটারেরি রিভিউর ২০০৬ সালের সাক্ষাৎকার

লন্ডনের লিটারেরি রিভিউতে নেওয়া সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ ভাষান্তরিত। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ফাররুখ ধোনী।

 

ভিএস নাইপলের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। ভারতীয় চিকিৎসক ও চিকিৎসা তাঁর কাছে ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের চেয়ে স্বস্তিকর মনে হওয়ায় চিকিৎসা ও সেরে ওঠার জন্য কয়েক মাস তিনি দিল্লিতে থেকে যান। তারপর লন্ডনে ফিরে আসেন এবং আবার লিখতে শুরু করেনে।

আমি তাঁর উইন্টশায়ার কটেজে আসি এবং দুদিন সময় নিয়ে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করি।

তিনি বললেন, তিনি আমাকে পছন্দ করেছেন কারণ সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য আমি তাঁর পদ্ধতিই অনুসরণ করি – সাক্ষাৎকারদাতা যা বলে যান আমি তার হাতে লেখা লম্বা নোট নিই। তিনি টেপ-রেকর্ডারকে বিশ্বাস করেন না। আমিও না। তাই আমি পকেট সাইজের দুটো

টেপ-রেকর্ডার নিয়ে এসেছি এবং অনধিকার চর্চা করে দেখার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম ডাইনিং টেবিলের এমন একটা জায়গায় রেখেছি, তার আগে নিশ্চিত করেছি যে ব্যাটারিগুলো নতুন। বিড়াল অগাস্টাস কিছুক্ষণ পরপর জানালার চৌকাঠের সামনে আসছে এবং ভেতরে আসতে চাইছে। তার ধৃষ্টতা সাধারণ বিড়ালের চেয়ে বেশি এবং বিদ্যাধরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পীড়াপীড়ি করে। তিনিও তাকে শুয়ে পড়ার হুকুম জারি করার পথটি জানেন। অবাক করে দিয়ে অগাস্টাস বিদ্যাধরের হুকুম তামিল করে এবং আমাদের পায়ের কাছে কু-লী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে।

লিটারেরি রিভিউর জন্য এটা আমার দ্বিতীয় বর্ধিত সাক্ষাৎকার। ২০০১-এর আগস্টে প্রকাশিত প্রথমটি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ই এম ফর্স্টার, জন ম্যানার্ড কিনস এবং জেমস জয়েসের ওপর তাঁর মন্তব্যকে প্ররোচনামূলক মনে করা হয়েছে। আমরা যখন শুরু করি, আমি আমরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকব, তিনি সম্মত হন।

ফাররুখ ধোনী : একজন লেখকের লেখক-জীবন ও সাফল্যে ভাগ্যের কোনো ভূমিকা আছে বলে কি আপনি মনে করেন?

বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল : আমি অনেক বিষয় নিয়ে অনেক পরিশ্রম করেছি। ভাগ্য এসেছে গোড়ায়, যখন আমি শুরু করার চেষ্টা চালাচ্ছি। সেদিন ল্যাঙ্গহাম হোটেলে বিবিসি ভবনে কাজ করছি, পোর্ট অব স্পেনের যে-রাস্তায় আমি বেড়ে উঠেছি, হঠাৎ যদি সে-রাস্তার কাহিনি লেখার কথা মনে না হতো তাহলে হয়তো আরো অনেক বছর আমাকে কী লিখব তা নিয়ে হাতড়ে বেড়াতে হতো। বিবিসির সেই রুমে ফ্রিল্যান্সাররা যদি উৎসাহিত না করতেন তাহলে হয়তো আমার শুরুটাই কখনো হতো না।

আমি বেশ অনুভব করেছি, কাজটা আমি আমার নিজের মতো করে করছি – ব্যাপারটা খুব সহজ ছিল না। আমি যে-বইটা, মিগেল স্ট্রিট, লিখছিলাম পরের চার বছরেও তা প্রকাশিত হয়নি। সেকালে লেখালেখি নিয়ে ইংল্যান্ডের ধারণা ভিন্ন ছিল –  আমি যা করছিলাম তা থেকে ভিন্ন।

ধোনী : আপনি কি বলছেন যে, ইংরেজি সাহিত্যের ঐতিহ্যের বাইরে আপনি লেখালেখি করছিলেন?

নাইপল : সেটা লিভিস (ফ্রাঙ্ক র‌্যায়মন্ড লিভিস তখন ক্যামব্রিজের তথা ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাহিত্য-সমালোচক) এবং ক্যামব্রিজ ঘরানার – এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ    কথাটি হচ্ছে – আমি কী কাজ করছি ইংল্যান্ড বুঝতে পারেনি। এটা যদি আমার নিজের ভূমি হতো তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। কিন্তু আমার কোনো দেশ নেই। আমি যে-কাজ করেছি ইংল্যান্ড তার প্রশংসা করেনি, স্বীকৃতিও দেয়নি। আমার কাজ ছিল একটি পাঠকগোষ্ঠী গড়ে তোলা। আমার বেলায় এটা ছিল ধীরগতির – খুব ধীরগতির।

ধোনী : আপনি যে নিজস্ব পাঠকের জগৎ উন্মোচন করার চেষ্টা করছেন এ-সম্পর্কে নিজে কি সচেতন ছিলেন?

নাইপল : আমি সবসময়ই অতি ক্ষুদ্র একটি পাঠকগোষ্ঠীর জন্য লিখেছি : আমার স্ত্রী (প্যাট্রিসিয়া, এখন নাদিরা), বিবিসিতে আমার চেনা কেউ, আমার প্রকাশক, আমার প্রকাশক ডয়েসের সম্পাদক।

ধোনী : মুসলিম বিশ্বভ্রমণ শেষে লেখা আপনার বই অ্যামাং দ্য বিলিভার্স নিশ্চয়ই বৈশ্বিক পাঠকের জন্য লিখিত?

নাইপল : যেহেতু লেখালেখি হচ্ছে শেখার একটি প্রক্রিয়া, সেই বইটি লেখাও আমার জন্য একটি প্রক্রিয়া। প্রকাশিত হওয়ার পর বইটি পাঠক পেয়েছে। হার্ভার্ড ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) মতো জায়গায় এই বই নিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে। এসব জায়গায় কিছু জ্ঞানী লোক আছেন, যাঁরা তাদের প্রাজ্ঞতা দিয়েই জানতে পারেন, কী ঘটছে দেখার জন্য তাঁদের যেতে হয় না। যা জানার তা এর মধ্যেই তাঁরা জেনে গেছেন। অবশ্য আমি এটা খুব জোর দিয়ে বলছি না যে, যা কিছু আমি আবিষ্কার করেছি এবং লিখেছি সবই আমার জন্য। দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে এমআইটিতে যাওয়ার কারণ বইটির ওপর কথা বলার জন্য তাঁরা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, আমার মনে হয়েছে তাঁরা ইরান নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। আমার মনে আছে রক্তের জন্য ইরানিদের ভালোবাসার কথা আমি বলেছি। একটি ধর্মীয় বিক্ষোভে একজন মানুষ যখন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল, লোকজন তার ক্ষত ও রক্তে হাত ও কাপড় ডুবিয়ে রক্তে ভেজাচ্ছিল। আমি এমআইটিতে যাদের সঙ্গে ছিলাম তারা এটি বিশ্বাস করতে অস্বীকার করল। এমন কিছু ঘটতে পারে না; ওহ্ ঈশ্বর! তারা কত জ্ঞানী। একটি আমেরিকান পত্রিকা তিন খ-ে আমার বইটি ছাপতে যাচ্ছিল; কিন্তু তা বাতিল করে দিলো।

ধোনী : কেন?

নাইপল : সেখানকার জ্ঞানী লোকজন তাদের বলে থাকতে পারে এটা প্রকাশ করা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কুড়ি বছর পর মনে হতে পারে, অপেক্ষমাণ পৃথিবীকে যদি এই ভাবনাটা দেওয়া যেত … কিন্তু তখনো তাদের কঠিন সময় যাচ্ছিল।

এমনকি আমার প্রথম বই মিগেল স্ট্রিট­-এ আমি নিরীক্ষামূলক কাজ করেছি; আমি চেয়েছি এটা খুব সহজ হোক, নতুন হোক, দৃশ্যগুলো যেন ভেসে ওঠে। প্রতিটি বাক্যে তা-ই করেছি।

ধোনী : আপনি যখন এগোতে থাকলেন, আপনার লেখার অভিজ্ঞতাও কি বদলে গেল?

নাইপল : আমি যখন লিখতে থাকি লেখার ‘আইডিয়া’ গড়ে ওঠে। আমার একমাত্র আইডিয়া হচ্ছে লেখাটা নন-ফিকশন হলে এটা সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। আমি যাদের নিয়ে লিখছি তারা এর ভেতর সত্যটা দেখতে পাবে। আমরা যে-বইটি নিয়ে কথা বলছিলাম অ্যামাং দ্য বিলিভার্স প্রকাশিত হওয়ার পর আমি ইরান থেকে চিঠি পেয়েছি যে, আমি মূল বিষয়টি ধরতে পারিনি। আমি তেহরানে গাড়ি চালানোর কথা লিখেছিলাম – এটা ভয়ংকর ও আশঙ্কাজনক অভিজ্ঞতা। আমি যে-গাড়িতে ছিলাম প্রত্যেক জায়গা থেকে অন্য গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে সে-গাড়ির কিছু রং তুলে এনেছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রোতাদের সামনে যখন বইয়ের অংশবিশেষ পড়ি, তাদেরও একইরকম প্রতিক্রিয়া – সত্য কথা লেখা ‘ঔপনিবেশিক’ মানসিকতাজাত।

ধোনী : আপনি কি মনে করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আপনি গোঁড়া কিংবা বোকাটে ধরনের লোকের দেখা পেয়েছেন? নাকি জ্ঞানী?

নাইপল : আমি সেরকম কিছু মনে করছি না। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শীর্ষ অতিক্রম করে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-ধারণা তা শেষ হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘসময় ধরে ‘ঐশ্বরিক’ উৎপাদন করেছে। তারপর অক্সফোর্ড একটা বাঁক নিল এবং চটপটে মানুষ তৈরি করতে শুরু করল। শেখার ধারণা এসেছে বেশ পরে, সম্ভবত উনবিংশ শতকে – কোনোভাবে বিংশ শতক পর্যন্ত এসেছে। এখন মনে হচ্ছে বিজ্ঞানের বিষয় ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। সমাজতন্ত্রীরাও সবাইকে এখানে পাঠাতে চায়। আমি মনে করি, এসব জায়গা গুটিয়ে ফেলা উচিত এবং চাইলে সার্টিফিকেট কিনতে মানুষ পোস্ট অফিসেই যেতে পারে।

ধোনী : নিশ্চয়ই বিজ্ঞান বিষয়ের সার্টিফিকেটও নয়।

নাইপল : না ওগুলো থাকতে হবে। মানবিক বিভাগ – ‘হিউম্যানিটিজ’ – আমার মনে হয় অর্থহীন বিষয়।

ধোনী : আপনি বলেছেন যখন লিখতে থাকেন, লেখার আইডিয়াটাও গড়ে উঠতে থাকে। অতীতে আপনি একটি সংস্কৃতিতে লেখালেখির ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন এবং লিখেছেন। যেমন রাশিয়া …

নাইপল : এবং ফ্রান্স। এই আইডিয়া নিজেরাই নিজেদের গড়ে তুলেছে। শুরুতে আমার কাছে আসেনি। আমি বেশ অজ্ঞ ছিলাম। আমি যখন মোপাসাঁ পড়তে শুরু করি আমি পুরোপুরিভাবে তাকে মূল্যায়ন করতে পারিনি। একটি সংস্কৃতি এবং সেই সংস্কৃতির একজন লেখককে দেখার আগে কিছু প্রাজ্ঞতা, কিছু অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। আপনি যদি পঁচিশ বছর আগে আমার সাক্ষাৎকার নিতেন তাহলে আমি বলতাম বালজাক ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ফ্রেঞ্চ লেখক। এখন আমি বলি মোপাসাঁ – একজন সত্যিকারের বড় মানুষ। আমি বালজাক পড়তে শুরু করি এবং তাঁকে নিয়ে আমার কিছু সমস্যা হয়। আমি নিজেকে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। আমি মোপাসাঁর গল্প হাতে নিই। সবই গল্প – ১১০০ পৃষ্ঠা। গল্পগুলো লেখার কাল অনুযায়ী সাজানো এবং অনুবাদও চমৎকার। এটা আমার জন্য শিক্ষা।

শুরুতে তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লিখতেন, একটি ভুল পদক্ষেপও যেন না হয় খেয়াল রাখতেন। মাঝখানে এসে তিনি আরো বেশি নিরাপদ ও নিশ্চিত হলেন। তিনি সহজাতভাবে ভালো  কাজ করেছেন, শেষদিকে তাঁর মৃত্যুচিন্তা এসে যায়, তাঁর লেখাগুলো  সংক্ষিপ্ত এবং খুবই মেকি হয়ে আসে।

শেখভের নাটকে একটি চরিত্র আছে যে মোপাসাঁ সম্পর্কে কথা বলে; এবং বলে তাঁর মেধা অতিপ্রাকৃতিক। আমি তাঁর সঙ্গে একমত হই কারণ তাঁর প্রায় সব গল্পেই একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন তিনি দেখিয়েছেন। আর তাঁর গল্পের সংখ্যা কত! বিস্মিত হতে হয়, এত গল্পের উপাদান তিনি পেলেন কোথায় – প্রতিটি গল্পই মনে হয়েছে কেমন স্বাভাবিক ও সহজ।

আপনি যখন গল্পটা পড়েন, তা বিশ্লেষণ করতে পারেন, তাঁর গল্পের পদ্ধতিটি বুঝতে পারেন। তিনি সবসময়ই তাঁর গল্পের মানুষকে একটি চরিত্র দেন – সেটা খুব জরুরি। তাঁর এখানে একটি আবেগরেখা থাকে, তাঁর লেখার সঙ্গে সঙ্গে আবেগের

হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, পাঠক গল্পের মামুলি বর্ণনা কেমন করে শেষ হয়ে এলো তা অনুসরণ না করে লেখকের আবেগকে অনুসরণ করেন। আমি মনে করি মোপাসাঁর মতো আর কেউ নেই।

তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনের নির্মমতা রয়েছে। তাঁর বয়স যখন তিরিশের ঘরে তিনি লিখতে শুরু করেন, তারপর দশ বছরেই সব প্রায় শেষ হয়ে যায়। তিনি যন্ত্রণায় ছিলেন, তারপর পাগল হয়ে যান, কাজেই যা কিছু করার তিনি দশ বছরেই করেছেন। তাঁকে অবশ্য সারাক্ষণই লিখতে হয়েছে, তাও কত সহজভাবে লিখে গেছেন। এটি অতিপ্রাকৃতিক মেধা। তাঁর গল্প পড়তে পড়তে আপনি নিজেকে জিজ্ঞেস করেন কোন সেই দেশ, যে-দেশ তাঁকে লেখায় বিস্ময়কর এত উপাদান দিয়েছে; তারপর কিছু সময় পর আপনি বুঝতে পারেন কোনো দেশ তাঁকে এসব উপাদান দেয়নি। তাঁর দেখার শক্তি দিয়ে তিনি দেশ সৃষ্টি করছেন। অদ্ভুত ব্যাপার। আমরা যখন স্কুলে মোপাসাঁ পড়ি, আমরা বড্ড প্রাদেশিক হয়ে পড়ি – ফ্রেঞ্চ! এটা এখনো সত্য, কিন্তু তাঁর কাজ সবার জন্য।

ইংরেজি ভাষার লেখকদের নিয়ে এমন কথা বলা যায় না। (আমরা চার্লস ডিকেন্সকে আলোচনার বাইরে রাখতে পারি)। ইংরেজি ভাষায় লেখা স্পষ্টতই ইংল্যান্ডের জন্য, ইংল্যান্ডের মানুষের জন্য, খুব বেশি দূরে যাওয়ার জন্য নয়।

ধোনী : কোন কোন লেখক বিশেষ করে এই ইংরেজিপনা – ‘ইংলিশনেসে’র কাতারে পড়বে বলে আপনি মনে করেন?

নাইপল : (টমাস) হার্ডি। একজন অসহ্য লেখক।

ধোনী : কেন?

নাইপল : তিনি লিখতে জানেন না; একটা প্যারাগ্রাফ কীভাবে তৈরি করতে হয় তিনি জানেন না। আমি বলব রোমান্টিক মেয়েলি কাহিনির এরকম বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

ধোনী : এমনকি বড় লেখকরাও – জেইন অস্টিন?

নাইপল : জেইন অস্টিন নিয়ে আমার কী সমস্যা? যারা ইংরেজি কেতায় শিক্ষিত হতে চান জেইন অস্টিন তাদের জন্য। এটা যদি আপনার লক্ষ্য না হয়, তাঁর বই দিয়ে আপনি কী করবেন, তাও আপনার জানা নেই।

কবছর আগে বাথে একটি সম্মেলন হয়েছিল, আমাকে দাওয়াত করা হয়েছে। আমি বাজে ধরনের কনফারেন্স অতিথি। আমি একটি কথাও বলিনি। তাঁরা আমাকে বাথের প্রেক্ষাপটে লেখা জেইন অস্টিনের নর্থহ্যাঙ্গার অ্যাবে উপন্যাসটি দেন। সাম্প্রতিক অসুস্থতার পর থেকে আগে আমার যেসব বই পড়া হয়নি, সেগুলো তুলে নিচ্ছি। কাজেই বইটা নিলাম। বইটার অর্ধেক পর্যন্ত আমার মতো একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ, এই ভয়ংকর নীরস নারীর তথাকথিত প্রেমের জীবন – একজনের সঙ্গে একবার দেখা হওয়ার পরই তিনি বলছেন প্রেম – আমি এ-জিনিস নিয়ে কী করব? এটা আমার জন্য নয় – রাস্তার কারো পড়ার জন্য হতে পারে, আমার নয়।

ধোনী : জেইন অস্টিনকে নিয়ে এত কথা – আপনি কি তাতে বিস্মিত হলেন?

নাইপল : হ্যাঁ, এটা নির্ভর করে পৃথিবীর রাজনৈতিক শক্তির ওপর। আপনি যদি ইংল্যান্ডের হয়ে থাকেন, আপনার কাছে দেশ যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে এ-ধরনের বাজে অর্থহীন লেখা আপনার কাছে গুরুত্ব পাবে। উনবিংশ শতকে যদি দেশটির পতন ঘটত, তাহলে কেউ জেইন অস্টিন পড়ত না। বইগুলো হতো ব্যর্থতা নিয়ে। লেখকরা ব্যর্থতার কারণ প্রদর্শন করতেন।

আমি জেইন অস্টিন নিয়ে যা বলছি আর জ্ঞানী লোকেরা তাঁকে নিয়ে যা বলছেন, আমি তা গুলিয়ে ফেলতে চাই না। বিভিন্ন জ্ঞানবান স্থানের অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষেরা বলছেন জেইন অস্টিন একটি বড় ধরনের ভ্লাদিমির প্রতিনিধিত্ব করেন। যেখানে ক্যারিবিয়ান ফসলের ক্ষেতে ক্রীতদাসরা পরিশ্রম করে যাচ্ছে, সেখানে তরুণদের হৃদয়ের ব্যাপার নিয়ে মজে থাকা ভ্লামিই তো। কী ভ্লমি! জ্ঞানীরা এমনই বলে থাকেন। এটা বোকামি কারণ তাঁরা যদি তাঁদের নিজের বিষয়ের বাইরের কিছু বিষয় নিয়ে জানতেন, বুঝতেন ১৮০৭ সালে ক্রীতদাস ব্যবসা – ব্রিটিশ ক্রীতদাস ব্যবসা নিষিদ্ধ হয় আর এসবের যৌক্তিকতা সংবেদনশীলতা – এসব নিয়ে আলোচনা ১৮৩৪ সালে ক্রীতদাস প্রথা অবলুপ্ত করার পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজে লেগেছে। পরিশুদ্ধকরণ আচরণ এসবের ধারণা হচ্ছে অবলুপ্তির পরিবেশ।

ধোনী : তাহলে জেইন অস্টিনের কিছু প্রভাব আছে?

নাইপল : তাঁর কোনো প্রভাব নেই, তিনি ছিলেন এর অংশ। তিনি নিজেই এর প্রতিফলন। প্রাচীন রোমানদের সঙ্গে যদি এর তুলনা করি – তাঁরা ভালো জীবনের কথা বলেছেন আবার নিজেদের চারপাশে সবচেয়ে নির্মম দাসপ্রথাকেও উৎসাহিত করেছেন। তাঁদের চারপাশে যে-জীবন সে-জীবন নিয়ে তাঁরা কখনো প্রশ্ন করেননি। ক্রীতদাসদের সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং অ্যারেনায় তাদের ভয়াবহ মৃত্যু হচ্ছে, এ নিয়ে সিসেরো কৌতুক করেছেন। দিনের বিভিন্ন সময়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের নির্মমতা নির্ধারিত ছিল। অপরাধীকে নিরস্ত্র অবস্থায় সশস্ত্র ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পাঠানো হতো। অসমতার এই লড়াই তো আর সত্যিকারের লড়াই নয়, তবু তা জনতার মধ্যে এক ধরনের সরল উত্তেজনা জাগাত। সেনেকাই বলেছেন, তোমাদের মনে রাখতে হবে ক্রীতদাসও মানুষ। তিনি এর বেশি এগোননি। রোমান দাসত্ব ছিল অত্যন্ত পাশবিক।

ইংল্যান্ড দাসত্ব বিলোপকারী প্রথম দেশ। এটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। জেইন অস্টিনের উপন্যাস পড়ার দরকার নেই, তবে এটা মনে রাখতে হবে, যে আচরণ ও সংবেদনশীলতার কথা তিনি লিখেছেন, যে-শিক্ষা দাসত্বের বিলুপ্তি ঘটিয়েছে, এটা তারই অংশ।

ধোনী : ইংরেজ লেখকদের মূল্যায়নের সময় আপনি চার্লস ডিকেন্সকে ছাড় দিচ্ছেন কেন?

নাইপল : আমি কিছুদিন আগে তাঁর প্রথমদিককার লেখা

কিছু প্রবন্ধ পড়েছি। স্কেচেস বাই দ্য বজ খুবই ভালো। কিন্তু ডিকেন্সের লেখায় এত বেশি বাজে জিনিস। কেবল শব্দের জারিজুরি – বড্ড বেশি শব্দ, শুধু পুনরাবৃত্তি। তিনি কিছু একটা করতে চেষ্টা করছিলেন, দোহাই ঈশ্বরের আফ্রিকানদের কখনো জঘন্য শত্রু ছিল না। তাঁর একটি প্রবন্ধে …

ধোনী : কোন প্রবন্ধ?

নাইপল : আমি স্মরণ করতে পারছি না। যদি তারা দাসত্ব অবলুপ্ত না করত জ্ঞানী লোকেরা যে কত কথা বলত। ডিকেন্স কালো মানুষদের ঘৃণা করতেন। অদ্ভুত তাই না?

ধোনী : আপনি কি একইভাবে বিংশ শতকের ব্রিটিশ লেখকদের বিচার করেন?

নাইপল : এটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এটা (এভলিন) ওয়াফের বেলায় সত্য। আন্তর্জাতিক পাঠক লাভের বিষয়টি খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এইচজি ওয়েলস যখন তাঁর প্রথমদিককার গল্পগুলো লিখছেন তিনি বাইরের মানুষের জন্য লেখেননি। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বহু চর্বিতচর্বণ গ্রহণ করে গল্পগুলো লিখেছেন, যদিও তিনি একজন ভালো লেখক। আশির দশক থেকে লেখা গল্পগুলোতে রয়েছে আফ্রিকান ভুডু – প্রেতধার্মিক, ভারতীয় যাজক ইত্যাদি। তিনি দেশের বাইরে যাচ্ছেন না, যেসব আইডিয়া তিনি গ্রহণ করছেন তা লেখায় কাজে লাগাচ্ছেন।

যদিও কোনো ফিকশন লেখেননি (বার্ট্রান্ড) রাসেল ছিলেন বৈশ্বিক। তিনি খুব সাধারণভাবে, স্পষ্টভাবে দার্শনিকী ভাবনা ব্যাখ্যা করেছেন।

ধোনী : ভারতে যাঁরা ইংরেজি বলেন তাঁদের মধ্যে রাসেলের বড় পাঠকগোষ্ঠী রয়েছে। যেমন হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি।

নাইপল : হ্যাঁ, তবে সবাইকে বিশ্বের জন্য লিখতে হবে এমন নয়, তাঁরা অবশ্যই নিজেদের জন্য লিখবেন, তাঁদের বন্ধুদের জন্য লিখবেন।

ধোনী : কিন্তু তাতে কি বইয়ের গুরুত্ব অস্বীকার করা হয় না?

নাইপল : না। উত্তম যুগে লেখকরা নিজেদের জন্য যা লিখেছেন তা-ই মানুষের কাছে চলে এসেছে। বইয়ের এই সফরের ব্যাপারটি ঘটার কারণ, পৃথিবী এতটাই প্রতিবন্ধী যে দেখার মতো তার নিজের সামান্যই আছে। আমি এটা বলছি না বাইরের পৃথিবীর জন্য মানুষের বার্তা নিয়ে যাচ্ছে। বইয়ে যে-ধরনের কৌতূহল সঞ্চার করা হয়েছে স্বাভাবিকভাবে তা অন্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।

আমেরিকান লেখার কথাই ধরুন। মার্ক টোয়াইন হচ্ছেন বৈশ্বিক, যে কেউ তাঁর বই পড়তে পারেন এবং তাতে তাঁদের আগ্রহের বিষয় পেতে পারেন, কিন্তু আমেরিকার জন্য ফিটজেরাল্ড হচ্ছেন লোকাল – স্থানীয়। মার্ক টোয়াইনের লেখায় আমরা হিউমার পাই – এতে এমন এক স্বর রয়েছে যা সব মানুষের সঙ্গে কথা বলে; তারপর বস্তুর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, বস্তুর গুরুত্ব নিয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত হননি।

দেখবেন এখনকার ভারতীয় লেখকরা তাঁদের বস্তুগত অর্জন নিয়ে উচ্ছ্বসিত। তাঁরা ড্যাডি, মাম্মি, চাচা, চাচি এসব নিয়ে লিখছেন, তাঁদের অর্জিত বস্তুর জন্য আনন্দিত হচ্ছেন। ভারতীয় বইয়ের   বেচারা সমালোচকরা হয়তো এই উপসংহারে আসতে পারেন : ‘হাঁ, ঈশ্বর! এক্স, ওয়াই, জেড এত বড় ভারতীয় পরিবার থেকে এসেছেন, আমরা জানতামই না।’

ধোনী : ভারতীয় লেখকদের বইয়ে আমরা শুধু এসবই পাই না।

নাইপল : আপনাকে ওই ভয়ংকর আমেরিকান হেনরি জেমসের দিকে তাকাতে হবে। আসলে পৃথিবীতে তিনি সবচেয়ে বাজে লেখক। তিনি কখনো নিজের ত্রিসীমানার বাইরে যাননি। হ্যাঁ, তিনি ইউরোপে এসেছেন, কিন্তু এখানে এসে ‘লেখকের জীবন’ যাপন করেছেন। তিনি কোনোকিছুর ঝুঁকি নেননি। তিনি নিজেকে কোনো ঝুঁকির সামনে দাঁড়াতে দেননি। তিনি ভদ্রলোক হিসেবে সফর করেছেন। আমেরিকান ম্যাগাজিনের জন্য যখন তিনি ইংলিশ আওয়ার্স লিখলেন, তিনি দূর থেকে এপসম (সারের একটি ছোট শহর) ঘোড়দৌড় নিয়ে লেখেন। তিনি কখনো ভাবেননি জনতার সঙ্গে মিশবেন, তারা কেন সেখানে এসেছে, কী তাদের আচরণ তা জানবেন। গাড়ির ওপরে থেকে কিংবা ট্যুরিস্ট কোচের ওপরতলায় বসে তিনি এ-কাজটি করবেন। তাঁর অনেক লেখা এরকমই। তাঁর লেখায় বস্তুর জয়গান, তিনি মনে করেন এ-বিষয়ের ওপর লেখার জন্যই তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন, ইউরোপের জাঁকজমক এবং আমেরিকার নতুন টাকার চাকচিক্য কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। অনেক বছর আগে এলিজাবেথ হার্ডউইক (১৯১৬-২০০৭; সাহিত্য-সমালোচক) আমাকে বলেছেন, কী হচ্ছে? হেনরি জেমস যাদের সঙ্গে কথা বলছেন সবাই আমেরিকান। আর এর ফলে আমেরিকান তরুণরা ভাবছে তারা ইউরোপ দেখতে বেরোবে এবং তাঁর মতো ‘একটা হেনরি জেমস’ লিখে ফেলবে।

ধোনী : আপনি নিশ্চয়ই হেমিংওয়ে সম্পর্কে এ-কথা বলতে পারেন না, তরুণ আমেরিকানরা তাঁকেও অনুসরণ করার চেষ্টা করে। তিনি তো জনগণের সঙ্গে মেশেন।

নাইপল : হেমিংওয়ে কোথায় ছিলেন তিনি নিজেও জানতেন না। তিনি আমেরিকান হওয়া নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন আর তাঁর বিষয়ও তেমনই। আপনি হেমিংওয়ে কিংবা ফিটজেরাল্ডের গল্প কিংবা অন্য কোনো রচনা, কিংবা প্যারিস নিয়ে লেখা কোনো কিছু থেকে

এ-ধারণাই পাবেন না – দুই যুদ্ধের মাঝখানের সময়টাকে প্যারিসকে কী কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাঁরা কেবল কাফে, পানীয়, শামুক ঝিনুক এসব নিয়ে লিখেছেন। বাইরের বৃহত্তর পরিসরকে তাঁরা দেখেন না। এ-ধরনের লেখা পড়তে এবং এগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে আমার অসুবিধা হয়। এসব আমার জন্য নয়, রাস্তার অন্য মানুষের জন্য।

তাঁরা ‘গে প্যারিস’ কিংবা এ-ধরনের বিষয় নিয়ে লিখেছেন। যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, মানুষের মৃত্যু – এসব নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাতে চাননি। এখন তো কেউ ফ্রান্স নিয়ে লেখার জন্য সেখানে যাচ্ছেন না। কারণ একটা জায়গার যখন সব ঠিকঠাক, যেমন এখনকার ফ্রান্স, লেখাটা কেমন হবে জানা কঠিন। যেখানে গিয়ে আপনি স্থানীয় জনগণের ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন, সেখানে লেখা সহজ। আপনি ভারতে যেতে পারেন, নেপালে যেতে পারেন। সেখানে অগণ্য জনতার ভিড়। এসব লোকের জন্য যারা ঠেলে আপনার বইয়ে উঠে আসার জন্য পথ করে নেবে তাদের জন্য ট্রাভেল এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রতি মাসে আমার কাছে অনেক বই আসে, তারা আপনার কাছে পাঠাবে না, কারণ আপনি তেমন করে ভারত নিয়ে বই লেখেননি।

 

জোনাথান রোসেন ও তরুণ তেজপালের নেওয়া  ১৯৯৮-এর প্যারিস রিভিউর সাক্ষাৎকার থেকে :

প্রশ্ন : আমি আপনার বইয়ের নাম অ্যা ওয়ে ইন দ্য ওয়ার্ল্ড শুনেই হতবাক। এটা আমাকে প্যারাডাইস লস্টের শেষাংশের কথা মনে করিয়ে দেয়। স্বর্গ থেকে বের করে দেওয়ার পর উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি। বাড়ি ছাড়ার পর আপনি যেখানে আসেন এটা সেই বিশ্ব?

নাইপল : আমার মনে হয়, আপনি কোথায় বাস করছেন তার ওপর এটা নির্ভর করে। আমি বুঝতে পারছি না এটা ন্যায্য কোনো প্রশ্ন কি না কিংবা আমি এর উত্তর দেবো কি না। আপনি বরং অন্যভাবে প্রশ্নটি করুন।

প্রশ্ন : আমার মনে হচ্ছে বিশ্ব বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন সেটাই জানতে চাচ্ছি।

নাইপল : মানুষ খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করতে পারে। তাই না? চিন্তাভাবনা ছাড়া কোথাও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। আমি মনে করি, আপনি যখন চিন্তা করেন তখন যেখানে প্রবেশ করেন সেটাই বিশ্ব – যখন আপনি শিক্ষিত হয়ে ওঠেন, যখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন – আপনি বিশাল বিশ্বে থাকতে পারেন এবং পুরোপুরি আঞ্চলিকও হতে পারেন।

প্রশ্ন : আপনি কি বৃহত্তর ভাবনার একটি বিশ্বে বেড়ে উঠেছেন? আপনার ‘বিশ্ব’ শব্দে যে ধারণা দিতে চেয়েছেন?

নাইপল : আমি সবসময়ই জানতাম বাইরে একটি বিশ্ব আছে। আমি সে-বিশ্বে বেড়ে উঠেছি – কৃষিভিত্তিক ঔপনিবেশিক সমাজ – আমি তা মেনে নিতে পারিনি। এত বিষণœ, এত সীমিত আপনি থাকতে পারেন না।

প্রশ্ন : অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করার জন্য আপনি ১৯৫০ সালে ত্রিনিদাদ ছেড়ে যান। আপনার উচ্চাশা চরিতার্থ করার জন্য সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অপরিচিত এক দেশে।

নাইপল : আমি খুব বিখ্যাত হতে চেয়েছিলাম। আমি একজন লেখকও হতে চেয়েছি, লেখার জন্য বিখ্যাত। আমার সেই উচ্চাশার অসম্ভব দিকটি ছিল – আমি কী লিখতে যাচ্ছি, সে-সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। বাস্তবে আমার অনেক আগে উচ্চাশাটি এসে যায়। চিত্রনির্মাতা শ্যাম বেনেগাল একবার আমাকে বলেছিলেন, তিনি ছ-বছর বয়স থেকে সিনেমা বানাতে চেয়েছেন – আমি লেখক হতে চেয়েছি দশ বছর বয়স থেকে। …

প্রশ্ন : সবকিছুর সমাধানের পথ হিসেবে লেখালেখিটাই কেন আপনার জীবনের মূল প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে?

নাইপল : জীবনের লক্ষ্য হিসেবে এটা আমাকে দেওয়া হয়েছে। বরং আমি আমার বাবার উদাহরণ দিই। তিনি একজন লেখক ছিলেন – একজন সাংবাদিক; তিনি গল্পও লিখতেন। আমার কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি এটাকে পেয়েছেন নির্দয় প্রেক্ষাপটে; তাঁর গল্প থেকে আমি বুঝতে পারি তাঁরটা ছিল খুব নির্দয় বিশ্ব। কাজেই আমি এই ভাবনা নিয়েই বেড়ে উঠি যে, সবসময়ই বাইরের শত্রুকে খোলাসা করার দরকার নেই, জরুরি হচ্ছে নিজের ভেতর দিকটাতে তাকানো। অবশ্যই আমাদের নিজেদের পরীক্ষা করতে হবে – আমাদের নিজেদের দুর্বলতাকে পরীক্ষা করতে হবে। এটা আমি এখনো বিশ্বাস করি।

প্রশ্ন : আপনি বলেছেন, লেখালেখি আপনি দেখছেন সত্যিকারের মহান আহ্বান হিসেবে।

নাইপল : হ্যাঁ, আমার জন্য এটা মহান আহ্বান। এটা মহান, কারণ সত্য নিয়ে এর কারবার। আপনার অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করতে আপনাকে পথ খুঁজতে হয়। আপনাকে তা বুঝতে হয়, বিশ্বকে বুঝতে হয়। লেখালেখি হচ্ছে গভীরতর উপলব্ধির নিরন্তÍর প্রচেষ্টা। এটা বেশ মহান কাজ।

প্রশ্ন : আপনি কখন লিখতে শুরু করেন?

নাইপল : ১৯৪৯-এ একটি উপন্যাসের কাজ শুরু করি। মজার একটি চিন্তার এটা বেশ প্রহসনমূলক লেখা – ত্রিনিদাদের একজন কালো মানুষ আফ্রিকার একজন রাজার নামে নিজের নাম রাখছেন। আমি এই ভাবনাটিরই অনুসন্ধান করছিলাম। এই লেখাটা টানতে টানতে দুবছর নিয়ে নিই, কারণ আমি এতটাই তরুণ ছিলাম যে, বেশি কিছু তখনো আমার জানা হয়নি। আমি বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর কদিন আগে লেখাটা শুরু করি, অক্সফোর্ডের একটা লম্বা ছুটির সময় শেষ হয়। আমি খুশি হই কারণ একটি বই শেষ করতে পারার যে-অভিজ্ঞতা তা আমি অর্জন করি। অবশ্যই এই বইয়ের কিছুই হয়নি।

আমি যখন অক্সফোর্ড ছেড়ে যাই সত্যিকারের আর্থিক টানাটানির মধ্যে পড়ে যাই – আমি খুবই সিরিয়াস কিছু একটা লিখতে শুরু করি। আমি আমার নিজের স্বর, নিজের সুর খুঁজতে থাকি – যা একান্তই আমার নিজের। কারো কাছ থেকে ধার করা নয়, কিংবা অভিনীত কিছু নয়। সিরিয়াস স্বর আমাকে নিয়ে গেল গভীর হতাশার দিকে। এটা আমাকে কিছুকাল টেনে রাখল, যতক্ষণ আমার পাঠানো পা-ুলিপি পড়ে একজন পরামর্শ দিলেন এসব ছেড়ে দাও। …

প্রশ্ন : এ-সময়ই কি আপনি মিগেল স্ট্রিট লিখতে শুরু করেন?

নাইপল : হ্যাঁ। কোনো কিছু নিয়ে সবার আগে কিছু লেখাটা খুব কঠিন কাজ। এরপর এটা অনুসরণ করা বেশ সহজ। আমি যে-বইটি লিখেছি তাতে রয়েছে আমার পর্যবেক্ষণ, লোককথা, সংবাদপত্রের ক্লিপিং এবং আমার স্মৃতির মিশ্রণ। এরকম অনেকেই করতে পারেন কিন্তু সে-সময় আমি যা করেছি ভেবেচিন্তে করতে হয়েছে।

একবার ভাবুন, ১৯৫৫ সালে মিগেল স্ট্রিটের মতো একটা বই লেখা হয়েছে। এখন তো মানুষ ভারতের এবং অন্য কোনো সাবেক উপনিবেশের লেখালেখি নিয়ে আগ্রহী, কিন্তু সে-সময় এগুলো লেখা বলে বিবেচিত হতো না। প্রকাশিত হওয়ার আগে চার বছর এই বইটি বহন করা আমার জন্য খুব কঠিন একটি কাজ ছিল। এতে আমি ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলাম এবং তা এখনো আমার ওপর কালো ছায়া ছড়িয়ে আছে।

প্রশ্ন : ১৯৫৫ সালে আপনি দুটি বই লিখেছেন। দ্য মিস্টিক ম্যাসিওর এবং মিগেল স্ট্রিট। প্রথম বইটি ১৯৫৭-র আগে এবং গল্পগুলো ১৯৫৯-এর আগে প্রকাশিত হয়নি।

নাইপল : আমার জীবন ছিল বেশ কঠিন। যখন আপনি তরুণ যখন আপনি নিঃস্ব, যখন আপনি আপনার উপস্থিতি পৃথিবীকে    জানাতে চান, তখন অপেক্ষার দুবছর অনেক লম্বা সময়। আমাকে সত্যিই অনেক ভুগতে হয়েছে। দ্য মিস্টিক ম্যাসিওর (এর বাংলা হতে পারে অতীন্দ্রিয় অঙ্গমর্দনকারী) শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে এবং আমার নিজের পত্রিকা (আমি তখন নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায় কাজ করি) বইটিকে নাকচ করে দেয়। অক্সফোর্ড থেকে পাশ করা পরবর্তীকালে বেশ খ্যাতিমান একজন এটাকে ঔপনিবেশিক দ্বীপ থেকে আসা কিঞ্চিৎ চাটনি বলে উড়িয়ে দিলেন – এতে কোনো শ্রমের স্বাক্ষর নেই।

সে-সময় বইয়ের আলোচকরা কোনগুলোকে সত্যিকারের বই বলতেন তা দেখাটা কৌতূহলের ব্যাপার। এখন এসব আমাকে বলা অর্থহীন। যাকগে, বইটা তো চল্লিশ বছর ধরে বাজারে আছে এবং এখনো ছাপা হচ্ছে। কিন্তু আমি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি উপেক্ষায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। এখন এ-ধরনের বই সহজেই প্রকাশিত হয় – এজন্যই অভিযোগ করেন। আমি কখনো অভিযোগ করিনি, আমি আমার মতো চালিয়ে গেছি।

প্রশ্ন : আপনি মূলত আত্মবিশ্বাসের বলে টিকে গেছেন?

নাইপল : এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। যখন আমি শিশু ছিলাম, সে-সময় থেকেই আমার বিশ্বাস ছিল আমি চিহ্নিত; আমি আলাদা।

প্রশ্ন : অ্যা হাউজ ফর মিস্টার বিশ্বাস প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পরই লিখতে শুরু করেন?

নাইপল : হ্যাঁ। আমি মরিয়া হয়ে একটি বিষয়ের জন্য চারদিকে খোঁজ করছিলাম। এটা খুব হতাশাব্যঞ্জক ছিল, আমি যথেষ্ট নিশ্চিতবোধ করছিলাম না বলে পেনসিল দিয়ে লিখতে শুরু করি। আমার যে-ধারণাটি কাজ করে, তাতে আমার বাবার মতো একটি চরিত্র, যে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে যেসব জিনিসপত্র তাঁকে ঘিরে রেখেছে, সেগুলো দেখছে, ভাবছে এগুলো কেমন করে তাঁর জীবনে এলো। আমি দীর্ঘসময় কোনো ধরনের অনুপ্রেরণা ছাড়াই লিখে গেছি, প্রায় নয় মাস।

প্রশ্ন : আপনি কি প্রতিদিনই লেখেন?

নাইপল : প্রতিদিনই লিখি, কঠোরভাবে এটা বলা যায় না – মন খারাপ থাকলে অনুপ্রাণিত হয়ে আপনি লেখালেখির কাজটা চালাতে পারেন না। আমি একই সঙ্গে আমার লেখার রিভিউয়ার হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কেউ একজন নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকার কাছে আমাকে সুপারিশ করেছিল। তারা আমাকে একটার পর একটা কাজ পাঠাতে থাকে, আমি খুব চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, কিন্তু চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারপর তারা আমাকে জ্যামাইকার ওপর কিছু বই পাঠায়। একসময় চমৎকার সহজ স্বরটি আমার অধিকারে চলে আসে। তার মানে আমার সে-সময়ের কিছু সাফল্য আছে – কেমন করে একটা বই নিয়ে ছোট কিন্তু মজার একটা লেখা দেওয়া যায়, কিংবা কেমন করে বইটিকে পাঠকের কাছে সত্যিই বাস্তব করে তোলা যায় – এসব শিখেছি। শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটি গতি পেয়ে গেল, তারপর সে-গতিতেই চলতে থাকল। আমি প্রতি চার সপ্তাহের তিন সপ্তাহই লেখালেখির জন্য ছেড়ে দিচ্ছি। আমি খুব শিগগির বুঝতে পারি, এটি একটি ভালো বই হতে যাচ্ছে। আমি তখন খুব সন্তুষ্ট, আমি যদিও তরুণ তবু নিজেকে বড় কাজের জন্য প্রতিশ্রুত করাতে পেরেছি – আমি বরং ছোট আকারেই কাজটা শুরু করেছিলাম এবং ভেবেছি নিজেকে প্রশিক্ষিত করতে পারলে বড় কাজ ধরব। সে-সময় কেউ যদি আমাকে রাস্তায় আটকে দিয়ে বলত, কাজটা বাদ দাও আমি তোমাকে এক মিলিয়ন পাউন্ড দেবো আমি তাকে বলতাম : কেটে পড়ো। আমার বই আমাকে শেষ করতেই হবে।

প্রশ্ন : বইটাকে (অ্যা হাউজ ফর মিস্টার বিশ্বাস) কেমনভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল?

নাইপল : প্রকাশক যখন বইটা পড়লেন তখন থেকেই বইটা ভালোভাবে গৃহীত হয়েছে বলা যায়। এটা বলতে পারলে ভালো হতো যে, প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বইটি সংগ্রহের জন্য ভিড় লেগে যায় – কিন্তু অবশ্যই সেরকম কিছু হয়নি। এটা বলতে পারলে ভালো হতো বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী দাঁড়িয়ে গেল এবং বইটি পৃথিবীর নজরে পড়ল – অবশ্যই সেরকম কিছু হয়নি। আমার অন্য বইগুলোর পাশে এটা মৃদু টুনটুন শব্দই করল, তবে বইটিকে নিজের পথ করে নিতে অনেকটা সময়ই পার করতে হলো।