সিমাস হিনি

ভূমিকা ও অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী

কবিতা পৃথিবী বদলে দিতে পেরেছে এমন একটি ঘটনার কথাও আমি মনে করতে পারছি না; কিন্তু পৃথিবীতে কী ঘটছে, কবিতা সে-সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে বদলে দিতে পারে।’ – সিমাস হিনি

কবিতার কাছে অসম্ভবের প্রত্যাশা করেননি সিমাস হিনি। পৃথিবী বদলে দেওয়ার বিপ্লব ব্রত করে যাঁরা কবিতা লিখতে বসেছেন, তাঁদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত কিছু  স্লোগান রচনা করেছেন। তাহলে কবিতা কেন? শিল্প কেন?

সিমাস হিনির স্মরণীয় উদ্ধৃতি, দ্য এন্ড অব আর্ট ইজ পিস – শিল্পের শেষই শান্তি।

১৯৯৫ সালে যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন, তিনি নোবেল বিজয়ী চতুর্থ আইরিশ। আগের তিনজন ডব্লিউ বি ইয়েটস, জর্জ বার্নার্ড শ এবং স্যামুয়েল বেকেট। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, এই তিনজনের পাশে নিজের নাম দেখে কেমন বোধ করছেন? তিনি জবাব দিলেন, পর্বতমালার তলদেশে ছোট একটি ঢিবির মতো।

সিমাস হিনি ইয়েটস-উত্তর শ্রেষ্ঠ আইরিশ কবি। কারো কারো মতে, জীবিতদের মধ্যে ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে দীর্ঘদিন নীরবে রাজত্ব করেছেন।

সিমাস হিনির বেড়ে ওঠা

আইরিশ কবি, নাট্যকার, অনুবাদক সিমাস হিনির জন্ম ১৩ এপ্রিল ১৯৩৯, আয়ারল্যান্ডের লন্ডনভেরি কাউন্টির ক্যাসলডাউসন ও টমব্রিজের মধ্যবর্তী মসবৌন খামারবাড়িতে। নয় সন্তানের সবার বড়। বাবা প্যাট্রিক হিনির একটি ছোট খামার থাকলেও তিনি মূলত গবাদিপশুর ব্যবসায় বেশি মনোযোগী ছিলেন। তাঁর মা মার্গারেট ক্যাথলিন নিকটবর্তী সম্ভ্রান্ত জ্যাককান পরিবারের সদস্য। এই পরিবারটি যত না ঐতিহ্যবাহী আইরিশ গ্রামীণ অর্থনীতির ধারক, তার চেয়ে বেশি সম্পৃক্ত শিল্পনির্ভর আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে। এই পরিবারের মালিকানাধীন কিছু ছোট কলকারখানা ছিল। সিমাস হিনি মনে করেন, বাবার দিক থেকে তিনি পেয়েছেন গো-পালনের গেইলিক অতীত-ঐতিহ্য আর মায়ের দিক থেকে এসে যোগ হয়েছে শিল্প-বিপ�ব – কাজেই তাঁর প্রেক্ষাপটে রয়ে গেছে একটি অন্তর্গত দ্বন্দ্ব – আপাতদৃষ্টিতে তা কৃষি ও শিল্পের, কিন্তু নিজের জীবনে তা দেখা দিয়েছে মুখরতা ও নীরবতার দ্বন্দ্ব হিসেবে। প্যাট্রিক হিনি যতটা সম্ভব কথা এড়িয়ে চলতেন, মার্গারেট ক্যাথলিন ততই কথা বলতে চাইতেন। কাজেই  ঝগড়াটা নিত্যকার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। এ দুইয়ের সমন্বয় সিমাস হিনির ভেতরে সৃষ্টি করেছে নিজের সঙ্গে ঝগড়া করার একটি আবহ – সেখান থেকেই উঠে এসেছে তাঁর কবিতা।

গ্রামের ছেলে হিসেবে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার  শুরু। তাঁর যখন জন্ম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের তখনই সূচনা। আমেরিকান সৈন্যরা স্থানীয় মাঠে প্রস্ত্ততি নিচ্ছে, তারা নরম্যান্ডি আক্রমণ করবে। তাদের আস্তানা ছিল হিনির গ্রাম থেকে এক মাইলের মধ্যে তৈরি একটি অ্যারোড্রামে। যুদ্ধ তাঁর স্মৃতিতে জাগ্রত – এখান থেকে তিনি তুলে এনেছেন ইতিহাস ও অজ্ঞতার আখ্যান। ১৯৫৩-তে খামারবাড়ি ছেড়ে বাবার সঙ্গে আরো দূরে বিভিন্ন স্থানে থাকলেও গ্রামীণ ভেরি কাউন্টি রয়ে যায় তার ‘মানস দেশ’ হিসেবে। সেই মানস দেশেই সিমাস হিনির কবিতা প্রোথিত।

বারো বছর বয়সে বৃত্তি পেয়ে বাড়ি থেকে চলি�শ মাইল দূরে ভেরি শহরের ক্যাথলিক বোর্ডিং স্কুলে পড়তে যান। সে-সময়ে তাঁর চার বছর বয়সী ভাই ক্রিস্টোফার  সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে দুঃসহ একটি বেদনাও কৈশোর থেকে লালন করতে থাকেন। ভাইকে নিয়ে তাঁর স্মরণীয় কবিতা ‘মিড-টার্ম ব্রেক’ এবং ‘দ্য ব্ল্যাক বোর্ড অব গ্লানমোর’।

১৯৫৩-তে চলে এলেন বেলফাস্টে, কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়বেন। টেড হিউজেসের একটি  কাব্যগ্রন্থ হাতে এলে ভাবলেন, তিনিও তো এমন কবিতা লিখতে পারেন। শুরু তখনই। কিন্তু টেক্সট বই ছেড়ে বোহেমিয়ান জীবনে প্রবেশ করে নয়। ১৯৬১ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অসাধারণ ছাত্র’ বিবেচিত হন, পুরস্কারের টাকায় কেনেন লুই ম্যাকনিস, জে. এম. সিঙ্গে এবং অস্কার ওয়াইল্ডের বই। প্রথম শ্রেণির অনার্স ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেন। পেশা হিসেবে নিলেন শিক্ষকতা। স্কুলেই ল্যাটিন ও আইরিশ ভাষাচর্চা শুরু করেন। বেলফাস্টের সেন্ট থোমাস সেকেন্ডারি ইন্টারমিডিয়েট স্কুলে শিক্ষকতার সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক লেখক মাইকেল ম্যাকলেভার্টি তাঁকে প্যাট্রিক কাভানাগের কবিতার সঙ্গে পরিচিত করান। ম্যাকলেভার্টির প্রেরণায় তাঁর কবিতার প্রকাশনা ১৯৬২ সালে। সিমাস হিনি পরবর্তীকালে তাঁর এই ‘প্রিয় শিক্ষক’ ‘প্রিয় পালক পিতা’ কবি মাইকেল ম্যাকলেভার্টির রচনাসংগ্রহ সম্পাদনা করেন। হিনির কবিতা ‘ফস্টারেজ’ এবং ‘সিংগিং স্কুল’ তাঁকে নিয়েই রচিত।

সিমাস হিনির প্রথম প্রধান কাব্যগ্রন্থ ডেথ অব অ্যা ন্যাচারালিস্ট ১৯৬৬ সালে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ফেবার অ্যান্ড ফেবার প্রকাশ করে। আগের বছর প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ এলিভেন পোয়েমস। তাঁর কবিজীবনের শুরুতে একে আরো অর্থবহ করে তোলেন স্কুল শিক্ষয়িত্রী ম্যারি ডেভলিস। দুজনের সম্পর্কের নৈকট্য বিয়েতে গড়ায়। ম্যারি পরিচিত হয়ে ওঠেন ম্যারি হিনি নামে। তিনিও লিখতে শুরু করেন, ধ্রুপদ পুরাণ নিয়ে তিনি লিখেছেন আইরিশ মিথস অ্যান্ড লিজেন্ডস। কবির পেশাগত জীবন, তাঁর কল্পলোক এবং কবিজীবনের প্রধান সহায় ম্যারিকে ঘিরেই তাঁর জীবন আবর্তিত। হিনি ছয় বছর কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করে সাহিত্য পড়াতে চলে যান হার্ভার্ডে। পাঁচ বছরমেয়াদি গৌরবজনক পদ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রফেসর অব পোয়েট্রি’ হিসেবে ১৯৮৯-৯৪ অধিষ্ঠিত থাকেন। ‘গীতিময় সৌন্দর্য ও নৈতিক গভীরতাসম্পন্ন যে-রচনা নিত্যকার দৈব এবং যাপিত অতীতকালকে উদযাপিত করে’ – সেজন্য সিমাস হিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান ১৯৯৫ সালে।

সিমাস হিনির প্রধান কাব্যগ্রন্থ

ডেথ অব অ্যা ন্যাচারালিস্ট (১৯৬৬), ডোর  ইনটু দ্য ডার্ক (১৯৬৯), উইন্টারিং আউট (১৯৭২), স্টেশনস (১৯৭৫), নর্থ (১৯৭৫), ফিল্ড ওয়ার্ক (১৯৭৯), স্টেশন  আয়ল্যান্ড (১৯৮৪), দ্য হঅ ল্যান্টার্ন (১৯৮৭), সিয়িং থিংগস (১৯৯১), দ্য স্প্রিং লেভেল (১৯৯৬), ইলেকট্রিক লাইট (২০০১), ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড সার্কেল (২০০৬), হিউম্যান চেইন (২০১০)।

গ্রিক নাট্যকার সফোক্লেস ফিলোকটেটস অবলম্বনে তাঁর নাটক দ্য কিউর অ্যাট ট্রয় (১৯৯০) এবং অ্যান্টিগোন অবলম্বনে দ্য বেরিয়াল অ্যাট থেবস (২০০৪)।

তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ চারটি এবং অনূদিত গ্রন্থ তেরোটি, স্মারক প্রবন্ধ ও অভিভাষণ নিয়ে প্রায় সত্তরটি পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়েছে।

৩০ আগস্ট ২০১৩ সালে সিমাস হিনি ৭৪ বছর বয়সে তাঁর দীর্ঘদিনের আবাসভূমি ডাবলিনে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি যে ইয়েটস-পরবর্তী শ্রেষ্ঠ আইরিশ কবি এই স্বীকৃতি অনেক পুরনো, জীবিত কবিদের মধ্যে তিনিই ছিলেন ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ – এ দাবি নস্যাৎ করতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

তাঁকে বলা হয়েছে একটুখানি বেশি আইরিশ – বস্ত্তত তিনিও এভাবেই পরিচিত হতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতায় আয়ারল্যান্ডের আরণ্যক সৌন্দর্য উঠে এসেছে, বিদীর্ণ মানুষের যন্ত্রণার পুনর্লিখন ঘটেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর মানবিক অন্তর্দৃষ্টি প্রশংসিত হয়েছে সর্বত্র। তিনি অভিযুক্তও হয়েছেন। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির লাগাতার আন্দোলনে তিনি শরিক হননি – উলটো দোষারোপ করে বলেছেন, সহিংসতা কখনো উৎপাদনশীল হতে পারে না।

জঙ্গি আইরিশ না হয়ে ওঠার যে অভিযোগ সিমাস হিনি তার জবাব দিয়েছেন ‘একটি খোলা চিঠি’ নামের কবিতায়।

আমার  পাসপোর্টের রং সবুজ

আমাদের গ্রাম কখনো রানির কল্যাণ কামনায় উঁচু করা হয়নি

আবার আইরিশ সন্ত্রাসীদের যথেষ্ট নিন্দা না করার অভিযোগ এলে চার্লস মুর তাঁকে বলেছেন ধূর্ত। ‘পায়ের তলায় শক্ত মাটি তবু বড় ধূর্ত’ – এই পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, এটা হিনির বেলাতেই লাগসই।

সিমাস হিনির প্রিয়

শহর : সেন্ট পিটার্সবার্গ

দশ বছর আগে আমি পিটার্সবার্গ যাই। শহরটি নিয়ে আমার আগ্রহের কারণ এই শহরের দুজন কবি মান্দেলস্তাম এবং আখমাতোভার কবিতা আমি পড়ে আসছিলাম। সুন্দর প্রেক্ষাপটে এ এক চমৎকার শহর – অবরোধের (১৯৪১-৪৪-এর লেনিনগ্রাদ) মধ্যে শহরটি মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে, আর সময়ে প্রতিটি বাঁকে দাঁড়িয়েছে সাহিত্য সংঘ। তথাকথিত ‘দস্তয়েভস্কি যুগ’ রয়েছে এবং রয়েছে নেভস্কি প্রসপেক্ট। মান্দেলস্তাম কবিতা লিখেছেন ‘অ্যাডমিরালটি বিল্ডিং’ নিয়ে, পুশকিনের কবিতা সেন্ট পিটার দ্য গ্রেটকে নিয়ে। আমরা জোসেফ ব্রডস্কির অ্যাপার্টমেন্ট ঘুরে এসেছি। আমরা তাঁকে আমেরিকাতে চিনতাম, তিনি যে সোভিয়েতে ‘দেড় কক্ষের ঘরে’ বেড়ে উঠেছেন, তার কথা লিখেছেন। সেখানে তাঁর এক  বন্ধুর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে। জোসেফ ব্রডস্কিকে যেদিন নির্বাসনে পাঠানো হয়, সেদিন তিনি তাঁর ছবি তুলেছিলেন। তিনি কেক বানালেন, ভোদকা ছিল, আমরা জোসেফের স্মৃতি স্মরণ করে একটি ছোট্ট আয়োজন করে ফেললাম।

শিল্পকর্ম : খ্রিষ্টের ওপর কশাঘাত

আমি এমন একটা ছবি বেছে নিয়েছি যা পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। আর কোনো ছবিতে যদি খ্রিষ্টের কশাঘাত দেখে থাকেন, তাহলে তিনি ছবিতে ঠিক আপনার সামনে। কিন্তু এই ছবির চিত্রকর পিয়েরো দেল্লা ফ্রান্সেসকা তাঁর আঁকা ছবিতে খ্রিষ্টকে দৃশ্যমান একটি বিলুপ্তি বিন্দুতে স্থাপন করেছেন আর তা এই চিত্রকর্মটিকে এক অপার্থিব আবহ প্রদান করেছে। তা কার্যত এক খ্রিষ্টীয় প্রতিমা, কিন্তু সাধারণ পরিচিতির বৃত্তের বাইরে।

দৃশ্য : সানফ্রান্সিসকোতে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উত্তরাংশ।

আমার জন্য সুবিধাজনক অবস্থান হচ্ছে গ্রিজলি পিক বুলেভার। ওখান থেকে নিচে পুরো উপসাগরের ওপর চোখ রাখা যায় – দেখা যায় সানফ্রান্সিসকো ও গোল্ডেন গেট ব্রিজ। মনে আছে, এক গ্রীষ্মের সকালে, দৃশ্যটিতে সূর্য সাদা টেরাস আর শহরের টাওয়ার ব�কগুলোর ওপর আলোকসম্মাত করছে। বিপুল বিস্ময় নিয়ে আমি ভেবেছি, নারী-পুরুষ মিলে এ কী সৃষ্টি করেছে। এটা তো বুজুর্গদের যিশুখ্রিষ্টের কাছে আগমন-মুহূর্তের মতো, এ তো ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ উদ্ভাসিত হওয়ার মতো একটি ব্যাপার।

সৌধ : প্যান্থিয়ন

আমার বয়স পঞ্চাশ বছর হওয়ার আগে আমি রোমে যাইনি; প্যান্থিয়নের কথা আমি অবশ্যই পড়েছি; কিন্তু বাস্তবে এর প্রকৃত বিশালত্ব, এর ব্যাপকতা ও গুরুত্ব, হাজার হাজার বছর ধরে মাথা উঁচিয়ে টিকে থাকার মহিমা – সবই আপনার ভেতর প্রবেশ করে যায়। এটা আপনাকে সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত করে। এর ভেতরে মহান এক সৌন্দর্য, বিশাল হয়েও সুন্দর। সামনের উঠানে বসে প্যান্থিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার মধ্যে এক দৃঢ়তার অনুভূতি এনে দিয়েছে।

হোটেল : বলোনিয়ার হোটেল ওরোলোজিও

পিয়াৎজা ম্যাজ্জিয়োরের প্রান্তে এই হোটেলটি ছোট্ট কিন্তু স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছে। নিতান্ত অজ্ঞাত মানুষের মতো এখানে থাকা যায়। আমি বলোনিয়া শহরটিকে পছন্দ করি। এখানে সংস্কৃতির বড় বড় মাস্ত্তল নেই। আপনি সবকিছু ঘুরেফিরে দেখতে পারেন, আরো কেন দেখা হলো না সে অপরাধবোধ আপনার মনে জাগবে না। ফ্লোরেন্স ও রোমে কাজের তালিকাটি দীর্ঘ, কিন্তু বলোনিয়াতে সাংস্কৃতিক দায়িত্বের চাপ নেই।

সৈকত : ভেরি কাউন্টিতে পোর্টসওয়ার্থ স্ট্র্যান্ড

পোর্টসওয়ার্থ সৈকতেই প্রথম সমুদ্রের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। মাইলের পর মাইল দীর্ঘ বালিয়াড়ি-বাঁকে সমুদ্র আছড়ে পড়ছে। এটা আমার মধ্যে আদি বিস্ময়ের একটি অনুভূতি সঞ্চার করে রেখেছে – আর সে-সঙ্গে সৈকতে দেহলগ্ন মানব-মানবী জোড়ের অবস্থান তো রয়েছেই।

ভ্রমণ : পেলোপোনেস উপদ্বীপে ভ্রমণ

গ্রিসের পার্বত্য পেলোপোনেস সফরে যাই ১৯৯৫ সালে। পৌরাণিক নামের স্থান আর্গোস, নেমিয়ার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকি। নেমিয়াতে হেরাক্লেস সিংহের সঙ্গে লড়াই করেছে – এগুলো সত্য কিনা, এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমরা যখন আর্কেডিয়ায় প্রবেশ করি গোটা রাস্তায় আপেল ছড়িয়ে আছে। নিশ্চয় কোনো লরি থেকে পড়ে গেছে। কচমচে আপেলের ওপর দিয়ে আমাদের গাড়ি যায়। আর্কেডিয়ায় দুর্ভাগ্য, সৌভাগ্য, অভিশাপ, আশীর্বাদ সবই আছে। যখন পাইলসে পৌঁছি, দেখি, সবাই আমার খোঁজ করছে। এমনকি সুইডিশ অ্যাকাডেমিও (নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটা তখন পৌঁছে)।

ভ্রমণ সংক্ষেপ করে হেলিকপ্টারে আমায় এথেন্স চলে আসতে হয় – কিছুটা ব্যথিত; আবার কৃতজ্ঞবোধ করি যে, নিজেকে সমন্বিত করতে এতোটা সময় পেয়েছি।

মুকুট পরিহিত কবি

ছোট ছোট সাম্রাজ্যের মধ্য দিয়ে আমি দক্ষিণে চলে যাই

(এন্টারপ্রাইজে চড়ে বেলফাস্ট থেকে ডাবলিন)

আমার সম্রাটের নতুন বারান্দায় প্রোজ্জ্বল

ঈশ্বরগণ নিজেদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মেট্রোনোম

এবং মাত্রা, স্মৃতি ও ব্যুৎপত্তির ট্যাটু পবিত্র ঢোলের ওপর

হাঁটুর ওপর দাঁড়িয়েছে যেমন কতিপয় জাতি, তেমনি চমৎকার :

চিৎকার করে আমাদের নাম জানা হয় এবং প্রভাব আসে

যখন একঘেয়ে মাঠের কোথাও

রাখাল এবং ছেলে কোলে তার স্ত্রী

তার বিস্ময়কর সৃষ্টির মধ্যে অনবহিত

এখন নিজের নতুন নাম শুনে হতবাক।

তারা নিজেদের ভাবে বিস্মৃত এবং নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে।

 

স্বচ্ছতা

আমি মহাকাশে ঘুরে ঘুরে হেঁটে বেড়ানোর কথা ভেবেছি

সম্পূর্ণ শূন্য, সম্পূর্ণ এক উৎস

যেখানে প্রোথিত চেস্টনাট বৃক্ষ হারিয়েছে তার স্থান

আমাদের সামনে কাঁটাঝোপে দেয়াল-ফুলের সারিতে

সাদা ফালি লাফিয়ে লাফিয়ে ছিটকে ওপরে উঠে যায়

আমি শুনতে পাই কুড়ালের বৈষম্যমূলক আচার

পুঙ্খানুপুঙ্খ কাটা, বৃক্ষের ফেটে যাওয়া, দীর্ঘশ্বাস।

একসময় যা ছিল আনন্দ-উচ্ছল

তা এখন আঘাতপ্রাপ্ত, ধ্বংসাবশেষই সব

গভীরে প্রোথিত এবং

 

ট্রয় নগরীতে উপশম

সফোক্লেসের ফিলোকটেটেস-অডেসির গল্প, কেমন করে ছলচাতুরীর মাধ্যমে অডেসিয়াস একিলিসের পুত্রকে ট্রোজান যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে গ্রিকদের পক্ষে লড়িয়েছেন, সিমাস হিনি সে-গল্পই নতুন করে শুনিয়েছেন তাঁর ‘ট্রয় নগরীতে উপনাম’ নামে দীর্ঘ কবিতায়। কবিতার একাংশ অনূদিত :

মানবজাতির ভোগান্তি হয়

তাদের একজন অন্যজনের ওপর নির্যাতন চালায়

তারা আঘাত পায় এবং কঠোর হয়ে ওঠে

কোনো কবিতা বা নাটক বা গান

ভুলকে কখনো পুরোপুরি শুদ্ধ করতে পারে না,

বেদনাহত হয় এবং সহ্য করে নেয়।

 

নিষ্পাপ যায় কারাগারে

একসাথে গরাদে মাথা ঠুকে

একজন অনশনকারীর পিতা

কবরস্থানে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে

ঘোমটা টানা পুলিশের বিধবা স্ত্রী

শেষকৃত্যালয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।

 

ইতিহাস বলে, আশা করো না

কবরের এই পাশটিতে

তারপর জীবনে একবারই

দীর্ঘ প্রত্যাশিত জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ

ওপরে উঠে যেতে পারে।

এবং তখন আশা ও ইতিহাসের ছন্দ জন্ম নেয়।

কাছে বিশাল সাগরপ্রমাণ প্রত্যাশা

যাকে প্রতিশোধের দূরবর্তী প্রাতে

বিশ্বাস করে যে দূরের তীরে

এখান থেকে পৌঁছা যায়।

অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করে

অলৌকিক উপশমে আরোগ্য জলে

 

অলৌকিক স্ব-উপশম বলুন

পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশে

বিস্ময়কর অনুভূতিতে বিলম্বিত প্রতীক্ষা

যদি পাহাড়ের ওপর জ্বলে আগুন

কিংবা বিদ্যুচ্ছটা ও ঝড়

এবং আকাশ থেকে ঈশ্বর কথা বলেন

 

তার মানে কেউ শুনছেন

চিৎকার ও জন্মোত্তর ক্রন্দন নতুন জীবনের

তারই শর্তে।

 

সিমাস হিনির নোবেল ভাষণ থেকে

এক. উনিশশো চলি�শের দশকে গ্রামীণ কাউন্টি ভেরির একটি ক্রমবর্ধমান পরিবারে আমি সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, আমরা সকলে তিন কক্ষের ঐতিহ্যবাহী খামার-চালাতে একত্রিত জীবনযাপন করতাম – আমরা একধরনের গুহা-জীবন যাপন করতাম, যে-জীবন বাইরের পৃথিবীর কমবেশি আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক আবহ নিরোধক।

দুই.     (সিমাস হিনির শৈশবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বিবিসি রেডিওর সংবাদপাঠকের কণ্ঠ শুনে) আমাদের বাবা-মায়ের আঞ্চলিক উচ্চারণ থেকে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের নাম জানতে পারি এবং ধ্বনিসমৃদ্ধ সংবাদপাঠকের ইংরেজি শব্দ-ধ্বনি থেকে আমরা বোমারু ও বোমা-পড়া শহরের নাম, রণাঙ্গন ও সেনাবাহিনীর ডিভিশনের নাম, বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ ও যুদ্ধবন্দির সংখ্যা, ভোগান্তি ও অগ্রগতির কথা। অন্যসব শব্দের সঙ্গে পবিত্রজ্ঞানে অদ্ভুত এসব শব্দ আমরা তুলে নিয়েছি – শত্রু এবং মিত্র। তারপরও এসব বিশ্বকে মোচড় দেওয়া ভীতিকর শব্দ হিসেবে আমাদের ভেতর প্রবেশ করেনি।

তিন.   (যুদ্ধের সময়) রেডিওর নির্দেশক বিবিসি থেকে রেডিও আয়ারান পর্যন্ত ঘোরাতে ঘোরাতে বিভিন্ন বিদেশি ভাষার ছোট ছোট বিস্ফোরণ শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম – লন্ডনি স্বর থেকে শুরু করে ডাবলিনের কথার টান – যদিও অনেক সময় এমন শ্রবণে ইউরোপীয় কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত ও শিসধ্বনিযুক্ত শব্দের মানে বুঝিনি, ততোদিনে আমার পৃথিবীর বাইরে বিপুলাবিশ্বে আমার পরিভ্রমণ শুরু হয়ে গেছে।

 

চার. নোবেল ভাষণে উদ্ধৃত একটি কবিতা থেকে

 

প্রদর্শন

আমি যদি উল্কার মতো আসতে পারতাম!

তার বদলে বরং আমি শরতের স্যাঁতসেঁতে পাতা

তুষ, নিষ্প্রাণ পাতা মাড়িয়ে যাই,

 

কোনো কর্দমাক্ত আঙিনায়

একজন নায়ককে কল্পনা করে

তার মেধা গুলতিছোড়া পাথরের মতো

বেপরোয়া ঘুরে বেড়ায়।

 

আমার এমন পরিণতি হলো কেন?

প্রায়ই আমার বন্ধুদের কথা ভাবি

চমৎকার বিচিত্রবর্ণ পরামর্শ

আমাকে যারা ঘৃণা করে তাদের প্রস্তরীভূত মস্তিষ্ক।

পাঁচ. সত্তর বছর আগে ডবি�উ বি ইয়েটস যখন এই প্পাটফর্মে (নোবেল ভাষণ দেওয়ার জন্য) দাঁড়িয়েছিলেন আয়ারল্যান্ড তখন ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের যাতনা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শিগগিরই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে লিপ্ত হয়। যে-সংগ্রাম তখন আপতিত হয় তা সংক্ষিপ্ত ছিল এবং ১৯২৩-এর মে মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এর সাত মাস পর স্টকহোমের পথে ইয়েটসের জাহাজ ছাড়ে। এ-যুদ্ধ ছিল রক্তাক্ত, পাশবিক ও আত্মঘাতী – তারপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ঘটনা আয়ারল্যান্ডের ছাবিবশটি কাউন্টির মধ্যে রাজনীতির দিকনির্দেশনা দিয়ে এসেছে। ফলে এই দ্বীপের একাংশ একসময় হয়ে ওঠে আইরিশ ফ্রি স্টেট এবং পরবর্তীকালে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড। ইয়েটস তাঁর নোবেল ভাষণে গৃহযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা তেমন উলে�খ করেননি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি ও ধ্বংস, সাংস্কৃতিক জীবনের বিকাশ ও বিকাশের মধ্যে যে-সম্পর্ক, তা ইয়েটসের চেয়ে ভালো কেউ বোঝেনি; কিন্তু এই অনুষ্ঠানে অভিভাষণের জন্য তিনি বেছে নিলেন আইরিশ নাট্য-আন্দোলনের মতো একটি বিষয়।

ছয়. (গ্রিক) চারণ কবি ডেমোডোকাস ট্রয়ের পতনে ও পরবর্তী গণহত্যা নিয়ে গান বেঁধেছেন, তা ওডিসিয়াসের কান্না ঝরিয়েছে আর হোমার বলেছেন, তাঁর কান্না রণক্ষেত্রে পরাস্ত ও নিহত সৈনিকের বিধবা স্ত্রীর অশ্রুর মতো হয়ে উঠেছে। তাঁর মহাকাব্যিক উপমার উদাহরণ :

হাঁপাতে হাঁপাতে মৃত্যু-উন্মুখ মানুষটির এই দৃশ্য দেখে

স্ত্রী তার গুটিয়ে আছড়ে পড়ে তার ওপর কাঁদতে থাকে

তারপর অনুভব করে বল্লাম এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে তার

পৃষ্ঠদেশ ও কাঁধ, দাসত্ব ও সন্তাপে বাঁধা পড়ে যায়

গন্ডদেশ বেয়ে নেমে আসে করুণার্দ্র অশ্রু

কিন্তু ওডিসিয়াসের অশ্রুর চেয়ে করুণ নয়

শোকাচ্ছন্ন লেবাসে ছিল যেমন, এখন

এমনকি আজও তিন হাজার বছর পর, বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরিয়ে আমরা সমকালীন নৃশংসতার যে জীবন্ত বিবরণ দেখে থাকি, খুবই অবহিত হই, সবকিছু সয়ে যাওয়ার বিপদ মেনে নিই, শ্রমশিবির আর গুলানোর সংবাদচিত্রের সঙ্গে এতো পরিচিতি গা-সওয়া হয়ে যায়। হোমারের চিত্রকল্প এখনো আমাদের বিবেক জাগাতে পারে।

সিমাস হিনির শেষ কথা

মৃত্যুর আগে সিমাস হিনি তাঁর স্ত্রীকে একটি টেক্সট-বার্তা পাঠান। ল্যাটিনে লেখা এ-বার্তার ইংরেজি অনুবাদ দাঁড়ায় ‘ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড’ – ভয় পেয়ো না। পিতার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তাঁর দেশে মাইকেল হিনি বার্তাটি সকলকে অবহিত করেন। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মিনিট আগে এই বার্তাটি লিখেছেন।

ডাবলিন ক্যাথলিক চার্চ অব দ্য স্যাকরেড হার্টে দেড় ঘণ্টার শেষকৃত্য সকলকেই অশ্রু-ভারাক্রান্ত করে তোলে। সিমাস হিনির দুই পুত্র, কন্যা এবং স্ত্রী ছাড়া অনাড়ম্বর এই বিদায়ী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর জীবনভর বন্ধু ও কবি মাইকেল লংলে, পুলিৎজার বিজয়ী কবি পল মুলডুন, থিও ডোরগান, মাইকেল ও’সিডহাইল এবং প্রথম মহিলা পোয়েট লরিয়েট ক্যারোল অ্যান ডাফি, নাট্যকার ফ্রাঙ্ক ম্যাকগিনেস, ব্রায়ান ফিয়েল, টম মার্ফি ও বার্নার্ড ফেরেল। পাইপারে শোকের সুর বাজান আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পী লিয়াম ও’ফ্লিন। ঘুমপাড়ানি গান গাইতে থাকেন নেইল মার্টিন। পল মুলডুন বললেন, বিশ্বখ্যাত সিমাস হিনি নিজেকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। তাঁর সান্নিধ্যে সকলেই অনুভব করেছেন, যেন তারা তাঁর সঙ্গে একই সূত্রে বাঁধা। শুধু তাঁর সঙ্গেই নয়, তাঁর কারণেই উপস্থিত সকলেরই প্রত্যেকের সঙ্গে।

সিমাস হিনির মৃত্যু অনেকের কাছে একটি মহাবৃক্ষের পতনের মতো মনে হয়েছে।

সিমাস হিনি বচন

* তোমার কাছে যদি শব্দ থাকে, তাহলে সবসময়ের এটাই সম্ভাবনা – তুমি পথ খুঁজে পাবে।

* তোমার কাছে আছে ঝুঁকি আর সত্য আর তোমার সামনে পৃথিবী।

* লেখার আনন্দের জন্য লেখাটাই আসল কথা।

* আমি নিজেকে ছন্দ শোনাই, যেন অন্ধকার প্রতিধ্বনি করতে থাকে।

* আমার মনে হয় আমি বলছি, স্পর্ধা আসলে একটি কাব্যিক কাজের অংশ।

* আমি গৌরব লাভ করব কিংবা আমার মৃত্যু হবে।

* তোমার শ্রেষ্ঠ বিচারবোধের ওপর ভরসা করে বাতাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারো।