সিনেমা নিয়ে এক ধ্রুপদী অবলোকন

সুশীল সাহা

নান্দনিকতার বিচারে সিনেমা-শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। শিল্পমাধ্যম হিসেবে এর চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু নেই যে! মহামতী লেনিন-কথিত এই আপ্তবাক্যটি শতবর্ষ অতিক্রান্ত করতে চলল। বস্তুত সারা পৃথিবীতে সিনেমা নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কেবল বিনোদনের উপাদান হিসেবে নয়, শিল্প হিসেবে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন ক্রমবর্ধমান। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এখন সিনেমার জয়জয়কার। নির্মাণে তো বটেই। নানা মাধ্যমে এর প্রদর্শনের আয়োজনও সত্যি সত্যি বিস্ময়কর। কেবল প্রেক্ষাগৃহ নয়, দর্শক এখন সিনেমা দেখে নিজের গৃহকোণে, ল্যাপটপে, কম্পিউটারে এমনকি মোবাইলেও। এই শিল্পের এতটাই গ্রহণযোগ্যতা।

চলচ্চিত্রের সঙ্গে সুরঞ্জন রায়ের সংযোগ বহুকালের। উত্তমকুমারের সঙ্গে একাধিক ছবিতে অভিনয় করাই কেবল নয়, শিশুশিল্পী হিসেবে অনেক ছবিতেই তাঁকে দেখা গেছে। সিনেমা থেকে নাটক এবং নাটকের সূত্রে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য হওয়া। অভিনয়ের পাশাপাশি সিনেমা নিয়ে তাঁর লেখালেখি চলতে থাকে। ফিল্ম সোসাইটিগুলোর বিভিন্ন মুখপত্রে তাঁর লেখা বহু গুণীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই চলচ্চিত্র ও শিল্পীর সংকট ১৯৯৩ সালে বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের শ্রেষ্ঠ বইয়ের সম্মান এনে দেয়। এরপর আর তিনি পেছন ফিরে তাকাননি। পরপর প্রকাশ করেছেন সিনেমা নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। এমনকি ইংরেজিতে রচনা করেন একটি অসামান্য গ্রন্থ Mackbeth on celluloid। ইতোমধ্যে কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রখ্যাত কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে নিয়ে তাঁর একটি অসামান্য নির্মাণ – দুই সংস্কৃতির সেতু। বারবার দেখার মতো এই ছবি।

সিনেমার ঝরণাতলায় শীর্ষক গ্রন্থটি সুরঞ্জন রায়ের ষষ্ঠ গ্রন্থ। এতে সন্নিবেশিত তেরোটি প্রবন্ধ কেবল সুলিখিতই নয়, একই সঙ্গে চিন্তা উদ্রেককারী। মূলত বিদেশি ছবি নিয়ে আলোচনাগ্রন্থ হলেও মাঝেমধ্যেই দেশি ছবির প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি চমৎকারভাবে মিলিয়েছেন বার্গম্যানের ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের নায়ক ছবিটিকে। এছাড়া পিটার ব্রুকের মহাভারত এবং হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ ছবিদুটি তো আগাগোড়াই ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নির্মিত। সিদ্ধার্থ ছবিতে তো রীতিমতো বাংলা গান ব্যবহার করেছেন পরিচালক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরারোপিত এবং তাঁর কণ্ঠে গীত ‘ও নদীরে’ গানটি এই ছবির সম্পদ।

গ্রন্থের শুরুতেই লেখক সিনেমার ঝরণাতলায় শীর্ষক যে-নিবন্ধটি পেশ করেছেন তাকে আমরা এই আয়োজনের ভূমিকা হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। শিল্পমাধ্যম হিসেবে লেখক সিনেমার গুরুত্ব এভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, ‘…শাসক শ্রেণি যেমন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে, সচেতন বুদ্ধিজীবী মানুষও তেমনি চলচ্চিত্রকেই করে তুলতে চায় সংগ্রামের হাতিয়ার। আমাদের দেশের সিনেমা প্রসঙ্গও এই আঘাত-সংঘাতে রক্তাক্ত।’

পাবলো পিকাসোর গুয়ের্নিকা একটি বিখ্যাত ছবি। এই ছবিটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। এটি শুধু ছবি নয়, ১৯৩৭-এ ঘটে যাওয়া গুয়ের্নিকা শহরের ওপর জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতেই তৈরি হয়েছিল অ্যালা রেনের বিখ্যাত স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি গুয়ের্নিকা। ছোট্ট পরিসরে একটি চমৎকার ছবি নির্মাণ করে গেছেন তিনি। ভাবলে অবাক হতে হয় আটষট্টি বছর আগে নির্মিত ছবিটি এখনো কত প্রাসঙ্গিক! কত আধুনিক! এই ছবির ভাষ্য রচনা করে দিয়েছিলেন ফরাসি কবি পল এল্যুয়ার। অরুণ মিত্রের অনুবাদে আমরা তার মর্মকথা জেনেছি বাংলায়।

তোমাদের মৃত্যু এখন দৃষ্টান্ত হবে

হৃৎপিণ্ড দলিত হয়ে মৃত্যু

ওরা তোমাদের কাছ থেকে

তোমাদের প্রাণের অন্নের দাম আদায় করেছে।

চার্লি চ্যাপলিনের সার্কাস একটি অসামান্য ছবি। অন্যান্য ছবির মতো এই ছবিতেও চ্যাপলিন নিজেকে বিপন্ন করে দর্শককে হাসিয়েছেন। কিন্তু এই ছবিতে লেখক আবিষ্কার করেছেন এক অন্য চার্লিকে। তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা টানাপড়েন, দ্বিধাদ্বন্দ্বকে আড়াল করে চার্লি যেন সত্যিকারের এক জীবনশিল্পী হয়ে উঠেছেন। লেখক চ্যাপলিনের হয়ে-ওঠার বৃত্তান্তকে অত্যন্ত সুচারু ভাষায় বর্ণনা করেছেন।

ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর ফারেনহাইট ৪৫১ একটি বিখ্যাত ছবি। মানুষের জ্ঞানপিপাসাকে দমিত করে রাখার যে স্বৈরাচারী প্রয়াস তারই এক শিল্পিত প্রকাশ এই ছবিতে। এ-ছবির নায়ক একজন দমকলকর্মী। তবে সে আগুন নেভানোর কাজ করে না, করে বই পোড়ানোর কাজ। তার নেতৃত্বে এক বাড়ির অভ্যন্তরে নানা জায়গায় লুকিয়ে রাখা বইয়ের বহ্ন্যুৎসব দেখানো হয় পর্দায়। এই ছবি তাই ১৯৩৩ সালের হিটলারের বই পোড়ানোর অনুষঙ্গকে মনে করিয়ে দেয়। মনে করায় বিশ্বব্যাপী জ্ঞানস্পৃহাকে অবদমনের নগ্ন প্রয়াস। লেখক অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য ভাষায় ফ্রান্সের তদানীন্তন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বিশ্লেষণ করেছেন। শুধু এই ছবি নয়, ত্রুফোর লাস্ট মেট্রো ছবিটিকেও অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। এমনকি তাঁর প্রতিবাদী সত্তা যে ক্রমে ধনবাদী ব্যবস্থার চাপে মুখ ঘুরিয়ে সস্তা বিনোদনের কাছে নুইয়ে ছিল একদা, সে-কথা জানাতেও দ্বিধা করেননি লেখক।

স্প্যানিশ সাহিত্যে সার্ভেনতিসের ডন কিহোতে একটি জগদ্বিখ্যাত আখ্যান। ও-দেশে এই আখ্যানের নানা রকম অবয়ব দেখতে পাওয়া যায়। সুখের কথা, এই আখ্যান নানা ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। এই আখ্যান অবলম্বনে বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত হয়েছে নাটক ও চলচ্চিত্র। এমনই একটি চলচ্চিত্র হলো ম্যান অফ লা মাঞ্চা। পিটার ও’টুল এবং সোফিয়া লোরেন অভিনীত ইংরেজি ভাষায় নির্মিত এই ছবি শুধু জনপ্রিয়ই হয়নি, হয়ে উঠেছে এক ধ্রুপদী মাত্রার কাজ। আসলে যুগে যুগে ‘ডন কিহোতে’রা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার স্বপ্ন দেখায়। তার সেই বিখ্যাত গান –

To dream the impossible dream

To fight the unbearable foe

To bear with unbearable     sorrow

To rub where the breave     dare not go.

এই হলো ‘ডন কিহোতে’। সার্ভেনতিসের স্বপ্নচারী নায়ক, যার স্বপ্ন আজো সফল হয়নি।

পিটার ব্রুকের মহাভারত একটি এপিকধর্মী ছবি। কয়েক পর্বে বিভক্ত এই ছবিটি মহাভারতের মতো একটি জটিল শতধা উপাখ্যানে আচ্ছন্ন কাহিনিমালাকে বিন্যস্ত করেছে নিজের মতো করে। ভারতীয় অন্তরাত্মাকে পিটার ব্রুক যেমন বুঝেছেন, তেমন করেই চিত্রিত করেছেন। আমাদের চেনা ছকের কাহিনিতে যেন মিমোকে অন্য এক আলোর রোশনাই। তাই তো এই ছবির পাত্রপাত্রী অতিচেনা হয়েও যেন খানিকটা অচেনা। পাত্রপাত্রী নির্বাচনে ব্রুক তাঁর নিজস্ব ভাবনার পরিস্ফুটন করেছেন। এদের পোশাক, অলংকার, শিরস্ত্রাণ কিংবা আয়ুধ – বই এক অন্য মাত্রার। লেখক মহাভারতের আখ্যান বিন্যাসের চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রাচ্য আত্মার স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। সুখের কথা, প্রতীচ্যের মানুষ হয়েও ব্রুকের চলচ্চিত্রায়ণে আমরা খুশিই হই। বিনির্মাণ হয়েও তাই মহাভারত হয়ে ওঠে উচ্চস্তরের এক শিল্পসমৃদ্ধ ছবি। অবাক লাগে, যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি অভারতীয় হয়েও পরিচালক ভারত আত্মার স্বরূপকে আত্মস্থ করে একে বিনির্মাণ করেছেন। আমাদের এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

সুরঞ্জন রায় দেশি-বিদেশি ছবির প্রাণরসকে আবিষ্কার করে তার মর্মমূলে ঢুকতে চান। তাই তাঁর কলমে তারকোভস্কির ইভান্স চাইল্ডহুড থেকে ভিসকন্তি, মিকোলাস ইয়াৎসা, বার্গম্যান এবং আন্দ্রে হবাইদার ছবির নান্দনিক বিচার করেন। অবাক হয়ে আমরা দেখি, বার্গম্যানের ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজের বৃদ্ধের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের নায়কের জীবনানুসন্ধানের সঙ্গে তিনি যখন তুলনা করে দেখান – মানুষের একাকিত্বের সর্বজনীনতা। লেখক একে এক বিরামহীন পথচলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। লেখকের ভাষায়, ‘পাবলিক সাকসেস আর হিউম্যান ফেলিওরের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে তারা পৌঁছে গিয়েছিল নরকের অতল গহবরে – অপ্রেম থেকে প্রেমের পথে যাত্রা, মৃত্যু থেকে ভালোবাসায় যাত্রা, স্বার্থপরতা থেকে জীবনের পথে যাত্রা তাই হয়ে ওঠে এত জরুরি। যদিও থিমেটিক স্ট্রাকচারের আদলেই দুই শিল্পী তাঁদের সিনেমার শরীরকে সাজিয়েছেন।’ ভালো লাগে এই বিশ্লেষণ।

এই গ্রন্থের শেষ লেখাটি বিশ্ববরেণ্য এক ইতালীয় অভিনেত্রী সোফিয়া লরেনকে নিয়ে। চরম দারিদ্র্যকে যে-মানুষটি খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে তাঁর অভিনীত চরিত্রসমূহে। এ যেন সেই জীবনশিল্পী, যিনি জীবনের নানা কলুষ অনুভবকেও শিল্পের নান্দনিকতায় ভরিয়ে দিয়েছেন। তাই তাঁর অভিনীত চরিত্রেরা হয়েছে জীবন্ত। জীবনের উপান্তে বৈভবের শিখরে উঠেও অভিনেত্রী তাঁর অতীতকে ভোলেননি। তাই তো তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে জীবন্ত।

সুরঞ্জনের এই গ্রন্থটি চলচ্চিত্র শিল্পে আগ্রহী পাঠকদের মুগ্ধ করবে। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মতো এতেও পাঠক পাবেন নান্দনিক অনুভবে ভরা এক পরম রোমান্স।

বিশ্ব-চলচ্চিত্রের অঙ্গন থেকে বাছাই করা এমন সুচয়িত অর্ঘ্যকে তাই জানাই আমত্মরিক অভিবাদন।