সাদা কাক

ইমদাদুল হক মিলন

বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল আফরিন।

সকালবেলার এই সময়টা তার খুব প্রিয়। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। নীল আকাশের তলা দিয়ে ভেসে যায় সাদা তুলোর মতো মেঘ। মেঘেদের সঙ্গে মনে মনে কথা বলে আফরিন। কোথা থেকে এলে মেঘ? চলেছ কোথায়?

শব্দ করে, পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলার ক্ষমতা থাকলে সে হয়তো শব্দ করেই প্রশ্ন করত মেঘদের। আফরিনের সেই ক্ষমতা নেই। সে বাকপ্রতিবন্ধী। কানে লাগানো আছে হেয়ারিং এইড। বাকপ্রতিবন্ধীরা কেউ কেউ কানে শুনতে পায় না। আফরিনও শুনতে পেত না। সিঙ্গাপুরে গিয়ে হেয়ারিং এইড লাগিয়ে এসেছে অনেক বছর আগে। তারপর থেকে পরিষ্কার শোনে সবকিছু।

পরীর মতো সুন্দর আফরিনের বয়স পনেরো বছর। সে ভিকারুননিসা গার্লস স্কুলের ধানমন্ডি শাখায় ক্লাস এইটে পড়ে। ছবি আঁকার হাত খুব ভালো। চমৎকার ছবি আঁকে। কেউ ছবি আঁকা শেখায়নি তাকে। নিজে নিজেই শিখেছে। নিজের রুম ভরে ফেলেছে ছবি এঁকে।

মা-বাবা দুজনই খুব ভালোবাসেন আফরিনকে। জন্মের পর, একটু বড় হয়ে ওঠার পর যখন বোঝা গেল আফরিন বাকপ্রতিবন্ধী, কানে শুনতে পায় না, তারপর থেকে তাকে নিয়ে রীতিমতো একটা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন দুজন মানুষ। তাঁদের সঙ্গে ছিল পাঁচ বছরের বড়ভাই শাওন। কী যে ভালো বোনটিকে সে বাসে!

শাওন এখন আমেরিকায়। ‘এ’ লেভেল করে পড়তে চলে গেছে। দুয়েকদিন পরপরই স্কাইপে শাওনের সঙ্গে

কথা হয় মা-বাবার। আফরিনের সঙ্গে কথা হয়। ল্যাপটপ অন করে ভাইকে দেখে আফরিন আর ইশারায় কথা বলে। বোনের ইশরায় বলা কথার প্রতিটিই বুঝতে পারে শাওন। সে বলে শব্দ করে। তার কথা পরিষ্কার শুনতে পায় আফরিন। পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকা দুই ভাইবোন হাসাহাসি করে, আড্ডা দেয়। মজার মজার কথা বলে। কোন ফাঁকে যে সময় কেটে যায়, টেরই পায় না কেউ।

প্রযুক্তি একেবারেই ঘুচিয়ে দিয়েছে সব দূরত্ব।

আফরিনের বাবা ফরিদ সাহেব বড় ব্যবসায়ী। বেশ কয়েকটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক। ব্যবসার কাজে দেশের বাইরেই থাকেন বেশিরভাগ। গত পরশু চলে গেছেন চায়নায়। চায়নার এক কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে বড় ইন্ডাস্ট্রি করার কথা ভাবছেন। গাজীপুরে দেড়শো বিঘা জমি কেনা আছে। ওখানেই করবেন ইন্ডাস্ট্রি।

কিন্তু এত ব্যস্ততার মধ্যেও, পৃথিবীর যেখানেই থাকেন দিন-রাত মিলিয়ে তিন-চারবার ফোন করবেন মেয়েকে। আফরিনকে তিনি ডাকেন বাবা। সকালবেলা ফোন করে বলবেন, নাশতা করেছ বাবা? স্কুলে থাকলে টিফিন পিরিয়ডে ফোন করবেন। আজ দুপুরে কী খেলে বাবা? রাতে ফোন করে বলবেন, কী করছ, বাবা?

আফরিন তার অস্পষ্ট ভাষায় হয়তো বলল, ছবি আঁকছি।

কী ছবি মা?

ছবির বিষয় বলল আফরিন।

বাবা বললেন, বেশি রাত জাগে না বাবা। ঘুমিয়ে পড়ো।

আফরিনও ঠিক এরকমই পাগল বাবার জন্য। বাবার কখনো ফোন করতে দেরি হলে সে-ই ফোন করে। খেয়েছ বাবা? বেশি লোড নিও না। তোমার ডায়াবেটিস, কথাটা মনে রাখবে। একদম সময়মতো খাবে, সকালবেলা ট্রেডমিল করবে। অনিয়ম করবে না।

আফরিন এসব বললে বাবা একদম শিশু হয়ে যান। না বাবা, আমি অনিয়ম করব না। আমি তোমার কথামতো চলব। আমাকে নিয়ে তুমি টেনশন করো না।

আজ সকালে বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলেই বারান্দায় এসেছে আফরিন।

শাওনের সঙ্গেও প্রতিদিন অন্তত একবার কথা বলেন ফরিদ সাহেব। এতবড় ব্যবসায়ী, এত ব্যস্ত মানুষ, আজ বাংলাদেশ, কাল বিদেশ করছেন; তারপরও ছেলেমেয়ের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। পরিবার তাঁর কাছে সবার আগে। ঘরবাড়ি সবার আগে।

ধানমন্ডিতে পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি আফরিনদের। দেড় বিঘার ওপর বাড়ি। সামনে-পেছনে অনেকখানি খোলা জায়গা। সবুজ ঘাসের লন আছে সামনের দিকে, ফুল পাতাবাহারের ঝোপঝাড়, হাসনুহেনা, কামিনী আর মেহেদির ঝোপ। পেছন দিকে কদম-বকুল গাছ, দুটো আমগাছ, একটা জামগাছ, কদমগাছ আছে একটা, লিচুগাছ, পেয়ারা গাছ আছে। সবমিলিয়ে সবুজ বাড়ি। কুঞ্জলতায় ছেয়ে আছে গেটের দিকটা। একপাশে দারোয়ানদের বসার ঘর। সিকিউরিটি রুম। বাড়ির পেছনদিকটায় সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। রফিক দারোয়ান বহু বছর ধরে পরিবার নিয়ে থাকে।

রফিকের বউয়ের নাম মর্জিনা। সে এই বাড়ির রাঁধুনি। মেয়ের নাম ময়না, আফরিনের চেয়ে বছর তিনেকের বড়। সে করে বাড়ির অন্যান্য কাজ। রফিকের ছেলে বজলু তাগড়া জোয়ান। বাপের সঙ্গে সেও করে দারোয়ানের কাজ। অর্থাৎ রফিকের পুরো পরিবার এই বাড়ির কর্মচারী।

ড্রাইভার আছে তিনজন। শাজাহান, ফারুক আর বুলবুল। একজন ম্যানেজার আছে বাড়ির যাবতীয় দেখভালের জন্য। নাম ওসমান। এত শান্ত, নম্র-বিনয়ী এবং সৎমানুষ আজকালকার দিনে পাওয়া যায় না। কোটি টাকা দিয়েও তাকে বিশ্বাস করা যায়। এক পয়সাও এদিক-ওদিক হবে না। যে-কোনো কাজে ডাকামাত্রই হাজির। বলামাত্রই কাজ শুরু। সময় মেনে কাজ করে না। সকালবেলা এসে রাত পর্যন্ত থাকে। দেড় হাজার টাকা বেতনে ঢুকেছিল, এখন বেতন পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। মোহাম্মদপুরের পশ্চিম দিকটায়, একটু ভেতরের দিকে ফরিদ সাহেব তাকে তিন কাঠা জমিও কিনে দিয়েছেন। সেই জমিতে চারদিকে ইটের দেয়াল আর ঢেউটিনের চালা দিয়ে বাড়ি করেছে ওসমান। মা, স্ত্রী আর পাঁচ বছরের ছেলে নিয়ে থাকে। খুবই ধর্মপ্রাণ মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। মরে গেলেও মিথ্যা কথা বলবে না। এটা তার প্রতিজ্ঞা।

একবার হেপাটাইটিস-বি-তে আক্রান্ত হয়েছিল ওসমান। তখন কলেজে পড়ে। বাপ নেই। মায়ের একমাত্র সন্তান। মা একটু এলোমেলো মানুষ। অল্প বয়সে ছেলে হওয়ার পর স্বামী তাকে ফেলে অন্যত্র বিয়ে করে। ওসমানকে বুকে নিয়ে মহিলা ফিরে আসেন বাপের বাড়ি। মাথায় তখন থেকেই একটু গন্ডগোল।

বাপের বাড়ির অবস্থা ভালো। ওসমানের মামা নেই। একমাত্র খালার বিয়ে হয়েছে অবস্থাপন্ন পরিবারে। স্বামী ব্যবসায়ী। সিলেট শহরে আড়তদারির ব্যবসা। ছোট্ট ওসমানকে তার কাছে নিয়ে গেল খালা। সেখানে খালাতো ভাইবোনদের সঙ্গে বড় হয়েছে। এমসি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছে। তারপর ঢাকায় এসে খালাতো বোনের বাড়িতে থাকত।

এ-সময় হলো জন্ডিস। ধরা পড়ল হেপাটাইটিস-বি। আটমাস রোগে ভুগল। মা তাঁর ভাগের জমি বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করালেন। শান্তিনগরের ওদিককার একটা ক্লিনিকে পড়েছিল। একটা সময়ে মা, খালা, খালাতো ভাইবোনরা চিকিৎসার ব্যয় চালাতে পারছিল না। মা ছাড়া অন্যরা বলতে গেলে মুখই ফিরিয়ে নিয়েছিল ওসমানের দিক থেকে। ধরেই নিয়েছিল এই ছেলে বাঁচবে না। এর পেছনে টাকা খরচা করে লাভ কী! ওসমানের পাগল মা চারদিকে ছোটাছুটি করেন, কেউ সাহায্য করে না। বিক্রি করার মতো জমিও আর নেই। বাপের বাড়িতে শুধু ছোট্ট একটা টিনের ঘর আছে। ওসমানের বাপ তো তাদেরকে আর চেনেই না।

ওসমানের পাগল মা সারাদিন কাঁদেন, সারারাত কাঁদেন। ক্লিনিকে এসে ছেলের মাথার কাছে বসে থাকেন। ডাক্তারদের  হাতে-পায়ে ধরেন। আমার পোলাটারে বাঁচান।

ক্লিনিকের মালিক ফরিদ সাহেবের বন্ধু ডাক্তার আহমেদ মাসুদ। বড় ডাক্তার। ফরিদ সাহেব ওদিকটায় গেলে বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসেন।

এক সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে গেছেন। দেখেন, মাসুদের রুমে একেবারে ভাঙাচোরা, অসহায় ধরনের এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। কাতর গলায় বলছে, আমাকে সাহায্য করার এখন আর কেউ নেই স্যার। আপনি আমাকে বাঁচান। আমাকে দয়া করুন স্যার। দয়া করুন। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করবেন।

মাসুদ সাহেব চুপচাপ বসে আছেন।

ফরিদ সাহেব বললেন, ঘটনা কী রে মাসুদ?

ঘটনা তিনি বললেন, শুনে যুবকের দিকে তাকালেন ফরিদ সাহেব। ঠিক আছে, তুমি তোমার রুমে যাও।

যুবক আর কথা বলল না। চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।

ফরিদ সাহেব বললেন, তোর তো অবস্থা ভালো মাসুদ। বাঁচা না ছেলেটাকে। এই বয়সী একটা ছেলে এইভাবে মারা যাবে? আর কী সুন্দর করে কথা বলে, মুখের দিকে তাকালেই মায়া লাগে। কথা শুনলেই মায়া লাগে। বাঁচা ছেলেটাকে।

আমি চেষ্টা করছি বন্ধু। আড়াই মাস ধরে ফ্রি ট্রিটমেন্ট করছি। খাওয়া-দাওয়া দিচ্ছি। ওষুধ দিচ্ছি। রুম ভাড়া নিই না। আর কত, বল?

পুরোপুরি ভালো হতে কতদিন লাগতে পারে?

আরো মাস চার-পাঁচেক।

তারপর কাজটাজ করতে পারবে?

হালকা ধরনের কাজ করতে পারবে। অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে।

ঠিক আছে, ওর বাকি চিকিৎসার দায়িত্ব আমার। মাসে মাসে টাকা আমি তোকে দিয়ে যাবো।

তারপর থেকে মাসের ফার্স্ট উইকে মাসুদের ক্লিনিকে যেতেন ফরিদ সাহেব, ওসমানকে দেখে আসতেন, ক্লিনিকের বিল পে করে আসতেন। দেশে না থাকলে ফোনে খবর নিতেন। দুমাসের বিল একসঙ্গে পাঠিয়ে দিতেন।

ওসমান তখন ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। স্বাস্থ্য-চেহারা ফিরতে শুরু করেছে।

ঘটনার মাস সাতেক পর এক সকালে এই বাড়িতে এসে হাজির ওসমান। ফরিদ সাহেব বাড়িতেই ছিলেন। ওসমানকে দেখে অবাক। খয়েরি রঙের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরা। শরীর-চেহারা একদম বদলে গেছে। সেদিনকার সেই ভাঙাচোরা ছেলেটি আর নেই।

ফরিদ সাহেবকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল সে। অতি বিনয়ী গলায় বলল, ডাক্তার স্যার আর আপনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার নেই। তবু আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি যাতে আমাকে দেখে আপনি বুঝতে পারেন, মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আপনাদের দুবন্ধুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ থাকব।

তুমি এখন কী করবে?

দেখি কোথাও যদি হালকা ধরনের কোনো কাজ পাই।

সামান্য সময় কী ভাবলেন ফরিদ সাহেব তারপর বললেন, আমার বাড়িতে কাজ করো। ম্যানেজার। বাড়ির দেখভাল করবে, টুকটাক যা কাজ থাকে, এই ধরো ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস পানির বিল, হোল্ডিং ট্যাক্স…

আর বলতে হবে না স্যার। এসব কাজ আমি পারব। খুবই সহজ আর হালকা কাজ।

কত হলে চলতে পারবে তুমি? থাকবে কোথায়?

থাকব স্যার খালাতো বোনের বাসায়।

খাওয়া?

খালাতো বোনকে কিছু টাকা দিলে ওদের সঙ্গেই খাওয়া যাবে।

সেটার দরকার নেই। একটু সকাল সকাল আসবে। আমার বাড়িতে নাশতা করবে। দুপুরে খাবে, রাতেও খেয়ে যাবে। দেড় হাজার টাকা বেতন।

ওসমান মুগ্ধবিস্ময়ে ফরিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল। কোনো রকমে বলল, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করবে স্যার। আপনি আরো বড় হবেন। আরো অনেক বড় হবেন। এখন থেকে প্রতিদিন বড় হতে থাকবে আপনার ব্যবসা। এমন এমন জায়গা থেকে টাকা আসবে, আপনি ভাবতেও পারবেন না স্যার।

একটু থামল ওসমান। তারপর বলল, আমি একটা প্রতিজ্ঞা করেছি স্যার। আল্লাহ্পাকের দরবারে একদিন দুহাত তুলে বলেছিলাম, যদি আমাকে তুমি বাঁচিয়ে রাখো আল্লাহ, তাহলে আমি জীবনে একটাও মিথ্যা কথা বলব না। কোটি টাকা নিয়েও কারো সঙ্গে ছলচাতুরী করব না। আমি স্যার জীবন দিয়ে হলেও এই প্রতিজ্ঞাটা রাখব। আর প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আপনার জন্য, আপনার পরিবারের জন্য দোয়া করব। পরম করুণাময় আপনাকে দীর্ঘজীবন দেবেন। আপনার পরিবার, স্ত্রী-সন্তানেরা অতি সুখে থাকবে।

পরদিন থেকে এই বাড়ির কাজে লাগল ওসমান। তার চালচলন ব্যবহারে দিনে দিনে মুগ্ধ হয়ে গেল সবাই। আর ফরিদ সাহেবের ব্যবসায় বলতে গেলে প্রতিদিনই উন্নতি হতে লাগল। বছরখানেকের মধ্যে বিস্ময়কর উত্থান।

ফরিদ সাহেবের স্ত্রীর নাম মিলি। ওসমান বাড়ির কাজে লাগার পর, ব্যবসায় উন্নতির পর উন্নতি, এই নিয়ে ফরিদ সাহেব স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই কথা বলতেন। আমাদের ভাগ্য ফিরে গেল ওসমানের জন্য। ও যা বলেছিল তা-ই হয়েছে। তাই হচ্ছে।

মিলি বলতেন, সৎমানুষের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে ওসমান আমাদের জন্য দোয়া করছে। তার দোয়ার বরকতে আল্লাহ আমাদের দয়া করছেন।

আমার ভাগ্য কখন বদলাতে শুরু করেছিল তোমার মনে আছে?

আছে। আফরিনের জন্মের পর।

হ্যাঁ। আমার মেয়েই আমার জীবনের বড় সম্পদ হয়ে এসেছে।

তারপরই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফরিদ সাহেব। সব দিয়েও আল্লাহ যে কেন আমার মেয়েকে প্রতিবন্ধী করলেন!

এই নিয়ে দুঃখ করো না। যত রকমের চেষ্টা মেয়ের জন্য করতে হয় করব আমরা। মেয়েকে ভালো রাখব। একটুও দুঃখ পেতে দেব না তাকে।

আফরিন তখন বড় হচ্ছে। দিল্লি, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক করা হয়েছে তাকে। এই ফাঁকে অদ্ভুত কিছু বিষয় তার মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। ছবি আঁকে একেবারেই অকল্পনীয় সব বিষয় নিয়ে। এমন একটা জীবের ছবি আঁকল, যে-ধরনের জীব পৃথিবীতে নেই। একটা পাখি আঁকল বা একটা ফুল, পৃথিবীর কোনো ফুল পাখির সঙ্গে তা মেলে না। অন্যরকম একটা আকাশ আঁকলো, একটা উড়োজাহাজ বা মানুষের মুখ আঁকলো, একটা ল্যান্ডস্কেপ – কোনোটাই এই পৃথিবীর নয়।

এ নিয়ে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে ফরিদ সাহেব কথা বলেছিলেন। সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছিলেন, ওর মনোজগৎ অন্যরকম। কল্পনার জগৎ অন্যরকম। কোনো কোনো প্রতিবন্ধীর মনের গঠন এমন হয়। ওর মনের গঠন একটু অস্বাভাবিক। এ নিয়ে আপনারা ভাববেন না। উদ্বিগ্ন হবেন না। এটা একসময় কেটে যেতে পারে, আবার নাও কাটতে পারে। ওকে ওর মতো থাকতে দিন। ডিস্টার্ব করবেন না। ওর নিজস্ব জগতে ও খুব ভালো থাকবে।

আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে আফরিনের মধ্যে। হঠাৎ হঠাৎ ইশারায় বা লিখে এমন এমন কথা বলে, যা হুবহু মিলে যায়।

একদিন সকালবেলা বারান্দা থেকে এসে মিলিকে ইশারায় বলল, আজ ওসমান আংকেল আসবেন না। তার জ্বর।

তোকে কে বলল?

আমি জানি। আকাশ বলে দিয়েছে।

আফরিনের কথা শেষ হওয়ার পনেরো-বিশ মিনিট পর ওসমানের ফোন। কাতর কণ্ঠে বলল, ম্যাডাম, কাল মাঝরাত থেকে আমার জ্বর। কিছুতেই মাথা তুলতে পারছি না। আজ আসতে পারব না ম্যাডাম। মাফ করবেন।

মিলি বিস্মিত। ফরিদ সাহেবকে ফোন করে জানালেন। তিনিও বিস্মিত। আফরিন কী করে বলল কথাটা? যা বলল তা একদম মিলে গেল! এ তো আশ্চর্য ঘটনা!

একদিন বিকেলের দিকে দিশেহারা ভঙ্গিতে আফরিন ছুটে এলো মিলির রুমে। ভাইয়ার গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে।

মিলি শুয়ে ছিলেন, ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। তোকে কে বলল?

আকাশ। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আকাশ বলল, তোমার ভাই শাওন গাড়ি ড্রাইভ করছিল, গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে।

সেদিন শুক্রবার। ফরিদ সাহেব গেছেন কুয়ালালামপুরে। দুপুরের পর শাজাহান ড্রাইভারকে নিয়ে বেরিয়েছে শাওন। উত্তরায় ওর বন্ধু তাহসান থাকে। তাহসানের সঙ্গে দেখা করতে গেছে।

এ-অবস্থায় আফরিনের ওই কথা!

মিলি কী করবেন বুঝতে পারলেন না। ফ্যালফ্যাল করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মিনিট সাতেকের মধ্যে ফোন। শাজাহান ড্রাইভার ফোন করেছে। ম্যাডাম…

বলো, বলো কী হয়েছে?

ছোট সাহেব আমাকে সরিয়ে দিয়ে…

মিলি ভয়ার্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। নিজে ড্রাইভ করছিল? অ্যাকসিডেন্ট করেছে? বড় রকমের…

না না, তেমন কিছু না ম্যাডাম। পেছন থেকে অন্য একটা গাড়িরে মাইরা দিছে। আমাদের কারো কিছু হয় নাই। গাড়ির ক্ষতি হইছে। দুই গাড়িরই ক্ষতি হইছে।

মিলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

বাড়ি চলে এসো। আমাদের গাড়ি আর অন্য গাড়িটা গ্যারেজে দাও। যদি টাকা চায়, বাড়িতে নিয়ে এসো। টাকা দিয়ে ম্যানেজ করো।

ওকে ম্যাডাম, আমি ম্যানেজ করতেছি।

শাজাহান সবই ম্যানেজ করল।

বাড়ি ফিরে শাওনের অপরাধী মুখ। মিলির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মিলি খুবই রেগেছেন। তোকে না বলেছি গাড়ি ড্রাইভ করার চেষ্টা করবি না। তোর এখনো গাড়ি চালাবার বয়স হয়নি। আমি আর তোর বাবা দুজনেই বলেছি, তুই আমাদের কথা শুনিসনি কেন? আজ যদি কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেত কী করতি তুই? তোর বাবাকে কী জবাব দিতাম আমি? সবচে’ বড় কথা তুই পঙ্গু হয়ে যেতে পারতি, মারা যেতে পারতি!

এ-অবস্থায় আফরিন এসে ভাইকে উদ্ধার করল। মাকে বোঝাল ভাইকে আর কিছু বলো না। ও আর কখনো এমন করবে না। তুমি আর বাবা দুজনে ড্রাইভারদের বলে দেবে ভাইয়া চাইলেও তাকে যেন ওরা ড্রাইভ করতে না দেয়।

তারপর ভাইকে ঠেলে দিলো তার রুমের দিকে। যাও ভাইয়া, তোমার রুমে যাও।

সে-রাতেই কুয়ালালামপুর থেকে ফিরলেন ফরিদ সাহেব। গাড়ি অ্যাকসিডেন্টের কথা বলার আগে আফরিনের কথা বললেন মিলি। শুনে আগের মতোই বিস্মিত ফরিদ সাহেব। এ তো অদ্ভুত কান্ড। মেয়েটা কী করে আগাম এসব বলে দিচ্ছে?

আমিও বুঝতে পারছি না।

আরেকদিন সকালবেলা ট্রেডমিল সেরে খবরের কাগজ পড়ছেন ফরিদ সাহেব। আফরিন তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল।

ফরিদ সাহেব বললেন, কিছু বলবে, বাবা?

হ্যাঁ।

বলো।

ফুপিকে ফোন করো। তাঁর শরীর খারাপ।

ফরিদ সাহেবের একমাত্র বোন থাকেন আমেরিকার লং আইল্যান্ডে। বোনকে খুবই ভালোবাসেন তিনি। আফরিনের কথা শুনে দিশেহারা হলেন। কে বলল তোমাকে?

আগের দুবারের মতো ইশারায় আফরিন বোঝালো, আকাশ বলেছে।

ফরিদ সাহেব লাফিয়ে উঠলেন। তক্ষুনি ফোন করলেন বোনকে। ফোন ধরল বড় ভাগ্নি ইশিতা। ভেঙেপড়া গলায় বলল, আম্মু স্ট্রোক করেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাচিছ।

ফরিদ সাহেব নার্ভাস হয়ে গেলেন। তারপরও ভাগ্নিকে সাহস দিলেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি দুয়েকদিনের মধ্যে রওনা দিচ্ছি। কোনো কিছু নিয়ে ভাবিস না। আপার দিকে খেয়াল রাখ।

পরদিনই তিনি বোনকে দেখতে আমেরিকায় চলে গেলেন।

কিন্তু আফরিনের ব্যাপারটা কী? আকাশ থেকে কেমন করে সে এসব খবর পায়?

দশদিন পর আমেরিকা থেকে ফিরে ফরিদ সাহেব মিলিকে বললেন, নিউইয়র্কের খুব বড় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। সব শুনে তিনি বললেন, তোমার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে এসো। সামনাসামনি বসে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তোমার মুখ থেকে শুনে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। ব্যাপারটা একটু জটিল, একটু অন্যরকম।

মিলি বললেন, তাহলে অবশ্যই আমাদের যাওয়া উচিত।

চলো তাহলে।

কবে যাবে?

তোমার সুবিধামতো।

এটা মে মাস। আজ দশ তারিখ, জুনের সাত তারিখে চলো।

হ্যাঁ। তখনই ভালো হবে। আফরিনের সামার ভ্যাকেশন শুরু হয়ে যাবে।

একটু থেমে মিলি বললেন, শুধু তো মেয়ের কথাই বলছ, আপার কথা দেখি কিছুই বলছ না।

ফোনে রোজই দু-তিনবার করে বলেছি। তেমন কিছু হয়নি। প্রেশারের ওষুধ খেতে ভুলে গিয়েছিল…

তা তো জানি।

এজন্যই স্ট্রোক করেছে। ঠোঁটের ডানদিকটা একটু বাঁকা হয়ে গেছে। মাস দুয়েকের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমাকে দেখেই অর্ধেক ভালো হয়ে গেছে আপা।

আপা তোমাকে খুবই ভালোবাসেন।

আমিও আপাকে খুব ভালোবাসি। ভাই তো নেই-ই, বোন ওই একজন। মা-বাবা কবে চলে গেছেন…

ফরিদ সাহেব একটু উদাস হয়েছিলেন।

মিলি বুঝলেন মন খারাপ হয়েছে। বললেন, চলো, খেতে চলো।

অর্থাৎ স্বামীর মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন।

আজ সকালে মেয়ের রুমে ঢুকে তাকে ডাকলেন মিলি। আফরিন, মা, কোথায় তুমি?

আফরিন বারান্দা থেকে রুমে এলো। মুখটা গম্ভীর। কী যেন ভাবছে।

মিলি মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। কী হয়েছে?

আফরিন মাথা নাড়ল। কিছু না।

গম্ভীর কেন?

আমি আজ দুটো ছবি আঁকব।

আঁকো। আমি কিছুক্ষণ পর বেরোবো। বসুন্ধরা শপিংমলে যাবো। কেনাকাটা আছে। ফিরতে দেরি হবে। তুমি তোমার মতো ছবি আঁকো। এখন চলো, নাশতা রেডি।

আফরিন আগের মতোই গম্ভীর মুখে মিলির সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে এলো।

দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরল মিলি।

ফরিদ সাহেব মিলি এবং শাওন এই তিনজন মানুষের যে কেউ বাড়ি ফিরে প্রথমেই আফরিনকে ডাকে। ফরিদ সাহেব ডাকেন, বাবা, ও বাবা। আমার বাবা কই?

মিলি ডাকেন, মা, আফরিন, কোথায় তুমি?

আফরিনকে শাওন ডাকে, আপু। দেশে থাকার সময় বাইরে থেকে ফিরেই ডাকত, আমার আপুটা কই রে?

এখন আমেরিকা থেকে মোবাইলেও ওরকম করেই ডাকে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ওই ডাক না শোনা পর্যন্ত শান্তি নেই আফরিনের।

নিজের রুমে গম্ভীর মুখে শুয়ে আছে আফরিন। বাড়ি ঢুকেই তাকে ডাকলেন মিলি। আফরিন, মা, কোথায় তুমি?

ময়না ছিল কিচেনে। বেরিয়ে এসে বলল, আপু তার রুমে।

মিলি ভাবলেন নিশ্চয়ই ছবি আঁকছে। ড্রাইভার শাজাহান শপিংব্যাগগুলো নিয়ে এলো। ময়না সেগুলো নিয়ে চলে গেল মিলির বেডরুমে আর মিলি গিয়ে ঢুকলেন মেয়ের রুমে।

ঢুকে অবাক হলেন। না আফরিন ছবি আঁকছে না! সে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। মুখটা গম্ভীর।

মেয়ের পাশে বসলেন মিলি। মাথায় হাত রেখে বললেন, শুয়ে আছো কেন, মা?

আফরিন গম্ভীর মুখেই ইশারায় বলল, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

আমার একটু দেরি হয়ে গেল। রাস্তায় জ্যাম ছিল।

আফরিন কথা বলল না।

মিলি বললেন, তুমি ছবি আঁকোনি?

আফরিন মাথা নাড়ল।

এঁকেছ? কই, দেখি আজ কী ছবি আঁকলে?

আফরিনের স্বভাব হচ্ছে হ্যান্ডমেইড পেপারে ছবি এঁকে বোর্ডটা উলটোদিকে ঘুরিয়ে রাখা। অর্থাৎ রুমে ঢুকে প্রথমেই যেন ছবিটা কারো চোখে না পড়ে। আসলে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে সে একটা সারপ্রাইজ দিতে চায় দর্শককে।

দর্শক বলতে বাড়ির মানুষজন। মা বাবা ভাইয়া। ময়নাও তার পেইন্টিংয়ের একজন ভক্ত। আফরিনের আঁকা যে কোনো ছবি দেখেই সবাই মুগ্ধ হয়। প্রশংসা করে।

আসলে সবাই মিলে মেয়েটিকে ভালো রাখার চেষ্টা।

মিলির কথা শুনে উঠল আফরিন। বোর্ড উলটোদিকে ঘোরানো। সেই বোর্ড মায়ের দিকে ঘোরালো। ক্লিপ দিয়ে আটকানো হ্যান্ডমেইড পেপারের পুরোটা কালো রং করা হয়েছে। তার মাঝখানে একটা কাক। বেশ বড় কাক। দাঁড়কাক সাইজের। কিন্তু কাকটা সাদা।

আফরিন উদ্ভট ছবি আঁকে এটা এই বাড়ির সবাই তো জানেই, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব পরিচিতজন অনেকেই জানেন।

এ-ছবিটাও অদ্ভুত। সাদা কাক এঁকেছে আফরিন। কাক কি কখনো সাদা হয়?

তারপর মিলি ভেতরে ভেতরে খুশি হলেন। এই প্রথম আফরিন বাস্তবের অনেক কাছাকাছি একটা ছবি এঁকেছে। কাকের ছবি। আজ সাদা কাক এঁকেছে নিশ্চয় এরপর আসল রঙের কাক আঁকবে কিংবা বাস্তব দৃশ্যের ছবি আঁকবে। অর্থাৎ মেয়ের মাথায় বাস্তব জগৎ ধীরে ধীরে ঢুকছে। তার চিন্তা বদলাতে শুরু করেছে। আমেরিকায় নিয়ে গেলে নিউইয়র্কের সেই ডাক্তার নিশ্চয় এমন কিছু সাজেশন দেবেন যেগুলো ফলো করলে আফরিনের উদ্ভট চিন্তার সমস্যা কেটে যাবে।

মিলির মুখ উজ্জ্বল হলো। গভীর আনন্দে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। বিউটিফুল ছবি এঁকেছ মা, বিউটিফুল। অপূর্ব সুন্দর কাক এঁকেছ।

আফরিন গম্ভীর মুখে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে মাকে বলল, কাক কালো হয়। আমি এঁকেছি সাদা কাক।

কোনো অসুবিধা নেই। এরপর কালো কাক আঁকবে।

আফরিন কথা বলল না।

মিলি বললেন, দেখি পরের ছবিটা।

প্রথম ছবির তলায় দ্বিতীয় ছবি। এই ছবি দেখে মিলি আরো অবাক। অন্ধকার রাত। আকাশে ম্লান হয়ে আসা চাঁদ। সেই চাঁদের দিকে উড়ে যাচ্ছে একটা বড়সড় কাক। এই কাকটাও সাদা। তার মানে একটাই সাদা কাক এঁকেছে আফরিন। প্রথমে অন্ধকারে বসে আছে সাদা কাক, পরে আকাশে চাঁদ দেখার পর চাঁদের দিকে উড়াল দিয়েছে।

এই ছবি দেখেও মুগ্ধ মিলি। অনেকটাই বাস্তবের কাছাকাছি হয়েছে। নাকি এই ধরনের ছবিকে বলে অ্যাবসট্র্যাক্ট ফর্মের ছবি! শিল্পীর কল্পনায় নিশ্চয় এই ছবির কোনো ব্যাখ্যা আছে। পৃথিবীর কোনো বিখ্যাত শিল্পী নাকি সবুজ রঙের ঘোড়া এঁকেছিলেন?

ঘোড়া কি কখনো সবুজ হয়?

মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন মিলি। এই ছবিটাও সুন্দর হয়েছে।

আফরিন গম্ভীর।

মিলি বললেন, কিন্তু মা, রাতে কাক কখনো আকাশের দিকে উড়াল দেয় না। অনেক পাখির মতো কাকও রাতকানা। রাতে চোখে দেখে না। এজন্য সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের ডালে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমাদের বাড়ির গাছগুলোতে অনেক কাক থাকে। ভোররাতের দিকে তো ডাকেই, মাঝরাতেও কখনো কখনো ডাকে।

আফরিন আগের মতোই গম্ভীর মুখে বলল, সাদা কাক রাতে চোখে দেখে। আকাশ থেকে আসে, আকাশেই উড়ে যায়।

মিলি বুঝলেন মেয়ে আবার তার উদ্ভট কল্পনার জগতে চলে গেছে। এসব নিয়ে তিনি আর কথা বললেন না। আফরিনের হাত ধরে বললেন, চলো মা, খেতে চলো।

ফরিদ সাহেব বাড়িতে না থাকলে আফরিন এসে মায়ের সঙ্গে ঘুমায়।

আজো তাই করেছে।

গভীর রাতে সে হঠাৎ মাকে ধাক্কাতে লাগল।

মিলির ঘুম ভাঙল। কী হয়েছে, মা?

রুমে হালকা আকাশি রঙের ডিমলাইট জ্বলছে। সেই আলোয় নিজের ভঙ্গিতে মিলিকে আফরিন বলল, ওই সাদা কাকটা এসেছে মা!

মিলি অবাক। কী?

হ্যাঁ, সাদা কাকটা এসেছে। আমার রুমের বারান্দায় বসে আছে।

মিলি উঠে বসলেন। কে বলল তোমাকে?

আমি সকাল থেকেই জানি। আকাশ বলে দিয়েছে। ইচ্ছে করেই তোমাকে বলিনি। ছবি এঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি।

মিলি কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। মেয়ের সেই অদ্ভুত ক্ষমতার কথা তার জানা। আফরিন যা বলে তা ঠিক হয়।

এটা কি ঠিক হবে?

আফরিন বলল, চলো তোমাকে দেখাই।

মায়ের হাত ধরে বিছানা থেকে নামলো আফরিন।

মিলির তখন ভয়ে বুক কাঁপছে। পুরনো দিনের এতবড় বাড়ি। এত গাছপালা বাড়িতে, এত নির্জন…

মায়ের মন পুরোপুরি বুঝতে পারল আফরিন। হাসিমুখে বলল, ভয় পেয়ো না। সাদা কাক কিচ্ছু করবে না। এসো আমার রুমে। আমরা কাকের সামনে যাবো না। বারান্দার দিককার জানালার পর্দা সামান্য সরালেই দেখতে পাবে।

আমি ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তুমি গিয়ে কি দেখে এসেছ?

না।

তাহলে জানলে কী করে?

বললাম না, আমি সকাল থেকেই জানি।

এখন তো তুমি ঘুমিয়েছিলে, এখন জানলে কী করে?

সাদা কাক তিনবার ডেকেছে।

আরে না, ওগুলো আমাদের গাছে থাকা কাকগুলোর ডাক।

না, সাদা কাকের ডাক। তুমি এসো আমার সঙ্গে।

আফরিনের সঙ্গে তার রুমে এলেন মিলি। রুমে এসে লাইট জ্বালল না আফরিন। মায়ের হাত ধরে পা টিপে-টিপে বারান্দার দিককার জানালার কাছে এলো। নিঃশব্দে পর্দা সরাল। প্রথমে নিজে তাকাল তারপর ইশারায় মাকে বলল, ওই যে দেখো।

মেয়ের গালে গাল ছুঁইয়ে মিলিও তাকালেন। তাকিয়ে প্রথমে তার গায়ে কাঁটা দিলো, তারপর শরীর হিম হয়ে এলো।

আফরিনের এ-বারান্দায় সারারাত আলো জ্বলে। ফরিদ সাহেবের নির্দেশ। অন্ধকারে মেয়ে ভয় পেতে পারে এজন্য বারান্দায় আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়। রুমে জ্বলে সবুজ ডিমলাইট। ভারি পর্দা টাঙানো আছে। বারান্দার আলোও রুমে হালকাভাবে ঢোকে। পর্দার ফাঁক দিয়ে মিলি পরিষ্কার দেখতে পেলেন বারান্দার রেলিংয়ে একটা দাঁড়কাক সাইজের কাক বসে আছে। একদম বরফের মতো রং কাকের। গোল চোখ দুটোও দেখা যাচ্ছে। সেই চোখ থেকে মৃদু নীলচে একটা আলো বেরোচ্ছে।

এই দৃশ্য দেখে শক্ত করে আফরিনের হাত ধরলেন মিলি। তাঁর হাত একটু একটু কাঁপছে।

মিলির হাতে চাপ দিলো আফরিন। বোঝাতে চাইল, ভয় পেয়ো না। ভয়ের কিছু নেই। দেখো বেশিক্ষণ থাকবে না এই কাক। এখনই আকাশে চলে যাবে।

আকাশে চাঁদ আছে। মাঝরাতের দিকে ওঠা চাঁদ। একটু যেন কুয়াশা-জড়ানো, ম্লান আলো চাঁদের। আফরিনের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাদা কাক চঞ্চল হলো। এতক্ষণ তাকিয়েছিল আফরিনের রুমের দিকে। এবার মুখ ঘোরাল আকাশের দিকে, চাঁদের দিকে। তারপর নিঃশব্দে উড়াল দিলো। সোজা চাঁদের দিকে উড়তে লাগল।

মা-মেয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে সাদা কাক উড়ে যেতে দেখল। যখন আকাশে একেবারেই মিলিয়ে গেল তখন জানালার কাছ থেকে সরে এলো আফরিন। সুইচ টিপে আলো জ্বাললো, মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। দেখলে?

মিলি চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।

এবার আরেকটা জিনিস দেখবে?

কী?

এসো আমার সঙ্গে।

মিলির হাত ধরে ছবি আঁকার বোর্ডের সামনে এলো আফরিন। আগের মতোই অন্যদিকে ঘোরানো বোর্ড। বোর্ড মায়ের দিকে ঘোরাল আফরিন। মিলি তাকালেন, তাকিয়ে হতবাক। বারান্দার রেলিং এঁকেছে আফরিন। রেলিংয়ে কালো একটা কাক বসে আছে। অতি বাস্তব ছবি, অতি জীবন্ত।

মিলি উত্তেজিত গলায় বললেন, পরেরটা দেখি।

প্রথম ছবিটা বোর্ড থেকে খুলল আফরিন। মিলির চোখের সামনে এখন পরের ছবিটা। বারান্দার রেলিং থেকে গাছপালার দিকে উড়ে যাচ্ছে কালো কাক।

একেবারেই বাস্তব ছবি। প্রতিদিনই এরকম কাক আর কাকের উড়ে যাওয়া দেখছেন মিলি। শুধু মিলি কেন, বাড়ির সবাই দেখছে। কাক আর কাকের উড়ে যাওয়া খুবই পরিচিত দৃশ্য সবার।

মিলি বললেন, এই ছবি তুমি কখন আঁকলে?

আমি আঁকিনি।

মানে?

আঁকিনি মানে আঁকিনি।

তাহলে?

আপনা-আপনি আঁকা হয়ে গেছে।

সেটা কী করে সম্ভব?

আফরিন খিলখিল করে হাসতে লাগল।

সেই রাতের পর থেকে আফরিন অতিবাস্তব সব ছবি আঁকে। সে এখন চারুকলার ছাত্রী। নিউইয়র্কের সেই বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে তাকে আর যেতে হয়নি। কোনো ঘটনা ঘটার আগে এখন আর সে আগের মতো টের পায় না। সাদা কাক আঁকা, গভীর রাতে সেই কাক তার বারান্দায় এসেছিল, একসময় আকাশের দিকে উড়েও গেছে, তার আঁকা সাদা কাক আপনা-আপনি কালো হয়ে গেছে, এই রহস্যের কোনো কূল-কিনারা হয়নি। ওই নিয়ে এখন আর কেউ ভাবেও না।

সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।

না, তারপর অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল। আফরিনদের বাড়ির জামগাছে একজোড়া পাতিকাক বাসা বাঁধল। ডিম দিলো। ডিম ফুটে দুটো ছানা বেরোল। প্রথমে কিছুই বোঝা গেল না। ছানা দুটো বড় হওয়ার পর দেখা গেল সে দুটো কালো হয়নি, হয়েছে বরফের মতো সাদা। আফরিনের আঁকা সেই সাদা কাকের মতো।

আফরিনই প্রথম তার রুমের জানালা থেকে দেখেছিল কাকের ছানা সাদা হয়েছে। ফরিদ সাহেব সেদিন বাড়িতে। আগের দিন শাওন এসেছে আমেরিকা থেকে। তার ইউনিভার্সিটি তিন সপ্তাহ বন্ধ। মিলি নিজেই ছেলের জন্য রান্নাবান্নার তদারক করছেন।

এসময় আফরিন এসে সবাইকে নিল তার রুমে। জানালা দিয়ে দেখালো কাকের সাদা ছানা।

মা বাবা ভাই তিনজনেই বিস্মিত।

এরকম কাকই তো এঁকেছিল আফরিন। সেই কাক এসেও ছিল এই বাড়িতে। এসেছিল রাতের বেলা। তারপর চাঁদের দিকে উড়ে গেছে।

এই রহস্যের ব্যাখ্যা কী?

ফরিদ সাহেবের পরিচিত শরিফ খান। তিনি পক্ষীবিশারদ। ফরিদ সাহেব শরিফ খানকে ফোন করলেন। আফরিনের আঁকা সাদা কাক ইত্যাদির রহস্যময় ঘটনা তাঁকে বললেন না। বললেন জামগাছে সাদা কাক ছানা দুটোর কথা।

এ কী করে সম্ভব?

কাকের ছানা সাদা হয় কী করে?

শরিফ খান মোটেই অবাক হলেন না। অতি স্বাভাবিক গলায় বললেন, হতে পারে। এদেরকে বলে অ্যালবিনো। মানুষের মধ্যেও অ্যালবিনো হয়। আপনি একটা কাজ করুন, চিড়িয়াখানায় খবর দিন। ওরা এসে ছানা দুটো নিয়ে যাক। সাদা কাক দেখে দর্শকরা আনন্দ পাবে।

ফরিদ সাহেব তা-ই করেছিলেন।