সাদি ইউসেফের কয়েকটি কবিতা

ভাষান্তর : মঈনুস সুলতান

ভূমিকা ও কবি-পরিচিতি

সাদি ইউসেফের জন্ম ১৯৩৪ সালে দক্ষিণ ইরাকে – বসরার কাছাকাছি আবুল খাসিবে। এ অবধি রচনা করেছেন পঁয়তাল্লি­শটি কবিতা ও সাতটি গদ্যগ্রন্থ। বাগদাদে তাঁর পড়াশোনার বিষয়বস্ত্ত ছিল আরবিসাহিত্যে। প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করেন কিছুকাল। পরে পেশাগতভাবে তিনি সাংবাদিক ও প্রকাশক হিসেবে কাজ করেন। রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেও তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ বয়সে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে শামিল হন এবং বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন সমাজতন্ত্র ও সম্পদের সুষম বণ্টনে। প্রভাবিত হন প্যান-আরব ভাবধারায়। রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিজমে যুক্ত থাকার পরিণামে ইরাকে কারাবরণ করেন। পরে স্থায়ীভাবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন ১৯৭৯ সালে। প্রবাস জীবনে স্বল্পমেয়াদে বাস করেন আলজেরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, যুগোস্ল­াভিয়া, ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস প্রভৃতি দেশে। অবশেষে স্থায়ীভাবে থিতু হন বিলেতে।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। কবিতায় মৌলিক অবদান ছাড়াও আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, ওয়াল্ট হুইটম্যান প্রমুখের কবিতা। সমালোচকরা সাদি ইউসেফকে আরবি সাহিত্যের সাম্প্রতিককালের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। তাঁকে আধুনিক আরবি কবিতার পায়োনিয়ারও বলা হয়। জনপ্রিয় এ-কবি তাঁর কিছু কবিতার জন্য বিতর্কিতও হয়েছেন। যেমন, কুর্দিদের নিয়ে রচিত একটি কবিতার জন্য কুর্দিস্থানের স্থানীয় প্রশাসন তাঁর তাবৎ রচনা স্কুল কারিকুলামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

২০১২ সালে কবি অত্যন্ত মর্যাদাবান নাগিব মাহফুজ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৪ সালে তাঁকে আল কায়েস পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসক শেখ জায়েদ বিন আল নাহিয়ানের সমালোচনা করার জন্য তাঁকে পুরস্কার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হয়। ২০০২ সালে খালেদ মাত্তাওয়ার ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় তাঁর নির্বাচিত কবিতার বই – উইদআউট অ্যালফাবেট, উইদআউট অ্যা ফেস।

আরবি সাহিত্যের হাল-জামানার বোদ্ধা-সমালোচকরা একটি বিষয়ে একমত যে, গত শতকে জাজিরাতুল আরব উপদ্বীপের কাব্যকলায় নিরীক্ষা হয়েছে প্রচুর, ভাষাগত পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক এবং বিষয়বস্ত্ত নতুন থিমের সংযোজনে সমৃদ্ধ হয়েছে বিপুলভাবে। বিকাশের চলিষ্ণু ধারাস্রোতে দক্ষ নাবিকের মতো যারা হাল ধরেছেন – তৈরি করেছেন দিকনির্দেশনার কম্পাস, ঘেঁটেছেন প্রকরণের মানচিত্র কিংবা জুড়ে দিয়েছেন বিষয়বস্ত্তর আনকোরা পাল; তাঁদের মধ্যে দিকপাল হিসেবে স্বনামে পরিচিতি লাভ করেন মশহুর সাদি ইউসেফ। এ কবির যাত্রা শুরু হয় মূলত পঞ্চাশের দশকে ইরাকের বসরা-বাগদাদে। তাঁর পয়লা জামানার গ্রন্থ – ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত উগনিয়াত লাইসাত লিল – আখারিন বা, সংস্ নট ফর আদার্সে তিনি তাঁর স্বাতন্ত্র্যকে উচ্চকিত করেছিলেন। সে-ধারাপ্রবাহে পরবর্তী জীবনে মননের বিবর্তনে যুক্ত হয়েছে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ক্বাস্সাইড আক্বালু সামতান বা, মোর সাইলেন্ট পোয়েমস গ্রন্থটি, যা তাঁর প্রৌঢ় বয়সের নিভৃতিপ্রিয়তার পরিচায়ক।

সাদি ইউসেফ কারো প্রতিনিধিত্ব করেন না, কথাও বলেন না সরাসরি কারো সপক্ষে। তবে তাঁর কাব্যকলায় বারবার ফিরে আসে সমাজবাস্তবতা। পাঠক, সমঝদার কিংবা তরুণ বয়সের কবিরা তাঁর সৃজন ও জীবনযাপনে খুঁজে পান মহাকাব্যের নায়কের মতো শক্তিমত্ম এক রোলমডেল। রাজনৈতিক দুর্বিপাকে দশকের পর দশক জুড়ে হরেক দেশে ভ্রাম্যমাণে এ চারণ কবি তাঁর কবিতায় সামাজিক ইনসাফ ও ব্যক্তিমানুষের মুক্তির অঙ্গীকারকে ক্রমাগত ঋদ্ধ করেন। আরবি ভাষার সাম্প্রতিক কাব্যকলায় তাঁর মৌলিক অবদান হচ্ছে ব্যক্তিভিত্তিক অভিজ্ঞতার মর্যাদাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা। বিষয়বস্ত্ত ও প্রকরণের দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি কবিতার ভাষান্তর এখানে পেশ করা হচ্ছে। অনূদিত কবিতাগুলোর সূত্র হচ্ছে – উইদাউট অ্যালফাবেট, উইদাউট অ্যা ফেস : সিলেকটেড্ পোয়েমস্ অব সাদি ইউসেফ গ্রন্থটি।

 

সংবর্ধনা

ক্যাকটাসের কাঁটাময় পাতায় সদ্য ঝরেছে তুষার। কে যেন কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে ক্যাফের ভেতর। ছাউনির চতুর্দিকে গড়খাই,ঁআকাশে একটি নক্ষত্র। পাদ্রির আলখাল্লা নেকড়ের নখরে হয়েছে ছিন্নভিন্ন। চমৎকার মসৃণ চামড়ায় তৈরি জুতো। হাদ্রামাউতের সমুদ্রতটে কচ্ছপগুলো শীতে কাঁপছে দেখো কীভাবে? নদীর তলদেশ থেকে গোঙাচ্ছে পূর্ণচাঁদ। আর বালিকাটি চিৎকার করছে ব্যাপক আতঙ্কে। না, বুলেটের প্রয়োজন নেই আমার। এ পৃথিবীতে আমার সম্পদ বলতে আছে পেছনের আঙিনায় একটি দেয়াল।

শাহরজরের স্তেপে ঘাস কতটা গাঢ় সবুজ? আমি দেখি – দুলছে একটি দড়ি মাথার ওপর। কোথায় ইউসেফ? আমি তো ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তিমবাকতুর বাজারে।… আর মেহনত করছিলাম প্রচন্ডভাবে। এক রাতে জাহাজে চড়ে অন্ধকারে আমি চলে এলাম জিবুতির উপকূলে।

মুগাদিসুর সমুদ্রজলে ভাসছে হাঙর; তাদের দিকে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে ভেড়ার মাংস। আমার নির্দ্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই। পোষা বিড়ালটি হালফিল শোনাচ্ছে আমাকে আমারই জীবনের গল্প। চিরায়ত সময় চলে আসছে খুব কাছে। তোমার সঙ্গে বেইমানি করা হলো কেন? আজ অপরাহ্ণে আমি লিখে রাখব – কেমন করে চুমুক দিয়ে পান করতে হয় পুষ্পের নির্মমতা। আর বিশ্বাসঘাতকতার স্বাদই বা কেমন? একবার আমি আমার স্বরচিত গানে বিমুগ্ধ হয়ে বেরিয়েছিলাম সফরে। গড়িয়ে আসছে – আমার দিকে সৈন্যদের জলপাই রঙের আর্মড কার… আসছে তারা গড়গড়িয়ে… বহরের পর বহর। মস্কোর তুষারে উষ্ণ হয় আমার অশ্রু। রাখালরা বিশ্রাম ও ভ্রমণের মাঝে এমন কোনো প্রভেদ দেখে না; এ-নিয়ে তারা ভোগেও না নৈতিক কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে।

শহরগুলোর আঙুলের ইশারায় বিধ্বস্ত হচ্ছে গ্রাম ও গঞ্জ। খুব বাজে কাঁকরময় ময়দায় তৈরি আমার রুটি। আর মাছে নুনের বদলে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে ছাই। মেয়েদের ডরমিটরিতে যাওয়া যেতে পারে আজ রাতে; কিন্তু তার প্রেমিক যে হবো এমন কোনো সম্ভাবনা তো দেখি না। না… শনিবারে ছুটির দিনেও সে আমার জন্য খুলে রাখবে না দোয়ার। কাগজগুলো আমি পুড়িয়ে ফেলবো ইন্সপেক্টর এসে পড়ার আগেই। নিশিরাতের রেলগাড়িতে বসে বসে আমি ঢলে পড়ছি ঘুমে। আমার দুহাত ও পায়ে পরানো লোহার শিকল। কাঠের যে-বেঞ্চে বসে আছি – দিনকয়েক আগে তা ছিল বিমানের খন্ডাংশ, যা বিধ্বস্ত হয়েছে সম্প্রতি। পোতাশ্রয়ের পানশালায় চোখে আলো ছড়ানো মেয়েটি, তোমার নাম জপ করছে তারা নিভৃতে। হীরকের অনুসন্ধান করে করে ক্লান্ত হয়ে অজানা আগন্তুকরা ফিরে এসেছে ঘরে। হেজার পাথরে ডানা ছড়িয়ে বসে বিশ্রাম করছে হেমিয়ার বাজপাখি। একবার আমি কিন্তু শিশুচন্দ্রকে ধরে রেখেছিলাম আমার করতলে। পার্কের সুশীতল বাতাবরণ ছেড়ে মানুষ অন্যত্র যায় কেন? তোমার হাত আমি আর স্পর্শ করতে চাই না। ন্যাতাকিনি পাকিয়ে তৈরি দড়িতে ঝুলিয়ে আমাকে ছুড়ে দিও না। আমি আজ খুঁজে পেয়েছি বেগবান একটি প্রপাত।

স্বাগত হে জীবন – শুভাগমন হোক আমার দিনযাপনে ভিন্ন এক প্রেমিকের।