সিকিমের ডাকে

জয়ন্ত সরকার

মনপাখির ডানায়

সেবক রোড এসে পড়লেই মনপাখিটা আমার বুকের পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে এসে এদিক-ওদিক উড়তে শুরু করে। কখনো উত্তুঙ্গ পর্বতশীর্ষ, কখনো বনানীর সবুজাভ হিন্দোল, কখনো-বা স্নিগ্ধ প্রপাতের ধ্বনি ওর ডানায় প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। এক টুকরো নীল আকাশ, তুষারের সান্নিধ্যে গড়ে ওঠা কোনো সূর্যাস্ত কিংবা পাহাড়ঘেরা জলাশয়ের অনাবিল সৌন্দর্যে সে তার নিজস্ব পৃথিবী গড়ে তুলতে চায়।

শিলিগুড়ির যানজট থেকে বেরিয়ে এসে শাল-সেগুনের বিক্ষিপ্ত জঙ্গল পার হতে-হতে ঘুম লেগে এসেছিল চোখে। ড্রাইভার সাহেবের মৃদু ধাক্কায় নড়েচড়ে উঠলাম হঠাৎ। সামনের সিটে বসে না-ঘুমোনোর পরামর্শ দিলেন মধ্যবয়সী মানুষটি। কারণ একটানা গাড়ি চালানোর সময় পাশের সহযাত্রীর এই ঘুম সঞ্চারিত হয়ে যেতে পারে চালকের স্নায়ুতন্ত্রে। আর তাহলেই মহাবিপদ। তড়িঘড়ি চোখ কচলিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। একটু পরেই সেবকেশ্বরী কালীমন্দিরের কাছে এসে গাড়ি থামালেন ড্রাইভার। যাত্রাপথকে বাধাহীন ও সুগম করার জন্য এই মন্দিরে পুজো দেয় সবাই। দেখাদেখি আমরাও অর্ঘ্য সাজিয়ে দেবীদর্শন সেরে নিলাম। করনেশন ব্রিজ পার হয়ে এরপর তিস্তার আঁচল ধরে ছুটে চললাম গন্তব্যের দিকে।

আমাদের প্রথম গন্তব্য রাভাংলা। পাহাড়ি এই জনপদটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। শিলিগুড়ি থেকে এর দূরত্ব একশ একুশ কিলোমিটার। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, পানডিম, সিনিয়ালচু কিংবা কাবরু পর্বতশীর্ষ খুব স্পষ্ট দেখা যায়। পাহাড়ের বুকে হোটেল, রেসেত্মারাঁ, বাজার, যানজটঘেরা শহুরে পরিবেশ আমার বরাবরের না-পসনদ্। ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছুটা দূরের নিরালা একটি অতিথিনিবাসই আমরা বুক করে এসেছিলাম কয়েকটা দিন কাটানোর জন্য।

নিবাসের প্রশস্ত টেরাসে এসে দাঁড়াতেই নিমেষে জুড়িয়ে গেল মনটা। পথশ্রমের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। দিকচক্রবালে উঁচুনিচু পাহাড়রেখা। নীল ক্যানভাসে আঁকা তুষারধবল শৃঙ্গরাজি। মেঘছায়ার অবিরত লুকোচুরি খেলা। সবুজ বনানীর চিরন্তন সমাহার, আবছায়া এক সৌন্দর্য নিয়ে যেন প্রকৃতি নিজেকে উন্মোচিত করল আমাদের সামনে।

‘সার, লাঞ্চ আ গয়ে’ – মাথাটা ঘুরোতেই দেখি পাহাড়ি একটি মেয়ে আমাদের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বছর ত্রিশেক বয়স। পরনে ফেডেড জিন্স। রঙিন টি-শার্ট। সঙ্গে লোমশ একটা কুকুর। গরম গরম ভাত, রঙিন টি-শার্ট, পোস্তর বড়া, ডাল, চিকেন স্টু  – একে একে গুছিয়ে রাখল ডাইনিং টেবিলে। যত্নসহকারে খাবার পরিবেশন করতে-করতে ও আমাদের সঙ্গে গল্পগুজব করল কিছুক্ষণ। জানলাম, মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল ওর। স্বামী ট্রাক ড্রাইভারের কাজ করত। একটা পথদুর্ঘটনায় দুটো পা জখম হওয়ায় অল্প বয়সেই পঙ্গু হয়ে গেছে সে। বছর দশেকের এক ছেলেকে নিয়ে জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে মেয়েটি। মাইল চারেক দূরে ছোট্ট একটি পাহাড়ি গ্রামে থাকে। ট্যুরিস্ট সিজনে হোটেলের রান্নাবান্না করা, অতিথিদের দেখভাল করা – এই-ই মূলত তার কাজ। অন্যান্য সময় এলাচ চাষের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

কথা বলতে-বলতে দেখি মেঘলা হয়ে উঠল পরিবেশ। এক টুকরো মেঘখ- এসে ঝাপসা করে দিল হোটেলের ডাইনিং হলটাকে, কী আশ্চর্য এক পরিস্থিতি! আমরা পরস্পরের কথা শুনতে পাচ্ছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না কাউকে। একটা জলীয় বাতাবরণ ক্রমেই গ্রাস করে নিতে লাগল আমাদের। আমার ছোট ছেলে মৈনাক তো ভয়ে চিৎকারই করে উঠল। হাতটা বাড়িয়ে আমি ওকে কাছে টেনে নিলাম। তারপর ষষ্ঠেন্দ্রিয় সক্রিয় অনাস্বাদিত এক মেঘলোককে অনুভব করতে শুরু করলাম।

 

অপরূপ সূর্যোদয়

পাহাড়ের গা-ঘেঁষে লম্বা-লম্বা লাঠির গায়ে লাগানো আয়তাকার এক-একটি পতাকা। পালি বা নেপালি ভাষায় তার গায়ে নানান সেত্মাত্রকথা লেখা রয়েছে। সারবাঁধা এই পতাকাগুলোর রং কোথাও পুরোপুরি সাদা। আবার কোথাও রঙিন পতাকাগুলো শোভাবর্ধন করছে পরিবেশের। গল্পচ্ছলে ড্রাইভার সাহেবকে এই পতাকাগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি সবিস্তারে আমাকে অবগত করলেন এই ব্যাপারে। জানলাম, এই পতাকাগুলোর স্থানীয় নাম ধ্বজা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কোনো মানুষ মারা গেলে তার আত্মীয়স্বজন মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে এসব ধ্বজা সারবেঁধে পাহাড়ের ধারে-ধারে পুঁতে রাখে। আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে সাধারণত একশ আটটি ধ্বজা পোঁতার চেষ্টা করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে একান্ন বা একুশটি পতাকাও অনেক সময় পোঁতা হয়। অন্যদিকে রঙিন ধ্বজাগুলি পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে পর্বতগাত্রে লাগানো হয়।

ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, ভাষা, সংস্কার নিয়ে গড়ে ওঠা বৈচিত্র্যময় মানব সমাজের কথাই বারবার আলোড়িত করতে লাগল আমাকে। সামান্য কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রকৃতি তথা মানুষজনের কী আশ্চর্যরকম অদলবদল। আজ ভোর চারটেয় উঠে হোটেলের ছাদ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঘিরে অপূর্ব সূর্যোদয় দেখেছি, তার স্মৃতি আজীবন তাড়িত করবে আমাকে। মুহূর্তে-মুহূর্তে বদলে চলা দৃশ্যপট। দিগন্তরেখায় তুষারাবৃত শৃঙ্গরাজিকে ঘিরে কতো না বর্ণের বিচ্ছুরণ! সহস্র হিরের দ্যুতির মধ্যে ধাঁধিয়ে-ওঠা দৃষ্টিবলয়। মনে হচ্ছিল, অবর্ণনীয় এই সৌন্দর্যকে আস্বাদন করার জন্য একটু ভিন্ন মনন নিয়ে প্রকৃতিকে অবলোকন করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র লেন্সবন্দি করে বা ভাষার মাধ্যমে এই লালিমাকে ব্যক্ত করা সম্ভবপর নয়।

যাহোক, দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম বুদ্ধ-পার্কে। ২০০৬ সালে সিকিম গভর্নমেন্ট ও স্থানীয় লোকজনের পৃষ্ঠপোষকতায় অপূর্ব এই স্থাপত্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বুদ্ধের ২৫৫০ জন্মশতবর্ষের স্মারক এই দর্শনীয় স্থানটি এখন রাভাংলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণস্থল হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি ও মন্যাস্ট্রি-সংলগ্ন পার্কটি প্রথমে মোহিত করে তুলল আমাদের। মন্যাস্ট্রির ভেতরে কাচে ঘেরা অনিন্দ্যসুন্দর বুদ্ধ এবং দেয়ালে-দেয়ালে আঁকা পুরাণকথা ও ভাস্কর্যকথন ইতিহাসের পাতায় টেনে নিয়ে গেল স্মৃতিকে। শান্তসমাহিত পরিবেশ স্থিতধী করে তুলল মনকে। অনেকটা সময় নিয়ে আমরা নানা ধরনের গাছপালা, বিভিন্ন আকৃতির ফোয়ারা ও কারুকার্যশোভিত জলাধারগুলোকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখলাম। বয়স্ক শারীরিকভাবে অসমর্থ মানুষজনের জন্য ব্যাটারিচালিত গাড়িরও বন্দোবস্ত আছে এখানে।

খেয়ালই করিনি কখন বিকেল হয়ে গেছে। ফেরার পথে আমরা গেলাম খিয়ানফিলিং কার্পেট সেন্টারে। তিববতী শৈল্পিকে কার্পেট তৈরির বুনন প্রক্রিয়াটি স্বচক্ষে দেখে হোটেলে ফিরে এলাম।

 

গ্রাম-পাহাড়ের দেশে

পরিচিত জায়গাগুলো ছাড়াও রাভাংলাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে যেতে হবে স্থানীয় গ্রামগুলোতে। পাহাড়ের ফাঁকে-ফাঁকে গড়ে ওঠা এই গ্রাম্য প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য সত্যিই মনোরম। বর্ষার প্রারম্ভে দেখি, পাহাড়ের গায়ে-গায়ে বসে গেছে নবসবুজের মেলা। উঁচু-নিচু পথরেখা ধরে হাঁটতে-হাঁটতে বিচিত্র রকমের শ্যাওলা, মস, ফার্ন ও নাম-না-জানা ফুলেদের সান্নিধ্য পেলাম। শাল, পাইন, ঝাউবীথিকাদের কাষ্ঠল সমারোহ ছাড়া নানা জাতের রডোডেনড্রন ও অর্কিডের অপূর্ব বিস্তার অন্য এক জগতে পৌঁছে দিল আমাদের। পাশাপাশি আছে সরল, সদাহাস্য মানুষজন। গো-পালন, চাষবাস  – এসবই প্রধান জীবিকা ওদের। সদালাপী এই মানুষগুলো অতিথি রূপে বরণ করে নিল আমাদের।

এরকম একটি গ্রামের নাম বোরং। পদব্রজে গ্রামীণ প্রকৃতিকে দেখা ছাড়াও এখানকার সিলভার ফলসের শুভ্র জলধারা, বারমেলি ব্রিজের মায়াবী রূপ, রংগীত নদীর ধারের চা-চু উষ্ণ প্রস্রবণ দেখে অর্ধেক দিন অতিবাহিত করে দিলাম আমরা। এরপর ফ্যামট্যাম গ্রামে গিয়ে এলাচের চাষ স্বচক্ষে দেখলাম। শেষে গেলাম রালাং মন্যাস্ট্রি দেখতে। তিববতের উদ্দেশে চতুর্থ চোগ্যালের (chogyal) সফল তীর্থযাত্রার স্মৃতির স্বার্থে এটি তৈরি করা হয়েছিল। মন্যাস্ট্রির বুদ্ধমূর্তিটি ও দুষ্পাপ্য বেশকিছু পেইন্টিং এখনো চিরায়ত শিল্পকলার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। প্রায় শখানেক সন্ন্যাসীকে এখানে বৌদ্ধধর্মের দীক্ষা দেওয়া হয়।

প্রকৃতির সান্নিধ্য ছাড়াও যারা একটু অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ আস্বাদন করতে চান, তাদের জন্য নানা ট্রেকিং রুট খোলা আছে রাভাংলায়। নিকটস্থ মিনাম স্যাংচুয়ারি থেকে আট দিনের পদযাত্রা শেষে বোরংয়ের ভঞ্জন ভ্যালিতে পৌঁছানো যায়। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ছাড়াও হামিং বার্ড, সান বার্ড, ফ্লাই ক্যাচার, থ্রাশ বার্ড, পাহাড়ি বাবুই, কাঠঠোকরা, কোকিল প্রভৃতির উপস্থিতি টের পাবেন পক্ষীপ্রেমীরা। এছাড়া ছোট শৃগাল, হরিণ বা বাইসনেরও দেখা মিলতে পারে। এক-একটা আদর্শ ইকো-টুরিজমের ক্ষেত্র হিসেবে জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

 

আকাশচুম্বী

নেপালি ভাষায় নামচি শব্দটির অর্থ হল আকাশচুম্বী (sky high)। দক্ষিণ সিকিমের জেলাসদর হিসেবে জায়গাটি বিখ্যাত। এনজিপি থেকে এর দূরত্ব নববই কিলোমিটার এবং রাভাংলা থেকে ত্রিশ কিলোমিটার। উচ্চতা পাঁচ হাজার পাঁচশো ফুট। বছরভর জায়গাটি ঘিরে নানা উৎসব সংগঠিত হয়। যেমন ফুল-উৎসব, খাদ্য-উৎসব। প্রতিবছর অক্টোবরে নামচি মহোৎসব পালন করা হয়।

নির্মীয়মাণ বাইচুং স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে নামচির মানুষজনের মধ্যে মিশ্র এক সংস্কৃতির ছোঁয়া দেখতে পেলাম। আপাতসরল মানুষগুলোর মধ্যেও চোখে পড়ল হাতে-পিঠে ট্যাটু-আঁকা কয়েকজন যুবক-যুবতীকে। মোটরবাইকে সওয়ারি হয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ি বাঁকগুলোতে পেরিয়ে চলছে ওরা। বিকট শব্দে ঝালাপালা করে দিচ্ছে পরিবেশের নিস্তব্ধতাকে। ভয় হচ্ছিল, যে-কোনো সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বড় বড় মেট্রোপলিস কিংবা আধা-শহরেও আজকাল এই উচ্ছৃঙ্খল বাইক-আরোহীদের দৌরাত্ম্য প্রাণঘাতী হয়ে দেখা দিচ্ছে বারবার। ভাবছিলাম, তবে কি অপসংস্কৃতি ধীরে ধীরে কলুষিত করতে শুরু করছে পাহাড়ের নির্মল পরিবেশকেও?

নামচিতে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল পবিত্র ‘চারধাম’ পরিদর্শন করা। প্রায় ঊনত্রিশ একর জায়গার ওপর নির্মিত এই তীর্থক্ষেত্রটি নামচি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। মূলত সিকিম সরকারের অর্থানুকূল্যে এটি তৈরি করা হয়। ২০১১ সালের ৪ নভেম্বর সিকিমের প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার চ্যামলিং মন্দিরটির দ্বারোদ্ঘাটন করেন। সোলোফক (solophok) পর্বতে অবস্থিত এই তীর্থক্ষেত্রটির প্রধান আকর্ষণ হল একশ আট ফুট উঁচু শিবের মূর্তিটি। এই মূর্তিটি ঘিরে বারোটি জ্যোতিলিঙ্গের মন্দির তৈরি করা হয়েছে। গুরু শঙ্করাচার্য এই মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

দু-একবার চা-পর্বের পর মন্দিরে পৌঁছতে-পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। কবোষ্ণ আবহাওয়ায় মন্দিরপ্রাঙ্গণে ঢুকতেই দেখলাম বিশাল হলঘরে চারটি ধামের ক্ষুদ্র সংস্করণটি সযত্নে রাখা হয়েছে। এই চারটি ধাম হল – বদ্রীধাম, জগন্নাথ ধাম, দ্বারকাধাম ও রামেশ্বর ধাম। প্রথম তিনটি ধাম ভগবান বিষ্ণুর নামে উৎসর্গীকৃত। চতুর্থ রামেশ্বর ধামে ভগবান শিবের মাহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়া ‘চারধামে’ একটি সাঁইবাবার মন্দির আছে। প্রায় সতেরো ফুট উঁচু কিরাতেশ্বরের মূর্তি ও তৎসংলগ্ন যজ্ঞকু-টিতে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়।

প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে পাহাড়ের কোলে নির্মিত এই সুন্দর মন্দিরপ্রাঙ্গণটি ঘুরে দেখলাম আমরা। মনে হচ্ছিল, কোনো স্বর্গভূমে যেন বিচরণ করছি সবাই। হালকা মেঘের আস্তর বারবার ঝাপসা করে দিচ্ছিল শিবের মুখম-লকে। বিভিন্ন ধরনের বাহারি গাছ বা ফুলের সমারোহের মধ্যে ব্রহ্মকমল ফুলটি আমাদের মুগ্ধ করে তুলল। সাদা বড় বড় ছড়ানো পাপড়িকে কেন্দ্র করে মধ্যকার পরাগদ-টি ও রেণুদের ভেতর থেকে অদ্ভুত এক সুরভি নির্গত হচ্ছিল। সেই সুগন্ধে উতলা ভ্রমরদের দেখলাম ফুলেদের আশপাশে ঘুরে বেড়াতে।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে পুণ্যার্থীরা এখানে পুজো দিতে আসেন। ওদের জন্য একশ বেডের যাত্রীনিবাসও এখানে তৈরি করা হয়েছে। আছে বিশাল কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। মন্দির-সংলগ্ন রেসেত্মারাঁ থেকে নিরামিষ আহারাদি সেরে এরপর আমরা পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চললাম।

নামচির সাঁইমন্দিরটি সিকিমে সাঁইবাবার প্রথম পীঠস্থান। কারুকাজশোভিত সোনালি রঙের ওই মন্দিরটির একতলায় প্রার্থনালয় ও দোতলায় সাঁইয়ের আবক্ষ মূর্তি রাখা আছে। এছাড়া পুরাণের দশাবতারের ইতিকথা চিত্রময় শিল্পকলার মাধ্যমে দেয়ালে অঙ্কিত করা হয়েছে। সাঁইমন্দির দেখার পর রক গার্ডেন ছুঁয়ে আমরা গেলাম সামড্রুপসি পর্বতে (wish fulfilling hill) নির্মিত গুরু পদ্মসম্ভবার একশ পঁয়ত্রিশ ফুট উঁচু মূর্তিটি চাক্ষুষ দেখতে। ১৯৯৬ সালে দালাইলামা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।

বিকেল গড়িয়ে গেছে তখন। শেষ গন্তব্য টেমি টি-এস্টেটে পৌঁছে গেছি আমরা। ১৯৬০ সালে নির্মিত এই চা-বাগানে চা-পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজটিও সম্পন্ন হয়। একঢালে চাষ হওয়া এই অপূর্ব বাগানটি ঘুরে নিকটবর্তী একটি রেসেত্মারাঁয় বসে চা খাচ্ছিলাম। দেখি একদল পাহাড়ি ছেলে ফুটবল হাতে বাড়ি ফিরছে। ময়ূখ ও মৈনাককে নিয়ে একটি গ্রম্নপ ফটো তুলব বলে ইশারা করলাম ওদের; আমাকে ভ্রূক্ষেপ না করে দৌড় লাগাল ওরা। আমিও খপ করে ওদের একজনের হাতটা ধরতে যেতেই ছেলেটি শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে একটা চা-গাছের ওপর গিয়ে পড়ল। অদ্ভুত কায়দায় শরীরটাকে বিছিয়ে নিমিষে অন্তর্হিত হয়ে গেল। ওর পলায়নপর শরীরী বিভঙ্গের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম আমি। বুঝলাম, বাইচুং ভুটিয়ার দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

 

অ্যালবামে দেখা

উত্তরবঙ্গ ঘুরতে আসার আগে একাকী বসে একদিন অ্যালবামের পাতা ওলটাচ্ছিলাম। সাদা-কালো মলিন একটা ছবি মন কেড়ে নিল আমার। হোটেলের বিছানায় বসে একজন ঋষির মতো ধ্যান করছি আমি। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বরফঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা। একরাশ স্মৃতি সেদিন হামলে পড়েছিল মনের ভেতর।

বছর কুড়ি সময়ের তফাৎ। বন্ধু মনোজিৎকে নিয়ে দার্জিলিং হয়ে পেলিং গিয়েছিলাম সেবার। মাত্র দুটি হোটেল ছিল তখন। সুনসান রাস্তাঘাট। সন্ধ্যার পর কুয়াশা আর অন্ধকারে ঢাকা পড়ত পেলিং। কুমারী ওই প্রকৃতির মধ্যে তিনটে দিন কী সুন্দরভাবে যে অতিবাহিত করেছিলাম আমরা, ভাবলেই উদ্বেল হয়ে ওঠে ভেতরটা। সেই মনোজিৎ আজ পুনেতে সফট্ওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। আর আমি!

না-না। স্মৃতি ঘেঁটে আর লাভ নেই। বিপণনের এই দুনিয়া তো গ্রাস করছে সমগ্র বিশ্বকেই। প্রকৃতিকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে এগিয়ে চলেছে সভ্যতা। নিত্যনতুন হোটেল, রেসেত্মারাঁ, বাজার, রাস্তাঘাট। বাণিজ্য, শুধুই বাণিজ্যের হাতছানি। পেলিং এখন লোয়ার পেলিং আর আপার পেলিংয়ে বিভক্ত। লোয়ার পেলিং জমজমাট একটি পাহাড়ি লোকালয়ে রূপান্তরিত। তুলনায় আপার পেলিং এখনো খানিকটা ফাঁকা-ফাঁকা। তবু পেলিং পেলিং-ই। পেলিং থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্যই আলাদা।

এন-এইচ-৫১০ ধরে এগোতে-এগোতে এই কথাটাই মনে পড়ছিল বারবার। শিলিগুড়ি থেকে প্রায় একশ পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই জনপদটির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭২০০ ফুট। রাভাংলা থেকে এর দূরত্ব পঞ্চাশ কিলোমিটার। শীতকালে বরফে ঢেকে যায় পেলিং আবার বসন্তে কোকিলের কুহু রব শোনা যায়। যেসব পর্যটক সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার সূর্যোদয় দেখার পর সারাদিন ধরে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ঘুরে বিকেলে মার্কেটিংয়ে গা-ভাসাতে চান – তাদের পক্ষে পেলিং একটা আদর্শ ভ্রমণের জায়গা।

পথের ক্লান্তি কাটাতে একদিন পেলিং শহরে বিশ্রাম নিলাম আমরা। হেঁটে শহরটাকে ঘুরে-ঘুরে দেখলাম। পরদিন সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়লাম দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখতে। প্রথমে পড়ল সিংগসোর ব্রিজ। পেলিং থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত একশ আটানববই মিটার দীর্ঘ এই ঝুলন্ত ব্রিজটি সিকিমের সর্বোচ্চ ও এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্রিজ হিসেবে পরিচিত। এরপর আমরা গেলাম রিম্বি ও কাঞ্চনজঙ্ঘার জলপ্রপাত দেখতে। পেলিং থেকে বারো কিলোমিটার দূরে রিম্বি নদীর ধারের এই প্রপাতটি গ্রীষ্মকালে কিছুটা শুকিয়ে যায়। তবে ইচ্ছে করলে রিম্বি নদীতে মাছ ধরার অনবদ্য অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করতে পারবেন পর্যটকরা। অন্যদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাতটি পেলিং থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সুউচ্চ পর্বতশীর্ষ থেকে নেমে আসা দীর্ঘ এই জলপ্রপাত ও এর আশপাশের রমণীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ চড়ুইভাতির পক্ষে আদর্শ।

যেতে-যেতে দেখছিলাম মৌসুমির ফেসবুক আর হোয়াট্সঅ্যাপে ঘন- ঘন ভেসে উঠছে আমাদের চলমান যাত্রাপথের ছবি। তারপর লাইক্স আর কমেন্টসের জন্য অপেক্ষা। এরই ফাঁকে সেলফিতে একাত্ম হতে হতে আমরা পৌঁছে গেলাম র‌্যাবডেনট্স রাজত্বের ধ্বংসাবশেষে। পিচ-রাস্তা থেকে প্রায় আধঘণ্টার পথ পদব্রজে যেতে হয় ওখানে। সবুজের ঘন বুনোট, পাখির ডাক, সূর্যের চুঁইয়ে পড়া আলোর ফাঁকফোকর দিয়ে উঁচু-নিচু ওই যাত্রাপথে হেঁটে যাওয়া নিঃসন্দেহে এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। র‌্যাবডেনট্স ১৬৭০ সাল নাগাদ সিকিমের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল। ১৮১৪ সাল পর্যন্ত সিকিমের রাজা সেখানে রাজত্ব করেছিলেন। পাথরের প্রশস্ত চাতাল, ভাঙা দেয়াল ও প্রাচীর, চোরতেন, মন্দির নিয়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন এক রাজত্বের ধ্বংসসত্মূপ ইতিহাসের সাক্ষী করে তুলবে আপনাকে। এছাড়া এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার রেঞ্জগুলোকে খুব স্পষ্ট দেখা যায়।

পেলিংয়ের নিকটস্থ উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ মন্যাস্ট্রিগুলো হলো পিমেঅ্যাংগস্ট মন্যাস্ট্রি, ডাবডি মন্যাস্ট্রি, টাসিডিং মন্যাস্ট্রি। পিমেঅ্যাংগস্ট মন্যাস্ট্রি ১৭০৫ সালে নির্মিত এবং এটি নিংগমা-পা-সেকের অধীনে রয়েছে। তিনতলার স্থাপনাটিতে বহু দুষ্প্রাপ্য পেইন্টিং ও ভাস্কর্যের সমাবেশ রয়েছে। মূলত টা-সাও লামাদের (বিশুদ্ধ লামা) জন্য এটি তৈরি করা হলেও পরবর্তীকালে সব শ্রেণির লামাই এখানে প্রবেশাধিকার পায়। প্রতিবছর জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি মাসে এখানে ধর্মীয় উৎসব ‘চাম’ পালিত হয়। ডাবডি মন্যাস্ট্রির প্রচলিত নাম হল উকসাম মন্যাস্ট্রি। টাসিডিং মন্যাস্ট্রি রাথং চু ও রংগীত নদীর মধ্যবর্তী পর্বতশীর্ষে অবস্থিত। লোককথা আছে যে, গুরু পদ্মসম্ভবা তাঁর তপস্যায় বসার অবস্থান ঠিক করার জন্য বাতাসে একটি তির ছুড়েছিলেন। সেই তিরটি পর্বতগাত্রে যেখানে বিদ্ধ হয়েছিল সেখানেই তিনি তপস্যায় রত হন। সেই স্থানটিতেই পরবর্তীকালে টাসিডিং মন্যাস্ট্রি গড়ে ওঠে।

এরপর ডারাপ ও উকসাম নামের পাহাড়ি গ্রামদুটো পরিভ্রমণ করে আমরা গেলাম খেচিওপালরি লেকটি দেখতে। পিমেঅ্যাংগস্ট মন্যাস্ট্রি থেকে চবিবশ কিলোমিটার দূরে এই লেকটি অবস্থিত। ওপর থেকে দেখলে এই লেকটিকে ভগবান শিবের পদছাপ-সদৃশ লাগে। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের কাছে ওই লেকটি ‘উইশিং লেক’ হিসেবে বিখ্যাত। স্থানীয় মানুষের ধারণা অনুসারে এই লেকের জল স্পর্শ করে কিছু মানত করলে সেটি ফলপ্রসূ হয়। প্রচলিত লোককথা আছে যে, একদিন দেবী তারা জেসটাম দলমা এক সন্ন্যাসীর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁর হাতের পাত্রটিকে জল দিয়ে পূর্ণ করে দিতে অনুরোধ করেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সন্ন্যাসীটি খেচিওপালরি পর্বতে উপস্থিত হন। অগভীর একটি জলাশয়ের কাছে গিয়ে প্রার্থনার পর জল তুলতে যেতেই দেবীর মায়ায় সেটি সুবৃহৎ এক সরোবরে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

খেচিওপালরি লেকে পৌঁছতে-পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। গভীর অরণ্যের মাঝখানে অপূর্বসুন্দর এই সরোবরটি দেখে শান্ত হয়ে গেল মনটা। প্রকৃতির নিভৃতিকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে আরো কাছে এগিয়ে যেতেই দেখলাম কয়েকজন বৌদ্ধ লামা ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জনৈক  পর্যটক অদ্ভুত একটা বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করালেন আমার। সত্যি! আশপাশে এত গাছগাছালি, তবু একটাও পাতা নেই জলের ওপর। শুনলাম জলে পাতা পড়লেই একঝাঁক পাখি উড়ে এসে ঠোঁট দিয়ে সেটিকে তুলে অন্যত্র ফেলে দেয়। মৌসুমিকে দেখলাম দুই ছেলের হাত ধরে এক সন্ন্যাসীর পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে প্রার্থনা শুরু করেছে। সারবেঁধে আরো অনেকে দাঁড়িয়ে পড়েছে মনোবাঞ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে। আমি লেকের পাশ ধরে খানিকটা হেঁটে ফাঁকা একটা জায়গায় এসে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নিথর জলের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম – আমারও কি প্রার্থনা করা উচিত? কী কী চাইব এই পবিত্র সরোবরের কাছে? পার্থিব সুখ, সুঠাম স্বাস্থ্য, সন্তানের উন্নতি – এইসব? না-না। বরং ঈশ্বরকে বলি স্বচ্ছ এই জলের মতো স্থির ও নিষ্কলুষ একটা হৃদয় উপহার দিতে। সামান্য দূষণের শঙ্কা থাকলেও মনপাখিরা উড়ে এসে নির্মল করে দিয়ে যাবে আমার অন্তরটাকে। গতিময় সংসারবৃত্তে আবর্তিত হয়েও বিশুদ্ধ এক জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে পারব সব সময়।

 

প্রয়োজনীয় তথ্য :

 

কীভাবে যাবেন

হাওড়া ও শিয়ালদা স্টেশন থেকে প্রচুর ট্রেন আছে নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়ার জন্য। দার্জিলিং মেল, সরাইঘাট এক্সপ্রেস, কাঞ্চনকন্যা পদাতিক এক্সপ্রেস রাতে ছেড়ে পরদিন সকালে পৌঁছোয়। সকালে ও দুপুরে ছেড়ে একই দিনে পৌঁছোয় হলদিবাড়ি, তিস্তা-তোর্সা কাঞ্চনজঙ্ঘা ও শতাব্দী এক্সপ্রেস। এসপ্লানেড থেকে বিভিন্ন সময়ে সরকারি-বেসরকারি বাসে করেও শিলিগুড়ি যাওয়া যায়। এনজিপি বা শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে যেতে হবে রাভাংলা, নামচি বা পেলিং; এনজিপি থেকে রাভাংলা পাঁচ ঘণ্টার পথ। রাভাংলা থেকে নামচি ও পেলিং যথাক্রমে এক ও দুঘণ্টার পথ।

 

কোথায় থাকবেন

রাভাংলা, নামচি, পেলিংয়ে বিভিন্ন মানের ও দামের হোটেল বা রিসর্ট আছে। রাভাংলার হোটেলগুলির মধ্যে বস্নু স্প্রিং রেসিডেন্সি, দ্য বারফাঙ্গ রিস্ট্রি, হোটেল মিকডি উল্লেখ করার মতন। নামচির হোটেল কাভা সুইট্স, ফ্লেভার ইন, টারিবা উন্নতমানের, পেলিংয়ের হোটেল বস্নু হিলস, হিমালয়ান রিট্রিট অ্যান্ড রিসর্ট, র‌্যাবডেনট্স রেসিডেন্সি সাধ্যের মধ্যে বেশ ভাল হোটেল। r